দুঃখজনক যে বাম চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ অনেক তরুণ রাজনৈতিক কর্মীর ভেতরে সাহিত্য বিষয়ে এখনও অনেক ক্লিশে ধারনা রয়ে গেছে: শাহাদুজ্জামানের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jul 4, 2012 6:27:37 AM

ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস

শাহাদুজ্জামানের গল্প, অগল্প, না-গল্প সংগ্রহ

চিরকুট

একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়

ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন

কেশের আড়ে পাহাড়

কথা পরম্পরা : গৃহীত ও ভাষান্তরিত সাক্ষাৎকার

ক্রাচের কর্নেল (বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত)

পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ

কয়েকটি বিহ্বল গল্প

ভাবনা ভাষান্তর

চ্যাপলিন আজো চমৎকার

লেখালেখি

বায়োস্কোপ চলচ্চিত্র প্রভৃতি

দুপুর মিত্র: আমি একজন বামপন্থীর কথা জানি, যিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কাছ থেকে আপনি ভালো লেখেন শুনে পড়তে আগ্রহী হয়েছিলেন বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলাদেশ লেখক শিবিরে ছিলেন বলে সেই বামপন্থী তার মত করেই ভেবেছেন। পরবর্তীতে আপনি ব্র্যাকে যোগদান করার পর উনি ক্ষেপে গিয়ে ‘মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়ার‘ প্রশংসা করলেও ‘:তে দুঃখ‘ বইটিকে বলেছেন দুঃখ ব্যবসায়ী। সাহিত্যে মার্ক্সীয় প্রোপাগান্ডা বিষয়টা অনেক আগে থেকে থাকলেও এখনও পর্যন্ত যে এই প্রোপাগান্ডিষ্ট মার্ক্সীয় আচরণ শেষ হয়ে যায়নি বা সাহিত্যে এক ধরনের বল প্রয়োগ বা ব্যক্তি বা পার্টির পছন্দ অপছন্দ লেখকের ওপর বর্তানো- এসব আপনি কিভাবে দেখছেন?

শাহাদুজ্জামান: লেখা যখন ছাপা হয়ে যায় তখন সেটা পাঠকের সম্পত্তি। যে যার মত করে সে লেখা পাঠ করতে পারেন। একজন বিশেষ পাঠক আমার লেখা কিভাবে পাঠ করেছেন সে নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। বরং বামপন্থী রাজনৈতিক দলের শিল্প সাহিত্য ভাবনা নিয়ে কিছু কথা বলা যায়। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে শিল্প সাহিত্যের পঠন পাঠন যদি কোন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার মধ্যে থেকে থাকে তাহলে তা মূলত বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোরই ছিলো। কিন্তু সমস্যা হয় যে মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী অনেক রাজনৈতিক নেতা,কর্মীদের জীবনকে একরৈখিকভাবে দেখার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। উদ্বৃত্ত মূল্যের রহস্য খানিকটা বুঝতে পেরে তাদের অনেকের ধারনা হয় যে জীবনের যাবতীয় রহস্য তারা তাদের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছেন। সাহিত্যের কাছে তাদের দাবীও হয় তখন খুব সরল। যেমন দুঃখ নয় সাহিত্য হবে লড়াই, ক্রোধ, শ্রেণী ঘৃণা ইত্যাদি বিষয়ে। একসময় ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ‘ নামে একধরনের যান্ত্রিক,তরল সাহিত্য চর্চা হয়েছে। সাহিত্যের কাছে বামপন্থীদের এধরনের দাবী নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তো বটেই বাংলা সাহিত্যেও প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। যে সব প্রতিভাবান শিল্পী সাহিত্যিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে কোন বামপন্থী পার্টি ভুক্ত হবার চেষ্টা করেছেন তাদের প্রায়শই পার্টির সাহিত্য বিষয়ক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ঘেরাটোপে পড়ে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তার ‘মার্ক্সবাদী সাহিত্য বিতর্ক‘ বইটিতে তার চমৎকার ডকুমেন্টেশন করেছেন। রুশ চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কির সৃজনশীলতাকে রুশ কম্যুনিস্ট পার্টি কতভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিলো তার নিদর্শন আছে তার ডায়েরিতে। কম্যুনিস্ট পার্টি যখন সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন কি পরিস্থিতি হয় তা নিয়ে নানারকম কৌতুক আছে চেক লেখক মিলান কুন্ডেরার লেখায়। তবে মার্ক্সবাদী সাহিত্য ভাবনা তারপর অনেক পথ পেরিয়েছে, অনেক বিবর্তন ঘটেছে সেখানে। জীবনের জটিল জঙ্গমতা নিয়েই যে শিল্পসাহিত্যের কাজ এবং সেখানে যে কোন রকম জবরদস্তির চলে না এনিয়ে আর বিতর্কের অবকাশ নেই। আমাদের দেশে মার্ক্সীয় চিন্তায় উদ্বুদ্ধ পার্টি নিরপেক্ষ প্রজ্ঞাবান কিছু মানুষ থাকলেও দুঃখজনক যে বাম চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ অনেক তরুণ রাজনৈতিক কর্মীর ভেতরে সাহিত্য বিষয়ে এখনও অনেক ক্লিশে ধারনা রয়ে গেছে দেখতে পাই। শিল্পসাহিত্যের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও রাজনৈতিকভাবে যে বাম দলগুলো এদেশে কোন শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি তার একটি প্রধান কারণ চিন্তার ঐ বন্ধ্যাত্ব।

দুপুর মিত্র: আপনার ক্রাচের কর্নেল বইটি নিয়ে অনেকেরই অভিযোগ লেখাটি ইতিহাস নির্ভর হওয়ার পরও আপনি ইতিহাসকে নতুনভাবে নির্মাণ করতে চাননি বা প্রচলিত ইতিহাসের মধ্যেই আপনি থেকে গেছেন। যে ইতিহাস অনেকের মতে নিপীড়কের ইতিহাস, নিপীড়িতের নয়। এই জায়গাটি আপনি কিভাবে দেখছেন?

শাহাদুজ্জামান: ক্রাচের কর্নেল বইটি নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। কেউ কেউ দ্বন্দ্বে পড়েছেন বইটি উপন্যাস, নাকি ইতিহাস না গবেষনাগ্রন্থ এই নিয়ে। তবে আপনি যে অভিযোগের কথা বললেন সেটা আমার কাছে নতুন। প্রচলিত ইতিহাস বলতে আপনি কোন ইতিহাসকে বোঝাচ্ছেন তা আমার কাছে স্পষ্ট না। বাংলাদেশের প্রচলিত ইতিহাস কোনটা? বাংলাদেশের ইতিহাসের তো নানা ভার্সন আছে। ইতিহাস নিয়ে যে পরিমাণ বিকৃতি, টানা হ্যাচড়া বাংলাদেশে হয়েছে তার নজির পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। কর্নেল তাহেরের জীবনের উপর ভিত্তি করে আমি ক্রাচের কর্নেল বইটি লিখেছি। বাংলাদেশের কোন প্রচলিত, আনুষ্ঠানিক ইতিহাসে কর্নেল তাহের অন্তর্ভুক্ত আছেন বলে আমার জানা নেই। ফলে আমি কিভাবে প্রচলিত ইতিহাসের মধ্যেই থেকে গেলাম সেটি বুঝতে পাচ্ছি না। বরং ৭ই নভেম্বর কেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় বয়ানকে আমি এই বইয়ে চ্যালেঞ্জ করেছি বলেই মনে করি। আর নিপীড়িতের ইতিহাস এই বইটার সাথে কিভাবে প্রাসঙ্গিক বুঝতে পারছি না। আমি এই বইটিতে নিম্নবর্গের ইতিহাস লিখতে বসিনি। কর্নেল তাহের ব্যাক্তিগতভাবে নিপীড়িত কোন মানুষ ছিলেন না, তিনি বরং ছিলেন নিপীড়িতের পক্ষের একজন মানুষ। তার জীবনের উপর ভিত্তি করে লেখা একটি বই কি করে নিপীড়কের ইতিহাস হয় আমার কাছে সেটা বোধগম্য না।

দুপুর মিত্র: আপনি যেহেতু মেডিকেল এনথ্রোপলজি নিয়ে কাজ করেছেন, ‘একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়‘ এরকম চমৎকার একটি বই উপহার দিয়েছেন, আপনাকে একটি প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারছি না। ঔপনিবেশিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে আমরা যে চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলছি বা নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে এগুতে চাচ্ছি, অনেকটা এনজিও এর মাধ্যমে, এটা কি আরেকটি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বা নয়া ঔপনিবেশিক চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াবে কিনা? হলে তাতে কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে। না হলে কেন দাঁড়াবে না?

শাহাদুজ্জামান: ঐতিহাসিকভাবে আমাদের এই অঞ্চলে মূল দুটি প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু ছিলো, আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানি। এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এ অঞ্চলে আসে দুই পথে। এক খ্রিষ্টান মিশনারিদের হাত ধরে, দুই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের মাধ্যমে। দু' দলই চিকিৎসাকে ব্যবহার করেছে তাদের নিজেদের স্বার্থে। মিশনারিরা চিকিৎসা করেছে মানুষকে ধর্মান্তরিত করবার লক্ষ নিয়ে আর ঔপনিবেশিক শাসকরা হাসপাতাল বানিয়েছে এখানকার শ্রম বাজারকে সুস্থ রাখতে। ফলে ঔপনিবেশিক চিকিৎসা ব্যবস্থা কয়েকশ বছর আগেই এ অঞ্চলে এসেছে। ক্রমশ সেই চিকিৎসা ব্যবস্থা এ অঞ্চলের মূল ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থাতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এনজিওরা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই গ্রামে গঞ্জে প্রসারিত করছে মাত্র। এনজিও ধারনাটি নিয়ে পৃথক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু এনজিওরা নতুন কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেনি। সমস্যাটি ঔপনিবেশিক এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা কিম্বা এনজিওর মাধ্যমে সেই সেবা দেয়া নয়। রাষ্ট্র যখন চিকিৎসাকে ব্যক্তি মালিকানায় রেখে মুনাফা অর্জনের একটা উপায় হিসাবে চর্চা করার সুযোগ তৈরি করে সমস্যাটা সেখানেই, ক্ষতিটাও সেখানে। তবে এলোপ্যাথি চিকিৎসা দেশে যেরকম পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছে তাতে আমাদের এ অঞ্চলের সনাতন ঐতিহ্যের আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানি চিকিৎসা কোন ঠাসা হয়ে আছে, নয়তো হাতুড়েদের হাতে চর্চা হচ্ছে। ভারতে কিন্তু সেরকম অবস্থা নেই। সেখানে আয়ুর্বেদ এলোপ্যাথির মত সমান মর্যাদায় চর্চা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে। ভিয়েতনামে দেখেছি সরকারী হাসপাতালে একই সঙ্গে এলোপ্যাথি এবং সনাতন চিকিৎসা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসকরা যে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো তার ভালো দিকগুলো কি করে আমাদের সাধারণ মানুষের উপযোগী করে তোলা যায়, পাশাপাশি আমাদের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাকেও কি করে যুগোপযোগী করে তোলা যায় সেসবই আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রধান চ্যালেঞ্জ।

দুপুর মিত্র: ‘কথা পরস্পরা: গৃহীত ও ভাষান্তরিত সাক্ষাৎকার‘ নামক আপনার একটি বই আছে। এখানে আপনি এস এম সুলতান, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আপনার নির্বাচন থেকে মনে হয় আপনি হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে বিশেষভাবে দেখেন। এই দুই কথা সাহিত্যিককে আপনি প্রতিযোগীও কি মনে করেন? এই দুই সাহিত্যিক সম্পর্কে আপনার কাছ থেকেই কিছু জানতে চাই। বাংলা সাহিত্যে তাদের গুরুত্বটা কোথায়?

শাহাদুজ্জামান: বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রেক্ষিতে আমি অবশ্যই হাসান আজিজুল হক এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে বিশেষভাবে দেখি। বাংলা সাহিত্যে তাদের গুরুত্ব কোথায় সেটা সাক্ষাৎকারের এই পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। এদের দুজন সম্পর্কে পৃথক নিবন্ধে আমি আমার ভাবনার কথা লিখেছি যা আমার ‘লেখালেখি‘ বইটাতে অন্তর্ভুক্ত আছে। আমার সে লেখাগুলো পড়ে দেখতে অনুরোধ করবো। সাহিত্যে আমি কাল ঘনিষ্ঠতা, সমাজ ঘনিষ্ঠতা খুঁজি, ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বের জটিল আলোছায়া খুঁজি, খুঁজি ভাষার মায়াও। পৃথক ভঙ্গীতে সেসব আমি খুঁজে পাই এদের দুজনের লেখায়। সাহিত্য প্রতিযোগিতার ব্যাপার নয়। এরা একে অন্যের প্রতিযোগী ছিলেন না। যার যার নিজস্বতা নিয়ে তারা সাহিত্য চর্চা করেছেন। পরস্পরের ব্যাপারে অসম্ভব শ্রদ্ধা ছিলো তাদের। তারা একে অন্যের উপর লিখেছেন। তাদের দুজনের সাথে একত্রে বসে আলাপের অসাধারণ সব স্মৃতি আছে আমার।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখা পড়লে প্রথমেই মনে হয় টেকনিকের দিক দিয়ে আপনি বিশেষ কিছু করতে চান বা করেন। বিশেষ করে আপনার ‘গল্প, অগল্প, না গল্প সংগ্রহ‘ আমাকে ভাবিয়েছে যে আপনি ভাঙ্গার চেষ্টাও করেছেন। ভাষার ক্ষেত্রে একটা আরোপের চেষ্টা চলছে অনেকের লেখায় , কিন্তু একেবারে আঙ্গিকগতভাবে কোন কিছু পাল্টানোর চেষ্টা করা হয়নি। আপনার কি এরকম মনে হয়?

শাহাদুজ্জামান: হ্যাঁ, গল্পটা কিভাবে বলা হচ্ছে সে ব্যাপারটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একটা বিষয় বা কাহিনীসূত্রকে কিভাবে উপস্থাপন করবো সে ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবি। গল্পের প্রাণকে বিঘ্নিত না করে চেষ্টা করি গল্পের আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা করতে। আদি মধ্য অন্ত মিলিয়ে একটা নিটোল গল্প লেখার চর্চা আমাদের সাহিত্যে হয়েছে বহুকাল। আমি অনেক ক্ষেত্রেই সেটা ভাঙবার চেষ্টা করেছি। আমি চেষ্টা করেছি অনেক সময় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে। সাহিত্য ছাড়াও নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ইত্যাদি মাধ্যমেও আমার সক্রিয় আগ্রহ আছে ফলে ঐসব মাধ্যমের নানা উপাদানও আমার গল্পে এসেছে। ন্যারেশন ভাঙ্গার অনুপ্রেরণা পেয়েছি ব্রেখটের নাটক থেকে, গদারের চলচ্চিত্র থেকে। তবে নিরীক্ষার নামে ভাষা এবং আঙ্গিকের ইঞ্জিনিয়ারিং করার প্রবণতা থেকে দুরে থাকার চেষ্টা করেছি। আমাদের লোক গল্প বা রূপকথার ন্যারেশনের সারল্যও আমাকে টানে। এইসব নানা ধারার সংশ্লেষ হয়তো আমার গল্পে আছে। বাংলা সাহিত্যে নিরীক্ষার প্রবণতা সীমিত হলেও নেহাত কম না। রবীন্দ্রনাথও গল্পের আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। কমলকুমার ভাষা নিয়ে অসাধারণ নিরীক্ষা করেছেন। পরবর্তীকালে সুবিমল মিশ্র প্রমুখরা আঙ্গিক নিয়ে নানা পরীক্ষা করেছেন। সেগুলো সব সফল না হলেও সেই চেষ্টার ভেতর মেধা ছিলো। তবে মোটা দাগে বলা যায় বাংলা কবিতার আঙ্গিক যেমন ব্যাপকভাবে পাল্টেছে বাংলা গল্পের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি।

দুপুর মিত্র: নিজের পছন্দ অপছন্দের জায়গাগুলো বলুন প্লিজ। আপনি কোন ধরনের ভাষাকে বেশী পছন্দ করেন, কোন ধরনের গল্প বা কথা সাহিত্যের কোন বিষয়গুলো আপনাকে বেশী ভাবায় বা কোন বিষয়গুলো আপনার অভিজ্ঞতায় একেবারেই তিক্ততার।

শাহাদুজ্জামান: জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘আঁধার দেখেছি, আছে আরো বড় অন্ধকার‘। সেসব লেখা পছন্দ করি যা সেসব অন্ধকারের উপর আলো ফেলে। যেসব লেখা পড়ে জীবনের কোন চোরাগোপ্তা জানালা খুলে যায়। সেই কথাসাহিত্যকে পছন্দ করি যেখানে মননশীলতার ছাপ আছে, যা আমার ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে। ইংরাজিতে ওরা যেটা বলে, ‘আউট অব দি বক্স‘ চিন্তা। আমার কাছে ভাষার কাজ শুধু কাহিনীকে টেনে নিয়ে যাওয়া নয় একটা যাদুর আবহও তৈরি করা। আশ্চর্য দ্রুততায় ভাঙ্গা গড়া চলছে আমাদের সময়ে, সমাজ জীবনে, ব্যক্তি জীবনে। কথাসাহিত্যে কি করে এই সময়কে ধরা যাবে সে ভাবনায় তাড়িত থাকি। ঠিক তিক্ততা নয় তবে সাহিত্য বলয়ে প্রায়শই একধরনের ঔদ্ধত্য, আত্মতৃপ্তি, বালখিল্যতা লক্ষ করি যা একাধারে বেদনা এবং কৌতুক জাগায়।

দুপুর মিত্র: অনেকেই বলেন ধরুন কারও গল্প নিয়ে, এই গল্পগুলো টানে না, টাচি না। এই বিষয়গুলো বা পাঠকের রুচি নিয়ে আপনার মন্তব্য কি? এক্ষেত্রে একজন কথা সাহিত্যিকের ভূমিকা কি?

শাহাদুজ্জামান: গল্প পাঠককে টানতে হবে। সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোন ধরনের গল্প কোন ধরনের পাঠককে টানবে সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। পাঠক তার রুচি অনুযায়ী লেখা খুঁজে নেবে। কিন্তু পাঠককে কোন গল্প টানবে কোনটা টানবে না সে ভাবনা মাথায় রেখে কোন ভালো লেখা তৈরি হয় বলে আমার জানা নেই। সাহিত্য নিভৃতে নিজের সঙ্গে বোঝা পড়ার বিষয়। সৎ, সত্য, মেধাবী লেখার সঙ্গে মেধাবী পাঠকের যোগাযোগ ঘটেই যায়। আত্মবিশ্বাসী কথাসাহিত্যিক পাঠকের রুচির কথা ভেবে লেখেন না।

দুপুর মিত্র: হুমায়ূন আহমদের জনপ্রিয়তাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

শাহাদুজ্জামান: তার পাঠক প্রিয়তা, ব্যক্তিজীবন ইত্যাদি মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সাহিত্যের একজন কৌতূহলোদ্দীক চরিত্র। অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পর্যায়ের লেখা নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, নিশিকাব্য ইত্যাদি মনোযোগের সঙ্গে পড়েছি, ভালো লেগেছে। পরবর্তীকালে পাঠক হিসেবে সাহিত্যের কাছে আমার প্রত্যাশার ধরনগুলো বদলেছে। যে ধরনের সাহিত্যকে আমি মর্যাদাবান বলে মনে করি তার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সে ধরনের মর্যাদাবান সাহিত্য জনপ্রিয় হতে পারে, নাও হতে পারে। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জনপ্রিয় কিন্তু তার অধিকাংশ লেখাতেই আমার প্রত্যাশিত সেই সাহিত্যিক মর্যাদা নেই।