যে সাহিত্য মো. হাবিবুর রহমানকে কবি বানাতে চায়, তার কথা বলা মানে সময়ের অপলাপ: কবি কুমার চক্রবর্তীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 10, 2012 9:04:24 AM

প্রকাশিত বই: ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপ চিন্তা,শূন্যপ্রতীক্ষার ওতপ্রোতে আছি আমি আছে ইউলিসিস,অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা,কবিতার অন্ধনন্দন,হুমায়ুন আজাদ: মৃতদের সমান অভিজ্ঞ, মাত্রামানব ও ইচ্ছামৃত্যুর কথকতা, নোবেলজয়ী কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমারের স্মৃতির চাহনি: একটি স্মৃতিলেখ, হারানো ফোনোগ্রাফের গান।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

কুমার চক্রবর্তী: কেন কবিতা লিখি এর উত্তর হবে সেই জেন গল্পের মতো যা শেষাবধি গভীরতর নীরবতায় উপনীত হয়। জেন সুখী চিনেম্যানকে যখন তাঁর আচার্য জিজ্ঞাসা করেন জেন-এর তাৎপর্য কী, তখন তিনি নিস্তব্ধ উত্তরের মতো থলি মাটিতে নামিয়ে রাখেন; আবার যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, জেন-এর প্রয়োগ কী, তখন তিনি আবার থলেটা কাঁধে নিয়ে উঠে চলে গেলেন। অর্থাৎ নিরবতাই এখানে উত্তর । আসলে কেন কবিতা লিখি এর কোনো মৌলিক উত্তর হয় না। বস্তুত 'কারণ' থেকে কেউ কবিতা লেখা শুরু করে না, বরং লেখার পর কারণের উদ্ভব হয় আর তখন অনেকে এর দার্শনিক উত্তর নিয়ে উন্মথিত হয়ে পড়ে । এটা নিজেকে মায়াবীদর্শনাক্রান্ত করার এক উপায়। আমিও গদগদচিত্তে বলতে পারি, নিজেকে স্বাধীন করতে এবং সেই স্বাধীনতাকে উপভোগ করতেই কবিতা লিখি।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

কু: প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কেউ কবিতা লেখা শুরু করে না। তা করলে কবিতা লেখাই যায় না বলে আমি মনে করি। আসলে কবিতা লিখতে গিয়ে একজন কবি অর্জন করেন বা মুখোমুখি হন নানা বাস্তবতা ও ইন্দ্রিয়ানুসঙ্গের। উপ ও অধি, মনো ও জাগতিক বাস্তবকে নিজের ইন্দ্রিয়ে সূক্ষতমভাবে আত্মীকৃত করা এবং তার ফলাফলকে আবার ভাষায় প্রকাশ করা, এটিই কবিতার রসায়ন। এবং এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া যার ভেতর দিয়ে একজন কবিকে অন্তহীন ভ্রমণে মেতে থাকতে হয়। যে এই ভ্রমণকে প্রতিটি মুহূর্তে চলমান রাখতে পারে, পারে তার উদ্যাপনকে উপভোগ করতে, সেই অন্তত কবিতা লিখে যায়। আর আপনার প্রশ্নের সারাৎসারটি যদি বোঝায় পঠন-পাঠনের বিষয়টিকে তাহলে বলি, এটা অনস্বীকার্য নয়। পঠন-পাঠন থেকে কবিতা সৃষ্টি হয় না। আসল বিষয় হলো, জগৎ ও জীবনের সাথে আপনার একধরনের অদৃশ্য সম্পর্ক তৈরি হওয়া যা আপনার তরে চিন্তা ও অনুভূতির এক বিস্ময় এবং নন্দনের জন্ম দেবে, আর তা হবে অভূতপূর্ব, যা ভাষায় আত্মপ্রকাশিত হয়ে পাঠককে নতুন অভিজ্ঞতা এবং চৈতন্যের মুখোমুখি করে দেবে। পাঠক যারপরনাই হযে পড়বে বিপর্যিত ও সম্মোহিত। সুতরাং পঠন-পাঠনের প্রস্তুতি নয়, কবির জন্যে দরকার অদৃশ্য পর্যবেক্ষণ, অদৃশ্য সম্পর্ক স্থাপন ও তার শাব্দিক বিক্ষেপণ তৈরি করা। এটা অশেষ ও নিরন্তর। এবং এটাই প্রকৃত প্রস্তাবে প্রয়োজনীয়। পঠন-পাঠন পরোক্ষভাবে হয়তো একে সহায়তা করতে পারে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

কু: সমসাময়িকদের নয়, সমসাময়িক লেখা আমার ভালো লাগে, কারণ এতে আমি আমার আত্মার আয়নাকে খুঁজে পাই। পৃথিবীর সেরা একজন লেখকের চেয়েও আমার দেশের একজন নিভৃতচারি লেখকের লেখা যখন আমার কাছে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে হাজির হয় তখন কে আমার নিকট বড়ো হয়ে ওঠে? তবে আমি ব্যক্তিবাদী নই, মর্মবাদী অর্থাৎ লেখাবাদী। কোনো একজন লেখকের সকল লেখাই আমার পছন্দ হতে পারে না। কিন্তু তাই বলে অন্যের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতার সম্ভাবনা হ্রাস পায় না, এমনকি ভবিষ্যতে আমার কাছেও তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। লেখার পূনর্জন্ম হয়। তথাকথিত গৌণ কবির মধ্যেও আমি মাঝেমাঝে কিছু একটা পেয়ে যাই। আবার তাঁর গৌণত্বকে আমি উপভোগও করি। তথাকথিত সবল লেখকেরও দুর্বলত্বকে আমি আঁচ করতে পারি। সমসাময়িক লেখা যে আমার ভালো লাগে তার কারণ হলো, এসব লেখার রূপকত্ব আর সংশ্লেষের ক্ষমতা। যেখানেই নতুন অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা আবির্ভূত হয়, যেখানে হারমেনিউটিক জ্ঞান আত্মপ্রকাশ করে, যেখানে বাচনিক ক্ষেত্র নতুন ভাষার ও চিন্তার সন্ধান দেয়, সেখানেই আমি মুগ্ধ হই। নামোল্লেখ অপ্রয়োজনীয় কারণ এখন যার নাম করব তিনি পরক্ষণেই আমার কাছে নামহীন হয়ে পড়তে পারেন, তার স্থানে আসতে পারেন অন্য একজন। এক্ষেত্রে আমি আপেক্ষিকতাগ্রস্ত। তবে মজা লাগে যখন দেখি কেউ কেউ প্রিয়দের নাম নিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে, সেখানে এসে যায় এমন সব নাম যারা নিজের কবিতাটি এখন পর্যন্ত লিখতে পেরে উঠেননি। কেউবা নিজ ঘরানার বাইরে পা ফেলেন না। কেউবা আত্মসুবিধার জায়গা থেকে অনর্গল নাম বলতে থাকেন যেখানে থাকে নানা দেনা-পাওনার সরলতত্ত্ব। এ এক ট্রিভিয়ালিটি । তাদের পল্লবগ্রাহিতা আর কূপমণ্ডূকতা দেখে বিষণ্ন আমিও হাস্য করে উঠি।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

কু: এ প্রশ্নের উত্তর আগের উত্তরেই আছে, উলটো করে নিলেই হয়। তবে যা কিছু পছন্দের তা ব্যতীত অন্যকিছু অপছন্দের, ব্যাপারটা তা নয়। হয়তো তা তখনি মনোযোগ দাবি করে না। আমার কাছে সিগনিফিকেশন গুরুত্বপূর্ণ। যখন যা কিছু অর্থকরণ করে। তা সবকিছুতেই আগ্রহাতিশয্যের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তি অপছন্দের হতে পারে তবে তার সাহিত্য পছন্দের হতে বাধা নেই।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

কু: শূন্য দশকের কবিতায় নতুন কোনো প্যারাডাইম শিপ্ট আছে কি না তা ভেবে দেখা যেতে পারে। আমি শূন্য দশকের কবিতার সতর্ক ও মুগ্ধ পাঠক। সতর্ক কেননা এসব কবিতার গ্রীষ্ম ও শীতকালকে আমি ঠাওরাতে চেষ্টা করি। আর মুগ্ধ কেননা আমি এ দশকের কারও কারও কবিতায় প্রত্যাশিত ফাইনালিটির অন্বেষণকে খুঁজে পাই। এদের কতিপয় কবির কবিতায় আমি নতুন চিন্তার সংকেতকে পেয়ে যাই। অর্থাৎ কবিতা পেরোতে চাইছে। নব্বইয়ের কবিতার সংখ্যাগত ব্যাপকত্ব রয়েছে কিন্তু তা নিরেট নয়। আমার মনে হয় নব্বুইয়ের কবিতায় হারমেনিউটিক বিচিন্তা বেশি স্থান পেয়েছে। এ দশকেই বোধহয় কবিতার ভাষার অধিবিদ্যা ও যাপনের অবদমন এক অন্যমাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

কু: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের কবিতার মধ্যে ফারাক কী আছে জানি না তবে প্রবণতাগত কেন্দ্রিকতা আছে। বাংলাদেশের কবিতায় প্রথাগত ছন্দকে পরিহার ও প্রহার করার প্রবণতা আছে যা প্রকারান্তরে কবিতার এক বলয়বিশ্বকে প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনাকে হাজির করছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে প্রকৃতির অবকাশ ও জীবনের অন্যত্বে স্থির হওয়ার আকাঙ্ক্ষা । বাংলাভাষাবিশ্বের বহুলতাও বাংলাদেশের কবিতায় বেশি দৃশ্যমান। কবিতার ভাষা এখানে প্রাকৃতিকতায় জায়মানিত হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিম বঙ্গের কবিতায় ছন্দস্বাচ্ছন্দ্য বেশি। রিজমেটিক জীবন উঠে আসছে অন্তহীন শূন্যতায়। তার সাথে যুক্ত হচ্ছে বিভাজিত সত্তার লঘুত্ব ইত্যাদি।

কবিতা আসলে জীবনের উপস্থিত ও অনুপস্থিত বাস্তবতাকে ধারণ করে। সুতরাং স্থানভেদে তা ভিন্ন হলে কবিতা মেজাজে ও বাচনিকতায় আলাদা হয়ে যেতে পারে। এতে অবশ্য উচ্চত্ব ধরা পড়ে না। কবিতার মহত্ত্ব বোঝা যায় তার পুনর্পাঠ আর কৃত অর্থ যখন সারত্বে পরিণত হয়, সেই বহুমুখী অবস্থার ওপর। কবিতা যখন ছাড়িয়ে যেতে চায় তখনই প্রকৃত কবিতার জন্ম হয়। এ অর্থে বিশুদ্ধ কবিতাকে অর্জন করতে হয় মুক্তবেগ।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

কু: এ ব্যাপারে আমার প্রত্যক্ষ কোনো ধারণা নেই। শুনেছি এরকম কিছু-একটা আছে তবে সবিশেষ কিছু শুদ্ধভাবে জানি না। আর আমার সেখানে অংশগ্রহণের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

কু: এ বিষয়ে সম্যক ধারণা নাই। তবে মনে হয় লিটল ম্যাগ অধিকতর প্রসারিত ক্ষেত্র। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে লেখকের আত্মজ্ঞান, পাঠকের অহং আর যৌথ মনস্ত্বত্ত্ব।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

কু: পত্রিকার সাহিত্যের পেছনে প্রকৃত সাহিত্যরুচি থাকে না। থাকে শোভিনিস্ট কূপমণ্ডূকতা। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য হলো সেডিনট্রি লিটারেচার যা পুঁজি বা প্রতিষ্ঠান ধরে বসে থাকে। এর কাজ হলো মনগড়া কবি বা সাহিত্যিক বানানো। যে-সাহিত্য মো. হাবিবুর রহমানকে কবি বানাতে চায়, তার কথা বলা মানে সময়ের অপলাপ।