যে ছড়া মনের মাঝে গেঁথে যায় তাই প্রকৃত ছড়া: জুলফিকার শাহাদাৎ এর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jul 4, 2012 6:51:46 AM

দুপুর মিত্র: সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ছড়া আসলে হারিয়ে যাবে। আপনার কি এরকম মনে হয়?

জুলফিকার শাহাদাৎ: এ ধরনের শঙ্কা হঠাৎ কেন আপনার মনে এলো সে প্রশ্ন আগে আমি আপনাকে করতে চাই।তার আগে আপনার ভেতরে ছোটবেলা থেকে কী কী পরিবর্তন ঘটছে তা লক্ষ্য করুন। তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে মনে হয়?

        শিশুবেলা থেকে বেড়ে উঠে আজ এই বয়সে এসেও ছোটবেলায় পড়া ‘আয়,আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা’ আপনার মন থেকে হারিয়ে গেছে?কিংবা ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে’এ ধরনের ছড়ার অস্তিত্বে কি কোনো আশংকা সৃষ্টি হয়েছে?সময়ের পরিবর্তনের সাথে-সাথে ছড়ার আবেদন শেষ হয়ে যাবে এ কথা সঠিক নয়।

        ছড়া কখনও হারাবে না।কারণ ছড়া একধরনের শ্রুতিসাহিত্য। যা মুখে-মুখে ছড়ায়।কথায় কথায় ছড়ায়। যদি সেটা প্রকৃত ছড়া হয়।একটি শিল্পগুণ সমৃদ্ধ ছড়া টং টং বাজবে। এ বাজনার সুর বার বার শুনতে ইচ্ছে হবে। শুনতে শুনতে তা মনের মাঝে গেঁথে যাবে। যে ছড়া মনের অলক্ষেই মনের মাঝে গেঁথে যায় তাই প্রকৃত ছড়া। বাকিসব অছড়া বা পদ্য। শ্লোগানও বলতে পারেন। অথবা সমিল বাগাড়ম্বর।

দু: ছড়াকে শিশুসাহিত্য হিসেবেই কি আপনি মেনে নিতে চান? চাইলে কেন? না চাইলে কেন নয়?

জুলফিকার শাহাদাৎ:  প্রশ্নটা একটু জটিল। এর ব্যাখ্যাও দীর্ঘ।এ স্বল্প পরিসরে ছড়ার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না। প্রথমতঃ ছড়া সবতোষ।এই সবতোষ ছড়ারও রয়েছে নানা বৈশিষ্ট্য। কিছু কিছু ছড়া একসঙ্গে বহুবৈশিষ্ট ধারণ করে।বলতে পারেন একের ভেতর একাধিক স্বর। ছড়া যখন রূপক নির্ভর হয়,বা গল্পপ্রধান হয় তখন এখানে একসাথে একাধিক বিষয়ের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব ।আর ছড়া যখন শুধুই বক্তব্যনির্ভর হয় তখন এটি হয়ে উঠে একতরফা ভাষণ। এবার এই আলোচনার আলোকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি,ছড়া কিভাবে শিশুতোষ বা সবতোষ হয়ে উঠে।

        ছড়া শুধু শিশুতোষ নয়,এর আড়ালে থাকে বড়দের খোরাক। এ খোরাক সবাই দিতে পারে না। একমাত্র প্রতিভাবান ছড়াকারের পক্ষেই তা দেয়া সম্ভব।আপনি আবদার রশীদের ছড়া পড়লে এ সত্যতা ভালভাবে উপলদ্ধি করতে পারবেন। লোকজ ছড়ার মধ্যেও এর অজস্র উদাহরণ রয়েছে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমণির ছড়া’ সংকলন পাঠে বোঝা যায় ছড়া যতটুকু না শিশুতোষ,তার’চে বেশি সবতোষ। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি,আমরা লোকজ ছড়ার চেয়ে অধিকতর দুর্বল ছড়ার চর্চা করছি বর্তমানে। যা বড়ই হতাশাব্যঞ্জক।

দু: ছড়ার আবেদন ক্ষনস্থায়ী। আপনি কি একমত? হলে কেন না হলে কেন নয়?

জুলফিকার শাহাদাৎঃ আপনার এ প্রশ্নের কিছু উত্তর উপরে দিয়েছি।সব ছড়াত আর কালজয়ী হবে না। আর বাংলাসাহিত্যে দির্ঘস্থায়ী সাহিত্যপাঠ কয়টি সে ব্যাপারে ছড়াকাররাও প্রশ্ন তুলতে পারে।গত একশো বছরে রচিত কয়টি বাংলা কবিতা সুধিপাঠক মনে রেখেছে? মনে রেখেছে কয়টি কথা সাহিত্য?

        আমার মনে হয় এ সংখ্যা ছড়ার চেয়ে কম হবে। আপনি এখনি দু চারটা ছড়া হয়তো আমাকে মুখস্ত শোনাতে পারবেন। কিন্তু কবিতা? বোধ হয় ততটা নয়। এভাবে ছড়া এগুচ্ছে।সাহিত্যের এ শাখা একেবারে স্থিতিশীল তা নয়। ছড়া গতিশীল সাহিত্য। ছড়ার আবেদন মোটেও ক্ষনস্থায়ী নয়। যে ছড়ার আবেদন ক্ষনস্থায়ী সেটা প্রকৃত ছড়া নয়। সেটা কী তা আগে বলেছি।ছড়া ছড়িয়ে যায় দ্রুত।এর আবেদন এতো কম হলে ছড়া এত দীর্ঘকাল টিকত না। ছড়ার শেকড় আছে।শক্ত শেকড়। যা উপড়ানো সম্ভব না। ছড়ার আবেদন চিরন্তন।

রাজনৈতিক ছড়াচর্চা অনেকটাই কমে গেছে বা বলতে গেলে নেই। এর কারণ কি? অনেকেই এই ছড়াকে সাময়িক বা ক্ষণস্থায়ী বলে থাকেন। আপনারও কি তাই মনে হয়? হলে কেন না হলে কেন নয়?

       

জুলফিকার শাহাদাৎ:  রাজনৈতিক ছড়া চর্চা কমে গেছে এ কথা আমি আংশিক স্বীকার করে নিয়েও বলছি,এ ধরনের ছড়া একেবারে কম লেখা হচ্ছে তাও না। হয়তো প্রচার কম। আমাদের গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারি সরকার তালিয়া পছন্দ করে,পাকাতাল পছন্দ করে না। কারণ তাল পড়ে মাথা ভাঙতে পারে।আমাদের মিডিয়াকর্মীদের কী অবস্থা এখন? তারা কি নিরাপদ? হত্যা,গুম এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।কে কখন হাওয়া হয় তার ঠিক নেই। এর ভেতরও রাজনৈতিক ছড়া লেখা হচ্ছে। ছড়ার শক্তি প্রচণ্ড। আপনি ছড়া বিষয়ক লিটল ম্যাগে এ ধরনের ছড়ার অস্তিত্ব লক্ষ্য করবেন।দৈনিক পত্রিকা রাজনৈতিক ছড়া ধারণে অক্ষম। দন্ত ও বিষমুক্ত ছড়া আমাদের জাতিয় দৈনিক সমূহের বড় পছন্দ। তাদেরও দোষ দিয়ে লাভ কী? ওদের ঘাড়ে তো আর দুটি মাথা নেই। তাই আমাদের রাজনৈতিক ছড়ার বিকাশ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত।

        আবার রাজনৈতিক ছড়া ও শ্লোগান দুটি দু জিনিস।শ্লোগান এক ধরনের বাগাড়।যেখানে রূপক বা প্রতীকের উপস্থিতি গৌণ।বক্তব্যপ্রধান ছড়ার স্থায়ীত্ব বা অস্থায়ীত্ব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি আগে চাই ছড়ার প্রাণ।কেউ কেউ ছড়ায় অন্ত্যঃমিলের মোহে নানা ধরনের শব্দের বিয়ে দেয়। আমি এতে কোনো কৃতিত্ব দেখি না। আমাদের জনপ্রিয় কোন ছড়াতে এ ধরনের মিলমোহ আমি দেখিনি।তাই একটি প্রকৃত ছড়ার প্রাণ কৈ মাছের মত। সহজে এটি মন থেকে মরবে না।

অন্নদাশংকর রায় এর মতে, ছড়া লেখার উপকরণ আসে সমসাময়িক ঘটনা বা পরিস্থিতি থেকে। আপনিও কি এরকম মনে করেন? বা এর ফলে ছড়া তার বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলছে- এরকম মনে হয় কি?

দু: অন্নদাশংকর রায় এর মতে, ছড়া লেখার উপকরণ আসে সমসাময়িক ঘটনা বা পরিস্থিতি থেকে। আপনিও কি এরকম মনে করেন? বা এর ফলে ছড়া তার বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলছে- এরকম মনে হয় কি?

জুলফিকার শাহাদাৎ: মূলত ছড়ার জন্ম হয়েছে সমসাময়িক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আমাদের এ উপমহাদেশ ছিল দীর্ঘদিন মোগল,ইংরেজ শাসনের যাঁতাকলে।তাঁদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ক্ষোভ ছিল। এ ক্ষোভের কথা তারা বলছে ছড়ায়।রূপকথায়। পাত্র পাত্রীর নাম না নিয়ে তারা তাদের মনের কথা বলেছে ছড়ার আশ্রয়ে। এ মনের কথা যেহেতু রূপক বা প্রতীক নির্ভর ছিল তাই তা সবার পাঠ ছিল। বড় ছোট সকলেই তা পড়তে পারতো। যেহেতু তখনকার শাসকের প্রতি তাদের ভয় ছিল তাই তাড়া এক ধরনের আড়াল ভাষায় তাদের প্রতিবাদ জানাত।

        ধীরে ধীরে ছড়া বহুমুখি হয়ে উঠে। বাচ্চাদের বিনোদন,সমাজ সংস্কার,নীতিকথা,উপদেশ ইত্যাদি ছড়ার বিষয় হয়ে উঠে।ছড়ার আবেদন দিন দিন বাড়তে থাকে। যেহেতু ছড়ায় ছন্দটা মুখ্য তাই এতে সুর থাকে। এ সুরের কারণে ছড়া দ্রুত মুখস্ত হয়ে যায়। বাচ্চারা ছড়া শুনে মজা পায়। তাদের কৌতূহল বাড়ে।নানা বৈচিত্রের ছড়া লেখা হতে থাকে।

        না, ছড়া এ কারণে বৈচিত্র হারাচ্ছে না। বরং ছড়া দিন দিন আধুনিক হয়ে উঠছে। দুঃখের বিষয় আমরা আধুনিকতা আত্মস্থ করতে পারছি না। তাই ছড়া বা ছড়াকার নিয়ে এতো প্রশ্ন।

দু: ছড়া তার প্রয়োজনের খাতিরেই হাল্কা হয়। কিন্তু ছড়াকাররা একে এতটাই হাল্কা করে ফেলেন যে ছড়া কোনও গুরুত্বই বহন করে না। আপনি কি একমত? হলে কেন ? না হলে কেন নয়?

জুলফিকার শাহাদাৎ:  এ প্রশ্নের উত্তর আমি উপরে দিয়েছি। এ নিয়ে আমি আর বেশি বলতে চাই না।ছড়া তার নিজ গুণেই গুরুত্ব বহন করে।অছড়া তার নিজের অযোগ্যতায় ঝরে যায়।তাই আমাদের উচিৎ প্রকৃত ছড়া চেনা এবং এ ধরনের ছড়ার কদর করা।