আল মাহমুদ জামায়াতি হলে কোনও ক্ষতি নেই: কবি রাজু আলাউদ্দিনের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jul 6, 2012 4:48:38 AM

প্রকাশিত বই: আলাপচারিতা : রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ক সাক্ষাৎকার, পাবলো পিকাসো নারী বদলের শিল্পী, খ্যাতিমানদের মজার কাণ্ড, তোমার কাছে আমার হৃদয়, প্রসঙ্গ বোর্হেস, কথোপকথন (বিশ্ব বরেণ্য লোক-শিল্পীদের সাক্ষাৎকার) বিদেশী ভাষায় রবীন্দ্রনাথের আলাপচারিতা, টেডহিউজের নির্বাচিত কবিতা

দুপুর মিত্র: আপনি হুমায়ুন আজাদসহ অনেকেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কোন বিষয়টি আপনার ভাল লাগে নি এবং কোন বিষয়টি আপনার ভাল লেগেছে।

রাজু আলাউদ্দিন: হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সবই আমার ভালো লেগেছে। তার সঙ্গে কথা বলাটা ছিলো এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। তিনি যখন নিন্দা করেন বা কোন কিছুর বিরোধিতা করেন তখন সেটাও উপভোগযোগ্য হয়ে ওঠে তার অসামান্য রসবোধের কারণে। এমন কি তিনি যখন সাক্ষাৎকারে কোন কোন প্রশ্নের বা মতের বিরোধিতা করেছেন সেটাও আমি উপভোগ করেছি।

দু: জীবিতকালীন হুমায়ুন আজাদ আর মৃত্যুর পর হুমায়ুন আজাদ, এই দুইয়ের পার্থক্য কি?

রা: এ দুয়ের পার্থক্য বিশাল। তিনি ছিলেন আমাদের প্রথম এবং একমাত্র ননফিকশনস লেখক যিনি বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। উপন্যাস বা গল্প না লিখে কেবল প্রবন্ধ লিখে কেউ জনপ্রিয় এবং জননন্দিত হতে পারেন তা হুমায়ুন আজাদই প্রথম প্রমাণ করলেন বাংলা সাহিত্যে। কিন্তু তিনি যদি আক্রান্ত না হতেন এবং সবশেষে মারা না যেতেন তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম না মানুষ তাকে কতটা ভালো বাসতেন। জীবিত হুমায়ুন আজাদ অবশ্যই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী ছিলেন। রাজনৈতিক, সামাজিক নানা অসঙ্গতি সম্পর্কে মৃত হুমায়ুন আজাদ কোন বিতর্কিত উত্তেজক ও মনমুগ্ধকর কিছু লিখছেন না বা মন্তব্য করতে পারছেন না এটা একটা বড় এবং অমোচনীয় পার্থক্য। তাঁর মতো সাহস, পান্ডিত্য আর সততা এখন আমি কোন লেখকের মধ্যেই দেখি না।

দু: হুমায়ুন আজাদ আল মাহমুদের কবিতা সংকলনে নেন নি। এজন্য তিনি তার এই সাম্প্রদায়িকতাকেই দায়ী করেছেন। কিন্তু আপনি যখন সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তখন তাকে কবি বলেই সম্বোধন করছেন। এক্ষেত্রে আপনার মতামত জানতে আগ্রহী।

রা: আল মাহমুদের কবিতা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত না করার ব্যাপারে তার আসলেই কোন সদুত্তর ছিলো না। সেটা বোধ হয় ওই সাক্ষাৎকারেই স্পষ্ট হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা কোন অজুহাতই হতে পারে না। কেউ যদি ভালো কবিতা লিখে আর সে যদি সাম্প্রদায়িক হয় তাতে করে কাব্যপাঠে তো কোন বিঘ্ন ঘটার কথা নয়। অসাম্প্রদায়িক লোকের অকবিতা পাঠের চেয়ে আমি কোন সাম্প্রদায়িকের ভালো কবিতা পড়তেই বেশি আগ্রহী।

দু: আমার যতদূর মনে পড়ে, মানবজমিনে থাকাকালীন হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ ছফাকে নিয়ে ধারাবাহিক বিতর্কের আয়োজন করেছিলেন। এ নিয়ে কিছু বলুন।

রা: বিতর্কের আয়োজন করেছি—এ কথাটা ঠিক নয়। তারা নিজেরাই বিতর্কে জড়িয়েছেন। সত্য বটে, আমার করা প্রশ্নের উত্তরের সূত্রেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তারা তর্ক করতে না চাইলে আমার কী সাধ্য তাদেরকে বিতর্কে জড়ানোর। তবে বিতর্কটা বেশ জমে উঠেছিলো।

এ ধরনের বিতর্ক কিন্তু সব কালেই সব দেশে সাহিত্যিক পরিমন্ডলে ঘটেছে। ভবিষ্যতেও আশা করি ঘটবে। এটা খারাপ কিছু না।

দু: ছফা সম্পর্কে আপনার মতামত কি? আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা আর ব্যক্তি ছফার মধ্যে পার্থক্য কি?

রা: ছফা ভাইকে আমি অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষ হিসেবে দেখি। রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ, ইতিহাস এবং সাহিত্য তাঁর মতো এতো সংবেদনশীলতা ও সঠিক পর্যবেক্ষণসহ খুব কম লেখকই দেখতে পেরেছেন। তার উপন্যাসগুলো হয়তো দীর্ঘায়ু পাবে না, কিন্তু বুদ্ধিজীবীতার ইতিহাসে এবং মননশীলতার ইতিহাসে বাঙ্গালির ইতিহাসে তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। বাঙ্গালির মননশীলতার ধারাকে সঠিক পথে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের তুলনাহীন এক কান্ডারী। ব্যক্তি ছফার সঙ্গে মননের ছফার কোন পার্থক্য আমি পাই নি। তিনি এমন কিছু করতেন না যা তার ভাবনার বিপরীতে যায়।

দু: শামসুর রাহমানকে আপনার কেমন কবি মনে হয়?

রা: শামসুর রাহমানের কবিতা দিয়েই আমি পাঁচের দশকের কবিতা পাঠ শুরু করেছিলাম। কিন্তু শামসুর রাহমানে মুগ্ধ ছিলাম না। আমি মুগ্ধ শহীদ কাদরীতে।

শামসুর রাহমান অতিমূল্যায়িত। কিন্তু অতিমূল্যায়নের মুর্খতার মধ্যে তার সঠিক মূল্যায়নটি হয়নি। যদি হতো তাহলে উচ্ছ্বাস সরিয়ে তাকালে দেখা যেত তিনি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ মাঝারি মানের কবি মাত্র।

দু: সম্প্রতি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আপনি। জামায়াত ইসলাম সম্পর্কিত বেশ কিছু বিষয় আপনি সেখানে প্রশ্ন করেছেন। আল মাহমুদের এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

রা: সম্প্রতি নয়, এটি আমি নিয়েছিলাম ১৪ বছর আগে। তবে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ১০/১১ বছর পর।

আল মাহমুদ কবি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ--এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি জামায়াতের রাজনীতি হয়তো সমর্থন করেন না, কিন্তু যেহেতু তাদের নজরানা তিনি গ্রহণ করেন তাই ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারেন না। এটা মানুষ হিসেবে তার অসততা। তবে এই অসততা দিয়ে তিনি নিজের কবিতাকে কলুষিত করেন নি।

দু: আপনি বেশ অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে সাক্ষাৎকারের বিষয়টা কি সাহিত্য হয়ে উঠতে পেরেছে? এর সীমাবদ্ধতা, নান্দনিকতা এসব নিয়ে যদি কিছু বলতেন।

রা: আমাদের দেশে সাক্ষাৎকারকে সত্যি সত্যি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন ব্রাত্য রাইসু এবং আমি। সাজ্জাদও কিছুটা। সাক্ষাৎকারকে শিল্প মাধ্যম হিসেবে দেখা হয় কিনা জানি না। তবে সাক্ষাৎকারে সৃষ্টিশীলতার অবকাশ অবশ্যই আছে। আমি মনে করি এটি একটি যৌথ সৃষ্টিকর্ম। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী যদি চৌকশ, বুদ্ধিমান এবং একই সঙ্গে সংবেদনশীল ও বিস্তর পাঠের অধিকারী হন তাহলে সাক্ষাৎকারদাতার কাছ থেকে যতটুকু আদায় করা সম্ভব বলে মনে হয় তিনি তার চেয়েও বেশি আদায় করতে পারেন নিপুণ ও সতর্ক দক্ষতায়। বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে বক্তার বক্তব্যের সংযোগ করার ক্ষমতা থাকলে আশাতীত ফল পাওয়া সম্ভব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এই ক্ষেত্রটি প্রায় ফাকাই পরে রইলো।

দু: আপনার মাসুদ খানকে কোট করে লেখা একটি কবিতা পেলাম সাময়িকী ডট নেটে। বলা হয় বা জোর করে বলিয়ে নেওয়া হয় যে, মাসুদ খানই বাংলাদেশের এখনকার প্রধান কবি বা বিশেষ কবি এই জাতীয়। এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

রা: মাসুদ খান আমার প্রিয় কবি। আমি বলবো আমাদের সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন। আমাদের একটা আধি হচ্ছে একজনের বেশি মেনে না নেওয়া। অন্য দেশের উদাহরণ না দিয়ে আমাদের দেশের ছয়ের দশকের কবিদের কথাই ধরুন। মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুন -এরা সবাই কিন্তু কবি হিসেবে কেউ কারো চেয়ে খাটো নন। এদের প্রত্যেকের প্রবণতাও ভিন্ন, ভাষাভঙ্গীও আলাদা। এদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেয়া এবং প্রধান হিসেবে দেখানো মানে হয় আমাদের রুচির বিস্তারের অভাব অথবা নিহিত দুর্বৃত্তপনা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা ভাষায় আর কোন নজির নেই যিনি তাঁর সমকালের অতুলনীয় প্রধান কবি হিসেবে ছিলেন। এগুলো হচ্ছে হীনম্মন্যতা ও মুর্খতা থেকে উত্থিত বিষয়।

দু: মাসুদ খান-সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ-সাজ্জাদ শরিফ- মজনু শাহ্ এবং হালের সোহেল হাসান গালিবকে একেবারেই সাহিত্য সন্ত্রাসী হিসেবে দেখেন অনেকে। মানে কবিতার ক্ষমতায়ন করেন তারা তাদের সামাজিক(অসামাজিক) ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে। এর ভিতর দিয়েই তারা প্রথম আলো, লিটলম্যাগ, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এসবকে এক করে বিরুদ্ধ মতকে বা যারা তাদের মত ভাবতে চান না বা তাদের মত কবিতাকে দেখেন না তাদেরকে আলাদা করে দেন এবং হেয় করেন।

রা: প্রায় এক যুগ দেশের বাইরে থাকায় সাহিত্যিক সন্ত্রাস বা দুর্বৃত্তপনা দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয় নি। এসব অভিযোগের কথা বলেছে অনেকে। তবে আমি দেখিনি বলে যে তা অসত্য হবে তা আমি বলছি না। যখন একাধিক লোক একই বিষয়ে অভিযোগ করছেন তখন তা সত্যি না হয়ে উপায় কী। তবে মাসুদ খানও এ রকম তা আমার বিশ্বাস হয় না। তিনি সাহিত্যিক সন্ত্রাসী--এটা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়। আমার ধারণা যারা এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হোতা তাদের সাথে বহু আগে থেকেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে বলেই হয়তো তাকেও সন্ত্রাসী বলে মনে হচ্ছে। তবে সাজ্জাদ শরিফ সম্পর্কে সাহিত্যিক দুর্বৃত্তপনার কথা এত শুনেছি যে এটা আমার কাছে এখন আর নতুন কিছু মনে হয় না। দেশে এসে শুনেছি এই ধরনের দুর্বৃত্তপনার কারণে নাকি তাকে একবার এক তরুণ তার অফিসে গিয়ে চড় মেরেছিলো। ঘটনাটা কতটা সত্যি জানি না।

কিন্তু আপনাকে আমি প্রশ্ন করিঃ আপনি যাদের লেখা বা কবিতা পছন্দ করেন তারা কি দুর্বৃত্তপনার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে নাকি ভালো লিখেই বড় হয়েছে?

অলেখকরা দুর্বৃত্তপনার আশ্রয় নিয়ে পোটকা মাছের মতো বড় হয়ে উঠবে। আপনি তো জানেনই ও আসলে বড় নয় ও আতংকে বড় হয়ে আছে। ওটাই ওর আত্মরক্ষার উপায়, ওর ছোট্ট অস্তিত্বকে বাঁচানোর উপায়। সাহিত্যের এসব আবর্জনা নিয়ে কথা বলাটাও সময়ের অপচয় মাত্র।

দু: লিটলম্যাগকে প্রথমে গ্রাস করা শুরু করে যে দৈনিক বা যে ব্যক্তি তার নাম আবু হাসান শাহরিয়ার। তিনি দেশ জুড়ে তরুণদের কবিতা ছাপিয়ে লিটলম্যাগ আন্দোলনের বা দৈনিক বিরোধিতা করে এমন একটি বিকল্প ধারার সাহিত্য চর্চাকে নষ্ট করে দেন। এর পর এর সাথে যুক্ত হন শামীম রেজা। সম্প্রতি সাজ্জাদ শরিফরা একেবারেই মাঠে নেমে পড়েন। তারা ভিন্নতর একটা জায়গা তৈরি করেন যে আমাদের দেশে দৈনিক পত্রিকা একেবারেই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে নি, কাজেই লিটলম্যাগের দৈনিকের বিরোধিতার বিষয়টা একেবারেই ভূয়া। এবঙ তারা এমন একটা তরুণগোষ্ঠীকে হাতে টেনে নেন যারা একই সাথে কিভাবে দৈনিকে লেখা যায় বা লবিং করতে হয় তা শেখান এবং কিভাবে লিটলম্যাগ তৈরি করতে তাও শেখান। এ বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

রা: আপনার এই প্রশ্নের সাথে আমার একটু দ্বিমত আছে। (১) কোন তরুণ যদি বিকল্প ধারার কবিতা লিখতে চায় আর সেটি যদি আবু হাসান শাহরিয়ার দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করেন তাহলে তো আমি বলবো তিনি প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। (২) কোন তরুণ যদি মনে করে সে লিটলম্যাগেই চর্চা করবে, তাহলে তাকে আপনি চাইলেও দৈনিকে আনতে পারবেন না যদি সে মনে করে এতে তার ক্ষতি হবে।

আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের সাথে আমি একমত। আপনি যে-দুজনের নাম বললেন, এরা যতটা না লেখক তার চেয়ে বেশি সাহিত্যের দুষ্টায়নে তুখোড়। এরা খ্যাতি ও প্রতিপত্তির ভিখাড়ী তরুণদেরকে নিজেদের দৈনিক সাহিত্য পাতায় লেখার সুযোগ দিয়ে নিজেদের সাহাবা বানিয়ে নিচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত কোন তরুণ প্রতিভার দেখা মিলবে না ততদিন পর্যন্ত এই সব অপদার্থ ও অযোগ্যরাই রাজত্ব করবে। এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভালো লেখাই হচ্ছে এর উত্তম জবাব। গ্যোটে তো অনেক আগেই এদের সম্পর্কে বলে গেছেন: প্রতারণার যুগ আসছে.... অপদার্থরা করবে প্রভুত্ব বিস্তার আর কাপুরুষদের হাতে বন্দী হবেন বীরগণ।”

দু: শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদকে ঘিরে মিডিয়ার রাজনীতি অনেক পুরুনো। এটা নিশ্চয়ই স্বীকার করি বা জানি যে কেউ আওয়ামীলীগের বিরোধিতা করলেই আওয়ামী বিরোধী হয়ে যান না, বা কেউ ইসলামের পক্ষে কথা বললেই জামায়াত হয়ে যান না। কিন্তু যে রাজনীতিটা দেখা গেল প্রগতিশীল চর্চা করতে করতে শামসুর রাহমান একেবারেই আওয়ামীলীগের পেটে ঢুকে গেল। আর এদিকে আল মাহমুদ ঢুকে গেল জামায়াতের পেটে। আল মাহমুদের জামায়াত সংশ্লিষ্টতার সুস্পষ্ট নজির থাকার পরও একটা সাহিত্যের গ্রুপ দেখা গেল সে যাই করুক আল মাহমুদ কবিতা ভাল লিখেন। আবার হুমায়ুন আজাদকে দেখা গেল আল মাহমুদকে একেবারেই খারিজ করে দিতে। এ বিষয়গুলোকে আপনি কিভাবে দেখেন?

রা: রাজনীতির সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট না হলেও যেকোন লেখকই কোন না কোনভাবে রাজনৈতিক সত্ত্বাই। আল মাহমুদ জামায়াতি হলে কোনও ক্ষতি নেই। কারণ ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে একজন মাঝারি মাপের রাজনীতিবিদ সেটাকে প্রতিহত করতে পারবেন। আমি শংকিত হবো তখনই যদি তিনি জামায়াতি ভাবাদর্শ দ্বারা কবিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করেন। এই ক্ষতিটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। যেমন ধরেন বঙ্কিমচন্দ্র লেখক হিসেবে যদি সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে দূরদর্শি হতেন তাহলে তার রচনা আজকে মৌলবাদীদের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারতো না। সেকালে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক বৈরিতার কথা তিনি জানতেন। তিনি এ বিষয়ে সতর্ক থাকলে বা সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকলে তার লেখা অন্য রকম হতো। এই দিক থেকে দেখলে আল মাহমুদ সে ভুল করেন নি বলে মনে হয়। আর এই কারণেই তার জনগ্রাহিতা, তার প্রতি মানুষের ঔৎসুক দিনদিন বাড়ছেই। কিন্তু শামসুর রাহমানের বেলায় ঘটনা ঘটেছে উল্টোভাবে। তিনি আওয়ামী ভাবাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, কিন্তু আওয়ামী বন্দনামূলক কবিতা তিনি লেখেন নি। কিন্তু তিনি জনপ্রিয় উপাদান নিয়ে প্রচুর হালকা কবিতা লিখে কবিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।

দু: আমাদের দেশে সাহিত্য চর্চায় বামপন্থীদের টাল বাহানা নিয়ে কিছু বলুন।

রা: বিশ ত্রিশ বছর আগেও বামপন্থী সাহিত্যিক ধারা বলে একটা কথা শুনা যেত। কিন্তু এখনও সে রকম কিছু আছে কি? সাহিত্যের আবার ডান/ বাম কী। সাহিত্য নিজেইতো একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ ধারা। রাজনৈতিক ধারার মতো সাহিত্যকে চিহ্নিত করা মানে সাহিত্যকে তার মূল লক্ষ্য থেকে অন্য এক উদ্দেশ্যপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা।

দু: এটা সত্যি যে আপনার অনুবাদ ও সাক্ষাতকারের বই প্রকাশের ভিড়ে আপনার নিজের কবিতা চাপা পড়ে গেছে বা এটা আমাদেরই ব্যর্থতা যে আপনার কবিতাকে আমরা আবিস্কার করতে পারি নি। আমাদের দেশের অধিকাংশ কবির কবিতা পড়ে এক লাইন মনে রাখা যায় না কিন্তু আপনার ১২-১৩টি কবিতা পড়েই একটা লাইন আমাকে বেশ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। 'আমি যত দূরে যাই

আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।' নিজের সৃষ্টিশীল জগতকে এভাবে চাপা দিয়ে রাখাটা কি ইচ্ছাকৃত? কবিতার বই প্রকাশ করেন নি কেন এখনও?

রা: আপনি ঠিকই বলেছেন, বিপুল পরিমাণ গদ্য আর অনুবাদের আড়ালে আমার কবিতা অনেকেরই নজরে আসে নি। এর পেছনে ব্যর্থতা আপনাদের নয়, আমারই। কারণ আমিতো বেশি কবিতা লিখিনি বা লেখার সুযোগ পাই নি। তবে কিছুটা আত্মশ্লাঘার মতো শোনালেও সত্যের খাতিরে অবশ্যই স্বীকার করবো যে আমি অল্প হলেও স্মরণীয় কিছু পংক্তি লিখেছি। আমার কয়েকটি কবিতা অনেক প্রবীণ এবং নবীন লেখক /পাঠকের খুবই পছন্দ। তারা অভিযোগ করেন কেন কবিতা কম লিখি।

আমি প্রবল তাগিদ বোধ না করলে কবিতা লিখি না। বানিয়ে বানিয়ে, ইনিয়ে বিনিয়ে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করেনা। প্রবল ঘোরের মধ্যে কবিতার স্ফুরণ না ঘটলে আমি কবিতা লিখতে বসি না। এ জন্যেই কবিতা কম লেখা হয়েছে।

তবে কম লিখলেও, বাইরে থেকে একে যতই প্রচলিত ধারার মনে হোক না কেন আমি ভেতর থেকে বদলে দেয়ার চেষ্টা করেছি। আপনি যে কবিতাটির কথা বললেন, ওটা বাংলাদেশ বা স্বদেশ নিয়ে একটি একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা। কবিতাটি প্রকাশের পর অনেকেই আমাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। এমনও বলেছিলেন কেউ কেউ যে আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত, গুরুত্বহীন এই ছোট্ট দেশটি সম্পর্কে নতুন ধরনে আস্থাবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি কবিতাটি। সবচেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট জানিয়েছিলেন কবি জাহিদ হায়দার। বলেছিলেন আমার বড় ভাই দাউদ হায়দার এত দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার পরও এ রকম একটি কবিতা লিখতে পারেনি। কিন্তু আপনি পেরেছেন। জাহিদ ভাইয়ের বলার আন্তরিকতা আর অনুভূতি জানানোর সততা আমাকে দারুন স্পর্শ করেছিল।

তবে ভালো কবিতা বা মহৎ কবিতা কবির অজান্তেই ভূমিষ্ট হয়। ওটা আয়োজন করে বুদ্ধি পাকিয়ে বানানোর কোন জিনিস নয়। কবিতা একটা বুনো ব্যাপার। ওটা নিজে নিজে জন্ম নেয়ার মতো একটা ব্যাপার। তবে ওর জন্মের অনুকূলে নিজেকেও প্রস্তুত রাখার একটা ব্যাপার আছে অবশ্যই। কখনো কখনো সে জন্মাতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কিংবা আমি যখন প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছি সে আসেনি। উভয় পক্ষের সমন্বয় কম ঘটেছে বলে আমার কবিতার সংখ্যা কম। তবে ইচ্ছে আছে আগামী বই মেলার কমসংখ্যক হলেও একটা কবিতার বই বের করার।