প্রবন্ধ-নিবন্ধ

বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে জীবনবোধ

বীরেন মুখার্জী  

‘লেখকমাত্রই মেধাবী’ কথাটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে সাহিত্য বোদ্ধামহলে। তবে একজন লেখক যে প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। একজন বড় সাহিত্যিকের ‘টোটাল’ পরিচয় নিহিত থাকে তার সাহিত্যকর্মের ব্যাপ্তি ও বহুমুখীনতায়। বহুবিধ সংযোগ ও লিখন প্রতিভার গুণে একজন সৎ সাহিত্যিক নিজের জন্য পাঠক-বোদ্ধামহলে স্থায়ী আসন করে নিতে সম। এ ক্ষেত্রে লেখক তার চারিত অভিজ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটান তার সৃষ্টিকর্মে। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবেশ, প্রতিবেশ, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলী তাকে পরিমার্জিত শৈলীতে উপস্থাপন করতে হয় তার সাহিত্যে। যাপনের এমন কোনো বিষয়-আশয় নেই যা একজন সাহিত্যিক স্পর্শ করতে অম। যে কারণে সৎ সাহিত্যিকের হাতে রচিত সাহিত্যকর্ম যুগ যুগ ধরে পাঠক তার অন্তঃস্থলে ধরে রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, আপাতসরল দৃষ্টিতে সমাজ সম্পর্কে উদাসীন সাহিত্যিকের রচনাতেও গভীরভাবে উঠে আসে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অনুপুঙ্খ বাস্তবতা। এক্ষেত্রে সাহিত্যিক অনেকটা অজ্ঞাতসারেই তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সম হন। এরূপ রচনা পাঠে আলোচকরা প্রথমদিকে রচনাটির শিল্পমূল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও সেটির নিবিড় পাঠ ও পর্যালোচনায় আবিস্কৃত হয় অপরিমেয় শিল্পমূল্য এবং সমাজ মূল্য। এ ধরণের সাহিত্য পাঠে সাহিত্যিকের এক ধরণের নিরীক্ষাপ্রবণ মানসিকতার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে। উন্মেষ ঘটে লেখকের শ্রেণীসচেতনতার। লিখনীতে মানব-সংসারের বিচিত্রতা তেমনভাবে ফুটে ওঠেনি এমন অভিঘাতে জর্জরিত হতে হয় ‘পথের পাঁচালী’র অমর রূপকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাহলে প্রশ্ন জাগে- বিভূতিভূষণ কি শ্রেণীচেতন ছিলেন না? মানুষের জীবন-যাপনের প্রতিমুহূর্তের বিবর্তিত অবস্থা, সংঘাত জানতেন না তিনি? প্রকৃতার্থে বিভূতিভূষণ রচিত উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পের চরিত্র স্থান, কাল, পাত্র সমন্বয়িত হতে দেখা যায় সুষম বিন্যাসে। উপন্যাসিক হিসাবে বিভূতিভূষণের খ্যাতি বেশি হলেও তার গল্পগুলোতে আবেগঘন পরিস্থিতির প্রাধান্য থাকায় সমকালীন অনেক সমালোচক তার ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন। সমাজতন্ত্রবাদী লেখক ও সমালোচকরাও তাকে  এড়িয়ে গেছেন। অথচ তার ‘মেঘ মল্লার’ (১৯৩১), ‘মৌরীফুল’ (১৯৩২), ‘জন্ম ও মৃত্যু’ (১৯৩৮), ‘নবাগত’ (১৯৪৪) গ্রন্থের গল্পগুলো শ্রেণীচেতন বিভায় সমুজ্বল। বিভূতিভূষণের রচনাতে একদিকে যেমন ফুটে ওঠে শ্রেণী-বৈষম্য তেমনি রয়েছে নর-নারীর শ্বাশত রোমান্টিকতা। রয়েছে প্রকৃতি অবলোকনের অপূর্ব দর্শন। ইউরোপ-আমেরিকার নবজীবন-চেতনার প্রবাহ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের প্রবল হাওয়ায় তৎকালীন ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নাগরিক জীবনের আলোড়ন, আক্ষেপ, হতাশা নানামুখী বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার রচনাশৈলীতে স্পষ্টভাবেই মুদ্রিত।

বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে ইদ্রিয়বেদী অনুভূতিগুলি প্রযত্ন পরিচর্যায় বেড়ে উঠতে দেখা যায়। দৃশ্য, ঘ্রাণ, শ্র“তি, স্বাদ অনুভবভেদ্য প্রায় প্রতিটি উপযোগই তার লিখনীতে সঘন। এরপরও তৎকালীন প্রগতিবাদী সমালোচকরা তার প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। মূলত ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’ প্রকাশিত ‘প্রগতি’ পত্রিকায় বিভূতিভূষণের ‘সই’ গল্পটি প্রকাশিত হলে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠে। কারণ হিসাবে বলা হয়, প্রগতি ছিল ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন-আন্দোলনের প্রতিরোধী মঞ্চ। সেখানে বিভূতিভূষণের লেখায় কোনো ধরনের ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভূমিকা দেখা যায়নি। ‘সই’ গল্পটি লেখা হয়েছিল গ্রামীণ শৈশবে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের দু’টি মেয়ের বন্ধুত্বকে উপজীব্য করে। কালপরিক্রমণে বড় হবার পর দুই বান্ধবীর মধ্যে মধ্যবিত্ত মেয়েটি পায় সচ্ছল সংসার এবং দরিদ্র মেয়েটির ভাগ্যে জোটে কপর্দকহীন-সঞ্চয়হীন জীবন। একদিন সেই দরিদ্র মেয়েটি তার শীর্ণকায় শিশু পুত্রটিকে নিয়ে সইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। তার মনে আশা ছিল শৈশবের সই তার শিশু পুত্রটিকে দেখে হয়তো তাকে একটা মিষ্টি এনে দিবে কিংবা দুপুরে না খেয়ে ফিরতে দিবে না। কিন্তু তেমন কোনো ঘটনা ওই মেয়েটির ভাগ্যে ঘটে না। শিশুটির ভাগ্যে জোটে জলের সঙ্গে একটু গুড়; অথচ তার ছেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এলে মধ্যবিত্ত সইটি তার নিজের ছেলেকে ভাত খাইয়ে নিজে গিয়ে শুয়ে পড়ে। সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের ফলে শৈশবের স্বাভাবিক সম্পর্কটি এ গল্পে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। বিবর্তনের ধারায় সম্পর্কটি হয়ে উঠেছে অনুগ্রহদাত্রী আর অনুগ্রহ প্রার্থিনীর মধ্যেকার সম্পর্ক। গল্পটিতে মধ্যবিত্তের এই আচরণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও উদাসীনতা যে হৃদয়হীনতার নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায় সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়; যা আমরা ভুলে যাই। মানুষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও যে শ্রেণীগত পার্থক্যের বোধ গভীরভাবে নিহিত থাকে সেটিই লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন আশ্চর্য সমতায়।

‘কয়লাভাটা’ গল্পটিতে গল্প-কথক ‘আমি’ চরিত্রটি অংশীদারীর ভিত্তিতে কয়লাভাটার ঠিকাদারী নিয়েছিল। কিন্তু কুলি-মজুরদের কম মজুরি দেয়া হয় এজন্য তিনি ঝুড়ি প্রতি রেট প্রায় দ্বিগুণ করে দেয়। দেখা যায় হাতে পয়সা বেশি পেয়ে মজুররা নেশা করে পড়ে থাকে। ফলে রেট আবার কমিয়ে পূর্বের মত করা হয়। রেট বাড়লে তার মুনাফা কমে যাবে এটা জেনেও তিনি সেটা করেন। জানা যায় এটা তার অপর অংশীদারের কারসাজি। সে-ই কুলিদের নেশা করার টাকা দিয়েছিল। পূর্বের রেটে ফিরে গিয়ে কুলিরা সেই ‘আমি’ চরিত্রটি ঠকে গেছে বলে কৌতুক অনুভব করে। এ গল্পটিতেও সাম্যবাদের ছোঁয়া পাননি প্রগতিবাদীরা। গল্পটি মামুলি হলেও শিল্পী বিভূতিভূষণ সর্বহারা শ্রেণীর চেতনার জাগরণে সক্রিয় ছিলেন বলে ধরা পড়ে। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন বঞ্চিত শ্রেণী অনেক সময় নিজেদের অধিকার আদায়েও সচেতন নয়। যুগে যুগে পুঁজিবাদীরা তাদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বহারাদের ঠকাতে নানা কৌশল অবলম্বন করে, গল্পটিতে তারই বাস্তবতা বিবৃত হয়েছে। প্রশ্ন জাগে গল্পটি কি শ্রেণী চেতনতা সমর্থন করে না?

বিভূতিভূষণের কাছে কোনো নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধের কোনো বিচ্ছিন্ন অর্থ ছিল না, যদি না সেসব নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধ মানুষকে আশ্রয় দিতে না পারে। সুতরাং এ কথা বলা মোটেও অসঙ্গত নয় যে, গ্রামীণ জীবনের নীতিবোধ ও মূল্যবোধের রক্ষণশীলতা বিভূতভূষণ সমর্থন করেননি। তিনি শ্রেণী বিদ্বেষীও নন কিংবা ব্যক্তিগতভাবেও কাউকে ঘৃণার চোখে দেখেননি। যে কারণে তার অধিকাংশ ছোটগল্পই গ্রামীণ জীবনের শান্তি ও পারস্পরিক নিশ্চিন্ততা নিয়ে বেড়ে ওঠে। তিনি নিজে বলেছেন, ‘সাহিত্য আমাদের কল্পনা ও অনুভব-বৃত্তিকে উজ্জীবিত করে।... কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী যত কথা বলেন, তার মর্ম এই যে আমাদের ধরণী ভারী সুন্দর- একে বিচিত্র বললেই বা এর কতটুকু বোঝান হলো! আমাদের এ দৃষ্টিটি বারে বারে ঝাপসা হয়ে আসে, প্রকৃতির বাইরেকার কাঠামোটাকে দেখে আমরা বারে বারে তাকে ‘রিয়ালিটি’ বলে ভুল করি, জীবন-নদীতে অন্ধ গতানুগতিকতার শেওলাদাম জমে, তখন আর স্রোত চলে না; তাই তো কবিকে, রসস্রষ্টাকে আমাদের বারবার দরকারÑ শুকনো মিথ্যা-বাস্তবের পাঁক থেকে আমাদের উদ্ধার করতে।’

বিভূতিভূষণের সমকালীন অনেক লেখকই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞান নিয়ে যন্ত্রণাময় কাহিনী রচনা করছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম ধারার সাহিত্যকর্মী। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালি যখন পৃথিবীর নানান মতবাদ আর পরিবর্তনের দোলায় দুলছিল, ঠিক সেই সময়ে ঝাঁঝালো জীবনবোধের বেড়াজাল থেকে মানুষকে অনাড়ম্বর ঘরোয়া পরিবেশে টেনে আনতেই তিনি নিরলস শ্রম বিনিয়োগ করেছেন। ফলে চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সংরাগ আর দ্বান্দ্বিক সৌন্দর্য ও রসবোধকে সহজেই তিনি পাঠকের সামনে হাজির করেন। দেহজীবিনীদের নিয়ে রচিত ‘হিঙের কচুরি’ গল্পটি বিভূতিভূষণের বহুল পঠিত গল্পের একটি। শৈশবে নন্দরাম সেনের গলিতে মাখন-কুসুম-প্রভাদের ঘরে নিয়মিত যাতায়াত ছিলো গল্প কথকের। প্রাপ্ত বয়সে তার প্রতি সবচেয়ে বেশি স্নেহ পরায়ণ কুসুম এখন একটি মেসের পরিচারিকা। অথচ কুসুম তার বিগত পতিতা জীবনের জন্য কোনো ধরণের সঙ্কোচ বোধ করে না সেই আট বছরের ছেলেটিকে বন্ধু বেষ্টিত দেখে। কখনও গোপন করার চেষ্টা করেনি নিজের পরিচয়। উপরন্তু পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে কুসুম সেই কচুরি-লুব্ধ বালকটিকে হিঙের কচুরি এনে খাইয়ে তৃপ্ত বোধ করে। তার ‘বিপদ’ গল্পটিতেও বর্ণিত হয়েছে জীবন-জীবিকার কারণে পতিতার খাতায় নাম লেখানো একজন গ্রাম্য বালিকা হাজুর কথা। একদিন যে মেয়েটি ভিখারিণীর মতো অন্ন-বস্ত্রের চাহিদা মিটিয়েছে সে এখন নিজের ঘরে বসে গ্রামের চেনা লোকদের আত্মীয়জ্ঞানে আপ্যায়ন করে। অথচ ওই বালিকার পিতাও কোনোদিন শহরে বসবাস কিংবা কাপ-পিরিচে চা খাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারেনি। গল্প-কথক তার গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় হাজু তাকে ঘরে ডেকে এনে সোপার্জিত অর্থে চা খাওয়ায়। এ সময় তার চোখে মুখে পরম সাফল্য ফুটে ওঠে।   

বোধকরি জীবনের মূলধারাকেই বিভূতিভূষন তার রচনাকর্মের আধার হিসাবে বিবেচনা করেছেন। যে কারণে বিশ্বব্যাপী কার্ল মার্কসের বৈপ্লবিক সাম্যনীতি গ্রহণ-বর্জনের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েও নগরকে পাশ কাটিয়ে গ্রামকেই সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করেন। চরিত্র সৃষ্টিতে প্রাধান্য পায় গ্রামের খেটে খাওয়া, অবহেলিত সাধারণ মানুষ। কাহিনীতে ফুটে ওঠে আমাদের চেনা-জানা মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ। প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনাচরণের সজীব ও নিখুঁত চিত্র তার কথাশিল্পে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক ডামাডোলে বিভূতিভূষণের সৃষ্টিকর্মের মৌলিকত্ব সমকালীন আলোচকদের কাছে প্রশ্নশীল হলেও তার প্রখর জীবনবোধ ও শিল্পবোধ জারিত রচনাগুলো বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য স্বর্ণফসল। উত্তরকালে তার রচনার পাঠকপ্রিয়তা এটাই প্রমাণ করে যে, দূরাশ্রয়ী অন্তর্দৃষ্টির মিশেলে রচিত উপন্যাসের পাশাপাশি বিভূতিভূষণের ছোটগল্পগুলোও পাঠককে মহাকালাশ্রয়ী চৈতন্যে টেনে নিতে সক্ষম। আর এখানেই সৃষ্টির প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।


ভাষাচিন্তাঃ পোকায় কাটা কয়েকটা দাত ফেলে দিলেই দুখিনি বর্নমালার দাত ব্যাথা সেরে যাবে

চয়ন খায়রুল হাবিব

*সম্প্রতি অভ্র ইউনিকোড ফন্টের ডেভলাপার এবং চর্চাকারিদের  সাথে,  বিজয়-পন্য-সামগ্রির যে বিরোধ তাতে সঙ্গত কারনেই আমার অভ্র দলের দিকে পক্ষ্যপাত করা দরকার।আমি অভ্র ব্যবহার করি। আনফ্রেন্ডলি সফটওয়্যার হওয়াতে বিজয়, সোলায়মানি এসব কখনোই ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনি।

সখ্যতার সহজিয়ায় অভ্র ইউনিকোড, বিজয়-পন্য-সামগ্রি থেকে অনেক এগিয়ে থাকলেও; ভাষার পেছনে ভাব প্রকাশ'কে অর্গলমুক্ত করবার এবং আবার ভাষাকেই শ্রেনি শাষনের মুল হাতিয়ারে পরিনত করবার যে-কায়েমি প্রয়াস  সেই দার্শনিক বিরোধে; অভ্র এবং বিজয়ের দ্বন্দকে আমার শুধু skill বা প্রায়োগিক মনে হয়েছে; মনে হয়েছে সামগ্রিকভাবে  যে-জিঞ্জিরা কালচার চলছে তারই বিস্তার; এর পেছনে সনাতনের অচলায়তন ভাংবার কোন ইশারা এখনো পাই নি!

আমি লম্বা ঈকার, লম্বা ঊকার, চাদবিন্দু ব্যাবহার করতে চাই না।অভ্রে 'দাঁড়িয়ে' লিখতে গিয়ে, আমি নিজের ভঙ্গিতে দাড়িয়ে পড়ি এখনো;  জীবন লিখতে গিয়ে কবিতা-বাসরে শুরু করি নিজের ভঙ্গিতে জিবনযাপন! কেন জানি মনে হতে থাকে অভ্রের চিন্তাপধ্বতি প্রাতিষ্ঠানিক নিক্তি পাল্লার সেদিকেই ঝুকে পড়া যেদিকে বাংলাভাষাভাষি সমাজ ক্রমশই তলিয়ে যাচ্ছে আরো আরো সংস্কারের জগদ্দল আড়ালে!

ইংরেজি ভাষাতে যেরকম বিট প্রজন্মের গ্রেগরি কর্সো; আজকের বেঞ্জামিন জেফনায়ার মত  কবিরা প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য চর্চার বাইরে নিজেদের লালনের পরেও মুলধারাতে আদৃত হয়েছেন মেজর কবি হিশেবে পোয়েটিক লাইসেন্সের গুনে; সেই কাব্যিক সুষমার পত্তনি আমি বাংলা সফটয়্যার ডেভলপারদের মধ্যে দেখি না।বাংলাভাষা ঘিরে যে-প্রানের মেলা, সেখানে ফন্টের পর ফন্ট এলেও স্পেল চেকারের অভাবে প্রুফ রিডারে্রা হয়ে গেছে সে-প্রানস্পন্দনের সম্পাদক, প্রকাশক, ব্যাবস্থাপক!এই প্রুফ রিডার শ্রেনির ছড়ি ঘোরানোকেই আমরা মোটাদাগে মেনে নিচ্ছি পাষবিকতা ও পেলবতার সিমা-সরহদ্দ বলে!

কবিতার অন্তস্থ ভাবনাকে যে নির্মেদ, নিরলঙ্কার, সংস্কারবিহিনতার জায়গা থেকে দেখি; স্পেলচেকারের শুন্যতার সুজোগে উড়ে এসে জুড়ে বসা  অর্থনিতিবিদ থেকে অভিধান রচনাকারি বনে যাওয়া কলিম খানের অতি উতসাহি অনুসারিরা যখন আমার সেই coreকে আক্রমনের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলে; তখন বুঝি যে  লম্বা ঈকার, লম্বা ঊকার, চাদ বিন্দুর বিরুধ্বে আমার সংগ্রাম'টা অযথার্থ নয়।৮ বছর বয়সিদের গড়পরতা মেধার সমান মেধাবি একটা স্পেলচেকারই হাজারো কলিমের মামদোবাজি বন্ধের জন্য যথেস্ট।বাই ডিফল্ট খান সেনানিদের ছড়ি ঘোরানো,   আমার বানান ভাবনাকে একেবারেই বিড়ম্বিত করে নাঃ

কারন, আমার স্বরবর্ন ৮টা!ব্যাঞ্জনবর্নও একই অনুপাতে কম!

আমার লেখ্য বাংলা'কে আমি বলি লজবাং বা লজিকাল বাংলা!তবে দন্ত, মুর্ধা, তালব্যের উচ্চারনে আমি আপনাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম! চ্যালেঞ্জ করলাম প, ফ এর উচ্চারন নিয়েও! শোনা যাক কে কত নাকামি করতে পারে! আমি নাকামি পারিনা।নাকামি লিখিও না!চ্যালেঞ্জ নেবার আগে একটু ভাববেন! গোলাম মুর্শিদও এখনো shepherdকে শেপহার্ড না লিখে, লিখছেন শেফার্ড!একজন স্টেশান'কে বানিয়ে ফেলেছেন 'স্টেশণ', আর ডিক্রি জারি করছেন যে বিদেশি সব শব্দের বানানে 'ন' এর বদলে 'ণ' বসাতে হবে!নাক বা নরুন যে বিদেশি শব্দ না, তা আমরা নিশ্চিত হবো কিভাবে! একাডেমি না আকাদমি?ফৃ না ফ্রি?ওপরচালাকি না কি উপরচালাকি?

সবাই খেয়ে বাচুক!বাজে ঢেকুরের গন্ধ ভালো পান, জর্দাতে ঢাকা দিলেও তাতে পেটের ব্যামো সারে কি?বানান নিয়ে নানা পরামর্শগুলোর যেটুকু বুঝেছি, নন্দনের বিচ্চারে তা আমার কাছে গ্রহনযোগ্যও মনে হয়নি, দরকারিও বোধ হয় নি!তবে মনে হয় এ-নিয়ে অনেকের বানান-বিশ্বাস-কেন্দ্রিক-ধর্মবোধ আছে!থাকতেই পারে।তবে একই ধর্মের ভেতর য্যামন ভিন্ন ধরনের চর্চা থাকতে পারে, বাংলা ব্যাবহারকারিদের পখ্যে সেরকম কি বাংলার চর্চাতেও বিচিত্রতা মেনে নেয়া সম্ভব?

কে এক বরেন্য রাস্ট্রনেতা বলেছিলঃ In victory magnanimity:

চাকমা, গারো, সাওতাল, বিহারিদের কি বাংলাভাষাভাষি আমলাতন্রের ভাগিদার হতে বাংগালির চেয়েও ভালো বাংলা শিখতে হবে?৫২'র ভাষা আন্দোলনের একটা দিক য্যামন মাতৃভাষার স্বিকৃতি, তেমনি রাস্ট্রের চাপানো সিধ্বান্তের বিরোধিতা।ভাষা আন্দোলনের আধা শতাব্দি পর বিদেশি শব্দ খুজে বের করা, অনলাইনে 'বানান পাঠশালা' খোলা জয়ের গৌরবের বদলে, জয়-মদমত্ত- হিনমন্যতার পরিচায়ক।

যেখানে, বাংলাভাষি জনগোষ্ঠির চেয়ে অনেক, অনেক কম সংখ্যার এবং একটাও নোবেল পুরস্কার না পাওয়া ভাষাগুলোর প্রচুর 'স্পেলচেকার' সফটওয়্যার আছে, সেখানে দু, দুটো একাডেমি থাকা স্বত্ত্বেও কোনরকম ডাউনলোডেবল স্পেলচেকার না থাকা ঘড়ির কাটাকে ভামিয়ান ধ্বংশের জিরো আওয়ারে ফেরানোর সামিল।দ্রস্টব্য যে ব্রিটেনে বাচ্চাদের এখন আর বানানের ওপর মার্কিং করা হয়না।যা স্পেলচেকা্রের বাইনারি সিস্টেম করে দিচ্ছে, তা নিয়ে বাচ্চাদের প্রাথমিক মেধার অপচয় করতেও ব্রিটেন রাজি নয়।

প্রাইভেট শিক্ষকের কাধে ভর দিয়ে , ভালো 'বানান' শিখে-পড়ে, উচ্চবিত্তের বা মধ্যবিত্তের ছানাপোনারা যেভাবে ধেই ধেই করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল এবং তার ফলস্রুতিতে খমতাকাঠামোতে ওপরের সিড়িতে চলে যেতে পারে, শ্রমজিবি সাধারনের পখ্যে তা সম্ভব নয়।উচ্চারন ও বানান-বিকারের সিমা-সরহদ্দ ঘটিয়ে খমতাকাঠামোতে; বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঙ্গিতিনিকেতনে, চারুকলা ভবনে নন্দন উপভোগের অধিকারে যে শিব্যলেথ ঘটানো হচ্ছে তাও ৫২'র উত্তরাধিকার নয়।

ভাষাকে কায়েমি স্বার্থে ব্যাবহারের প্রবনতাই য্যামন একদিকে সাধারনের সাথে এনার্কিস্ট লেখক সাবদার সিদ্দিকি, মুস্তফা আনোয়ারদের পরিচয় করিয়ে দেয় না; সেই একই প্রবনতা থেকেই আবার ফানডামেন্টালিস্ট শিবিরগুলো এই এনার্কিস্ট লেখকদের হাইজ্যাক করে, যাতে করে মনমতো অপব্যাখ্যা করা যায়!একই কারনে ডগমাটিক রাস্ট্রকাঠামোগুলো এবং মৌলবাদি প্রতিষ্ঠানগুলো লোক সংস্কৃতির ব্যাপারেও হয়ে ওঠে অতি উতসাহি।সোভিয়েতের ইতিহাস দেখা যাক; পাস্তেরনাক'কে বলছে বুরজোয়া, সোলঝেনিতসিন'কে পাঠাচ্ছে গুলাগে, প্রচার করছে রুপকথা, উপকথা!কিন্তু এসব যে শুভংকরের ফাকি তা কিন্ত সোভিয়েতের শাষনাধিন প্রজাতন্ত্রগুলো বুঝে ফেলেছিল।ঐ প্রজাতন্ত্রগুলো চাপানো রুশ ভাষাও কখনো মেনে নেয় নাই।

বাংলা ভাষাতে মুখের বুলি আর লেখার রুপ, বিরুপের সমকালিন বিবর্তনগুলো দেখা যাক! ব্র্যাকেটের পোকায় কাটা লম্বা ঈকার, লম্বা ঊকার, ণ' এর বিকার না থাকলেও নিচে লেখা সত্যগুলোর হেরফের হত'নাঃ

ক. বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষ(ণ)… আঞ্চলিক, কথ্য, শুদ্ধ, অশুদ্ধ তর্কের উর্ধ্বে মিথে পরি(ণ)ত হয়।

খ. র(বী))ন্দ্রনাথ কি কোলকাতার ভাষায় লিখতেন? সন্দেহা(তী)ভাবে না। অন্যান্য কোলকাতাবাসির মত ঠাকুরবাড়ির লোকদেরও দন্ত্য স, তালব্য শ, মূর্ধন্য ষ উচ্চার(ণে) সমস্যা ছিল। কবিগুরুকেও নিজের সাহিত্য ভাষাকে কথ্যভাষার অকথ্য উচ্চারন(ণ) রিতি থেকে সরিয়ে অন্য আরেকটি মান তৈরি করতে হয়েছিল। মাইকেলও কোলকাতার ভাষায় না লিখে মিশনারি বাংলায় মহাকাব্য লিখতে ব্র(তী) হন। তবে র(বী)ন্দ্রভাষাই মানভাষা হিশেবে চালু হয়ে যায়।

গ. মুজতবা আ(লী) সিলেটের ভাষায় বা (জী)বনানন্দ বরিশালের ভাষায় লিখলে ওদের সাহিত্যের (কী)

পরি(ণ)তি হতো বলা মুশকিল।

ঘ. ২০০৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এক বন্ধুর বাসায় ঢাকা ও কোলকাতার কজন কবির সাথে পরিচয় হয়েছিল। বেশ ফাটাফাটি হাসাহাসির ভেতর কোলকাতার কবিদের নিজেদের কবিতার স, শ, ষ-গুলো উচ্চার(ণ) করতে বললে তিনজনই ফেল মারলেন।

ঙ. গোলাম মুরশিদ আক্ষেপ করছেন যে কোলকাতা কেন্দ্রিক স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ও ঢাকা কেন্দ্রিক স্ট্যান্ডার্ড বাংলার দূরত্ব তৈরি হলে আমরা ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হব। যে কেন্দ্রিকতা কখনো তৈরি হয়নি তাকে নিয়ে নস্টালজিয়া অর্থ(হী)ন। আরেকটি নতুন কেন্দ্রিকতা হবে ওয়েব-কেন্দ্রিকতা।

চ. কিশোরগঞ্জ থেকে আসা (নী)রদ চৌধু(রী) থেকে আজকের রিফাত চৌধু(রী), কাজল শাহনেওয়াজ, কফিল আহমেদ'দের গল্প, কবিতা, গানে কিশোরগঞ্জি সাহিত্যের যে বিবর্তন হয়েছে তা নিয়ে মজার লেখা হতে পারে।

শেষমেষ,আমাদের আগে বহু ভাষাই শুদ্ধতার যোয়ালে ধ্বংশ হয়েছে!শাষকের প্রবল সমর্থনেও সংস্কৃত, ল্যাটিন বা উর্দু টিকে নাই!ধন্যবাদ।

সুজিত সরকারের কবিতায় সমগ্রের ধারণা

জাহেদ সরওয়ার

প্রফেসর এডওয়ার্ড জোনস উরউইকের ধারণা ভারতীয় দর্শন দ্বারা সবচাইতে প্রভাবিত পশ্চিমি মহৎ বইটির নাম ‘রিপাবলিক’ হলেও মনে হয় উপনিষদের ‘সমগ্র’র ধারণা সবচাইতে আন্তরিক হেরাক্লিতসের লগোসের কনসেপ্টে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপনিষদের লগে পরিচিত হবার আগেই হেরাকিতাসের লগোসের লগে পরিচয় হয়ে যায় আমাদের। যাইহোক কেন্দ্রে যাবার পথ অভিন্ন। লগোস এমন এক সত্তার ধারণা যা সর্বভূতে বিদ্যমান। যা সবকিছুর কেন্দ্রে আবার সবকিছুকে কেন্দ্র করে থাকে। কোনো কিছুই লগোসের বাইরে না। বস্তুর ভেতর একই প্রাণ বিরাজিত এই প্রাণময় সত্তাই লগোস। অন্যদিকে উপনিষদের যে ব্রক্ষ্ম তাও প্রায় সমার্থ হলেও উপনিষদে সমগ্র’র ধারণা আরও ব্যাপক। ব্রম্ম থেকেই ব্রক্ষ্মাণ্ড আবার সবকিছুকে ঘিরেই ব্রক্ষ্ম। একই ব্রক্ষ্মের বহুরূপ বহু বিভক্তি আদিতে এক। যাকে আমি হত্যা করার কথা ভাবছি সেও আমি। উপনিষদ সম্পর্কে মহাত্মা শোপেনহাওয়ার যথার্থই বলেছিলেন-the production of the highest human wisdom. কিন্তু এই ধারণার দুর্বলতা এইখানেই যে যতক্ষণ পর্যন্তু না ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে সমধারণায় নিমজ্জিত করা না যাচ্ছে ততণ পর্যন্তু এই অবকাঠামো বাস্তবেক্ষেত্রে প্রয়োগ প্রায় অসম্ভব। আবার অন্যদিকে শক্তিশালী বুদ্ধিমান প্রাণি মানুষ যদি সামগ্রিকভাবে এই জিনিসটা নিতে পারে যাকে সে ঠকাবে, যাকে সে হত্যা করবে, যাকে সে ধর্ষণ করবে, যাকে লুণ্ঠন করবে ,যার লগে মিছা কথা কইবে, যার লগে প্রতারণা করবে, সে মূলত সে নিজেই। তখন হয়তো অন্য এক পৃথিবী হতেও পারতো। কিন্তু বস্তুপৃথিবীর চেহারা অন্যরকম। মানুষ কেন্দ্রচ্যুত হয়ে ধর্মীয়, জাতীয়, দার্শনিক, রাজনৈতিক গোত্রভিত্তিক নি:সঙ্গতায় জারিত হতে হতে এমন এক নিস্বতায় পর্যবসিত হয়েছে যে আত্মহত্যা ও হননচিন্তা ছাড়া অন্যকোনো উত্তরণের পথ আপাতত তার চর্মচরে সামনে খোলা নাই। এই সংকট যেমন ব্যক্তি জীবনে তেমনি মানুষের ভাব-জগতেও বিরাজিত। বিশ্বসাহিত্যে দুইটি ধারা দেখা যায় একপ আত্মহত্যাকারী ও তার বর্ণনাকারী অন্য প হত্যাকারী ও তার বর্ণনাকারী। উনিশ শতক ও রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলাসাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় এই দুইটি ঘরাণা সুস্পষ্ট। জীবনানন্দের মত দুর্বল অথচ মহৎ মানুষদের পথ হয়তো আসলে অবরুদ্ধ। ফলে একগোছা দড়ি হাতে একা একা আত্মহত্যা করতে যাওয়া বা লাশকাটা ঘরে শুয়ে জীবনকে নিমেষে ভুলে পরাজয়ের মর্ষ আনন্দ পাওয়া আর বিশ্বনিন্দার ঝড় বইয়ে দেওয়ার মধ্যে তার জীবন সার্থক হয়ে উঠে। জীবনানন্দের প্রায় কবিতার ভেতর দেখা যায় ইতিহাসের ভুলভ্রান্তিকে টেনে এনে মানুষের মিছা সমাজগঠনের জন্য হাহাকার। কিন্তু যে কোনো সময়ের মানুষকে তো গ্রহণ করলে তার বাস্তবতাসহ গ্রহণ করতে হবে।  এই অর্থহীন আত্মহননের নদীতে তিরিশি আধুনিকদের প্রায় সবাই সাঁতার  কেটেছে।  হতাশা আত্মহত্যা নিরাশা শূন্যতার পাকে জড়িয়ে সবাই প্রায় লাড্ডুর মতো ঘুরেছে। আবার কল্লোল বা চল্লিশি কবিতা ধনীদের ধন কেড়ে নিয়ে সমান করে দেবার প্রবণতা। দীনেশ দাস সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি। অনেকটা হননপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। কারণ অত্যাচারিদের ভেতর থেকে ন্যায় সম্পদ সমবণ্টনতো আর সহজ পথে আসবেনা। যদিও এছাড়া অন্যকোনো বিকল্প আপাতত পৃথিবীতে নাই। শোষিতের ধর্ষিতের দলিতের সচেতনতার জন্য বিষয়টা জরুরি হলেও কবিতার মতো স্পর্শকাতার শিল্পে এর আবেদন অত্যন্ত সীমিত। এখনো বাংলা কবিতা এর ভেতরই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এই পথে বেশিদূর যাওয়া অসম্ভব। কারণ কবিতায় এই পথ সীমাবদ্ধ রুদ্ধ।  এই রুদ্ধতার ভেতর অবুঝ শিশুর মতো নিরন্তর উত্তরণের পথ খুঁজে চলেছেন কবি সুজিত সরকার। সম্প্রতি তার কিছু কবিতা পড়ে সেরকমই ধারণা হল। তিনি বলেন,

পাহাড়চুড়োয় উঠে এসে দেখি/শুধু আমি আর অনেক আকাশ;

হাজার হাজার ফুট নিচে,সমতলে,/কলেজ, হোটেল,ব্যাঙ্ক মিলেমিশে সব একাকার;

সহসা বুঝতে পারি/ দুই নয়, তিন নয়-এক,শুধু এক। (এক-নির্বাচিত কবিতা-কবিতাপাকি জানুয়ারি-১৯৯৭ কলিকাতা)

এভাবেই সুজিত বীজ পুতেন কবিতায় সমগ্রের। সুজিত হোমারের জিউস আর অলিম্পাসের ধারণা থেকে গড়ে উঠা সেমেটিক সর্বনিয়ন্তাদের আকাশের বাসস্থান থেকে পরিচালিত মহাবিশ্বের ধারণার বাইরে গিয়ে নীচের দিকে তাকিয়েও উচ্চারণ করেন এক। এই এক একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নয়, সমগ্র অর্থাৎ জগতে প্রাণ আর বস্তু সামগ্রীকভাবে এক। এরপর শুরু হয়ে যায় তার প্রায়োগিক অনুসন্ধান।

সুজিত সরকারের কবিতার ভেতর থেকে দুইলাইন কোনো অর্থ বহন করেনা। সমগ্র কবিতা মিলেই একটা ধারণা পোক্ত হয় তাই উদাহরণ দিতে গেলেও পুরো কবিতাই পড়তে হয়।

মাটি থেকে উঠে আসে গোলাপ বকুল/ ফের মাটিতেই ফিরে যায়

মাটি থেকে উঠে আসে শিল্পীর প্রতিমা/ ফের মাটিতেই ফিরে যায়

মাটি থেকে উঠে আসে হরপ্পা নালন্দা/ ফের মাটিতেই ফিরে যায়

ঘাস মাড়িয়ে মাড়িয়ে পথ তৈরি হয়/ ফের একদিন ঘাসে ঢেকে যায় পথ

আজ মাঠ, কাল বাড়ি/ আজ বাড়ি, কাল ফের মাঠ

আকাশ-বাতাস মাটি জল আলো-অন্ধকার/শাশ্বত ভুবন

পশু-পাখি-পোকা-উদ্ভিদ-মানুষ লক্ষ কোটি প্রাণ/ -সব প্রাণ এক প্রাণ

‘কে তুমি?-কঠিনতম এই প্রশ্নে ব্যক্তি চিরদিন অসহায়

খণ্ড খণ্ড সব ‘আমি’ মিশে যায় মহাস্তব্ধতায় (মহাস্তব্ধতায়-ঐ)

মাণ্ডুক্য উপনিষদে আছে:

সর্বং হি এতৎ ব্রক্ষ্ম; অয়ম্ আত্মা ব্রক্ষ্ম; সঃ অয়ম্ আত্মা চতুষ্পাৎ

অর্থাৎ সমগ্র জগতই ব্রক্ষ্ম। এই জীবাত্মাও ব্রক্ষ্ম। আপাতদৃষ্টিতে এই আত্মার  চারটি অবস্থা।

যা কিছুর অস্তিত্ব আছে সবই ব্রক্ষ্ম। জীব ও জগৎ এক। ব্যষ্টি ও সমষ্টি এক ও অভিন্ন। যা এই দেহে তাই ঐ সূর্যে।  সেই একই আত্মা। এ কথা উপনিষদে বার বার বলা হয়েছে।

এই সামগ্রীকতার ধারণা থেকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে গিয়ে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে

এই পৃথিবীর আলো-অন্ধকার/ আমাকে শেখায়

ভাালোবেসে প্রতিদিন কীভাবে নিজেকে/ অশেষ অম্লান করে তোলা যায়।

নিজেকে সহজ করে আনি ধীরে ধীরে/ মানুষের কাছে প্রকৃতির কাছে

সম্পর্কের জটিলতা রাখিনা কোথাও-/ তবু, ভালোবেসে টের পাই, আমারই ভিতরে আছে

            সে এক রহস্যময় বিশাল পৃথিবী। (অশেষ-ঐ)

ফলে সুজিত সরকারের কবিতায় একীভূত হয়ে যায় প্রকৃতি। কারণ যে ব্রক্ষ্মকে ধারণ করতে পারে সে তো নিজেই প্রকৃতি। আর কিছুইতো তার কাছে অচেনা আর দুর্ভোধ্য মনে হতে পারে না। এখান থেকে সর্বপ্রাণবাদের ধারণা নিতে পারি আমরা। বাংলাকবিতার ‘মানুষ মূলত একা’র কনসেপ্ট এখানে খারিজ হয়ে যায়। মানুষ একা নয় সে সমগ্রের অংশ। এইটাই মূলরাস্তা। একা  কোনো প্রাণী বাঁচতে পারেনা। মানুষতো একেবারেই বাঁচবেনা। প্রত্যেক আত্মহত্যা তার স্মারকচিহ্ন। একা নি:সঙ্গতার নেতিবাচক বোধ থেকেই মানুষ আত্মহত্যা করে। অথচ এই নি:সঙ্গতারই ইতিবাচক ধারণা নিয়ে মানুষ সাধক হয়ে যায়। প্রত্যেক প্রফেটের পথ এটাই। এদেশে নব্বই দশকের কবিরা পর্যন্তু আত্মহত্যা করব করব করছিল কিন্তু আত্মহত্যা করেছে নব্বই পরবর্তী তরুণতর কবিদের কয়েকজন। আত্মহত্যা করেছে কারণ তাদের ভেতর নিজেদের উৎরানোর মতো পাথেয় ছিল না। সামগ্রিকতার বোধ তাদের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে নাই। অথচ এই মানুষই এক সময় যা-ই বলে সবই মন্ত্র হয়ে যায়।

এখন আমার কণ্ঠস্বর/ নগ্ন/ এখন আমার উচ্চারণ/ শুদ্ধ/ এখন আমার কথা/ মন্ত্র হয়ে যায়।

ছিল  ছোট ছোট লোভ,/ সন্দেহ, ঘৃণা ও ভয়,/ ছিল পাপবোধ ও জিজ্ঞাসা,/

এখন সবুজে নীলে ভরে আছে হৃদয়ের প্রান্তর আকাশ-/ কথাগুলি মন্ত্র হয়ে যায়। (কথাগুলি মন্ত্র হয়ে যায়-ঐ) অথবা

আমার হৃদয় প্রতিদিন একটু একটু করে বড়ো হয়,

বড়ো হতে হতে অবশেষে একদিন ছুঁয়ে ফেলে পৃথিবী/ চারপাশে যারা আছে, তারা

 ছোট জয়ে-পরাজয়ে/ নিজেদের ব্যস্ত রাখে সমস্ত জীবন।

তবু, ভালোবেসে দেখি,/ সব মানুষের মুখ সমান সুন্দর,

সব ভাষাকেই বাঙলাভাষার মতো সহজ মধুর মনে হয়। (অনন্ত বেদনা-ঐ)

ভাষাও সমগ্রের অংশ। সমগ্রের সাথে একীভূত হতে পারলে সবভাষাই একই। প্রতিদিনের সন্দেহ ঘৃণা, ভয়, পাপবোধ, জিজ্ঞাসা, ছোট ছোট পরাজয় এই জীবনকে ব্যস্ত রাখবার এই সব উপসর্গের ঠিক উল্টোপিঠেই আছে ভালোবাসার বোধ যা আসে সমগ্রের বোধ থেকে। একেই সুফিবাদে ‘ফানা’ বলা হয়। আমাদের দেশেও ‘চিনিফানা’ বলে একটা শব্দের লগে আমরা ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। একগ্লাস পানিতে প্রয়োজনমতো চিনি দিয়ে চামচ দিয়ে নাড়ালেই সে পানিতে মিশে যায়। একে বলে চিনিফানা। মিশে গিয়ে নিজের রূপ হারায় কিন্তু নিজের গুণ দিয়ে সে পানিটাকে মধুর শরবত করে তোলে। সমগ্রের প্রতি ভালোবাসায় ফানা হলে সব মানুষের মুখ সমান সুন্দর মনে হয়।

কিন্তু তাহলে এখানে একটা ফাঁক তৈরি হয়। সবমানুষের মুখ যদি একইরকম সুন্দর হয় তাহলে মানুষের ভেতর যারা অত্যাচারী তাদের মুখও কি সুন্দর। সুজিত সরকার বলেন,

আমি এই আশ্চর্য যুদ্ধের কথা ভাবি।

 কেউ ঈর্ষা করে, কেউ গায়ে প’ড়ে অপমান করে,/ কেউ অভিশাপ দেয়

এইসব ছোটখাটো যুদ্ধ কান্ত করে প্রতিদিনÑ

তবু আমি রক্তপাতহীন অস্ত্রহীন আশ্চর্য যুদ্ধের কথা ভাবি/যে যুদ্ধে আমার পরাজয়/ আমাকে মহান ক’রে যাবে। (যুদ্ধ-ঐ)

তিনি আরও বলেন মানুষ এখন আর মানুষের ভালো দেখতে পারে না।

পাঁচজন মানুষ একজায়গায় জড়ো হ’লে/প্রত্যেকেই আত্মমহিমা প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে

প্রত্যেকের বুকের ভিতরে হিংসা ধিকিধিকি জ্বলে যায়।

.. .. .. .. .. .. ..

হয়তো সবাই মিলে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই।/ প্রকৃতির সম্পূর্ণতা দেখে, পর্বত ও সমুদ্রের বিশালতা দেখে/ মানুষ বুঝতে পারে তার ছোটখাটো লাভতির তুচ্ছতা

এক শুভময় বোধ মানুষকে মানুষের কাছে নিয়ে আসে/ পাঁচজন মানুষ মিলে যায়। (যুদ্ধ-ঐ)

উপনিষদে বলা হচ্ছে অজ্ঞান থেকে সমস্ত অনাচারের উৎপত্তি। এই যে আত্মমহিমা প্রচারকারী মানুষ এই যে হিংসুক মানুষ সে যদি জানতো ব্যক্তি হিসাবে সে কত তুচ্ছ সেই জ্ঞান যদি তার থাকতো তাহলে সে কখনোই এসব তুচ্ছতার ভেতর থাকতো না তাই প্রয়োজন মানুষের সঠিক জ্ঞান-আন্দোলন। দরকার সবার অন্তরে এক শুভময়ের বোধ। আর তা এনে দিতে পারে সমগ্র’র ধারণা।  বিজ্ঞান যেখানে কণার ভেতর ইলেকট্রন প্রোটন আর নিউট্রনের সমাহার খুঁজে পেয়েছে। সেই বিজ্ঞানেরই একটা অংশ ব্যবহারিক বিজ্ঞান প্রকৃতির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। বিজ্ঞান নয় মূলত অজ্ঞান মানুষই এই অসম প্রতিযোগীতা করছে।

 খুব ভোরে বারান্দায় এসে বসে আছি/কাক, চড়–ই, শালিখ, পায়রার ডাক শোনা যায়।

কিছুণ পরে/ মেশিনের শব্দে, বাস-মিনিবাস-স্কুটারের শব্দে

এইসব পাখিদের ডাক আর শোনাই যাবে না।

বস্তুপৃথিবী ক্রমশ ঢেকে দেবে শাশ্বত ভুবন। (শাশ্বত ভুবন)

এখানে প্রকৃতি আর বিজ্ঞানের কৃত্রিমতা বা বিরোধ অসম্ভব আন্তরিকতা আর কৌশলে আলাদা করা হয়েছে। স্বপ্ন সম্পর্কে বেশ কিছু শ্লোক আছে উপনিষদে। বস্তুজগতকে উপনিষদে বলা হয়েছে মায়া। এমন কোনো বস্তু যদি থাকে যা শুরুর আগেও ছিল না আবার শেষ হবার পরেও থাকবে না তাকে মিথ্যা বলে মনে করতে হবে। বস্তুটি মরীচিকার মতোই মিথ্যা। বস্তুটিকে সত্য বলে মনে হলেও বস্তুটি সত্য নয়। যা চিরন্তন সত্য তা নিত্য অর্থাৎ অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যৎ এই তিন কালেই তা সত্য। এই হচ্ছে অনিত্য জগৎ সম্পর্কে উপনিষদের সারমর্ম।

সুজিত সরকারের প্রতিবাদ এখানে ঠিক বস্তুপৃথিবীকে মায়া বলে পরিত্যাগ করা নয়। তিনি শুধু বিজ্ঞানের নঞার্থক দৃশ্যকে চিত্রিত করছেন। প্রতিনিয়ত মানুষের কাছে বস্তুর দানবীয় ও অপ্রোয়জনীয় শব্দে কীভাবে চিরন্তন শব্দাবলি চাপা পড়ে যাচ্ছে।

আর বিজ্ঞান খেকো বাজিকরদের ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নিয়েও কম হাসান না তিনি।

মন্দিরে ঢুকছে ডাব,/গোপন রহস্যময় পথ দিয়ে আবার বেরুচ্ছে

ডাব-বিক্রেতার হাত ঘুরে/ ডাইনে দাঁড়ানো ভক্তের মাধ্যমে/ আবার ঢুকছে..

জাগ্রত দেবতাÑ/ ডাব ঢুকছে বেরোচ্ছে, ঢুকছে বেরোচ্ছে / সারাদিন.. (মন্দির-ঐ)

জার্মান ঋষি আলবার্ট শোয়াইৎজার ১৯৩৬ সালে ভারতীয় চিন্তা সম্পর্কে এক পুস্তক রচনা করেন।

Indian thought and its Development (Die weltan Schaung der indischen Denker) নামে। জগতমায়া, মরীচিকার সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন।

`It is interesting to trace the origin of this idea, so contrary to nature, of world and life denial. It had at first nothing whatever to do with any world view, but was a magical conception of the Indian priests of early times. It was assumed that by detachment from the world and from life they could become in some measure supernatural beings and obtain power over the gods.’

( গোড়ারদিকে বিশ্ব-বীণের সহিত মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ জীবন সম্পর্কে এইরূপ নেতিবাচক ভাবধারার কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রাচীন ভারতীয় পুরোহিতবর্গেরও ধারণা ছিল যে  স্বাভাবিক জীবনযাপন না করিয়া আত্মানুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকিলে তাঁহারা ঐন্দ্রজালিক শক্তি অর্জন করিয়া দেবতাদিগের উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে পারিবেন। পরবর্তীকালে কেবল পুরোহিতবর্গের মধ্যে এই বিশ্বাস আবদ্ধ থাকে নাই। আপামরের মধ্যে এই ভাব জীবনাদর্শ বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে।)

আরেক অধ্যায়ে তিনি বলেন, এই ভাবধারা ভারতীয় ধর্মাবলম্বীদের এমনভাবে মোহগ্রস্ত করিয়া রাখিয়াছে যে উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে তাহাদের চিন্তাধারার গতি জীবনমুখি করিবার অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভারতীয় সমাজ এই জীবনবিমুখীনতার সংস্কার থেকে মুক্ত হইতে পারে নাই।

অথচ শোয়াইৎজার নিজেই কিন্তু চলে গিয়েছিলেন আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে। ভারতবর্ষের ইতিহাস ঘুমন্তু দেহ ও জাগ্রহ আÍার ইতিহাস। বাইরের ডাকাতরা সবসময় লুট করেছে ভারতবর্ষের অনাবিল সম্পদ। তাই কহিনূর হীরা শোভা পায় বৃটেনের রাণীর মাথায়। এরকম কত টন টন স্বর্ণ যে সোলতান মাহমুদরা নিয়ে গেছে তার কোনো ইয়ত্তা নাই। কিন্তু এসম্পর্কে সুজিত সরকারের সেই লাইন আবার উচ্চারণযোগ্য-

তবু আমি রক্তপাতহীন অস্ত্রহীন আশ্চর্য যুদ্ধের কথা ভাবি/যে যুদ্ধে আমার পরাজয়/ আমাকে মহান ক’রে যাবে।’

কর্জ:

*সুজিত সরকারের নির্বাচিত কবিতা-কবিতা পাক্ষিক(১৯৯৭-কলিকাতা)

*উইকিপিডিয়া

* Indian thought and its Development-Albert soyaitzar

* উপনিষদ-স্বামী লোকেশ্বরানন্দ

কবি আর কবিতা

জয়দেব কর

 

০১।

আমি একজন পাঠক।শেলেটে পেন্সিল ঘষে যেদিন অ,আ লেখা শুরু করি সেদিন থেকেই আমার পাঠক হিশেবে যাত্রা শুরু হয়, যৌবনে এসেও আমি পাঠ করছি ভালো এবং মন্দ। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যদি আমার শরীর পাঠ করার মতো উপযুক্ত থাকে তবে আমি থামবো না _ আমার যাত্রা অব্যাহত থাকবে। জন্মগতভাবেই কবিতার প্রতি আমার প্রবল ঝোঁক। একটা সময় কবিতা ভেবে কবিতার মতো অবিকল পঙক্তির স্তূপ পড়েছি, যা আমার কবিতার তৃষ্ণা মোটেও নিবারণ করে নি, বরং দিয়েছিলো ফালতু উত্তেজনা। আসল নকল বোঝার মতো বোধ আসার পর থেকে বুঝতে পারছি কবিতাবিমুখ করতে এই দেশের শিক্ষাপদ্ধতির অবদান কতো বিশাল!অন্য দশজনের মতো বিদ্যালয় জীবনে কবিতার সারমর্ম আর ব্যাখ্যা লিখে হাঁপিয়ে ওঠার দিনগুলো মনে হলে পীড়িত হই। পাঠ্য পুস্তকের সীমানা অতিক্রম না করলে পৃথিবীকে নিজের মতো করে জানতে পারতাম না, জানতে পারতাম না চিনতে পারতাম না কবিতার আসল রূপ-রস-গন্ধ। সিংহভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কবিতাভীতির মূল কারণ হলও বিদ্যালয়জীবনে চাপিয়ে দেয়া শিল্পবিবর্জিত পঙক্তিমালার আধিক্য।

 ০২।

কবিতা কী? কবি কী? সহজ ভাষায় কঠিন করে বললে, কবির সৃষ্টিকর্ম কবিতা,আর কবিতার স্রষ্টা কবি! কিন্তু কবি চিনবো কী করে? আর কবি না চিনলে কবিতাই বা চিনবো কীভাবে? চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, কৃষক চেনা তো কঠিন মনে হয় না। কিন্তু, কবি ও কবিতা জানতে , চিনতে বুঝতে গিয়ে যে কেউ প্রাথমিক অবস্থায় হিমশিম খায়, ঠিক যেভাবে সাঁতার শিখতে গিয়ে  নাকে মুখে পানি ঢোকা খুবই মামুলি বিষয়  । কবি যেহেতু বস্তুজগতের বাহিরের কেউ নন সেহেতু বস্তুজগতকে জানার পরিধিটা বাড়ালে হয় তো একটা সময় কবিকে জানা যাবে, এটাই মনে করতাম, এবং এখনো মনে করি জ্ঞানার্জন অপরিহার্য; তবে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও কল্পনার বিস্তৃতি ছাড়া কবি ও কবিতা অধরাই রয়ে যায়। কবিতা আর যাই হোক দলবদ্ধভাবে সৃষ্টি করা হয় না। একটা কবিতার স্রষ্টা তো একজনই। তাহলে অবশ্যই কবিতা ঐ একজন কবির অভিজ্ঞতা আর কল্পনার শিল্পিত প্রকাশ।অভিজ্ঞতা ও কল্পনা সবার আছে, তাই বলে তো সবাই কবি নয়,এখানে প্রয়োজন নিজস্বতার। নিজের প্রতি সততা ছাড়া আন্তরিকতা ছাড়া নিজস্বতা আসে না । নিজস্বতা না থাকলে সৃষ্টি সম্ভব নয় । একটা মানুষের সততা আন্তরিকতা অভিজ্ঞতা ও কল্পনার রসায়নই তাকে কবিতার উদার ও অফুরান গুপ্তধন বের করে নিয়ে আসার শক্তি যোগায়, আর তা ধারণ করার জন্য ঐ মানুষটি হন কবি। এই কবিকে কবিকে চাক্ষুষ দেখে তার কবিতার সন্ধান সবসময় পাই না আমরা, তবে কবিতাই কবির সাথে সম্বন্ধ ঘটায় ।  কিন্তু কবিতা পাঠের বেলায় কল্পনায় ঠিকই ওই কবিকে সৃষ্টি করা ছাড়া উপায় নেই এবং এটাই উত্তম পাঠকের বৈশিষ্ট্য। কারণ অনেকসময় কবিতার কবির সাথে বাস্তবের কবির দিনরাত ফারাক থাকে।এদের অনেকেই একটা সময়ে এসে ভ্রান্ত হয়ে যায়। কবিতার জন্য কাউকে কবি বলা কঠিন। কবিতা তো মানুষ নয়, মানুষদের মধ্যে কেউ কেউ কবিতার সৃষ্টি করে। কবিতা সৃষ্টির চাইতে কবি হওয়া দুঃসাধ্য।

বিশ্বসাহিত্যে উপন্যাস  বিশৃঙ্খলিত মানবিকতা অন্য উপমা 

                                 

নাজমুল আরেফীন

বিশ্বায়ন আমাদের কতটা গ্লোবাল করেছে জানিনা কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের উপন্যাস নিজেদের ব্যক্তিমানুষের  পরিচয়গুলোকেই যেন  তুলে ধরেছে।  উত্তর উপনিবেশবাদ আমাদের যেমন একদিকে লোকাল না করে গ্লোবাল করার পাঁয়তারা করছে অন্যদিকে বিশ্ব সাহিত্যের উপন্যাস নিজেদের সাহিত্য পাঠে এবং রচনা  অনুধাবন করতে এবং প্রকাশ করতে  একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠ দিয়েছে। উপন্যাসগুলোকে এখন আর কোন  সংজ্ঞার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়না। উপন্যাস গুলো তার চিরচেনা রূপ হারিয়ে ফেললেও এর মাঝে চলে এসেছে বহুমাত্রিকতা ।

তবে জানিনা কেন  ঔপন্যাসিকরা মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও নৈতিকতা  প্রচার করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা উপন্যাসের চরিত্র অঙ্কন ও হিতাকাঙ্খী ভূমিকার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করেছে। ঔপন্যাসিকরা এখন  Poetic justice  বা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের জয় না দেখিয়ে বরং সমাজের বিদ্যমান রূঢ় বাস্তবতার চিত্রই তুলে ধরেছেন। যেখানে প্রধান চরিত্রগুলো মানব চরিত্রের আদর্শ দিয়ে নয় বরং বেঁচে থাকার লক্ষ্যে নীতি আদর্শ বিচ্যুত বিচ্ছিন্ন মানুষ রূপে চিত্রিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় ক্যেজিওর উপন্যাস লা ফিয়েভবরের জেফ্রোয়া অ্যালেন , অরবিন্দ আদিগার দ্যা হোয়াইট টাইগারের বলরাম, টনি মরিসনের দ্যা ব্লুয়েস্ট আইয়ের’ চোলি ব্রীডলাভ কিংবা খুশবন্ত সিং এর দ্যা কোম্পানি অব ওমেন এর প্রধান চরিত্র মোহন কুমার, কুনাল বসুর  রেসিস্টস এর বেলাভোয়া  নীতি আদর্শবিচ্যুত সমাজ বিচ্ছিন্ন রূপেই চিত্রিত হচ্ছেন ।

এর কারণ হয়তো মহাজাগতিক বিশৃঙ্খলা। অতীতের তুলনায় বর্তমানের জগৎ চরম বিশৃঙ্খল। ঔপন্যাসিকরা এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে আঁকতে হচ্ছে চলনসই বাস্তবতার ছবি , বোধের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল অবস্থাকে বোধগম্য করতে হচ্ছে সর্বসাধারণে। দুনিয়াজোড়া সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের ভয়াবহ চাপ লেখকদের আত্মমুখীন করে তুলেছে, তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। তাই বিষয় হিসেবে উঠে আসছে ব্যক্তিমানুষের বিচ্ছিন্নতা , নিঃসঙ্গতা, একাকীত্বতা এবং অস্তিতত্বসংকট। ঔপন্যাসিকরা যতই বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন , তাদের উপন্যাসগুলোও তেমনি বিচ্ছিন্নতার জটিল সমীকরণে আবদ্ধ হচ্ছে মূল্যবোধ বা নৈতিকতা প্রচার সেই অর্থে অনেকাংশ হয়ে পড়ছে ধ্বংসের সম্মুখীন। ঔপন্যাসিকরা বিশৃঙ্খলিত জগতকে সুতায় বাধতে গিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন, তাদের  নিজেদের মূল্যবোধ চেতনাও ব্যাহত হচ্ছে। তাই

উপন্যাসে মূল্যবোধের রার ঐতিহ্য থেকেও ঔপন্যাসিকরা মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন, এই ভেবে যে বৈশ্বিক মূল্যবোধ এবং মানবিক প্রত্যয় হারিয়ে একালের মানুষ পরিণত হয়েছে না- মানুষে বা anti man।

একালের anti novel চরিত্রগুলোকে ভুগতে দেখি নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ সর্বোপরি অস্তত্বিসঙ্কটে যা তাদের নৈতিকতাবোধ বা মূল্যবোধকে ছাপিয়ে যায় , প্রায়শই অতিক্রম করে। সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের উপন্যাসে এ ধরনের চরিত্রের আনাগোনা ব্যাপকতা ল্য করা গেলেও তা কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের  কাছে নতুন নয়। বহু আগেই দস্তয়ভস্কি কাম্যু, কাফকা , জয়েস ,সাঁর্ত্র ,হেমিংওয়ে লরেন্স, মান প্রচুর উপন্যাসে পরিলক্ষিত হয়েছে। তাদের লেখনীতে ব্যক্তিমানুষের নিঃসঙ্গতা ও অস্তিত্ব সংকটের যন্ত্রণার কথকতা জ্বলজ্বল করতে থাকে। তবে সাম্প্রতিক উপন্যাসে এর প্রভাব ব্যাপক আকারে লক্ষ্য  করা যায়। মনে হয় ঔপন্যাসিকরা যেন বেশিমাত্রায় অবিশ্বাসের কর্কট রোগাক্রান্ত।

তাই হয়তো লরেন্সের পরে আর কোন ঔপন্যাসিক পাইনা যিনি বিশ্বাস করেন যে ফিনিক্স পাখির মতো নিজের ছাই থেকে আবারো জেগে উঠবে মানুষ, অথবা মায়াবিভ্রম অল্প সময়ের জন্য হলেও মানুষকে রা করতে পারে -কনরাডের পরে কেউ এ সত্য গ্রহণে এগিয়ে আসেনি । ই এম ফরস্টারের পরে আর কোন আশাবাদী পাইনি , যিনি দাবি করবেন যে মানুষ সেতুবন্ধনের মধ্যে বেঁচে থাকবে ।

বিগত দশকগুলোর বিখ্যাত ঘটনাবলী, পৃথিবীব্যাপী সংঘাত, যুদ্ধকালীন ভয়াবহতা , রাজনৈতিক সংঘাত , এমনকি ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবীর বাস্তবতা -সবকিছু অবজ্ঞা করেছেন সমসাময়িক ঔপন্যাসিকরা। তবে সমসাময়িকদের  মধ্যে টনি মরিসন , ওরহান পামুক , ক্যাসিও , অরবিন্দ আদিগা বা কুনাল বসু সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘাত সমূহের  বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন। যা আমরা প্রত্যক্ষ্য করেছিলাম আলবেয়ার কাম্যু ,কাফকা ,সাঁর্ত্র ,জয়েস, হেমিংওয়ে,বারবুস, মান প্রমুখের উপন্যাসে। কাম্যুর দ্যা আউটসাইডার (১৯৪২) , দ্যা প্লগে (১৯৪৭), কাফকার দ্যা ট্রায়াল (১৯২৬) উপন্যাসের মূল চরিত্রটি ইনট্রোভার্ট আত্মহত্যা শূন্যতা, নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় ভোগা মানুষের চরম নিদর্শন। তবুও আমরা লক্ষ্য করি যে কাম্যুর  দ্যা আউটসাইডারের অথবা কাফকার দ্যা ট্রায়াল, উপন্যাসের   কেন্দ্রীয় চরিত্র বিচারালয়ের ও আমলাতন্ত্রের কুৎসিত স্বরূপ উন্মোচন করেন পাঠকদের সামনে । কাফকার  মেটামরফোসিসের দেখি গ্রেগর সামোসা প্রত্যঙ্গে পরিণত হলেও তার বোনের বিপদের সময় সে রুখে দাঁড়ায় লোকগুলোর বিরুদ্ধে।  মানবিক প্রত্যয় ও প্রমূল্য হারিয়ে বিভ্রান্ত - মানব হয়েও তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এর মাঝেই প্রকাশ পায় যে তারা জীবন সম্পর্কে হতাশ হলেও মূল্যবোধ ও নৈতিকতা থেকে তারা দূরে সরে যায়নি।

যদিও সেই সময় মানব সমাজ চরম অনিশ্চয়তা ও সংকটের মাঝে পথ অতিক্রান্ত করছিলো। পাশ্চাত্য ঔপন্যাসিকরাও এই পথ অতিক্রান্তকরতে যেয়ে সন্ধান পান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা। যুদ্ধোত্তর কালে এই অন্তঃসারশূন্যতা।, কখনো আমলাতান্ত্রিক দাপট, কখনো ঈশ্বরের মৃত্যুর কারণে, কখনো বা ব্যক্তি বিকারের ফলে মানুষের জীবনে দেখা দিয়েছিলো অস্তিত্বসংকটজাত উদ্বেগ অসহায়ত্ব  নিঃসীম নিঃসঙ্গতা। সন্দেহ নেই ঔপন্যাসিকরা আক্রান্ত হয়েছিলেন সেই বোধে। কিন্তু এখনো কেন ঔপন্যাসিকরা সেই বোধে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন?

কেন উপন্যাসের  কেন্দ্রীয় বা প্রধান চরিত্রের নৈতিকতাকে হতে হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। অরবিন্দ আদিগার দ্যা হোয়াইট টাইগারের কেন্দ্রীয় চরিত্র বলরাম কিংবা টনি মরিসনের  দ্যা ব্লুয়েস্ট আইয়ের চোলী ব্রীডলাভের মূল্যবোধহীনতা সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ। তারা জানেনা নৈতিকতা কি? অথবা ভালবাসা, স্নেহ আদর প্রভৃতি মানবিক অনুভূতির সংজ্ঞা কি ? জাঁ ম্যারিও  গুস্তাভ লা  কেসিও লা ফিয়েভর এর জেফোয়া অ্যালেনকেও আমরা পাই সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষ রূপে। তার শুধু একটি মানবিক অনুভূতিই রয়েছে আর তা হলো সীমাহীন ঘৃণা। কুনাল বসুর  রেসিস্টের  বেলাভোয়াকে দেখা যায় শিশুদের হাতে গোপনে ছুরি সরবরাহ করতে, যাতে তারা একে অপরকে হত্যা করতে পারে।  এখন প্রশ্ন হিসাবে আসতে  পারে উপন্যাসে মূল্যবোধের চেতনা লেখকের না লেখক কর্তৃক সৃষ্ট চরিত্রাবলির? এ প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, তবে উভয়ক্ষেত্রেই  তার যথার্থতা বিচার করা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখি লেখক সৃষ্ট চরিত্রই লেখকের প্রতিনিধি। মোদ্দকথা লেখক যেভাবে তার চরিত্রকে মূল্য দেবেন তাইতো তার মূল্যবোধ। উপন্যাস চলমান জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।

উপন্যাসের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন ঔপন্যাসিকরা।। অনেকক্ষেত্রেই ঔপন্যাসিকদের মূল্যবোধের চেতনার ভাবনার প্রতিফলন ঘটায় চরিত্রগুলো। কিন্তু মানুষ প্রতিটি কাজ করে তার ইচ্ছার ফলে। অন্যায় অপরাধ করা ও তার ইচ্ছাধীন ব্যাপার। এ ব্যাপারে পাসকেলের চমৎকার একটি উক্তি আছে আর তা হলো there are two kinds of men , righteous who believe themselves sinner the rest sinner who believes themselves righteous.  অর্থাৎ সাধুরা নিজেদের পাপী ভাবেন , পাপীরা সাধু তাই মূল্যবোধ ব্যাপারটিতেও একধরনের আপেক্ষিকতা লুকিয়ে রয়েছ। কিন্তু এই মূল্যবোধের  চেতনা মানুষকে ভালোমন্দের পার্থক্য চি‎হ্ণিত করতে সাহায্য করছে। মানুষের মাঝে জন্ম নিয়েছে কোনটা উচিত , কোনটা অনুচিত কাজ । মানুষের মাঝে শিকড় গেঁথেছে নৈতিকতা আর অনৈতিকতার দ্বন্দ্ব। এই নৈতিকতা আর অনৈতিকতার দ্বন্দ্ব প্রথম পরিলক্ষিত হয় টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা ও ফবেয়ারের মাদামবোভারী  উপন্যাসের মাধ্যমে। টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা মস্কোতে এসেছিল রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে। সেই আসাটাই কাল হলো তার । রেল স্টেশনে দেখা হয়। ভ্রনস্কির সঙ্গে। আন্নার মন বলছিলো দেখাটা শুভ হবেনা , হলোওনা। তারপর আন্নাকে দেখি  অস্থির। আন্না যখন ভ্রনস্কির প্রেমের আশ্চর্য মসৃণ স্পর্শ থেকে তার নীরস স্বামী তাকে বঞ্চিত করেছে। ঘর ছাড়লো আন্না , ঘর আর পেলোনা ফিরে। অবশেষে দেখা গেলো মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব রেলগাড়ীর তলায় মাথা পেতে আত্মহত্যারত। আন্নার তুলনায় অতিসামান্য মেয়ে ফবেয়ারের মাদাম বোভারী মফস্বলের অসফল এক ডক্টরের স্ত্রী। কেবলই রোমান্স চায়। নিজেকে কল্পনা করে নায়িকা হিসারে।  সেই তাড়নায় কেবলি ছুটে – ছুটে বেড়ায় তারপর যখন দেখে সকলেই ঠকিয়েছে তাকে। আটকা পড়ে আছে সে জ্বালে, তখন আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই ভারতে পারেনা সে টলস্টায়ের আন্না কারেনিনার রেলগাড়ির তলায় আত্মহত্যা ইঙ্গিত করে অনৈতিকতার বিরুদ্ধে নৈতিকতার জয়কে। লেখকদ্বয় নীতিধর্মের প্রতি আস্থাশীল হয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রের অনুশোচনা পাপবোধ ও poetic justice  প্রয়োগ করে পাঠকদের সচেতনতার বার্তা প্রদান করেন।

এমনকি দস্তয়ভস্কির ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্টের রাসকলনিকভ যে মনে করতো প্রতিভা সব নীতিধর্ম ও সকল সংস্কারের কাছে সব স্বীকারও আত্মসমর্পণ করতে দেখি। কিন্তু সাম্প্রতিক উপন্যাস টনি মরিসনের  দ্যা ব্লুয়েস্ট আইয়ের পিতা দ্বারা কন্যাকে ধর্ষণ, তার কাছে অনৈতিক  মনে হয় না। এমনকি  চোলি ব্রীডলাভের  ভেতর কোন অপরাধবোধ দেখিনা। নৈতিকতাবোধের কোন নিদর্শন আমরা দেখতে পাইনা। ঔপন্যাসিক হিসাবে টনি মরিসন শক্তিশালী ও বেশ উঁচুমানের। লেখার গাঁথুনি ও চিন্তার গতি অসাধারণ। এই উপন্যাসে তিনি চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিক শক্তি কিভাবে উপনিবেশিত সংস্কৃতি ও সমাজকে বদলে ফেলে , খোঁড়া করে দেয়। নিজেরাই কিভাবে নিজেদের ঘৃণা করতে থাকে। আমরা পাই পিকোলার মা পাউলিনকে, যে নিজে কালো হয়েও তার মেয়ের কালো রঙকে ঘৃণা করেন । মেয়ে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। বাবা চোলী ব্রীডলাভ মদ্যপ, খুনি। উপন্যাসের এক পর্যায়ে নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করেন এবং ভাবেন এটা ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ উপন্যাসটি পাঠকদের চেতনাকে স্পর্শ করে ক্ষুব্ধ বিক্ষুব্ধ করে তোলে।

উপন্যাসটিতে টনি মরিসন চোলী ব্রীডলাভের কোন ট্র্যাজিক পরিণতি রাখেননি বরং তাকে রেখেছেন সম্পূর্ণ অনুশোচনা, পাপচেতনামুক্ত। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেননি নৈতিকতার মতো মানবিক বিষয়। তিনি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন  যে, উপন্যাস কোন নৈতিকতা প্রচার করেনা, করে মানবসমাজের নিগূঢ়তম সত্যকে অনুসন্ধান । একইভাবে আমরা অরবিন্দ আদিগার দ্য হোয়াইট টাইগারের বলরাম প্রসঙ্গ আনতে পারি,আনতে পারি লা  ফেভরের  জেফ্রোয়া অ্যালোন অথবা কুনালবসুর রেসিস্টের বেলাভোয়ারে। প্রথমেই আনি বলরামের প্রসঙ্গ, বলরাম একজন কোড হিরো চরিত্রটি নায়কের বিপরীত। কোড হিরোর বার্তা হলো- এই হচ্ছে জীবন, তুমি হেরে যাচ্ছ, তবুও যা টিকে থাকে সে হচ্ছে তোমার আচরণ, নিশ্চিত ধ্বংসের মধ্যে এই টুকুই তোমার প্রাপ্য। যা প্রথম প্রকাশ পেয়েছিলো হেমিংওয়ের দি ওল্ডম্যান  এন্ড দি সীর বুড়ো সান্টিয়াগোর মাঝে। তার চরিত্রের মূল লক্ষণ হচ্ছে ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে তার কাজ করা- হাঙ্গর তার মাছ নিচ্ছে কেড়ে তবুও । বলরাম চরিত্রটি ও ধৈর্য ও  সাহসের সঙ্গে কাজ সম্পূর্ণ করে। তার ভিতরে কোন দ্বন্দ্বই ক্রিয়া করতে দেখা যায় না। বলরামের জন্ম দ্যা ব্লুয়েস্ট আইয়ের চোলী ব্রীডলাভের মতোই অন্ধকারময় ভুবনে। চোলীর মতোই তার আশ্রয় হয় আস্তাকুড়ে। বেঁচে থাকার তাগিদে দিল্লী শহরে আসে। অশোকের কাছে আশ্রয় পায়। বলরাম এই সমাজেরই product যাকে দেখি উপরে উঠার জন্য বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে সংযুক্ত থাকতে। সে মানুষ খুনের মতো ভয়ংকর অপরাধ করেও নির্লিপ্ত থাকতে পারে । রাসালনিকভের মতো অনুশোচনায় দগ্ধ হতে দেখা যায় না। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি মানুষকে চরম সীমায় নিয়ে যায় যেখান থেকে আর ফেরা যায়না তা অরিবিন্দ আদিগা তার উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন। তিনি প্রধান চরিত্র বলরামের ভিতর দেখাননি কোন পাপবোধ অনুশোচনা অথবা  নৈতিকতা আর অনৈতিকতার দ্বন্দ্বকে । বলরাম তার অপরাধ গুলোকে ভাবে উপরে উঠার সিঁড়ি হিসাবে, তাই পাঠকরাও বিভ্রান্ত হন, ভাবেন বেচে থাকার জন্য অন্যায় আর অন্যায় নয় , অপরাধও অপরাধ নয়। এতে মূল্যবোধের অবয় অবচেতনভাবেই পাঠক গ্রহণ করতে থাকে । মনে হয় ঔপন্যানিসকর বৈরী পরিবেশের চাপে পরিচিত ভুবনের বেহাল অবস্থা দেখে , নিজেদের ভিতরই নির্মাণ করেছেন বিকল্প বসত। তারা আক্রান্ত হয়েছেন বিচ্ছিন্নতাবোধে , তাই হয়তে উপন্যাস এখন নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুত আক্রজগত অনুসন্ধানরত। ল্যা কেজিও ‘লা ফিয়েভর’উপন্যাসের আমরা দেখি ফ্যাঁতাঁ নামে দনি ফ্রান্সের এক নয় বছরের বালক ইতালীয় মায়ের সাথে অচেনা ইংরেজি বংশের বাবার সাথে রওয়ানা দেন । ফ্যাতো যখন জাহাজে থাকে তখন উপনিবেশিকতা বাদের সীমাহীন ঘৃণা অসহিঞ্চুতাও হিংসাকে রাগ করে লেখে Ôpoko ingezi’ যার মানে ইংরেজ শুয়োর, অথচ তার বাবা জেফ্রোয়াএলোন একজন ইংরেজ , তাদের যখন দেখা হয় তখন জেফ্রোয়া এলোন বলেন ‘শুয়োরের বাচ্চা তুইকে ? যদিও তিনি পুত্রের পরিচয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন ।  এতেই আমরা বুঝিয়ে জেফ্রোয়া এলোন একজন নৈতিকতাহীন মূল্যবোধবিহীন মানুষ যে জানেনা সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ব কি । কুনাল বসুর রেসিস্টের কাহিনী বিন্যাসে দেখতে পাই ঐতিহাসিক আখ্যান , ঔপনিবেশিক অভিযান কাহিনী । কুনাল বসুর লেখায় রবিনসন ক্রুসো , আইল্যান্ড অফ ডক্টর নো , হার্ট অফ ডার্কনেস , লর্ড অব দ্যা ফাইজ এর নানা উপন্যাসের মত ছায়া পড়ে । কাহিনী শুরু হয় ১৮৫৫ সালে । একটি জনমানববর্জিত দ্বীপে এক ইংরেজ বৈজ্ঞানিক বেটস ও তার ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বী বেলাভোয়া  তাদের জাতি বিষয়ক তাত্ত্বিক বিরুদ্ধের চিরঅবসানের সন্ধানে এক ভয়াবহ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। একটি সাদা কন্যা শিশু ও একটি কালো পুরুষ শিশুকে এক মুক পরিচারিকার তত্বাবধানে দীর্ঘ বার বছরের জন্য দ্বীপে রাখা হয় ।তারা বড় হয়ে উঠে প্রাকৃতিক পরিবেশে যেখানে সভ্যতার স্পর্শ মাত্রা নেই । এই আবহাওয়ায় কি সাদা কালো দ্বন্ধ বাধবে একজন আরেকজনের আধিপত্য বিস্তার করবে নাকি বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে, নাকি একজন আরেকজনকে হত্যা করবে এই গল্পের মূল বিষয় ।উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বেলাভোয়াকে দেখতে পাই কালোচামড়া প্রতি তীব্র ঘৃণাবশত শিশুদের হাতে ছুরি সরবরাহ করেন যাতে একে অন্যকে হত্যা করতে পারে।উপন্যাসিক কুলান বসু জাতি বিভেদ ও দাস প্রথা সাদা কালোর যে প্রভেদ দেখাতে গিয়ে কালো শিশুদের উপড়ে অনেক অত্যাচারই দেখিয়েছেন এবং সব শেষে কাকতালীয় ভাবে আরব বনিকরা এসে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় । অন্যদিকে সাদা চামড়ার মেয়েটাকি দেখি নিশ্চিন্তে কানাডার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় । এখানে মানুষ হিসাবে অন্য মানুষের যে মূল্যায়ন তা খোদ উপন্যাসিকের কাছেই ব্যাহত হতে দেখি । এখানে পাই  বেলাভোয়ার মত নীতি ধর্ম বিরচিত মানুষ । ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিংয়ের দ্য কোম্পানি অফ ওম্যান  উপন্যাসটির মূল উপজীব্য বিষয় হিসেবে এসেছে যৌনতা। মূল্যবোধের চেতনা হয়েছে ভুলুন্ঠিত । এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মোহন কুমারও সমাজ ধর্ম ও জগত বিচ্ছিন্ন মানুষ।তিনি বিভিন্ন পেশা শ্রেণীর নারীদের সাথে করেন অবাধ যৌন অভিযান । তার মধ্যে নেই সংস্কার, নেই ধর্ম , নেই সমাজের প্রতি কোন বিশ্বাস । উপন্যাসে তার ট্র্যাজিক পরিণতি ইঙ্গিত করে উপভোগ আর কামনার ভিন্ন রঙগুলোকে । গুস্তাভের মাদাম বোভারীর মতো তার ভিতরে জাগ্রত হয়না মূল্যবোধচেতনা অথবা রাসালনিকবের মত কোন  নৈতিকতা আর অনৈতিকতার দ্বন্দ্ব ।

 সমকালীন উপন্যাসগুলো বাস্তবতাকেই অন্যরূপে উপস্থাপন করেন। উপন্যাস জগৎ, সমাজ এবং মানব সম্পর্কে জানার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এটি পাঠকদের চিন্তা চেতনার সাথে সেতুবন্ধন গড়ে তোলে। তাই উপন্যাসের মাঝে মূল্যবোধহীনতা পাপচেতনা বা অনুশোচনা অথবা অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনা অবশ্যই পাঠকদের ভিতর নাড়া দেয়। উপন্যাসের ভেতর যদি মূল্যবোধহীনতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় তবে তা পাঠকদের জন্য ক্ষতিকারক,তবে উপন্যাসের মাধ্যমে বিকৃতি, পাশবিকতা, অনৈতিকতা উপস্থাপন না করে সৃষ্টিশীল ও নৈতিকতা উপস্থাপন অবশ্যই সৃজনশীল পাঠকদের জন্য ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

                                              

পাতাটি যতই মেজাজ দেখাক

সরসিজ আলীম

১. বিচারটা আগেই করা দরকার বন্ধুরা

আমি দৈনিক পত্রিকাগুলোতে লিখি। লেখা দিই। দৈনিক কাগজে নিয়মিত লেখা ছাপা হোক, এটা আমি চাই। দৈনিক পত্রিকা ব্যবসায়িক পত্রিকা। আমার লেখা ছাপার কারণে আমার লেখাতে পত্রিকার ২পয়সা ব্যবসা হবে তা আমার মনে হয় না। বরং আমাকে লেখা বাবদ ৫০০/১০০০ টাকা দেয়। এটা একজন লেখকের সম্মানী। আমি এই সম্মানী পেয়েই মহাখুশি। আর সারাদেশের ২/৪ টা আমার পরিচিত লেখকবন্ধুরা আমার লেখাটা হাতে পাবার সুযোগ পায়। ২/১ টা সাধারণ পাঠকও আমার লেখাটাতে অলস সময়ে হাই তুলতে তুলতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারে। যদি মনের ভেতর খামচি দেয়, তবে তার প্রেমিকাকে ফোনে পাঠ করে শোনায়। এই আহ্লাদেই আমি গদ গদ হই। আমি কবিতাই লিখতে পছন্দ করি। গদ্য লিখলে কাগজওয়ালারা বেশ সমাদর করেন, টাকাটা বেশি পাওয়া যায়। নিত্যদিনই ছাপার অক্ষরে পাঠকের দরবারে আমার নামটা জ্বলজ্বল করে, ঝিকমিক করে, রোশনাই ছড়ায়! লেখকের খানদানি ক্লাবে নামটা ঢুকিয়ে দিতে পারার মহাসড়কে গড় গড় করে গাড়িটি দৌড়ায়। আমার মতো মূর্খের বাচ্চা মূর্খের পক্ষে তারায় তারায় খচিত গদ্য লেখা সাত জনমেও অসম্ভব। তাই অন্যের গদ্য পড়ে বাহবা দিই। আর কবিতার বালুতে মুখ ডুবিয়ে খড়-বিচালি খোঁজার চেষ্টা করি। তো, আমার আউল বাউল লালনের দেশে কবিতা লেখিয়ে বন্ধুদের সংখ্যা নেহাত কম তো নয়! তাদের সবার দৌড়-ঝাঁপ মদিনার দিকে। আমার মতোই দৈনিকে লেখা ছাপার একটা পথ বাতলিয়ে নিতে পারাটা কত যে মহান অর্জন, যার ছাপা হয় সেই জানে! তরুণ লেখকের কাছে দৈনিকে লেখা ছাপা ও লেখা ছাপা হওয়ার পর টাকা পাওয়াটা একটা সামাজিক সম্মান বয়ে আনার মতো সম্মানের ব্যাপারও বটে। তাইতো তরুণদের লেখা ছাপার ব্যাপারটা একটা প্রতিযোগিতা, দৌড়-ঝাঁপের মধ্য দিয়ে যায়। এই দৌড়-ঝাঁপ আর প্রতিযোগিতার বাইরে বড়োরা, বুড়োরা, অগ্রজরা। তাদের লেখা পেলে কাগজাওয়ালারা ধন্য হয়ে যায়! ব্যাংক থেকে বেছে বেছে নতুন টাকা তুলে একটা বিশেষ খামে ভরে একজন দায়িত্বপ্রাপ্তকে পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে লেখকের বাসায় বা দপ্তরে পাঠিয়ে মাথা ঝুঁকে খামটা লেখকের হাতে তুলে দেবার পর লেখকের মর্জির উপর অপেক্ষা করে থেকে, লেখক লেখা দেবার পর লেখাটা হাতে পেয়ে সাতপুরুষের সৌভাগ্যকে সাধুবাদ দিতে দিতে ফিরে এসে সম্পাদকের টেবিলে জমা দেবার পর কাগজের দপ্তরে হুলস্থূল বয়ে যায় বেশ সময় ধরে। আমাদের মগবাজারের অন্ধ বুড়োর মুখের বিবৃতি অনুলিখনের জন্য ধীর-ঠাণ্ডা একটা মেয়েকে পাঠাতে হয়। কবি সুন্দরী তন্বীর পাশে বসে ভাবে ভেসে যেতে পছন্দ করেন। তার মহান কবিতা পেয়ে দেশ-জাতি ধন্য হয়ে যায়! তাদের মহান লেখাগুলো বাজারে বিকোনোর পর তরুণদের লেখার সিরিয়াল শুরু হয়। তাই তো ফিরে ফিরে ২/৬ মাসের মধ্যে লেখা ছাপা হওয়াটা কঠিন ব্যাপার। আর বুড়োরা তো কম যান না! তরুণদের লেখা কি-বোর্ড থেকে বের হলেও বুড়োদের বের হয় বহুমূত্রের থলি থেকে। তাদের কলমের কালির রং অবশ্যই হলুদ। বুড়োদের লেখার দায়-দায়িত্ব লেখকদের নিজের। আর তরুণদের লেখার দায়দায়িত্ব সম্পাদককে নিতে হয়। এভাবে বোঝা যায়, তরুণদের জায়গা তাহলে অবশ্যই সীমিত।

আমি যে র‌্যাববাদী অথবা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অথবা আল্লামা পীর মাসায়েকবাদী অথবা জামায়াতে ফতুয়াবাদী অথবা এরশাদবাদী অথবা স্বাধীনতার ঘোষকবাদী অথবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ অথবা বিপক্ষবাদী অথবা সরকারী তথ্য বিবরণবাদী এই কথাগুলোর বিবরণ কেন দিলাম, তাহলে আপনাদেরকে খোলাসা করে বলি:

আমার লেখা এই সময়ে বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত ছাপা হচ্ছে বলে অনেকে চোখে পড়ছে। আমি খই ভাজা মানুষ, লেখকদের পাড়ায়, প্রকাশকদের দপ্তরে ঘোরাঘুরি করা ফুটপাতের মানুষ। প্রতিনিয়ত এইসব মহান ব্যক্তিদের সাথে দেখা-সাক্ষাত হচ্ছে। তারা জানতে চাই, আমার এই সময়ে এতো এতো লেখা ছাপা হওয়ার মাজেজা কি? এরমধ্যে গিভ এন্ড টেকের কোন ব্যাপার আছে কি? আমি বলি ভাই, আমার লেখা ছাপার আগে কোন সম্পাদকের সাথে তেমন পরিচয় ছিলো না। এখন প্রায় সব সম্পাদকই আমাকে চেনে। ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক আমাকে চিনতো খুবই সামান্য। খুব ভালোমতো পরিচয়ের আগেই সে আমার কয়েকটা লেখা ছাপছে। কথাসাহিত্যিক মইনুল আহসান সাবের ভাইয়ের সাথে আমার এখনও ঠিকমতো পরিচয় হয়নি। তিনি আমারে মেইল করে লেখা চেয়ে নিয়ে ছেপেছেন। নতুন ধারায় লেখা ছাপার পর সম্পাদকের সাথে পরিচয় হয়েছে। এই সময়ে আমার একটি কবিতা পাঠকের কাছ থেকে বেশি সাড়া এসেছে, কবিতাটি ছাপা হয়েছে উত্তরাধিকারে। লেখা ছাপার পর সরকার আমিনের সাথে দেখা হলে খুবই ভালো লাগছে কবিতাটা বলেই তিনি ছাপছেন বলে জানালেন। আমি লিটলম্যাগগুলোতে বেশি লিখি, সম্পাদকরা হয়তো সেই লেখাগুলোর ভালোলাগা থেকেই আমার কবিতা ছাপছেন। একটা কথা বলার থাকে, দৈনিকে সব লেখাই হয়তো মানসম্মত নয়। কিন্তু বরেণ্য লেখকরা দুর্বল লেখা লিখলে সম্পাদকদের কিছু করার হয়তো থাকে না। আবার অনেক তরুণের পাঠানো খামটা হয়তো খুলেও দেখে না। মেইলটা না পড়েই ডিলিট করে দেন। এমন অভিযোগ আছে সম্পাদকদের বিরুদ্ধে। আমি মনে করি, তারা সবাই এখন চাকুরিটাই করেন। শিল্প-সাহিত্যের মহান দায়িত্ব পালন করার জন্য এখন আর কেউ বসে নেই। নিজের লেখনী শক্তি দিয়েই সম্পাদকের টেবিলটা নাড়িয়ে দিতে হবে।

লিটলম্যাগ নিয়ে অনেক বড় বড় কথা হয়তো হয়েছে, হচ্ছে। আমি খুব ছোট করে বুঝি, লিটলম্যাগ ছোট ছোট উদ্যোগ। তরুণরা নিজের জায়গা থেকেই এই ছোট উদ্যোগের মাধ্যমে নিজের চর্চাটাকে তুলে ধরার চেষ্টা করে। নিজেকে লেখক হিসেবে তৈরি করতে পারে। তার নতুন লেখাকে নতুন পাঠকের কাছে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়। একজন নতুন লেখক অবশ্যই দৈনিকের গৎবাঁধা সাহিত্যের হাত ধরতে নতুন উচ্চতায় উঠে আসতে পারবে না। তরুণদের লেখালেখির ক্ষেত্র অনেক এখন। বিভিন্ন ওয়েবে-ব্লগে তরুণরা নিজের মতো করে লিখতে পারছে। ব্লগের বন্ধুত্ব দিয়ে, ফেসবুকের যোগাযোগ দিয়ে সারাদেশে অসংখ্য ম্যাগ বের করা হচ্ছে। যোগাযোগের এই সরল পথে অনেকে লেখক হিসেবে তৈরি হচ্ছে। অনেকে সম্মিলিতভাবে বই করছে। পাঠকও পেয়ে যাচ্ছে সহজেই। অনেকেই শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী মানুষ পৃষ্ঠপোষকতাও করছে। সব মিলিয়ে দোয়ার তো খুলছে। আসল কাজ লেখালেখিটার জন্য মেধা-শ্রম ব্যয় করার মতো সামর্থ্য আমাদের কতজনের আছে, বিচারটা আগেই করা দরকার বন্ধুরা।

২. নতুন সনে কোন নতুন ভাবনা

বাংলা সন ফসলী সন। কৃষি ও কৃষক পর্যায়ে বাংলা সনের হিসেবকে মিলাতে পারা যায়। বাংলা সন বাঙালির আপন সন। প্রকৃতির রূপ-রস চিনতে আমরা বাংলা সন-তারিখের আশ্রয় নিই। আমাদের ঋতু বৈচিত্র্যও ভিন্ন। এই বৈচিত্র্যে আমাদের প্রকৃতির আলাদা আলাদা রূপ। ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফুল-ফল-ফসলের দেখা মেলে। এই ফুল-ফল-ফসলের ক্ষেত্রটা কৃষি। আর এই ক্ষেতে বসে যে নির্মাণে মগ্ন, সৃজনে নিবিষ্ট হয়ে আছে, সে কৃষক। ছয়টি ঋতুর রূপ-রস-রঙকে পরম মমত্বে আমাদের প্রকৃতির বিশাল ভূমিতে বসে ছবি এঁকে চলেছেন আমাদের চিত্রকরেরা। পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের উৎসব আমাদের বাঙালির আত্মার রঙ। নববর্ষের উৎসবটা আমাদের গ্রামীণ জীবনের নব প্রকৃতির অভিবাদন। যেখানে গ্রামীণ নৈসর্গিক জীবনের যোগ নেই, সেখানে বাঙালি উৎসবের এত রঙ কেনো? নগর জীবন প্রকৃতি-নির্মাণ করে গড়া ফসলী জীবন নয়। নগর জীবন ব্যবসায়িক, প্রকৃতির অপর পিঠে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে হটিয়ে প্রকৃতিকে ঠকানোর জাল ছড়িয়ে যাওয়া নিরন্তর। আমাদের কল-কারখানাগুলো আমাদের জীবন-যাপনের মৌলিক তাগিদগুলো প্রকৃতির উপাদান থেকে আহরণ করে উপযোগী করে তুলছে, কিন্তু সেগুলো শুধুই নগর জীবনের মুনাফার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। এই অবস্থানগুলো আমাদের চিত্রকরদের মতো মানবিক নয়। সৃজনশীল-মননশীল নয়, শুধুই বাণিজ্যিক।

একটি দিনকে একটি বিশেষ দিন করে তুলতে পারাটা একটা ব্যবসায়িক ফায়দার জায়গা। এক ঘেয়ে একটা জীবনকে একটু আলাদা করে বের করে দেখার চেষ্টার একটা দিন। বাহ্যিক জীবনটাকে নানান রঙে সাজিয়ে চিত্তে ও দেহে আলাদা স্বাদ গ্রহণের একটা তাগিদ ছড়িয়ে দেবার কাজটা করতে পারলেই বিশেষ বাণিজ্যিক ফায়দা তুলে নেবার একটা নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা যায়।

একটা দিনকে কতই-না রঙিন করে তোলা যায়, একটা উৎসবের শরীর থেকে কত কত রঙ ছিনিয়ে নেয়া যায়! একটা উৎসবের দিন যত মোহময়, ততোধিক সংখ্যায় মানুষ মোহগ্রস্ত। মানুষকে যত মোহগ্রস্ত করা যাবে, ততোই মুনাফা। নাগরিক জীবনের জয়ধ্বনি দিতে দিতে আমরা ঢুকে যাবো সর্বগ্রাসী ক্ষুধার্ত মুনাফার জালের ভেতর। আমাদের উৎসবকে হাতিয়ার বানিয়ে আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির ভেতরে কত সহজে ঢুকে যেতে পারছে বাণিজ্যিক রোমশ হাতগুলো। নগরে নগরে এত যে উৎসবের রং, সবই বাণিজ্যের আলোয় ছড়ানো। আমাদের বিজয়ের গানগুলো দখল করে নিতে পারছে বাতাস বিক্রেতা কোম্পানি। আমাদের খাদ্যাভ্যাস পাল্টিয়ে দিতে পারছে লুটেরা-পরগাছা সংস্কৃতি। আমাদের জীবনাচরণ আমূল বদলিয়ে দিতে পারছে ফ্যাশন আমদানীকারক ভেল্কিবাজরা। আমরা আকণ্ঠ ডুবে যাচ্ছি যাদুকরের জমাট কাদায়।

আমাদের প্রকৃতি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে। আমাদের জল, আমাদের নদী, আমাদের বনভূমি, আমাদের ফসলী জমিন, আমাদের শস্যের বীজ, আমাদের শিক্ষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের খনিজ সম্পদ, আমাদের রাজনীতি, আমাদের সাধারণ সার্বজনীন জীবন যাপন, জীবন জীবিকা, আমাদের নারীর অধিকার, আমাদের শ্রমিকের অধিকার, প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতে সতর্ক হতে পারাটা, আমাদের মুক্ত বাতাস, শিশুর তরে ও মুক্তমানুষের তরে একটু খোলা প্রান্তর, আর আমাদের আইনি অধিকারটা কতটুকু নিরাপদ? আমি কি আমার প্রাণের উৎসবকে আমার মতো করে স্নিগ্ধ, মায়াবী আর উদার আনন্দের ভেতরে বসে উপভোগ করতে পারছি? হায় নববর্ষ, আমাকে এক মুঠো নির্মল আনন্দ উপভোগের একটু সুযোগ দাও! নতুন সনে আমরা কি আমাদের নিরাপত্তার দিকটা নতুন অর্থে ভাবতে চাইবো না? শুভ হোক তোমার জন্মদিন হে ১৪১৮ সন!

৩. বাল বিড়ম্বনা

এ সময়ে টাকাওয়ালাদের পাড়ায় মাঝে মাঝেই ঢু মারতে হয়। টাকার টর্নেডোর টানে অসহায়ভাবে ঢুকে পড়তে হয় দিলকুশা বা মতিঝিলের ঘূর্ণি আবর্তের ভেতর। ঘূর্ণি আমাকে আছড়ে ফেলে, প্রাণ যায়-যায়। তো মাঝে মাঝেই যাচ্ছি যখন, পথে পথে টাকাওয়ালাদের হাতছানি। মানি এক্সচেঞ্জের বন্ধুরা সারি সারি দাঁড়িয়ে ‘এই ডলার-রিয়াল’ হাঁকে। প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত হতাম। এখন বেশ উপভোগ করি। আমার মতো মানুষের কাছে ‘ডলার-রিয়াল’ থাকার সুযোগ কোনভাবেই নেই, এটা ওরা বুঝছে না ভেবেই মনে মনে খুশি হই। একদিন একজনকে জিজ্ঞেস করি, মামু, আমার কাছে ডলার আছে, আমার চেহারা দেখে তাই মনে হয়? উত্তরে কয়, ‘কেউ কি টাকা গলায় বেঁধে হাঁটে?’ আমাদের বণিকদের লাগি পহেলা বৈশাখ চলে গেলো। আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হলও না। আমাদের সরকারি দলের অহমিকা কমলো না। আমাদের বিরোধীদলের নাদানীপনা গেলো না। আমাদের আমিনীরা কাপড় তুলে কৃঞ্চকেশ প্রদর্শন করে। আমাদের বণিকের ব্যাটা বণিকেরা আমাদের ললিপপ-বুড়োআঙুল ঢুকিয়ে দেয় আমাদের মুখে। আমাদের যুবকদের ডিজুস আর ডিজিটাল সংস্কৃতির ঝাপটাই মাথা আওলা ঝাওলা। বাজার বাণিজ্যের টাকা-টর্নেডোর ঘূর্ণিতে ঘুরছে আমাদের সকল ধ্যান-জ্ঞান, ধর্ম আর কায়াহীন ঈশ্বর। পহেলা বৈশাখের পর টাকাওয়ালাদের পাড়ায় গেছি ফের! আমার বাল মাথার চারপাশ দিয়ে ঝুলে পড়ছে। মামুরা, আমারে জেঁকে ধরলো। মাথা দুলিয়ে, হাত নেড়ে, মুখে হাসি ঝুলিয়ে ‘নাই’ শব্দটি বোঝাতে পারলাম হয়তো। আমি যখন একটা অফিসে টুকতে যাবো, এক মামু দৌড়ে এসে যেনো হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সে নিশ্চিত আমি টাকা ভাঙাবার জন্যই অফিসে ঢুকছি! তো আমি তাকে জিজ্ঞাসিলাম, তোমাদের কেনো মনে হচ্ছে আমার কাছে বৈদেশিক মুদ্রা আছেই? সে কইলো, ‘পহেলা বৈশাখ গেছে। আপনি কোন বিখ্যাত মানুষ হবেন, বিদেশ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে ফিরছেন, এমন কিছু মনে হচ্ছে।’ কেমন? ‘বাউল শিল্পী মনে লয়!’ আমি বললাম, ‘বাউলদের বাল কেটে দেয়া হচ্ছে। আর আমারে দেখে বণিকদের টাকায় লালিত-পালিত নাগরিক বাউল, বিখ্যাত টাকা পয়সাওয়ালা লোক বলে মনে হয়!’ সে লজ্জিত হয়ে বললো, ‘বাউলদের 'বাল' কাটাতে আমরা লজ্জিত। আমার এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’

বাউল হোন, বাল লম্বা রাখেন, গঞ্জিকা সেবন করেন কিন্ত বণিকদের কেনা গোলাম হয়ে যান। শালার বাউল পেটে ভাত নেই, লম্বা চুল রেখে আমাদের লুটেরা সংস্কৃতির পরোয়া না করে লোভ-লালসাহীন, অসাম্প্রদায়িক মানুষ হবার তত্ত্ব দিয়ে বেড়ায়! নেতা হিসেবে ধর্মের এ দেশীয় এজেন্ট হিসেবে আমরা কিভাবে এটা মেনে নিই? রাষ্ট্রে বসবাস করতে হলে রাষ্ট্র মানতে হবে, তার আইন মানতে হবে, এ রাষ্ট্রের মহান নেতাদের মানতে হবে। রাষ্ট্রের নিপীড়ন ও রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য টিকিয়ে রাখতে অনেক বেশি সাহায্য করে যে ধর্ম তাকে অবশ্যই মানতে হবে। ধর্মটা মানতে হবে ধর্ম ব্যবসায়ীদের মতো করেই!

আবার একদিন গেলাম দিলকুশাতে। আমার মামু, টাকা হাতে বলতাছে, ‘এই ডলার-রিয়াল’। আমি মাথা দোলাতে দোলাতে বাবরি দোলাতে দোলাতে হাঁটছি। মামু টাকা মুঠ করে ধরে গাইতাছে: ফকির লালন মরল...

৪. সমালোচনার ভাষাটা তারা নিজেরা আত্মস্থ করুক

বিশ্বমানব ও প্রাণীসকলের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অশ্লীল নয়। তেমনি লেখনীতে শব্দগত অবস্থানটাও অশ্লীল নয় কখনোই। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রদর্শন অশ্লীল কখনো কখনো। তেমনি লেখনীতে শব্দের ব্যাবহার বা উপস্থাপনটাও অশ্লীল হয়ে উঠতে পারে। পরিবেশগত অবস্থান ঠিক রেখে যৌন অঙ্গ উন্মুক্ত করা, ব্যাবহার করাটাও অশ্লীল নয়। এভাবেই বলা যায়, শব্দগত অবস্থান ও উপস্থাপন সঠিক রেখে যৌন অঙ্গকে শব্দের ব্যাবহারে উপস্থাপন করাটা অশ্লীলতাকে ঢেকে দিতে পারে। আধুনিক সৃজনশীল সাহিত্যে বিষয়-ভাবনার প্রয়োজনে যৌনতাকে অনিবার্যভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। শব্দের অবস্থান ন্যায়ত অনিবার্যতা পায়।

আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অনেকক্ষেত্রে শ্লীলতা-অশ্লীলতাকে ভিন্ন দোষ-গুণে পরিমাপ করে। একটা ছেলে যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্যান্টের জিপার খুলে লোক-চোখের সামনের হিসি করে, আমাদের চোখের অভ্যস্ততা একে অশ্লীলভাবে দেখে না। আবার একটা মেয়েকে একইভাবে উন্মুক্তস্থানে হিসি করতে দেখলে আমরা ভিরমি খাবো নিশ্চয়, আমাদের চোখ বিচার করবে অশ্লীল বলে। আমাদের ধর্মীয় বোধ, উচ্চবর্গীয় কৌলিন্যবোধ, বিশেষ শিষ্টাচারের পরিমাপে নারীর কাছে আমরা অনেক বেশি অনুগত, শালীন(?), পুরুষের একান্ত নিজস্ব ভোগ-সম্ভোগের বস্তু বলে খুবই সুরক্ষিত ও নিরাপদ নারীদেহ হিসেবে পেতে চায়। পুরুষ নারীদেহকে কমলার খোসার তল থেকে রসালো তরতাজা কোয়া হিসেবে রসাস্বাদনই করতে চায়। তাইতো সাহসী, স্বতন্ত্র ব্যক্তিস্বত্বাসম্পন্ন, স্বাধীনচেতা, পুরুষের বাহুবিচ্যূত, অনুগত নয়, সমাজের অন্যায্য শৃঙ্খল ভেঙে বের হয়ে আসা, এমন নারীকে অশালীন নারী হিসেবে দেখি। পুরুষের বহুগামিতা উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতির অহমিকা মনে করা হয়। বহুগামী নারীকে গালি দেয় বেশ্যা বলে। উন্মুক্ত নারীদেহের উচ্চারণগত শব্দগুলোকেও বিচার করছি অশ্লীল হিসেবে। ভাষাকে গ্রহণ ও ত্যাগ করার মধ্যেও একজন মানুষের নিজস্ব সমাজ ভাবনার দৈন্যতা বা প্রাপ্যতা প্রকাশ পায়।

মানুষের আনন্দ-উল্লাসের ভাষা যেমন আলাদা ক্ষোভ-হতাশার ভাষাও তেমনি আলাদা হবে। উচ্চবর্গের জীবনাচরণ-সংস্কৃতি যেমন আলাদা, নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবনাচরণকেন্দ্রীক ভাষা আলাদা। নিম্নবর্গের মানুষের ক্ষোভ-হতাশার ভাষা তাদের বেঁচে থাকার নতুন প্রেরণা, তাদের ভাষাটাই স্বতন্ত্র শক্তি।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্র নিপীড়ন করে, গণমানুষের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ধনিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে চলে। শ্রেণীস্বার্ধ রক্ষা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের সম্পদ প্রভু রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়। বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে, গুম করে। ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করে। একজন শ্রেণী সচেতন বঞ্চিত মানুষ কোন পক্ষে দাঁড়াবে? দাঁড়াবে তার শ্রেণীর পক্ষে। আমি আমার শ্রেণীর পক্ষে দাঁড়িয়েই কথা বলতে চাই। আমি আমার অত্যাচারী শক্তির বিপক্ষে কথা বলতে চাই। আমার ভাষা ক্ষোভের, বিক্ষোভের। আমার বিক্ষুব্ধ ভাষা দিয়েই আঘাত হানতে চাই। এই আঘাতে রক্তাক্ত হবে কারা? এই আঘাত পেয়ে পাল্টা আঘাত করতে আসবে কারা? তারা শ্রেণী সচেতন, নিপীড়ক শক্তি।

শব্দনীড় ব্লগে ‘বাল বিড়ম্বনা’ শিরোনামে যে পোস্ট দিয়েছি, সেটাতে আমার শ্রেণীর পক্ষ হয়ে ক্ষোভ-হতাশাকে প্রকাশ করতে চেয়েছি। আবার আঘাত করতে চেয়েছি নিপীড়ক রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহদেরকে। এখানে ভাষাই তো প্রধান। ভাষাই তো অস্ত্র। এই বক্তব্যগুলো অবশ্যই এই পুলিশী রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহদের স্বস্তির কারণ হতে পারে না। শব্দনীড় ব্লগ আমার কাছে শ্রেণী চরিত্রের জায়গায় স্পষ্ট মনে হয়েছে। শব্দনীড়কে ধন্যবাদ দিই, তারা খোলসে নিজেকে ঢেকে রাখার ভণিতা করেনি। তারা মুক্তবুদ্ধির চর্চার জায়গাতে শুধু তাদের স্বার্থটাই রক্ষা করে চলছে। বাল শব্দটা বিষয়-ভাবনার সাথে মিলিয়ে দেখলে কখনই আপত্তিকর নয়। বাল ক্ষোভ-হতাশার ভাষা হয়ে উঠেছে এখানে। এখানে বাল শব্দটা আপত্তির হতে পারে না, যদি বিষয়-ভাবনাটা আমি গ্রহণ করি। আর না গ্রহণ করতে পারাটাই আপত্তির কারণ।

নতুন নতুন ব্লগের জন্ম হচ্ছে। নতুন লেখিয়ে সস্তা জায়গা পেয়ে বন্ধুদের দেখাদেখি দু’এক লাইল লেখার চেষ্টা করছে। এটা তাদের কাছে নিছক ফুর্তির জায়গা। হয়তো কিছুটা আড্ডার জায়গাও। নতুন চিন্তাকে যারা পাত্তা দিতে চায় না, থাকুক না তার নিছক ফুর্তি, আনন্দ নিয়ে! যাদের কাছে রাজনীতি মানে লুটপাটের সুযোগ নেওয়া। সাহিত্য-সংস্কৃতি মানে ফুর্তি-আনন্দ বিনোদনের মাঝে মত্ত হয়ে থাকতে পারা। যারা বাপের টাকায় সার্টিফিকেট কেনে বলে দেশ-জনসাধারণের প্রতি কোন দায় অনুভব করে না। থাকুক তারা বাপের স্বার্থ নিয়ে। সমালোচনার ভাষাটা তারা নিজেরা আত্মস্থ করুক।

৫. পাখি সব করে রব

শুধু ব্লগিং দিয়ে যারা লেখালেখিতে সেধিয়ে যেতে চেয়েছে, তারা দু' একজন লেখক হতে পেরেছে কিনা জানি না। তারা ব্লগিংয়ের আশ্রয় করে দু' একটা কাগজ বের করার চেষ্টা করছে।লেখালেখির মূলধারায় ভিড়তে চাইছে। এটা প্রথম প্রথম ভালো চোখে দেখার চেষ্ট করেছি। এখন দেখি তারা মুলধারা লেখকদের অবমূল্যায়নের প্রয়াস চালায়। তাদেরকে নিজ কাতারে নামিয়ে নিয়ে এসে নানা রকম ভেংচি কাটে। নোংরামী ছড়ায়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ ধরনের ব্লগার প্রজাতির লেখকদের থেকে ১০০ হাত দূরে থাকবো।তাদেরকে লেখা দেয়া বা লেখালেখি কেন্দ্রিক কোন প্রকার সাহায্য করতে যাওয়া বিণয়ের সাথে এড়িয়ে যাবো।তারা কার পৃষ্ঠপোষকতায়, কি উদ্দেশ্যে লেখালেখির চর্চাটাতে সম্পৃক্ত হতে চাই, আমার কাছে পরিষ্কার নয়।তাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থানটা অস্পষ্ট। কখনো কখনো ছদ্মাবরণে ঢাকা।তাইতো তারা বিপদজনকও।

ব্লগটা লিটলম্যাগের বিকল্প হতে পারতো; হলে খুব কর্যকর, ধারালো, অনায়সসাধ্য ও অনেকটা নিখরচায় হতো। সময়টা বাঁচতো, অংশ গ্রহন করাটা সার্বজনিন, বিপুল সংখ্যাই হতো। একটা স্বত:স্ফূর্ত সমাবেশ ঘটে ব্লগকে ঘিরে। যে যেখানে আছেন, তার লেখাটা সেখান থেকেই পোষ্ট করছেন।একটা বড় সংখ্যার পাঠকের কাছে তাৎক্ষণিক পৌঁছে যাচ্ছে। পাঠক পাঠ করছেন। তার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরছেন। সব পাঠকই একে অপরের সাথে ভাবনা-প্রতিক্রিয়া বিনিময় করছেন। লেখককের সাথে আলোচনায় অংশ গ্রহন করছেন। লেখক তাৎক্ষণিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হচ্ছেন। খুব মজার ও উপভোগ করার মতো ব্যাপার! ব্লগটা যদি লিটলম্যাগের বিকল্প হতো তবে আমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চার স্তর, আমাদের পাঠকের মান, আমাদের চেতনার মান, আমাদের মুক্তবুদ্ধির চর্চার মান, আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের পর্যায় অনেক অনেক গুণ বেড়ে যেতো। আমাদের লিটলম্যাগের জায়গা থেকে ব্লগের ব্যাপ্তি অনেক গুণ বেশি। সেই অর্থে ব্লগিংয়ের সামাজিক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারতো।কিন্তু ব্লগ সেই গুরুত্বের জায়গাটা পায় নি।২/১টা ব্লগ বাদে খুবই নিম্নমানের ব্লগিং হয়। ব্লগারদের মান তো কোন ধরণের মানদন্ডে মিলানো যাচ্ছে না। ব্লগারদের পাঠ, মুক্তচিন্তার প্রস্তুতি, রাজনৈতিক একটা বিশেষ চেতনার জায়গায়, নিছক শিল্পের জন্য শিল্পের জায়গাতেও তারা খুবই প্রাথমিক স্তরেই পড়ে আছে। সমাজ মূল্যায়ন ও অগ্রসর জীবনপাঠের নতুন অধ্যায়কে উল্টে-পাল্টে দেখতে পারার মতো উচ্চমান ধারণ করার মতো ব্লগার বা লেখককে কল্পনায় আনা যায় না। নতুন নতুন ব্লগ তৈরি হচ্ছে ব্লগার কি তৈরি হচ্ছে? আবার একজন ব্লগার পরিণত লেখক হয়ে ওঠার পরও কি তিনি আর ব্লগে লিখবেন? লেখার সময়-সাধ্য-সুযোগ কি তিনি পাবেন? খুব কম সংখ্যক ব্লগারের নিয়মিত পাঠ্যাভ্যাস আছে। আর বাকী সব করে রব রাতি পোহাইলো...। ভালো মানের ব্লগিং উপহার কে দেবে? ব্লগারাই! তাহলে ভালো মানের ব্লগার থাকতে হবে ব্লগে। ভালো মানের ব্লগার কেমনে থাকবে? তার লেখা নিয়ে আলোচনার মানুষ যদি না থাকে, তার ভাবনাকে যদি উল্টো ব্যাখ্যা করে দাবড়ানি দেয়া হয়, তার সমকক্ষ ব্লগিং সক্ষমতার মানুষ ২/১ জন যদি না থাকে, তাহলে সে কেমনে থাকবে? তাইতো ২/১ টা ব্লগ বাদে সব ব্লগেই পাখি সব করে রব। একজন ভালো ব্লগার শুধু দিতেই চাইবে না, কিছু নিতেও চাইবে। আমাদের কতজনের দেবার সাধ্য আছে? আমাদের বাংলা ব্লগিংয়ের বয়স বেশি দিনের নয়, অনেক বড় কিছু আশা করারও নাই। কিন্ত আশা করার আছে, দিন দিন ব্লগিং মানের উন্নতিটাকে। কিন্ত আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। গ্রুপবাজি, গলাবাজি, গালিবাজি, ব্যাক্তিক মানুষের ব্যাক্তিক লাভ-লোকসানের হিসেব মেলানো। এইসব প্রাপ্তীর যোগফল পাখি সব করে রব!

ব্লগকে কি আন্দোলনের জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব? হ্যা সম্ভব। যারা সমাজের সার্বিক স্তরে একটা সঠিক আন্দোলনের পথ খুঁজে ফিরছেন, তাদেরকে এক জায়গায় মিলিয়ে দিতে পারাটা দরকার। এমন একটা ব্লগের জায়গা হয়তো নির্মাণ হতে যাচ্ছে। আবার বলা যায়, ব্লগকে আন্দোলনের জায়গায়, মুক্তবুদ্ধির চর্চার জায়গায় নিয়ে যাওয়া কখনই সম্ভব নয়। আমাদের রাষ্ট্র বিশেষ কয়েকজন মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে চলে। আর বাদবাকী মানুষের জন্য বন্দুক তাক করে বসে থাকে। তারা তাদের পক্ষে গণমানুষের পক্ষে বসে নিজেদের সাধ আর সাধ্যের ব্যাবধান খুঁজবেন, নিজেদের মুক্তির পথ নির্র্মাণ করবেন, রাষ্ট্র বসে বসে আঙুল চুষবেন, সেটা তো হতে পারে না। ব্লগের মালিক কারা? ধনিক শ্রেণী, প্রভুভক্তেরা, নিবোর্ধ আর অন্ধ অনুসারী, তোষামোদকারী, চাটুকরেরা! নীতিমালা তৈরী করেছেন, একদল পেটোয়া বাহিনী আছে ব্লগের তদারকিতে। শব্দ টিপে টিপে দেখে কোথাও র্দূগন্ধ বের হয় কিনা! মুক্তবুদ্ধির চর্চা হওয়া তো দূরের কথা! একদল নিবোর্ধের ব্লগে ব্লগে তালি দিয়ে যায়। জিন্দাবাদ আর জয় জয় ধ্বনি, রিয়াল-দিনার-ডলারের বিনিময়ে ক্ষমতার ভাগ পাওয়া যায়! সবখানে উন্মাদের ধেই ধেই নাচ। ফূর্তি করো ভোগে মত্ত থাকো। ব্লগকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে? সময়ের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখা, চেয়ে চেয়ে থাকা। আহা, পাখি সব করে রব!

জল পড়ে পাতা নড়ে বলেই কি আমি ব্লগিং করি? আমি কেনো ব্লগিং করি? অথবা আমি কেমন বেঁচে আছি, কেন বেঁচে আছি?

আমরা সভ্য মানুষ

দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য

বারান্দায় জানলাটা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম রাস্তাটার দিকে। ব্যস্ত শহর। হাজার হাজার গাড়ী আলো জ্বালিয়ে ছুটে চলেছে গন্তব্যে। এক পলকে দেখতে দেখতে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম কোথায়। মনটা হঠাৎ ভারী হয়ে আসতে লাগল। চোখের সামনে হঠাৎ যেন দেখতে পেলাম কয়েকজন মানুষ হেঁটে এগিয়ে আসছে। তাদের মাঝখানে আমি। তারা ভাসতে ভাসতে যেন আমার সামনে এসে দাঁড়াল।সকলে পা মুড়ে বসলো আমার সামনেটাতেই। আমিও বসলাম। মানে সেই আমার সামনের আমি। হাঁটু মুড়ে বসে আমি বলতে লাগলাম এই পৃথিবীর উদ্দেশ্যে,এই মাটির,এই বাতাস এই জলের উদ্দেশ্যে। কি বলছি আমি? আরও মন দিয়ে শুনতে লাগলাম- হে পৃথিবী,আজ আমরা তোমার সামনে conface করছি,আমরা তোমার অপরাধী। আমাদের তুমি শাস্তি দাও। আমরা মানুষ তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। সেই জন্মের মুহূর্ত থেকে,তোমার কত অক্সিজেন ধার করেছি,কত জল পান করেছি, তোমার ওপর ভর দয়ে হেঁটেছি,খেলেছি,ছুটেছি। কিন্তু তুমি তো কিছু বলোনি কখনও। দাম চাওনিতো কখনও।এখন জল চাইলেও টাকা লাগে। তোমার থেকে কত গ্যালনই না জল নিলাম। কিছুতো চাইলে না। অক্সিজেনের দাম লাগে আমাদের হসপিটাল নার্সিং হোমে। তোমার থেকে কত সিলিন্ডার যে অক্সিজেন নিলাম। এক টাকাও নিলে না। তবে অবশ্য নেবেই বা কেন,চাইবেই বা কেন। টাকার যে কি মূল্য তা তো তুমি জানই।কারণ "টাকা মাটি মাটি টাকা", আর এই মাটিই যে তোমারই গো। কিন্তু আমরা তোমাকে কি দিয়ে এই বিরাট ঋণ শোধ করি? আমরা তোমাকে কি দিয়েছি? আমাদের বর্জ্য পদার্থ,মলমূত্র,শ্লেষ্মা,অক্সিজেনের বিনিময়ে কার্বনডাই অক্সাইড,আর? আমরা মানুষ। না না,আমরা উন্নত বুদ্ধিজীবী মানুষ। আমরা থাকার জন্য ঘর বানিয়েছি তোমার বুকে দাগ দিয়ে। তোমার ওই যে আকাশ, যে আকাশে একসময় প্রাণ খুলে উড়ে বেড়াত হাজার হাজার পাখি,তারা প্রাণ বাঁচাতে,ঘর বাঁচাতে কোথায় চলে গেছে। কি করি বল, আমরা উন্নত সভ্যতার মানুষ, তাদের আবর্জনা যে আমাদের কাম্য নয়। আমরা কত বড়ো বড়ো কারখানা বানিয়েছি দেখ। কত উন্নত প্রযুক্তি। কিন্তু দুঃখিত গো,ওই কালো ধোঁয়া মিশিয়েছি তোমারই সেই বাতাসে,যা তুমি বিনি পয়সায় আমাদের দিয়ে গেছো এবং আজও যাচ্ছ বাঁচার জন্য। তবে......তবে আর কতদিন দিয়ে যেতে পারবে জানিনা। আমাদের উন্নতি যেভাবে বাড়ছে। জানি ওই সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির হাত থেকে বাঁচিয়েছো তোমার ওজন দিয়ে। না না ওজন মানে weight নয় গো। ওজন গ্যাস। দেখ আমরা কত কিছু শিখে গেছি। এটাও আবিষ্কার করতে পেরেছি। তুমি না জানানো সত্ত্বেও। কিন্তু এত শিখেও একটা ভুল হয়েছো জানো। তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমার দেওয়া সেই সুরক্ষা ভেঙে ফেলতে শুরু করেছি। তুমি চেষ্টা করে যাচ্ছ তোমার সন্তানদের বাঁচাতে, আপ্রাণ চেষ্টা করছো। কিন্তু.....সন্তানরা যদি মার কথা না

মানে। মা কি করে বল। সন্তান যে উন্নত গো, শিক্ষিত। ওই যে পাখিদের কথা বলছিলাম, চড়ুই গুলো কোথায় চলে গেল। কি করি বল, দূরত্ব যে কমাতে হবে, পরস্পরকে কাছে আনতে হবে। শিক্ষিত মানুষ যে আমরা। তাতে যদি প্রাণী সম্প্রদায় মরে,মরুক। মোবাইল বানিয়েছি গো আমরা। বড় বড় টাওয়ার, যেগুলো তোমার বুকে পুঁতেছি শূলের মতন, সেই টাওয়ার মারছে চড়ূই। কি করে? ইস। সে তুমি বুঝবে না গো।অনেক পড়াশুনো লাগবে।আমরা শিক্ষিত, তাই বুঝি। জানো, সেদিন ফসল মাঠের পাশ দিয়ে আসছিলাম।ফসলগুলো যেন কেঁদে কেঁদে বলল আমাদের সুস্থ মাটি সুস্থ জল দাও। আমাদের হরমোনের ইনজেকসন দিয়ে please মোটা করোনা। দম আটকে আসে। আর দেখো ওই যে জলের কথা বলুছিলাম শুরুতে, আমরাই তোমার পরিশুদ্ধ জলের সব শুদ্ধতা কেড়ে নিচ্ছি। কি করবো,রা সায়ানিক সার দিলে ফসল বেশী বড় বেশী ভাল হলে বেশী টাকা আসবে। সেটাই তো আসল আমাদের কাছে। তোমার জল তাতে একটু খারাপ হলে হোক। তুমি নিজেই শুদ্ধ করে দিও। এতদিন করেও আসছো। কত ভাল গো তুমি। এত অপরিষ্কার জলও যখন বাস্প করে ছড়াও বারিধারা, আহা, কি সুন্দর সেই জল।একটুও বিষ মিশে থাকে না। কি করে যে কর। sorry গো। তখন বলছিলাম,আমরা শিক্ষিত, তুমি বুঝবে না, এত দেখছি তুমি আমাদের থেকে অনেক অনেক বেশী শিক্ষিত। আমরা নোংরা করছি আর তুমি আমাদের দোষ মাফ করে যাচ্ছ। যতটা পারছো শুধরে নিয়ে আমাদের বাঁচার ব্যবস্থা করে চলেছো। কিন্তু কতদিন পারবে ?তোমার ভেতর থেকে লোহা,কয়লা,তেল,সোনা রূপা যা পেয়েছি সবই কেড়ে নিয়েছি নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। কি করব বল, সভ্যতা উন্নত করতে এসব তো লাগবেই। কিন্তু ভেবোনা সব তুমিই পাবে,এ যে তোমারই সম্পদ। কেউ নিয়ে নিতে পারবে না। আরে যতই ক্ষমতা হোক আমাদের যতই শিক্ষিত হই, মৃত্যুকে তো পারিনি জয় করতে। মরবো তো সকলেই একদিন। ওই যে কেড়ে নিলাম সোনা, নিয়ে তো যেতে পারবোনা একটুকরোও। সবই তোমার। আমরা তো বোকার মত এটা আমার ওটা আমার করে মরি। কাড়াকাড়ি,মারামারি,খুনোখুনি করি। তাতেও তোমার বুকের ওপর নানা অপরাধে মেতে উঠি। কত বোকা না আমরা,ইস। তুমিই বুঝবে গো তোমার এই সন্তানরা কি মানুষ হয়েছে। তুমি চেয়েছিলে কিন্তু মানুষ করতে।আরে আমরা তো মানুষই, শিক্ষিত সভ্য মানুষ।

আজ আমরা বুঝেছি নিজেদের দোষ,অপরাধ। কিন্তু আজ যে কিছু করার নেই। এতদিনের এত ক্ষয়ক্ষতি কি শোধরানো যায়? শুধু অনুশোচনা,আত্মসমালোচনা আর ক্ষমাভিক্ষা। আর যে কিছুই করার নেই। পারলে আমাদের ক্ষমা করো। হয়তো ভাবছো আমাদের তোমার বুকে ঠাঁই দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। হয়তো তাই সত্যি। জন্তুগুলো আমাদের মত উন্নত নয়,শিক্ষিত তো নয়ই। তারাও কিন্তু এই জল,মাটি এতকিছুকে এভাবে অপব্যভার করতে পারেনি যা আমরা করেছি। কি করবো বল,সভ্যতাকে যে উন্নত করতে হবে। কিন্তু সত্যি আজ আমরা দঃখিত। তাই আজ আমরা এসব বললাম। নিজেদের অনেক হাল্কা লাগছে হে পৃথিবী। কি ভাবছো? একটু হলেও এবার মানুষ হতে পেরেছি না? সভ্য,শিক্ষিত মানুষ?

লিটলম্যাগ, ওয়েবম্যাগ, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ও বিকল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে সুশান্ত কর এর দুইটি লেখা

পূর্বোত্তরের বাংলা সাহিত্য এবং বিকল্প প্রতিষ্ঠানের খোঁজ

( ৩১ মার্চ, ২০১১ গুয়াহাটির কটন কলেজের বাংলা বিভাগে  দেবার জন্যে তৈরি বক্তৃতা) 

পূর্বোত্তরের বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমার অধ্যয়ন বড় বিচ্ছিন্ন। এর কোনো ধারাবাহিকতা নেই, নেই কোনো মনোযোগ। কৈশোরের সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা আমাকে শেষটায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নানা সমাজতাত্বিক জিজ্ঞাসার সামনে। সেসব জিজ্ঞাসা আমাকে এতো ব্যস্ত করে রাখে যে সাহিত্যের অধ্যাপনাটা আমার পেশা হলেও নেশা হতে পারে নি, সাহিত্য কর্মতো নয়ই। সুতরাং সাহিত্যের তত্ব আর তথ্য নিয়ে আমার অজ্ঞতাকে আপনারা নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। আমাকে এমন এক বিদ্বজ্জন সমাজে টেনে এনে যে সম্মান উদ্যোক্তারা দিলেন তার ভার বহন করবার যোগ্যতা আমার কতটুকু রয়েছে সেই নিয়েও আমার সন্দেহ বেশ গভীর।

                    

সাহিত্য নিয়ে আমার সমাজতাত্বিক জিজ্ঞাসাগুলোও এমন বিধঘুটে যে যারা শুনেন তাঁরা বিশেষ উত্তর দিতে চান না। নতুবা ক্ষমা ঘেন্না করে দেন আর কি। সাহিত্যর বহু প্রচলিত প্রশ্ন যেগুলো ইউরোপীয় তাত্বিকেরা দশকওয়ারি হিসেবে উৎপাদন করেন, এবং আমাদের কলকাতার তাত্বিকেরা সেগুলো পরিস্রুত করে ভারতের বাজারে অথবা 'নাবাজারে' চালান দেন, সেগুলো আমার কিছু কিছু জানা আছে। কিন্তু এর কোনোটাই যে আমাদের পূর্বোত্তর ভারতের কবি-লিখিয়েদের মৌলিক সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পেরেছে আমি দেখিনি। ব্যাপরটি আমাকে হতাশ করেছে বহুদিন। আমাদের লেখকেদের অনেক সময় পূর্বোত্তরের পশ্চাদপদতা তার জাতিগত ভেদবিভেদ নিয়ে বেশ চিন্তিত হাহাকার করতে দেখি। কিন্তু, সেই পশ্চাদপদতার জন্যে শিল্পকর্মের কোনো সমস্যা হচ্ছে এই সত্য মানতে বেশিরভাগ লেখক এক্কেবারেই নারাজ। তাঁদের কথা হচ্ছে ভালো লিখলে তার পাঠক আছে। সে লেখক হোন নগরের কিম্বা পর্বত অরণ্যের। এই ধারণা যে একেবারেই অসত্য তা হয়তো নয়, কেননা তাঁদের অনেকেরই স্বদেশ বা বিদেশে বা অন্যপ্রদেশে লেখা বেরোয়। কিন্তু, আমি যখন আমার ছাত্রদের ওদের কথা জিজ্ঞেস করি, ছাত্রেরা কিচ্ছুটি জানে না। আমি যখন আমার সহকর্মীদের তাঁদের কথা জিজ্ঞেস করি, দেখি তাঁরা জানেন না। যখন বন্ধুদের জিজ্ঞেস করি, দেখি তাঁরা জানেন না। প্রতিবেশি রাজ্যের রাজধানী যাকে লোকে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির পীঠ বলে সেখানকার বন্ধুদের গিয়েও জিজ্ঞেস করি দেখি তাঁরা জানেন না। কেউ জানে না, কেউ চেনে না। হাত গুনা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে। গেল দু'বছরে বাংলার প্রধান কেন্দ্রটি থেকে যারাই এই উপত্যকার নানা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসছেন, আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি এরা প্রায় প্রত্যেকে বলেছেন এখানকার লেখালেখি সম্পর্কে তাঁরা বিশেষ কিছু জানেন না। 'দেশে'র মতো কাগজ যার এই অঞ্চলে আছে এক বিশাল বাজার তার সম্পাদক শিলচরে গিয়ে অবাক হয়ে গেছেন এতো কাগজ এখানে বেরোয় দেখে, এতো লোকে এখানে লেখে দেখে। এই সংবাদগুলো আমরা সব্বাই এখানকার কাগজেই পড়েছি। মহাশ্বেতা দেবীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রণাম করতে গেলে আমাদের শ্রদ্ধেয় মাষ্টার মশাই উষারঞ্জন যেভাবে প্রত্যাখাত হয়েছেন, সেই সংবাদ 'ব্যতিক্রমে' পড়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত বোধ করে একা একা হজম করে চুপচাপ বসেছিলাম। কারণ মহাশ্বেতা মহান লেখিকা আর আমাদের মাষ্টার মশাই কেউ না কিচ্ছুটি না। এইতো সাধারণ্যে ধারণা ! আমার মনে আছে ইনি যখন অনুবাদ সাহিত্যে সাহিত্য একাদেমী পান তখন আমার জেলার বহু সহকর্মী বাংলার অধ্যাপকদের শুরুতে বিশ্বাসই করাতে পারিনি। ভাবখানা এই যে ছোঁড়া বলে কি! অসমের কোনো বাঙালি আবার সাহিত্য একাদেমী পায় বুঝি!

                    

এই কথাগুলো যদি শিলচরে উচ্চারণ করতাম, আমি জানি এতোক্ষণে 'প্রতিষ্ঠান' বলে একটা শব্দ অনেকের মনে দানা বেঁধে খোঁচাখোঁচি করতে শুরু করত। গুয়াহাটিতে বোধহয় যতদূর জানি 'প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা'র লড়াইটা তত জোরালো নয়। যারা সেই লড়াইয়ের সৈনিক তাঁরা নিশ্চিত এই প্রশ্ন করতেন, এই সব প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন নিয়ে আমার জিজ্ঞাসার পেছনে মোহটা কিসের? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতেও রুচি হয় না। নিজের ভাষা সাহিত্যের প্রচার প্রসার চাইতে যাওয়াটা লজ্জাটা কোথায় সেকথাটাই আজো বুঝে উঠতে পারি নি।

পূর্বোত্তর ভারত, বাকি ভারত বা বাংলাদেশের বেশ কিছু ছোট কাগজ আর অত্যন্ত ভালো কিন্তু সাধারণ্যে স্বল্প পরিচিত লেখকেরা যে পরষ্পরকে চেনেন , সে আমাদের জানা আছে। আমাদের এও জানা আছে, ভালো লেখক আর ভালো লেখার বিচার করে কোনো কাগজের সম্পাদক কিম্বা প্রতিষ্ঠান নয়, কাল, মহাকাল। কিন্তু এহ বাহ্য!

একবার এক ছাত্রীর মুখে শুনেছিলাম, সে জীবনানন্দ দাসের উপর খুব তথ্যবহুল এক প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে বলছে, “আমরা যারা বাংলাদেশে জন্মেছি...।” 'রূপসী বাংলা'র মতো মহৎ কবিতার কবিকে খুব বেশি করে পড়বার আর আমাদের কবিকে একেবারেই না পড়বার বিপদ হচ্ছে যে আমরা আমাদের ছাত্রদের এই বোধটুকুও দিতে পারছিনা যে সে বাংলাদেশে জন্মায় নি! দেখুন বিপদ। তার পর আর আমাদের অধ্যাপনা নেশা হয়ে দাঁড়ায় কী করে! আমাদের পাঠ্যক্রমেও যে এখানকার রচনাবলী এসে ঢুকবে তার জন্যে আগে মাস্টারমশাইদের সেইসব লেখককুলের কথা জানতে হবে তো।

                       আমাদের যারা প্রতিষ্ঠানের বিরোধীতা করবার মন্ত্রে সেই কৈশোরে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরা যে কখনো এই বিপদের দিকটা নিয়ে বিশেষ ভেবেছেন, এমনটি দেখিনি । বস্তুত তাদের নিজেদের 'প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা'র তত্ব কতটা স্বদেশী ছিল আর কতটা বিদেশী, কতটা এই প্রদেশের আর কতটা তাদের কল্পিত জন্মভূমি 'বাংলাদেশের' এই প্রশ্নও আজ তোলাই যায়। তাদের চোখের সামনে প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচুর থেকে উঁচু করে গেছে, আর নিজেরা তাঁরা একের পর এক মাথা নত করে করে পথ ছেড়ে ছেড়ে সরে গেছেন। হেরেছেন তবু যুদ্ধ ছাড়েন নি। কোনো বিকল্প প্রতিষ্ঠান দিয়ে যার বিরোধীতা করছিলেন তাকে প্রত্যহ্বান জানাতে পারেন নি। প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার কথা এলেই সাহিত্যের বামপন্থার কথা এসেই যায়। বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়া নিয়ে গোটা বিশ শতকে এই পূর্বোত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ধ্যান ধারণা ছিল না । 'সাহিত্যের' মতো কিছু ছোট ছোট ব্যতিক্রম রয়েছে। সেগুলোর সমস্ত অবদান স্বীকার করেও বলছি, সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠানের টিকিটি এরা কেউ নাড়াতে পারেন নি।

প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের অনেকেই নিজেদের বামপন্থী পরিচয় নিয়ে গৌরব বোধ করেন। কিন্তু এদের এই অবস্থানের সঙ্গে পোস্টমডার্নদের অবস্থানের মূলগত কোনো বিরোধ নেই। পোস্টমডার্নরা যেমন বলেন ‘গ্র্যান্ডন্যারেটিভ’ আর সম্ভব নয়—এরা সেটি বলছিলেন অন্যভাষায় অন্য চিহ্ন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। যেমন ধরুন, ‘দেশ-আনন্দবাজারে’র বিকল্প এরা দাঁড় করাচ্ছিলেন ‘লিটিলম্যাগ।’ সে আরো মারাত্মক! লিটিলম্যাগ হতেই পারে। কিন্তু সে একে আন্দোলনের আদর্শ করে ফেলাটা বড় বিভ্রান্তিকর। পশ্চিমবাংলাতে যে ঢাউস আকারের তিনচারশ টাকার লিটিল ম্যাগাজিনগুলোতে বহু পড়াশোনা করা বিদ্বজ্জনেরা লেখেন তেমন কাগজ করার সাহস করা শিলচর-গুয়াহাটি-আগরতলাতে বেশ বিপদ আছে। আর কিনে পড়তে গেলেও যে বেকার ছেলেটি ট্যুশন পড়িয়ে মাসের শেষে শ’তিনেক টাকা রোজগার করে তার বুকে লাগবে; আর খোঁজে পেতে গেলেও তাকে বেশ পড়াশোনা করা ছেলে হতে হবে। তার জন্যে সে শুধু পাকা মাইনের চাকরি পাবার স্বপ্ন দেখে দিন গুনতে পারে। কিন্তু চাইলেই পান কিনতে গিয়ে একটা ‘দেশ’ পত্রিকা কিনে বাড়ি চলে যেতে পারে। এইখানেই লিটিল মেগাজিনের ব্যর্থতা। এর আছে গোষ্ঠী চরিত্র, কোনো গণ চরিত্র আদৌ নেই। যদিও অনেকে লিটিম্যাগের সাহিত্যকেই বলেন জনতার সাহিত্য।

                   আমাদের ছেলেবেলা 'দেশ আনন্দবাজারে’র বিরুদ্ধে বাম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আকছার গালিগালাজ শুনেছি। আজকাল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও আনন্দবাজার-আজকালের ব্যবসা তেমন চলে বলে মনে হয় না, বরাক উপত্যকাতেতো একেবারেই না। আজকাল গোটা অসমে বাংলা ছোটকাগজের সংখ্যা ৭৭টিরও বেশি। তথ্যটি আমি দিচ্ছি প্রবন্ধের কাগজ ‘নাইন্থ কলাম’ থেকে। পূর্বোত্তরে সংখ্যাটি ১১৮ বা তারো বেশি। এগুলো আনন্দবাজারকে ঠেলে বের করতে পারেনি। করেছে যে দশ বারোটি রঙিন চকচকে বাংলা কাগজ বেরোয় গুয়াহাটি, ডিব্রুগড়, শিলচর, করিমগঞ্জ, ধর্মনগর, আগরতলা এবং শিলং শহর থেকে—তারা । এবং সম্ভবতঃ গেল দু’বছরে গুয়াহাটি শহর থেকে ‘ব্যতিক্রম’ বা ‘অন্যদেশ’ নামের কাগজগুলো যে দুর্দণ্ড প্রতাপে আমাদের ভাবনাগুলোকে ভাষা দিতে শুরু করেছে তাতে শীঘ্রই ‘দেশ-নবকল্লোলে’র মতো কাগজগুলোও এখান থেকে হয় পাততাড়ি গোটাতে শুরু করবে, নতুবা দৈনিক সকলাবেলার মতো এক পূর্বোত্তরীয় সংস্করণ বের করে টিকে থাকতে হবে। 'ব্যতিক্রম' এখানকার এক বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও বটে। তেমনি নাম নিতে পারি ত্রিপুরার অক্ষর প্রকাশনীর। এই এরা সাহিত্যের জন্যে যে পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছেন, তাতেই লিটিলম্যাগগুলোও বাড়ছে এতো দ্রুত লয়ে। নইলে 'নগর কলকাতা'র 'বাম'পন্থার রপ্তানী করা 'প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা'র তত্ব এতোদিন আমাদের পথে বসিয়ে রেখেছিল। একেও তাই আমার মনে হয় আরো এক 'প্রতিষ্ঠান' যার ক্ষয় অবধারিত । আগর তলা থেকে প্রকাশিত 'কাগজের নৌকো'তে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি বন্ধু অমিতাভ দেব চৌধুরী গেলবছরে লিখছিলেন, “...আজকের সমাজে অনেকে নিজের প্রতিবাদী কিম্বা দায়বদ্ধ চরিত্র অটুট রাখার জন্যেই মুখিয়ে থাকেন। দায়বদ্ধতা কিম্বা প্রতিবাদও, এখানে এসে পণ্য হয়ে উঠে। হ্যাঁ, অবশ্যই ব্যক্তির ভাবমূর্তীর চাপে।” এই কথাতে আমরা আবার পরে আসছি।

এই যে স্থান-কাল পাল্টালে শব্দগুলোর মানের বদল ঘটে যাচ্ছে, বা কিছু মানেকে সচেতনভাবে রক্ষা করা কিম্বা অন্তর্ঘাত করবার প্রয়াস হচ্ছে একে নাম দিতে পারি 'চিহ্নায়ন' প্রক্রিয়া। কথাগুলো বললেই 'আধুনিকোত্তরবাদে'র কথা মনে পড়ে যায়। । আমরা যে এক ক্রম সম্প্রসারণমান আবিচ্ছিন্ন অথচ বিশৃঙ্খল বিশ্বে বাস করি--এ নিয়ে কোনো সংশয় থাকা উচিৎ নয়, একে শুধু বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। ব্যাপারটা এখন ইন্টারনেটের যুগে অনেক প্রত্যক্ষ। তাই ফরাসী বা বিলেতিরা আধুনিকোত্তরবাদের জন্ম দিয়েছে আর বলছে এখন আর কোনো 'মহা আখ্যান' গড়ে তোলা সম্ভব নয়।আমাদের আগেকার 'প্রতিষ্ঠান বিরোধী'রা তাতে চোখে চড়ক গাছ দেখছেন আর সউৎসাহে সে দলে যোগ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন।

               কিন্তু, আমার নিজের প্রায়ই সগৌরবে মনে হয়, আমরাতো এখনো 'রামায়ণে'র যুগে বাস করি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের 'মহাআখ্যান'--কবে ফুরোবেন কেউ জানি না। দেরিদা-ফুকো--লাকারা ফুরিয়ে যাবেন। আমরা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ি। কিন্তু, যদি শুধু 'রামায়ণে'র কিম্বা 'কোরানে'র কিম্বা তথাকথিত মধ্যযুগের 'চন্ডীমঙ্গলে'র ইতিহাস ভালো করে পড়তে পারতাম --কী করে সেগুলো রূপান্তরিত, পুনঃসৃজিত হচ্ছে, কারা পড়ছেন, দেখছেন শুনছেন এবং কোথায় কোন কোন ভাষাতে--তবে চিহ্ন বিজ্ঞানের জনক আমরা হতে পারতাম। হইনি, তার কারণ 'বিলেত' বলে যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে সে আবার 'নগর কলকাতা'র ঘাড়টিকে জন্ম থেকেই বাঁকা করে রেখে দিয়েছে। আর নগর কলকাতা আমাদের দিয়েছে অনেক বটে, কিন্তু দিয়ে দিয়ে ভিখিরি আর ছিন্নমূল করে ছেড়েছে । বিলেতি ভাষাতে কোট না করলে আমাদের পান্ডিত্য সিদ্ধ হয় না।

আধুনিকোত্তরবাদিরা অনিশ্চয়তাবাদের কথা বলেন, বলেন বিশৃঙ্খলার কথা। তারা এন্ট্রপির কথা পড়েছেন। আমরাও পড়েছি। কিন্তু জলের তাপ শূন্য ডিগ্রীতে নামিয়ে আনলে যে সে বরফ হয়ে যায় এবং সেই বরফে বিলেতেরও উত্তরের মহাদেশের কেউ কেউ ঘর বানিয়েও বসত করেন--সে তথ্যও দিব্বি চেপে গেছেন। শৃঙ্খলা বিশৃঙ্খল বিশ্বের একটি অন্তর্লীন সত্য। আর তাই কেবল প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা কিম্বা 'মহাআখ্যানে'র বিরোধীতা কোনো সম্পূর্ণ তত্বই নয়। 'বিকল্প প্রতিষ্ঠান' একটি চিরন্তন এবং ঐতিহাসিক সম্ভাবনা । ইতিহাসের প্রতিটি মোড়ে তার সম্ভাবনা ছিল, আছে এবং থাকবে।

                   আর বিকল্প প্রতিষ্ঠানের কথা বললেই আমাদের পূর্বোত্তর ভারতের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা পাড়তেই হয়। কেন? সেরকম প্রশ্নের উত্তরে গেল এক দশকে বহু জায়গাতে বহু কথা লেখা হয়ে গেছে। যেমন সম্প্রতি প্রকাশিত 'নাইন্থ কলামে'র 'অসমের বাংলা কবিতা' সংকলনের মুখবন্ধে সম্পাদকেরা লিখছেন, “ বাংলার 'সাংস্কৃতিক উত্তাপকেন্দ্র' থেকে দূরবর্তী এই অঞ্চলে কাব্যচর্চার ভুবন পল্লবিত হয়েছে নিজস্ব ধারায়। গড়ে উঠেছে বাংলা কাব্যের ভিন্ন এক প্রেক্ষিত। এই কাব্যধারা নিজস্ব চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র” তাই আমাদের বন্ধু অভিজিৎ চক্রবর্তীতো তাঁর সম্পাদিত কাগজের নামই দিয়ে রেখেছেন, “কবিতার পূর্বোত্তর”। বর্তমান লেখক, সেখানেও চিঠির আকারে আর অন্যত্র নিবন্ধের আকারে এই নিয়ে আগেও লেখা লেখি করেছি। আমাদের সেই সন্মিলিত প্রয়াসকে অমিতাভ ভাষা দিয়েছেন এভাবে। 'কাগজের নৌকো'তে সেই পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “...একটা বয়স পর্যন্ত আমি কলকাতার ছিলাম, আমার সমস্ত ভাব-পৃথিবী কলকাতা-কেন্দ্রিক ছিল। তারপর একটা সময় এল জীবনে যখন বুঝতে পারলাম, আমি ঠিক কলকাতার নয় বা আমার থাকা-না থাকার ওপর কলকাতা কিছুই যায় আসে না। ততদিনে ত্রিপুরার শ্যামল ভট্টাচার্য, পল্লব ভট্টাচার্য ও প্রবুব্ধ সুন্দর কর, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সঞ্জয় চক্রবর্তী ও অভিজিৎ চক্রবর্তী, শিলচর থেকে তিনসুকিয়ায় নতুন তাঁবু গেঁড়ে বসা সুশান্ত কর সবাই উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় সাহিত্য নামক এক ধারণাকে হাতের কড়ির শেষদান হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে। আমার ধারণা তাদের সঙ্গে মিলে গেল। আমরা একটা জায়গায় এক হয়ে গেলাম। এর আগে দেবাশিষ তরফদার—যাঁর বেড়ে উঠা কেবল মাত্র বরাক উপত্যকা কেন্দ্রিক ছিল না, -অস্পষ্টভাবে হলেও, এই উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় সাহিত্যের দিকে এক অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন। আমাদের বাস্তবতা যে বাঙালির অপরাপর ভুবনগুলির থেকে আলাদা,...এই কথাটা সম্ভবত দেবাশিস তরফদারই প্রথম পয়েণ্ট আউট করেছিলেন। পরে দেখা গেল এই বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় থেকেও, একই রকম ভাবছি।” 'অসীমান্তিক' গল্পের সংকলন যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন ওখানে হাসান আজিজুল হকের উচ্চারণ আরো তীক্ষ্ণ আর ধারালো, “বলতে পারি, আবেগে আক্ষেপে সংক্ষেপে আর্তনাদ করে জানাতে পারি, কোনো বিভাজন মেনে নেয়া হবে না, কোনো বিভাজনই প্রকৃত নয়। কিন্তু সত্য হলো বিভাজন ঘটে গেছে। … সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক বিভাজন কার্যকর নয় একথা ভাবালুতা-আশ্রয়ী খানিকটা সত্য হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু সত্য নয়। অভ্যাস মাফিক আবেগ মাখা ঐক্যের কথা বলা হয়, সঙ্গে সঙ্গে আবার ধরাছোঁয়া বাঁচিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের স্বতন্ত্র ইতিহাস সুরচিত হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। ১৯৪৭ সালে পৌঁছেই নিজের নিজের ঘর দেখা দিচ্ছে, আলাদা হয়ে যাচ্ছে হেঁসেল। বাংলাদেশ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতা মেনে নেয়া হয় তারপর থেকে তার নিজের ইতিহাস শুরু করে। উত্তরপূর্ব ভারতের বাংলাভাষা চর্চা বা সাহিত্য-ফসল আলাদা করে চোখে পড়েনি, যেন তার অস্তিত্বই নেই, যা বা যেটুকু আছে তা বুঝি পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্যের সঙ্গে মিশে গেছে। পরিতাপ করি আর ক্ষোভ জানাই পরিস্থিতি কিন্তু এই রকম।”

                        আজ সে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে? কী রকম? পশ্চিম বাংলা কি আমাদের স্বীকার করে নিতে শুরু করেছে? না, বাংলাদেশ? এরকম প্রশ্ন কেউ করে ফেললে বুঝব, আমার বক্তব্যের কোনোটাই আমি তুলে ধরতে পারিনি। হ্যাঁ, ওখানকার দুএকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সাহিত্য পাঠ্যক্রমে ঢুকেছে। কিন্তু তাতে সার্বিক হালচাল কিছু পাল্টায় নি পাল্টাবেও না। পাল্টেছে, আমাদের এখানে, এই মাটিতে। দৈনিক কাগজগুলোর কথাতো আগেই বললাম। এবার তাকান টিভির দিকে। নব্বুইয়ের দশকের প্রথম বছরগুলোতে বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে যখন উপগ্রহ চ্যানেলগুলো এসছিল স্টার টিভি, এম টিভি দিয়ে ওরা যাত্রা শুরু করেছিল। পন্ডিতেরা বলছিলেন এসব বিশ্বায়নের উপরিকাঠামো গঠনের ষঢ়যন্ত্র। পশ্চিমের সংস্কৃতি আমাদের দেশজ সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে। হয়তো, খানিকটা তাতে সত্য ছিল। কিন্তু, ঘটনা কী চেহারায় এগুলো? সেই আদ্যিকালের ইংরেজি চ্যানেলগুলো প্রান্তে চলে গেল। আমরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বসেও একসময় কলকাতার বাংলা চ্যানেলগুলো দেখতে পেলাম। এভাবে বাংলার মূলস্রোতের সঙ্গে আমরা পরিচিত হলাম। যে অসমে এক সময় ভাষার জন্যে প্রাণ দিতে হয়েছে, সেখানে কিছু চ্যানেল বাংলা এবং বডোতো বটেই সাদ্রি, ডিমাসার মতো ছোট ছোট এবং কোত্থাও মর্যাদা না পাওয়া ভাষাগুলোতে চব্বিশঘন্টা ধরে সংবাদ অনুষ্ঠানাদি প্রচার শুরু করল। এমন ঘটনা নগর কলকাতাতেও কেউ কল্পনাই করতে পারে না। ছোট ছোট শহরে গড়ে উঠা চ্যানেল এখন নগর কলকাতা যাদের ভুলে গেছিল--সেই অসমের বাঙালিদের আত্মপ্রকাশের এক একটা মঞ্চ দিয়ে দিল। স্রষ্টা আর ভোক্তার তফাৎ এতোটাই ঘুচে গেল যে আমাদের শহরগুলো থেকে গোটা ভারতে দেখা গেল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর দেবজিৎ, অভিজ্ঞান, অমিত, সপ্তপর্ণাদেরও মুখ। হয়তো, সুমন নচিকেতা, লোপামূদ্রাদের সামনে এরা এখনো ধূমকেতু, কিন্তু এইতো সবে শুরু। এই চেনেলগুলো সাহিত্যের তেমন উপকার প্রত্যক্ষভাবে করেনি বটে, কিন্তু ভাষার ব্যবহারের মধ্যি দিয়ে এগুলো যে আমাদের মেধাগুলোর আত্মবিশ্বাস বাড়াবার একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে সেটিকে অস্বীকার করা যাবে কী করে? তিনসুকিয়ার মতো শহরে বাংলা কাগজ , বই উন্মোচিত হচ্ছে টিভি স্টুডিওতে বসে এমন সরাসরি অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে।

                  জ্ঞান অর্জনের পথে শ্রব্য-দৃশ্যমাধ্যমগুলোর ভূমিকাকে আমরা কোনো স্বীকৃতি দিতে এখনো কুন্ঠিত। অথচ এরাই আমাদের মতো প্রান্তিক অবস্থানে আর ভাষিক আধিপত্যের চাপের তলাতে থাকা মানুষগুলোর জন্যে পথের নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে সে কথা যেন আমরা বুঝেও বুঝে উঠতে চাইনা। বই সম্পর্কে এক জনপ্রিয় কথাকে সংস্কারের মতো গড়ে উঠতে দেয়া হয়েছে, বইয়ের মতো বন্ধু বুঝি আর নেই। খুব ভালো কথা। কিন্তু সেই বন্ধুটিকে কাছে পেতে যে আমাদের কতটা ঘানি ঠেলতে হয় সে নিয়ে কিন্তু মনে মনে আমরা সবাই জানি। আমরা কি জানি, যে এই ভারতে কলকাতাতে যেখানে প্রথম ছাপা বই বেরুচ্ছিল সেখানে বইকেও একটা সময় লোকে খুব ভালো চোখে নেয় নি? মনে করা হচ্ছিল এবারে আর জাত ধর্ম বলে কিছু থাকবে না। এমনও হয়েছিল,যে কেউ কেউ বই ছেপে আত্মরক্ষার জন্যে এই মিথ্যেটা প্রচ্ছদে লিখেও দিচ্ছেন যে, এই গ্রন্থের কালি গঙ্গাজলে শোধন করা হইয়াছে। তারপর থেকে আমাদের সন্মিলিত ধারণা প্রায় এরকম যে জ্ঞান মাত্রেই থাকে বইএর দুই পাতাতে সংগঠিত -সুসংবদ্ধ। যত পড়া যায়, তত জানা যায়। শুনেও যে জ্ঞান বাড়াবার একটা প্রাক-ছাপাখানা প্রাচীন রামায়ণী ঐতিহ্য আমাদের ছিল সেই তথ্য আমরা এক্কেবারেই ভুলে গেলাম। যদিও মাস্টার মশাইদের কথা শোনা আর সেই সঙ্গে বেতের বাড়ির ঐতিহ্য আমাদের এখনো আছে বহাল তবিয়তে। তাছাড়া শুনে-দেখে-পড়ে আমাদের জ্ঞান বাড়ে আর কৈ। আমরা তো সংগৃহীত করি কিছু বিশৃঙ্খল তথ্য মাত্র। সেগুলো শৃঙ্খলিত জ্ঞানে পরিণত হয় শুধু আমাদের কাজের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। যার যত বড় কাজ তাঁর তত বড় জ্ঞান।

                    সেই বিশৃঙ্খল তথ্য বিশ্বের এক আধুনিকতম আধার হচ্ছে ইন্টারনেট। টিভির থেকেও বড়। তাকে নইলে টিভিরও চলে না। যাদবপুরের মতো প্রযুক্তিবিদ্যার কেন্দ্রে গিয়েও দেখেছি ওখানকার অধ্যাপকেরা কম্পিউটারে বাংলা লেখেন শুধু পাওয়ার পয়েন্টে স্লাইডশো দেখাতে। আমাদের অধ্যাপকেরা অতি অল্পই এখনো এর বেশি এগুতে পেরেছেন। আমারা এখনো ইংরেজি হরফে বাংলা লিখতে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করি। যখন কিনা যুগ এতোটাই এগিয়ে গেছে যে আপনি করতে পারেন ঠিক উলটো। বাংলা হরফে ইংরেজি লিখে দূর দেশের বন্ধুকে মুহূর্তের পাঠাতে পারেন বার্তা। উত্তরভারতের হিন্দিভাষিরাও কেউ আজকাল ইংরেজি হরফে হিন্দি লেখেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। এতো ভুরি ভুরি হিন্দি সাইট আর ব্যক্তিগত ব্লগ রয়েছে যে সে এক সমূদ্র। কিন্তু বাংলাভাষাতে বাংলাদেশ ভারত থেকে এগিয়ে গেছে বহু বহু দূর। সেদেশে এখন দ্বিতীয় এক ভাষা আন্দোলন চলছে দ্রুত গতিতে। আর তার নেতা হচ্ছেন তরুণ মেহেদি হাসান খান।

                       কম্পিউটার বুঝি ইংরেজি ছাড়া কিছু বোঝে না, এই এক ঔপনিবেশিক বোধ হলো অন্যতম কারণ যে গেল দুই দশকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে গোটা দেশ ছেয়ে গেছে। পন্ডিতেরা আশংকা করছেন আরো দশক দুই পর বাংলা সহ ভারতীয় ভাষাগুলোর অস্তিত্ব থাকবে কি না। এই যে আতঙ্কের পরিবেশটা তৈরি হয়েছে এর কারণ কিন্তু কম্পিউটার নয়, আপনারা মানুন বা নাই মানুন কালি-কাগজ , ছাপা বই এবং সেগুলোর থেকে উদ্গত রাজনীতি ভাষারাজনীতি । ছাপা বইয়ের আগে, উপভাষা মান্যভাষার তর্কটাও ছিল না। বইএর দরকারে ঐ তর্কটা সামনে এলো, উপভাষাগুলো চলে গেল প্রান্তে। কিন্তু সেই তর্কটা ওখানে থেমে গেলনা কিন্তু, এলো জাতীয় ভাষা রাষ্ট্র ভাষা রাজ্যভাষার তর্ক। এর মধ্যে ব্যয়সংকোচ, সুগমপ্রবেশের যুক্তিগুলো ছিল। কিন্তু আগেকার দিনে যেমন সংস্কৃত ছাড়া সাহিত্য চর্চা হবে না, বামুন ছাড়া কেউ পড়বে না, এমন যুক্তি ছিল, আধিপত্যের সেই রাজনীতিই কিন্তু ভাষা পেয়ে গেল ঐ মান্যভাষা-জাতীয়ভাষার তর্কে। বাকি ভাষাগুলো চলে গেল প্রান্তে, বিলীন হবে নাতো কি মুক্ত আকাশে সুনীল হবে? ইন্টারনেট সেই প্রান্তের ভাষাগুলোকে আবার নিয়ে আসছে চিহ্নপ্রক্রিয়ার কেন্দ্রে। সামনের সারিতে। বন্দী ভাষাকে করছে মুক্ত। অভ্রের স্লোগানই হচ্ছে 'ভাষা হোক উন্মুক্ত!' অচিরেই ভাষা রাজনীতির চেহারাটাকে ইন্টারনেট আর কম্পিউটার দেবে পালটে।

                  ২০০৯ সনে অক্টোবরে ইণ্টারনেট কোরপোরেশন ফর এসাইন্ড নেমস এন্ড নাম্বারস ( আই সি এ এন এন) বলে একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের সদর দপ্তর সিওলে--তারা ইন্টারনেটের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এক যুগান্তরকারী ঘটনা ঘটিয়েছেন। এতে তারা আশা করছেন, ইন্টারনেটের সত্যিকার আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটবে। তাঁরা লাতিন কোডিং ব্যবস্থাকেই পালটে দেবার কাজ সম্পূর্ণ করেছেন। 'ইংরেজিতে শুধু বিশ্বময় ছড়ানো যাবে'---এতোদিনকার এই লালিত বিশ্বাসকেই তাঁরা ধ্বসিয়ে দিয়েছেন। কোনো রাষ্ট্র চাইলেই তারা সে ব্যবস্থাটি সে দেশকে দিচ্ছেন। ভারত সরকার ইতিমধ্যে সে আবেদন করেছেন এবং পূর্ণদ্যোমে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। ইন্টারনেটের সমস্ত বিষয়কে ভারতীয় ভাষাগুলোতে অনুবাদের ব্যবস্থা করবার কাজ এগুচ্ছে। ছোট ছোট কিছু ভাষাতে তা সম্পূর্ণও হয়ে গেছে। তার সমান্তরালে আরো বেশ কিছু কাজ এগুচ্ছে। লিনাক্সের ভারতীয় ভাষাগুলোর সংস্করণ বহুদিন হলো বেরিয়ে গেছে।'ফায়ারফক্স' ব্রাউজারেরও তাই। গোগল অনেক ভারতীয় ভাষা লেখা পড়ার সফটওয়ার ছেড়েছে বহুদিন হলো। এগুলো যে কেউ পেতে এবং ব্যবহার করতে পারেন বাংলাতে। ইংরেজিতে আর ব্যবসা এগুবে না জেনে মাইক্রোসফট সেভেন এবং উইন্ডো সেভেনও এখন বাঙালি -অসমিয়া হয়ে গেছে। এগুলো যখন হচ্ছিল না বা হয় নি তখনই অনেকগুলো ইউনিকোড ব্যবস্থা এসে গেছিল ভারতীয় ভাষাগুলো লেখা পড়ার জন্যে। একা 'বারাহা'দিয়ে আপনি ভারতের যে কোনো ভাষা লিখতে ও পড়তে পারেন। কিন্তু বাংলা, অসমিয়া, মণিপুরি লিখবার জন্যে অভ্র তার থেকেও আকর্ষণীয়। ব্যবহার বান্ধব এই সফটওয়ার নির্মাতা মেহেদি হাসান  খান এক বাংলাদেশী তরুণ। শুধু ভাষার জন্যে কম্পিউটার ব্যবহার করবার স্বার্থে বাংলাদেশের সফটওয়ার প্রযুক্তি যে কী দ্রুত হারে বাড়ছে-- না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। লিনাক্সের বাঙালি পরামর্শদাতারা প্রায় সব্বাই বাংলাদেশের লোক। কম্প্যুটারকে তারা বাঙালি করে ছেড়েছেনতো বটেই--তাদের সুবাদে বিশ্বময় ছড়িয়ে যাবার স্বাধীনতা পেয়ে গেছে অসমিয়া, মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, হাজং, চাকমাদের মাতৃভাষা। রাজবংশীর মতো ভাষাকে বাংলা কিম্বা অসমিয়া বলে আটকে রাখবার দিন ফুরোলো বলে।

            কী হয়, সেই ভাষা দিয়ে? যাদের আমাদের সৃজনী চিন্তার ভাষা বাংলা কিন্তু কম্প্যুটারে সেটির ব্যবহার জানা নেই, তাদের ধারণা মেইল করা , ইংরেজি হরফে চ্যাট করা, অরকুটে, ফেসবুকে বন্ধু বাড়ানো ছাড়া আর কিছু ওয়েব সাইট খোঁজে বেড়ানোই এর কাজ। আসলে কম্প্যুটার তথা ইন্টারনেট এখন আপনার সিনেমা-থিয়েটার হল, সঙ্গীত মঞ্চ, রেডিও, লেখার ঘর, পড়ার ঘর, লাইব্রেরী, বইয়ের দোকান, বাজার , স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়। আপনি যদি ব্লগ লিখতে পারেন তবে সেখানে আপনি লেখক সম্পাদক প্রশাসক সবটাই।

           আপনার এই আক্ষেপ করবার কোনো দরকারই নেই যে আমরা এই পূর্বোত্তরের মানুষেরতো আর এতো সাধ্যি নেই যে আমরা আরেকটা কলেজস্ট্রীট গড়ে তুলব। কলেজ স্ট্রীট এতো দ্রুত আপনাকে ঢাকা কিম্বা টোকিওর পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না, যতটা পারে ইন্টারনেট। ফলে যে নগর কলকাতা এতোদিন শুধু লিখত বাকি বাংলা পড়ত, নগর কলকাতা গাইত বাকি বৃহত্তর বাংলা শুনত, নগর কলকাতা অভিনয় করত বাকি বাংলা তা দেখতো--বৌদ্ধিক আধিপত্যের এই সমীকরণ যাচ্ছে উলটে। হাজার পৃষ্ঠার চারশ টাকার লিটিল ম্যাগ শুধু বুদ্ধিজীবিদের জন্যে প্রকাশ করেও যারা প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার বড়াই করেন বা করতেন তাদের দিকে চোখটি না ফেলে গট গট করে বিশ্বজয়ের পতাকা উড়িয়ে দিচ্ছে 'উড়ালপুল', 'খোয়াব', 'সৃষ্টি', 'কৌরব', 'গুরুচন্ডালী', 'ইচ্ছামতি', 'কঁচিকাচা', 'কর্ণিকা', 'দ্রোহ', 'অলসদুপুর' 'বাঙালনামা'র মতো ওয়েব কাগজগুলো। আপনি বিনে পয়সায় পড়তে পারেন। শুনতেও পারেন, কেননা অনেকেই সেখানে সঙ্গীত বক্তৃতাও তুলে দিচ্ছেন, নিজেদের লেখালেখির সঙ্গে। এই ভাবেই পুরোনো সেই পটের কথা আর ওঝাপালার ঐতিহ্যকে নিয়ে এসছেন ফিরিয়ে। কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই বটে, থাকবে কী করে? সেতো এখন ওয়েব ম্যাগাজিন হয়ে গেছে। রোজ লেখা বেরুচ্ছে। রোজ পড়া হচ্ছে--সেই আড্ডায় যোগ দিচ্ছে তিনসুকিয়া থেকে তিউনেশিয়ার বাঙালি। পশ্চিমবাংলাথেকে নিয়ন্ত্রিত হয় তেমনি আরেক আড্ডার নাম 'লোটা কম্বল'; বাংলাদেশে আছে 'সচলয়াতন', সামহোয়ার ইন, মুক্তমনা, প্রথম আলো, চতুর্মাত্রিক, আমার ব্লগ। 'আমার ব্লগে' আপনার লেখা পছন্দ না হলে 'বাঙাল ভাষা'তে পাঠক আপনাকে গালিও দিতে পারে। আর 'মুক্তমনা' পড়লে তসলিমা নাসরিণকে নিয়ে আনন্দবাজারীয় নাটকটা আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। সে নাটকের দিন ফুরোলো। সবই এখন 'মুক্তমনা'। কোনো কিছু আর গোপন নেই। বেড়া নেই কোনো।

             রবীন্দ্রনাথের দেড়শত বছরের সবচাইতে সেরা অর্জন যদি আমাদের কিছু থেকে থাকে তবে এই যে তাঁর লেখার প্রায় সবটাই এখন মেলে ইন্টারনেটে। এতো ঢাউস রচনাবলী আপনি কিনবেন কী করে, রাখবেন কৈ, সেনিয়ে সামান্যও মাথাব্যথা না ঘটিয়ে আপনি খোঁজে নিন ইণ্টারনেটে। যেখানে থাকুন যেভাবে থাকুন , নেট আছে তো রবীন্দ্রনাথ আপনার সঙ্গে আছেন।

              ব্লগ লিখতে যদি আপনার আগ্রহ জন্মায়, অথচ না জানেন কী করে কী করতে হয়--আপনাকে পরামর্শ দেবার জন্যে রয়েছে 'বাংলাহ্যাক্স', 'টেকটনিক্স', 'আমার প্রযুক্তি     ' এমন আরো অনেক। বাংলা লিখতে আপনি কি বানান ভুল করেন? দেখে নেবার জন্যে সংসদের অভিধান সহ আছে প্রচুর একভাষিক দ্বিভাষিক অভিধান।

এই বিশাল যজ্ঞশালাতে অসম তথা পূর্বত্তরের জায়গাটা কোথায়? সত্য বলতে প্রায় শূণ্য। আমাদের বরাক উপত্যকার বন্ধুরা ভাষা নিয়ে খুব আবেগিক। কিন্তু আমার হাসি পায় যখন দেখি, ওরা সেই আবেগের কান্নাকাটিটা করেন ইংরেজি হরফে। যে দুএকটা ইংরেজি সাইট আছে শিলচর শহরের সেগুলোতে আপনি প্রেমিক প্রেমিকার সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন, প্রেমের বাংলা কবিতার সন্ধান পাবেন না। অথচ, ওখানে বাংলা লেখার জন্যে কেউ আপনাকে জেলেও পুরবে না, আঙুল মটকাবে না, কলম কেড়ে নেবার ভয়টাও এক্কেবারেই নেই। কী মজা দেখুন, ফেসবুক যখন বিখ্যাত হয়ে গেল মিশরের বিপ্লবের অনুঘটকের কাজ করে , আমাদের শিলচরে তখন সে কুখ্যাত হয়ে গেল এক প্রেমিকের প্রেমিকা হত্যার প্রয়াসের জন্যে! আমাদের মেজাজ আর মানসিকতাটাকে চিনে নেয়া্টা তাই জরুরি।

         পূর্বোত্তর ভারতে প্রথম ইউনিকোড সম্পদ অসমিয়া ভাষার 'অভিধান' 'শব্দ' । ২০০৬ সনে আবুধাবীতে কর্মরত প্রবাসী অভিযন্তা বিক্রম মজিন্দার বরুয়া তাঁর আরো দুই বন্ধুকে নিয়ে সেটি শুরু করেন। পরে সেটি পূর্বত্তরের প্রায় সব ভাষার অভিধানে পরিণত হয়। গেল বছর থেকে এতে বাংলা, হিন্দি, নেপালিও ঢুকে গেছে। পূর্বোত্তরের ভাষাগুলোর এক তুলনামূলক অধ্যয়নের দুর্দান্ত আকরে পরিণত হচ্ছে এই অভিধানটি। ইতিমধ্যে তাতে ৩৫০০০ এর বেশি অসমিয়া শব্দ এসে গেছে। বিক্রমেরা বিহু ডট ইন বলে একটা সন্মিলিত ব্লগও চালাতেন। কিন্তু তাতে তাঁরা লিখতেন খুব কম, লিখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লিখতেন ইংরেজিতে।

    গেল বছর জানুয়ারীতে ফ্রেন্ডস অব আসাম এন্ড সেভেন সিসটার্স সংক্ষেপে 'ফাস' আয়োজিত প্রবাসী পূর্বত্তরীয়দের সম্মেলন 'নেইমস ২০১০'র পাশাপাশি 'শব্দে'র এক সভা বসে গুয়াহাটিতে। সেখানে আলাপ শুরু হয়েছিল 'শব্দে' সক্রিয় কর্মী বাড়াবার সমস্যা নিয়ে। সেখানেই ঠিক হয়, বন্ধুদের নিজেদের মাতৃভাষাতে ব্লগ লিখতে উৎসাহিত করতে পারলেই একটা অভিধানের দরকার বাড়বে। বাড়বে স্বেচ্ছাসেবী কর্মী। তার পর দীর্ঘ ছ'মাস নেদারল্যন্ড প্রবাসী অসমীয়া লেখক সমাজকর্মী ওয়াহিদ সালেহ, এবছর যিনি প্রবাসী ভারতীয় সম্মানে ভূষিত হলেন , তাঁর নেতৃত্বে এক জিমেলগ্রুপে আলোচনা চলে কী করে অসমিয়া উপকরণ নেটে বাড়ানো যায়। এই আন্দোলনের শেষে গড়ে উঠল একটা সাইট যার নাম 'ই-জোনাকি' যুগ, ফেসবুক গ্রুপ যার নাম 'অসমীয়াত কথা বতরা'। তাতে লাভ হয়েছে এই যে এখন শব্দের প্রায় প্রত্যেকের একটি করে সুদৃশ্য অসমীয়া ব্লগ আছে। 'সুগন্ধী পখিলা', 'শতদল', আমি অসমীয়া, 'খার নোখোয়ার কলম' 'জালপঞ্জী', জীবনর বাটত, 'মই আরু মোর পৃথিবী' ইত্যাদি আরো অনেক। এর মধ্যে দিল্লী প্রবাসী হিমজ্যোতি তালুকদারের 'মই আরু মোর পৃথিবী' এবং যামিনি অনুরাগের শুরু করা সন্মিলিত ব্লগ 'সুগন্ধী পখিলা' সবচে জনপ্রিয় আর সুশোভিত ব্লগ। এনাজরি ডট কম বলে একটি অসমীয়া সাহিত্য সম্ভার গেল বছর থেকে যাত্রা শুরু করলেও এরা প্রথমে লেখাগুলো হয় দিত ছবির আধারে, নতুবা ইংরেজিতে। 'ই-জোনাকি' যুগের প্রভাবে এরাও এখন সরাসরিই ইউনিকোড ব্যবহার করেন। অরিন্দম চৌধুরীর সম্পাদিত কাগজ দ্য সানডে ইন্ডিয়ানের বাংলা ওয়েব সংস্করণ ছিলই,এখন অসমিয়া সংস্করণ এসে গেছে। বাংলাতেও আর কোনো কাগজ ইউনিকোড ব্যবহার করে বলে আমরা জানিনা। আনন্দবাজার রয়েছে। কিন্তু ওদের ব্যবস্থাটি এতো আত্মকেন্দ্রিক এবং জটিল যে সাধারণ মানুষ পড়বার ঝক্কি নেন বলে মনে হয় না। আরেকটি সুখবরতো না দিলেই নয় ,যে গুয়াহাটির এক তরুণ  বনজিৎ পাঠক গেল ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে 'কুঁহিপাত'নামে একটি অসমিয়া ফন্ট নির্মাণ করে মুক্তকরে দিয়েছেন। এবারে তিনি সেটি যাতে বাংলা, মণিপুরি, হাজং, চাকমা লিখতেও ব্যবহার করা যায় তার উপর কাজ করছেন।

                          অসমের প্রায় প্রতিটি বাংলা অসমীয়া দৈনিকের ওয়েবসাইট রয়েছে। কিন্তু তারা পৃষ্ঠাগুলো তোলেন ছবির আধারে, ইউনিকোডে নয়। আর পরের দিন বা পরের সপ্তাহেই স্থানসংকুলানের জন্যে সেগুলো সরিয়ে ফেলেন। সংরক্ষিত হয় না। তার মানে , প্রায়োগিক দিক থেকে তাঁরা এখনো পিছিয়েই আছেন। এটি কতটা তাদের সাধ আর কতটা সাধ্যির জন্যে হচ্ছে সে নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। যে দু'একটা বাংলা সাহিত্যের ওয়েবসাইট রয়েছে বিষয়গুলো কোনোটারই হয় ইউনিকোডে নেই অথবা অন্যকে দিয়ে ছবির আধারে তৈরি , নিত্য নবীকরণ করবার কেউ নেই। সুতরাং এখন আর খোলে না। শিলচরের চন্দ্রিমা দত্তের 'কবিতার চন্দ্রিমা' কিম্বা আগরতলার কল্যাণ চক্রবর্তীর 'ভাষা' সাইটের দশা এই। পূর্বোত্তর থেকে প্রথম বাংলা ব্লগার আমি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এবং প্রাবন্ধিক শুভপ্রসাদ মজুমদার। শুভপ্রসাদ আগে তাঁর লেখালেখিগুলো পিডিএফে করে স্ক্রাইবডে তুলে দিতেন। আর নিয়মিত লিখতেন সচলয়াতন সন্মিলিত ব্লগে। পরে 'অশুভ'নামে নিজের একটি ব্লগ করেন। এর পর এখন কবি কবি সপ্তর্ষি বিশ্বাস, জয়িতা দাস ব্লগ লেখাতে যোগ দিয়েছেন। সপ্তর্ষির ব্লগের নাম 'আমারসোনারবাংলা আমিতোমায় ভালোবাসি' এবং 'খাতা কবিতার'। 'খাতাকবিতা'তে তিনি তাঁর পড়া ভালো লাগা নানা কবিদের কবিতাগুলো তুলে রাখেন। সপ্তর্ষি অনির্বান ধরিত্রীপুত্র এবং দেবাশিস তরফদারের নামে আরো দুটো ব্লগ নিজেই সম্পাদনা করেন। এর প্রথমটি 'মন্থরতাবিষয়ক ' দ্বিতীয়টি 'পুনরাবৃত্ত' । জয়িতার ব্লগের নাম 'ইচ্ছামতি'। জয়িতারই ছোট ভাই অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিমাদ্রি শেখর দাস আরো এক পা এগিয়ে। তিনি তাঁর 'হিমাদ্রি' ব্লগে বিজ্ঞান নিয়ে আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিখছেন বাংলা ভাষাতে। 'স্বাভিমান' নামে একটি ব্লগ রয়েছে অরূপ বৈশ্যের, যাতে তিনি নানা সামাজিক আর্থরাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে বাংলা ইংরেজিতে লিখে থাকেন। সম্প্রতি নিজের বই লেখালেখি নিয়ে ব্লগ শুরু করছেন কবি অমিতাভ দেব চৌধুরীও। তাঁর ব্লগের নাম 'বাজেখাতা'।

                আমার নিজের অনেকগুলো ব্লগ রয়েছে। তার মধ্যে একটির নাম 'সুশান্ত', অন্যটি 'প্রজ্ঞান' । প্রজ্ঞান মূলত দ্বিভাষিক 'ইংরেজি ও অসমিয়া' সেখানে আমার কলেজ থেকে সম্পাদিত নিয়মিত কাগজ 'প্রজ্ঞান' সম্পর্কিত নানা বিষয় তুলে দেয়া হয়। দুটোই পূর্বোত্তর ভারতের জনপ্রিয় ব্লগগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের 'আমার ব্লগ' এবং কলকাতার 'কফি হাউসের আড্ডা' নামের দুটো সন্মিলিত ব্লগেও আমি নিয়মিত লেখালেখি করে থাকি। এছাড়াও বাঙালনামা, গুরুচন্ডালী, সৃষ্টি, অলসকথার দুপুরের মতো ওয়েব মেগাজিনেও কখনো সখনো।এছাড়াও আমার রয়েছে ঈশানকোনের কথা, ঈশানকোনের কাহিনি এবং কাঠের নৌকো। ঈশানকোনের কাহিনিতে আমি দীর্ঘদিন ধরে অরূপা পটঙ্গীয়া কলিতার বিখ্যাত উপন্যাস 'ফেলানি' বাংলাতে অনুবাদ করছি। পাঠকেরা সেখানেই সেটি পড়ছেন। অভিমত দিচ্ছেন। এবং সে অনুযায়ী সেটি সংশোধিত হয়ে হয়ে এগুচ্ছে। স্বয়ং লেখিকা এটি পড়ে পড়ে যাচ্ছেন। এবং প্রায়শঃই নিজের অভিমত জানাচ্ছেন। এই অনুবাদের কথা তিনি উপন্যাসটির সাম্প্রতিক সংস্করণে উল্লেখও করেছেন। কিন্তু যেটির কথা আমি এখানে বিশেষ করে বলতে চাইব, সেটির নাম 'কাঠের নৌকা' । শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর কবিতাগ্রন্থের নামে তৈরি এই ব্লগে আমরা যে উদ্যোগটি নিচ্ছি তা এই যে পূর্বোত্তরের যে কোনো প্রকাশক কিম্বা সম্পাদক তাঁদের সম্পাদিত প্রকাশিত পত্রিকা বা গ্রন্থের পিডিএফ পাঠিয়ে দিলেই আমরা সেটি সেখানে তুলে দিয়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছি। কবি বন্ধু অমিতাভ দেবচৌধুরী ইতিমধ্যে এই ব্লগে আমার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে তাঁর দু'তিনটি মূল্যবান কবিতা আর নিবন্ধ গ্রন্থ ছাড়াও আমরা তুলেছি প্রতিশ্রোত, মহাবাহুর মতো ছোট কাগজের সাম্প্রতিক সংখ্যাগুলো। ভিকি পাব্লিসার্স ইতিমধ্যে 'কাঠের নৌকো'তে তাদের আটখানা প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আরো পাঠাবার প্রতিশ্রুতি রয়েইছে। আমরা চাইব, যারা দুটো কথা বাংলাতে লিখতে পারেন আর যাদের হাতে ইন্টারনেট রয়েছে তারা বাংলাতেই সেখানে লিখুন। ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা বন্ধ করুন। ইন্টারনেট আপনার হাতে থাকলে বাকি কাজগুলো হচ্ছে বিনামূল্যে। আগামীদিনে ইন্টারনেটও প্রায় বিনামূল্যের হয়েই যাবে। অন্তত গ্রন্থের কারবার থেকে এর ব্যয় হবে অতি সামান্য। স্থানে কালে এর বিস্তার আর গভীরতা হবে ব্যাপক। সবচে' বড় কথা গ্রন্থকীটের মতো একে কোনো কম্পিউটার কীট কখনো ধ্বংস করতে পারবে না। বাংলা ভাষা সাহিত্য যেখানে ডানা মেলে অবাধে উড়তে পারে সেখানে আপনারা ডানা মেলবেনই বা না কেন? এর তো একটাই কারণ হতে পারে, পুরোনো অভ্যেস। পালিত পাখি যেমন ছেড়ে দিলে আবারো খাঁচাতে ফিরে ফিরে আসে! আমি অনেক অনেককে বলেছি। আমার হাজারো বাঙালি বন্ধু আছে দেশে বিদেশে যাদের সঙ্গে আমার বার্তালাপ হয় বাংলা ভাষাতে , বাংলা হরফে। লেখাপড়া নিয়ে আড্ডা হয় বাংলাতে। তাদের মধ্যে পূর্বোত্তরের বন্ধু ঐ হাতে গুনা কয়েকজন। তাঁরা এখনো, ইংরেজি হরফের প্রতি ভালোবাসাটা ছেড়ে উঠতে পারেন নি। শিলচর স্টেশনের নাম কেন ভাষাশহীদ স্টেশন হলো না এই নিয়েও তাঁরা তাদের হাহাকার চীৎকারের ভাষাটা কিন্তু ইংরাজি।

            আমার ইচ্ছে ছিল কী করে কাজগুলো করবেন সেই নিয়ে দুটো কথা বলবার । কিন্তু সেই সময়ও নেই, মনে হয় না আপনাদের ধৈর্যও রয়েছে। সে নাহয় হবেখন ইন্টার নেটে। আগ্রহীরা আমাকে মেল করতে পারেনঃ karsushanta40@gmail.comএ । ফেসবুক, অরকুটে খোঁজে নিলেও পেয়ে যাবেন। আর আজকের এই বক্তৃতাটাও ইতিমধ্যেই উঠে গেছে আমার ব্লগে। লগ অন করুনঃ http://sushantakar40.blogspot.com. আপনাদের স্বাগত।

বৈদ্যুতিন মাধ্যমঃ নাগরিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক নতুন প্রত্যাহ্বান ।

( বর্তমান প্রবন্ধটি আসলে গেল নভেম্বর-ডিসেম্বর, ২০১০ মাসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সহযোগিতাতে বিদ্যায়তনিক কর্মী মহাবিদ্যালয়ের ( এ এস সি) আয়োজিত সঞ্জীবনী পাঠমালাতে দেয়া বক্তৃতা। অমন এক কেজো বক্তৃতাকে এখানে হাজির করাটা অনেক অধ্যাপকের কাছেই অকেজো আর হাস্যকর প্রয়াস বলে মনে হতে পারে। যখন ছাত্র ছিলাম তখন, যখন ছাত্র পড়াই তখনও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মতান্ত্রিকতার কাছে নির্ভেজাল আত্মসমর্পণ করাটা শিখলামও না, শিখতে চাইলামও না। বেশ কিছু বৈষয়িক লাভালাভ চিরদিনই আমার হাত থেকে ছুটে গেল, ছুটে যায়— জেনেও।এই বক্তৃতা ছিল, তেমনই অশিক্ষার এক ফসল। নিয়মতান্ত্রিকতার ছোট্ট মঞ্চকেও তার ভেতর থেকে অন্তর্ঘাত করবার এক ছোট নিদর্শন মাত্র। তাই এতে নেই সেমিনার পেপারেরর প্রচলিত ঢং, এখানে তুলে দেবার সময়েও মূল সুরটি যাতে অক্ষত থাকে তাই কোনো পরিবর্তন করাটা দরকার বলে বোধ করি নি। তথ্যের ভুল ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব, তত্বের গণ্ডগোল নিয়ে চলুন তর্কে মাতা যাক।)

যে বিষয়টা নিয়ে আমি বলব ভেবেছিলাম তার দুটো দিক ছিল। একটা হলো, কেন আমি ‘প্রত্যাহ্বান’ শব্দটি ব্যবহার করলাম—সেই তত্বের দিক। আরেকটা হলো তথ্যের দিক—কীভাবে সে প্রত্যাহ্বান আসছে। কিন্তু যে সময়ের পরিসর আমাদের বেঁধে দেয়া হয়েছে তাতে দুটো দিককে সামাল দেয়া বেশ মুস্কিল। দক্ষ লোকেরা অবশ্যি সেটিও করে ফেলেন। কিন্তু আমি যে তেমন দক্ষতার দৃষ্টান্ত দেব তার পথে আমার সমস্যা হচ্ছে ভাষার কিম্বা পরিভাষার। যেমন ধরুন , ‘নগর’ শব্দটির যে মানে আমরা এ ক’দিন ধরে শুনে আসছি, মনে হচ্ছে আপনারাও সে মানের সঙ্গে বেশ অভ্যস্ত । আমার ঐতিহ্য তেমন নয়। আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে জেলা সদরগুলো থেকে এসেও ‘মফসসল’ শব্দটি বেশ হজম করছেন। আমার কিন্তু বেশ ঢেকুর উঠছে। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষাতে শব্দটি নেই। যে শহরে আমি বড় হয়েছি, সেই শিলচরকে লোকে আদর করে বলে ‘কবির শহর’। তাকে ‘মফসসল’ বললে অপমানিত বোধ করবারই কথা। ‘মহানগর’, ‘নগর’, ‘শহর’, ‘গঞ্জ’, ‘গ্রাম’ –এতোগুলো শব্দ আছে বাংলা ভাষাতে, কিন্তু মনে হচ্ছে নগর কলকাতার পরিভাষাতে সচেতনভাবেই দুটো শব্দকে রাখা হচ্ছে—‘নগর’ এবং ‘মফসসল’ । একে আমি বলছি ‘প্রতিষ্ঠান’।

এতে ‘প্রতিষ্ঠান’ কথাটারও যে কিছু বোঝানো গেল না। ‘প্রতিষ্ঠানে’র আভিধানিক অর্থের সঙ্গে আমরা পরিচিত তাতে সে পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া তেমন মন্দ কিছু নয় যে তাকে প্রত্যাহ্বান জানাতে হবে। যখনই সন্মিলিত কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে আমরা দল বেঁধে কোথাও বেশ একটা দীর্ঘকালের জন্যে জড়ো হই তখন তাকেই বলে প্রতিষ্ঠান। তার অবয়ব থাকতেও পারে, নাও পারে। যেমন আমাদের জাত, ধর্ম, অর্থ ব্যবস্থা—সেগুলোও এক একটা ‘প্রতিষ্ঠান’। বামপন্থী ঘরানায় আমরা যে প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার স্লোগান শুনেছিলাম তার কারণ কিছু চিহ্নিত প্রতিষ্ঠান, যেগুলো পুরোনো হয়ে যাচ্ছিল বা যাচ্ছে সেগুলো আরো কিছু মহত্তর প্রতিষ্ঠানের পথ রুখে দাঁড়িয়ে ছিল। বুঝতেই পারছেন আমার ‘প্রত্যাহ্বান’ শব্দটির অনেকটাই সেই বাম সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। কিন্তু তার মানে এও নয় যে বাম প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার প্রতি আমার বেশ শ্রদ্ধাভক্তি আছে। প্রতিষ্ঠান বলতে তাঁরা কিছু বুঝতেন কিনা সে নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কিন্তু বিকল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে তাদের যে বিশেষ কোনো ধ্যান ধারণা ছিল না—সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেতো বটেই আজকাল এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও। কিছু কিছু ছোট ছোট ব্যতিক্রম রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর নাম নেবার সময় এখনো আসেনি।

এদের এই অবস্থানের সঙ্গে পোস্টমডার্নদের অবস্থানের মূলগত কোনো বিরোধ নেই। পোস্টমডার্নরা যেমন বলেন ‘গ্র্যান্ডন্যারেটিভ’ আর সম্ভব নয়—এরা সেটি বলছিলেন অন্যভাষায় অন্য চিহ্ন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। যেমন ধরুন, ‘দেশ-আনন্দবাজারে’র বিকল্প এরা দাঁড় করাচ্ছিলেন ‘লিটিলম্যাগ।’ সে আরো মারাত্মক! যে ঢাউস আকারের তিনচারশ টাকার লিটিল ম্যাগাজিনগুলোতে বহু পড়াশোনা করা বিদ্বজ্জনেরা লেখেন তেমন কাগজ করার সাহস করা শিলচর-শিলিগুড়িতে বেশ বিপদ আছে। আর কিনে পড়তে গেলেও যে বেকার ছেলেটি ট্যুশন পড়িয়ে মাসের শেষে শ’তিনেক টাকা রোজগার করে তার বুকে লাগবে; আর খোঁজে পেতে গেলেও তাকে বেশ পড়াশোনা করা ছেলে হতে হবে। তার জন্যে সে শুধু পাকা মাইনের চাকরি পাবার স্বপ্ন দেখে দিন গুনতে পারে। কিন্তু চাইলেই পান কিনতে গিয়ে একটা ‘দেশ’ পত্রিকা কিনে বাড়ি চলে যেতে পারে।

আমাদের ছেলেবেলা ‘দেশ আনন্দবাজারে’র বিরুদ্ধে বাম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আকছার গালিগালাজ শুনেছি। আজকাল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও আনন্দবাজার-আজকালের ব্যবসা চলে না, বরাক উপত্যকাতেতো একেবারেই না। আজকাল গোটা অসমে বাংলা ছোটকাগজের সংখ্যা ৭৭টিরও বেশি। তথ্যটি আমি দিচ্ছি গুয়াহাটির বিখ্যাত প্রবন্ধের কাগজ ‘নাইন্থ কলাম’ থেকে। পূর্বোত্তরে সংখ্যাটি ১১৮ বা তারো বেশি। এগুলো আনন্দবাজারকে ঠেলে বের করতে পারেনি। করেছে যে দশ বারোটি রঙিন চকচকে বাংলা কাগজ বেরোয় গুয়াহাটি, ডিব্রুগড়, শিলচর, করিমগঞ্জ, ধর্মনগর, আগরতলা এবং শিলং শহর থেকে—তারা। এবং সম্ভবতঃ গেল দু’বছরে গুয়াহাটি শহর থেকে ‘ব্যতিক্রম’ বা ‘অন্যদেশ’ নামের কাগজগুলো যে দুর্দণ্ড প্রতাপে আমাদের ভাবনাগুলোকে ভাষা দিতে শুরু করেছে তাতে শীঘ্রই ‘দেশ-নবকল্লোলে’র মতো কাগজগুলোও ওখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে শুরু করবে। ‘ব্যতিক্রম’ ওখানকার এক বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও বটে।১ এই এরা সাহিত্যের জন্যে যে পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছেন, তাতে লিটিলম্যাগগুলোও বাড়ছে এতো দ্রুতো লয়ে। নইলে ‘নগর কলকাতা’র ‘বাম’পন্থার রপ্তানী করা ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা’র তত্ব এতোদিন আমাদের পথে বসিয়ে রেখেছিল। একেও তাই আমার মনে হয় আরো এক ‘প্রতিষ্ঠান’ যার ক্ষয় অবধারিত। সেটিতে আমরা আবার পরে আসছি।

এই যে স্থান-কাল পাল্টালে শব্দগুলোর মানের বদল ঘটে যাচ্ছে, বা কিছু মানেকে সচেতনভাবে রক্ষা করা কিম্বা অন্তর্ঘাত করবার প্রয়াস হচ্ছে একে নাম দিতে পারি ‘চিহ্নায়ন’ প্রক্রিয়া। কথাগুলো বললেই ‘আধুনিকোত্তরবাদে’র কথা মনে পড়ে যায়। বললে অনেক কথাই বলা যায়–যার সুযোগ নেই। আর একেবারে না বললে, আমাদের সিদ্ধান্তকে দাঁড় করানো যাবে না। আমরা যে এক ক্রম সম্প্রসারণমান আবিচ্ছিন্ন অথচ বিশৃঙ্খল বিশ্বে বাস করি–এ নিয়ে কোনো সংশয় থাকা উচিৎ নয়, একে শুধু বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। ব্যাপারটা এখন ইন্টার নেটের যুগে অনেক প্রত্যক্ষ। তাই ফরাসী বা বিলেতিরা আধুনিকোত্তরবাদের জন্ম দিয়েছে আর বলছে এখন আর কোনো ‘মহা আখ্যান’ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।আমাদের আগেকার ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’রা তাতে চোখে চড়ক গাছ দেখছেন আর সউৎসাহে সে দলে যোগ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন।

কিন্তু, আমার নিজের প্রায়ই সগৌরবে মনে হয়, আমরাতো এখনো ‘রামায়ণে’র যুগে বাস করি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের ‘মহাআখ্যান’–কবে ফুরোবেন কেউ জানি না। দেরিদা-ফুকো–লাকারা ফুরিয়ে যাবেন। আমরা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ি। কিন্তু, যদি শুধু ‘রামায়ণে’র কিম্বা ‘কোরানে’র কিম্বা তথাকথিত মধ্যযুগের ‘চন্ডীমঙ্গলে’র ইতিহাস ভালো করে পড়তে পারতাম –কী করে সেগুলো রূপান্তরিত, পুনঃসৃজিত হচ্ছে, কারা পড়ছেন, দেখছেন শুনছেন এবং কোথায় কোন কোন ভাষাতে–তবে চিহ্ন বিজ্ঞানের জনক আমরা হতে পারতাম।২ হইনি, তার কারণ ‘বিলেত’ বলে যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে সে আবার ‘নগর কলকাতা’র ঘাড়টিকে জন্ম থেকেই বাঁকা করে রেখে দিয়েছে। বিলেতি ভাষাতে কোট না করলে আমাদের পান্ডিত্য সিদ্ধ হয় না।

আধুনিকোত্তরবাদিরা অনিশ্চয়তাবাদের কথা বলেন, বলেন বিশৃঙ্খলার কথা। তারা এন্ট্রপির কথা পড়েছেন। আমরাও পড়েছি। কিন্তু জলের তাপ শূন্য ডিগ্রীতে নামিয়ে আনলে যে সে বরফ হয়ে যায় এবং সেই বরফে বিলেতেরও উত্তরের মহাদেশের কেউ কেউ ঘর বানিয়েও বসত করেন–সে তথ্যও দিব্বি চেপে গেছেন। শৃঙ্খলা বিশৃঙ্খল বিশ্বের একটি অন্তর্লীন সত্য। আর তাই কেবল প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা কিম্বা ‘মহাআখ্যানে’র বিরোধীতা কোনো সম্পূর্ণ তত্বই নয়। ‘বিকল্প প্রতিষ্ঠান’ একটি চিরন্তন এবং ঐতিহাসিক সম্ভাবনা । ইতিহাসের প্রতিটি মোড়ে তার সম্ভাবনা ছিল, আছে এবং থাকবে।

এবারে আমরা বৈদ্যুতিন মাধ্যম নিয়ে কথা বলবার মতো জায়গায় এসে গেছি। নব্বুইয়ের দশকের প্রথম বছরগুলোতে বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে যখন উপগ্রহ চ্যানেলগুলো এসছিল স্টার টিভি, এম টিভি দিয়ে ওরা যাত্রা শুরু করেছিল। পন্ডিতেরা বলছিলেন এসব বিশ্বায়নের উপরিকাঠামো গঠনের ষঢ়যন্ত্র। পশ্চিমের সংস্কৃতি আমাদের দেশজ সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে। হয়তো, খানিকটা তাতে সত্য ছিল। কিন্তু, ঘটনা কী চেহারায় এগুলো? সেই আদ্যিকালের ইংরেজি চ্যানেলগুলো প্রান্তে চলে গেল। আমরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বসেও একসময় কলকাতার বাংলা চ্যানেলগুলো দেখতে পেলাম। এভাবে বাংলার মূলস্রোতের সঙ্গে আমরা পরিচিত হলাম। যে অসমে এক সময় ভাষার জন্যে প্রাণ দিতে হয়েছে, সেখানে কিছু চ্যানেল বাংলা এবং বডোতো বটেই সাদ্রি, ডিমাসার মতো ছোট ছোট এবং কোত্থাও মর্যাদা না পাওয়া ভাষাগুলোতে চব্বিশঘন্টা ধরে সংবাদ অনুষ্ঠানাদি প্রচার শুরু করল। এমন ঘটনা নগর কলকাতা কল্পনাও করতে পারে না। ছোট ছোট শহরে গড়ে উঠা চ্যানেল এখন নগর কলকাতা যাদের ভুলে গেছিল–সেই অসমের বাঙালিদের আত্মপ্রকাশের এক একটা মঞ্চ দিয়ে দিল। স্রষ্টা আর ভোক্তার তফাৎ এতোটাই ঘুচে গেল যে আমাদের শহরগুলো থেকে গোটা ভারতে দেখা গেল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর দেবজিৎ, অভিজ্ঞান, অমিত, সপ্তপর্ণাদেরও মুখ। হয়তো, সুমন নচিকেতা, লোপামূদ্রাদের সামনে এরা এখনো ধূমকেতু, কিন্তু এইতো সবে শুরু।

এর থেকেও বড় মঞ্চ আর প্রত্যাহ্বান নিয়ে হাজির হচ্ছে ইন্টারনেট। এ ক’দিন আমরা কম্পিউটারে এখানে কিছু কিছু বাংলা লেখা পড়েছি। স্লাইডশো দেখেছি। আমাদের অধ্যাপকেরা বোধ করি এখনো এর বেশি এগুতে পারেন নি। এ যদি হতো, বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আমি নিশ্চিত, আপনারা দু’একজন বক্তার পুরো বক্তৃতাই এখানে লেখা দেখতেন কাগজের বদলে কম্পিউটারের পর্দায়। এবং তা ছাপার অক্ষর থেকেও সুজ্জিত ফন্টে। আপনারা বাংলাদেশের একটা সফটওয়ারই দেখেছেন–যদিও তার ব্যবহার দেখেন নি। মেহেদি হাসানের ‘অভ্র’।

কম্পিউটার বুঝি ইংরেজি ছাড়া কিছু বোঝে না, এই এক ঔপনিবেশিক বোধ হলো অন্যতম কারণ যে গেল দুই দশকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে গোটা দেশ ছেয়ে গেছে। পন্ডিতেরা আশংকা করছেন আরো দশক দুই পর বাংলা সহ ভারতীয় ভাষাগুলোর অস্তিত্ব থাকবে কি না। ২০০২ সনে আমি নিজেও যখন কম্পিউটারের ব্যবহার জানতাম না, তখনই এক প্রবন্ধে লিখেছিলাম ভারতবর্ষ হচ্ছে সেই দেশ যেখানে কম্পিউটার হয়ে উঠবে বহুভাষিক। ৩ এটা এখন হচ্ছে, কিন্তু আমরা সে প্রক্রিয়া শুরু করিনি। কারণ আমাদের ঔপনিবেশিক মোহাচ্ছন্ন মন বিদেশ থেকে নির্দেশ না পেলে নড়ে চড়ে বসে না। গেল বছর অক্টোবরে ইণ্টারনেট কোরপোরেশন ফর এসাইন্ড নেমস এন্ড নাম্বারস ( আই সি এ এন এন)৪ বলে একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের সদর দপ্তর সিওলে–তারা ইন্টারনেটের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এক যুগান্তরকারী ঘটনা ঘটিয়েছেন। এতে তারা আশা করছেন, ইন্টারনেটের সত্যিকার আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটবে। তাঁরা লাতিন কোডিং ব্যবস্থাকেই পালটে দেবার কাজ সম্পূর্ণ করেছেন। ‘ইংরেজিতে শুধু বিশ্বময় ছড়ানো যাবে’—এতোদিনকার এই লালিত বিশ্বাসকেই তাঁরা ধ্বসিয়ে দিয়েছেন। কোনো রাষ্ট্র চাইলেই তারা সে ব্যবস্থাটি সে দেশকে দিচ্ছেন ভারত সরকার ইতিমধ্যে সে আবেদন করেছেন এবং পূর্ণদ্যোমে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। ইন্টারনেটের সমস্ত বিষয়কে ভারতীয় ভাষাগুলোতে অনুবাদের ব্যবস্থা করবার কাজ এগুচ্ছে। ছোট ছোট কিছু ভাষাতে তা সম্পূর্ণও হয়ে গেছে। তার সমান্তরালে আরো বেশ কিছু কাজ এগুচ্ছে। লিনাক্সের ভারতীয় ভাষাগুলোর সংস্করণ বহুদিন হলো বেরিয়ে গেছে। ‘ফায়ারফক্স’ ব্রাউজারেরও তাই। গোগোল ভারতীয় ভাষাগুলোর সংস্করণ বহুদিন হলো বেরিয়ে গেছে। ‘ফায়ারফক্স’ ব্রাউজারেরও তাই। গগোল ভারতীয় অনেক ভাষা লেখা পড়ার সফটওয়ার ছেড়েছে বহুদিন হলো। এগুলো যে কেউ পেতে এবং ব্যবহার করতে পারেন বাংলাতে। ইংরেজিতে আর ব্যবসা এগুবে না জেনে মাইক্রোসফট সেভেন এবং উইন্ডো সেভেনও এখন বাঙালি হয়ে গেছে। এগুলো যখন হচ্ছিল না বা হয় নি তখনই অনেকগুলো ইউনিকোড ব্যবস্থা এসে গেছিল ভারতীয় ভাষাগুলো লেখা পড়ার জন্যে। একা ‘বারাহা’ দিয়ে আপনি ভারতের যে কোনো ভাষা লিখতে ও পড়তে পারেন। কিন্তু সেটির তেমন ফন্ট বৈচিত্র নেই, রয়েছে ‘অভ্রে’র ৫ । অত্যন্ত আকর্ষণীয়, ব্যবহার বান্ধব এই সফটওয়ার নির্মাতা মেহেদি হাসান এক বাংলাদেশী তরুণ। শুধু ভাষার জন্যে কম্পিউটার ব্যবহার করবার স্বার্থে বাংলাদেশের সফটওয়ার প্রযুক্তি যে কী দ্রুত হারে বাড়ছে– না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। লিনাক্সের বাঙালি পরামর্শদাতারা প্রায় সব্বাই বাংলাদেশের লোক।৬ কম্প্যুটারকে তারা বাঙালি করে ছেড়েছেনতো বটেই–তাদের সুবাদে বিশ্বময় ছড়িয়ে যাবার স্বাধীনতা পেয়ে গেছে অসমিয়া, মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, হাজং, চাকমাদের মাতৃভাষা। রাজবংশীর মতো ভাষাকে বাংলা কিম্বা অসমিয়া বলে আটকে রাখবার দিন ফুরোলো বলে।

কী হয়, সেই ভাষা দিয়ে? যাদের আমাদের সৃজনী চিন্তার ভাষা বাংলা কিন্তু কম্প্যুটারে সেটির ব্যবহার জানা নেই, তাদের ধারণা মেইল করা , ইংরেজি হরফে চ্যাট করা, অরকুটে, ফেসবুকে বন্ধু বাড়ানো ছাড়া আর কিছু ওয়েব সাইট খোঁজে বেড়ানোই এর কাজ। আসলে কম্প্যুটার তথা ইন্টারনেট এখন আপনার সিনেমা-থিয়েটার হল, সঙ্গীত মঞ্চ, রেডিও, লেখার ঘর, পড়ার ঘর, লাইব্রেরী, বইয়ের দোকান, বাজার , স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়। আপনি যদি ব্লগ লিখতে পারেন তবে সেখানে আপনি লেখক সম্পাদক প্রশাসক সবটাই। কলেজ স্ট্রীট এতো দ্রুত আপনাকে ঢাকা কিম্বা টোকিওর পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না, যতটা পারে ইন্টার নেট। ফলে যে নগর কলকাতা এতোদিন শুধু লিখত বাকি বাংলা পড়ত, নগর কলকাতা গাইত বাকি বৃহত্তর বাংলা শুনত, নগর কলকাতা অভিনয় করত বাকি বাংলা তা দেখতো–বৌদ্ধিক আধিপত্যের এই সমীকরণ যাচ্ছে উলটে। হাজার পৃষ্ঠার চারশ টাকার লিটিল ম্যাগ শুধু বুদ্ধিজীবিদের জন্যে প্রকাশ করেও যারা প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার বড়াই করেন বা করতেন তাদের দিকে চোখটি না ফেলে গট গট করে বিশ্বজয়ের পতাকা উড়িয়ে দিচ্ছে ‘উড়ালপুল’, ‘খোয়াব’, ‘সৃষ্টি’, ‘কৌরব’, ‘গুরুচন্ডালী’, ‘ইচ্ছামতি’, ‘কঁচিকাচা’, ‘কর্ণিকা’, ‘দ্রোহ’, ‘অলসদুপুর’ ‘বাঙালনামা’র ৭মতো ওয়েব কাগজগুলো। আপনি বিনে পয়সায় পড়তে পারেন। কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই বটে, থাকবে কী করে? সেতো এখন ওয়েব ম্যাগাজিন হয়ে গেছে। রোজ লেখা বেরুচ্ছে। রোজ পড়া হচ্ছে–সেই আড্ডায় যোগ দিচ্ছে তিনসুকিয়া থেকে তিউনেশিয়ার বাঙালি। এই বাংলাতে তেমনি আরেক আড্ডার নাম ‘লোটা কম্বল’; বাংলাদেশে আছে ‘সচলয়াতন’, সামহোয়ার ইন, মুক্তমনা, প্রথম আলো, চতুর্মাত্রিক, আমার ব্লগ। ‘আমার ব্লগে’ আপনার লেখা পছন্দ না হলে ‘বাঙাল ভাষা’তে পাঠক আপনাকে গালিও দিতে পারে। আর ‘মুক্তমনা’ পড়লে তসলিমা নাসরিণকে নিয়ে আনন্দবাজারীয় নাটকটা আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। সে নাটলের দিন ফুরোলো। সবই এখন ‘মুক্তমনা’। কোনো কিছু আর গোপন নেই। বেড়া নেই কোনো।

ব্লগ লিখতে যদি আপনার আগ্রহ জন্মায়, অথচ না জানেন কী করে কী করতে হয়–আপনাকে পরামর্শ দেবার জন্যে রয়েছে ‘বাংলাহ্যাক্স’, ‘টেকটনিক্স’, ‘আমার প্রযুক্তি’ এমন আরো অনেক।

টীকাঃ

১) পূর্বোত্তরের বহু পরিচিত প্রকাশনা সংস্থা আগরতলার ‘অক্ষর’। অসমের ‘করিমগঞ্জে’র ‘অক্ষরবৃত্ত’ কাগজও একসময় বেশ মূল্যবান কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। বরাকউপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থা, ‘খ’ ইত্যাদি পত্রিকা বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব বহন করলেও হাইলাকান্দির ‘সাহিত্য’ই এখন অব্দি সদাব্যস্ত বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশে। আগরতলার ‘অক্ষর’ বাদ দিলে এদের কারোরই উদ্যোগগুলো ব্যবসায়িক নয়। গুয়াহাটিতে কবি-ঔপন্যাসিক বিকাশ সরকারের ‘মিথ প্রকাশন’ প্রথম প্রকাশনার কাজে একটা নজড় কাড়ার উদ্যোগ নেয়। এই তথ্যটি জানা গেল , এবারের গুয়াহাটি বইমেলাতে ‘ভিকি পাবলিশার্স’ এবং ‘ব্যতিক্রম’এর আয়োজিত পূর্বোত্তরের বাংলা প্রকাশনা শিল্প নিয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা চক্রের সংবাদ থেকে ( যুগশঙ্খ, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১০) । এর পর একে একে এগিয়ে আসে নাইন্থ কলাম, সাময়িক অসম, অন্যদেশ ইত্যাদির মতো কাগজ যারা প্রকাশনার কাজটিকে ব্যবসায়িক দিক থেকেও সফল করবার চেষ্টাতে হাত দেন। হেমপ্রভা প্রকাশনীর নামও এই প্রসঙ্গে নিতে হবে। এর মধ্যে ভিকি পাবলিশার্সই সম্ভবত সবচে’ সফল এক ব্যবসায়িক উদ্যোগ। শীঘ্রই তারা গুয়াহাটির রিহাবাড়িতে নিজেদের এক স্থায়ী স্টল খুলতে যাচ্ছে। ক্রমে যা রাজ্যের অন্যত্রও ছড়িয়ে যেতেই পারে।

২) যেগুলো কি না ছিল একাধারে শ্রব্য-পাঠ্য-দৃশ্য কাব্য, এবং সেগুলো লেখক-গায়ক-পাঠক-দর্শকের বিভেদ প্রায়ই ভেঙ্গে দিত, তার জন্যে ‘ব্রেখটীয় ফর্মূলা’রও দরকার পড়ত না। এভাবেই জ্ঞান অর্জন করে এসছে আবহমান কালের ভারতবর্ষ। ছাপাখানার উৎপাদ কেবল গ্রন্থ, যা কিনা ব্রাহ্মণদের হাত থেকে বেরিয়ে দু’একটি নগরের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে আদৌ জ্ঞান বিশ্বের একমাত্র মাধ্যম কিনা, এবং সেই বিশ্বের শ্রেণি বিভাজনকে মুছে ফেলে দিতে পেরেছে কি না কিম্বা পারবার ক্ষমতা রাখে কি না–এই প্রশ্ন আজ এই একুশ কম্প্যুটার যুগে সজোরেই উঠাই উচিৎ।

৩) সেই ২০০২তে তিনসুকিয়া থেকে প্রকাশিত ‘দৃষ্টি’ বলে একটা কাগজে আমার তখনকার অধ্যয়ন-অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে ‘অসমে ব্যবহারিক বাংলা শিক্ষার সংকট’ নামে এক প্রবন্ধে লিখেছিলাম “কম্প্যুটার ইংরেজি ছাড়া বোঝেনা—এ অবশ্য ডাহা মিথ্যা প্রচার। তা যদি সত্যও হয় তবে ভারতবর্ষ সেই দেশ যেখানে তাকে বহু ভাষার পাঠ দেয়া যায়। সে পাঠ না নেয়, তবে পুরোনো প্রযুক্তির আস্তাকুড়ে তাকে ঝেড়ে ফেলে আমাদের তৈরি করে নিতে হবে আরো আধুনিক সেই যন্ত্র যে ঈশ্বরের পাশে বসবে না। স্বয়ং ঈশ্বরকে -–যিনি বাংলা বোঝেন না—জায়গা ছাড়ার নোটিশ দেবে। যে বলবে—শুনবে বোঝবে শুধু ইংরেজি নয়—মানুষের ভাষা। তার মাতৃভাষা। সে ভাষার শত বৈচিত্রকে সে বুকে ধরবে পরম গৌরবে আর মমতায়। অচিরেই তা হতে যাচ্ছে বলে আমাদের বিশ্বাস। এবং কম্প্যুটারই তা করবে…।”

৪)http://www.icann.org/en/announcements/announcement-30oct09-en.htm

৫) http://www.omicronlab.com/

৬)(Ubuntu Bangladesh ;http://www.linux.org.bd/)

৭) পশ্চিম বাংলা থেকে নিয়ন্ত্রিত সমবেত ব্লগঃ

ক) কফিহাউসের আড্ডাঃ http://coffeehouseradda.com

খ) লোটাকম্বলঃ http://lotakambal.sristisukh.com

বাংলাদেশ থেকে নিয়ন্ত্রিত ব্লগঃ

ক) http://www.sachalayatan.com

খ)http://www.somewhereinblog.net

গ)http://mukto-mona.com/banga.blog

ঘ) http://prothom-aloblog.com

ঙ) http://prothom_aloblog.com

চ) http://choturmatrik.com

কতকগুলো ওয়েব কাগজঃ

ক) উড়ালপুলঃ http://urhalpul.com

খ) খোয়াবঃ http://khoyab.com ;

গ) সৃষ্টি   http://www.sristi.co.in

ঘ) কৌরবঃ http://kaurab.com

ঙ) গুরুচণ্ডালিঃ  http://guruchandali.com

চ) ইচ্ছামতিঃ http://ichchhamoti.org

ছ) কচিকাঁচাঃ http://diyala.kochisamsad.com

জ) কর্ণিকাঃ http://www.kornika/co.in

ঝ) দ্রোহ ঃ http://www.droho.net

ঞ) বাঙালনামাঃ http://bangalnama.wordpress.com

চ) অলস দূপুরঃ http://www.alasdupur.tk/

কতকগুলো প্রযুক্তির দিশা দেখাবার ব্লগঃ

ক) বাংলাহ্যাক্সঃ http://banglahyacks.com

খ) টেকটিউনসঃ http://techtunes.com.bd

\গ) আমার প্রযুক্তি ঃ http://forum.amaderprojukti.com/

আমার নিজের ব্লগঃ

ক) সুশান্তঃ http://sushantakar40.blogspot.com

খ) ঈশানকোনের কাহিনিঃ http:ishankonerkahini.blogspot.com

গ) ঈশাঙ্কোনের কথাঃ http://ishankonerkotha

ঘ) কাঠের নৌকোঃ http://kathernouko.blogspot.com

এই ব্লগ তৈরি হয়েছে পূর্বোত্তর ভারতের বাংলা বই, কাগজের কথা মনে রেখে। যে কেউ নিজেদের প্রকাশিত বই ,পত্র পত্রিকার পিডিএফ পাঠালেই আমরা এই জনপ্রিয় ব্লগে তুলে দিচ্ছি । যদি সফল হই তবে নিজস্ব অয়েবসাইট খুলা যাবে।

ঙ) প্রজ্ঞানঃ http://pragyan06now.blogspot.com

কৃতজ্ঞতাঃ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন নেট বিচ্ছিন্ন তখন আমাকে ওয়েব ঠিকানাগুলো দিয়ে সাহায্য করেছেন ‘কফিহাঊসে’র কবি গল্পকার বন্ধু শ্রীমান অভ্র পাল। অভ্রকে অজস্র ধন্যবাদ!

চিত্তরঞ্জনের উত্তরসূরি আসবেন কবে?

আরিফ জেবতিক

মিডিয়াওয়াচ-এ পাঠসূত্রের কর্ণধার রাজীব নূরের কয়েক পর্ব লেখা পড়ে ভালো লাগল। আমাদের দেশের প্রকাশকেরা সাধারণত লেখেন না, তাই তাদের পেশার যন্ত্রণাগুলো সাধারণ মানুষের তেমন করে জানা হয় না।

৮ মার্চ-২০১০ তারিখে প্রকাশিত রাজীব নূরের লেখার কিছু অংশ মন খারাপ করে দেয়। তিনি লিখেছেন, ‌'বিক্রি না হওয়া বইয়ের বিশাল স্তূপ বাকি ১১ মাস রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।' নিশ্চিত বুঝতে পারি, একজন তরুণ ও ছোটো পুঁজির প্রকাশকের জন্য সে এক বড় হতাশা।

যেকোনো পেশাই সারা বছরের রোজগার না দিলে সে পেশায় উৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের প্রকাশনা ব্যবসাটি মৌসুমি ব্যবসা। ডিসেম্বরে টেক্সট বুক-নোটবুক আর ফেব্রুয়ারিতে কিছু গল্প-উপন্যাস ছাপার মধ্যেই তার কাজকর্ম সীমাবদ্ধ। এর বাইরে সারা বছর বই প্রকাশ করে এ রকম প্রকাশনীর সংখ্যা খুব বেশি হবে না।

ইদানীং শোনা যায়, আমাদের প্রকাশনা ব্যবসা নাকি উন্নতি করেছে। লেখক, প্রকাশক, আলোচক অনেকের মুখেই আমি এই কথাটি শুনি। আমাদের প্রকাশনা ব্যবসাটি কী উন্নতি করেছে, সেটা আমি বুঝতে পারি না। ৪০ গ্রাম দেশি কাগজের স্থলে ৮৫ গ্রামের ঝকঝকে অফসেট ছাপা, বইয়ের দুই পাশে দুটো ফ্ল্যাপ দিয়ে সেখানে লেখকের লেমিনেটেড করা মুখে মেকি হাসি, নিজের গুণগান গেয়ে নিজেই বইয়ের ফ্ল্যাপ লেখা, এগুলো কি ‘প্রকাশনা ব্যবসা’র উন্নতির মাপকাঠি? আমার দ্বিমত আছে।

আমাদের প্রকাশনা আসলে ব্যবসা হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না। এই দাঁড়াতে না পারার একটা দায় লেখক এবং পাঠককে দেওয়া হয়। ‘পাঠক ভালো বই পড়ে না,’ কিংবা ‘ভালো লেখক নেই,’ এগুলো হচ্ছে প্রচলিত অভিযোগ। কিন্তু এই ব্যবসাটি শক্ত ভিতের ওপর না দাঁড়ানোর পেছনে আরেকটি বড় কারণ আমাদের প্রকাশকেরা। আমি টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ জাতীয় বহুল চর্চিত অভিযোগগুলোর কথা বলছি না, আমি বলছি বই বিপণনের বিষয়টি।

বই বিপণনে আমাদের সৃজনশীল প্রকাশকদের একটি বড় অংশ, যারা রাজীব নূরের মতোই ভালো বই প্রকাশ করার কমিটমেন্ট থেকে এই ব্যবসায় এসেছেন, তাদের কোনো বড় উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ‘ঢাকা বইমেলা’ নামের একটি সাজানো-গোছানো ছিমছাম বইমেলা প্রায় বছরই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু সেখানে কোনো নতুন বই আনেন না প্রকাশকেরা। অবশ্য একুশে বইমেলার মাত্র মাস দুয়েক আগে এ রকম বইমেলা করার দরকারটা কী, সেটাও প্রশ্ন বটে। হেমন্তের বইমেলা নামের একটি বইমেলা গত দুই বছর দেখলাম শাহবাগে, আজিজ মার্কেটের পাশেই। সেই মেলা হওয়ায় ঘুরেফিরে আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোর নিয়মিত ক্রেতারাই সেখানে হাজির হন, নতুন পাঠক তেমন একটা আসেন না।

কথা হচ্ছে, পাঠক হিসেবে আমি বই কিনতে চাই, বইমেলার বাইরে সারা বছর বই কিনতে চাই। কিন্তু কোথা থেকে বই কিনব? সৃজনশীল প্রকাশকদের একটা বড় অংশ বইমেলার বাইরে তাদের বই বাজারজাত করেন না। তারা বাকি ১১ মাস বই ‘রক্ষণাবেক্ষণ’ করেন, বিক্রি করেন না বা করতে পারেন না। এ বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি আমাকে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছিল। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ফিরে আমি পছন্দের বইগুলোর বেশির ভাগই আর কিনতে পারছি না। কারণ সে বইগুলো কোথায় পাওয়া যাবে, সে রকম কোনো তথ্য আমার হাতে নেই। আমি হয়তো ব্যক্তিগত যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছু বই সংগ্রহ করে ফেলতে পারব, কিন্তু বেশির ভাগ পাঠকেরই সেই সুযোগ নেই।

রাজীব নূর প্রকাশিত পুরস্কার পাওয়া বইগুলো যদি সিলেট, চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহীর একজন পাঠক সংগ্রহ করতে চান, তাহলে পদ্ধতিটা কী, কেউ বলতে পারবে না। রাজীব নূরের পাঠসূত্র, ফয়সল আরেফিন দীপনের জাগৃতি আর রবিন আহসানের শ্রাবণ প্রকাশনীর উপস্থিতি আছে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে, কিন্তু সেখানেও তাদের বই পাওয়ার কোনো উপায় লেখা নেই। পাঠসূত্রের আলাদা একটি ওয়েবসাইট আছে, সেই ওয়েবসাইটেও বই কেনার কোনো পদ্ধতি বাতলানো নেই। সাদা চোখে দেখা যায়, ঢাকার বাইরের বইয়ের দোকানগুলো এসব বই রাখে না। তবে আদৌ রাখে না, নাকি রাখার জায়গা খুঁজে পায় না, সেটা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। সাধারণ মানের বইয়ের দোকানে হুমায়ূন-মিলন-জাফর ইকবালের বাইরে বই বিক্রি হয় কাশেম বিন আবু বাকার নামের এক লোকের, কিন্তু আহমাদ মোস্তফা কামালের বই সেখানে পাওয়া দুষ্কর। জামায়াত শিবিরের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কাশেম বিন আবু বাকার সেখানে পৌঁছে যায় ঠিকই, কিন্তু সে রকম নেটওয়ার্ক না থাকায় আহমাদ মোস্তফা কামাল সেখানে পৌঁছাতে পারেন না। এখন ঢাকার বাইরের বাংলাদেশের এই বড় পাঠকগোষ্ঠীকে কীভাবে বলা যায়, আপনারা বই পড়তে চান না!

এই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আমাদের প্রচলিত দোহাই হচ্ছে সরকারের দিকে আঙুল তোলা। সরকার যদি একটি বইয়ের মার্কেট করে, সরকার যদি বই কেনে, সরকার যদি ট্যাক্স কমিয়ে দেয়ঃএভাবে সরকারের ঘাড়ে অনেকগুলো ‘যদি’ তুলে দিয়ে এই ব্যবসাটি শেষ বিচারে একটা স্থবির অবস্থায় চলে যাচ্ছে।

তরুণ ও সৃজনশীল প্রকাশকদের কাছে আমার অনুরোধ, দয়া করে আপনারা বই বিপণনের বিষয়টিকে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবুন। শুধু বইমেলাকেন্দ্রিক বিপণনব্যবস্থা নিয়ে আপনারা বেশি দিন টিকে থাকতে পারবেন না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই তরুণ ও ক্ষুদ্র পুঁজির প্রকাশকেরা কী করতে পারেন? তাদের পক্ষে তো জেলায় জেলায় দোকান তৈরি করা সম্ভব নয়। কথা সত্যি, কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও সত্যি, এই তারুণ্যের উদ্যমই এসব পুঁজির স্বল্পতা জয় করতে পারে।

একুশের বইমেলা কীভাবে শুরু হয়েছিল, সে কথা নিশ্চয়ই সচেতন পাঠকের স্মরণে আছে। চিত্তরঞ্জন সাহা নামের সেই মানুষটি তার অসীম মমতা বুকে নিয়ে একদিন সকালে বাংলা একাডেমীর মাঠে চাদর বিছিয়ে বসে পড়েছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে চিত্তরঞ্জন সাহা সেই কাজটি করেছিলেন, সরকার কবে জায়গা দিয়ে মার্কেট তৈরি করবে, সে আশায় তিনি তার গুদামে বই জমিয়ে বসে থাকেননি। সেই চিত্তরঞ্জন সাহার একটা উদ্যোগই আজকের বইমেলা, যেখান থেকে লাভবান হচ্ছেন প্রকাশক-লেখক-পাঠক।

আমরা কি তরুণ প্রকাশকদের মধ্য থেকে এ রকম আরও কিছু চিত্তরঞ্জন সাহা পেতে পারি না? একটা সহজ হিসাব দিই। ঢাকা থেকে আন্তনগর বাস ছেড়ে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ‘সোহাগ, ‘শ্যামলী’ এ রকম কাব্যিক নামের বড় বড় বাস কাউন্টারের প্রত্যেক যাত্রী-অপেক্ষাগারে দিনে গড়ে ১৫০০ যাত্রী অপেক্ষা করে। যিনি নিয়মিত বই পড়েন না, সেই পাঠকও দীর্ঘ যাত্রায় একটি বই পড়ে সময় কাটাতে চান। কিন্তু যাত্রী-অপেক্ষাগারে থাকার সময় একটা বই নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ নেই সেখানে। আমাদের সৃজনশীল প্রকাশকেরা যদি সেখানে গিয়ে একটা বইয়ের র‌্যাক করেন, তাহলে বড়জোর জায়গা লাগবে ২০ বর্গফুট। একেকটি বড় যাত্রী-অপেক্ষাগারের গড়ে সাড়ে চার হাজার বর্গফুটের ১ শতাংশ জায়গাও নয়। একটা তরুণকে বসিয়ে দিলে বই বিক্রির টাকায় তার বেতন আর ভাড়া উঠে যাওয়ার কথা, বই বিক্রি থেকে প্রকাশকের লাভ যদি নাও হয়, অন্তত বই ‘রক্ষণাবেক্ষণ’ থেকে তো মুক্তি পাওয়া যাবে। কেউ কি উদ্যোগ নিয়ে বাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দেখবেন?

একুশের বইমেলা শেষ হয়েছে, বিক্রি না হওয়া ‘বিশাল বইয়ের স্তূপ’ নিয়ে সৃজনশীল প্রকাশকেরা কি নারায়ণগঞ্জ কিংবা কুমিল্লা, ময়মনসিংহের মতো আশপাশের শহরে যেতে পারেন না? হতে পারে একটি সাত দিনের বইমেলা, যেকোনো স্কুলের আঙিনায়, স্থানীয় শিল্পকলা কিংবা শিশু একাডেমীর উঠোনে কিংবা শহীদ মিনারের পাদদেশে একটা ঝুপড়ির মতো করে সেখানে তাদের বই নিয়ে একটা ছোট্ট বইমেলা করাটা কি খুব কঠিন? মোটেও কঠিন নয়, প্রয়োজন উদ্যোগ, উদ্যম। আমার বিশ্বাস, স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী আর সাংবাদিকেরা তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন।

ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লে দেখা যায়, ইদানীং কিছু হকার বিদেশি পাইরেটেড বইগুলো নিয়ে গাড়ির জানালায় ভিড় করে। ইংরেজি এই বইগুলোর বিক্রি মন্দ নয়, নইলে এতোগুলো হকার বই নিয়ে রাস্তায় ছুটোছুটি করত না। আমাদের সৃজনশীল তরুণ প্রকাশকেরা কি এ রকম কোনো পদ্ধতির কথা ভেবেছেন? দেশে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিকেল কলেজ কম নয়। সেগুলোর সামনে একটা ছোট টেবিল সাজিয়ে যদি ফ্লেক্সিলোডের টাকা ভরা যায়, তাহলে বই নিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়তে অসুবিধা কোথায়? কিছু বেকার তরুণের একটি গতি হতে পারে তাহলে; বিশেষ করে কয়েকজন ছাত্রকে কমিশনের ভিত্তিতে পার্টটাইম কাজে লাগিয়ে দেখুন না কী ফল আসে।

ডাকযোগে পছন্দের বইটি পাওয়ার কোনো উপায় আমাদের দেশে তেমন একটি নেই। কিন্তু মোবাইল ফোনের যুগে ফ্লেক্সিলোডে টাকা পাঠিয়ে বই সংগ্রহ করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করা কি খুব জটিল কিছু? মনে তো হয় না। ফরিদ নামের এক ছাত্রকে আমি জানি, সে বইমেলা ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইট চালাচ্ছে। তার এখানে অর্ডার দিলে সে দুনিয়ার যেকোনো দেশেই বই পৌঁছে দেয়। অনেক কষ্টেসৃষ্টে শুধু শখের বশে সে দীর্ঘদিন ধরে ওয়েবসাইটটি চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রকাশকেরা কি এই পাগলা তরুণ ফরিদকে একটু বেশি কমিশন দিতে পারেন না? বিদেশে আমাদের বিপুলসংখ্যক পাঠক আছেন, সরকার হঠাৎ করে কয়েক বছর আগে ডাকমাশুল বাড়িয়ে দেওয়ায় তারা বই কিনতে হিমশিম খান। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে কি প্রকাশকেরা একটু ধরনা দিয়ে বলতে পারেন না, যাতে করে বইয়ের ডাকমাশুল কমানো হয়?

ইন্টারনেট এখন মধ্যবিত্তের সহজলভ্য মাধ্যম। আমাদের বইয়ের মূল পাঠকও এই মধ্যবিত্তরাই, কিন্তু বিদেশে আমাজন ডটকমের অসাধারণ সাফল্যের পরও আমাদের প্রজন্মের কোনো প্রকাশক এই মাধ্যমটিকে বাজার সম্প্রসারণের কাজে ব্যবহার করছেন না। গুগল বুকস এ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের বইয়ের অংশবিশেষ আপলোড করে রেখেছেন প্রকাশকেরা, সেখান থেকে বিনা মূল্যে বইয়ের কিছু অংশ পড়ার পর ভালো লাগলে সেই বই কেনা যায়। এই ফ্রি সুবিধাটুকু নেওয়ার ব্যাপারে দেশের কোনো প্রকাশক কি আগ্রহী হবেন না? এই দেশে কিছু অসৎ ওয়েবসাইটে জনপ্রিয় লেখকদের বইয়ের স্ক্যান কপি বিনা মূল্যে ডাউনলোড করা যায়। এই সাইটগুলোর জনপ্রিয়তা বিস্ময়কর। এতে লেখক-প্রকাশক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন, কিন্তু কোনো লেখক-প্রকাশক কি ওয়েবসাইটের এই তালিকাটি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে দাবি তুলেছেন, এই সাইটগুলোর এক্সেস বন্ধ করে দেওয়ার জন্য? তেমন কোনো সংবাদ আমার চোখে পড়েনি।

আমাদের সমস্যা হচ্ছে যে মমতা নিয়ে ক্ষুদ্র প্রকাশকেরা বই প্রকাশ করেন, সেই একই মমতা আর আগ্রহ নিয়ে বছরব্যাপী আগ্রাসী মার্কেটিংয়ে তাদের ব্যস্ততা অনেক কম। একটি সত্যিকার পরিবেশক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য কয়েকজন প্রকাশক যদি এক হন, তাহলে কম খরচে সারা দেশে বই ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। এই পরিবেশক প্রতিষ্ঠানটি শুরু হতে পারে ১০ জন ছোট প্রকাশকের অংশগ্রহণে। সারা দেশে বিপণনকর্মী নিয়োগ দেওয়া অসম্ভব হলেও অন্য প্রতিষ্ঠানের বিপণনকর্মীদের কাজে লাগিয়েও এ কাজ করা যায়। ভোগ্যপণ্য এবং ওষুধ কোম্পানির বিপণনকর্মী দেশের সব জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে আছেন। দিনের একটি অংশে তাদের কোনো কাজ থাকে না। তাদের কমিশনের ভিত্তিতে পার্টটাইম কাজে নিয়োগ দিলে তারা বই বিপণনেও দক্ষতা দেখাতে পারবেন। দেশের বড় বড় পত্রিকা, টিভি চ্যানেল-এসবে নানা ধরনের কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রাইজবন্ড পুরস্কার দেওয়া হয়, ভোগ্যপণ্য বিপণনে স্ক্র্যাচ কার্ডের মাধ্যমে পুরস্কার দেওয়ার পদ্ধতি কয়েক বছর ধরে চালু আছে। প্রকাশকেরা সেখানে বই পুরস্কার দেওয়ার জন্য মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করতে পারেন। মোবাইল ফোন কোম্পানির সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির স্লোগানে বই বিক্রির সুযোগ আছে, প্রয়োজন সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সঠিক প্রস্তাব উত্থাপন করা যায়। আগোরা, নন্দনের মতো মেগাশপে যদি তেল ডাল চিনির জন্য তাক ভাড়া নিয়ে কোম্পানিগুলো তাদের প্রডাক্ট বিক্রি করতে পারে, তাহলে বই পরিবেশক প্রতিষ্ঠানেরও উচিত সেখানে তাক ভাড়া করে বই বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া। ব্যবসাকে ব্যবসা হিসেবেই নিতে হবে, পণ্যকে পৌঁছে দিতে হবে ভোক্তার হাতের নাগালে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আগ্রাসী বিপণন পদ্ধতি ছাড়া কোনো পণ্যেরই এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

আমি নিশ্চিত, প্রকাশকেরা যদি তাদের মেধা খাটিয়ে উপায় উদ্ভাবন করতে চান, তাহলে অনেক সুন্দর বিপণনব্যবস্থা তারা গড়ে তুলতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম উল্লেখ করতে চাই। বইমেলাকেন্দ্রিক জনপ্রিয় লেখকদের বই প্রকাশ না করেও এই প্রকাশনাটি বছরের পর বছর সাফল্যের সঙ্গে চলে আসছে। এর মূলে রয়েছে কাজী আনোয়ার হোসেনের শক্তিশালী বিপণন নেটওয়ার্ক। সেবার বই প্রকাশ মেলাকেন্দ্রিক নয়, প্রকাশনাকে সারা বছর চালু রেখে নিজস্ব বিপণনের মাধ্যমে তারা পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেয়। সারা দেশের রেলওয়ে বুক স্টলগুলোতে সেবা প্রকাশনীর বই পাওয়া যায়, কিন্তু অন্য কোনো প্রকাশনীর বই, এমনকি হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো জনপ্রিয় লেখকদের বইও সেখানে পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা অন্য প্রকাশকেরা করেননি।

বই বিপণনের যে কয়টি নতুন পদ্ধতি আমি এই লেখায় প্রস্তাব করেছি, তার অনেকগুলোই অনেকের কাছে অবাস্তব এবং হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু আপাত অবাস্তব আর হাস্যকর মনে হওয়া ধারণাগুলো থেকেই হয়তো কোনো একটি চমৎকার সাফল্য চলে আসবে।

চিত্তরঞ্জন সাহা যখন কোনো এক একুশে ফেব্র“য়ারির বিকেলবেলা, মাঠের মাঝে চাদর বিছিয়ে তার বইগুলো নিয়ে বসে পড়েছিলেন, তখনো নিশ্চয়ই সেটাকে অদ্ভুত বলার লোকের অভাব হয়নি। রাজীব নূর যখন বইয়ের মাঝে বিজ্ঞাপন ছাপেন, হার্ড কভারের বদলে পেপার ব্যাকে বই ছাপার চেষ্টা করেন, তখনো আমি দেখেছি, অনেকেই ভুরু কুঁচকেছেন।

কিন্তু ভুরু কুঁচকানোর কিছু নেই। নতুন কিছু করেই বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। শেষ বিচারে বই একটি পণ্যই, বই প্রকাশ করা একটি ব্যবসাই বটে। যে প্রকাশকেরা ব্যবসায় সুস্থতা বজায় রাখতে চান, তাদেরও খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে।

আর সেটা তখনই সম্ভব হবে, যখন প্রকাশক সারা বছর বই বিক্রি করতে পারবেন।

চিত্তরঞ্জন সাহা আমাদের ফেব্রুয়ারি মাসে বই বিক্রি করতে শিখিয়ে গেছেন, এখন আমরা পাঠকেরা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব পরবর্তী প্রজন্মের প্রকাশকদের কাছে, যারা বাকি ১১ মাসগুলো বই ‘রক্ষণাবেক্ষণ’ না করে, ‘বিক্রি’ করার কৌশল আবিষ্কার করবেন।

নিজের ঢাক ঢোল নিজে পিটাই

         

সুরাইয়া হেলেন

কী করি বলুন তো ? আমরা যারা ছুটকা ফুটকা লেখালেখির সাথে জড়িত, বইমেলা যতই এগিয়ে আসতে থাকে,ততই আকুল হতে থাকি নিজের লেখাগুলো একটা বইয়ের আকারে দেখতে! প্রথম বই যখন প্রকাশিত হয়েছিলো, কিছুই বুঝতাম না এসব প্রকাশনীর ব্যাপার স্যাপার! ফর্মা, ১০০-৭০গ্রাম কাগজ, স্ক্রিপ্ট, প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ, বাঁধাই, কম্পোজ, ছাপা, আরও কত কী! প্রকাশকের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে শুনতে হলো কত যে মহার্ঘ বাণী! একে তো নবীশ লেখিকা তারপর আবার কবিতার বই! এক প্রকাশক তো সরাসরি বলে দিলো কবিতা বুঝিও না,ছাপিও না! আরেক নামকরা প্রকাশক বললো,কবিতার বই ছাপলে আমাদের ব্যবসার ক্ষতি,নিজের ক্ষতি করে তো আর বই ছাপতে আসি নি? বিখ্যাত কবি আল মাহমুদের বই ই গত মেলায় ১০কপির বেশি বিক্রি করতে পারিনি। পারলে উপন্যাস লিখে নিয়ে আসুন,আর উপন্যাস যেন ৫-৬ফর্মার বেশি না হয়। বুঝুন ঠেলা,ফরমায়েসী লেখা, কবিতা ছেড়ে উপন্যাস লিখতে হবে,আপনি বোধহয় বহুপ্রতিভামুখী, আর লেখা মনে হয় যাদুমন্ত্রে হয়ে যায় । আরে যে কবিতা লেখে সে যে উপন্যাস লিখতেই পারবে এমন কোন নিয়ম কি আছে? তাছাড়া লেখার আগেই কী করে বোঝা যাবে কত ফর্মার লেখা হবে?

    

কী আর করা,বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে অনন্যা আর সৃজনী থেকে বের হলো আমার ২টি কাব্যগ্রন্থ । তারপর শুরু হলো আত্মীয়,বন্ধু,চেনা-জানা,একে তাকে বই কেনার অনুরোধ! এ যেন ইলেকশনের ভোট-প্রার্থী ! ডা.মোহিত কামাল বললেন,আপা এসবে কাজ হবে না, এ্যাড দেন বড় করে কয়েকদিন,প্রচারে প্রসার। কিন্তু অত বড় করে বিজ্ঞাপন দেয়ার অর্থটা আমাকে দেবে কে?এমনিতে কাছের মানুষেরা বলতে শুরু করেছে,ঘরের খেয়ে নাকি বনের মোষ তাড়ানোর খায়েস হয়েছে আমার। তাদের বইয়ের ব্যাপারে কাউকে বলতে অনুরোধ করলেই বলে,ভিক্ষা চাইতে পারবোনা। এতোদিন জানতাম ভোট ভিক্ষুক,এখন শুনলাম বই-ভিক্ষুক! কত সাধ্য সাধনা করে স্ক্রিপ্ট রেডি করলাম, প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ধরণা দিলাম,তারপর আবার রাত জেগে একটা একটা শব্দ অতি সাবধানে দেখে দেখে প্রুফ দেখতে গিয়ে মশার কামড় খেয়ে বাঁধালাম ডেঙ্গু ! যমে মানুষে টানাটানি, ১৮ ব্যাগ রক্ত শরীরে ঢুকিয়ে সে যাত্রায় প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরলাম ।কাছের লোকেরা ভাবলো ইহজনমে বোধহয় আর বই প্রকাশের নাম মুখে আনবো না ।হলো ও তাই,পরের বছর চুপচাপ কাটলো,কিন্ত মেলার সময় মনটা বিষাদে ছেয়ে রইলো, ছোট বড় বইয়ের বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলাম,কার কার বই বেরিয়েছে দেখেও আনন্দ! এর পরের বছর আবার নব উদ্যমে বই প্রকাশের উদ্যোগ শুরু করলাম ! কাছের মানুষেরা বেজার, রোগান্বিত স্বরে বলতে লাগলেন, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী, একবারেও শিক্ষা হয়নি! বনের মোষ তাড়ানোর কাজ আবার শুরু হলো,আমরা কিন্তু তোর বই বিক্রির জন্য ভিক্ষা চাইতে পারবো না…ইত্যাদি ইত্যাদি।

     হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন তারা ।আমাদের মতো যারা পয়সা খরচ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে পারিনা,তাদের বিভিন্ন ব্লগ আর ফেসবুক বিনি পয়সায় সে সুযোগ করে দিয়েছে।কত লেখক কবিদের যে বইয়ের প্রচ্ছদসহ বিজ্ঞপন আসছে , দেখলেই ভালো লাগে ।অথচ এর মাঝেও কিছু কিছু নেগেটিভ চরিত্রের মানুষ উৎসাহ,অনুপ্রেরণা দেয়ার বদলে সমালোচনায় মুখর ।নিজের ঢোল আমরা নিজে পেটাচ্ছি,বই-ভিক্ষুক,লেখক-ভিক্ষুক এইসব ।কোন কোন কবি লেখকদের হয়ে তাদের বন্ধুবান্ধবরা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, তো কথা তো একই হলো,যেই লাউ সেই কদু ! আমার বইয়ের কথা কেও যদি না ই জানলো তবে পড়বেটা কে আর না পড়লে লেখার ভালোমন্দ বুঝবেই বা কীভাবে? কত আজেবাজে,বস্তাপঁচা জিনিষের বিজ্ঞাপনে মিডিয়া সয়লাব,আর বইয়ের মতো ভালো কিছুর প্রচারেই জাত গেলো,মান গেলো,ভিক্ষুক ! সত্যি সেলুকাস… ! অথচ বিদেশি সাদা চামড়ার লেখকরা তাদের বই কাঁধে নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন সারা পৃথিবীময় ।স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার করে তারা তাদের বই নিয়ে কথা বলছেন,প্রচার,বিক্রি আর যা যা করা দরকার সবই করছেন । আর আমরা সে তুলনায় তো কিছুই করছি না।তাতেই যেসব বিরূপ মন্তব্য আর সমালোচনা ! ঐ যে কথায় বলে,যত দোষ নন্দ ঘোষ ! একেকবার ইচ্ছে করে, নাহ্ আর নয়, এতো প্রতিকূলতা সয়ে বই প্রকাশের দরকার নেই । কিন্তু মন যে মানে না । কী করি বলুন তো ?

        মনে মনে ভাবি,দাঁড়াও না,একবার হুমায়ূন আহমদের মতো নামকরা হয়ে নিই,তারপর দেখবে, প্রকাশকরা টাকার বস্তা নিয়ে এসে বাড়ির সামনে লাইন দিবে, ভীড় সামলাতে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে, টাকা গুনতে চার্টার্ড একাউনটেন্ট নিয়োগ দিতে হবে । মনের কথা মুখেও বলে ফেলি । শুনে সবাই বলে, ঐ বেটা হুমায়ূনের কথা আর বলিস না, সে ও কি কম নির্লজ্জ, দেখিস না তার বিজ্ঞাপনের রকম সকম, হলুদ পাঞ্জাবি পরিয়ে হিমু,বর বউ সাজিয়ে সারা বইমেলা চত্বর মিছিল করে ঘোরানো ! বলি, তাহলে আমাদের মতো চুনোপুটিদের মলা মাছের মতো ফেসবুক আর ব্লগ বিজ্ঞাপন কী এমন দোষ করলো রে বাবা ?

        নিজের ঢাক ঢোল নিজেই পেটাচ্ছি, ছি ছি লজ্জাও নেই ।লজ্জার মাথা খেয়ে বলছি বই নামক জিনিষটা বোধহয় খুবই ভারি, তাই কেউই বহন করতে রাজী নন, তাই তো নিজেরটা নিজেকেই পেটাতে হয় !

সত্যিকারের সাহিত্যের চর্চা যারা করেন, তাগোর সহিংস হওনের কথা না।

শোয়েব সর্বনাম

পয়লা দিন থেকাই বইমেলা জমছে দেখা গেল। পুরা মেলা ধইরা একটা চক্কর মাইরা বয়রাতলায় লিটলম্যাগ এলাকায় ঢুইকা পরিচিত লোকজনের দেখা পাইলাম। মুলত, বইমেলার সাহিত্যিকগো আড্ডা এইখানেই জমে ভালো।

 

হটাৎ, একপাশে হাউকাউ শুইনা ঘুইরা খাড়াইলাম, - ঘটনা কী?

 

ঘটনা হইল, লিটলম্যাগঅলারা একটা উচা টেবিল জোগার কইরা তার উপরে টান হইয়া খাড়াইয়া বইমেলার স্পন্সরের নাম টাইনা ছিরতাছেন। অন্যান্যরা একটু দূরে অবস্থান নিছেন এবং দুই হাত প্রসারিত কইরা তালি বাজাইতাছেন। আমি বিভ্রান্ত হইলাম, বয়রাতলায় বইসা এইটা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নমুনা কি না সেইটা বুঝনের জন্য একটু ভাবনা ভাবলাম।

 

যতদূর আমি জানি, মেলা শুরুর আগে দিয়া বাংলা একাডেমঅলাগো কাছে লিটলম্যাগঅলারা তাগোর দাবি দাওয়া লইয়া গেছিলেন। সেইখানে তাগোর একটা প্রস্তাব ছিলো এইরকম যে, প্রত্যেক দোকানের নামের তলে স্পন্সরের নাম না লাগাইয়া আলাদা কইরা একজায়গায় স্পন্সরের নাম দেওন যাইতে পারে। বাংলা একাডেমি তাগোর এই প্রস্তাব আমলে নিছেন। ফলে, লিটলম্যাগঅলাগো সেইটা ছিরনের লেগা বেশি কষ্ট স্বীকার করনের দরকার পরে নাই। অতঃপর, নিজ দায়িত্ব তেনারা ওইজায়গায় লিটলম্যাগ চত্বর লেইখা লাল কইরা থুইসেন।

শুনছি, ট্রিপিকাল বাঙ্গালি স্ত্রীলোকের পরিবারে প্রকাশ্যে তাগোর সোয়ামীর নাম লইতে বারন আছে, যদিও সোয়ামিরা তাগোর ভরন পোষন দেন।। তো, দেখা গেল, লিটলম্যাগঅলারা স্পন্সরের খরচায় তেরপল লাগানো খুপড়িতে বইসা পত্রিকা বেচেন, আবার স্পন্সরঅলাগোর লগে স্ত্রীসুলভ আচরন করেন; প্রকাশ্যে নাম লন না। তাগোর পত্রিকার তলে কিন্তু ঠিকই এইসব স্পন্সরের নাম আছে, সেইগুলিও তারা ছিড়েন না। রিকশাওলারা দামি গাড়ির বডিতে চাক্কা বাঝাইয়া দিয়া যেই প্রকারের সুখ পান, ছোত প্রতিস্থানগুলি একই সূত্রমতে বড় প্রতিষ্ঠানের নাম ছিড়া দিতে পারলে সেই ধরনের সুখ অনুভব করেন মনে হয়। যদি লিটলম্যাগগুলা ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান হয়, সেই ক্ষেত্রে বড় প্রতিষ্ঠানের নাম তাগোর নামের পাশে দেইখা খাউজানি উঠবোই, বাংলা একাডেমি সেইটা বুইঝা উঠে নাই।

 

আমার মনে হয়, সত্যিকারের সাহিত্যের চর্চা যারা করেন, তাগোর এইরকম সহিংস হওনের কথা না।

মানিক-মনোবিন্যাস

ড. সন্দীপক মল্লিক

ক. মহাসদ্ভাবনাময় যে মহাবিপ্লব,

    আমি তারই আত্মীয়তা চাই।(প্রথম কবিতার কাহিনী)

খ. আমি অনুভব করিন, পৃথিবী আমার ...

                                             (‘নূতন ঘৃণার প্রথম কবিতা’)

উপর্যুক্ত প্রত্যয়-সঞ্জীব কবিতাপঙ্ক্তির  বিশ্বস্ত উৎপাদক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়(জন্ম : মে-জুন, ১৯০৮খ্রি. অথবা ১৯১০খ্রি. --  মৃত্যু : ৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৬খ্রি.)। তাঁর কথাসাহিত্যই ব্যাপক অর্থে স্বাধ্যায়-সন্নিহিত। কিন্তু, কবিতাগ্রন্থিত শিল্পানুপ্রাসেও তাঁর সত্যায়িত সত্তার অমলিন স্থিতির রূপকল্পের সন্ধান মেলে।

১.

প্রবুদ্ধ সংলাপ : মানিকের ব্যক্তিক আর্থ-দারিদ্র্য তাঁর ঔদার্য-সঞ্জীবিত প্রাণবলয়কে ক্ষীণবৃত্তায়ত করেনি। মানবমনের অনুপুঙ্খ অমৃতায়োজনে মানিক তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ নীলবিষকে শোধন ক’রেছেন। কাব্যানুভবের দীপসারথি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উচ্চারণ এ-প্রসঙ্গে স্মর্তব্য :

                             তুমি নীলকণ্ঠ চারা পুঁতে দিয়ে বলেছিল -- একে জল দাও

                                       একে বিষণ্ন রেখো না ...

                                                        (‘এলেজি : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’)

মানিক বস্তুনিষ্ঠতার অন্তঃপুরে সুধীর স্বারূপ্য অর্জন ক’রেছিলেন। বিজ্ঞানবোধ আর যুক্তিনির্ভরতার আলপনায় তাঁর কথাশিল্প সংবৃত হ’য়েছিলো। ন্যায়সঙ্গ আর কল্যাণচারুতায় তাঁর বাক্যাবলি ফাগুনমণ্ডিত হ’য়েছিলো। কথাসাহিত্যের উজ্জ্বল আভরণে তাঁর শুদ্ধশ্রীমান প্রাণশক্তি হ’য়েছিলো যত্নসুরভিত। অবিনাশী সন্তরণ-অভিজ্ঞায় নিরুপদ্রব হ’য়েছিলো তাঁর সপ্রেম কথাসঞ্চারণা ! তাঁর নৈর্ব্যক্তিক ধ্যানকুশলী কাহিনীবিন্যাস, প্রচ্ছন্ন অথচ চিত্ত্কার্ষক চিত্রার্পিত-সত্যব্যঞ্জনা ছিলো মুগ্ধতায় সমর্পিত। তবে, প্রত্য, মনোমোহিত সংকীর্তন তাঁর প্রার্থিত ছিলো না। সুগভীর, সুতীক্ষ্ণ, স্বজ্ঞা-প্রণোদনাবিদীপ্ত নৈর্ব্যক্তিক অন্তঃসত্যসৌন্দর্যই তাঁর বাক্যবল্লরীতে হ’য়েছিলো বৃত্তাবদ্ধ। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রাসঙ্গিক প্রামাণ্য :

                                ফুলকে দিয়ে

                                মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই

                                ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।

                                তার চেয়ে আমার পছন্দ

                                আগুনের ফুলকি --

                                যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না।(‘পাথরের ফুল’)

 

মানিকের শিল্পীসত্তানুষঙ্গের নির্মেদ দ্রবণ এ-কথকতায় সমুৎসারিত। মানিকসত্তার ধীনিষ্যন্দী সত্যায়ন এ-পঙ্ক্তিমালায় বিধৃত।

২.

মানিক সম্পর্কে মহাত্মা প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঋজু উচ্চারণ :

                        ক. সুদীর্ঘ সুঠাম বলিষ্ঠ চেহারা আমার মনে ... মুদ্রিত।(বিশ্বনাথ দে-সম্পাদিত

                           মানিক বিচিত্রা, কলিকাতা : সাহিত্যম, পৃ. ১৫)

 

                        খ. বিস্ময়, আশ্চর্য অসামান্য একজন লেখকের আকষ্মিক আবিষ্কারে, কৌতূহলী

                            তাঁর লেখার অদ্ভুত ব্যতিক্রমের মূল সম্বন্ধে, প্রশংসা তাঁর সহজাত

                            অনায়াস রচনাকৌশলের জন্যে, আর যন্ত্রণা তাঁর স্রষ্টামনের সেই দুর্বোধ

                            বিফলতার আভাসে জীবনের গভীর প্রতিচ্ছবিও যাতে কেমন একটু বাঁকা

                            হ’য়ে ছাড়া দেখা যায় না।(ঐ,পৃ. ১৬)

যথার্থ, নির্ভার সমালোচনা।

মানিকের কাহিনী-গ্রন্থনায় -- শব্দবাক্যবল্লরীতে এই ‘অদ্ভুত ব্যতিক্রম’-এরই রসায়ন। মানবচরিত্রের অন্তঃস্রোত -- বাসনাবিভ্রান্তি, আর্থদৈন্যপ্রভাবিত অবস্থান-সংকট, অনুষ্ঠানিক ধর্মায়োজনভিত্তিক জীবনধর্মবিচ্যুতি তাঁর সৃজনপটে সন্নিবদ্ধ। তাঁর ভাষ্যে মানবমনায়ত অভিসন্ধি -- নৈতিক অবয়জনিত কষ্ট, অভিঘাত শিল্পস্বনির্ভর হ’য়ে দীপ্যমান। তাঁর চরিত্র-অবলোকনে সূক্ষ্ম পরিব্যাপ্তির কারুকাজই সমুজ্জ্বল। প্রেমেন্দ্র-কথিত ‘ব্যতিক্রম’, ‘বাঁকা’ অভিধা মূলতঃ মানিকের সুগভীর অন্তর্দৃষ্টিপাতেরই মনোমোহন ভঙ্গির ধারক।

মনীষী গোপাল হালদার-এর পর্যবেণ :

                        ক. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হন এই সত্যকে ঘোষণা করে

                            -- রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-সুষমাবাদে আর তাঁর কুলোয় না। অতি-আধুনিকের

                            প্রতিবাদ এবার নাস্তিকের বিদ্রোহে রূপায়িত হ’লো।(ঐ, পৃ.৪৮)

                        খ. মানুষকে, বিশিষ্ট মানুষকে আশ্রয় করে তিনি চরিত্রসৃষ্টিতে অগ্রসর হননি,

                            বরং অনুভূতিকেই আশ্রয় করে -- অমূর্ত ধারণাকে গ্রহণ করে -- তাকেই

                            মানবচরিত্ররূপে মূর্ত করতে চেয়েছেন।(ঐ, পৃ.৫০)

উপর্যুক্ত সম্পন্ন বিবৃতির প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ(১৮৬১খ্রি.- ১৯৪১খ্রি.) প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ ক্রমান্বয়ী পুরুষকারের এক একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের চারিত্র্য সংরণ ক’রেছেন। তাঁর বাস্তবতাপোষিত চিন্তাবলম্বন, শিল্পনিরীতি প্রকরণ -- ছন্দঃকথাযোজনার মোহন মহোৎসব ‘স্রষ্টা’-সত্তানুগত। ‘জীবনদেবতা’ অভিধার অধঃস্তন ধারক ‘নারী’-শিল্পায়িত অশরীরী রমণার্দ্রতায় তাঁর সত্তা সুস্নিগ্ধ হ’য়েছিলো -- এমন ভাবনায় তাঁর স্বতঃউচ্ছল জৈবিক প্রেরণার মানই সুস্থির। বঙ্গভারতবর্ষীয় উপমহাদেশের ধ্যান-অভ্যাসে সত্যাসত্যেও সুবর্ণ-সদ্ব্যবহার কিন্তু যুক্তি-সম্পোষিত নয়। জৈবস্থিতির সুস্বাস্থ্য সর্বোৎকৃষ্ট ‘স্রষ্টা’-অভীক্ষার প্রত্যয়কে সুদৃঢ় করতে সম। কিন্তু শারীরিক-মানসিক সত্তাকর্ষণার পরিশুদ্ধ পদ্ধতি-আত্মঃস্থকরণে দুর্বিপাকের সঞ্চারণাহেতু ঐ প্রক্রিয়াটি অবিন্যস্ত, সর্বজনীন নয়। প্রক্রিয়াটি এমন -- অর্বাচীন মানবগোষ্ঠীই অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক অপঘাতের শিকার হ’য়ে বিধ্বস্তপ্রায়। উজ্জ্বল প্রাণ-আবাহক গোপাল হালদার মানিক-চারিত্র্য-বিশ্লেষণের এক পর্যায়ে যথাযথই উচ্চারণ ক’রেছেন :

                           দেবতায় বা পারমার্থিক সত্যে বিশ্বাস অনেক সহজ, কিন্তু মানুষে বিশ্বাস,

                           সভ্যতায় বিশ্বাস অনেক দুশ্চর সাধনা-সাপে। এ সাধনাকে গ্রহণ করে

                           মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মানবীয় সততার প্রমাণ ও শিল্পীসত্তার এক মহৎ

                           ঐতিহ্য রেখে গিয়েছেন -- যারা সাহিত্যে বিশ্বাসী, মানবতায় বিশ্বাসী তাদের

                            জন্য রেখে গিয়েছেন পরাহত মানবাত্মা ও মানুষের এই জয়স্তম্ভ।(ঐ, পৃ. ৫৩)

বিজ্ঞানদ্যুতিময় মানিক ছিলেন প্রত্য জীবন-আস্তিক্যে সাধক। তবে, অবোধ স্বজ্ঞাহীনের নাস্তিক্যসাধনার প্রেক্ষাপটে তাঁর কথা-শিল্পায়োজনের রসাস্বাদন দুরূহ। তিনি ছিলেন অবিনাশী প্রত্য শিল্পায়তনের সমুৎপাদক।

৩.

শিল্পপ্রাজ্ঞ বুদ্ধদেব বসুও মানিক-মনোভঙ্গির ‘কঠোরতর বস্তুনিষ্ঠা’ ও ‘কর্মভেদী তীক্ষ্ণতা’র সংসিদ্ধ চিত্রশ্রী পর্যবেণ ক’রেছেন। বিত্তহীন জন-আত্মার দৈনন্দিনতা -- নিরালম্ব অশনবসনতৃষ্ণা, ‘নিম্নতম’ সামাজিক ‘পাঁক’-পঙ্কিলতা, ‘জীবনসংগ্রামে আরক্তিম’ অভিজ্ঞানের সম্পন্ন আধার হিসেবে মানিক-বিনির্মিত কাহিনীবৃত্তকে ধ্যানাশ্রয়ী ক’রেছেন বুদ্ধদেব। তাঁর অনুভব-পরিসংখ্যান :

                           ... আস্তে আস্তে এক দিগন্তহীন চতুষ্কোণ প্রদেশ তিনি দখল করে নিলেন :

                             মানুষের নিঃশ্বাসে ঘন ও তপ্ত সেই দেশ, উদ্ভাবনে উর্বও, জীবনসংগ্রামে

                             আরক্তিম -- যেখানে চোর, ভিখিরি, কুষ্ঠরোগী, কেরানী এবং কেরানীর

                             বউ জীবন ও প্রজননের মূলসূত্রে অবিরাম ঘূর্ণিত হচ্ছে। এই প্রদেশের

                             বাস্তবতা অনস্বীকার্য এবং বাস্তবতাই এর প্রধান গুণ।(ঐ, পৃ. ৮৩)

বাস্তব জীবনছবি-সংরক্ষণ -- আর্থ-অন্ত্যজ, গুণ-অন্ত্যজ প্রথাবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সত্তাপ্রভুত্বই মানিকের বাঞ্ছিত ছিলো। আর্থ-প্রসাধন যে জীবনধারাকে উপভোগ্য ক’রে তোলে, নর-নারীর শরীরী-সমুৎপাদন যে পারস্পরিক সৌন্দর্য-সংস্থাপিত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিযোগের নিয়ামক -- এ-সত্যও মানিক আত্মঃস্থ ক’রেছিলেন। তবে, দারিদ্র্যকিষ্ট জনচিত্তের পরিসীমায় সংবেদ্য ইন্দ্রিয়জ ভাবসজ্জার প্রতিই ছিলো তাঁর আত্যন্তিক আকর্ষণ। এ-সূত্রেই তাঁর মনোবিন্যাস -- তাঁর কর্তব্যোচ্ছল তারুণ্যসন্দীপ্তি তাঁর কথাশিল্পসদ্ভাবনার সমান্তরাল সদগতিতেই হ’য়েছিলো সঞ্চয়িত।

sandipakmollick@gmail.com

নারী গেরিলার ডায়রি

ইলোরা চৌধুরী

সাংবাদিক ও নন-ফিকশন লেখক দেবেন্দ্র ভট্টরায় মাস ছয় পূর্বে নেপালের ইলম জেলার চা বাগানে যান। সেখানে তার নিমন্ত্রণকর্তা একজন অল্পবয়সী মহিলার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন যিনি ভট্টরায় এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য তার গ্রাম থেকে প্রায় তিন ঘন্টা হেঁটে এসেছেন।

“ও আটঘর গ্রামের এক কৃষক পরিবারের মেয়ে,” স্মৃতিচারণ করেন ভট্টরায়। “পরিবারের তিন সন্তানের ভিতর সবার বড়। সামান্য যে জমিটুকু ছিল তাতে চাষাবাদে সাহায্য করত। গরুর দুধ দুইয়ে সেই দুধ গ্রামের বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যেত। গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী অব্দি পড়াশোনা করেছিল”। খানিকটা ঘাবড়ে যাওয়া অল্পবয়সী হাস্যোজ্জ্বল মহিলার সাথে ছিল একতাড়া কাগজের একটি পাণ্ডুলিপি। তাতে তার বিশ বছর বয়সী জীবনের কাহিনী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আন্তরিক সরলতার সাথে বর্ণিত। “লেখাটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে আমার প্রকাশককে পাণ্ডুলিপিটি দেখাই,” ভট্টরায় বলেন।

তারা রায় এর “একজন নারী গেরিলার ডায়রি” এখন বিক্রি তালিকার শীর্ষে  অবস্থান করছে। দুমাসেই এটির ৫০০০ এর অধিক কপি বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে এর পঞ্চম সংস্করণের কাজ চলছে ।

১৯৯৬ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছর গৃহযুদ্ধ চালিয়ে আসা গোপন মাওবাদী পার্টির সাথে লেখক কীভাবে মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্ত হলেন তার বিবরণ তিনি এ ‘ডায়রি’ তে তুলে ধরেছেন।

   

উদঘাটিত কাহিনী

তারা রায়ের উপর পার্টির সাংস্কৃতিক অঙ্গের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মাত্র তিন মাস সেখানে অবস্থানের পর তিনি গ্রেপ্তার হন। “আর্মি আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। একজন সৈন্য এসে চুলের মুঠি ধরে আমাকে টেনে আনল”, লিখেছেন তিনি। তিনি মাটি খোঁড়ার শব্দ শুনতে পান এবং ভাবেন হয়তো তাকে খুন করে মাটি চাপা দেওয়া হবে। কিন্তু তা না করে তাকে বিভিন্ন কারাগারে প্রেরণ করা হয় যেখানে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা ও অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা প্রাপ্তির ভিতর দিয়ে তার প্রায় একটি বছর কাটে। ধর্মশিলা চাপাগাইন নামে জেষ্ঠ্য এক মাওবাদী নেতার সাথে তারার পরিচয় ঘটে যাকে তার মেয়ে সহ গ্রেপ্তার করা হয়। চাপাগাইন তারার মা হয়ে ওঠেন, ওকে দেখাশোনা করেন। তারার কালাজ্বর হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য জেলের কর্মকর্তাদের সাথে লড়াই করেন।

বইটি শেষ হয় ২০০৭ সালে তারার মুক্তিপ্রাপ্তির ঘটনার মাধ্যমে। তার আগের বছর মাওবাদীরা একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং নেপালে অস্ত্র ত্যাগ করে। যে কোন ভাবেই হোক না কেন, এই আন্দোলনের বিষয়ে মোহমুক্তি ঘটার ফলে তারা আর পার্টিতে ফিরে না গিয়ে গ্রামে তার পরিবারের কাছে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

বইটির সম্পাদক ভট্টরায় বলেন, “কিছু মানুষ বইটি পড়বে সম্ভবত কৌতূহল থেকে, তবে এটির নিজস্ব কিছু গুণ রয়েছে। যদিও তারা ষষ্ঠ শেণীর বেশি পড়াশোনা করেন নি, লেখার ব্যাপারে তার একটি স্বাভাবিক নৈপুণ্য আছে। একই সাথে তার ডায়রিটি পড়তে গিয়ে স্লোগানসর্বস্ব মনে হয় না যা গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পর মাওবাদী নেতাদের লেখা বইগুলোতে লক্ষ্য করা যায়। এতে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। তারা এতে মাওবাদীদের ভালো ও মন্দ দুটি দিক তুলে ধরেছেন এবং আর্মিকে আপাদমস্তক শত্রু হিসেবে দেখানো হয়নি। খারাপ সৈন্যদের পাশাপাশি ভালো সৈন্যও রয়েছে। যেসকল সৈন্য তাকে বন্দী করেছিল, তারা তাদেরই একজনের প্রেমে পড়েন।

উৎস- ডেকান হেরাল্ড (Deccan Herald)

মেয়েদের দিকে কেন তাকাই

মলয় রায়চৌধুরী

আমরা অনেক জিনিস কেবল দেখি, তাকিয়ে থাকি সেদিকে কিছুক্ষণ, তাকিয়ে থাকার জন্যে তাকাই, হয়তো একটি মুহূর্তের জন্যে। কোনও মেয়ে দেখলে তার দিকে তাকাই। ম্যাজিক হলে সেদিকে তাকাই, সার্কাসের দিকে তাকাই; তাকাবার জন্যে উঠতি সূর্যের খোঁজে যাই কাঞ্চনজঙ্ঘা বা পড়ন্ত সূর্যের খোঁজে যাই কন্যাকুমারীল পুরীর সমুদ্রের ঢেউ বা হরিদ্বারের জলস্রোতের দিকে তাকাই। তারাপীঠের কালীর মুখের দিকে তাকাই বা ছুটে বারান্দায় গিয়ে বরযাত্রীর দিকে তাকাই, বা পুকুর পাড়ে মাছের দিকে তাকাই।

কেন তাকাই?

সে-সব তাকানোর সঙ্গে গভীর চিন্তার সংস্রব থাকে না। তাকাবার পর কোনও কিংবা বিশেষ দার্শনিক প্রতিক্রিয়া ঘটে না মননে। দেখলুম, ব্যাস, কাজ শেষ। কিন্তু কেন দেখি?

আগেকার কালে এরকম ধারণা ছিল যে যা সুনদর তা আমাদের আকৃষ্ট করে । কিন্তু সুন্দর হোক বা কুৎসিত, এই বাইনারি বৈপরীত্যের অস্তিত্ব তর্কের খাতিরে স্বীকার করে নিলেও আমরা কিন্তু সুন্দর-কুৎসিতের ভেদাভেদ দেখার আগে ওব্দি, এবং পরেও করি না। পথে চলতে-চলতে একজন পটচাঋঈ মহিলার দিকে যখন তাকাই তখন কী চাই? আমি আমার কাছ থেকে কী চাই? সুন্দরী না হলেও তাকাই। পথদুর্ঘটনা হলে তাকাই। ঝগড়াঝাঁটি হলে তাকাই। তাকিয়ে দেখবো বলে ছবি আঁকিয়ের প্রদর্শনীতে যাই।

যাকে বা যে-ব্যাপার দেখি, আমরা কিন্তু তার জন্যে দেখি না। আমরা নিজের জন্যে দেখি। আমার দেখায় তার কি এলো-গেল তা নিয়ে ভাবি না। আমি আমার কাছ থেকে কিছু-একটা চাই বলেই দেখি। কিন্তু প্রত্যেকবার তাকালেই যে তা হবে তার স্হিরতা নেই। আমরা সবসময়েই যৌনতার জন্যে কোনও নারীর দিকে তাকাই যে তা নয়। মা কালীর মুখ মোক্ষ-প্রাপ্তির জন্যে দেখি না। তুরীয় আনন্দের জন্যে যে পাঁঠা বলি দেখি, তা নয়। আনন্দ পাবো বলে সূর্যোদয় বা শূর্যাস্ত দেখি না। এমন নয় যে যা দেখি তা ভাললাগে; কিন্তু তবু দেখি।

দেখলে, সঙ্গে-সঙ্গে কেমন একটা অনুরণনের মুহূর্ত তৈরি হয়। চিন্তার গভীরতায় নয়, কেননা দেখা হয়ে গেলে সে-সব নিয়ে আর ভাবি না। আমি একে নাড়া খাওয়া বলতে চাই না। হয়তো একে চমৎকৃত হওয়া বলা যায়। কিন্তু দেখার আগে চমৎকৃত হবো কিনা জানি না। কিংবা যেমন তাজমহলের ক্ষেত্রে, চমৎকৃত হবো ভেবে দেখতে গিয়ে হই না। অথচ কালবৈশাখীর দাপটে নারকেল গাছের পাতাদের একপাশে হেলে গিয়ে দুলছে দেখে চমৎকৃত হই। যদিও মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তা দেখতে থাকলে ভয়ের উদ্রেক হবার সম্ভাবনাকে বাদ দেওয়া যায় না।

অনুরণন কেন ঘটে?

যে-প্রাণী, ঘটনা বা জিনিসের দিকে তাকাই, তার ক্ষমতা নিজের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর জায়গায় পৌঁছোয়। যে দেখছে তার মধ্যে তৎক্ষণাৎ একটি জটিল ও জীবন্ত সাংস্কৃতিক সাড়া জাগিয়ে তোলে, তা অজানা বা অচেনা হতে পারে। যে দেখছে, তাকে মুহূর্তের জন্যে থামিয়ে দ্যায়। যে দেখছে সে নিজের দেখবার প্রক্রিয়ার মধ্যেই গ্রেপ্তার হয়ে যায়।

দেখি বলে, দৃষ্টি আকর্ষণের তোড়জোড় হয়। নারী সাজগোজ করতে পারেন। অট্টালিকার স্হাপত্য অন্যরকম হতে পারে। সত্যসাইবাবা ম্যাজিক দেখাতে পারেন। পত্রিকার প্রচ্ছদ রংবেরং হতে পারে। একে অনেকে বলেন চিত্তাকর্ষক। এখানে চিত্তের কিছু করার নেই। মনের ভাবার সময় নেই। মুহূর্তের মধ্যে প্রভাবিত হবার প্রশ্ন ওঠে না। কেননা দেখি আর ভুলে যাই। মেয়েদের দিকে চোখ বুলোই আর এগোই, হয়তো তখন মনে-মনে অন্য কোনও চিন্তা চলছে, এমনও হতে পারে।

যে প্রাণী, ঘটনা বা জিনিসকে মুহূর্তের জন্যে, vulnerable লাগে, দেখার মাধ্যমে, সেদিকেই বোধহয় তাকাই আমরা। অনেকে মিউজিয়ামের এঘর-সেঘর ঘুরে কোনও একটি দর্শনীয়ের সামনে দাঁড়িয়ে চমৎকৃত হন। মিউজিয়ামে ভাঙাচোরা মূর্তি দেখবো বলে প্রস্তুত হয়ে যাই। তার মানে চমৎকৃত হবো বলে প্রস্তুতি নিই। অথচ পরে স্মৃতিতে ধরে রাখি না অনেক কিছুই।

যা দেখি তা ছোঁয়া যাবে না, তার স্বত্বাধিকারী হওয়া যাবে না, ভোগদখল করা যাবে না। আর দেখার সময় আমার সেসব চিন্তাও করি না। কোনও আধ্যাত্মিকতা নেই, শিল্পবোধ নেই, শিক্ষিতকরণ নেই, আধুনিকতার ব্যাপার নেই, ক্ষণমুহূর্তের দেখাটির মধ্যে। আগেকার দিনে রাজারাজড়াদের দেখাবার জন্যে, ‘খুশি’ করার জন্যে, প্রজারা, ব্যাপারিরা, নানা বিদঘুটে জিনিস উপহার দিতেন বা ক্যারদানি প্রস্তুত করতেন। স্রেফ তাকা বার জন্যে। মনোযোগ দিয়ে, সতর্কভাবে দেখার জন্যে নয়। উদ্দেশ্য থাকে না অমন চাউনিতে। অনুরণনের ক্ষমতা, সেই ক্ষণটুকুর জন্যে, যে দেখছে তার খাতিরে, ওই বস্তুটির বা ঘটনার বা প্রাণীটির মধ্যে জাগ্রত হয়। অনুরণনটি প্রেম নয়। অভিজ্ঞতা শুরু হবার আগেই আমাদের দেখার পর্বটি শেষ হয়ে যায়। অনন্ত পৃথিবীতে একটি জটিলতম সংকেত এক পলকের জন্যে তৈরি হয়।

দেখার মুহূর্তটিই তো কবিতা। নয় কি?

উ ত্ত রা ধু নি ক তা : উত্তপ্ত যৌবনের অন্তর্গত যোগ বিয়োগ

সারওয়ার চৌধুরী

 

ক.

উত্তরাধুনিকতা কি আসলেই খুব জটিল কিছু? না, অতো জটিল কিছু না, যতোটা জটিল দেখানো হয়েছে কিছু ইংরেজী আলোচনায়, যে-সব আলোচনায় মুলত 'রাজকীয়' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, অপেক্ষাকৃত সহজ শব্দ প্রয়োগ করা হ'লে সৃষ্টিশীল পাঠকের কাছে উত্তরাধুনিক ধারনাসমষ্টি আরো সহজবোধ্য হতো বলে মনে হয়।

সেই কথা ঠিক যে, একাডেমীর চত্তরেই উত্তরাধুনিকতা জন্ম লাভ করেছে এবং লালিত হয়েছে কিছুকাল। বলা হয়েছে আধুনিকতার এক অবাধ্য/বিদ্রোহী সন্তান উত্তরাধুনিকতা। প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আপাত প্রতিষ্ঠান বিরোধী এক নব্য বিগ ব্যাঙ, যার ভেতর থেকে ক্রমাগত তত্ত্ব বেরিয়ে আসছে এবং প্রসারিত হচ্ছে।

মানবজাতি এখন উত্তরাধুনিক সময়ের চৌহদ্দিতে জীবন ও স্বপ্নের খেলায় মেতে আছে। আধুনিকতা বেচারা কানা বোবা মিসকিন! খুব করুন দশা আধুনিকতার! কেন? কে দায়ী? এর সদুত্তর বের করা মুশকিল। কেননা, যদি এমন হয়ে থাকে, সময়ের বিশাল ক্যানভাসে চিত্রায়িত দৃশ্যই স্বয়ংক্রিয় আসছে ধারাবাহিক, তাইলে কাউকে দায়ী করা যায় না। কিন্তু উত্তরাধুনিকতার কিছু ধারনা আধুনিকতার কিছু কীর্তিকলাপকে দায়ী করছে। তা তর্কসাপেক্ষ বটে।

এক বান্ডিল দর্শনের বাক্স এই উত্তরাধুনকতা ১৯৮০ কিংবা মতান্তরে ১৯৭০ এর দশক থে'কে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে- এই তথ্য পন্ডিতগণ দিয়েছেন। আবার এও জানানো হয়েছে, ১৯৫১ সালে এক চিঠিতে আমেরিকার কবি চার্লস ওলসান 'উত্তরাধুনিক মানুষ' উল্লেখ করেছিলেন। আধুনিকতা ঠিক কখন শুরু হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিগত শতকের প্রথম/দ্বিতীয়/তৃতীয় দশককে আধুনিকতার যৌবনকাল ধরা হয়। আর শুরুটা ধরা হয়, ইউরোপীয় এ্যানলাইটেনমেন্টের সময় আঠারো শতকের মাঝামাঝি। উত্তরাধুনিকতাকে বুঝার জন্য আধুনিকতার লেবেলগুলো দিকে নজর দেয়া দরকার। কারণ, আধুনিকতা প্রায় সকল দরজায় লেবেল লাগিয়েছে একেবারে মজবুত ক'রে সুপারগুলু দিয়ে! আধুনিকতার যৌবনকালের রূপ একেবারে 'মায়াবনবিহারীনি হরিণী'! সকল প্রকার মতবাদ/বিশ্বমত আধুনিকতার রূপে পাগল হয়েছে, প্রেমে পড়েছে। আধুনিকতাও তার অনিন্দ্য আদরে সবাইকে সন্তুষ্ট করেছে। আহ্ এই আধুনিকতার সেই যৌবনের ঝলক আর এখন নেই! বলে রাখা দরকার, হাই মর্ডানিজম সময়ে মানবজাতি কিছু অসাধরণ মানুষ পেয়েছে। তারা হলেন, এলিয়ট, কাফকা, ওলফ, মালার্মে পাউন্ড প্রমুখ।

উত্তরাধুনিকতাও কারো কাছে রূপবান কন্যা, রহিম বাদশারাই প্রেমে পড়েছে, অনেকে এখনো নাবালক, তাই রূপবানের পেছনে ঘুরঘুর করতে আরো কিছু দশক পার হতে হবে।

তাহলে উত্তরাধুনিকতাকে সহজে কেমনে বুঝা যায়? সংজ্ঞা নাই। তার একটা অংশ সংজ্ঞা ও বিরোধী। চট ক'রে ধরে ফেলা যাবে না। ওই পথে হাঁটতে হবে, দেখতে হবে- কি কয়, কেন কয়, কারে ডাকে, কেন ডাকে? জায়েজ ভালোবাসা নাকি না-জায়েজ ভালোবাসা! পরিচয় পেলে হয়তো আপনিও বলবেন-'আমারো পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই গো'।

কিছু সারকথা এরকম, যা উত্তরাধুনিকতাকে তুলে ধরে-

> বিষয়ের অর্থে অনিশ্চয়তা থাকবে এবং সিদ্ধান্তমুলক ব্যাখ্যা পরিহার (গ্রাউন্ডলেস)

> আধুনিকতার অবাধ্য সন্তান

> এক অংশে- অলৌকিকতা পূর্নাঙ্গতা এবং পবিত্রতার বিরোধিতা (আইকনোক্লাজম)

> সকল প্রকার বিশ্বমত ক্ষমতার নিমিত্তে, সত্য পাওয়ার জন্য না, এমন মনে করেন উত্তরাধুনিকতাবাদীরা।

> পশ্চিমা আধুনিকতাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, মশকারী মূখ্য কিংবা রংবাজি

> নিপীড়িত জনতার পক্ষে, বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে

> নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া, পুনর্জাগরনের পক্ষে (সকল প্রকার পুনর্জাগরন, ধর্মীয় পুনর্জাগরনসহ)

> যা করা দরকার করো, দ্বিতীয় চিন্তার প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।

ইত্যাদি।

উল্লেখ করা আবশ্যক যে, উত্তরাধুনিকতার গুরু পুরুষেরা হলেন মিশেল ফুকো, জ্যাক দেরিদা এবং রোর্টি। আর চমৎকার হলো, উত্তরাধুনিকতাও বাইনারী অপজিশনের আওতাভূক্ত। না-বোধক এবং হাঁ-বোধক প্রপঞ্চ এর ভেতরে আছে।

খ.

বাইনারী অপজিশন- না-হ্যাঁ, বা ইতি নেতি, ডান বাম, দিন রাত. আলো অন্ধকার, উপর নীচ অর্ডার ডিজঅর্ডার ইত্যাদি প্রাণহীন ও প্রাণসমেত অগণন প্রপঞ্চ। নারী পুরুষও বাইনারি অপজিশন গন্য। কিন্তু এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়,নারী পুরুষ আসলেই কি একে অপরের বিপরীত সত্ত্বা? ক্রোমোজম এক্সএক্স এক্সওয়াই পার্থক্য সূচকে কি দেখা যায়? অর্থাৎ এক্স ক্রোমোজম দুইয়ের মধ্যে আছে। দুইটা আলাদা লৈঙ্গিক সত্ত্বা হয়েও ইন্দ্রিয়জ অনুভূতিগুলো একই রকম নয় কি? মানুষ, হ্যাঁ মানুষ, নারী হোক কিংবা পুরুষ, মানুষ সত্ত্বাটার মধ্যে পুরুষ মন নারী মন উভয়ের আংশিক উপস্থিতি দেখা যায় কি? সভ্যতার ইতিহাসে নারী ও পুরুষের লৈঙ্গিক রাজনীতির একটা বিরাট ভূমিকা (অধিকাংশই নেতিবাচক) প্রণিধানযোগ্য। এর পেছনে কিছু বিশ্বমতের (গ্রান্ড নেরেটিভস) অপব্যবহার/চালবাজি চোখে পড়ার মতো। অধিকার বঞ্চনার ধারাবাহিকতা নারীবাদ এর জন্ম দিয়েছে। ক্ষোভ, বেদনা ভারাক্রান্ত অবস্থা আর্ত-চিৎকারসমৃদ্ধ শিল্পেরও জন্ম দিয়েছে। ঈসা নবী মৃত লেজারাসকে কবর থেকে জিন্দা করা নবীয়ানা কুদরতি। কিন্তু সিলভিয়া প্লাথ এর 'লেডি লেজারাস' অন্তরজ্বালা থে'কে বেরিয়ে আসা কান্না হিসাবে গণ্য।

নারীবাদের ধারণাগুলোও আপডেটেড হচ্ছে। নারীবাদ উত্তরাধুনিকতাকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু যখন দেখা যায়, ক্লাস্টার বোমা ফেলে যারা অগণন মা শিশু হত্যা করে নির্বিচারে, তারাই আবার এসপিওনাজ কারিশমা দেখিয়ে গ্লোবাল পলিটিক্স নিয়ন্ত্রন করার জন্যে নারীবাদী কারো কারো পেছনে 'মহান' পৃষ্টপোষকের ভূমিকা রাখে,তখন ব্যাপারটা হাস্যকর ড্রামা হয় কি না ভেবে দেখার অবকাশ আছে। রাজনীতির ভেতরে বিস্তর রংবাজি খালি চোখে দেখা যায়। বিশেষ চশমা লাগালে দেখা যায় অন্য কিছু! উত্তরাধুনিকতা বলে- 'খালি চোখে দেখো, অনেক তামাশা দেখবা'। রাজনীতির 'সত্য' হলো- 'তুমি আমার হইলে তোমার সাত খুন মাফ। তুমি কয়লা হইলেও তোমাকে সোনা বইলা চড়া দামে বাজারে বেইচা দিমু।' রাজনীতির এই 'সত্য' নারীকে যথাযথ সম্মান দেয় না এবং পুরুষকেও পুরুষ থাকতে দেয় না- এমন মত প্রকাশ করার সুযোগ থাকে।

আধুনিকতা যেমন সকল দরজায় তার লেবেল লাগাতে সক্ষম হয়েছে, তেমনি উত্তরাধুনিকতাও সকল বন্ধ দরজার কড়া নাড়ছে! উত্তরাধুনিকতাকে দেখলে আধুনিকতার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, রক্তশূন্যতায় ভোগে! কিন্তু আধুনিকতার 'রোমান্টিসিজম' ঘাঁটি বড়ই মজবুত কেউ কেউ বলেন। উত্তরাধুনিকতার জন্যে 'রোমান্টিসিজম' এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। পুতুপুতু প্রেমের বন্যায় ভাসছে বিশ্বসমাজ। এ্যান্ডু কোহেন বেচারা বলে দিয়েছেন, 'ওই মাইয়ার জন্যে ভালোবাসা আর নতুন গাড়ি কেনার প্রবণতা একই রকম।' তবে কথা আছে, নারী আর গাড়ি এক নয়।

গ.

আধুনিকতার বিস্তারিত সময় ব্যাপে রোমান্টিসিজম পাকাপোক্ত হয়েছে বলা হয়। প্রেম প্রেম এবং প্রেমের মধ্যেই মুক্তি যুক্তি- এইমতের কথা আছে।। রোমান্টিসিজম এই মর্মে অভিযুক্ত যে, 'আবেগ দিয়া বুদ্ধি বা যুক্তিকে চাপা দেয় অথবা ঢাইকা রাখে'। আর এই ইজমের পক্ষে যারা, তারা বলেন, যুক্তি কান্ধে নিয়া দৌঁড়াইয়া সাতরাইয়া কূল-কিনারা পাওন যাইব না। যুক্তির বাত্তি দিয়া আইজ দেখবা এক রূপ, কাইল দেখবা আরেক রূপ। আইনস্টাইন মিয়াও ভাবে মজিয়া বেহালা বাজাইসে, প্রেম করছে শালীর লগে।'

রোমান্টিসিজমকে ভাব দরিয়া বলা হয়। দেহ প্রেমের সিঁড়ি বেয়ে অধরার প্রেমের দিকে উঠতে থাকে। সভ্যতার তাফালিংয়ের চাইতে প্রকৃতির দিকে মনোযোগ দেয় বেশি। কথার উপরে কথা নাচে। শুধু ভাবে মজে থাকলেও তো চলে না। দুনিয়াদারীর পক্ষে যুক্তির ভূমিকাও অনুজ্জ্বল নয়। অঙ্ক করতে হয়। সমিকরণের সমাধান বের করতে হয়। অংকের দৌলতে 'যাও পাখি বলো তারে সে যেনো ভূলে না মোরে' এর দিনকাল এখন নাই। এখন আলোর গতিকে পেছনে ফেলে 'এসএমএস' এর শব্দগুলো মুহুর্তেই পৌছে দেয় প্রেম! আবার প্রেমিক/প্রেমিকা এসে বলবেন- 'বিজ্ঞানের আবিস্কারের মধ্যেও অধরার প্রেম ক্রিয়াশীল। তাই আইনস্টাইন নিজেও দেখাতে পারেন নি কেমতে বের হয়েছিলো ই = এমসি স্কয়ার!' নিমগ্ন সুরকার হঠাৎ পেয়ে যান অসাধারণ সুর। কবি কখন লিখে ফেলেছেন অনিন্দ্য পংক্তিটি টের পান নি, নিজের পংক্তি নিজেই দেখে বিস্মিত! সকল প্রকার শিল্পের কারিগরদের বেলায় এমন হয়।

উত্তরাধুনিকতার না-বোধক প্লাটফরমের কিছু ব্যাপার নারীবাদীগণ খুব পছন্দ করেন। কারণ 'the postmodern avowal of fragmentation and multiplicity tends to attract liberals and radicals. This is why, in part, feminist theorists have found postmodernism so attractive'. একজন নারীবাদী বলেছিলেন, 'রোমান্টিক প্রেম পুরুষকে খবরদারী করার সুযোগ দেয়'। বিষয়টা নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। ভালোবাসা সমান্তরালে থাকলে আধিপত্যের প্রশ্নটা আসে না। আর যেই অরগ্যানের যেই দায়িত্ব, সেই অরগ্যান সেইটা ঠিক মতো পালন করলো কি না দেখার বিষয়।

উত্তরাধুনিকতার ওই যে মাল্টিপ্লিসিটি, তার কোনো সীমা নেই, অনেক ব্যাপারকে আওতায় আনতে পারে। মুক্ত বিহঙ্গের অসীম আকাশে উড়ে বেড়ানোর মতো।

যাক, এ পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে, উত্তরাধুনিক পন্ডিতগণ রোমান্টিসিজমকে যে-ভাবে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন, হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে রোমান্টিসিজমকে একটা স্থান দিতে হতে পারে। কেননা মন ও দেহের ক্যারিজম্যাটিক কীর্তিকলাপ দূরেও রাখে, কাছেও ডাকে, আড়ালেও রাখে।

ঘ.

কোলরিজ এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট এর সমান্তরালে, রোমান্টিসিজমকে মহিমামন্ডিত করেছেন এই দুই কবি। প্রেম ও প্রকৃতির কাব্যিক ব্যাখ্যা তাদের অসাধারণ ও মরমস্পর্শী যা চাউর হয়েছে বিশ্বময়! রোমান্টিসিজমের ব্যাপারে কোলরিজ চমৎকার প্যারাডক্সিক্যাল ফ্রেজ(অক্সিমরোনও বলা যেতে পারে) ব্যবহার করেছেন, বলেছেন, ইন্টেলেকচুয়াল ইনটুইশান।

একটি মানুষের চেহারা কত রূপ ধারণ করে?  হাসি দিলে এক রকম, কাঁদলে আরেক রকম, ঠাট্টা করলে আরেক রকম, মেঘাচ্ছন্ন হলে আরেক রকম, ভালোবাসা ছুঁয়ে দিলে অন্তরের বিমুগ্ধ ঢেউ মুখমন্ডলে ঝিলিক মারে, চোখ কথা বলে, কপোল কথা বলে; আবার বঞ্চনার তীব্রতার কারণে সমগ্র চেহারায় অগ্নিশিখা চিত্রায়িত; কখনো সুন্দর মুখটিতে এমন একটা ভাব ফুটে উঠে যা রহস্যাবৃত কিন্তু অনিন্দ্য, যথাযথভাবে ধরা না-গেলেও ভালো লাগে; আবার অধরা বিমর্ষতাও ফুটে, দরদ জাগায়, মায়া লাগায়, ভাবায়,ভাসায়, কাছে ডাকে, দূরেও ঠেলে দেয়। । ওদিকে কূটচাল যখন মস্তিষ্কে খেলা করে, মুখমন্ডল হয়ে যায় 'রাষ্ট্রদূত'! - এইসব মুখপঠনে ধরা পড়ে বলে জানা যায়। পন্ডিতগণ মুখপাঠ করতে পারেন, অপন্ডিতগণও পাঠ করেন। লেখক পাঠ করেন, অলেখকও পাঠ করতে পারেন। কেউ বেশি কেউ কম।

মানুষের মনের আয়না চেহারায় কখনো অগণন জীব জানোয়ার পাখি-টাখি, ফুল-টুল দেখা যায়। ক্ষেপা শিম্পাঞ্জি, আফ্রোডিজায়িক জেব্রা,ধাবমান সারমেয়,  'মহান' গাধা, কূটনৈতিক বানর ইত্যাদির ছায়া মানুষের মুখে জলছাপের আদলে পরিলক্ষিত-এমন তথ্য কেউ কেউ জানাতে কুন্ঠাবোধ করেন না।

উত্তরাধুনিক শিক্ষকেররা বলেন, একই মুখের, একই অন্তরের এতো রূপ থাকতে পারলে, মানুষের মুখের ভাষার কিংবা অন্তরের ভাষার প্রতিটি শব্দ কেন বহু অর্থ বহন করতে পারবে না? পারবে। উত্তরাধুনিক কবিতার প্রতিটি শব্দ অজস্র অর্থ দিতে পারে। (যদিও অর্থ মূখ্য নয়।) কবি নিজেও জানেন না তার কবিতা কতো প্রকারের অর্থ দিতে পারে। উত্তরাধুনিকতা এতো রূপের বাহারকে কদর দেয়ার কথা বলে। পংক্তিটিকে, শব্দটিকে, স্বাধীনভাবে উল্টেপাল্টে ব্যাখ্যা করার কথা বলে। উত্তরাধুনিক আলোচনার ধরনটাই আলাদা। ক্রমসম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের মতো বিস্তার হতে থাকে।

ঙ.

উত্তরাধুনিক চোখ শব্দের অঙ্গে বহুরূপ দেখে। শব্দের বাহির দেখে, ভেতর দেখে। শব্দটি বেরিয়ে আসার কারণ খুঁজে। পটভূমিতে কি আছে দেখে। শব্দকারিগরের মনস্তত্ব যে-দিকে ধাবিত হলো তার ইতি নেতি ব্যাখ্যা করে। কবি'র কাব্যিক শব্দ বিন্দু থেকে সিন্ধুতে ঝাঁপ দ্যায় কেমনে দেখায়।

উত্তরাধুনিক চোখে দ্রোহের আগুন আধুনিকতার বিরুদ্ধে! কারণ আধুনিকতা 'উন্নয়ন' এর দোহাই দিয়ে শব্দ ও ভাষার এবং বিবেকসম্মত সব ধরনের স্বাধীনতার টুটি চেপে ধরেছে। আধুনিকতা স্বাধীনতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। 'স্বাধীনতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ' এটি মুলত স্ববিরোধ। পরিস্কার অক্সিমরোন! উন্নয়ন তো একটা মিথ। উন্নয়নের ভেতরেও অসভ্যতা আছে। বলা হয়েছে, ঈশ্বর ছাড়া, যুক্তি ছাড়া, বিশ্বমত ছাড়া কেমনে বাঁচা যায়? উত্তরাধুনিক জবাব- জীবনকে তার নিজের রাস্তা খুঁজে বের করতে দাও, জীবন যাপন করো, জীবন নিয়ে যাবে জীবনের পথে।

(The prophets of postmodernity and their cohort have little to offer. Foucault says power is god. Derrida says dance to the sound as human civilization is deconstructed -- god by god and idea by idea. Rorty says let life be guided by success, it does not matter if there is no intrinsic good in life or success.) প্রফেট মুলত এখানে ফোরকাস্টার বা প্যারাসাইকোলজিস্ট অর্থ বহন করে বলে মনে হয়।

উত্তরাধুনিক চোখে আগুন কেন? কারণ আধুনিকতা দেশে দেশে স্বাধীনতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে বাণিজ্যপ্রবণ ক'রে তুলেছে। স্বাধীনতা বিক্রি করে প্রতিষ্ঠান! স্বার্থের লড়াইয়ে নেমে এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতা কখনো এই খোয়াড়ে কখনো ওই খোয়াড়ে! কবি, লেখকের শব্দগুলোকে খোয়াড়বন্দী করেছে! তাই মানুষেরই চেতনার এক অত্যুজ্জ্বল দ্রোহ আকারে উত্তরাধুনিকতা এসেছে। , (the human spirit is rebelling in the form of postmodern moments of insanity.)

আগেই বলা হয়েছে, উত্তরাধুনিকতা এক বান্ডিল দর্শনের বাক্স। বান্ডিল আবার বাক্স? হ্যাঁ, বাক্সের নাম উত্তরাধুনিক, আর এর ভেতরে ধারণাসমষ্টির বান্ডিল। একটা উজ্জ্বল দিক হলো দ্রোহ এবং দ্রোহ। এই দ্রোহ কোনো প্রকার জাতীয়তাবাদকেও প্রশ্রয় দেয় না। এমনকি ধমীয় পুনরুজ্জীবনের আন্দোলনকেও উত্তরাধুনিকতা বাহবা দেয়। 'the contemporary resurgence of religion is a postmodern phenomenon. Both postmodern philosophy and Religious theology reject the modernist claim in the infallibility of reason.)

এখানে বলে রাখা ভালো হতে পারে, আধুনিকতা যেই সব শর্তে মানব সভ্যতার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো, বিগত শতকে সেইসব শর্ত ভঙ্গ করেছে এবং অপমান করেছে সভ্যতাকে। দার্শনিক ক্যান্ট বেচারা ব্যাপক অর্থের 'স্বাধীনতা'কে ভালো কাজে ব্যবহার করার জন্য বুঝিয়েছিলেন। আধুনিকতা দিলো লাগামছাড়া যা খুশি করার আশকারা। আর উত্তরাধুনিক চিন্তা লেখকদের জন্য বলছে- স্ট্রিম অব কনশাসনেস রাইটিং।

চ.

আদিম  মধ্য আধুনিক উত্তরাধুনিক- এইসব নামকরণ সময়ের, যে-সময়ে আমরা বাস করে আসছি হাজার হাজার বছর ধরে. এর পর্যায় বিভাজন বা লেবেল লাগানোর মধ্যে সার্থকতা অসার্থকতা দুই-ই আছে মর্মে বিস্তর কথা বলা যেতে পারে। একটা ব্যাপারে এক ফোটা আলোকপাত যেমন- জ্ঞানতত্ব (epistemology) আলোচনার নিমিত্তে যদি ধরা হয় আমাদের পূর্বজ পন্ডিতগণ 'আধুনিক' লেবেলটা লাগিয়েছেন। এই আধুনিক সময়টা জুড়ে আদিম ও মধ্যযুগীয় সংস্কার/সংস্কৃতি বিশ্ব সমাজে কি অনুপস্থিত? উত্তর পাওয়া যাবে, কিয়দংশে হ্যাঁ, কিয়দংশে না। যে কোনো প্রকারের 'এনলাইটেনম্যান্ট' বেচারা সূর্যের মতো সমগ্র ভূপৃষ্ঠে একসাথে আলো দিতে অক্ষম!

মানুষের সভ্যতার প্রতিটি পর্যায়ে আমরা দেখে আসছি সংস্কৃতি কিংবা দর্শন বনাম দর্শনের লড়াই। সরাসরি এবং ঠান্ডা লড়াই! সেই চেঙ্গিস খানের 'শয়তানী' আর এই জর্জ ডব্লিউ বুশের 'শয়তানী'র মধ্যে পার্থক্য কী? আবার এই সময়েরই, পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানের ওই 'অশিক্ষিত' টিপিক্যাল পাঠান, যে-তার ফুলের মতো বোনটাকে 'প্রেম' করার অপরাধে 'প্রেমিক প্রেমিকা' দুজনকেই নৃশংসভাবে গুলি করে মারে; ওই পাঠানের গুষ্ঠিদম্ভ কিংবা সংস্কার চেতনা যার সাথে অর্থনীতিরও রিশতা আছে; ওই পাঠানের চেতনাপ্রসূত বর্বরতা আর 'শিক্ষিত-এনলাইটেন্ড' জর্জ ডব্লিউ বুশের চেতনাপ্রসূত বর্বরতার মধ্যে মুলত পার্থক্য কী?

আমরা বিস্ময়কর এক জগতে বাস করছি! একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধারণ সফলতা, জেনোম প্রজেক্ট সম্পন্ন হয়েছে, মানুষ ক্লোনিংয়ের প্রয়াস চলছে এবং উত্তরাধুনিক প্রপঞ্চ কৃত্রিম বুদ্ধির খেলা; আর অন্যদিকে পূর্বে তালেবানরা, হিন্দুত্ববাদীরা এবং পশ্চিমে জেরি স্প্রিংগারেরা এবং জেরি ফালওয়েলরা দিব্যি দিলখোশ মিলিয়ন মিলিয়ন শিষ্যের সমর্থন পেয়ে!

আর উত্তরাধুনিক ধারনাসমষ্টি সকলের ঘরে ধর্ণা দিচ্ছে! সুবিচার কিংবা সিদ্ধান্ত দেয়া কঠিন! কবি খলিল জিবরান জানালেন- ‘'What judgement pronounce you upon him who though honest in the flesh yet is a thief in spirit?'  & 'And how  prosecute you him who in action is a deceiver and an oppressor, yet who also is aggrieved and outraged?'’

কিন্তু আসলেই কি কঠিন? সুবিধা অসুবিধা অথবা ইতি নেতিসহ অবস্থাভেদে, স্থান কাল পাত্র দেখে, একটা জুডিশিয়েল সিদ্ধান্ত দেয়াটাও কি জরুরি নয়? অন্তত যেসব ইজম এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি, যা অধিক অকল্যান নিয়ে আসে তুলনামুলক, তার বিরুদ্ধে 'এ্যাকশন' নেয়া সমূহের জন্য দরকার নয় কি? দুনিয়াদারী এক অর্থে 'অর্থহীন' হলেও সময় সাপেক্ষে 'অর্থহীন' নয়। প্রয়োজনের প্রেক্ষিত ধাপে ধাপে পরিলক্ষিত।

পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ এর ভেতরে মধ্যযুগ ঝিলিক মারে! রেইসিজমকে লাটিপেটা করার প্রয়োজন আছে বলে অনেকেই মনে করেন। আমিরি বারাকা'র 'সামবডি ব্লিউ আপ আমেরিকা' এর ভেতরে আন্তরিক শব্দের ঝংকার এবং সুমধুর ক্ষোভ হোয়াইট হাউসের রক্তিম মুখমন্ডলকে ফ্যাকাসে করে দিতে সক্ষম হয়েছে। ৯/১১ কারা ঘটিয়েছে আমিরি'র কবিতায় পরিস্কার; কে লাদেন, কারা জেনোসাইডের দৌলতে 'ধনী' হয়; কারা তেল চোর, কাদের আরো তেল দরকার; আমিরি জানিয়ে দিয়েছেন। ওই কবিতাটিকে একটি উত্তরাধুনিক কবিতা বলা যায়। কারণ, বাচনভঙ্গির বহুমাত্রিকতা এবং বিক্ষুব্ধ উচ্চারণ যেনো ক্লাস্টার বোমাকেও অকার্যকর করে দেয়! বারবার 'হু' এসেছে কে বা কারা হয়ে। এর ভেতরে অনেক ইজমকে আনা যেতে পারে।

আমেরিকা বহুদেশকে সাহায্য করে, লাখো নারী শিশুকে দুবেলা খাবার দ্যায়; এই তথ্য সত্য বটে কিন্তু শাটল ডিপ্লোমেসি- একদিকে বিনাশ – লাশ-লুট চুরি করে অন্যদিকে দরদি হওয়ার এই আধুনিক ফাইজলামি কেন? দশ বিলিয়ন লুট করে এক মিলিয়ন দান খয়রাত করার বিটলামী বুঝার জন্য কাউকে অক্সফোর্ড থেকে ডিগ্রি নেয়া আবশ্যক নয়! আমেরিকার ফরেন পলিসি বিশ্বের মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে! নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কি আর কোনো উপায় নেই? উত্তরাধুনিক চিন্তা আরো উত্তম উপায় বের করার তাগিদ দ্যায় কি?

বিড়ালের মতো চোখ বুজে দুধ খেয়ে ফেলার সুযোগ দ্যায় কি না উত্তরাধুনিকতা দেখতে হবে।  খেতে চাইলে চোখ খোলা রেখে খাও বলবে কি? নিজেকে ধোঁকা দিও না অথবা দিও বলবে? বিলাই চোখ বন্ধ করে খায় আর ভাবে কেউ দেখে না!

ছ.

মিশেল ফুকো'র সব ধরণের বিশ্লেষণের সাথে একমত না-হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের 'সাইকোএনালিসিস'কে ফুকো কর্তৃক ঝুলিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা মজাদার। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন, আকাঙ্খা/তৃষ্ণা আসে অভাববোধ থে'কে। ফুকো দেখালেন, না, অভাববোধের কারণেই তৃষ্ণা/আকাঙ্খা আসে না। তিনি দেখালেন- Desire is a productive, real force. এই ডিজায়ার এর ভেতরেও বাইনারি অপোজিশান আছে। ইতি নেতি (dichotomy/duality) আছে। নেতিবাচক ডিজায়ার ও প্রডাক্টিভ বটে। তবে এই ডিজায়ারকে লাগামহীন ছেড়ে দেয়া যাবে কি? যদি ছেড়ে দেয়া হয়,যদি রাষ্ট্র ছাড়পত্র দ্যায় এই মর্মে যে, সকলেই যার যার তৃষ্ণা নিবারণ করো যখন খুশি তখন। তাইলে তো পাবলিক নুইসেন্স এ্যাক্ট এর সাথে সংঘর্ষ বাঁধবে কি? কোনো সুন্দর নারী বা হ্যান্ডসাম পুরুষ যদি রাস্তা-ঘাটে যখন তখন যৌন তৃষ্ণার প্রডাক্টিভিটি দেখাতে শুরু করে, তখন সমাজের অবস্থা কেমন হবে?

ফ্রয়েড পরিবারের বিরুদ্ধে ছিলেন না। পরিবারের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন। ফুকো পরিবারকেই চিহ্নিত করেছেন The family therefore constitutes the first cell of the fascist society. দেশে দেশে পরিবারের ভেতরে কুসংস্কার, অন্যায় খবরদারি, ইত্যাদি কিছু নেতিবাচক দিক পাওয়া যাবেই। কিন্তু তাই বলে পরিবার প্রথা উঠিয়ে দিলে সমাজের সর্ব নিম্ন ইউনিট কি হবে? সব সিস্টেমের ভেতরেই কিছু অসুবিধা যেহেতু আছেই সেইহেতু অসুবিধাগুলোর কারণেই কি পুরো সিস্টেম ভেঙ্গে ফেলতে হয়? বিকল্প চমৎকার সিস্টেমটা কি? সেই সিস্টেমেও কি বাইনারি অপোজিশান থাকবে না? ডিজায়ারের ভেতরে চমৎকার 'তুমি' 'আমি' এর খেলা দেখা যায়! বাইনারি অপোজিশন। 'তুমি' ছাড়া 'আমি' এর অর্থ পাওয়া যায় না। আবার 'আমি'টা অর্থবহ করে 'তুমি'কে। ''According to Ferdinand de Saussure, the binary opposition is the “means by which the units of language have value or meaning; each unit is defined against what it is not”. এবং ডিজায়ারের ভেতরকার 'অর্ডার' 'ডিজঅর্ডার' নিত্য সহচর। যেখানে 'অর্ডার' সেখানেই 'ডিজঅর্ডার'। ছায়াসঙ্গি!

ফুকোর 'এ্যান্টি ঈডিপাস' বইটি ভালো বাজার পেয়েছে। জগতের সমাজগুলোতে বহু লোক এমন আছে যে নিজে নেংটা হতে চায় না কিন্তু অন্য নারী পুরুষকে নেংটা করানো হচ্ছে জেনে পুলকিত হয়! দেখতে চায়! ফুকো ফ্যাসিজম'র জড় তালাশ করতে করতে পরিবারের ভেতরে গিয়ে পেয়েছেন। যে-সব কার্যকলাপকে, পরিবারের ভেতরকার, ফুকো ফ্যসিজম আখ্যা দিয়েছেন, তার উপর তর্ক চলে আসছে দুনিয়া জুড়ে। তিনি বলেছেন-

'And not only historical fascism, the fascism of Hitler and Mussolini [...] but also the fascism in us all, in our heads and in our everyday behavior, the fascism that causes us to love power, to desire the very thing that dominates and exploit us.'

 

পূর্বে উল্লেখ আছে, উত্তরাধুনিক চিন্তার দাবীদার অনেক পন্ডিত পরিবারপ্রথা ও সমাজ বিরোধী। কিন্তু মজার প্যারাডক্স, তারাই আবার 'পোস্টমডার্ন সোসাইটি'র কথা বলেছেন। সেই সোসাইটিতে কি থাকবে কি থাকবে না তাও বাতলিয়েছেন যা এখনো স্পষ্ট নয়।

জ.

এ পর্যায়ে দেরিদা তাঁর বিনির্মান তত্ব ব্যবহার করে কিভাবে দেখেছেন বাইনারি অপোজিশানকে, উত্তরাধুনিক চিন্তার ক্ষেত্রে এর আলোচনা হতে পারে। দেরিদা কেমনে দেখলেন দেখা যাক-

Derrida states that all of Western thought forms pairs of binary opposites in which one component of the pair is privileged, arresting the play of the system and marginalizing the other component. With the application of deconstruction, Derrida employs a tactic of decentering; destabilizing the primary term so that the secondary term temporarily overthrows the hierarchy.

এখানে দেরিদার চিন্তার কেন্দ্রে হায়ার্কি বা চেইন অব কমান্ড বা শ্রেণী কাঠামো বা আদেশ নিষেধের কাঠামো এর ব্যাপারটি মুলত মূখ্য। পশ্চিমের সাংস্কৃতিক পটভূমি সামনে এনে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, উপস্থিত-অনুপস্থিত, ইত্যাকার দ্বৈত বিরোধগুলোতে প্রতি দ্বৈত ইউনিটে একটি আরেকটির উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিধৃত। নারীর উপর পুরুষের, কালোর উপর সাদার, অনুপস্থিতের উপর উপস্থিতের খবরদারীর ব্যাপারটি উঠে এসেছে।

উত্তরাধুনিকতার প্রচন্ড রাগ আধুনিকতার উপর এইজন্যে যে, আধুনিকতা মুলত 'অর্ডার'কেই সমীহ করে এবং ডিজঅর্ডারকে দাবাতে চায়, পিটাইতে চায়, থাপ্পর মারতে চায়, বন্দী করতে চায়, ঠেঙ্গাতে চায়, কনুই মারতে চায় এবং চরমপন্থা অবলম্বন করে খুন করতে চায়। উত্তরাধুনিকতা চ্যালেঞ্জ করে- 'ভালোত্ব' আর 'খারাপত্ব'র কি নিরংকুশ অবস্থান আছে? স্থান কাল পাত্র ভেদে যা ভালো তা-ই মন্দ আবার যা মন্দ তা-ই ভালো নয় কি? সাংস্কৃতিক প্রভেদ কিংবা বিভেদ দেশে দেশে 'ভালো' 'মন্দ' ফেরী করছে কি? ক এর কাছে যা ভালো খ এর কাছে তা মন্দ আবার ক এর কাছে যা মন্দ খ এর কাছে তা ভালো এ রকম বাস্তবতা সবখানে আছে। আধুনিকতা 'ইতি'র সুপেরিয়রিটি চায়, কারণ 'নেতি' ডিস্টার্বিং এলিমেন্ট; শুধু বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করে।

এ পর্যায়ে আবারো স্মরণ করা যাক পূর্বোল্লেখিত, উত্তরাধুনিকতা কোনো ধারণাকেই বাতিল করে না। ইতি নেতি সব দরকারী। অতএব ইতি এর খবরদারীকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। খবরদারী ছাড়া সহাবস্থান থাকার ওকালতি করে উত্তরাধুনিকতা। আবার দেখা গেছে, উত্তরাধুনিক চিন্তাওলা বুদ্ধিজীবির মধ্যে স্ববিরোধ আছে। উত্তরাধুনিকতা জাতীয়তাবাদ কিংবা ধর্মবিশ্বাসমেত 'গ্রান্ড ন্যারেটিভস' এর কঠোর সমালোচনা করে। ওই বুদ্ধিজীবি তা মানেন কিন্তু নিজ দেশের স্বার্থ সংশ্লিস্ট অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজ দেশের কিংবা অন্য দেশের বিপরীত মেরুতে থাকা চেতনার বিরোধিতা করেন বা পাত্তা দেন না কিংবা 'রুখো' আন্দোলনে সহযোগিতা করেন। এই প্যারাডক্স থেকে উত্তরাধুনিকতা কিভাবে বের হবে?

'Postmodernism, in rejecting grand narratives, favors "mini-narratives," stories that explain small practices, local events, rather than large-scale universal or global concepts. Postmodern "mini-narratives" are always situational, provisional, contingent, and temporary, making no claim to universality, truth, reason, or stability.'

এই 'মিনি ন্যারেটিভস' এর পক্ষে অথবা 'লোকাল ইভেন্টস' এর পক্ষে দাঁড়াতে গেলেই উত্তরাধুনিক ধারনার বান্ডিলের ভেতরকার অন্য ধারনার বিপক্ষে দাঁড়াতে হয়! 'for postmodern societies, there are only surfaces, without depth; only signifiers, with no signifieds.' কিন্তু কই? উত্তরাধুনিকতা 'নো ম্যানস ল্যান্ড' অবস্থানে দাঁড়াতে পারছে কি? ব্যাপারটা কি এমন হচ্ছে যে, নিজের মেয়ের জন্যে 'ভালো জামাই'র সংগা এক আর অন্যের মেয়ের জন্যে আরেক প্রকারের সংগা?

ঝ.

 [নারী পুরুষের সম্পর্কে আধিপত্য বিষয়ে আমি একজন উত্তরাধুনিক নারী কবির সাথে বিস্তর কথা বিনিময় করেছিলাম। তিনি নারীবাদী। নারীবাদ কিভাবে আপডেটেড হচ্ছে, এর তথ্যও তিনি আমাকে দেন। তিনি আল্লাহ-খোদায় বিশ্বাস রাখেন না এও জানিয়েছিলেন। আমি তাকে আল্লাহ কোথায় এবং কিভাবে এ্যাকশন নেন এবং অনেক ক্ষেত্রে কেন নেন না, একেকটা নৃশংস ঘটনার সাথে আগে পরের অনেক বিষয়ের সম্পর্ক থাকে। তার উপর অনেক কথা বলার পর তিনি লিখেছিলেন, 'আপনার চিন্তা সমৃদ্ধ এবং বিপক্ষে দাঁড়াতে পারছি না।' আমি তাকে বলেছিলাম, 'নারী পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে রিসাইপ্রোকাল এ্যাট্রাকশান বা পারস্পিরিক আকর্ষন ক্রিয়াশীল যা প্রকৃতির সাধারন নিয়মের সাথে মিল খায়। আধুনিক সমাজের যে-সব পুরুষ নারীর প্রতি অবিচার করে তারা অপরাধী নিঃসন্দেহে। কিন্তু সব পুরুষ তো অবিচার করে না। মধুর সম্পর্কও তো আছে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ইওর ওয়ার্ডস আ্যার সাবসটেনশিয়েল বাট আই থিংক সামথিং ডিফরেন্ট। তিনি ক্ষুব্ধ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণে। আমি এও বলেছিলাম, ব্যক্তিগত প্রাপ্তি না-প্রাপ্তির আলোকে তো ইউনিভার্সেল ধারনা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তিনি অন্য প্রসঙ্গে জাম্প দেন। তিনি আবার 'সতিত্ব এবং সাধুতা ধরে রাখার পক্ষপাতি, জীবন যৌবনের যাচ্ছেতাই ব্যবহারের বিরোধী]

পূর্ব কিংবা পশ্চিম, পৃথিবীর সবখানেই জেন্ডার বৈষম্য আছে। ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক বলয়ে পুরুষের উপর আধিপত্যের অভিযোগ। অর্থাৎ নারীর উপর খবরদারী করে। একটা বাস্তবতা এরকম যে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অল্পশিক্ষিত, ধর্মব্যবসায়ীরা নারীর যথাযথ অধিকার দিয়ে আসছে না। তাই বলে ঢালাওভাবে 'গ্রান্ড নেরেটিভস'কে দায়ী করা সুবিচার হয় কি? কিছু লোকের আচরণ দিয়ে কি সমগ্রকে অভিযুক্ত করা যৌক্তিক? বাংলাদেশের অজপাড়া গাঁর একজন কাটমোল্লার ধর্মচিন্তা আর মিসরের আল আজহার ইউনি কিংবা মদীনা ইউনি থেকে বেরিয়ে আসা ইসলামিক স্কলারের ধর্মচিন্তা কি এক? অথবা যারা তুলনামুলক ধর্মতত্ব নিয়ে উচ্চ ডিগ্রী নেন, তাদের ধর্মচিন্তা  উপমহাদেশের অনেক মাদ্রাসা পাশ বিখ্যাত আলেমের ধর্মচিন্তার চাইতে উজ্জ্বল এমনও দেখা যায়। যে-সব 'ধার্মিক' এর ভেতর থেকে কাম ক্রোধ লোভ ঘৃণা বের হয় বিষাক্ত ফণা তোলা সাপের মতো, তারা কি আসলেই 'ধার্মিক'? অপরদিকে যারা আল্লাহ খোদা মানেন না, মানবতাবাদী দাবী করেন, অথচ তাদের ভেতর থেকে ক্ষ্যাপা শিম্পাঞ্জির মতো হিংস্রতা বের হয় 'ধার্মিক'দের উদ্দেশে, তারা কি আসলেই মানবতাবাদী?

উত্তরাধুনিক পন্ডিতদের কারো কারো দৃষ্টিতে ইসলামও একটি 'গ্রান্ড নেরেটিভ'। তারা এই 'নেরেটিভ' এর ইতি নেতি বের করার জন্য চিরুনী অভিযান চালানোর পক্ষপাতি। কারো দৃষ্টিতে সালমান রুশদী'র 'স্যাটানিক ভার্সেস' উত্তরাধুনিক প্রয়াস। আবার কারো মতে, না, ওটা উত্তরাধুনিক চিন্তা সমৃদ্ধ বই নয়। কেউ কেউ ইসলামী পুনরুজ্জীবন আন্দোলনকেও উত্তরাধুনিক ফেনোমেনন মনে করেন। পুঁজিবাদের বিপক্ষে যুদ্ধের ময়দানে উত্তরাধুনিক চিন্তা পুঁজিবাদের সব ধরণের শত্রুর সাথে হাত মিলাতে চায়। কারণ আধুনিকতার বিশাল ক্যানভাসে, ইউরোপীয় এ্যানলাইটমেন্টের ভেতরে, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নামক 'মারাত্মক রোগ' এর বিরুদ্ধে ইসলাম তিন শ বছর লড়াই করেছে, যা অন্য কোনো 'গ্রান্ড নেরেটিভ' করে নি। এখানেও ধারণাগত প্যারাডক্স আছে। কেননা উত্তরাধুনিক পন্ডিতদের একাংশ রোমান্টিসিজম ও ফান্ডামেন্টালিজমকে মস্ত চ্যালেঞ্জ মনে করেন।

উত্তরাধুনিক চিন্তা জেন্ডার বৈষম্যকে গলা ধাক্কা দিয়ে পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে মহাশুন্যে ফেলে দিতে চায়। তাই ফেমিনিজম বলে- 'আসো বন্ধু গলাগলি করি প্রাণভরে'। কারণ আগেই উল্লেখিত রোমান্টিক ভালোবাসা নাকি পুরুষের খবরদারীকে সুযোগ দ্যায়। কিন্তু মানুষের মেধাজাত বিস্তর ধারণা ভালোভাবে প্যাঁচ বন্ধনে যুক্ত অর্থাৎ তত্বের সাথে তত্বের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যোগ একেবারে গার্ডিয়ান নট বা মরা গিট্টু এর মতো লেগে আছে। পশ্চিমের বাইনারি অপোজিশানের ব্যাখ্যা নারী পুরুষের বেলায় দুই প্রকার। কেউ দেখছেন নারীলিঙ্গ ইতিবাচক আর কেউ দেখছেন নারী লিঙ্গ নেতিবাচক। কেউ বলছে পুরুষলিঙ্গ বাইরে আছে অবস্থায় প্রকাশিত,তাই ইতি; আর নারীলিঙ্গটি বাইরে নাই বিধায় নেতি। নারীলিঙ্গকে যারা ইতিবাচক বলছেন, তাদের যুক্তি- নারীলিঙ্গ আধার- ধারন করে, গ্রহন করে। পুরুষলিঙ্গ আধার নয়, গ্রহন করে না। এই দ্বন্দ ফেমিনিজমকে ভালো একটা সমস্যায় ফেলেছে।

'বঞ্চনা' র উপর চোখ রাখলে, দেখা যাবে, দেশে দেশে বহু সংখ্যক নারী যেমন বঞ্চিত, তেমনি বহু সংখ্যক পুরুষও বঞ্চিত। সারভাইভাল অব দি ফিটেস্ট এর খেলায় জেন্ডার কি আসলেই মূখ্য? নারীও নারীকে ধাক্কা মেরে ফেলে আগে যেতে চায়, পুরুষও পুরুষকে মারে, নারী পুরুষকে মারে, পুরুষও নারীকে মারে ধাক্কা! এই ধাক্কা মারামারি দৃশ্যে তত্ব নিরব দর্শক। সভ্যতার বিশাল ক্যানভাসে প্রখর মেধাবী নারী আছে,পুরুষও আছে। ব্যক্তির সাফল্যের আলো দিয়ে সমষ্টির ষোল আনা সাফল্য আসে না, সেই দৃশ্যও আছে কালান্তরের দৃশ্যপটে।

(আগে উল্লেখ করেছিলাম প্রফেট জেসাস'র কথা, আবার করি) প্রফেট জেসাস কবর থেকে জিন্দা তুলেছিলেন ল্যাজারাসকে। সেটা ছিলো তার নবীয়ানা কারিশমা। আর সিলভিয়া প্লাথ'র 'লেডি ল্যাজারাস' কবিতার শেষ পংক্তি 'আর পুরুষ খাই বাতাসের মতো'। খুব কষ্ট ছিলো তাঁর মনে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩১ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন। তাঁর 'লেডি ল্যাজারাস' সম্পর্কে আলোচকদের মত- 'বেদনার্ত কান্না-চিৎকার মুলত এই কবিতাটি'। সিলভিয়া গোস্বায় পুরুষ খেয়েছেন তার কবিতায়। সব নারী কি বাতাসের মতো পুরুষ খায়? খায় না। সব দেশে প্রতি দিন জনম নেয় রোমিও জুলিয়েট, লায়লী মজনু। প্রতি জনপদেই জুলেখার অনুসারী আসে, রাধার অনুসারী আসে।

উত্তরাধুনিকতা যদি শুধু ভালোবাসাহীন মেশিন মানুষ বানাতে চায়, তার সফলতার তৃষ্ণা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। নারী পুরুষের প্রেমাবেগের জন্য দায়ী হরমোন। এই হরমোনকে অকেজো করে ফেলা হয় যদি প্রেম করা বন্ধ। স্টপ লাভ!

ঞ.

কবিতা শিল্প ও ভাষার বহুবিধ কারিশমা প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা এখন বলা যায়।

অন্তত উত্তরাধুনিক কবিতার রূপটা কেমন, এই রূপ মায়া লাগায় কি না, কিংবা মায়া ব্যাপারটা কতটুকু আছে এখানে, এইটুক বুঝার জন্য কিছু সংগা রকমের কথা পাওয়া গেছে। উত্তরাধুনিক পন্ডিতেরা টের পেয়েছেন, তত্বের একটা সংগা না-থাকাটা খুব অসুবিধায় ফেলে। একটা বাউন্ডারী না-থাকলে নিরাপত্তা হুমকীর মুখে থাকে। অন্য তত্ব এসে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। তবু গতানুগতিক সংগার মতো নয়। উত্তরাধুনিক চিন্তায় closed definition are rejected in favour of investigation and free play.

কিছু ইংগিত এরকম-

> মনের জটিল দ্বান্দ্বিক ব্যাপারগুলো থাকতে পারে

> বিক্ষিপ্ত, খন্ডিত, বাস্তবতার চিত্রায়ন

> চর্চাটাই মূখ্য, কবিতা ফসল নয়, চর্চা চলমান জীবনের মতো

> নীতিকথা, উপদেশ সরাসরি থাকবে না

> সমসাময়িক, দৈনন্দিন জীবনের ক্ষোভ সুখের  বিষয়াবলী থাকবে

> 'আমি' 'তুমি' 'সে' ছাড়া নৈর্ব্যক্তিক বুনন হতে পারে, যেখানে শব্দগুলোই হবে বোধদাতা, ফলে পাঠক পাবে অনেক প্রকার 'আমি'র সাক্ষাৎ

> নির্দিষ্ট বিষয়কে ধারন করে পুরো কবিতা না হতে পারে, অনেক বিষয়ের সমাবেশ একটি কবিতায়

> ব্যাকরণের রীতি ভাঙ্গা থাকতে পারে কখনো, বোধের ব্যাঞ্জনে সততার পরিস্ফুটন

> অবচেতন ততোটা গুরুত্বপূর্ন নয়, চেতনের যৌক্তিক বিশ্লেষণ

> কবিতাটির একাধিক অর্থ পাবে পাঠক, একেক পাঠক একেক অর্থ দেখবে, প্রত্যেকের জীবন ও বাস্তবতার আলোকে

> আবেগের পক্ষে বিপক্ষে ওকালতি থাকবে না

> উত্তরাধুনিক কবিতায় তত্বের ঝিলিক থাকবে যা আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে অনেকটা মানা ছিলো

> পশ্চিমা আধুনিকতাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, মশকারী মূখ্য কিংবা রংবাজি

ইত্যাদি ইত্যাদি।  সত্য যে, উত্তরাধুনিক কবিতার ধারনাও ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে। বিভিন্ন আকার ধারণ করার স্বাধীনতা থাকবে যেই কারণে we must call it a practice and not a product. আর হ্যাঁ, উত্তরাধুনিকতা যেহেতু কোনো ধারনাকেই বাতিল করে না সেইহেতু সকল প্রকার ধারনা/বোধ/তত্ব এই শিল্প মাধ্যমে অপ্রত্যক্ষভাবে পাওয়া যাবে। মধ্যযুগীয় ও আধুনিক কবিতার সিংহভাগ প্রডাক্ট হিসাবেই বিবেচিত হয়েছে। প্রডাক্ট মানে একটা সিদ্ধান্ত সরাসরি বেরিয়ে আসা। একটা 'কিছু' বলা হয়েছে কবিতায় এই প্রকারের বিচার। উত্তরাধুনিক কবিতা একটা 'কিছু' বের করে না। অনেক 'কিছু'র উপলক্ষকে প্রকাশ করে সরাসরি সিদ্ধান্ত না-দিয়ে। পাঠক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। Roland Barthes বলেন- each text possesses a plurality of meanings. প্রকাশিত প্রপঞ্চ ডিকৌড করবে পাঠক। আর শিল্পটা চিন্তাটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। নতুন শিল্প, নতুন চিন্তার পেছনে পূর্বের অনেক চিন্তা ও শিল্পের ভূমিকা থাকে।

T. S. Eliot এর কথা স্মরণ করা যায়, বলেছিলেন- No poet, no artist of any art, has his complete meaning alone. His significance, his appriciation is the appriciation of his relation to the dead poets and artists. (Traditioin and the Individual talent) বুর্জোয়া আদর্শের চোখে টেক্সট এর একক অর্থ বের করা যা লেখক বলতে চেয়েছেন হিসাবে ধরা হয়, এইমতের দেখাকে Roland Barthes বাজে পাপ বা worst sin বলেছেন। জ্যাক দেরিদার 'বিনির্মান'ও দেখিয়েছে- 'any text has more than one interpretation'. ব্যক্তির 'আমি' গৌণ, সমষ্টির ভূমিকা মূখ্য। শিল্প কারিগরদের কাজ-কাম কপিয়ার মেশিনের মতো। চমৎকার একটা মিল পাওয়া গেলো ইসলামী জীবনবোধের সাথে! ইসলাম এর উচ্চমার্গীয় দর্শনে 'আমিত্ব' এর গুরুত্ব নেই। 'আমি'র অহংকে জ্বালিয়ে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার কথা বলা আছে। মধ্যযুগের 'আমি'গুলো, আধুনিক এর 'আমি'গুলো জগতের যথেষ্ট অকল্যান করেছে। ব্যক্তিক 'আমি' ও সামষ্টিক 'আমি'কে কেন্দ্র করে প্রাতিষ্ঠানিক ফাইজলামী, নারী পুরুষের সম্পর্কে বেদনাবিধুর পরিণতি, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা, ইত্যাদি অনিষ্টকর কাজ হয়ে আসছে। উত্তরাধুনিকতার একাংশে, বলা যায় নেতি প্রধান অংশে আল্লাহ গড ঈশ্বর নিয়ে মাথা ঘামানী নেই।

উল্লেখ করা ভালো যে, আজ যা নতুন কাল তা ঐতিহ্য হয়ে যায়। প্রতিটি সমাজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শুরুতে 'নতুন কিছু' আকারেই প্রকাশ পেয়েছিলো। মানুষের পছন্দ ধীরে ধীরে তাকে ঐতিহ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। 'নতুন কিছু'কে ঘিরে তৈরী হয় পছন্দ ও না-পছন্দের ধারাবাহিকতা। উত্তরাধুনিক চিন্তা ও শিল্প সাঁতার কাটে ঘোলা জলে কিংবা পরিবর্তনের উলট-পালট স্রোতের মধ্যে। আনন্দের ঢেউয়ে উতলা হয়। Postmodernism swims, even wallows, in the fragmentary and the chaotic currents of change as if that is all there is- Harvey এর মতে। উত্তরাধুনিক চিন্তা ও শিল্প স্থায়িত্ব বা জীবনের 'চিরন্তন সত্য'কে গুরুত্ব দিতে চায় না। কারণ স্থায়ী থাকছে কই ব্যাপারগুলো? কারণে অকারণে পরিবর্তনশীলতাই বাস্তব আকারে স্ফুট। সব'কিছু' যেনো সমুদ্র সৈকতে। সময়ের ব্যবধানে সাগরের অথৈ জলে মিশে যায়।

Roland Barthes কিছু শব্দের মাধ্যমে দেখিয়েছেন ভাষার ভেতরে যা থাকে বা ঘটে- সিগনিফায়ার (বোধদাতা/বর্ননাকারী) সিগনিফায়েড( অর্থ/তাৎপর্য) সাইন (সংকেত/প্রতীক/অর্থবোধক কিছু) কনোটেটিভ (যা প্রকাশিত তার অধিক ইংগিতবহ কিছু) ডিনোটেটিভ (প্রকাশিত প্রাথমিক অর্থ)এবং Denotative system: A signifier, signified, and sign that together form a meaning.

 

ট.

 (('উত্তরাধুনিকতা বনাম বিজ্ঞান' শীর্ষক একটা এ্যাটমিক ইংরেজী গদ্য পড়ে আমার মাথার ভেতরে যেনো কিছুটা আউলা-ঝাউলা বোধ এসে ধাক্কা দিলো! অথবা কনফ্লিক্টিং স্রোতের মাঝখানে পড়লে যা হয় আর কি! কয়েক বছর আগে আমি একটা গল্পে বলেছিলাম- অতীত বর্তমান ভবিষ্যত আবার অতীত এই রকম একটা চক্র ঘূর্ণনের ব্যাপার-স্যাপার আছে কি না আমাদের সময়ে, যে-সময়ে আমরা বাস করছি! ইতোমধ্যে বুদ্ধিঅলাদের অনেকে বলেছেন, উত্তরাধুনিকতা মানে আধুনিকতার আগের জমানায়, মধ্যযুগেরও আগের কালে ফিরে যাওয়া অথবা আধুনিকতাকে কনুই মারতে মারতে এক সময় উত্তরাধুনিকতা নিজেই আত্মহত্যা করবে! এক পশ্চিমা পন্ডিত মিয়াসাহেব তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে উত্তরাধুনিকতার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি প্রকাশ করে বারবার বুঝাইতে চাইলেন, শত প্রকারের শৃংখলা নির্মাণ করেও মানুষ মুলত জঙ্গলের মতো আউলা-ঝাউলা জীবন যাপন করে আর জঙ্গলীপনাকে গোপন করে সাধু সাধু ভাব দেখায়। আমি সামগ্রিকভাবে উত্তরাধুনিকতার পক্ষে বা বিপক্ষে না-দাঁড়িয়ে চিন্তাগুলোকে প্রকাশ করছি মাত্র এবং প্রাসঙ্গিক  প্রশ্নও উত্থাপনও করছি। আগে এই দর্শনের বান্ডিলের ভেতরকার কিছু চিন্তার চমৎকারিত্বও প্রকাশ করেছি।))

জীবনের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করার সময় মানুষ বাস্তবতা বা রিয়েলিটি এর প্রসঙ্গ আনে। যেমন, 'এই হলো বাস্তবতা. এর আলোকে সমাধান বের করা দরকার।' বাস্তবতা আসলেই কি স্থায়ী কিছু? বাস্তবতা কি ক্রমপরিবর্তনশীল নয়? কারো সাধ্য আছে কি দেশ কালের পটভূমিকে এক জাগায় ধরে রাখার? বলা হয়েছে, মানুষ প্রতি ন্যানোসেকেন্ডে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা তৈরী করে চলেছে।

আশা আকাঙ্খা স্বপ্ন ইচ্ছা মনের মধ্যে যেমন খুশি, যতো খুশি লালন করতে পারে কেউ। এইগুলান লালন করতে টেক্স দেয়া লাগে না। মানুষ নিরংকুশ স্বাধীনতা কীভাবে উপভোগ করবে? তার মন খাঁচায় বন্দী। সাথে আছে বিবেক প্রহরী। বিবেককে তোয়াক্কা না-করে যেই মানুষ নিরংকুশ স্বাধীনতার আনন্দ পেতে চেয়েছে, সেই মানুষ নিজেই নিজের বিপদ ডেকে এনেছে, এমন নজির খুব আছে। ইচ্ছা করলেই কি বাইনারী অপোজিশানগুলোর নাম-নিশানা মুছে ফেলা যাবে? আহ বেচারা কার্ল মার্কস! কতো অর্থকষ্টে জীবন কাটিয়ে গেলেন! শক্তিমান মার্কসবাদীরাই মার্কসবাদকে নেংটা করে, বেইজ্জত করে একেবারে বরবাদ করে দিয়েছে!

উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে কথা বলতে গেলেই দুনিয়ার সবাই ফরাসী বুদ্ধিঅলা Lyotard এর কথাটা, "incredulity towards metanarratives." সকলেই স্মরণ করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসাবে Walter Truett Anderson এর অনেক নাম। উনি 'উত্তরাধুনিক রাজনীতি'র পক্ষে কথা বলেন। তিনি Alan এর প্রশ্নের জবাবে ইউনিভার্সেল বিশ্বমত নাই সে-প্রসঙ্গে কথা তোলেন। অর্থাৎ মার্কসবাদ খৃষ্টবাদ ইসলাম, প্রত্যেকে ইউনিভার্সেলিটি দাবী করলেও ইউনিভার্সেল হয় নি বা হতে পারে নি, সেই কথা বলছেন। আর এও বলছেন, ওই গ্রান্ড নেরেটিভগুলো সাম্রাজ্যবাদকে লালন করেছে। এই কথা সর্বাংশে সত্য নয়, তা বলার সুযোগ আছে। তিনি প্লুরেলিজম বা বহুমতের সহাবস্থানের পক্ষে কথা বলছেন।

কিন্তু এ্যালান যখন প্রশ্ন করলেন- বহুমতকে গুরুত্ব দিলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা মূল্যায়ন করন কেমনে? তখন এ্যান্ডারসানকে দেখা গেলো একটু চেতে গেলেন, যেনো সদুত্তর না-পাওয়া অবস্থার উত্তেজনায় জ্বলে ওঠা! তিনি নিজের কাছে ফিরে এসে বললেন- I just mobilize the best facts and values I can in the language of our times, and I have to live with the outcomes of my actions. এ্যালান আরেকটু টোকা দিলেন- 'তাহলে তো আপনার কথায় রেডিক্যাল ইনডিভিডুয়েলিজম এর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে?' এ্যান্ডারসান জবাব দিলেন- 'কইতে পারো তুমি তা, আর এও কইতে পারো যে আমি রেডিক্যাল কনটেক্সচুয়েলিজম-এ আছি।' অতঃপর  এ্যান্ডারসান জানালেন, 'উত্তরাধুনিক রাজনীতি' হলো Postmodern politics is just whatever is happening at the moment. পূর্বোল্লেখিত কথাটা আবারো স্মরণ করা যায় এখানে- উত্তরাধুনিক রাজনৈতিক চিন্তায় জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানবজাতির শরীরে একটা 'মারাত্মক রোগ'। এ্যান্ডারসান আরো যা বললেন তার সারকথা হলো, জাতীয়তাবাদী ও দেশীয়ঐতিহ্য চেতনা খুব ঠুনকো। রাশিয়ানরা লিথুনিয়ায় থাকছে, এশীয়রা কানাডায়, আমেরিকায় বহুদেশী থাকছে, ইত্যাদি ইত্যাদি একটা plain old human mobility বিদ্যমান।

ওই সাক্ষাতকারের সর্বশেষ অংশ ছিলো-

Alan: In this turbulent sea, how do you set your political rudder? You advocate taking strong positions - but how do you sort through the complexities and competing values systems to know where to stand?

Walt: First off, you make some choices. Certain issues, for whatever reasons, have a lot of energy for me. Lately I find myself less involved with mainstream environmentalism but very involved in biotechnology issues, which are getting neglected in a lot of ways. So I put my energy where it feels like some difference can be made.

I think the scare talk about biotechnology has prevented people from understanding what a tremendous revolution is going on in the life sciences, and how important this will become in the very near future. I'm especially interested in exploring ways biotechnology can be applied to sustainable development projects in Third World countries.

এ্যালানের প্রশ্নের পরিস্কার উত্তর বেরিয়ে এলো কি এখানে?

'উত্তরাধুনিকতা বনাম বিজ্ঞান' আলোচনায় কেন ওরা বলেন সকল প্রকার বিজ্ঞান লৈঙ্গিক যুদ্ধ? কেনো বলা হলো উত্তরাধুনিকতা মানে - outright irrationalism and rejection of science per se. কোনো কিছুই ঠিক না, কোনো কিছুই ভুল না, কোনো কিছুই সত্য না, কোনো কিছুই অসত্য না, বিরোধী কেউ না, সবকিছু কুয়াশাচ্ছন্ন, অস্পষ্ট। ভবিষ্যতের (?) উত্তরাধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে এমন চিন্তা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে?

আমি আমার মাকে দেখতে চাই

ফয়সল অভি

শৈশবে জেনেছিলাম; মাটি দিয়ে গড়া মাটি’র মানুষ । মাটিতেই জন্ম তারপর তার বুকে হেঁটে হেঁটে বড় হওয়া, বড় হলে মাটি’র খাজনা চাষ দিয়ে স্বপ্নের পিঠে ডানা গজিয়ে দেশকে সবুজ রাখা । সবুজ গাঢ় হতে হতে সবুজ হয়ে গিয়ে মাটিতে মিশে যাওয়া । এমনটাই তো কথা ছিলো?

যে কথা দিয়ে পৃথিবীতে এনেছিল জন্মদাতা সেই কথার ভাঙ্গনে চর হলো -তাতেই বুঝে গেলাম সময়ের হাত, পা ও মাথা আছে আর সুযোগে ধারালো অস্ত্রও আছে । কথাটা মৃত হলে এখানে কারো দায় নেই শুধুই অন্তর থেকে পৃষ্ঠা খুলে কথা পড়া ।

 

আমি তো এমনটা চাইনি । আমিও কবিতা লিখতে চেয়েছি-পাতা আর ফুলে মৌমাছির সাইকেল চালানোয় । নদী পাড় আর পিচ রাস্তায় আমার পাও ভিজবে-আমাদের অনুভবের গভীর নিমগ্নতায় । সভ্যতা পরিবর্তনের মাঝমাঝি দাঁড়িয়ে সত্তার দ্বিখণ্ডিত রূপ বড় তীরবিদ্ধ রক্ত ক্ষরণ-প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয় । নগরে আমি নাগরিক হয়েছি-আমাকে দিয়েছে অধিকার নামে কিছু লোম-যেগুলো শিহরণে দাঁড়িয়ে থেকে জানিয়ে দেয় আমি নাগরিক-দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে দেয়ালকে কাঁধে নিয়েই পিছু হেঁটেছি-পায়ের অনুগত্য আর ভোর হয়েছে বৈরাগী । নগর শুধু নাগরিক প্রসব করেছে-মানুষের মাঝে কোন প্রাণ দেয়নি ।

এখানে ভীষণ ভীড় যেন পিঁপড়ের লাইনচ্যুত সমাজ । কাতর হলেও কাঁদা যায় না, কান্নার জন্য প্রয়োজন বৃষ্টির আড়াল । সে আড়াল এখন আর পৌছে না নাগরিক দ্বারে, কি অদ্ভুত আমার কোন দাওয়া নেই । যেখানে থৈ থৈ কাঁদায় পায়ের কলঙ্ক এঁকে দিবো চৈত্রে বর্ষার সাক্ষী ।

সবকিছু দূরে সরে গেছে । ঋতুর আগমন ছাদে গিয়ে ঠেকে, কংক্রিট পার করে দেয়ালে ঝুলন্ত ক্যানভাসে চোখ রেখে বলি:- “এক সময় বৃষ্টিতে ভীষণ ভিজতাম আর ঠাণ্ডা আমাকে ধরলে মা বকতো, কচুর চোখ বন্ধ হলে আমাদের উনুনে দাউ দাউ ধোঁয়া হতো” । শ্রাবণের ধারা আজ কোথাও নেই । না বুকে-না আকাশে সর্বত্র ক্ষরণ, এক নিদারুণ ক্ষরণ ।

এই নগরে বৃষ্টি হয় না-হয় আকাশের ধৌতকরণ । যে জল কর্পোরেট ছাতা গলে বাইলে পড়ে-প্রমাণ দিয়ে যায় এখন উন্নয়নের সময় রাস্তায়, বিদুতের ট্রান্সফরমারে, তিন পায়ের রিকশায়, সচিবালয়ের মেইন গেটে আর মাটির দম আটকে জলাবদ্ধতায় ।

 

বদলে বদলও বদলায় । কেউ শব্দ কিনে নিলেও রূপ কিনে না-বৃষ্টির রূপও বিকিয়েছে প্রাইম টাইমের কর্পোরেট নাটকে । মাটির কি দোষ?? আগে শুষে নিতো জল এখন নগরের পাপ নিতে চায় না । বুড়িগঙ্গাও বলি হতে হতে এখন ধর্ম হয়ে গিয়েছে-আমি তাতে ইমান এসেছি তবে তাতে কোন লেভেল লাগেনি তাই আজও তাকে ঘিরে আন্দোলন হয় । বৃষ্টির কি দোষ? বৃষ্টিরও শেষ আছে বুড়িগঙ্গায় মিশতে মিশতে বৃষ্টি হারিয়েছে ইমান তাই খাল খেটে প্রকল্প আনে । বলো বৃষ্টির কি দোষ ।

আগামীর দোষ । আগামীর যত ক্ষয় । আগামী যেন এক জন্মান্ধ-সকল কিছু দৃশ্যত দৃশ্যায়িত কল্পনা । সবুজ থেকে নদীর বেহুলা বাঁশি কিংবা ষড়ঋতুর যত লাললিক মন-সব হবে শব্দে, ইথারে আর নারীর বুকে কান পেতে । নারী সামগ্র্যই প্রকৃতির দ্বিতীয় রূপ । তবে কি নারীতেই থেকে যাবে অনুভূতির বন্ধ্যাত্ব?

হয়ত.............................জানি না । সভ্যতার অনিকেত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বোধগুলো শব্দে প্রসব করছি । কেউ হয়ত জানে না সত্তার বিখণ্ডকরণে এক মানবিক যন্ত্রনায়-শ্রাবণও রূপ নেয় নতুন কোন রূপের গঠনশৈলীতে । শ্রাবণের সত্ত্ব কিনে নেয়নি বাংলাদেশ তাই উন্নত বিশ্বের অহরহ চলাচলে ও উন্নতে-বিক্ষত হয়েছে আমাদের আকাশ । সেখানে আমার আকাশ ছিল ছোট্ট-মাকে নিয়ে । সেটাও গেলো দূষণের থাবার আয়ু যেন সবার সাথে গোসসা করেছে । এই নগরে শ্রাবণকে কেউ চেনে না । উন্নয়ন কতৃপক্ষের এক ব্যস্ত সময়ই আজ এর নামকরণ । কদমগুলো মাছের বিনোদন যে শপিংমল ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় বড় মাছদের অভিবাদন জানায় । এখন সর্বত্র সংবিধিবদ্ধ সর্তকীকরণ, “সহবাস হবে শুধু ফ্ল্যাটে, কর্পোরেট ফ্ল্যাটে শরীর হবে সিঁড়ি, পেশা ধাবিত হয়েছে সিঁড়িতে” । তাই কবিরা আর মহৎ কবিতা লিখতে পারে না-সমাজও বিপ্লবে রুখে দাঁড়ায় না । শ্রাবণের ভেতরে পাপ-অসচ্ছ জল কখনও আয়না হয় না । আবারও নবীর প্রয়োজন-একজন মহা পুরুষ । আরেকটা কুরআন চাই আমার বাংলাদেশের জন্য-যেখানের লালের কোন বিভক্তি নেই-ক্ষুধার জন্য সত্তার কর্পোরেট বানিজ্য নেই-আমার মা শুধুই মা হয়ে থাকে শাড়িতে, ঘোমটায়-সকল আশ্রম হবে থিয়েটার-আশ্রমবাসী চলে যাবে যেখানে তাদের অধিকার । মানুষ বদলাক আলোতে-আঁধার গাঢ় হলে পরিবর্তন নয় । সকল বদল হোক বুকের বা’পাশে-যেটা মুখোমুখি থাকে নিজের সাথে নিজে ।

পৃথিবীতে আবার শ্রাবণ হোক আকাশে-মানুষের বুকে বুকে । কাঁদতে কাঁদতে বাংলাদেশীরা জানুক-অনুভূতি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ । রক্তের খাদ্য নিয়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতে কোষগুলো শুধু বেড়ে যায়-মানুষ হয় না । আমাদের মানুষ হতে হবে সকল মানবিকতায় তাই বৃষ্টি হোক, ঝরে পড়ুক সকল অন্যায় চক্র । ভেসে যাক-বয়ে যাক যে নীল নিয়ে নাগরিক । নগরের রঙ হোক শুভ্র-আমি আমার মায়ের হাসি দেখতে চাই যে মা আমার গর্ভধারিণীকে প্রসব করেছে ।

অনুভবের অকৃত্রিম প্রতিফলন কবিতা;

ভাষার এক শুদ্ধসৎ রতিক্রিয়ার ফসল কবিতা

মাসুদ খান

কারো মাতৃভাষা বাংলা, কারো চাকমা, কারো-বা ফারসি, ফরাসি, আরবি, ইংরেজি, চৈনিক, হিন্দি, হিস্পানি, জাপানি...। পৃথিবীতে কত জাতি, কত জনগোষ্ঠী, আর তাদের ভাষা, তাদের বুলি কতটা বিভিন্ন ও বিচিত্র! কিন্তু অনুভূতির মৌলিক ভাষা এক, অভিন্ন। আর সেই বিমূর্ত অনুভূতির সৎ ও মূর্ত প্রকাশই কবিতা। কবিতাকে তাই বলা হয় সমগ্র্র মানবজাতির মাতৃভাষা। মাতৃভাষা আমাদের যা-যা দেয়, যা-কিছু জোগায়-সৌন্দর্য, মাধুর্য, সহজতা, চিদানন্দ, জৈবটান, মাধ্যাকর্ষণ, শুশ্রূষা, উপশম, স্তন্যদুগ্ধ, মোণশান্তি, প্রেরণা, এষণা, সাহস, শক্তি, উদ্দীপন, অক্সিজেন, করণ, বাহন, মাধ্যম..., সেসবের অনেক কিছুই আমরা পাই কবিতার কাছ থেকে।

কবিতা একটি শিল্পমাধ্যম। অপরাপর সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমের মতো এটিও একটি সৃজনশীল মাধ্যম, একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম। কারণ, মানুষের অনুভূতির ও উপলব্ধির সবচাইতে সৎ ও অকৃত্রিম প্রতিফলন ঘটে কবিতায়, আর সেই অনুভূতি ও উপলব্ধি একজন সৃজনশীল শিল্পীর অনুভূতি ও উপলব্ধি।

শিল্পীর অনুভূতি ও উপলব্ধি। কথাটি এজন্য বলছি যে, একজন শিল্পীর ফার্স্ট সিগনালিং সিস্টেম থাকে শক্তিশালী। কবিদের, শিল্পীদের ইন্দ্রিয় থাকে নিত্যজাগর, সদাপ্রখর। বাইরের জগতের যে-কোনো সংকেত-হোক তা সুখের কিংবা অসুখের, আনন্দের কিংবা ব্যথার, ভয়ের বা নির্ভয়ের, হোক সে-সংকেত উত্তাল কিংবা নিস্তরঙ্গ, লাউড কিংবা হাস্কি কিংবা মাফল্ড-সবচেয়ে আগে ধরা দেয় শিল্পী তথা কবির অ্যান্টেনায়। সাড়া তোলে তাঁর সংবেদী চেতনায়, তৈরি হয় সে-সম্পর্কিত অনুভূতি ও উপলব্ধি। আর যেহেতু কবি সৃজনশীল, তাই তাঁর সেই অনুভূতি ও উপলব্ধির প্রতিফলন তিনি ঘটান এমন এক কাব্যিক জগৎ তৈরির মধ্য দিয়ে, এমন এক প্রকৃতি-সৃজনের ভেতর দিয়ে যে, সেই জগৎ, সেই প্রকৃতি এই প্রচলিত জগতের বস্তু-বাস্তবতা, শব্দ-নৈঃশব্দ্য দিয়েই গড়ে ওঠে বটে, কিন্তু গাঁথা হয়ে ওঠে এক ভিন্নতর সম্পর্কসূত্রে, বিন্যস্ত হয় যেন এক অপ্রাকৃত বিন্যাসে, এক আপাতছদ্ম যুক্তিসিলসিলায়। এজন্যই, কবি যা সৃষ্টি করেন তাকে বলা হয় ‘দ্বিতীয় প্রকৃতি’, যেখানে খেলা করে অন্য আলো-ছায়া, অন্য মেঘ-রোদ্দুর, অন্য নিসর্গ-ভিন্ন চালে, ভিন্ন লজিকে। আর এই ‘দ্বিতীয় প্রকৃতি’ সৃষ্টির যে-রসায়ন, তাতে অবলীলাক্রমে, এক অকপট বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, সংশ্লেষ ঘটে নানা ছন্দ ও স্পন্দন, প্রতিমা ও প্রতীক, উপমা ও রূপকের। আর মানুষের মনের ওপর ছন্দ-স্পন্দন, প্রতিমা-প্রতীক, উপমা-রূপকমেশানো ভাষার অভিঘাত সবসময়ই হয় তীব্র ও কার্যকর। ভালো কবিতা তাই ছুঁয়ে যায় পাঠকের যুগপৎ হৃদয় ও মনন, দুলিয়ে দেয় তাকে, হন্ট করে চলে প্রতিনিয়ত। একটি উৎকৃষ্ট কবিতা কোনো-না-কোনোভাবে ছাপ ফেলেই যায় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে।

এগুলি তো আছেই, কবিতার গুরুতর দিক আমার বিবেচনায় অন্যত্র। কবিতা লেখা হয় শব্দ দিয়ে, যে-শব্দরাশি একটি জনগোষ্ঠির ভাষার অন্তর্গত, যে-ভাষা ফের যৌথের সম্পদ। আর ভাষার সবচেয়ে সূক্ষ্ম, সংবেদনশীল, স্থিতিস্থাপক, সৃজনমুখর ও সৃষ্টি-উন্মুখ দিকগুলি নিয়েই কবিতার কারবার। শব্দের প্রচলিত, অভিধানসিদ্ধ অর্থেরও অতিরিক্ত, সম্প্রসারিত ও নব্য অর্থের সম্ভাবনাকে ক্রমাগত উসকে দিতে থাকে কবিতা। টালমাটাল করে দিতে থাকে শব্দের প্রথাগত অর্থ, উৎপাদন করে নতুন-নতুন অর্থ। ভাষার বিভিন্ন সুপ্ত শক্তি ও সম্ভাবনাকে বিচিত্র ধারায় উন্মোচন করে করে এগিয়ে চলে কবিতা। পোয়েট্রি ইজ দ্য সুপ্রিম ইউজ অব ল্যাংগুয়েজ। মানুষ ভাষিক প্রাণী; সমাজ একটি ভাষাবদ্ধ ব্যবস্থা। আর কবিতা সেই ভাষার মধ্যে ঘটিয়ে দেয় এবং নিত্য জারি রাখে একধরনের বৈপ্লবিক অন্তর্ঘাতের ধারা, নীরবে-নীরবে, আস্তে-আস্তে, গেরিলা কায়দায়। আর এভাবে প্রতিনিয়ত ঝাঁকুনি-খেতে-থাকা ভাষার মধ্য দিয়েই ঝাঁকুনি খায় সমাজের নানা ক্ষেত্রের স্থিতাবস্থা, রণশীলতা। কবিতা ঢেউ তোলে ভাষার সাগরে আর সেই ঢেউয়ের ধাক্কা গিয়ে লাগতে থাকে সমাজে প্রচলিত নানা প্রথা ও মূল্যবোধে। কবিতার কাজ এক্ষেত্রে নীরব, অন্তর্ঘাতমূলক। আপাতদৃষ্টিতে, বাইরে থেকে হয়তো বোঝা যায় না, কিন্তু কাজ চলে নীরবে, ভেতরে-ভেতরে। আর বলাই বাহুল্য, এই অন্তর্ঘাত সদর্থক। এই অন্তর্ঘাত ইতিবাচক। 

কবিতা ও দর্শন:

কবিতা দর্শনের আগে-আগে-থাকা একটি শিল্পপ্রপঞ্চ। এটি সবসময় তা-ই ছিল। একটি কালপর্বের কবিতার মধ্যে আগাম পাওয়া যায় সেই কালের অস্ফুট ও স্ফুটমান বিভিন্ন চিন্তা ও দর্শনের রূপরীতি, তাদের নানারকম উদ্ভাস। একটি কালখণ্ডের মধ্যে জন্ম-নেওয়া কাব্যসমুদয়ের বিপুল হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটতে থাকে, আকার পেতে থাকে সেই সময়কালের নানা চিন্তা, ভাব ও দর্শন।

কবিতার ভাষা:

কোন কবিতা যে কোন ভাষাভঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে আসবে সার্থকরূপে, কবিতার হয়ে ওঠার ব্যাপারটি অর্থাৎ ভেতরকার ফুল ফুটিয়ে দেবার কাজটি সুন্দরভাবে সাধিত হবে যে ঠিক কোন ভাষায়, নির্দিষ্ট করে তা বলার চেষ্টা বৃথা। আগেই বলেছি, একটি কবিতা হচ্ছে কবির একটি বিশেষ অনুভূতি বা উপলব্ধির সবচাইতে সৎ ও অকৃত্রিম প্রকাশ, তাই যে-ভাষায় সেই অনুভূতি প্রতিফলিত হতে পারবে সবচেয়ে অকৃত্রিমভাবে, অর্থাৎ যে-কবিতা দাবি করবে যে-ভাষা, সেই ভাষাতেই লেখা হবে ওই কবিতা। ভাষার ব্যাপারে কবিতার তাই কোনো প্রেজুডিসও নাই, শুচিবায়ুও নাই। বলে-কয়ে-দেওয়া কোনো সুনির্দিষ্ট ভাষা নাই কবিতার। কোনো ফতোয়াও খাটে না কবিতার বেলায়। আর তা ছাড়া, এমনিতেই, কবিতার স্বভাবগত কারণেই, এর ভাষা সরাসরি কখনোই মিলবে না কোনো ভাষার সঙ্গে-না নিত্যব্যবহারের ভাষা, না চলতি, না কথ্য, না প্রমিত-কোনো চেনা ভাষাভঙ্গির সঙ্গেই না, আবার হয়তো সবরকম ভাষার সঙ্গেই। কারণ ভাষাকে ফাটিয়ে, বিশৃঙ্খল করে দিয়ে, নেমে আসে কবিতা। ভাষার ভিতরে ঘটিয়ে দেওয়া এক তুমুল রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে কবিতা। ভাষার এক শুদ্ধসৎ আরতিকতার ফসল কবিতা। উপমা-উৎপ্রেক্ষায় , রূপকে, প্রতীকে, প্রতিমায় আর ভাষা ও যুক্তির শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় এক নতুন শৃঙ্খলা, এক অভিনব গোধূলিভাষ্য। সে যেন খোদ অনুভূতিরই এক অবিকৃত সৎ প্রতিচ্ছবি, উপলব্ধিরই এক সৎ আলপনা-কবিতা। কবিতার ভাষা তাই ফাটা-ফাটা, বাঁকাচোরা, বিশৃঙ্খল ও প্রহেলিকাপূর্ণ। কারণ কবিতায় ভাষার প্রথাগত লজিক, শৃঙ্খলা, ব্যকরণ সবই ভেঙে পড়ে; অনুভূতির তীব্র চাপে ভাষা যায় বেঁকেচুরে, ফেটে-ফেটে।

কবিতা ও নিত্যব্যবহারের ভাষা:

আমাদের প্রাতহ্যিক যাপনপ্রক্রিয়া প্রায়শই থাকে নিয়ন্ত্রিত, কনডিশন্ড-সময় ও পরিবেশ-পরিস্থিতির নানা শর্তের চাপে। প্রাত্যহিক যাপনক্রিয়া তাই সম্ভব করে তুলতে পারে না আমাদের অনুভূতির, আমাদের উপলব্ধির সৎ ও অকৃত্রিম প্রকাশনা। অন্যদিকে কবিতার কাজ বা উদ্দেশ্যই হচ্ছে অনুভূতির অকৃত্রিম প্রতিফলন ঘটানো। কবিতাকে তাই কণ্ঠে তুলে নিতে হয় বিশেষ স্বর, বিশেষ ভাষা। কোনো চেনাজানা ভাষাই পারে না কবিতার দাবি মেটাতে পরিপূর্ণরূপে, প্রতিদিনকার ভাষা তো নয়ই। তবে নিত্যব্যবহারের ভাষা, তার শব্দ, বাগ্ধারা, তার চলনভঙ্গি, এসবের জোরালো অভিপে পড়তে পারে কাব্যভাষায়। সেটা সম্ভব, খুবই সম্ভব-তবে সে-ও অনুভূতির সৎ বহিঃপ্রকাশের তাগিদেই।

কবিতার প্রাসঙ্গিকতা:

যতদিন মানুষ থাকবে, ততদিন থাকবে তার আবেগ, অনুভূতি, সংবেদনা; ততদিন থাকবে কবিতা। বহির্জগতের নানা ঘটনাসংকেতে আলোড়িত হবেন কবি, সেগুলির ছাপ পড়বে তার চেতনায়, তৈরি হবে সে-সংক্রান্ত অনুভূতি আর সেই অনুভূতির প্রতিফলন ঘটাবেন তিনি কবিতা লিখে। আর মানুষ যেহেতু থাকবে সংবেদনশীল, অনুভূতিপরায়ণ, তাই সে পড়বে সেই কবিতা।

দ্রব্যগত কোনো মূল্য নাই কবিতার। ভবিষ্যতে, খোদা-না-খাস্তা, মানুষ যদি কখনো হয়ে পড়ে নিরঙ্কুশ দ্রব্যের দাস; দ্রব্যমূল্য নাই অজুহাতে, কিংবা উল্টিয়ে দিতে পারে দ্রব্যতন্ত্রের গণেশ-এই ভয়ে যদি কোনোদিন নিষিদ্ধও করে দেওয়া হয় কবিতাকে, সম্ভবত তারপরও থেকে যাবে কবিতা। মানুষ তখনো ‘শহরের একপ্রান্তে ফেলে দেওয়া ভাঙা অতিকায় টেলিভিশন বাক্সের মধ্যে বসে মাফিয়া, মগজ-ব্যাংক আর রোবট-পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে লিখে যাবে কবিতা, ’গেরিলা কায়দায়; তারপরও পড়তে থাকবে কবিতা। বেরিয়ে আসবেই কবিতা যে কোনো বন্দিদশা থেকে, যে কোনো দমন-দলন উপেক্ষা করে-হয়তো ভিন্ন ভাব ভাষা রূপরীতি নিয়ে, কখনো ত্রুবাদুর কখনো বাউল কিংবা অন্য কোনো রূপে (অতীতে যেমন হয়েছে), কিন্তু বেরিয়ে সে আসবেই।

লোকধর্মের তাত্ত্বিক-ধ্যানধারণা আর বাংলাদেশের মাজারকেন্দ্রিক লোকধর্মীয়-

সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

সুস্মিতা চক্রবর্তী

ভূমিকা

লোকসংস্কৃতির বিদ্যায়তনিক পরিসরে, 'লোকশাস্ত্রবিদেরা’ ‘লোকধর্ম’ প্রপঞ্চটি বোঝার জন্য বেশ কিছু মনোভঙ্গি বা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। এই সমস্ত মনোভঙ্গিগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আলোকে ও গবেষকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণজাত ধারণার সংমিশ্রণে ‘লোকধর্ম’ প্রপঞ্চটিকে বিবেচনা করে বাংলাদেশের লোকধর্মীয়-সংস্কৃতির প্রক্ষাপটকে মাথায় রেখে লোকধর্ম বিষয়ক এই প্রাথমিক-পর্যালোচনামূলক প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে।

লোকধর্ম: কিছু তাত্ত্বিক মনোভঙ্গি

লোকধর্ম যেহেতু ধর্মের লোকসাংস্কৃতিক রূপ বা বৈচিত্র বা লোকসংস্কৃতির ধর্মীয় বৈচিত্র বা রূপ (Yoder: 2001, p-80)  তাই লোকসংস্কৃতির সঙ্গে এর গভীর সম্পৃক্ততা অনিবার্য। সমাজের আধিপত্যশীল বা আরো স্পষ্ট করে বললে অক্ষর-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বিদ্যমান যে ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক ধ্যান-ধারণা-বিশ্বাস-রীতিনীতি-আচার-অনুষ্ঠান তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে লোকধর্ম সাধারণভাবে অবশ্যই গুরুত্ব দেয় পরম্পরাক্রমে প্রচলিত গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সামষ্টিক ধর্মীয় আচার-বিশ্বাস-সংস্কার আর রীতিনীতির অপ্রাতিষ্ঠানিক বিধি-ব্যবস্থার সংস্কৃতির ওপর। সমাজে, লোকধর্ম-সংশ্লিষ্ট লোকসম্প্রদায়ের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে কিন্তু সেটি সমাজের বিদ্যমান আধিপত্যশীল শাস্ত্রীয় ধর্ম-প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকাংশেই আলাদা। সেদিক থেকে, লোকধর্ম অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক-আধিপত্যশীল ধর্মীয় কাঠামোগুলো থেকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র (Redfield; Schoemaker: 1990, p-62) সমাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত মানুষের দীর্ঘ পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত থেকে লোকধর্ম ও তদ্সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়েরা তাদেররধর্ম-সংস্কৃতিকে লালন করে, পালন করে এবং নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নানামাত্রায় গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে স্ব স্ব লোকধর্মীয়-সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখে। সেদিক থেকে লোকধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো সাধারণত একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী-সংহতি নিয়েও ক্ষুদ্র, অক্ষরবঞ্চিত, বিচ্ছিন্ন, সমজাতীক। লোকধর্মকের এক্ষেত্রে দেখা হয়ে থাকে একটা অনানুষ্ঠানিক (informal) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে যা কিনা বিদ্যমান আধিপত্যশীল ধর্মীয়-কাঠামো থেকে স্বাধীন। 

লোকসংস্কৃতি আর ধর্মের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক (folk) এই দুইপক্ষের মধ্যে, বড় (great)  আর ছোট সনাতন-ধারাগুলির (little traditions) মধ্যে টানাপোড়েনে। (Yoder: Schoemaker: 1990, p-62)| । লোকধর্ম সম্পর্কিত এই ধরনের মনোভঙ্গির ভেতরে নিহিত থাকে এই ধারণা যে, লোকধর্ম কোনো না কোনোভাবে আনুষ্ঠানিক ধর্ম থেকে সরে আসা বা বিচ্যুত একটা ধর্ম। (Schoemaker: 1990, p-62)| তবে লোকধর্ম শুধু যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিপরীতে অবস্থান করেই গড়ে ওঠে তাই নয় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-সংস্কৃতির বলয়ে বাস করেও গোষ্ঠীগত আঞ্চলিক মানুষের সাংস্কৃতিক পরম্পরাআচার-অনুষ্ঠান-বিশ্বাস-প্রথা-রীতিনীতি-উৎসব ইত্যাদি প্রভৃতির মধ্য দিয়ে ধর্মের লৌকিক রূপ পরিলতি হয়ে থাকে।

এ কারণেই খৃষ্টান ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যেও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানে বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায় বিশেষ করে আধিপত্যশীল খৃষ্ট-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পরিসরের বাইরের আচার-অনুষ্ঠানে যখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র  গোষ্ঠীবদ্ধ খৃষ্টান-মানুষের পরম্পরাগত লোকধর্মীয় ধারাগুলি পরিলতি হয় তখন একে খৃষ্ট-ধর্মের ‘লৌকিক রূপ’ বা ‘লৌকিক খৃষ্টান’(wikipedia.org)  বলে অভিহিত করা যায়। যেমনটি আমাদের বঙ্গদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে ও এর বাইরে এর লোকায়ত-ধারাগুলো পরিলতি হয়েছে যাকে ‘লৌকিক ইসলাম’ (হক: রাইন: ২০০৯, পৃষ্ঠা-১৫৯) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই লৌকিক ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত বিভিন্ন সুফি-পীরবাদী ঘরানা।

একথা উল্লেখ্য যে, এদেশে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটেছে বহিরাগত সুফি-সাধকদের উদার, সাম্যবাদী চিন্তাচেতনার আলোকে ও পরবর্তীকালে তাদেরই প্রভাবজাত এদেশের অসংখ্য ফকির-দরবেশ-পীর-গুরুদের লোকধর্মীয় দর্শনের আলোকে। তাদের মানবতাবাদের উদার আর উদাত্ত আহ্বানে। ইসলামের কট্টর শরীয়তীধারা কখনোই এদেশের সাধারণ মানুষকে তেমন আকৃষ্ট করতে পারে নাই যতটা না আমাদের মারেফতি-ফকিরি ধর্ম তাদেরকে আপন করতে পেরেছে। আমাদের লৌকিক ইসলামের ধারাই ঐতিহাসিকভাবে এদেশের সাধারণ মানুষের ধর্মীয়-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে অনেক বেশি করে। বাংলাদেশে এই ধর্মের প্রবক্তরা এতটাই সৃষ্টিশীল ছিলেন যে তারা স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে তাদের ধর্মের আচরন বিধির মধ্যে গ্রহণ করে নিতে পেরেছিলেন। (রিচার্ড এম ইটন: ২০০৩, পৃ-২৪০) এদেশের আধিপত্যশীল-শাস্ত্রীয় ইসলামের আধিপত্যশীল ধর্ম-ভাবনার বাইরে সাধারণ মানুষের পরম্পরাক্রমে পালিত লোকসংস্কৃতির মধ্যেই এই ‘লৌকিক ইসলামের’ অবস্থান।

লোকধর্মের এই দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লোকধর্মীয়-সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির বিভিন্ন  সমৃদ্ধশালী ধারা ও রূপ পরিলতি ও পর্যবেতি হতে দেখা গেছে। অর্থাৎ ধর্মের আধিপত্যশীল শাস্ত্রীয় ধারা একরৈখিক; এর বৈচিত্র তুলনামূলকভাবে কম বিপরীতে লোকধর্ম যেহেতু লোকসমাজের স্থানীক-আচার-অনুষ্ঠান-বিশ্বাসের সঙ্গে বেশি করে সম্পর্কিত তাই লোকধর্মের বৈচিত্রমুখী লোকসাংস্কৃতিক রূপ যা কিনা পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ল্য করা যায়। উদাহরণ হিসেবে আমরা বিভিন্ন দেশের ইসলাম ধর্মের লৌকিক-রূপের যে ভিন্নতা রয়েছে সেকথা জোরে-সোরে বলতে পারি।

আসলে ধর্ম আর সংস্কৃতি আদিকাল থেকেই খুব ঘনিষ্টভাবে সমাজ-গভীরে প্রোথিত বিশেষ করে দেশীয় বা আদিবাসী গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সামষ্টিক আচার-ব্যবহার-বিশ্বাস-রীতিনীতি-সংস্কার-অনুষ্ঠান লোকধর্ম ও সংস্কৃতিকে এমনভাবে বেষ্টন করে আবর্তিত হয় যেখানে ধর্ম আর সংস্কৃতিকে প্রায়শই পৃথক করার উপায় থাকে না। আর প্রচারমূলক ধর্মগুলি যখন নতুন কোন দেশে বিস্তার লাভ করার চেষ্টা করে তখন সেই দেশের দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত লোকধর্মীয়-সংস্কৃতির সঙ্গে নানাভাবে জারিত হয়ে বিভিন্ন পরিবর্তন বা রূপান্তরের মাধ্যমে লোক-চেতনায় স্থান পায়। বিশেষ করে লৌকিক-পরিসরে যদি কোনো নতুন ধর্মীয়-ধারার আগমন ঘটে তখন তাকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্ব দেশের পরম্পরাগত লোকধর্মীয়সংস্কৃতির সঙ্গে এর মেলবন্ধন ঘটানোর মধ্য দিয়েই এর ইতিবাচক ফলাফল অর্জিত হয়।

এই জন্যই বাংলার লৌকিক-ইসলামের সঙ্গে হিন্দুধর্মের সনাতন-লৌকিক ধারার বিভিন্ন রূপ যেমন যুক্ত থেকেছে, বৌদ্ধধমের্র্র লৌকিক-ধারারও বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে এমন কি আর্য, অনার্য ধর্ম-সংস্কৃতির কিছু কিছু রূপও এখানে প্রবেশ করেছে।(হক: রাইন: ২০০৯, পৃষ্ঠা-১৫৯) যদিও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বেশিররভাগ বঙ্গীয়-লোকধর্মীয়-সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে আধিপত্যশীল-শাস্ত্রীয় বা শিষ্টধর্মের বিধিনিষেধের কট্টর মনোভাব আর শিষ্ট-ধর্ম-সংস্কৃতির প্রবল শ্রেণীবৈষম্য প্রবলভাবে কাজ করেছে, প্রতিবাদী লোক-চৈতন্যে স্থান পেয়েছে জাতপাতহীন উদার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোক-ধর্মীয় ধারা ও তাদের সংস্কৃতির পরম্পরা। সেই প্রাচীন কাল থেকে এদেশে কট্টর শাস্ত্রবিরোধী বিশেষত আধিপত্যশীল-ধর্ম-সংস্কৃতির বিপরীতে অবস্থান নেয়া অসংখ্য লোকসম্প্রদায় তাদের প্রতিবাদী-ধর্ম-সংস্কৃতির পালন আর পরিচর্চার মধ্য দিয়ে এদেশের লোকায়ত-ধর্ম-সংস্কৃতির স্বতন্ত্র-সমৃদ্ধ-পরম্পরা টিকিয়ে রেখেছে। বঙ্গীয় লোকসমাজের প্রতিবাদী চিন্তা-চেতনার ঐতিহাসিক পরম্পরাটি বিবেচনা করলে দেখা যায় সেই নবম-দশম শতাব্দীতে সেকালের আধিপত্যশীল ব্রাহ্মণ-ত্রিয়দের ধর্মের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন আমাদের লৌকিক-বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া-সিদ্ধাচারেরা যার প্রমাণ পাওয়া যায় আমাদের চর্যাগীতিতে।

আধিপত্যশীল কট্টর-শাস্ত্রীয় ধর্মের মূল স্তম্ভ বেদ আর ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে এরকম দুঃসাহসী প্রতিবাদ আজ থেকে অন্তত এক হাজার বছর আগেকার বাঙালির লোকধর্মের শক্তির কথাই ঘোষণা করে। (সরকার: ২০০৯, পৃ-৭৫) এই প্রতিবাদী সহজিয়া বৌদ্ধ-সিদ্ধাচার্যেরা শাসকশ্রেণীর ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে লোকধর্মের জয়গান করেছিলেন। লোকসমাজের শক্তিশালী এই প্রতিবাদী-চেতনা-পরম্পরা আমরা ল্য করি বঙ্গের আরো অনেক লোকধর্ম-সম্প্রদায়ের উদ্ভবের পেছনে। উদাহরণস্বরূপ আমরা চৈতন্যদেব প্রচারিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের কথা বলতে পারি যা কিনা শাস্ত্রীয় আধিপত্যশীল কট্টর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের শাসন আর শোষণের নিষ্পেষণ থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। আবার পরবর্তীকালে, চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর যখন গৌড়ীয়-বৈষ্ণবধর্ম আবারও অভিজাতধর্মতন্ত্রের শাস্ত্রীয়ধারায় রূপ লাভ করেছিল এর প্রতিক্রিয়ায় তখন বঙ্গে ছোট ছোট গোষ্ঠীকেন্দ্রিক লৌকিক-ধর্মের উদ্ভব ঘটে। আদিবাসী সমাজের আদিম বস্তুবাদই বিবর্তিত হয়েছে সহজিয়া বৌদ্ধ মতবাদে আর এই সহজিয়া মতবাদই নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চৈতন্য-উদ্ভাবিত বৈষ্ণবচিন্তায় চোলাই হয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে আঠারো উনিশ শতকের বঙ্গের প্রধান লোকধর্ম বাউলে (সরকার: ২০০৯, পৃ-৭৬)।

এছাড়া কর্তাভজা, সাহেবধনী, রামবল্লভী, খুশিবিশ্বাসী, মতুয়া, নামে ছোট ছোট স্বতন্ত্র লোকধর্মগুলো লৌকিক বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে গড়ে উঠেছিল মূলত আধিপত্যশীল-ধর্মীয়-সংস্কৃতির বাইরে স্বতন্ত্র প্রতিবাদী-লোকধর্মীয় ধারা হিসেবে টিকে থাকতে। বাংলাদেশের লোকধর্মগুলোর উদ্ভব আর বিকাশে এই প্রতিবাদী শ্রেণীচেতনা বিশেষভাবে ল্য করা যায়। লোকধর্মীয়-সম্প্রদায়ের এই প্রতিবাদী-চেতনা কখনো ক্রিয়াশীল থাকে আধিপত্যশীল-ধর্মীয়-শাস্ত্রের বিরুদ্ধে আবার কখনো ক্রিয়াশীল থাকে প্রত্যভাবে শ্রেণী-শাসকের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার আদিবাসীদের মধ্যে উদ্ভূত পাগলপন্থীরা (ভদ্র: ১৯৯৪, পৃ-৬১), দণিবঙ্গের রাজবংশীদের মধ্যে উদ্ভূত পো-দলেরা (সরকার: বিশ্বাস: ২০০৮, পৃ-৫০), ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের দয়াময়-সম্প্রদায়েরা (মণ্ডল: বিশ্বাস: ২০০৯, পৃ-১২৬), লৌকিক-বৈষ্ণবধারার মা-দাদা সম্প্রদায়েরা,(সরকার: বিশ্বাস: ২০০৮, পৃ-৪৮) ফকিরি-ধারার বিভিন্ন আঞ্চলিক-গুরুবাদী-পন্থীরা তাদের প্রতিবাদী-চেতনার স্বাতন্ত্র বজায় রেখে নিজেদেরকে স্ব স্ব লোকধর্মীয়-পরিসরে অধিষ্ঠিত রাখে।                       

অপর একটি দৃষ্টিভঙ্গি যেটা লোকধর্ম প্রপঞ্চটিকে নিরীণ করে প্রাচীন, আদিম ধর্মীয়-সংস্কৃতির অবশেষ নিয়ে গঠিত হিসেবে। উনিশ শতকের ব্রিটিশ স্কুল অব অ্যানথ্রোপলজি-এর কাজকর্মের ওপর ভিত্তি করে এই ধারণাটি গড়ে উঠেছে। লোকধর্মকে বোঝার এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি লোকধর্মকে দু’ভাবে দেখা হয়ে থাকে: বিবর্তনমূলক মনোভঙ্গি (evolutionary approach)  আর বিকেন্দ্রীকরণমূলক মনোভঙ্গি (devolutionary approach)|  ধর্মের বিবর্তনমূলক মনোভঙ্গি লোকধর্মকে সাংস্কতিক-উন্নয়নের গোড়ার দিককার আদিম ধর্ম-সংস্কৃতির হতাবশিষ্ট হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। আমাদের দেশের বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর উদ্ভব আর বিকাশের মধ্যে এই বিবর্তনের চেহারা পর্যবেণ করা যায়।  খোদ ইসলাম ধর্ম আরবে যেভাবে বিকশিত হয়েছিল সমাজের নিম্নবর্গীয় দাসমানুষদের  নিয়ে পরবর্তীতে নানা বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এটি প্রাতিষ্ঠানিক বা শাস্ত্রীয় রূপ পরিগ্রহ করে। এ বিবর্তনমূলক ধর্মীয়-চেহারা আমাদের আদিবাসী ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে শুরু করে লোকসমাজের অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক-শাস্ত্রীয় ধর্মের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। আর বিকেন্দ্রীকরণমূলক মনোভঙ্গি লোকধর্মকে একটা প্রাচীন স্বর্ন-যুগের হতাবশিষ্ট হিসেবে নিরীক্ষণ করে থাকে যেখানে ধর্ম ছিল তার সবচাইতে খাঁটি আর আদি-অকৃত্রিম রূপে (Schoemaker: 1990, p-62)| ।

অপর একটি মনোভঙ্গিতে লোকধর্মকে ’শিষ্টধর্মের’ বা ’উচ্চধর্মের’ একটা পূর্বতন অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যা একটা সংস্কৃতির ‘পশ্চাৎপদ’ মানুষের মধ্যে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলে আর এই ‘পশ্চাৎপদ’ মানুষেরাই তা রা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি জার্মানীর প্রথমদিককার পণ্ডিতদের নিমজ্জিত-সংস্কৃতি (সানকেন-কালচার)-এর ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে। এই ব্যাখ্যা অভিজাত থেকে কৃষকের সামাজিক শ্রেণীবিভাগের সংস্কৃতির ডুবে যাওয়াকে নির্দেশ করে। ( Schoemaker: 1990, p-62) এই মনোভঙ্গিগুলোর (evolutionary/ devolutionary approach) মাধ্যমে  লোকধর্মকে শণাক্ত করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা যদি খৃষ্ট-ধর্মের প্রটেষ্ট্যান্ট-মতবাদের দিকে মনযোগ দিই তাহলে দেখতে পাব এটি অবশ্যই লোকধর্ম কেননা এটি আধিপত্যশীল ক্যাথলিক-মতবাদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এবং এই কারণে প্রটেষ্ট্যান্টবাদীরা একে বলবে বিবর্তনমূলক। কিন্তু ক্যাথলিকরা একে বলবে বিকেন্দ্রীকরণমূলক।

একইভাবে আমাদের বঙ্গের বিভিন্ন লোকধর্মীয়-ধারাগুলো যখন আধিপত্যশীল ধর্মীয়-ধারা থেকে সরে এসে স্বতন্ত্র  ছোট ছোট লোকধর্ম-ধারা গড়ে তুলেছে সেখানেও দেখা যাবে আধিপত্যশীল ধর্ম-গোষ্ঠী তাদেরকে দেখবে বিকেন্দ্রীকরণমূলক মনোভঙ্গি থেকে যেখানে প্রতিবাদী-লোকধর্মীয়-ধারা নিজেদেরকে দেখতে পারে বিবর্তনমূলক মনোভঙ্গির মধ্য দিয়ে। এদেশের ফকিরি-সুফি-ধারার অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ট চিশতিয়া-তরিকার ফকিররা যখন নিজেদেরকে লৌকিক-ইসলামের প্রধানধারা হিসেবে নিজেদের পরিচয় চিহ্নিত করছে- ফকিরি-ধারার মধ্যে নিজেদের প্রধান বলে স্বতন্ত্র করছে তখন সেখান থেকে আলাদা হয়ে একটি লোকধর্মীয়-প্রতিবাদী ধারা হিসেবে নিজেদেরকে ’আল্-চিশতিয়া’ বলে ’মানবধর্মের’ লোক বা ‘বাউলের ধর্মডা করি’ বলে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় নির্দেশ করছে। এভাবে আধিপত্যশীল লোক-ধর্মীয়-ধারা থেকে যখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিবাদী লোকধর্মীয়-ধারা গড়ে ওঠে তখন বড়-পক্ষ ছোটপক্ষকে বিকেন্দ্রীকরণমূলক মনোভনোভঙ্গিতে দেখতে পারে যেখানে ছোট-প নিজেদেরকে বিবর্তনমূলক-ধর্ম বলে দেখতে পারে।

ফলে লোকধর্ম-বিশ্লেষণের এই মনোভঙ্গিগুলোর আলোকে যথার্থভাবে লোকধর্মকে বিশ্লেষণ করা যায় না কেননা এগুলো নির্ভর করে কাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থানের সাথে আমি অবস্থান করছি তার ওপর। এ সমস্ত মনোভঙ্গিতে একপ নিজেদেরকে ’শিষ্ট’ বা ’অভিজাত’ মনে করতে পারে আবার আরেকপকে ’অশিষ্ট’ ’পশ্চাৎপদ’ বলে হেয় প্রতিপন্ন করার সুযোগ তৈরী হয়। আমাদের আদিবাসীসমাজের সর্বপ্রাণবাদমূলক ও যাদুবিশ্বাসকেন্দ্রিক বিভিন্ন ধর্মাচারগুলোকে বা বঙ্গের সনাতনী-ধারার বাউল-ফকির-তান্ত্রিক-সহজিয়া-বৈষ্ণব-লোকধর্মীয়-ধারাগুলোকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার প্রবণতা  এ সমস্ত মনোভঙ্গিগুলোতে জারি থাকে।            

সমন্বয়মূলক ধারণা (syncretism)  বা অঙ্গীভূতমূলক (acculturation)  ধারণার আলোকে লোকধর্মকে চিহ্নিত করার আরেকটি পথ বা মনোভঙ্গি রয়েছে। এই ধরনের মনোভঙ্গিতে লোকধর্মকে বিভিন্ন পরম্পরাগত যে সনাতনী-ধারা প্রচলিত থাকে সেগুলোর মিশ্রণ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। (Schoemaker: 1990, p-62)| । সমন্বয়মূলক-প্রক্রিয়াটি তখনই ঘটে যখন একটা সংস্কৃতি নিজেকে অন্য একটি সংস্কৃতিতে আরোপ করে এবং দুই সংস্কৃতির মধ্যে নানামুখী  মিথোস্ক্রিয়া ঘটে। দুইটি সংস্কৃতির মধ্যকার পারস্পরিক এরূপ লেনদেন এক সংস্কৃতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মিশ্রিত হয়ে যায়। এই ধরনের প্রক্রিয়ার উদাহরণ আমরা অনেক দেশের সংস্কৃতির মধ্যেই পর্যবেণ করতে পারব এবং ইতোমধ্যে যা অনেকেই করেছেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা পাশ্চাত্যের, ক্যাথলিকবাদের কথা বলতে পারি। অষ্টাদশ-উনিশ শতকে খৃষ্টান-মিশনারীরা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে  আদিবাসী-সংস্কৃতির মধ্যে  ক্যাথলিকবাদ আরোপ করেছিলেন তখন অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীবদ্ধ সংস্কৃতি-দল তা গ্রহণ করেছিল। যদিও এই আদিবাসী ধর্মীয়-গোষ্ঠীরা তখনও তাদের পুরোনো বিশ্বাস-ব্যবস্থগুলিও রা করছিল। সেখানে দুটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ধারাগুলির মিশ্রণ ঘটেছিল।

বাঙালির লোকধর্মে শুধু দেশীয় অনার্য-দেবতা, আর্যদেবতা ও ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীয় ধর্মেরই সংশ্লেষণ ঘটায় নি, অনেক ইসলামী উপাদান ও মুসলমান পীরকেও অভিনব পদ্ধতিতে আত্মস্থ করে নিয়েছে। এবং এই দেবতা ও পীরেরা অনায়াসে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের মান্যতা আদায় করে নিয়েছেন। (সরকার: খান: ২০০৮, পৃ-৭১) বঙ্গের লোকধর্মে অঙ্গীভূতমূলক আর সমন্বয়মূলক-ধ্যানধারণার সংমিশ্রণ অনেক ঘটেছে। মধ্যযুগীয়-সাহিত্যে আমরা এদেশের লৌকিক ইসলাম আর লৌকিক হিন্দুধর্মের মানুষের ধর্মসমন্বয়বাদীতার চমৎকার সব চিত্র খুঁজে পাই।

লোকধর্ম সম্পর্কিত লোক-ব্যাখ্যার আলোকে লোকধর্ম-প্রপঞ্চটিকে নীরিণ করার আরেকটি পথ রয়েছে যেখানে লোকধর্ম লোকমানসের অনুভূতি, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠানের সামগ্রীক সত্ত্বা হিসেবে বিবেচত হয়ে থাকে। সংস্কৃতির অপ্রাতিষ্ঠানিক স্তরবিভাজনের মধ্যে নিজেদের ধর্ম-সম্পর্কিত বিষয়াদি এতে যুক্ত থাকে।(Schoemaker: 1990, p-62) |  বাংলাদেশের লৌকিক ইসলাম মারেফতি বা ফকিরিধারার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। এই ফকিরিধারার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট লোকধর্ম-সম্প্রদায় যারা বিভিন্ন তরিকা বা সিলসিলাপন্থী। এদের মধ্যে কোনো কোনো লোকধর্মীয়-পন্থীরা শরীয়তকে গ্রাহ্য করে পাশে রাখে আবার কোনো কোনো সম্প্রদায় আধিপত্যশীলশরীয়তী-আচার-আচারন বর্জন করে তাদের নিজেদের মারেফতি-ধারার লোকধর্মীয় নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা। এক্ষেত্রে, কখনো কখনো দেখা যায়, আধিপত্যশীল ধর্ম-সংস্কৃতির ভাষা-শব্দ বিভিন্ন লোকধর্মীয়-সংস্কৃতির মধ্যেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকে; লোকধর্মীয়ব্যাখ্যার কারণে সেগুলোর অর্থ হয় অন্যরকম- ভিন্ন। যেমন শাস্ত্রীয় ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয়-অনুসঙ্গ হিসেবে নামাজ, রোজা হজ্ব আর জাকাতের অর্থ যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে মারেফতি-ধারার লৌকিক ইসলামে সেগুলোর অর্থ অন্যরকম। এমনকি, লোকব্যাখ্যার সাহায্যে মারেফতি ধারার ফকিররা তাদের ধর্ম-সংস্কৃতিকে কখনো কখনো প্রকৃত বা আসল ইসলামের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবী করার শক্ত পাটাতন পায় আর তা প্রয়োজনে অন্য-সম্প্রদায়কে নিজেদের অনন্যতা বা স্বতন্ত্রতা ঘোষণা করার কাজে কিংবা আধিপত্যশীল-ধর্মীয় ধারার সাথে একাত্মতা রার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে।

আবার, অন্যদিকে বঙ্গের দেহবাদী লোকধর্মীয়-ধারাগুলো তাদের গুপ্ত-সাধনাগুলো লোকব্যাখ্যার আলোকেই পরম্পরাক্রমে চালিয়ে যায়। ইতিহাসের নানা কালপর্বে দেখা যায় যে, এই সমস্ত লোকধর্মীয়-সম্প্রদায়গুলো অনেকক্ষেত্রে উচ্চবর্গের ধর্মীয় অনুশাসনে শোষিত হয়, অত্যাচারিত হয়। উচ্চবর্গের এই অত্যাচারকে মোকাবেলা করার জন্য তারা অনেক সময়ই গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়।  কৌশল করে শাসকের ভাষাকে নিজেদের পরিসরে ব্যবহার করে যদিও শাসকের ভাষার অর্থ বদলে যায়। আবার, এ সমস্ত দেহবাদী-লোকধর্মীয়-সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের দেহসাধনার নানা বিষয় সিম্বলিক-আকারে থাকে যেন দেহসাধকদের বাইরে এই ভাষার অর্থ অন্যরা বুঝতে না পারে। এই সব ক্ষেত্রে প্রচলিত শাস্ত্রীয়-ভাষাকে তারা নিজেদের মতো অর্থ করে ব্যবহার করে। এখানে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনানুষ্ঠানিক চেহারা হিসেবে লোকধর্মকে বিবেচনা করার যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তার সঙ্গে লোকধর্ম সম্পর্কে লোক-ব্যাখ্যার এই দৃষ্টিভঙ্গির অনেক মিল ল্ক্ষ্য করা যায়। এই দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই লোকধর্মকে শণাক্ত করা হয় অনানুষ্ঠানিক আর অবরাদ্দকৃত ধর্ম-সংস্কৃতির চেহারায়। লোকধর্ম একটা শাস্ত্রীয় গোঁড়া ধর্মের পাশাপাশি ধর্মের লোক-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র গঠন করে। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক মানুষ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বলয়ে বাস করেও তার পরম্পরাগত ধর্ম-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে লৌকিক-ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান বিশ্বাস করে, বহন করে ও পালন করে চলে। তাই, এদেশের লৌকিক ইসলামের পরম্পরাগত শক্তিশালী ধারার ধর্মীয়-আচার-অনুষ্ঠান-উৎসবে বিদ্যমান শাস্ত্রীয়-ধারার লোকেরাও শামিল হতে পারে আবার বিপরীতে, আধিপত্যশীল-শাস্ত্রীয়-ধর্মের সমান্তরালে অবস্থিত লৌকিক-ইসলামের অনুসারীরাও লোকব্যাখ্যার সাহায্যে নিজেদেরকে শাস্ত্রীয়-ব্যাখ্যার বিপরীতে স্থাপন করেও প্রকৃত ইসলামের সঙ্গে নিজেদের সুসম্পর্কিত করতে পারে।

উপরোল্লিখিত মনোভঙ্গি বা দৃষ্টিভঙ্গিগুলির বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আমরা বিদ্যায়তনিক-পরিসরে লোকধর্ম প্রপঞ্চটিকে শণাক্ত করতে পারি। তবে এই সমস্ত ধারণাগুলি সর্বদাই যে স্পষ্ট তা নয়। বিশেষ করে লোকধর্ম সম্পর্কিত সংস্কৃতির আনুষ্ঠানিক আর অনানুষ্ঠানিক স্তরবিভাজনের মধ্যে টানাপোড়েনের যে ধারণা (Yoder: 2001, p-8)  সেটি অনেক সময় স্পষ্ট হয় না। লোকধর্মকে যদি কেবলমাত্র ধর্ম-সংস্কৃতির অনানুষ্ঠানিক চেহারার মধ্যে ফেলে বিবেচনা কার যায় তাহলে মনে হবে লোকধর্ম সর্বদা অপ্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ধর্ম-সংস্কৃতির কেবল অনানুষ্ঠানিক স্তরবিন্যাসের মধ্যেই এর অবস্থান। কিন্তু লোকধর্মের অভ্যন্তরেও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে।

আবার লোকধর্মের বিবর্তনমূলক আর বিকেন্দ্রিকমূলক ধ্যানধারণার মধ্যে সমাজ-মানুষের ধর্ম-সংস্কৃতি সম্পর্কে বৈষম্যমূলক ধ্যানধারণা প্রকট হয়ে উঠতে পারে। লোকধর্ম-সম্পর্কিত এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গিগুলির আলোকে যদি এদেশের লোকধর্ম ও সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, এদেশের আদিবাসী গোষ্ঠীকেন্দ্রিক মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস অনেকখানিই প্রকৃতি-নির্ভর। প্রকৃতির উপাসনা, সর্বপ্রাণবাদ, বিভিন্ন যাদু-বিশ্বাস নির্ভর আচার-অনুষ্ঠান আদিতে মানুষের ধর্মীয় আচারের প্রধান অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। আদিতে মানুষের জীবন-যাত্রা অনেক বেশি প্রকৃতিনির্ভর ছিল। প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া করে টিকে থাকা মানুষ সহজাত বিশ্বাসেই জীবনের অনিশ্চয়তা আর বিপদ-সঙ্কুল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য প্রকৃতির আরাধনা শুরু করে। প্রকৃতিকে জয় করতে আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে আদিবাসী মানুষ বিভিন্ন যাদুমূলক বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির কৃপা প্রার্থনা করতো।

আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর মানুষের জীবনযাপনের ধরন আর আদিতে বনে বাস করা মানুষের জীবনযাপনের ধরনের মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। এই বিস্তর ভিন্নতা তাদের ধর্মীয় জীবনেও লনীয় তা বলাই বাহুল্য। ফলে অনবরত অনিশ্চয়তা আর প্রকৃতির বৈরীতাকে অতিক্রম করতে তাদের প্রকৃতি-আরাধনা, আচার-অনুষ্ঠান সব কিছুতেই যাদু-বিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত হত। এই যাদুমূলক আচার-অনুষ্ঠানই ছিল আদিতে মানুষের ধর্ম। পরবর্তীতে সভ্যতার ক্রমবিভাজনের স্তরে স্তরে অন্যান্য বিষয়ের মত মানুষের ধর্মীয় বিশ্বসেও এসেছে নানান পরিবর্তন আর বৈচিত্র। যদিও যাদু-মূলক বিশ্বাস ও তদ্সংশ্লিষ্ট আচারাদির কিছু কিছু ছাপ এখনও নানা আদিবাসী-গোষ্ঠীগত মানুষের ধর্মীয়-সংস্কৃতিতে পর্যবেণ করা যায়; এমনকি এদেশের আধিপত্যশীল শাস্ত্রীয়-ধর্মীয়-পরিসরের বাইরে প্রন্তিক-মানুষের গোষ্ঠীগত লোকধর্মীয় ঐতিহ্যিক আচার-আচরনের মধ্যেও আদি-যাদুমূলক চিন্তাচেতনার ছাপ আজো পরিলতি হয়ে থাকে।

উনিশ শতকের নৃবিজ্ঞানী ফ্রেজার বলেন, যাদু ছিল ধর্ম আর বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধাপ। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক উন্নয়নের গোড়ার দিককার বিজ্ঞান হিসেবে তিনি যাদু আর ধর্মকে দেখেছেন। (G. Frazer; Schoemaker: 1990, p-61).  যাদু আর ধর্মের আদিরূপই পরবর্তীকালে বিবর্তিত হয়ে সামাজিক গোষ্ঠবিদ্ধ মানুষের ধর্মীয়-সংস্কৃতিতে ঠাঁই করে নেয় অন্য ভাবে। প্রকৃতি-আরাধনার পাশাপশি কোনো অতিপ্রাকৃত দৈবশক্তিতে বিশ্বাস করার প্রবণতা আমরা কমবেশি অনেক ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখতে পাই। আদিবাসী কৌমসমাজের যাদুবিশ্বাসমূলক লোকধর্মীয়-সম্প্রদায়ের  বিভিন্ন ধারা রয়েছে। এই সব কাল্টের মূল ধারা কয়েকটিই: মাতৃকা-উপাসনা, উর্বরতা-তন্ত্র, যৌনপ্রতীক-উপাসনা এবং পূর্বপুরুষদের স্মৃতিপূজা (পল্লব সেনগুপ্ত: ২০০১, পৃ-৩৬) আবার, একথাও ঠিক যে লোকধর্ম-সম্প্রদায়গুলো শুধুমাত্র বিশেষ দেবতা বা দৈবশক্তিকে আবর্তন করেই গড়ে ওঠে না, বিশেষ কোন উচ্চ গুণসম্পন্ন মানুষকে কেন্দ্র করেও গড়ে ওঠে। অখণ্ড বাংলার এই ধরনের অসংখ্য লোকধর্মীয়-সম্প্রদায়কে গবেষক অয় কুমার দত্ত অভিহিত করেছেন ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়’ (দত্ত, ১৪০৯ বাং) হিসেবে।  এই ধরনের লোকধর্মীয়-সম্প্রদায় (Cult)  আজও এদেশে যথেষ্ট পরিলতি হয়ে থাকে যাদেরকে সাধারণভাবে তরিকা-পন্থী বা সিলসিলাপন্থী বা স্ব স্ব সম্প্রদায়ের প্রবর্তকের নামানুসারে তাদের ধর্ম-সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে যাদের মধ্যে বৃহত্তর অর্থে বেশ কিছু ঐক্য পরিলতি হলেও প্রত্যেক লোক-সম্প্রদায়েরই ধর্ম-সংস্কৃতির কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য-চিহ্ন পর্যবেণ করা যায়। এই ধরনের লোকধর্মীয়-সম্প্রদায়েরা বৃহত্তর হিন্দু বা ইসলাম ধর্মের পরিচয়ের মধ্যে অবস্থান করেও যেমন নিজেদের সম্প্রদায়-ভিত্তিক লোকধর্মীয় আচার-আচরণ বজায় রাখতে পারে আবার অনেক লোকধর্মীয়-সম্প্রদায় আধিপত্যশীল ধর্মীয়-সংস্কৃতি থেকে দূরে অবস্থান করে তাদের স্বাতন্ত্রতা টিকিয়ে রাখে। 

বর্তমান প্রবন্ধটি যেহেতু গবেষকের এদেশের মাজারকেন্দ্রিক লোকধর্ম-সম্প্রদায় নিয়ে পরিচালিত দীর্ঘ-গবেষণার একটি অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হলো তাই লোকধর্ম-সম্পর্কিত বিদ্যায়তনিক-ধ্যানধারণার পাশাপাশি গবেষকের দীর্ঘ বছরের প্রত্য মাঠ-গবেষণার আলোকে লোকধর্ম সম্পর্কিত উপরোল্লিখিত পাশ্চাত্যের বিদ্যায়তনিক-ধারণাগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ধারণার সংমিশ্রণে (যেমন ধর্মের আধিপত্যশীল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় কাঠামোগুলো থেকে স্বাধীন ও স্বতšত্র হিসেবে লোকধর্মকে  ব্যাখ্য করে, প্রতিবাদী ধর্ম হিসেবে লোকধর্মকে ব্যাখ্যা করে, ধর্মের সমন্বয়মূলক চেহারা হিসেবে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অভ্যন্তরে ধর্মের লোকসাংস্কৃতিক রূপের ধারণা হিসেবে, ধর্মের অঙ্গীভূতমূলক আর সমন্বয়মূলক ধারণা হিসেবে আর স্ব স্ব লোকধর্মের লোকব্যাখ্যামূলক ধারণার আলোকে) এদেশের লোকধর্মের তাত্ত্বিককাঠামোর শক্তিশালী ভিতটি শণাক্ত করে এখানকার মাজারকেন্দ্রিক লোকধর্ম-সম্প্রদায় নিয়ে গবেষকের প্রত্য অভিজ্ঞতাজাত একটি সাধারণ বিশ্লেষণ নিচে উপস্থাপন করা হলো যেটা এদেশের লোকধর্মীয়সাস্কৃতিক প্রোপটকে একটু অন্যভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের ‘লৌকিক-ইসলাম’: মাজারকেন্দ্রিক লোকধর্ম ও সংস্কৃতি

বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় ইসলামের বাইরে এদেশের নিম্নবর্গীয় মুসলমান-লোকসমাজের হাজার বছরের পরম্পরাগত সুসমৃদ্ধ যে ধর্ম-সংস্কৃতি রয়েছে, তা আধিপত্যশীল ধর্ম-সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে আমাদের সামনে খুব বেশি পরিচিতি লাভ করার সুযোগ পায় না। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণী তার শ্রেণী-চরিত্রের বাইরে এসে এদেশের অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কিংবা নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর তথা গরীব মানুষের ধর্ম-সংস্কৃতিকে তেমনভাবে আমলে আনেন না। তাঁরা বরং অর-বঞ্চিত, স্বশিতি এই সমস্ত প্রান্তিক বা লোকায়ত জন-সংস্কৃতিকে ‘অপর’ জ্ঞানে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এসেছেন দীর্ঘ দিন ধরে। আবার বিপরীতে, শাসক শ্রেণীর স্বার্থরাকারী, আধিপত্যশীল ও কর্তৃত্বপরায়ন শাস্ত্রীয় ইসলামের ধারক-বাহকেরা ইসলামের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের দিকগুলিকে অতিশয় কট্টরভাবে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এর বাইরেও যে এদেশে খোদ ইসলাম ধর্মের মূলধারারই অর্ন্তগত অন্য অনেক বিচিত্র ধারা রয়েছে, সেগুলোকে তাঁরা বর্জনীয় বলে মনে করেন, আর অস্বীকার করেন কেবলমাত্র তাদের সংকীর্ণ শরিয়তী ভেদ-বুদ্ধি দ্বারা।

ধর্ম আর সংস্কৃতি সদা-সর্বদা পাশাপাশি অবস্থান করে প্রবাহিত হয়ে চলে মানুষের অস্তিত্বে ও জীবনযাত্রায়। কিন্তু, এদেশের লোকধর্মীয়-সংস্কৃতির চেহারা কেমন, এই লোকধর্মীয় বা ‘লৌকিক ইসলামের’ হালহকিকত-ই বা কী, সে-ব্যাপারে পশ্চিমা ভাবধারায় শিতি, আধুনিক, বা সেক্যুলারপন্থীদের তেমন খোঁজ-খবর নিতে দেখা যায় না। ফলে, এদেশের লোকধর্মীয়-সংস্কৃতি সমাজের তথাকথিত ‘প্রগতিশীল'দের কাছ থেকেও বহু দূরে অবস্থান করে। এভাবে, আমাদের দেশের লোকধর্মীয়-সংস্কৃতির বেগমান ধারাটি একদিকে ধর্মীয় আধিপত্যশীল কট্টর মৌলানা-পুরোহিত আর মতালিপ্সু রাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠনের উগ্র-একমুখি-প্রতাপে, অন্যদিকে তথাকথিত প্রগতিশীলদের সন্দেহপরায়ন, শত্রুসুলভ দূরত্ব রার কারণে তিগ্রস্ত হতে থাকে। হালে, খুব অল্প মাত্রায় হলেও মিডিয়ার বাণিজ্যমুখীন ‘জনপ্রিয়’ সংস্কৃতির ক্ষুধা মেটানোর বদৌলতে লোকসমাজ ও সংস্কৃতির কিছু কিছু ধারার সঙ্গে খুব বিচ্ছিন্নভাবে হলেও ভদ্রলোকেরা পরিচিত হতে পারছে। সেটা ভালো, কিন্তু লোকায়ত সমাজ-সংস্কৃতিকে পূর্ণাঙ্গভাকে অনুধাবন করতে হলে এদেশের মানুষের চলমান জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে তাকে পাঠ করা প্রয়োজন।

মূলত এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাজারগুলোকে আশ্রয় করে লৌকিক ইসলামের ধারাগুলি গড়ে উঠেছে, এর সংস্কৃতি পরিচর্চিত হয়ে চলেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সুদীর্ঘ কালের ঐতিহাসিক পরম্পরায় গড়ে ওঠা সাধু-ফকির-দরবেশদের সমাধিস্থলগুলোই মাজার হিসেবে পরিচিত। লৌকিক-ইসলামের সঙ্গে যুক্ত জনগণ মাজারকে অত্যন্ত পবিত্র আর জাগ্রত ধর্ম-সংস্কৃতির স্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন। লোকায়ত ধর্ম-সাধনার সঙ্গে যুক্ত ওলি-আওলিয়া-বাউল-ফকির-দরবেশগণ মৃত্যুর পর মাজারে শায়িত হন। এই সমস্ত মহৎ ব্যক্তিদের অলৌকিক মতার কথা তাদের ভক্ত-অনুরাগীরা বিশ্বাস করেন, মাজারগুলোকে তাই মসজিদ বা মন্দিরের মতই পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। মাজারে লোকায়ত ধর্ম-সাধনা-বিশ্বাস-আচার-অনুষ্ঠান-উৎসব চলে, সেইসাথে চলে সমাজ-সংসার-ইহকাল-শাস্ত্র-দর্শন-বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলাপ-আলোচনা-বাহাস-তর্ক-বিতর্ক আর গান। লোকধর্মীয় পরিসরে, বিভিন্ন মাজারে শায়িত ওলি-আওলিয়া-ফকির-দরবেশ-পাগলদের ত্যাগ-তিতিক্ষা-সাধনার দৃষ্টান্ত বহু মানুষ অনুসরণ করেন। ফলে, বিভিন্ন স্থানে অধিষ্ঠিত মাজারগুলোতে শায়িত আছেন যে-সমস্ত মহাজন, তাঁরা তাঁদের ভক্তদের পালিত আচার-অনুষ্ঠান-ওরশ-উৎসব তথা লোকসংস্কৃতির মধ্য দিয়ে স্মরণীয় থাকেন। এক একটি মাজারে স্ব স্ব ভক্ত-গোষ্ঠীর মাধ্যমে শুধু তাঁদের পীর-মুর্শিদ- বা গুরুদের স্মরণ করা হয়। এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে ইসলামের লোকায়ত-ধারার সঙ্গে যুক্ত নানা তরিকার মানুষজনের ধর্ম-সাধনার বহুবৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির অসংখ্য সুফি-সাধক-ফকির-দরবেশদের মাজার-আস্তানা-দরবার-খানকা-আখড়া।

এদেশে ইসলাম ধর্মের উন্মেষ ও বিকাশের পেছনে সুফিবাদের প্রভাব ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। স্বনামধন্য গবেষক-পণ্ডিত-অধ্যাপক Richard M. Eaton  তাঁর  Zuvi  The Rise of Islam and the Bengal Frontier গ্রন্থে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। বাংলা সাহিত্যের স্বনামখ্যাত গবেষক-অধ্যাপক এনামুল হকের বঙ্গে সূফী প্রভাব নামক গ্রন্থটিও বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অসংখ্য সুফি-সাধক-ফকিরদের প্রভাবে আমাদের দেশে লৌকিক-ইসলামী ধারাটির প্রাণ-প্রতিষ্ঠা ঘটেছে।

বাংলাদেশের লোকধর্ম ও সংস্কৃতির ধারাগুলি সঙ্কীর্ণতা ও বিধিনিষেধ থেকে বহুলাংশে মুক্ত। কালের পরিক্রমায় এদেশের লোকায়ত ধর্ম-সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে রয়েছে এদেশের বহু পুরোনো ধর্ম-সংস্কৃতির নানামুখী উদার আর সমৃদ্ধ ধারা। বৌদ্ধ সহজিয়া-দেহসাধনা-তন্ত্র-মন্ত্র-হিন্দু-বৈষ্ণব-সনাতনী ধারা আর বাউল-ফকির-সুফিবাদের ধর্ম-সংমিশ্রণে বিকশিত হয়েছে এদেশের লোকধর্ম ও সংস্কৃতির উদার ধর্মসমন্বয়মূলক বস্তুবাদী-ভাববাদী বিভিন্ন ধারা-উপধারা। লৌকিক-ইসলাম আর লৌকিক-হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরে এই সমস্ত লোকায়ত ধর্ম-সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারাগুলো পরিলতি হয়ে থাকে। এছাড়াও ষোড়শ শতকে চৈতন্য প্রবর্তিত উদার মানবিক লোকধর্ম-সংস্কৃতির হাত ধরে পরবর্তী সময়ে এদেশে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক অসংখ্য লোকধর্মের ধারা ল্য করা যায়।

বাংলার লোকায়ত পরিসরে ধর্ম-সংস্কৃতির যে-সুবিশাল ধারা সেটি সম্পূর্ণভাবে গুরুবাদী। কি ইসলামের ডিসকোর্সে, কি হিন্দুর ডিসকোর্সে, এখানকার লৌকিক ধর্ম-সাংস্কৃতিক পাটাতনের ভিত হল গুরুমুখীনতা। এখানে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় ধর্ম চর্চিত হয়ে থাকে। এরূপ গুরুবাদী ধর্ম-পরম্পরার সমৃদ্ধ ধারা অনেক কালের এবং এই ধারাটিও খুবই শক্তিশালী। মধ্যযুগীয় সাহিত্য-পুঁথি-পাঁচালীগুলি আমাদের এই লোকায়ত ধর্মের সমন্বয়মূলক চেহারাটিকে অত্যন্ত স্পষ্ট করে তোলে যেখানে হিন্দুর লৌকিক অবতার কৃষ্ণ অনায়াসে মুসলমানের মুহম্মদে পরিণত হয়, এক আসনে স্থান পায় রাধা-মা-ফাতিমা-মা-কালী।

আমাদের দেশের লোকধর্ম-পরিসরে যার নাম সবচাইতে বেশি করে ঘোষিত হয় তিঁনি হচ্ছেন ফকির লালন সাঁই। তাঁর ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা আর গান এদেশের লোকধর্ম-পরিসরটিকে এক অন্যরকম জাতপাতহীন মানবধর্মীয় ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শুধু লালনই নন এদেশের অসংখ্য লোকধর্মীয় সাধক-গুরু আর গায়েন-গীতিকারদের উদারনৈতিক ধর্মীয়-আচার-আচরন আর গানে সমৃদ্ধ হয়েছে এদেশের লোকধর্ম-সংস্কৃতির এক বিচিত্র-বৈচিত্র্যপূর্ণ উদার পাটাতন। লোকধর্মের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন তরিকাপন্থী সাধক-ফকির-বাউল-ভক্ত-অনুরাগীরা আজো গ্রামবাংলার মাজারগুলিতে-আখরায় অনুষ্ঠিত সাধুসেবায়-ওরশে সমষ্টিবদ্ধভাবে সামিল হন তাদের লোকধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-উৎসব পালন করতে। লোকসঙ্গীতের এক সুবিশাল গতিশীল ধারা এই সমস্ত মাজার আর আখড়াগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে যেখানে বাউল-মুর্শিদী-মারিফতি আর বিচ্ছেদী গানে ঢোল-করতাল-একতারা-দোতারা-মন্দিরার তানে এদেশের লোকায়ত-ধর্ম-সাধনা-সংস্কৃতির পীঠস্থানগুলি মুখরিত হয়ে ওঠে। লোকধর্মের উৎসবে-অনুষ্ঠানে সারা রাত বিভিন্ন স্থ্ান থেকে আগত ও স্থানীয় নারী-পুরুষ গায়েনরা তাদের গান পরিবেশন করে থাকেন। কোথাও কোথাও চলে গানের লড়াইয়ের আসর। লোকধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান উপলে এই সমস্ত মাজারে-আখড়ায় মেলা বসে। লোকশিল্পের নানা নিদর্শনে ভরে ওঠে সেই সব মেলা। শুধু আনন্দ-বিনোদনই নয় নিম্নবর্গীয় মানুষের অর্থনৈতিক লেনদেন চলে এই সব মেলায়। লোকধর্মের এই সমস্ত উৎসবগুলিতে মানুষের সামষ্টিক পদচারণায় এদেশের লোকসংস্কৃতির প্রাণস্পন্দন অনুভব করা যায়।

দীর্ঘদিন ধরে এদেশের নানান মাজারে-আখরায় অনুষ্ঠিত লোক-উৎসবে আমি সশরীরে সামিল হয়েছি, গবেষণার কাজে- কৌতুহল নিয়ে পর্যবেণ করেছি বিভিন্ন লৌকিক ইসলামের ধারাগুলিকে, যেখানে মানুষ ধর্ম-সংস্কৃতিকে তার ঐতিহ্য-পরম্পরায় পালিত বিশ্বাস-আচার-অনুষ্ঠান-উৎসব আর গানের মধ্য দিয়ে এক অন্যরকম মানবতাবাদের জয়গান গেয়ে থাকে। লৌকিক ইসলামের সঙ্গে যুক্ত লালন-পন্থী-ফকিরিধর্ম-সাধক একজন ভক্তের সাাৎকার গ্রহণ কালে আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করি তিনি ইসলাম ধর্মের অন্তর্গত কিনা, তখন তিনি আমায় উত্তর দেন:

... ইসলাম শব্দের অর্থ আমরা সকলেই জানি, শান্তি। ...শান্তি যেখানে আছে, সেখানে ইসলাম আছে। অশান্তিকর কর্ম যেখানে আছে, সেটা ইসলামভিত্তিক হতে পারে না। কারণ আল্লা শান্তির বাইরে না। আল্লা শান্তির ভিতরে। অশান্তি যতটুকু হয় সেটা শয়তানের মাধ্যমে। তাহলে বুঝা গেল আল্লার মনোনীত ধর্ম ইসলাম, এটা সত্য। আর আমার দ্বারা যদি অশান্তিকর কিছু সৃষ্টি হয়ে যায়, আমার দ্বারা যদি কারও কিছু ক্ষতি হয়ে যায়, আমার দ্বারা যদি আমার তি হয় তাহলেই সেটা ইসলাম ধ্বংস হয়ে গেল। কিন্তু একজন হিন্দু এটা করতে পারে কি না। একটা হিন্দুর পে সম্ভব। ইসলাম সে যদি ধ্বংস না করে। তার দ্বারা কারও যদি তি না হয় এবং সে যদি ঐ নিজের তি না করে তাহলে সে ইসলামভিত্তিক বা আল্লার মনোনীত ধর্ম আমল করছে। ...ইসলামের পরিপূর্ণ পন্থাতে আমি আমাকে দাবি করি। (ইউনুস আলী, গ্রাম-কামিনপাড়া, মোহনপুর, রাজশাহী) ।

রাজশাহী শহরের জামালপুরে অবস্থিত ওলিবাবার মাজারে অনুষ্ঠিত ওরশের রাতে লৌকিক ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাধক ও গায়েন ইব্রাহিম চিশতি যখন গেয়ে ওঠেন লোকধর্মসাধক-গীতিকার জালালুদ্দিনের গান “মানুষ থুইয়া খুদা ভজ এই মন্ত্রনা কে দিয়াছে/ মানুষ ভজ কুরান খুঁজ পাতায় পাতায় সাক্ষি আছে”, কিংবা রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর থানার অন্তর্গত কানপাড়ার কালাচাঁদ-বাবার মাজারের ওরশের খোলা মঞ্চে গায়েন আব্দুর রহমান বয়াতি যখন গেয়ে ওঠেন ওরে জীবের যাহা বাঞ্ছা করে, পুরাও বাঞ্ছা সেখানে/বাঞ্ছাপুরা কল্পতরু নাম সকলে জানে।/ ... হিন্দুর হরি মুসলমানের খোদা/দুইয়ে মিশে পথ বলে গো কারো নয় জুদা ...”, কিংবা সাধিকা ছবিলা পাগলী যখন মাজারের ওরশের রাতে ভাবের ঘোরে উন্মত্ত হয়ে নেচে নেচে গেয়ে ওঠেন “ওরে তোমার চরণ পাবার আশা করে/আমি বসে আছি আশার আসরে” অথবা ছেঁউড়িয়ার লালন সাঁইয়ের মাজারে লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে যখন শোনা যায়, আগুন পানি বাতাস দিয়া নূরের আলো জ্বালাইছে/মাটি দিয়া কোরান বানাইছে মওলায়/... মঈনুদ্দিন কয় শুন রে ছোবহান, মানুষ আল্লার সৃষ্টির প্রধান/কালিকলম পাতার কোরান এই মানুষই বানাইয়াছে”,  আর লালনের গানে যখন ভেড়ামারার সোলেমান সাঁইয়ের মাজারের ওরশের রাতের গানের আসরটি জমজমাট হয়ে ওঠে, তখন লৌকিক ইসলাম ও সংস্কৃতির প্রবহমান ধারাটির জীবন্ত চেহারা প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠে।

বর্তমান পৃথিবীতে, ইসলাম ধর্মকে যখন সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত করে পশ্চিমা সমাজ ইসলামের কেবলমাত্র এককাট্টা একটা চেহারা মিডিয়াতে প্রচার করে, সেই সময়ে বাংলাদেশের মত একটি দেশে লোকসমাজের মূলধারায় এক ভিন্নতর উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক আর বৈচিত্র্যপূর্ণ লৌকিক ইসলামের সজীব উপস্থিতি অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ।

ইসলামকে যাঁরা মতা বা রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, তাঁদের সহিংস মনোভাব আর দাপুটে আচরণ এদেশের লোকায়ত ইসলাম ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকসংস্কৃতির ওপর বলপ্রয়োগের রাজনীতি অব্যাহত রাখে। লৌকিক ইসলামের কলন্দরিয়া-পন্থী সাধিকা মোফেলা পাগলী যখন রাজশাহী জেলার টিকাপাড়াস্থ কাশেমের খানকায় অনুষ্ঠিত সাধুসেবায় সামিল হতে এসে ঘটনাচক্রে আমার সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে নীচু স্বরে অত্যন্ত দৃঢ়তা নিয়ে বলে উঠে ‘আমারে এই জগতটা সবসুময়ই শরীয়তীরা পুঁইতে ফেলার চেষ্টা করছে ... ওরা পারবে না’, তখন পাগলীর এই স্বর উপলব্ধি করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। লৌকিক ইসলাম অনুসরণকারী লোকসমাজ যেন প্রকাশ্যে নিজস্ব ধর্ম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচর্চা করতে পারে, তার জন্য উচ্চারিত হওয়া দরকার বৃহত্তর সামাজিক অভয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নয়। নিরাপত্তার নামে রাষ্ট্রের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক হস্তপে গোটা সমাজেরই সর্বনাশ ডেকে আনবে, একথা মনে রাখাও খুব জরুরী।

বর্তমান সময়ের একদিকে রয়েছে পুঁজিবাদী-বাজার-সংস্কৃতির প্রবল দাপট, যা মানুষকে সকল প্রকার মানবিক সম্পর্কের যৌথতা থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন করে কেবল ভোক্তা আর ক্রেতায় পরিণত করে চলেছে, আর অন্যদিকে রয়েছে ধর্মীয় উগ্র-মৌলবাদের কূপমণ্ডুকতা, যা কেবল অন্ধকারের দিকেই টেনে নিয়ে যায় মানুষকে। আর এদের মধ্যে ভারসাম্য রা করার জন্য আছে রাষ্ট্র। এসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে এদেশের নিম্নবর্গীয়-প্রান্তিক লোকগোষ্ঠীর সমষ্টিগত চেতনায় উৎসরিত ও লোক-পরম্পরায় পালিত মানবতাবাদী-সমন্বয়মূলক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোকধর্ম-সম্প্রদায় ও এর লোকসংস্কৃতিকে ভালভাবে চিনে নেয়া আমাদের কর্তব্য বৈকি।  

তথ্যসূত্র:

                                           

মুহম্মদ এনামুল হক, “বঙ্গে ‘লৌকিক ইসলাম’-এর উদ্ভব”, রায়হান রাইন সম্পাদিত বাংলার ধর্ম ও দর্শন (২০০৯) ঢাকা: সংবেদ প্রকাশনা, বাংলাবাজার।

রিচার্ড এম ইটন(২০০৩), “বঙ্গীয় মুসলিম কাহারা- বাংলার ধর্মান্তর এবং ইসলামিকরণ সম্পর্কে কিছু কথা”  (মইনুল হাসান সম্পাদিত মুসলিম সমাজ এবং এই সময়, কলকাতা: ন্যাসনাল বুক এজেন্সি।

অয় কুমার দত্ত (১৪০৯ বাং)। ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়। কলকাতা: করুণা প্রকাশনী।

পল্লব সেনগুপ্ত (২০০১)। পূজাপার্বণের উৎসকথা। কলকাতা: পুস্তকবিপণি।

গৌতম ভদ্র (১৯৯৪)। ইমান ও নিশান। কলকাতা: সুবর্ণরেখা।

অনুপম হীরা মণ্ডল, “ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের লোকধর্ম দয়াময় সম্প্রদায়”, (উৎপল বিশ্বাস (২০০৮) সম্পাদিত গণমুক্তি পত্রিকার লোকধর্ম সংখ্যা, ২০০৮, সংখ্যা-৯, ঢাকা: গণমুক্তি সংস্কৃতি পরিষদ।) 

যতীন সরকার, “বাঙালির লৌকিকধর্মের মর্মান্বেষণ” (উৎপল বিশ্বাস (২০০৮) সম্পাদিত গণমুক্তি পত্রিকার লোকধর্ম সংখ্যা, ২০০৮, সংখ্যা-৯, ঢাকা: গণমুক্তি সংস্কৃতি পরিষদ।)

যতীন সরকার, “বাঙালি সমাজে লোকধর্মের প্রভাব”( শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত ফোকলোর বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা, ২০০৮, পৃ-৭১-৭৬, ঢাকা: বাংলা একাডেমী। )

Schoemaker, George H. (ed.) (1990), The Emergence of Folklore in Everyday Life. Bloomington: Trickster Press, Indiana. p- 62.

Frazer, James G. (1922). The Golden Bough: A study in Magic and Religion. London: Macmillan.

Wikipedia (2010), “Folk Christianity”, http://en.wikipedia.org/wiki/Fol k_Christianity

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের যুগপূর্তি-উৎসবের অংশ হিসেবে আয়োজিত সেমিনারমালার একটি অধিবেশনে পঠিত প্রবন্ধ। ডিসেম্বর ১২, ২০১০

এ আজব হাওয়াই ঘুড়ি; উড়ছে হাওয়ায় শূন্যে সখা

বিধান সাহা

                           আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী

                                                তুমি থাক সিন্ধু পাড়ে ওগো বিদেশিনী

সপ্তপদীর তিনতালার ভাঙ্গা কার্নিশ ধরে নিঃঙ্গতার বিপরীতে হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে আমার এ নিরস কণ্ঠের উন্ন্যাসিকতা। হাওয়ায় অবশ্য আরো উড়ছে কড়া লিকার কড়া মিষ্টি মিশ্রিত চা-সিগ্রেটের ধোঁয়া, কাঠ মিস্ত্রীর খট খট শব্দের শিল্পীত অনুবাদ, অসংখ্য মানুষের উচ্চারিত খণ্ড খণ্ড শব্দের কোরাস। সব মিলিয়ে একটি কবিতা। তাৎনিক কবিতা। কবিতার কথা মনে হতেই কোত্থেকে এক উড়নচণ্ডি ব্যাকুলতা এসে দাবি জানালো কবিতার। স্মৃতির তল্লাটে ঢুঁ মেরে খুঁজে চলছি কবতা ; শব্দ। আবৃত্তি হলে ভালো হতো কিন্তু আবৃত্তি আমাকে দিয়ে হয়না। তবে কেউ আবৃত্তি করলে বাধ্যগত ছাত্রের মতো নিবিড় মগ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই প্রতিবার। ক্রমাগত মগ্নতার বৃত্ত ভেঙ্গে ভেঙ্গে আমি ছুটে যাচ্ছি আরো মগ্নতার দিকে, কবিতার খোঁজে। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম আমার ভাবনা জুড়ে কবিতা নেই আর। ভাবছি মহাজাগতিক কথা। ভাবছি বিজ্ঞান, ‘টাইম মেশিনে করে মানুষ অতীতে ফিরে যেতে পারেনা কেন, কখনও পারবে? কোথাও কি অজ্ঞাতসারে কেউ হরদম ইচ্ছেমাফিক ঘুরে আসছে অতীত থেকে? আমরাও কি পারবো কোন একদিন? সেই মেঠোপথ, বটগাছের নিচে বসে স্কুলের প্রথমপাঠ, ঘুমহীন পুরো দুপুর মায়ের দস্যি ছেলে হয়ে পুরোটা বাড়ী মাতিয়ে রাখা, সেই নদী, দলবেঁধে ডুব-সাঁতার, আমাদের রাখাল ভজনের কাঁধে চড়ে পাড়াময় টো-টো করে বেড়ানো, সন্ধ্যার আগে আগে দলবেঁধে পলানটু, গোল্লাছুট, বৌচি খেলার ধুম। সেই সব বহু রঙের দিন গুলোতে ফিরে যাওয়া যাবে? অথবা ‘এ শহরে এতো এতো জায়গা থাকতে এখানে কেন? বসার মতো আর কি কোন জায়গা ছিলনা? আগে যেমন হান্নানের বই’র দোকান, বাচ্চুর চা’র দোকান, পোস্ট অফিস মোড়ে নিকুঞ্জর চা’র দোকান, খোকন পার্ক, এ্যাডওয়ার্ড পার্কে বসতাম। এখন তত টানেনা কেন? কবিতার সাথে কি এর কোন সম্পর্ক আছে? অর্থাৎ কোথাও আমি তৃপ্ত হতে পারছি না কেন? অথচ একটা সময় কী দূর্দান্ত ভালোলাগা ছুঁয়ে যেত। এই ছুটে চলা কেন? কিসের জন্য?

না! আমার আর কবিতার কাছে যাওয়া হলো না শেষ পর্যন্ত। স্মৃতি মাঝে-মধ্যে আমার সাথে বড় বেশি বিমাতা সুলভ আচরণ করে। হঠাৎ হঠাৎ কী যেন বলতে চাই। কী যেন খুঁজে চলি। কিন্তু আমার সেই বলতে চাওয়া শব্দ, বলতে চাওয়া বাক্য শেষ পর্যন্ত আর বলা হয়না। সেই খুঁজে চলা জিনিসটা শেষ পর্যন্ত আর পাওয়া হয়না। সে অধরা। সে-ই আমার অব্যক্ত, অতৃপ্ত সার্থক কবিতা।

০২.

                                            তুমি তা জানোনা কিছু- না জানিলে

                                         আমার সকল গান তবু তোমারে লক্ষ্য করে;

                                                                                 জীবনানন্দ দাশ

শৈবাল ভাল আবৃত্তি করে। আমার বন্ধু। শৈবালকে পেলে খুব ভাল হতো এসময়। আবৃত্তির সাথে গানের দিক দিয়েও কম যায় না। কণ্ঠের সাথে তাল, লয়, সুরের সংমিশ্রন অপূর্ব। কখনও কখনও ওর কথাগুলোকেও আমার আবৃত্তি মনে হয়। বসে আছি। গভীর মনযোগের সাথে তাকিয়ে আছি- শূন্যতায় ভেসে যাচ্ছে সিগ্রেটের ধূসর ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার মধ্যে বিপ্তি ভাবে ভেসে উঠছে বিচ্ছিন্ন সব চিত্রভাষা। কখনও মানচিত্রের বিকৃত রুপ, পশু-পাখি, মেঘ-ফুল, গতকাল ফুটপাতে দেখা পাগলটার মতো অদ্ভুত দাড়িওয়ালা পোট্রেট। হঠাৎ সমস্ত চেতনায় ছেদ ঘটিয়ে একটি কোমল হাত আমার পিঠ স্পর্শ করে। তাকিয়ে দেখি শৈবাল, সাথে একটি মেয়ে।

কী দাদা, একা একা।

শৈবালকে আমি বন্ধু ভাবি বয়সের বিভেদটাকে ছুটি দিয়ে। ও সে কারণেই আমাকে দাদা ডাকে।

এই যে বসে আছি।

ওরাও আমার মুখোমুখি বসে পড়ে নির্দ্বিধায়।

‘ও প্রতিমা। আমার বন্ধু।’ পাশের মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘ও আচ্ছা’ ছাড়া মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ঐ মুহুর্তে আর কিছু বলার মতা আমার ছিলনা।

ও ভাল গান, কবিতারও নিমগ্ন পাঠক।

‘তাই! আজ তাহলে জমবে ভাল।’ বললাম বটে! কিন্তু এবার আর মেয়েটার মুখের দিকে তাকানোর সাহসও হলোনা আমার। কেন? আমি তখন মতা হারানোর তাৎনিক বেদনায় ছটফট করছি। সেই অপলক মায়াভরা লাজুক দৃষ্টির কী এমন মতা ছিল যে, আমার দৃষ্টি সমান্তরাল দাঁড়াতেই পারলো না? তাহলে আমি কী মেয়েটার সঙ্গে গোপন অথচ প্রচণ্ড মতা সম্পন্ন অপ্রাসঙ্গিকতায় জড়িয়ে ফেলছি নিজেকে? পৃথিবীতে এতো এতো সুপ্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সেই অপ্রাসঙ্গিকতার প্রসঙ্গেই বা আমি কতটুকু বুঝি?

... বুঝি তো অনেক কিছু। কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে গেলে আমি কী বলবো! আমি জানি, নিশ্চিত করে আমি কিছুই বলতে পারবো না।

আবারও কবিতা। সত্যিই কি কোন কবিতাকে আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো? তা হোক না খেয়ালে-বেখেয়ালে অথবা একটা ঘোরের মধ্যে আমার হাত থেকেই জন্ম নেয়া। কবিতা তো প্রতিমার সেই চোখের মতো, অনুভব্যতার গভীরে গিয়ে প্রতিনিয়ত ষষ্ঠেন্দ্রিয়কে চুমু দিয়ে উড়ে যায় হাওয়াদের বন্যদেশে।

০৩

একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য নিরবতা চলল। এই নিরবতার মাঝে ওরা দু’জনও সম্ভবত নিজস্ব চিন্তাবৃত্তে জমাচ্ছিল খণ্ডকালীন অভিজ্ঞতা অথবা ওদের মতো আমিও হয়ত এক অজ্ঞাত অস্থিরতা থেকে মুক্তি খুঁজছিলাম!

শৈবাল, এবার কবিতা শুনতে চাই। যে কবিতাতে খুঁজে পাওয়া যাবে অনুভব্যতার নিবিড় আস্বাদন। আমাদের প্রতিদিনের বহুবর্নিল কথকতা, বর্তমানের উপস্থিতি, আমাদের ভালোবাসা, ঘৃণা, ক্রোধ, অভিমান, আমাদের সমস্ত পিছুটান। যে কবিতায় ডুব দিয়ে আমরা কুড়িয়ে আনব ভালোলাগার প্রাচীন প্রবাল।

‘আবু হাসান শাহরিয়ারের বালিকা আশ্রম-০২ কবিতাটি পড়ছি আমার ভালোলাগাকে বিচারক বানিয়ে।’

নটে গাছ মুড়ালেও জানি

আমাদের গল্প ফুরাবে না

দিনভর কড়ইয়ের পাতা

গুড়ি গুড়ি কথোপকথনে

বাতাসে ওড়াবে রূপকথা                    বাঁচো

কে এক বালিকা নাকী পাখি

পালকে পালকে ছিল ঢেউ

আজও সেই ঢেউয়ের পালকে

কবিতার খাতা ভরে ছবি

আঁকি আর বালিকাকে ডাকি                আছো?

নিখুঁত উচ্চারণ আর দরদী কণ্ঠের মুগ্ধতায় বার বার বিমোহিত হচ্ছিলাম। খেয়াল করে দেখলাম প্রতিমাও বেমালুম ডুবে গেছে কবিতার গহীন আবেগের কাছে আবৃত্তির সাথে সাথে ওর চোখে প্রচণ্ড বিস্ময়ের আবহাওয়া খেলা করছে, কপালে ভাঁজ পড়ছে, মাথা দুলছে সাথে শরীরও খানিকটা। ভাবছি, কয়েকটি শব্দবন্ধের মতার কথা আর আশান্বীত হচ্ছি। যদি কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি পংক্তি মানুষের শরীরকে দুলিয়ে দিতে পারে; তাহলে নিশ্চয়ই... নিশ্চয়ই একদিন...

০৪

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝমঝম শব্দের মূর্চ্ছনায় পৃথিবী প্লাবিত হচ্ছে। এর মাঝেই কিছু মানুষ জীবিকার তাগিদে ছুটছে এদিক-সেদিক। আহ! বৃষ্টি এই ভ্যাপসা গরমে কোন অজ্ঞাত দেশ থেকে নেমে এলে!

‘প্রতিমা এবার তোমার কণ্ঠে শুনতে চাই।’ যেন অপ্রসঙ্গিক বিষয় উপস্থাপন করে ফেললাম, যেন হঠাৎ করে বজ্রপাত, তাল-লয়ে ছেদ। প্রথম দিকে কিছুটা সংকুচিত হলো। লজ্জা মাখানো চিরায়ত মেয়েলী ঢংয়ে বললো,‘আমিতো ভাল আবৃত্তি করতে পারিনা। পড়তে পারি।’

‘তারপরও শুনতে চাই।’ এবার আমার এই স্বল্প সময়ের পরিচিত মেয়েলি স্বভাবের প্রতীমা কী করে যেন হঠাৎ নারীতে পৌঁছে গেল। না, না নারী না। পূর্ণ মানুষ হয়ে গেল। জড়তাহীন কণ্ঠে বলে বললো, ‘নবনীতা দেবসেনের পানি গ্রহণ কবিতার কিছুটা পড়ছি- ’

কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে

এ মুহুর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো।

শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত

স্বজন। এই হাত, এই নাও হাত।

এই হাত ছুঁয়ে থাকো, যতণ

কাছাকাছি আছো, অস্পৃষ্ট রেখো না।

ভয় করে। মনে হয়, এ মুহুর্ত বুঝি সত্য নয়।

যেমন অসত্য ছিল দীর্ঘ গতকাল

যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী।

আমি তখন প্রতিপর্বে বিভক্ত হয়ে বিস্ময়ের ঘেরাটোপে বন্দী। কী দারুণ স্বত:স্ফুর্ত ভাবে আবৃত্তি করে গেল। একেবারে নিঃসংকোচে, নিঃসংশয়ে। মেয়েরা বুঝি এভাবেই প্রতিভা লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে! আর এই কবিতা; এটা কি আমাকে উদ্দেশ্য করে, নাকি শৈবাল? কিন্তু এটা তো আমার কবিতা, আমার জন্য লেখা। আমি তো মনে মনে এ কথাগুলোই বলতে চাইছিলাম। আমার ভালোলাগা কবিতাটা ওরও ভাল লাগলো কেন? এটাই বুঝি কবিতার সার্বজনীনতা!

০৫

এই অবেলায় আমার বুকের মধ্যেও যে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝড় হচ্ছে। এক মন বালিকার জন্য ভিজে যাচ্ছে হৃদয়ের পূর্ণাংশ, কেউ কী তা জানে? জানে না। শহরের রাস্তায় নিজস্বতা আর বেখেয়ালীপনা রেখে বৃষ্টি চলে গেল। কোন কোন দেয়াল তা স্বীকার করে নিচ্ছে নন্দনতত্বের বাহারি কলতানে।

হঠাৎ টোরিয়েডর-১ রিংটোন নিয়ে বেজে উঠল শৈবালের মোবাইল ফোনটা। ‘হ্যালো’। শৈবালের চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে ঝরে পড়ছিল দুপুর রোদের বিরক্তি।

বুঝলাম ঘরে ফেরার তাড়া হয়তো। অথবা ... অথবা দীর্ঘ কোন পিছুটান। অনেকটা সময়ও যে আমরা পার করে এসেছি এই মাত্র বুঝলাম। মেঘলা দিনের মতো গম্ভীর মুখ করে বললো, ‘আজ উঠতে হবে।’ বহুদিন পর ওর মুখে সেই পুরণো ঢং। সেই শিশুতোষ অভিমান। ওরা চলে যাবে। শুধু আমি একা একা নিঃসঙ্গতার বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে বিশ্বাস রা করে যাব আজন্ম। এক অজানা হাহাকারে কেঁপে উঠলো বুকটা। প্রতিমার মুখের দিকে এক পলকের জন্য চাইতেই ও বললো, ‘দাদা, অন্যদিন অনেক সময় ধরে আড্ডা দেয়া যাবে। সেদিনও সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে উঠে কবিতাতে প্রধান্য দেব হৃদয়।’

শেষ সৌজন্যতা দেখিয়ে ওরা চলে যায়। আমাকে পেছনে রেখে ক্রমাগত দূরত্ব বাড়ায়। এক সময় আমার দৃষ্টির সীমাকেও অতিক্রম করে যায়। হঠাৎ সব কিছুকে স্তব্ধ করে দিয়ে আকাশ-পাতাল, গ্রহ-নত্র, জীবন-দর্শন, সমস্ত বাধাঁকে উপো করে বুকের মধ্যে প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে কে যেন বলে গেল-

দৃশ্যের পেছনেও কিছুটা দৃশ্য থেকে যায়

তার পেছনে আমি

            এবং এক একটি

                      দীর্ঘশ্বাস...

যেসব গল্পের কাছে আজো মাঝে মাঝে যেতে হয় একা ...                                   

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

১।

সেদিন একবন্ধুর সঙ্গে এক টেলি-আলোচনাই আমাকে শেষ পর্যন্ত উৎসাহিত করলো এই লেখাটি নিয়ে বসতে। আলোচনা শুরু হয়েছিল কিছু কিছু ছোটগল্পের চলচ্চিত্রায়ন-সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু একটু পরেই ঘুরেগেলো কার কি ছোটোগল্প পছন্দ, সেদিকে।

প্রিয় গল্প, প্রিয় লেখা বলতে আমি যা বুঝি তা এই, যে, যে লেখাগুলোর দিকে করনে অকারনে বারবারই ফিরেযায় মন,সাধ হয় আবারো পড়তে...কখনোবা হাতে পেলেও না পড়ে নিছকই হাতেনিয়ে বসে থাকতে,ওল্টাতে পাল্টাতে,ফিরে ফিরে ভাবতে...তাই এখানে যে গল্পগুলোর কথা আমি লিখেছি সেগুলো কোনোভাবেই সেই লেখকজনের শ্রেষ্ঠগল্প না’ই হতেপারে...এগুলো শুধু আমারি প্রিয়গল্প মাত্র...সুতরাং এই তালিকার নিরিখে কোনো লেখককে বা কোনো দেশের,কোনো ভাষার সাহিত্যকে বিচার করতে গেলে তা হবে সেই লেখকের বা ভাষার সাহিত্যের প্রতি চুড়ান্ত অবিচার...আর লিখছি না একজন গল্পকারের কথা – তিনি সত্যজিৎ রায় কেননা তাঁর প্রতিটি গল্পই আমার প্রিয়গল্প...প্রায় বিভুতিভূষনেরই মতো...

        তালিকাটি বা তার প্রসংগে যাওয়ার আগে আরেকটি কথাও বলে নেওয়া দরকার যে এই তালিকাটিও একটি বিশেষ সময়ের, আমার বিশেষ বয়সের একটি খতিয়ান।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অদল বদল, অন্ততঃ কিছুদূর,ঘটাই স্বাভাবিক ঠিক যেমন এই তালিকা মিলবেনা আমারি দশ বছর আগে বানানো তালিকার সঙ্গে।

২। 

   

   যদিও একান্ত নিজস্ব এই তালিকা তবুও ভাবতে যতোটা সহজ মনে হয়েছিল কার্য্যত ব্যপারটা ততো সহজ হলোনা।যে গল্পগুলোর কথা মনেপড়ে শুধু সেগুলোর নাম লিখতে বসে দেখি মনে আসছে আরো অনেক নাম...আবার টেরপাচ্ছি ভুলেও গেছি,যাচ্ছি অনেকগুলি নাম ... যেমন বহুআগে,সেই ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়া গল্প একটা, ‘চুক আর গেক’,প্রগ্রেস না’কি রাদুগা’র প্রকাশিত,রাশিয়ান থেকে বাংলায়,সেই লেখাটা আমাকে ঘিরে রয়েছে আজো...দুটো ভীষন দুষ্টু বাচ্চা মা’র সাথে যাবে পাহাড়ে, যেখানে তাদের বাবা কাজ করেন ...কিন্তু গিয়ে দেখবে বাবার ‘কোয়ার্টার’ তালাবন্ধ... তালাবন্ধ আশেপাশের আর সব ‘কোয়ার্টার’গুলোই...তারপর?...বরফে ঢাকা সেই ভয়াল নির্জনতার গহনে কাটবে তাদের প্রায় এক সপ্তাহ,তারপরে সদলবলে ফিরে আসবেন বাবা...এইগল্প,প্রায়ই মনেপড়ে টুকরো টুকরো ছবিগুলি, সেই দুষ্টু ‘চুক আর গেক’এর, আবছা মনেপড়ে তাদের সকাল,বিকাল,দুপুর,সন্ধ্যা...কিন্তু পূরোপুরি ধরাদেয় না তারা...এতোদিন,এতোবছর ধরে যখন নিয়তই মনেপড়ে অতএব এটা নিশ্চয়ই আমার প্রিয়লেখা...কিন্তু কে লিখেছিলেন?লেখাটা গল্প ছিল না উপন্যাস...মনেপড়েনা আর কিছুই...বরং গল্পটির ছায়ার আবডালে উঁকি দিয়ে যায় আমাদের সেই ছোটোবেলা...ডিসেম্বর-জানুয়ারীর শীত,মিউনিসেপালিটির মাঠে মেলা, ‘নেতাজীমেলা’...সেখানেই আসতো রাশিয়ান বইএর দোকান ‘ভস্তক’...মার হাতধরে সেই মেলায় বেড়াতে যাওয়া...সন্ধ্যাবেলা...যেন উৎসব...কোনোদিনবা দুপুরে,ইস্কুল পালিয়ে ঘুরে বেড়ানো মেলায় গিয়ে...সংগে তখনকার একমাত্র বন্ধু মনিময়...

 মনেপড়ে ‘গল্পগুচ্ছ’ আর ‘বিভূতি রচনাবলী’ প্রথম পড়বার দিনগুলি রাতগুলি... ‘গল্পগুচ্ছ’র সবগুলি খন্ড আমাদের বাড়িতে ছিলনা।সম্ভবতঃ রামকৃষ্ণ মিশনের ছোটোদের লাইব্রেরী থেকে এনে পড়েছিলাম...‘বিভূতি রচনাবলী’র প্রায় সবগুলোই ছিলো বাবার বইএর আল্মারিতে...পড়তে আরম্ভ করেছিলাম কোনোএক গ্রীষ্মের ছুটিতে।শুরু করেছিলাম ‘পথের পাঁচালী’ দিয়েই...তবে তারপরে অন্য সমস্ত উপন্যাস,গল্প,তাঁর দিনলিপি,সমস্তই গিলতে আরম্ভ করেছিলাম গোগ্রাসে... গিলতে আরম্ভ করেছিলাম আর এক সম্পূর্ন নুতন পৃথিবীর গহনে পুন্র্জন্ম হচ্ছিল আমার...।সম্পূর্ন নুতন পৃথিবীর সন্ধান রবীন্দ্রনাথের গানে পেলেও তাঁর গল্পে, যেসব গল্প, তাঁর,আমার এতাবৎ অতিপ্রিয় সেগুলোতেও পাইনি,আজো পাইনা...আজো যখন তালিকায় বিভুতিভূষনের নাম লিখলাম তখনো ভাবলাম ভুলহচ্ছে কেননা বিভূতির প্রতিটি গল্পই আমার ‘প্রিয়তম’ গল্প, বিভূতির প্রতিটি রচনাই আমার ‘প্রিয়তম’ গদ্য।রবীন্দ্রনাথের কাছে পেয়েছিলাম মন্ত্র আপনার গহনের দিকে চেয়ে থাকার,চেয়েদেখার ‘ও আমার আপন হৃদয় হগন দ্বারে বারে বারে’ তে আর বিভূতির কাছে পেলাম তারি প্রত্যক্ষ সন্ধান...

    রবীন্দ্রনাথের গল্প মর্মে এনেদেয় এক সজলতা...মানুষের প্রতি,তার অসহায়তার প্রতি নত হয় মন আর বিভূতি ঐখান থেকে মনকে নিয়ে পাড়ি জমান সেই দেশের দিকে, প্রকৃতই যেখানে ভ্রমর বিবাগী হয় ‘নিভৃত নীল পদ্ম লাগি...কোন রাতের পাখি গায় একাকী সংগীবিহীন অন্ধকারে...’...গল্পগুচ্ছের গল্পগুলি থেকেও আমার প্রিয় রবীন্দ্রনাথের লিপিকার ‘গদ্য’ গুলি।সে গুলোর অবয়বে গল্পের ইংগিত আছে যা নেই তা হচ্ছে চরিত্রের উপস্থিতির ভার।তাই এরা গল্পের সীমারেখা অতিক্রম করে গিয়ে ছুঁয়ে দিতে চায় যেন কবিতার দিগন্তকেই... ‘সুয়োরানীর সাধ’, ‘কর্তার ভূত’, ‘বিদূষক’, ‘তোতাকাহিনী’ সবই আমার অতি প্রিয় ‘গদ্য-কাব্য’।

২।

     প্রেমের,মানব-মানবীর জাগতিক প্রেমের ছোটোগল্প বললে আমার অদ্যাপি প্রথমেই মনেআসে রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’, ‘পুনরাবৃত্তি’,বিভূতির ‘কুয়াশার রঙ’ আর ‘মেঘমল্লার’...তারপরে দস্তয়ভস্কির ‘White Nights’,চেকভের Late Blossoms যা Late Blooming Flowers নামেও অনুদিত।পরে পড়েছিলাম বিমল করের ‘সুখ’, সতীনাথ ভাদুরির ‘চকাচকি’...নানা ভাষায় নানান স্বাদের প্রেমের গল্প পড়েও, আজো আমার মনেহয় ঐগুলিই আমার পড়া শ্রেষ্ঠ প্রেমের গল্প...না থমাস মানের ‘ডেথ ইন ভেনীস্‌’ বা প্রেমের উপন্যাস হিসাবে ‘Wuthering heights’ বা ‘Farewell To Arms’ যে আমার মন্দ লেগেছে এমন নয় তবে প্রেমের গল্পের টানে ঐগুলির কাছে আর কোনোদিন যাবোনা বলেই মনেহয়...বরং প্রেমের উপন্যাসের টানে অপু-লীলার কাছে ফিরে গিয়েছি বারবার,যাবো বারবার ‘দৃষ্টি প্রদীপে’র কাছে, ‘অথৈজল’ বা ‘বিপিনের সংসার’এ...যাবো ‘Doctor Zhivago’ র কাছে...

    মানব-মানবীর জাগতিক প্রেমের অন্য রকমের গল্পও আমি প্রথম পড়ি রবীন্দ্রনাথেই আর ঐখানেই তাঁকে ঘিরে আমার বিস্ময় অদ্যাপি...’একরাত্রি’র মতো নিটোল প্রেমের গল্পের লেখক যখন লিখেন ‘মনিহারা’ বা ‘নিশীথে’ আমি টেরপাই বিমর করের ‘জোনাকি’ বা ‘পিঙ্গলার প্রেম’ এর তিনিই উত্তরসূরী...

বিভুতিতে মানব-মানবীর জাগতিক প্রেম সততই যেন পারহয়ে যেতেচায় তাদের মর্ত্যসীমাকে।ফলে তাকে আলাপে-বিস্তারে, ক্রমে যেতেহয় অন্তরার দিকে।কিন্তু ছোটোগল্পে ঐ ভাগগুলি তেমন স্পষ্ট হতে পারেনা বলেই বোধহয় বিভূতির ছোটোগল্পে মানব-মানবীর জাগতিক প্রেম হয়ে ওঠেনা কেন্দ্রবিন্দু।অথচ তাঁরি উপন্যাস ‘অথৈজল’ বা ‘বিপিনের সংসার’এ মানব-মানবীর জাগতিক প্রেমই পায় অনন্য অবয়ব...ঐরূপ ‘প্রেম’,রবীন্দ্রনাথের গল্পে ফিরে আসে বারম্বার কিন্তু উপন্যাসে, আমার তো মনেহয়,’গোরা’য় বিনয়-ললিতা ভিন্ন আর কোথাও নেই।

                       আমার এতাবৎ পঠিত আরেকটি অদ্ভুত প্রেমের গল্প ‘The Dearly Beloved of Benjamin Cobb’। এই ঘরানায়, এই রকমের কাহিনীযে এই প্রথম, এমন নয় কদাপি।বহিরঙ্গের দজ্জাল বউর অন্তঃসলিলা প্রেম,তার স্বামীর প্রতি,তা কোনো সাহিত্যেই নয় নুতন কিছু।কমল কুমারের ‘খেলার বিচার’ এর অসংখ্য মাত্রার মধ্যে এ’ও একটি মাত্রা।তথাপি ‘Dearly Beloved...’ গল্পটিতে কাহিনীর উপস্থাপনের ভংগী,তার অন্তর্গত সরলতা আমাকে মুগ্ধ করে।এই গল্পটি প্রথম পড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পাঠসময়ের শেষের দিকে।অর্থাৎ প্রায় পনেরো বছর আগে ১৯৯৫-৯৬ সালে। তারপরে প্রায়শই ভেবেছি গল্পটি নিয়ে, নানা ভাবে, নানা সময়ে। বছর তিনচার আগে সংকলনটি পেয়েযাই এক পুরনো বইএর দোকানে।ওই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আরেকবার পড়েনিই গল্পটি আবার, একশ্বাসে আর আশ্চর্য্য এই যে এবারো লেখাটি পড়ে তেমনি বিমুগ্ধ হয়ে যাই...

মানব-মানবীর জাগতিক প্রেমের গল্প ঠিক না হলেও আরো দু’টি গল্প,যারা আমার ভাষায় ‘প্রেম কে নিয়ে গল্প’ যা মূলতঃ হিংস্রতার আড়ালেও জীবনানন্দের গল্পগুলির একটি মূল ‘ভাব’,তেমন ধারার গল্পের মধ্যে  Andre Gide এর ‘Isabelle’ আর  Pushkin’ এর ‘The Queen Of Spade’ গল্পদুটি পড়ে দেখতে বলবো পাঠককে।

 

৩।

পছন্দের গল্পের এই তালিকাটি উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে আরো একটা ভাবনা এলো মনে।

          একজন লেখকের মধ্যে,যাকে বলে ‘integrity’ তার সন্ধানের পূর্বশর্তটি হলো খুঁজেদেখা তাঁর রচনার কোনো ‘মূলসুর’ রয়েছে কি’না আদৌ...ঐ ‘মূলসুর’টিকে আমি বলি ‘ধ্রুবপদ’।প্রকৃত শ্রষ্টাজন ঐ সুরটিকে ঘিরেই আবর্তিত হতে হতে,নিজের অজান্তেই এগিয়ে যান আপনার সৃষ্টির সম্পূর্নতার পথে আর সত্য এই,যে,সমস্ত প্রকৃত শ্রষ্টার গহনের ঐ ‘ধ্রুবপদ’টিকে চিনেনিতে বেগ পেতে হয়না প্রকৃত পাঠকের।‘সন্ধ্যা সংগীত’ এ যা ছিল ‘আলাপ’ তা’ই, ক্রমে বিস্তারিত হয়ে ‘নৈবেদ্য’ হয়ে, ‘গীতাঞ্জলী’, ‘গীতালী’ হয়ে ‘প্রান্তিক’, ‘আরোগ্য’, ‘শেষলেখা’ ...আরম্ভে যা ছিলঃ

‘অয়ি সন্ধ্যা , তোরি যেন স্বদেশের প্রতিবেশী /তোরি যেন আপনার ভাই /  প্রাণের প্রবাসে মোর দিশা হারাইয়া / বেড়ায় সদাই । /শোনে যেন স্বদেশের গান , / দূর হতে কার পায় সাড়া / খুলে দেয় প্রাণ । / যেন কী পুরোনো স্মৃতি / জাগিয়া উঠে রে ওই গানে । / ওই তারকার মাঝে   যেন তার গৃহ ছিল , /হাসিত কাঁদিত ওইখানে । / আরবার ফিরে যেতে চায় / পথ তবু খুঁজিয়া না পায়’

তা’ই শেষে হলোঃ তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি /বিচিত্র ছলনাজালে , /হে ছলনাময়ী । /মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে /সরল জীবনে । /এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত ; /তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি । /তোমার জ্যোতিষ্ক তারে /যে-পথ দেখায় /সে যে তার অন্তরের পথ , /সে যে চিরস্বচ্ছ , /সহজ বিশ্বাসে সে যে /করে তারে চিরসমুজ্জল । /বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু , /এই নিয়ে তাহার গৌরব । /লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত । /সত্যেরে সে পায় /আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে । /কিছুতে পারে না তা ' রে প্রবঞ্চিতে , /শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে /আপন ভান্ডারে । /অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে /সে পায় তোমার হাতে /শান্তির অক্ষয় অধিকার ...’

মানুষ যে অনাদি,অনন্ত, তার যাত্রা যে বিশ্ব থেকে মহাবিশ্বের মহাদিগন্তের দিকে সেই অনুভবের উচ্চারনেই ‘সন্ধ্যা সংগীত’ এর আরম্ভ আর মহামানবের সেই মহাদেবতা,যার পানে এই অন্তহীন যাত্রা আমাদের, তাকেই প্রনাম করে ‘শেষলেখা’র সমাপ্তি...

    সেই একই সত্য পুনরাবিষ্কৃত দস্তয়ভস্কি’তে,টলস্টয়’এ।আধুনিক কালের জন্য একটি ‘বাইবেল’ রচনার প্রয়োজনের প্রেরনায় দস্তয়ভস্কি’কে একের পরে এক প্রচেষ্টা নিতেহয় এক যুগোপযোগি ‘ক্রাইষ্ট’ নির্মাণের...রাস্কল নিকভ হয়ে,প্রিন্স মিশকিন হয়ে তিনি এসে যখন পৌঁছান ‘ব্রাদার্স্‌ কার্মাজভ্‌’ এ,তখনি ঘটে তাঁর অকাল মৃত্যু।একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি টলস্টয়’এ’ও।একটিই মানুষের গমন-গল্পের একেকটি স্তর যে পিয়ের,লেভিন,নেক্লুদভ তা অনুভব করতে খুববেশী কূট-পাঠক-প্রতিভার প্রয়োজন পড়েনা।

  এমন আরো অসংখ্য উদাহরন দেওয়া যায় এখানে। তবে আর বেশী উদাহরনে না গিয়ে এবার বলি আমার ধারনাটির কথা...লেখকের ‘integrity’ নির্ণয়ের নিয়মে নির্ণয় করা যায় কী পাঠকেরো ‘integrity’? প্রকৃত পাঠকের পাঠ-তালিকাও কি আবর্তিত হয় এমনি কোনো ‘ধ্রুবপদ’কে কেন্দ্র করে? উত্তরের সন্ধানে আমার এই তালিকাটিকেই যদি নিই গিনিপিগ হিসাবে...যদি এখান থেকে ‘আমি’ টিকে সড়িয়ে নিয়ে প্রশ্নকরি, যে, এই তালিকার জনক যে পাঠকজন তাঁর পাঠের আছে কী কোনো ‘ধ্রুবপদ’? অন্ততঃ ছোটোগল্পে কিসের সন্ধান করেন তিনি? কোন সুত্রে একই তালিকায় এসেপড়ে ‘Madame Tiller’s Establishment’ আর ‘Our Lady’s Juggler’? অথবা ‘একরাত্রি’ আর ‘জলবেশ্যা’?

    এখানে এসে মনে আসছে রবীন্দ্রনাথের ‘শাপমোচন’ গীতিনাট্যে ‘অসুন্দর’ রাজার বলা একটি কথা,সুন্দরী কমলিকাকেঃ ‘মর্তের অভিশাপে স্বর্গের করুণা যখন নামে তখনি তো সুন্দরের আবির্ভাব’...আমার মনেহয় এই তালিকাটির গল্পগুলিকে যদি কোনো এক-সূত্রে বাঁধাযায় তবে এ সেই ‘মর্ত্যের অভিশাপে স্বর্গের করুণা’র সূত্রে।এই আশ্চর্য সূত্রেই বাঁধাপড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি,’, ‘ছুটি’, ‘কাবুলিওয়ালা’ বা ‘দেনা পাওনা’র সংগে ‘ক্ষুধিত পাষান’, ‘নিশীথে’, ‘কংকাল’ ইত্যাদি তথাকথিত অর্থে ‘ভৌতিক’ গল্পগুলি।‘অতিথি,’, ‘ছুটি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘দেনা পাওনা’, ‘সুভা’, ‘দৃষ্টিদান’,’মেঘ ও রৌদ্র’ – ইত্যাদি কাহিনীতে তিনি যা শোনাতে চেয়েছেন তা তাঁর নিজের ভাষায়ঃ

                    ‘ ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা,            ছোটো ছোটো দুঃখকথা

          নিতান্তই সহজ সরল,

   সহস্র বিস্মৃতিরাশি                   প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

                 তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।

   নাহি বর্ণনার ছটা                  ঘটনার ঘনঘটা,

                 নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।

  অন্তরে অতৃপ্তি রবে              সাঙ্গ করি’ মনে হবে

                শেষ হয়ে হইল না শেষ।

  জগতের শত শত                অসমাপ্ত কথা যত,

               অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,

 অজ্ঞাত জীবনগুলা,              অখ্যাত কীর্তির ধুলা,

              কত ভাব, কত ভয় ভুল—

  সংসারের দশদিশি           ঝরিতেছে অহর্নিশি

              ঝরঝর বরষার মতো—

 ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ-হাসি            পড়িতেছে রাশি রাশি

              শব্দ তার শুনি অবিরত।

 সেই-সব হেলাফেলা,              নিমেষের লীলাখেলা

              চারি দিকে করি স্তূপাকার,

 তাই দিয়ে করি সৃষ্টি             একটি বিস্মৃতিবৃষ্টি

              জীবনের শ্রাবণনিশার ’

এইসব ‘ছোটো প্রান’ গুলি মূলতঃ অসহায় তাদের নিয়তির কাছে,তাদের সামাজিক বাস্তবতার কাছে।আপন প্রানের স্বাভাবিক ইচ্ছার সন্মান রাখতে ‘অতিথি’র ‘তারাপদ’ নিরদ্দেশ হয়ে যায় তার সামাজিক,অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তির ঠিক পূর্ব মুহুর্তে।পিছনে রয়ে যায় আলোকোজ্জল বিবাহ-বাসর,ক্রন্দনরতা মাতা,ভ্রাতা,ভগিনী আর সেই বালিকা যে ‘ভালবাসা’ কি জিনিস না জেনেই ভালবেসে ফেলে তারাপদকে।- এই গল্পটির প্রসঙ্গে বিষ্ণু দে তাঁর ‘স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ’এ লিখেছিলেনঃ ‘বর খুঁজেফেরে আপন সত্তার পরিচয়’, বিষ্ণু দে’র কবিতা বা তাঁর এই গোটা কবিতাটি আমার ভালো না লাগলেও তারাপদ’র অন্তর্ধানের এই বিশ্লেষন আমার ভালোলাগে।এই বিশ্লেষনের সূত্রে এক হয়েযায় তারাপদ আর হ্যামলেট।কিন্তু যারা পরে রইলো পিছনে, তারা? ক্রন্দনরতা মাতা,ভ্রাতা,ভগিনী আর সেই বালিকা? – তাদের ‘অভিশপ্ত’ জীবনের শিয়রেই নেমে আসে ‘স্বর্গের করুণা’ যে করুণার স্পর্শে তারা হয় অমর...

ঠিক তারাপদর মতো না হলেও ‘ছুটি’র ফটিকেরো ‘সত্তা’ মুক্তি পেতে চেয়েছিল অন্যত্র কিন্তু সেই মুক্তি তাকে কিনে নিতে হলো মৃত্যুর মূল্যে।‘পোস্টমাস্টার’ এর রতন চলেযেতে চেয়েছিল সেই পোস্টমাস্টার বাবুটির সঙ্গে কিন্তু পোস্টমাস্টারবাবু চলেগেলো তাকে পারহয়ে...চাওয়ার সংগে পাওয়া না পাওয়ার এই সকল দ্বন্দ্বের রূপকেই উদ্ভাসিত ‘ক্ষুধিত পাষান’।ঐ পাষানপুরীও বলে এমন এক মায়াপৃথিবীর কথা যাকে বাহিরে খুঁজে না পেয়ে উন্মাদ হয়েযেতে হয় মেহের আলিকে...জীবনের প্রতিটি নিবিড় মুহুর্তের গহনে ‘নিশীথে’র নায়ক শুনতে পান এক অতৃপ্ত আত্মার হাহাকার ‘ও কে? ও কে? ও কে?...’ তিনিও তারাপদর মতো মুক্তি চান ঐ হাহাকার থেকে...কিন্তু পরিশেষে তাঁকে ডেকেনেয় মৃত্যু যা একদা ডেকে নিয়েছিল ফটিককে...আর মর্ত্যের এইসব অভিশাপের শিয়রে জেগে ওঠে করুণাধারার কল্লোল যার ভগীরথ রবীন্দ্রনাথ...

এই তালিকাটির গল্পগুলির ভিতরে কোনো সূত্র থেকেই থাকে তা’ও ঐ একই সূত্র।‘Madame Tiller’s Establishment’ গণিকা মেয়েগুলির যন্ত্রণাকে আড়ালে রেখে লেখক এখানে বলেন,সেই স্বর্গীয় করুণায়, তাদের জীবনের সেই আপাতঃ আনন্দের মুহুর্তগুলির কথাই যার অভাবহেতু Notes from Underground এর নায়ক ক্রমে হয়ে ওঠে বিকৃত মস্তিষ্ক, Dream of a ridiculous man এর কেন্দ্র চরিত্রটি যে করুণার সন্ধান পায় স্বপ্নে...যার অভাবে এতোদিন আত্মহননকেই তার মনে হয়েছিল একমাত্র নিয়তি।

আর বেশী বাগাড়ম্বরের প্রয়োজন দেখিনা।তবে এতোদূর এসে এই আমার মনেহয়,যে,প্রথম যৌবণের সর্বগ্রাসী পাঠপিপাসার দিন শেষহলে প্রকৃত পাঠকজনও আর পারেননা সমস্ত রকমের সমস্ত স্বাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে।পরিবর্তে কোনো একটি বিশেষ সরই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্রুবপদ।

৪।

তালিকা

* নামের ক্রমবিন্যাস পছন্দের ‘তর-তম’কে সূচিত করবার প্রয়োজনে নয়।নামগুলি যেভাবে মনে এসেছে সেভাবেই লিখেগেছি।

১।অতিথি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২।ছুটি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৩।ক্ষুধিত পাষান – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৪।নিশীথে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৫।কংকাল – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৫।গুপ্তধন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৬।দালিয়া – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৬।কাবুলিওয়ালা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৭।একটি আষাঢ়ে গল্প – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৮।খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৯।জীবিত ও মৃত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১০।মধ্যবর্তিনী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১১।একরাত্রি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৩।ঠাকুরদাদা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৪।দুরাশা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৫।মনিহারা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৬।একটি দিন – বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

১৭।কুয়াশার রঙ – বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮।ভন্ডুলমামার বাড়ি – বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯।নাস্তিক – বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

২০।মেঘমল্লার – বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

২১।তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প -বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

২২।বউচন্ডীর মাঠ-বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

২৩।উপেক্ষিতা- বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

২৪।উমারানী - বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

২৫।যদু হাজরা ও শিখীধ্বজ- বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

২৫।অভাগীর স্বর্গ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়

২৬।মহেশ– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়

২৭।অগ্রদানী – তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

২৮।জলসাঘর – তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

২৯।ডাইনী – তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

৩০।সাড়েসাত গন্ডার জমিদার – তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

৩১।সুখ – বিমল কর

৩২।সত্যদাস (উপাখ্যানমালা) – বিমল কর

৩৩।কাম ও কামিনী (উপাখ্যানমালা) – বিমল কর

৩৪।জোনাকি – বিমল কর

৩৫।পিঙ্গলার প্রেম – বিমল কর

৩৬।বিস্ময় – জীবনানন্দ দাশ

৩৭।গ্রাম ও শহরের গল্প – জীবনানন্দ দাশ

৩৮।বিদ্রোহী – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৯।আমাদের মনোরমা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

৪০।দেখাহবে  - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

৪১।দূরত্ব     - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

৪২।কথা         - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

৪৪।আশ্চর্য্য প্রদীপ   - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

৪৫।চকাচকি – সতীনাথ ভাদুরি

৪৬।প্রেম এল – অমল মুখোপাধ্যায় ( কখনো ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত)

৪৭।ফৌউজ-ই-বন্দুক – কমল কুমার মজুমদার

৪৮।তাহাদের কথা – কমল কুমার মজুমদার

৪৯।মতিলাল পাদরী– কমল কুমার মজুমদার

৫০।খেলার বিচার– কমল কুমার মজুমদার

৫২।রসময়ীর রসিকতা– প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়

৫৩।খুড়া মহাশয়– প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়

৫৪।জলবেশ্যা – আল মামুদ

৫৫।বুনো বৃষ্টির প্ররোচনা– আল মামুদ

৫৬।রস – নরেন্দ্রনাথ মিত্র

৫৭।হবা – আবুল বাশার

৫৮।সুচিত্রা সেন -আবুল বাশার

Dream of a ridiculous man – Dostoyevsky [Russia]

Notes from Underground - Dostoyevsky[Russia]

White Nights- Dostoyevsky[Russia]

Our Lady’s Juggler – Anatole France[France]

Father Sergius – Tolstoy[Russia]

Death of Ivan Ilyich– Tolstoy[Russia]

Late Blossoms/Late Blooming Flowers – Anton Chekhov[Russia]

Ward Number 6– Anton Chekhov[Russia]

Seven Little Crosses In A Notebook – Gorges Simenon[France]

A Story told to the darkness – Rilke[German]

The Beggar and the Proud Maiden – Rilke[German]

Isabelle – Andre Gide[France]

The Queen Of Spade – Pushkin[Russia]

Sole Solution – Eric Frank Russell [Irish/English/American]

Araby - James Joyce[Irish/English/American]

A Little Cloud- James Joyce[Irish/English/American]

The Dead- James Joyce[Irish/English/American]

Selfish Giant – Oscar Wilde[Irish/English/American]

The Poet – Herman Hess[Norway]

A Simple Heart – Gustave Flaubert[France]

The Dead Past – Isaac Asimov[Irish/English/American]

Power House – Ray Bradbury[Irish/English/American]

I see you never– Ray Bradbury[Irish/English/American]

The Rocket– Ray Bradbury[Irish/English/American]

The Golden Apples of the Sun – Ray Bradbury[Irish/English/American]

Adulterous Woman – Albert Camus[France]

Sunstroke – Ivan Bunin[Russia]

Fall of Edward Barnard – Maugham

Madame Tiller’s Establishment – Maupassant[France]

The Dearly Beloved of Benjamin Cobb – Clemence Dane

Lamb to the slaughter – Royal Dhal[Irish/English/American]

 ৭/৫/২০১০ - ৯/৫/২০১০, বেঙ্গালোর

কবিতা-পথ

অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র

ক্ষুরের চেয়েও নিশিতধার, অতিদুর্গম সেই পথ, কবিরা ব'লে থাকেন। --- উদ্ধৃতিটি, এমনকি মূল দেবভাষাতেও , আমাদের সকলেরই চেনা, সকলেরই জানা। --- কিন্তু কোন্ পথ? কোন্ পথের বার্তা, এখানে দেওয়া হচ্ছে? নাকি সাধন-পথ? নাকি একসঙ্গে দুইই? কবিই সাধক আর সাধকই কবি? কবিতা-পথই সাধন-মার্গ?

...তখন ক্লাস নাইন। সৌমনমসা, তখনকার এক উদীয়মান নাট্যকার , আমার সেই বয়সের এক হীরা, শুনলেন আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছি। ক্লাস ছাত্র হিসেবে বেশ সুনাম ছিল তখন। ইস্কুলের মাস্টারমশাইরা, এমনকী পাড়া প্রতিবেশীরাও আশা করতেন যে পাড়ার বা ইস্কুলের পক্ষে একটা বেশ গৌরবজনকই কিছু ক'রে বসব হয়ত, হায়ার সেকেন্ডারি এগজামিন। কিন্তু কবিতা-লেখার কথাটা শুনেই , সৌমনমসা কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা বিরাট হতাশার ভঙ্গী করলেন। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে, যোগ করলেন: "হয়ে গেল। "

... হ্যাঁ, হয়েই গেল সত্যিই আমার, তার পর থেকেই। সেই পথের বার্তা যে একবার পায়, অন্য সব পথই তার কাছে বিপথই হয়ে দাঁড়ায়, একবারেই! কোনদিক কোনরকম তথাতকথিত উন্নতির বা প্রগতির আশাই যে আর থাকে না তার, কোনোভাবেই ! - -- শার্ল বদলেয়র, আধুনিক কবিদের সেই শিরমণি, এতদিন বুঝেছিলেন এই সারসত্যটি; বুঝে এই মন্তব্যও করেছিলেন যে :

Poetry and progress are like two ambitious men who hate one another with an instinctive hatred, and when they meet upon the same road, one of them has to give place.

--- আর আমাদের রামপ্রসাদ সেন? বলেছিলেন :

" যে জন তোমার নাম কর মা, তার হাড়মালা আর ঝুলিকাঁথা। "

... তখনই , ঐ ক্লাস নাইন পড়াকালীনই, হয়ত বুঝিনি ঐ সত্যটি, যেমন বোঝেননি মেডিক্যাল কলেজের কৃতী ছাত্র শ্রীভূমন্দ্রনাথ গুহরায়ও হয়ত একদিন, যে কবি সঞ্জয় ভট্রাচার্য কেন হঠাৎ নিঃস্পৃহ হয়ে পড়লেন তাঁর সম্পর্কে, যেই শুনলেন যে তিনি , কিছু সাংসারিক বাধ্যবাধকতাবশত, ডাক্তারীই পড়ছেন, অর্থাৎ ঐ জাগতিক উন্নতির পথেই হাঁটছেন। এতটাই নিঃস্পৃহ হয়ে পড়লেন, যে আর প্রায় কোন কথাই বলতে চাইলেন না তাঁর সঙ্গে, যদিও দুমিনিট আগেও , এই তিনিই উৎসাহের সঙ্গেই, তাঁর নতুন কবিতা বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন।

...ডাঃ বি.এন. গুহরায়, শব নিয়ে বহু কাটাছিঁড়া ত করেছেন নিশ্চয়ই, তাঁর সার্জারীর ক্লাস। কিন্তু সেই বিশেষ শবসাধনাটি কি তাঁর দ্বারা আর ঘ'টে উঠেছিল, অন্তত সেই প্রথমবয়স, যার অন্য নাম কাব্যসাধনা? তান্ত্রিক অভিসারক্রিয়ার সঙ্গে যে কাব্যিক অভিসারক্রিয়াটির পার্থক্য শুধু এইটুকুই, যে তান্ত্রিক অন্যের শবদেহের উপর আসীন হয়ে তাঁর সাধনাটি করেন, আর কবি করেন তাঁর নিজেরই শবদেহের উপর আসীন হয়ে? অর্থাৎ বাউলদের ভাষায় , "জ্যান্ত ম'র"?

... যদিও , অন্তিম সাধ্য বস্তু , এই দুই শ্রেণীর সাধনার ক্ষেত্রেই , বস্তুত সেই একই। সেই কুলকুন্ডলিনীরই জাগরণ। যে 'কুলকুন্ডলিনীর  জাগরণ' মান বস্তুত আর কিছুই নয়, শুধু মানুষেরই ভেতরের একটা চিরঘুমন্ত শক্তির, চিরনিদ্রিত  চেতনার এমনই একটা আকস্মিক , আগ্নেয় বিস্ফোরণ, যা একবার কোনভাবে ঘটলে, জগতের আর জীবনের সব অর্থই একবার বদলিয়ে যায়, সেই জাগ্রত মানুষটির কাছে। ' কী জানি হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ' তিনি তখন বলেন। 'হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল ভেসে যায়, উথল নয়ন-বারি--যেদিক চেয়ে দেখি, ওগো সখি, কিছু আর চিনিতে না পারি---" তিনি তখন বলেন।

... সাধক বামাক্ষ্যাপা একবার বলেছিলেন, নানাভাবেই ঘটতে পারে, এই জাগরণ--- অনুভূতির ও চেতনার নানরকম অগ্নুৎপাতের দ্বারাই । তীব্র প্রেম যেমন, তেমনই তীব্র শোকও কখনও। এমনকী তীব্র কাম বা ক্রধও, কোন কোন ক্ষেত্রে --- যদি সেই কাম বা ক্রোধ হয় কোন শুদ্ধ কাম বা শুদ্ধ ক্রোধ। অর্থাৎ সন্তানপ্রার্থীর কাম। বা রাষ্ট্রবিপ্লবীর ক্রোধ। প্রেমিকহৃদয় শুদ্ধ প্রেমানুভূতির জাগরণ ঘটে যে -বয়ঃসন্ধিকালটিতে, সেই অভিন্ন কালটিতেই, এই কারণেই,কবির কাব্যপ্রতিভাও, সচরাচর প্রষ্ফুটিত হয়ে থাকে।

...সাধক, পাগল, আর প্রেমিককে, একপঙক্তিতেই স্থান দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ একদিন, তাঁর বিখ্যাত একটি গানে। আর কবিই ত সাধক, কবিই ত পাগল, কবিই ত প্রেমিক। শুধু তাঁর দুর্ভাগ্যটি এইখানে, যে, আপনার সেই সাধকসত্তাকে, দিব্যোন্মাদসত্তাকে, প্রেমিকসত্তাকে --- কোন জন্মান্তরীণ কে জানে --- তিনি সচরাচর ভুলেই ব'সে থাকেন অধিকাংশ সময়ই।

...আর যখন চকিত মন প'ড়ে যায় সেই আত্মপরিচয়টি? ঘ'টে যায় সেই 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গটি? সেই বিখ্যাত কুলকুন্ডলিনীর জাগরণটি ? তখন?

...তখন কবি এমিলি ডিকেনসনের মতই, ব'লে ওঠেন,

‘‘If I feel physically as if the top of my head were taken off,

  I know that is poetry''

অথবা, অষ্টাদশ শতকের সিন্ধী সূফী কবি শাহ্ আবদুল লতীফের স্বরই, তিনি হয়ত তখন বলেন,

"...শুধু মাথা আছে, নেই ধড়---

কিংবা ধরই আছে, মাথা নাই---

কাটা গেছে! নেই কব্জি কিংবা হাতগুলি স্কন্ধোপর---

তাদের চেয়েছে যারা তাকে!-- তাই হয়েছে জবাই---"

কবিতা-পথ বা কবিতা-মার্গ এতক্ষণ আমরা খানিকটা বুঝেছি, যে কেন 'দুর্গম', কেন ক্ষুরের ধারের মত নিশিত?...অভিসারিণী শ্রী লাধার মতই যে দশা সেই প্রকৃত কবির, যিনি কাঁটার উপর দিয়ে হাঁটার অভ্যাস করছেন রক্তাক্ত পায়ে, কারণ বঞু মূল্য দিয়ে তাকে বুঝতে হয়েছে  এই সত্য, যে 'কানু বিন গীত নাই'

.. হে তরুণ কবি ঐ গীতটিকেই  কি চাও তুমি? চাও কি ঐ বিশুদ্ধ বংশীধ্বনিটিতেই মিলিয়ে যেতে?

আগে তবে জয় কর সমস্ত ভোগসুখব্যসনউন্নতিপ্রগতিপ্রতিষ্ঠানপ্রলোভনকে।

শীর্ণ, শীর্ণ হও একটি শিখার ন্যায়। পূর্ণ, পূর্ণ হও একটি কুম্ভের ন্যায়।

শোন শতাব্দীপারের কোন সূফী কবি, ঐ তোমাকেই বলছেন ---

প্রেমকথা জেন', শুধু তাদের মুখেই শোভা পায়

মাথাগুলি, হাত যারা বয়... ...

ইতি ১ লা চৈত্র, ১৪১৬

রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণসাহিত্য

সৌমিত্র দেব

বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণ নতুন বিষয় নয়। আদি নিদর্শন চর্যাপদের কবিতায়ও ভ্রমণের কিছু উল্লেখ আছে। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী ও রোমান্টিক কাব্যগুলিতে ভ্রমণ একটা বড় বিষয়। পুঁথিসাহিত্যেও সেটা খুব অপাঙক্তেয় নয়। তবে আধুনিক সাহিত্যে ভ্রমণ নিয়ে যারা লেখালেখি করেছেন তাদের মধ্যে বাংলা উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলা যায়। তাঁর উপন্যাসগুলিতে বিস্তরভ্রমণ বর্ণনা আছে। সহোদর ভাই সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘পালামৌ’ গ্রন্থে চমৎকার ভ্রমণ বর্ণনা দিয়েছেন। তবে রবীন্দ্রনাথে এসেই বাংলা ভ্রমণসাহিত্য যেন নতুন এক মাত্রা পায়। অনেকের মতে, তিনিই হচ্ছেন আমাদের আধুনিক ভ্রমণ সাহিত্যের জনক।এব্যাপারে হাসনাত আবদুল হাই তাঁর ভ্রমণ পিপাসু রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ভাবতে অবাক লাগে কী করে একজীবনে এত কিছু অর্জন করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু সৃজনশীল সাহিত্যের কথা ভাবলেই তাঁর লেখার বিষয়গত বেচিত্র্য এবঙ সংখ্যা বিস্ময়কর মনে হবে। তার সঙ্গে যোগ করতেহয় মননশীল ভাষায় ইংরেজি ও বাংলায় লেখা বই-পত্র, যা সংখ্যায় প্রথম শ্রেণীর তুলনায় কম হলেও উৎকর্ষে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। আর শুধুই কী সৃজনশীল ওমননশীল সাহিত্য-চর্চা? স্বদেশ ও সমাজের উন্নতির জন্য বিভিন্ন সময়ে যা চিন্তা করেছেন তার বাস্তব রূপ দিতে তিনি সময় ও মনোযোগ দিয়েছেন অকুণ্ঠচিত্তে। পতিসরে সমবায় ব্যাংক, কুষ্টিয়ায় কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে কৃষির উন্নতির জন্য বোলপুরে শ্রীনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়, এই সবই তাঁর বিশাল কর্মজীবনের এক একটি আলোক স্তম্ভ। একইসঙ্গে সৃজনশীলতায় বিশালতা অর্জন, চিন্তায় পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন এবঙ বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ প্রায় অচিন্তনীয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবনে তাই ঘটেছিল। এখানেই শেষ নয়। তিনি যৌবন থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়সে যতদিন সুস্থ ছিলেন বেরিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর পথে এবঙ স্বদেশের মাঠে-ঘাটে। সাহিত্যিক, প্রতিষ্ঠান-নির্মাতা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথের পরিচয় কম উল্লেখযোগ্য নয়, কেননা তাঁর এইসব ভ্রমণ ছিল জ্ঞানার্জন ও জানাশোনার পরিধি বিস্তৃত করার উপায় মাত্র। এমনকি যখন দেশে জমিদারির কাজ উপলে পালকি, নৌকা এবঙ ট্রেন যোগে ঘুরেছেন তখনও এই ঘোরাও ছিল এক ধরনের ভ্রমণ। দেশে হোক অথবা বিদেশে, ভ্রমণকালের অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে ধারণ করার উদ্দেশ্যে। দেশের ভেতর তাঁরজীবনের সৃষ্টি ভাণ্ডারে একটি বিশিষ্ট মাত্রা যোগ করেছেন ভ্রমণকাহিনী লিখে। রবীন্দ্রনাথই বাংলাসাহিত্যে প্রথম ভ্রমণসাহিত্যের সূচনা করেন, যেমন করেছিলেন ছোটগল্পের। ভ্রমণকাহিনীর সংখ্যার দিক দিয়েও তিনি সবাইকে অতিক্রম করে পুরোধায় রয়েছেন এখন পর্যন্ত। ‘ছিন্নপত্র’র ফেব্রুয়ারির, ১৮৯৩ তারিখে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘ঘরের কোণও আমাকে টানে, ঘরের বাহিরও আমাকে আহ্বান করে। খুব ভ্রমণ করে বেড়াতে ইচ্ছে করে, আবার উদ্ভ্রান্ত শ্রান্ত মন একটি নীড়ের জন্য লালায়িত হয়ে ওঠে। পাখির মতো আর কি!’ পরিণত বয়সে যখন ভ্রমণ পিপাসা রয়ে গিয়েছে অথচ শরীরে কুলায়নি তখন তিনি লিখেছেন, ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী।’ রবীন্দ্রনাথ সত্যিকার অর্থেই ভ্রমণ-পিপাসু ছিলেন।

তবে হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাচ্ছি- বাংলাসাহিত্যের ভ্রমণ বিষয়ক রচনার সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথের হাতে হয়নি। তবে তাঁর রচনাশৈলী ছিল বহুমাত্রিক। বিশাল ভারতবর্ষ এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরেছেন তিনি। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ইউরোপ, আমেরিকা কোথায় যাননি তিনি। লিখেছেনও বিস্তর। রাশিয়ার চিঠি পড়লে বুঝা যায় তিনি ভবিষ্যৎ ব্যাখ্যা করেছেন, তা শতবর্ষ পরেও অমিল। এ ব্যাপারে ড. সৌমিত্র শেখর তাঁর রাশিয়া ভ্রমণ রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র-নিরীক্ষা প্রবন্ধে লিখেছেন, গদ্যগ্রন্থটি ভ্রমণ-বিষয়ক। এর নাম ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’, প্রকাশিত হয় ১৮৮১ খ্রি স্টাব্দে। অবশ্য ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দেই ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘য়ুরোপ-যাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে হিমালয় থেকে ভারতীয় মরুঅঞ্চল ভ্রমণ অর্থাৎ ভারত-পরিক্রমা শুরু হয়েছিল তাঁর জীবনে এবং ইংল্যান্ড ভ্রমণ দিয়ে বিদেশ সফরের আরম্ভ, সে-ও কিশোরবেলাতেই। ১৮৭৮ সালে তিনি প্রথম বিদেশ-ভ্রমণ করেন; তখন তাঁর বয়স মাত্র সতের। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ভারত-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথম গ্রন্থ লিখলেন না; লিখলেন বিদেশ-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে। ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রে’ নিসর্গ-প্রকৃতি, দর্শনীয় স্থান ইত্যাদির বর্ণনা নেই বলেছেন; ‘বিদেশীয় সমাজ প্রথম দেখিয়াই যাহা মনে হইয়াছে তাহাই ব্যক্ত করা গিয়াছে।’ এক নবীন-যুবার কাছে ভ্রমণ যেখানে শুধু আনন্দ, দর্শন, বিনোদন হবার কথা, রবীন্দ্রনাথের কাছে ঠিক তা না হয়ে ভ্রমণে সমাজ-নিরাি’ এবং লেখনীর মাধ্যমে সে-কথা প্রকাশ মুখ বিবেচিত হয়েছে। অন্যদের থেকে রবীন্দ্রনাথ পৃথক এখানেই এবং এই পৃথকতা তাঁর ছেলেবেলা থেকেই। উত্তরকালে তিনি যতোবার বিদেশ-ভ্রমণ করেছেন, প্রতিবারই ওইসব দেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা; সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎস ও বিকাশ; মানুষ ও সভ্যতার বিবর্তনধারা তাঁর নিরীাভুক্ত ছিল। ১৮৭৮ সালে ইংল্যান্ড সফল দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদেশ-ভ্রমণ পর্বের সূচনা; তাঁর জীবনের শেষ বিদেশ-ভ্রমণ ইরাক-ইরান, ১৯৩২ সালে। এই সুদীর্ঘ পঞ্চান্ন বছরে অস্ট্রেলিয়া ছাড়া তিনি পৃথিবীর সব মহাদেশই ভ্রমণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ মোট ১২ বার বিশ্বপরিক্রমায় বের হয়েছিলেন। দেশ-দর্শন তাঁর ল্য ছিল না, দেশ অনুধাবন ও নিরীণেই ছিল তাঁর মুখ্য আগ্রহ। সারাজীবনে তিনি যে যে দেশ ভ্রমণ করেছেন, সালসহ সেগুলো এক নজরে উল্লেখ করা হলো:

অস্ট্রিয়া: ১৯২১, ১৯২৬। আমেরিকা: ১৯১২, ১৯১৬, ১৯২০, ১৯২৯, ১৯৩০। ইংল্যান্ড: ১৮৭৮, ১৮৯০, ১৯১২, ১৯১৩, ১৯২১। ইতালি: ১৯২৫, ১৯২৬। ইরাক: ১৯৩২। কানাডা: ১৯২৯। গ্রিস: ১৯২৬। চীন: ১৯২৪। চেকোশ্লোভাকিয়া: ১৯২১, ১৯২৬। জাপান: ১৯১৬, ১৯১৭, ১৯২৪, ১৯২৯। জার্মানি: ১৯২১, ১৯২৬, ১৯৩০। ডেনমার্ক: ১৯২১, ১৯২৬, ১৯৩০। বুলগেরিয়া: ১৯২৬। বেলজিয়াম: ১৯২০। ব্রহ্মদেশ: ১৯১৬। মলয়, জাভা, বালি: ১৯২৭। মিশর: ১৯২৬। রাশিয়া: ১৯৩০। রুমানিয়া: ১৯২৬। সিংহল: ১৯২২, ১৯২৪, ১৯৩০। হল্যান্ড: ১৯২০। হাঙ্গেরি: ১৯২৬। কালক্রমে এদেশগুলোর মধ্যে দু’একটির নাম পরিবর্তন হলেও দেশগুলোর ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে বুঝতে অসুবিধাহয় না। যে-সময় জাহাজে চেপে মাসের পর মাস সাগরের নোনাজলে বাস করে দেশ-ভ্রমণ করতে হতো, সে সময়ই রবীন্দ্রনাথ এতগুলো দেশ ভ্রমণ করেছেন। আজকের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দ্রুতগতির বিমান-ব্যবস্থা সে যুগে থাকলে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকৃত দেশের সংখ্যা এবং ভ্রমণ সংখ্যা যে নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পেত, তা সহজেই বলা যায়...।’

সৌমিত্র শেখরের এই মূল্যায়ন থেকে পাঠক যেন বিভ্রান্ত না হন যে, রবীন্দ্রনাথ শুধু বিদেশ ভ্রমণেই উৎসাহী ছিলেন। তিনি জন্ম রোমান্টিক একজন পথিক, দেশ এবং বিদেশ দু’দিকেই তাঁর আগ্রহ সমান ছিল। অনেক সময় নিকটতম বস্তুর প্রতি সুচিবার করতে পারেননি বলে নিজেই আপে করেছেন। যেমন তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন ‘... দেখিতে গিয়োছি পর্বতমালা/দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/ দেখা হয়নাই চু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু।’

নাগরিক রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৫ সালে প্রথম গ্রামে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেই তার প্রথম গ্রাম দেখা। তার ৩ বছর পর প্রথম বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। ব্যারিস্টার হবার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৭৮ সালে বিলেতে গিযে ব্রাইটনে একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন।সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। জাহাজ যোগে তাঁরা ইউরোপ হয়ে লন্ডনে যান। ব্রাইটনে কিছুদিন থাকার পর লন্ডনে ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৮০ সালে তিনি শিা অসমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে আসেন। হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতে, ‘১৮৭৮ সাল থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ভ্রমণপিপাসু রবীন্দ্রনাথ পাঁচ মহাদেশের তিরিশটির অধিক দেশে ভ্রমণ করেন। ভ্রমণকালে তিনি যেমন বিদেশ ও বিদেশিদের সম্বন্ধে জানতে পারেন একই সঙ্গে তাঁর নিজের দর্শন ও লেখা সম্বন্ধেও বিদেশিদের পরিচিত করাবার সুযোগ পান। ১৯১২ সালে তিনি তাঁর কবিতার একগুচ্ছ (গীতাঞ্জলি) নিয়ে বিলাত যান, সেখানে গান্ধীভক্ত সি এফ এ্যান্ডুজ, কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, কবি এজরা পাউন্ড, রবার্ট ব্রিজেস, আর্নেস্ট রিজ, এসটি মুর এবং অন্যান্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই সময় গীতাঞ্চলির ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকা লিখে দেন ইয়েটস।

১৯১২ সালের ১০ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা ও বিলেত ভ্রমণ করেন। ১৯১৬ সালের মে তেকে ১৯১৭-এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ জার্মানি ও আমেকিায় বক্তৃতা দিতে ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণকালে তিনি জাপানি ও আমেরিকান জাতীযতাবাদের সমালোচনা করেন।এই সময়েতিনি ‘ভারতে জাতীয়তাবাদ’ নাম ইংরেজিতে এক প্রবন্ধ লেখেন যা রমাঁ রলাঁর মতো চিন্তাবিদদের প্রশংসা অর্জন করে। ভারতের প্রত্যাবর্তনের কিছুকালপরই তিনি পেরুর সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে পেরু যান এবং সেই সময় মেক্সিকোও ভ্রমণ করেন। দুই দেশের সরকার থেকেই তিনি শান্তিনিকেতনের জন্য আর্থিক অনুদান লাভ করেন। ৬ নভেম্বর ১৯২৪-এ বুয়েনস আয়ার্সে পৌঁছার এক সপ্তাহ পর অসুস্থ হয়ে পড়লে লেখিক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর অনুরোধে তাদের বাসগৃহ ভিলা মিয়ালরিওতে আশ্রয় নেন। জানুয়ারি, ১৯২৫ সালে তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯২৬-এর ৩০ মে রবীন্দ্রনাথ ইতালির নেপলস শহরে পৌঁছানোর পর রোমে বেনিটো মুসোলিনির সঙ্গে সাাৎ করেন। ২০ জুলাই দু’জন সফরসঙ্গীসহ রবীন্দ্রনাথ দণি এশিয়া ভ্রমণে বের হন। এই সময় তিনি বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাঙ্কা, পেনাং, সিয়াম এবং সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেন। ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায় বছরব্যাপী ভ্রমণে বের হন। ইংল্যান্ডে পৌঁছে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেয়ার জন্য হিবার্ট বক্তৃতামালা লেখেন। এই সময় ইংল্যান্ডে কোয়েকারদের বার্ষিক সভায় তিনি ভারতীয় এবং ব্রিটিশদের সম্পর্কের ওপর বক্তৃতা দেন। ১৯৩০-এর জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবঙ জামৃানি ভ্রমণ করেন। এরপর তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। ১৯৩২-এর এপ্রিলে রবীন্দ্রনাথ পারস্যের সম্রাট রেজা শাহ পাহলভীর আমন্ত্রণে পারস্যে যান। বিদেশে ভ্রমণকালে তিনি বার্নার্ড শ, হেনরি বার্গসঁ, এইচ জি ওয়েলস, টমাস ম্যান, রবার্ট ফ্রস্ট, রমাঁ, রলাঁ এবং অন্যান্য মনীষীর সঙ্গে পরিচিত হন।

রবীন্দ্রনাথের জীবনী থেকে দেখা যায় তিনি প্রথম বিদেশে যান ১৮৭৮ সালে; সেই সময় তিনি উচ্চশিার জন্য ইংল্যান্ডে দেড় বছর ছিলেন। এই সময়ের ভ্রমণ অীভজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র যা প্রকাশিত ১৮৮১ সালে। ইংল্যান্ডে তিনি দ্বিতীয়বার যান ১৮৯০ সালে। তিনমাসকালের এই অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয় য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি যার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৯১ এবং দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে দণি আমেকিার ভ্রমণে যান, যার ওপর ভিত্তি করে লেখা হয় যাত্রী এবং যা মুদ্রিত আকারে বের হয় ১৯২৯ সালে। ১৯১৭ সালে মালয়, জাভা ও বালি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেিয় তিনি লেখেন যাভাযাত্রীর ডায়েরী। খুব সম্ভবত ১৯১৭ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে তিনি জাপান গিয়েছিলেন এবং জাপান যাত্রী নামে বইটি ছাপাহয় ১৯২৯ সালে। পারস্যে ১৯৩২ সালে ভ্রমণে গিয়ে তিনি পারস্য যাত্রী নামে বই লেখেন। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ায় গিয়েছিলেন এবং সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকাশ করা হয়রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১)। উত্তর আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ ভ্রমণ নিয়ে তিনি ‘পথের পরিচয়’ নামে যে বই লেখেন সেটি ছাপা হয় ১৯৩৯ সালে। বিদেশ ভ্রমণ ছাড়াও ভারতের উড়িষ্যা, বিহার ও বাংলায় জমিদারি উপলে তাঁর স্থল ও জলপথে ভ্রমণ নিয়ে তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে যেসব চিঠি (১৪৫) লেখেন তার সঙ্কলন ‘ছিন্নপত্র’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩১৯ সালে। এসব পত্রের সঙ্গে আরো ১০৭টি পত্র সঙ্কলিত করে ইংরেজি ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘ছিন্নপত্রাবলী’। নিচের আলোচনায়বিদেশে অথবা স্বদেশে স্থায়ী বাসস্থানের বাইরে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যা দেখেছেন ও শুনেছেন এবঙ এই দেখাশোনার ভিত্তিতে তাঁর মনে যে অনুভব সৃষ্টি হয়েছে ও বোধিতে চিন্তা দেখা দিয়েছে সেইসব বিষয় স্থান পাবে। ভ্রমণপিপাসু কবি কেবল পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে ভ্রমণকালীন অভিজ্ঞতা উপভোগ করেননি, তাঁর প্রজ্ঞা ও বোধির সাহায্যেও অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ করেছেন যার জন্য তাঁর ভ্রমণকাহিনী হয়েছে একইসঙ্গে বিচিত্র অনুভূতির সমাহার এবং সূক্ষ্ম চিন্তার বিস্তার। যখন যেখানেই পাশাপাশি সক্রিয় থেকেছে যার জন্য তাঁর ভ্রমণকাহিনী একই সঙ্গে বিশুদ্ধ আনন্দালোকে নিয়ে যায় এবং পাশাপাশি যুক্তি-তর্কের নির্মোহ বিষয়কে উপস্থাপন করে। ভ্রমণকালে ইন্দ্রিয় নির্ভর সৌন্দর্যানুভূতিতে তিনি যেমন আবিষ্ট হয়েছেন, একইভাবে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায়ও মগ্ন হতে পেরেছেন। একটি লেখায় পরিব্রাজক রবীন্দ্রাথের পূর্ণ পরিচয় দেবার চেষ্টা দুস্কর, কেননা তাঁর দৃষ্টিতে এত কিছু এসেছে এবং মনে এত বিচিত্র ভাবনার উদ্রেক হয়েছে যে তার বর্ণনাতেই দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। আর সেই সব দেখা এবং ভাবনার বিশ্লেষণ করতে গেলে অথবা অর্থোদ্ধারের চেষ্টা করতে গেলে রবীন্দ্রনাথে তাবৎ ভ্রমণসাহিত্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে- তিনি সব গণ্ডিকে অতিক্রম করে গেছেন। ভেঙে ফেলেছেন সব অচলায়তন। এগুলো হয়েছে নতুন এক সৃষ্টিকর্ম। যতদিন যাবে এর মধ্য থেকে নতুন কিছু আবিষ্কারের সম্ভাবনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমাদের চলার পথে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সাহিত্য দিক-নির্দেশিকার কাজ কুজতবা আলী ভ্রমণ সাহিত্যে কিছু নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। এখনো কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সাহিত্যের প্রভাব দুর্লক্ষণীয় নয়।

mansoumit@yahoo.com

শামসুর রাহমানের কবিতায় পুরাণ

ড. মাহবুব হাসান

আমাদের মৌণতার ফাঁক গলিয়ে কবিতায় ঐতিহ্যিক উপাদান আর দেশি-বিদেশি পুরাণ ঢুকে পড়ে। এ-কথায় মনে হতে পারে কবি সচেতনভাবে তার কবিতা রচনা করেন না। আসলে তা নয়। আমি বলতে চাই কবির অন্তরে পুরাণ ও ঐতিহ্য এমনভাবে ওতপ্রোত যে তা আপনা থেকেই উঠে আসে চিন্তার অরবিটে, লেখার পঙক্তিতে। লোকপুরাণ, লোকজ উপাদান যেমন প্রবাদ-প্রবচন লোকবিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার ইত্যাদি আমাদের জীবনের প্রতিটি ভাঁজে লেগে আছে। ভারতীয় মিথ ও গ্রেকো-রোমান-আসিরীয় মিথ আমাদের শিক্ষা রুচির ভেতর দিয়ে উঠে আসে কবিতায়, সৃষ্টিশীলতার ধারায়। ভারতীয় মিথের  সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এলাকা আমাদের মনো-এলাকার বাইরে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে ভারতীয় মিথ, যাকে আমরা হিন্দু পুরাণ বলেও জানি, যেহেতু হিন্দুদের  ধর্মদর্শন ও ধর্মীয় কাহিনীগুলোরই বিন্যাস, তাই ওই মিথিক্যাল পরম্পরা এতদাঞ্চলের জনজীবনের অংশ, আমরা প্রায়শই প্রতিবেশের কারণে অটোমেটিক্যালি সে-সব জেনে যাই। সামাজিক জীবনে হিন্দু-মুসলিমের বসবাসের এলাকা এক, প্রতিবেশ বিশ্ব এক, পরিবেশ বিশ্ব এক এবং যাপিত জীবনাচারের ভাষিক ও মানসিক প্যাটার্নও এক হওয়ায়, ওই অটো-কায়দায় ভারতীয় লোক-মিথ কমবেশি জানা হয়ে যায় আমাদের। বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় ‘শিবজাল’ বলে মাছ ধরার একরকম জাল আছে। আবার সেই এলাকারই কিছু কিছু লোক শিবজালকে ‘ধর্মজাল’ হিসেবেও ডাকে বা চেনে। শিব যেহেতু হিন্দুদের  দেবতা, তাই কেউ কেউ ওই জালের  নাম পাল্টে ধর্মজাল রেখেছে। শিব আর ধর্ম তো সমার্থক অনেক হিন্দুর কাছে। দুটোই এক। কিন্তু ব্যবহারের কারণে তা নতুন কনোটেশন  পেয়েছে। তো, সামাজিক জীবনের এই প্রেক্ষাপটে আমরা পাচ্ছি লোকপুরাণের উপাদান যা লোকসমাজের সম্পত্তি। এই সম্পদ সৃষ্টিশীল কবি-সাহিত্যিকরা ব্যবহার করেন তার সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান থেকে। আর কে না জানে, সংস্কৃতির কাজ অতীব সূক্ষ্ম। তার গতায়াত নিয়ন্ত্রণ কঠিন। সে মৌণতার ফোকড় গলিয়ে কবির চিন্তার ভেতরেই কেবল মাথা ঢোকায় না, পঙক্তির সজ্জায়ও তার কারুকাজ আঁকে। এ-কারণেই আমি বলেছি কবির মৌণতার ফাঁক গলিয়ে অবলীলায় ঢুকে পড়ে পুরাণ বাংলা কবিতার অন্তরমহলে, অন্দরমহলে।

শামসুর রাহমানের কবিতায় পুরাণের ব্যবহার আছে এক কথায় ব্যাপকভাবেই। প্রায় অধিকাংশ কবিতায় লোকপুরাণের উপাদান-উপকরণের ব্যবহার আমি দেখেছি। গ্রেকো-রোমান-আসিরীয় মিথের ব্যবহার মোটামুটি থাকলেও, আশ্চর্যজনক হলো তার কবিতায় ভারতীয় মিথের ব্যবহার অনেকটাই কম। কেন তিনি প্রতিবেশ বিশ্বের এক সহোদর মিথিক্যাল পরিপ্রেক্ষিতকে এড়িয়েছেন বা ব্যবহার করেননি, সেটা এ-রচনার লক্ষ্য নয়। তবে, আমি বিবেচনা করি, শামসুর রাহমান কেন ভারতীয় মিথের ব্যবহার এতো কম করেছেন, তার কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। আর সেই অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে তার সামাজিক-মানসিক মনোভূমির প্রেক্ষাপটটি। একজন কবিকে চেনার জন্য এই তথ্য-উপাত্তের অন্তর্নিহিত কারণ অনেকটাই কাজে লাগে। আমি বলবো, কবির মানসভূম ও মননপটের অনুপুঙ্খ জানা গেলে তার কবিতার বিষয় ও বক্তব্যের ভেতরে নিহিত উদ্দেশ্য জানা যেতে পারে। কবিতা বিচারে-বিশ্লেষণে এর চেয়ে উপযোগী পথ আর কি হতে পারে?

‘রূপালি স্নান’ কবিতায় একটি মাত্র মিথিক্যাল চরিত্র বা ধর্মজাত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা ‘যেসাস’। খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে যেসাস ঈশ্বরপুত্র, আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিতপুরুষ বা নবী বা রাসুল। আর মুসলমানদের কাছে যেসাসের আসিরীয় নাম ইশা [আঃ] নবী। তার ওপর নাজিল হয়েছিলো ইঞ্জিলগ্রন্থটি। খ্রীষ্টান সম্প্রদায় যাকে বলে ওল্ড টেস্টামেন্ট বা বাইবেল। তো এই মহাত্মার নামটিই কেবল শামসুর রাহমান ব্যবহার করেননি এ-কবিতায়, তার ক্ষমার বিশেষত্বটিও মেলে ধরেছেন এখানে। ‘সত্তাসূর্যে যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে শুধু গড়ি উজ্জ্বল কথার মিছিল’। এই বাক্যে শামসুর রাহমান যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে যে কথার মিছিল গড়ে তোলার কথা বলেছেন, তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছেন বিশেষণের মাধ্যমে। সেই বিশেষণ উজ্জ্বল। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে জন্মগ্রহণকারী হযরত ইশার [আঃ] মানুষের ধর্ম-চিন্তা-ভাবনা আর আদর্শ-নৈতিকতা তৎকালের আরবের সামাজিক জীবনকে যে সত্য আর সুন্দরের পথ দেখিয়েছিলো, ক্ষমার যে পথ তিনি প্রদর্শন ও প্রশস্ত করেছিলেন, তারই উত্তরসাধক ,  ৫৭০ বছর পর পৃথিবীতে এসেছিলেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ [সাঃ], ক্ষমার সুবিস্তারিতপরিমন্ডল ও মানবতার সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। যেসাসের ক্ষমা তার মৃত্যুও ভেতর দিয়ে পারলৌকিক জীবনে প্রত্যাগমন করেছে। আর ইসলামের নবী মুহম্মদ [সাঃ] সংঘাতময় আরবের সামাজিক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণই কেবল করেননি, তিনি  রোপন করেছেন চলমান জীবন আর এই রহস্যময় জগতের সৃষ্টি এক অনন্য নিরাকারের সৃষ্টিবেদনার ফসল। এ-ভাবে এই দুজন মহাত্মা বাস্তব পৃথিবীর ক্ষণজীবী মানব সন্তান থেকে দীর্ঘজীবী মানবিক মানুষে বা অতি-মানবে পরিণত হয়েছেন। এরই ফলে এ-দুজন মানব থেকে মিথিক্যাল চরিত্রের সেরা আকর হয়ে উঠেছেন।

‘পরী’কে আমরা মিথ চরিত্র বলবো না-কি লোকগল্পের নায়িকা হিসেবে ধরবো। মানবাকৃতি নারী এই চরিত্রটিকে মুসলমানেরা মনে করে আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি জিন এবং পরী। এরা বর্তমান। লোকগল্পেও আমরা পাই জিন-পরীদের ব্যাপক উপস্থিতি। যে-কোনো অসম্ভব কাজ তারা সম্পন্ন করে নিমেষেই। জিন-পরীরা অলৌকিক, আগুনের উপাদানে সৃষ্ট বলে এরা মানুষের চেয়ে ক্ষিপ্রগতির ও ক্ষমতাশালী। আমি নিজেও আমার বহু কবিতায় পরীদের ব্যবহার করেছি। শামসুর রাহমানের কবিতায় সেই অলৌকিক পরী নানামাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। তার ‘তার শয্যার পাশে’ কবিতায় লিখেছেন তিনি ‘ দেয়ালে আলোর পরী’। এখানে পরী হচ্ছে পড়ন্ত বিকেলবেলার সোনালু আলো। কবির মনে হচ্ছে ওই আলো পরীর মতো আলোময়। পরী যে আলোময় অলৌকিক নারী, এই চেতনা থেকেই করি এই মিথিক তুলনাটি নির্মাণ করেছেন। এ-কবিতায় আছে ‘অপদেবতা’ শব্দটি। এটিও লৌকিক শব্দ। লোকসমাজ অপদেবতা, ভূত-প্রেত ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে। ফলে এরা মিথ চরিত্রের মধ্যে পড়লেও এদেরকে পন্ডিতেরা লোকপুরাণের আওতায় ফেলেছেন। যদিও আমার ধারণা মিথ-লোকপুরাণ সবই লৌকিক সমাজসৃষ্ট। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতিজাত। শামসুর রাহমান লিখেছেন ‘ছায়াচ্ছন্ন অপদেবতার অমর্ত্য চোখের নিচে রাত’। রাতকে বিশেষায়িত করেছেন অমর্ত্য অপদেবতার সাংস্কৃতিক চরিত্রের প্রেক্ষণ  থেকে। এটিও লোক বিশ্বাসের অন্তর্গত। প্রকৃতপ্রস্তাবে শামসুর রাহমানের কবিতায় গ্রেকো-রোমান-মিথের ব্যবহারের প্রথম কাজটি ‘ টেলেমেকাস’ কবিতায়। গ্রীক মিথের অন্যতম চরিত্র অডিসিউসের পুত্র টেলেমেকাস। অডিসিউস ইথাকার রাজা। ট্রয়যুদ্ধে তার পরিকল্পনার জন্য গ্রীকরা বিজয়ী হতে পারে। যুদ্ধশেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় সমুদ্রদেবতা পোসাইডনের কোপে পড়ে পথভ্রষ্ট হন অডিসিউস। এবং কুহিকিনী শার্শিকে বিয়ে করে সেখানে বসবাস করতে বাধ্য হন।  শিশুপুত্র টেলেমেকাস পিতার প্রত্যাবর্তন নিয়ে দুর্ভাবনাতাড়িত।  সেই কাহিনীই এ-কবিতার উপজীব্য। হোমার তার অডিসি মহাকাব্যে টেলেমেকাসকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে দাড় করিয়েছেন। এ-কবিতা ছাড়াও ডেডেলাস, ইকারুসের আকাশ, ইলেক্ট্রার গান,একিলিসের গোঁড়ালি,হোমারের স্বপ্নময় হাত- এ-সব কবিতাকেই গ্রেকো-রোমান মিথের নামবাচক বলে চিহ্নিত করা যায়। এ-ছাড়া আরও কিছু কবিতায় মিথের ব্যবহার আছে, কিন্তু এতোটা উত্তুঙ্গ নয়। কয়েকটি স্তবক উদ্ধৃত করে শামসুর রাহমানের মিথপ্রীতির উল্লেখ করা যাক।

   তুমি নেই তাই বর্বরের দল করেছে দখল

   বাসগৃহ আমাদের। কেউ পদাঘাত করে, কেউ

   নিমিষে হটিয়ে দেয় কনুই-এর গুঁতোয় আবার

   ‘দুধ খাওগে হে খুকুমণি’ বলে কেউ তালেবর

   দাড়িতে বুলোয় হাত। পিপে পিপে মদ শেষ, কতো

   ঝলসানো মেষ আর শুয়োর কাবার, প্রতিদিন

    ভাঁড়ারে পড়ছে টান। থমথমে আকাশের মতো

   সমস্ত ইথাকা, গরগরে জনগণ প্রতিষ্ঠিত

   অনাচার, অজাচার ইত্যাদির চায় প্রতিকার।

   [টেলেমেকাস/ নিরালোকে দিব্যরথ]

রাজাশূন্য রাজ্যের কি অবস্থা হতে পারে, টেলেমেকাসের বর্ণনায় সেই সত্যই উঠে এসেছে। অডিসিউস দেশে না থাকায় ইথাকা এখন প্রতিবেশি রাজাদের দ্বারা নানা ভাবে আক্রান্ত। স্থানীয় জোতদাররা নানা কৌশলে লুটে নিয়ে যাচ্ছে সব কিছু। ভাঁড়ারের খাদ্যও শেষ হবার পথে। সেই সাথে টেলেমেকাসের সতী-স্বাধ্বী মা পেনেলোপীকে উত্যক্ত করছে প্রাণীপ্রার্থীর দল। কিন্তু পেনেলোপী প্রোষিতভর্তৃকা নারী। তিনি স্বামীর আগমনের প্রতীক্ষায় কাতর। এই মিথিক কাহিনী কেন কবিতায় আনলেন শামসুর রাহমান, সেই সংগুপ্ত অভীপ্সা জানা জরুরি। নিরালোকে দিব্যরথ’ কাব্যগ্রন্তটির রচনাকাল পাকিস্তানি শাসনামলের শেষ দিকে। দেশে চলছে নৈরাজ্যকর সামাজিক ও রাজনৈতিক হানাহানি। জনগণ এই সব অনাচার অজাচারের প্রতিকার চায়, কিন্তু তা না পেযে তারা হতাশ। কিশোর টেলেমেকসের জবানিতে ফুটে উঠেছে সেই সময়কার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি-‘ভাবি লম্পট-জোচ্চোর আর ঘাতকের বীভৎস তান্ডব/ কবে হবে শেষ? সূর্যগ্রহণের প্রহর কাটবে/ কবে? জননীর মতো চোখ রাখি সমুদ্রে সর্বদা।’ এ-প্রতিবেশ তো গত শতকের ষাটের শেষ দিককার রাজনৈতিক অভিঘাত!

‘নো এক্সিট’ কবিতার কয়েক পঙক্তিতে পাওয়া গেলো গ্রেকো-রোমান মিথের পরোক্ষ ব্যবহার। ‘ এতদিনে জেনে গেছি/আমার কর্কশ অভিশাপে/ কোনো নারী গাছ কিংবা প্রতিধ্বনি হবে না কখনো,’- এই পঙক্তিটিতে শামসুর রাহমান দুটি গ্রেকো মিথের সমীকরণের সাহায্যে নিজের মনোবাসনার বর্ণনা করেছেন। সাইপ্রাসের রাজা সাইনিরাসের কন্যা মিরা নিজের রুপের অহংকারে দেবি আফ্রেদিতিকে অসম্মান করলে দেবির অভিশাপে মিরবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়। রাহমান এই মিথিক পারম্পর্যের সাথে ইকোর পরিণতিকেও মিশিয়েছেন দুর্ভাগ্যের নমুনা হিসেবে। স্বর্গদেবতা জিউসের স্ত্রী দেবী হেরার অভিশাপে পর্বত পরী ইকো তার বাকশক্তি হারায়।

ইকারুসের আকাশ কবিতায় শামসুর রাহমান এক তরুণের স্বাধীনতার ইচ্ছা-স্বপ্নকেই রূপায়িত করেছেন, যা গ্রেকো মিথের ইকারুসের ছিলো। যে কোনো তরুণ চায় বাবা-মায়ের শাসন আর নিয়ন্ত্রণের শেকল ছিঁড়ে ‘স্বাধীন’ হতে। ইকারুসও চেয়েছিলো। তার সেই ইচ্ছা-স্বপ্ন বাস্তবায়নে গেলে তার অপ্রতিরোধ্য উচ্চাভিলাষের কারণে মোমের সাহায্যে লাগানো পাখির পালকের পাখা সূর্যেও তাপে গলে গেলে তার পতন হয় সমুদ্রসলিলে, এবং তার মৃত্যু ঘটে। ‘ তাই কামোদ্দীপ্তা যুবতীর মতো/প্রবল অপ্রতিরোধ্য আমার উচ্চাভিলাষ আমাকে অনেক/ উঁচুতে মেঘের স্তরে স্তরে/ রৌদ্রের সমুদ্রে নিয়ে গেলো।...অর্জন করেছি আমি অকাল লুপ্তির বিনিময়ে/সবার কীর্তনযোগ্য গাথা,/যেহেতু স্বেচ্ছায়/করেছি অমোঘ নির্বাচন/ ব্যাপ্ত জ্বলজ্বলে, ক্ষমাহীন, রুদ্র নিজস্ব আকাশ।’ [ ইকারুসের আকাশ]

 ইকারুসের এই স্বনির্বাচিত আত্মহননের কারণ তার জবানিতেই মেলে। ঈগলের মতো আকাশে উড়ার দুর্নিবার সাধ আর উপরে উঠার উচ্চাভিলাষই ইকারুসের এই পরিণতি। এ-জন্য উচ্চাভিলাষ ভালো কিছু নয়। অভিলাষ থাকা ভালো, যা বাস্তব আর সাধনযোগ্য, পাখির মতো উড়ার শখ, পাখির পালকের ডানা দিয়ে, তা আত্মহননেরই সামিল।

‘ইলেকট্রার গান’ গ্রেকো-মিথের এক এরিনিজ চরিত্র। এরিনিজরা পিতামাতার হত্যাকারীদেও বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্রমে নিজেদেও এই চরিত্রে উপনীত করেছে।ইরেকট্রা এই এরিনিজ চরিত্রে নিজেকে রূপায়িত কওে নেয় পিতৃহন্তার কারণে। ইলেকট্রার পিতা ট্রয়যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আগামেমনন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই স্ত্রী কাইটেমনেস্ট্রা ও এজিস্থাসের হাতে নিহত হন। পিতৃহন্তার প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি ছোটোভাই ওরেস্টসকে উত্তেজিত করে  মা কাইটেমনেস্ট্রা ও এজিস্থাসকে হত্যা করারজন্য। এ-কাজে ওরেস্টস সফল হয়। মাকে হত্যার অপরাধে এরিনিজ কন্যাত্রয ওরেস্টসকেও দাওয়া করে। শেষে ওরেস্টস দেবী আর্টেমিসের পরামর্শে এরিনিজদের নামে একটি মন্দির নির্মাণ করে, যার নাম রাখা হয় ইউমেনিডিস বা দয়ার দেবী।

        নন্দিত সেই নায়ক অমোঘ নিয়তির টানে

        গরীয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধসে।

        বিদেশি মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভূমে,

        নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাঁকে সহসা হেনেছে ওরা।

      

       নিহত জনক, এ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।

       [ ইলেক্ট্রার গান/ইকারুসের আকাশ]

উদ্ধৃত পঙক্তিগুলোপড়রেই বোঝা যায় শামসুর রাহমান কি কথা বলতে চাইছেন। ট্রয় যুদ্ধ জয়ের মহানায়ক আগামেমনন নিজ বাসগ্রহে স্ত্রী ও এজিস্থাসের হাতে নিহত হলেন। তার আপন লোকেরাই তাতে হত্যা করলো। এই গ্রেকো-কাহিনী যেন অবিকৃতভাবে ফলেছে বাংলাদেশের যুক্তিযুদ্ধেও মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবনে। তিনি নিহত হয়েছেন তারই রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধুদেও হাতে, সপরিবারেপ্রায়। কেবলমাত্র দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও রেহানা বাদে তার বংশ নিশ্চিহৃ করেছে ঘাতকেরা। শামসুর রাহমানের এ-কবিতায় আবহ বা পটভূমি বাংলাদেশের। আর শেখ হাসিনা হচ্ছেন সেই ইলেকট্রা, যিনি পিতৃহন্তারকদেও বিরুদ্ধে নিয়োজিত। তিনি রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার কওে [ ইলেকট্রা করেছিলেন ছোটো ভাইকে] হত্যাকালীদের বিচারের সম্মুখীন করেছেন এবং তাদেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে প্রতিশোধ তুলেছেন। মানতেই হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যার শোধ পুরোপুরিই তুলেছেন তিনি। এবং তা যথার্থই করেছেন। মা কাইটেমনেস্ট্রাকে হত্যার অপরাধে এরিনিজ কন্যারা ওরেস্টসের পিছু নিয়েছিলো, শেখ হাসিনার কিন্তু সেই দায় এখানে নেই। শামসুর রাহমানও সেই কাহিনীর রাজপথ ধরে হাঁটেননি। জাতির কাধে যে অপরাধের চাপটি ছিলো, আজ তা নেমে গেছে।

ডেডেলাস কবিতাটি মূলত ইকারুসকে হারানোর পর পিতার আত্মবিলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আবার তিনি গর্বিত ছেলে ইকারুসের উচ্চাভিলাষে, স্বাধীনতায়।

    কিন্তু সে তরুণ, চটপটে,ঝকঝকে, ব্যগ্র, অস্থির, উজ্জ্বল,

    যখন মেললো পাখা আমার শিল্পের ভরসায়,

    গেলো উড়ে উর্ধ্বে, আরও উর্ধ্বে, বহুদূরে,

সূর্যের অনেক কাছে,প্রকৃত শিল্পীর মতো সব

বাধা, সতর্কতা

নিমেষে পেছনে ফেরেও, আমি

শঙ্কিত অথচ মুগ্ধ রইলাম চেয়ে

তার দিকে, দেখলাম তাকে

পরিণাম বিষয়ে কেমন

উদাসীন,ক্রুর, রৌদ্রঝলসিত, সাহসী, স্বাধীন।

[ডেডেলাস/ ইকারুসের আকাশ]

শামসুর রাহমান নিজেও উচ্চাভিলাষী ছিলেন। আমার ধারণা প্রত্যেক নির্মাতাই উচ্চাভিলাষী, তবে সবসময় সতর্ক তার রচনা ও সৃজন নিয়ে। ইকারুসের আকাশ নামটি যেমন সেই উচ্চাভিলাষকে আমাদেও মগজে ঠাঁই দেয়, তেমনি ডেডেলাস, সেই উচ্চাভিলাসকে নিশ্চিত করেও যে রাহমানের চিন্তার বড় অংশ জুড়ে আছে উচ্চাভিলাষ, ছিলেন স্বাধীনতার অপার রহস্যময় সত্তার অধিকারী তিনি। আরও বহু কবিতায়ই গ্রেকোরোমান মিথের মিশ্রণ আমরা রাহমানের কবিতায় পাবো, তবে, যে উদ্যম আর লক্ষ্য নিয়ে তিনি এ-গুলো সৃষ্টি করেছেন, তার মূল্যায়ন অবশ্যই করা উচিৎ।

Poetmahbub03@yahoo.com