সাহিত্যের জন্য যেটুকু কাজ হচ্ছে, তা ওই দৈনিকের সাহিত্যপৃষ্ঠা ঘিরেই আবর্তিত: তপন বাগচীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 6, 2012 1:46:14 PM

তপন বাগচী, কবি, প্রাবন্ধিক। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় এমএ, পিএইচডি।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:: কবিতা: নির্বাচিত ১০০ কবিতা (২০১০), সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল (২০০৭), অন্তহীন তের গভীরে (২০০৫), শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি (১৯৯৬), কেতকীর প্রতি পপাত (১৯৯৬); ছড়াগ্রন্থ: ছন্দোবদ্ধ ভাবের পদ্য (২০১২), সকালবেলা স্মৃতির ভেলা (২০১১), সমকালে তমকালে (২০১০), খাচ্ছে ছুটি লুটোপুটি (২০০৯), মঙ্গা আসে ঘরের পাশে (২০০৮),স্বপ্নেবোনা তূণীরসোনা (২০০৭), চরকাবুড়ি ওড়ায় ঘুড়ি (১৯৯৫), রুখে দাঁড়াই বর্গী তাড়াই (১৯৯৪); কিশোরগল্প : সাতদিনের সাতকাহন (২০১১), শুভর শখের গোয়েন্দাগিরি (১৯৯৩); প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধ আখ্যান (২০১২), লালন মতুয়া লোকসংগীত সন্ধান (২০১২), সংবাদের ভাষা ও সাময়িকপত্র পর্যালোচনা (২০১২), সাহিত্যের মধ্যমাঠ থেকে (২০১২), রবীন্দ্রসাহিত্যে নতুন প্রেক্ষণ (২০১২), কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি (২০১১), সাহিত্যেও সঙ্গ ও অনুষঙ্গ (২০১১), চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (২০১০), লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ (২০০৮), বাংলাদেশের যাত্রাগান: জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেতি (২০০৭), মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ (২০০৭), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: চন্দ্রাহত অভিমান (২০০২); সাহিত্যের সাম্প্রতিক পাঠ (২০০১), নির্বাচন সাংবাদিকতা (২০০১), নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার (২০০০), তৃণমূল সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশ (১৯৯৯); জীবনী: বিপ্লব দাশ (২০০১), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৯৮)। বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পরিষদ, বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ ফোকলোর ফোরাম, বাংলাদেশ সম্পাদনা ও প্রকাশনা সমিতি (ইপিএবি), মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ, ঢাকা; বাংলাদেশ ভাষা সমিতি, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ও বাংলা একাডেমী-র সদস্য।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি:: মহাকবি মাইকেল মধুসূদন পদক (২০১২), নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা, ২০১১), বাংলাদেশ আর্কাইভ ফেলো, ঢাকা (২০১০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), কবি বাবু ফরিদী সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা (২০০৯), মহাদিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮ কলকাতা), এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), জেমকন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক (২০০৮), পাকি মুকসুদপুর সংবাদ সংবর্ধনা, গোপালগঞ্জ (২০০৭), জসীমউদ্দীন গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৬), মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)।

বাংলা একাডেমীর উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত। মেইল: drbagchipoetry@gmail.com

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

তপন বাগচী: আমি কি আদৌ কবিতা লিখি? নব্বই দশকের শুরুতে কবিতার মতো কিছু রচনার চেষ্টা করেছি। সেগুলো কবিতা কিনা জানি না! তবে দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক দিনকাল বাদে জাতীয় পর্যায়ের প্রায় সকল পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়েছে। বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্প থেকেই বেরিয়েছে কবিতার বই বেরিয়েছে। দেখতে পাঁচটি কবিতার বই বেরিয়েছে। নির্বাচিত ১০০ কবিতা বেরিয়েছে। প্রেমরে কবিতা বেরিয়েছে। অথচ কবিবন্ধুরা আমাকে কবিতার রাজ্য থেকে খারিজ করতে চায়! ছড়া, প্রবন্ধ, কথাসাহিত্য প্রবৃতি শাখায় নজর দেওয়ায় ঈর্ষাকাতর বন্ধুরা এই অপচেষ্টা করছে। তখন আয়নায় তাকিয়ে দেখতে পাই, আমার নিন্দুকদের চেয়ে খারাপ লিখি নাই। আর কবিতার নিন্দুক যেহেতু জুটেছে, তখন মনে হয়,আমার কবিতার কিছু মূল্য থাকলেও থাকতে পারে। যুক্তি আর তথ্য যখন ফুরিয়ে যায়, মিলের চটুলতা যখন গভীরতা পায়, কাহিনির ডালাপালা যখন গুটিয়ে পড়ে, তখন কবিতা ছাড়া অন্য কিছু অবলম্বন হতে পারে না। তাই কবিতা লেখাই হয়ে দাঁড়ায় অনিবার্য নিয়তি। যাবতীয় অভিজ্ঞতা তখন কবিতার আঁটসাঁট চরণে বাধা পড়ে। কবিতাই হয়ে পড়ে পরম আশ্রয়। যে কথাটি আমি চিন্তায় নয় বোধে জমা রাখতে চাই তার জন্য কবিতা ছাড়া আমার কাছে বিকল্প মাধ্যম নেই। তাই কবিতা লিখি।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

ত: কবি নীরেন্দ্র চক্রবর্তী একবার মজা করে বলেছেন এক টুকরো সাদা কাগজ, একটা পেন্সিল আর কিছুটা সময় পেলেই কবিতা লেখা যায়। এখন তো কাগজেরও দরকার নেই, পেন্সিলেরও দরকার নেই। শুধু সময়টা দরকার। সেই সময়টা যে কেউ হয়তো দিতে পারে। কিন্তু তাতে কি সবাই কবি হতে পারবে?

কবিতা লেখা যায় না, নাজেল হয়...এই ধরনের বাক্য বলে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু নাজেল হোক,আর রচিত হোক, কবির হাত দিয়েই তো ক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়! তাই কবির কিছু প্রস্তৃতি দরকার। ছবি আঁকতে রঙ লাগে বলে চিত্রকরকে রঙ চিনতে হয়। গান গাইতে সুর লাগে বলে কণ্ঠশিল্পীকে সুর চিনতে হয়। কবিতা লিখতে শব্দ লাগে বলে কবিকে শব্দ চিনতে হয়। শব্দ তথা বাক্য তথা ভাষা চিনতে হয়। ভাষা আয়ত্ত না করে যাঁরা কবিতা লিখেতে আসেন, তাঁরা টিকে থাকতে পারেন না। লালন হয়তো অক্ষরজ্ঞান লাভ করেননি, কিন্তু বোধ এবং উপলব্ধির মাধ্যমে শব্দ-বাক্য-ভাষা ঠিকই আয়ত্ত করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও অনেকে বড় কবি হয়েছেন। কিন্তু আজ সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীকেও ভুল বানানে ভুল শব্দে কবিতা লিখতে দেখা যায়।

মায়ের ভাষাটা ভালভাবে আয়ত্ত করাটাই কবির প্রাথমিক প্রস্তুতি বলে মনে করি। ভাষাপ্রেমরে পাশাপাশি দেশপ্রেম থাকাটাও জরুরি।আর যেহেতু কবিতা লিখতে চাই, তাই বাঙলা কবিতার হাজারো বছরের ঐতিহ্য ও পরম্পরা সম্পর্কে ধারণা রাখাটাও জরুরি।

গান যেহেতু কবিতা নয়, চিত্র যেহেতু কবিতা নয়, ছড়া যেহেতু কবিতা নয়,উপন্যাস যেহেতু কবিতা নয়, গল্প যেহেতু কবিতা নয়, নাটক যেহেতু কবিতা নয়, প্রবন্ধ যেহেতু কবিতা নয়... সেহেতু কবিতার করণকৌশলটা না জেনে কবিতা লেখার দুঃসাহস দেখানো ঠিক নয়!

আমার এই তাৎক্ষণিক উপলব্ধির মধ্যে হয়তো প্রস্তৃতির কথা কিছুটা বলা গেল।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

ত: ভাল লাগা কবিতার লেখকদের নাম হয়তো বলা যায়, কিন্তু কেন ভাল লাগে সেই ব্যাখ্যা দিতে গেলে ছোটখাট মহাভারত রচিত হতে পারে। এক-একজন কবিকে এক-এক কারণে ভাল লাগে। এক-একটি কবিতাকে এক-এক কারণে ভাল লাগে। কোনো কোনো কবিতার প্রতি বিশেষ দুর্বলতার কারণ হয়তো অনুভব করা যায়, প্রকাশ করা যায় না। ভাল লাগার কারণ প্রকাশ করার জন্য কেবল পাঠকের অনুভূতি দিয়ে হয় না। তার জন্য দরকার বিশ্লেষকের দৃষ্টি। সেই ক্ষমতা আমার নেই। তবে কাদের কবিতা ভাল লাগে, তাদের নাম বলতে আমার সমস্যা নেই। সমসাময়িক বলতে জীবিত এবং সচল কবিদের কথা বলছি। পঞ্চাশের নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সৈয়দ শামসুল হক; ষাটের রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, আসাদ চৌধুরী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, অসীম সাহা, আশিস সান্যাল, উত্তম দাশ, মৃণাল বসুচৌধুরী, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, হাবীবুল্লাজ সিরাজী, রুবী রহমান; সত্তরের আবিদ আনোয়ার, কামাল চৌধুরী, নাসির আহমেদ, আসাদ মান্নান, মুহম্মদ সামাদ, বিমল গুহ, ফারুক মাহমুদ, রবীন্দ্রনাথ অধিকারী, শ্যামলকান্তি দাশ, অপূর্ব দত্ত, মোহাম্মদ কামাল, মাহমুদ কামাল, ফরিদ আহমদ দুলাল; আশির দশকের খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ফেরদৌস নাহার, গোলাম কিবরিয়া পিনু, রেজউদ্দিন স্টালিন,আমিনুর রহমান সুলতান, রেজাউদ্দিন স্টালিন, আমিনুর রহমান সুলতান, ফরিদ কবির, ঈশিতা ভাদুড়ী, কাজল চক্রবর্তী, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, বদরুল হায়দার, প্রদীপ মিত্র; নব্বইয়ের দশকের হেনরী স্বপন, পরিতোষ হালদার, রণক মুহম্মদ রফিক, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মতিন রায়হান, কুমার বিপ্লব, রিষিণ পরিমল, মুজিব ইরম, শামীম রেজা, টোকন ঠাকুর প্রমুখ। আরো অনেকের নাম মনে আসছে না এই মুহূর্তে। মনে পড়লে বলব।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

ত: শিল্পসাহিত্যে খারাপ লাগার ব্যাপারটা সরাসরি প্রকাশ করা যায না। খারাপ লাগলে আমি বর্জন করতে পারি, কিন্তু তাদের তালিকা প্রকাশ করে ছোট করতে চাই না। তাছাড়া আমার খারাপ লাগলেই যে তারা খারাপ হয়ে গেলেন, এমনটি নয়। প্রশ্নটার মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। যা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ঘরোয়া আড্ডায় খারাপ লাগার কথা বলা যায়, কিন্তু প্রকাশ্য সভায় বলাটা রুচিকর নয়।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ত: খুবই কাছ থেকে দেখেছি। কিন্তু পরিপূর্ণ মূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। নব্বইয়ের দশকের কবিতার কথা যদি বলি, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এই সময়ের কবিতার শিল্পগুণকে ক্ষুণ্ন করেছে। প্রযুক্তির বিকাশের কারণে কবিতার বহুল প্রচার সম্ভবপর হয়েছে। লিটলম্যাগের প্রতাপ তেমন করে দেখা যায়নি। বাজারচলতি কাগজে পাত্তা না পেয়ে গোষ্ঠীবৃত্তি টিকিয়ে রাখার জন্য কেউ কেউ লিটলম্যাগ করেছে। নিজেকে বড় বানানোর জন্য বন্ধুদের দিয়ে লিখিয়ে নিজেদের লিটলম্যাগে ছাপিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে। তাতে কবিতার কোনো কাজে লাগেনি। নব্বইয়ের কবিতা তিরিশি আধুনিকতার প্রচল প্রথার ভেতেরই লোকঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যোগ ঘটেছে। উত্তরাধুনিকতা বলেও কিছু চেঁচামেচি হয়েছিল। আবার তা থেমে গেছে।এইসব আয়োজন-আলোড়ন নব্বইয়ের কবিতাকে কিছুটা বিভ্রান্ত করেছে। কিন্তুএকটা দশক যেতেই সে গাঝাড়া দিয়ে নিজের রূপ প্রকাশ করেছে। আমি নব্বইয়ের কবিতা না বলে শতাব্দীর শেষ দমকের কবিতা বলতে চাই। আর শূন্য দমক না বলে শতাব্দীর শুরুর দশক কিংবা প্রথম দশক বলতে চাই। এই দশকের সুবিধা এই যে, এরা মিডিয়ার সংখ্যাধিক্যের কারণে প্রচুর প্রচার পেয়েছে। আর অসুবিধা এই যে, অসম্পাদিত কবিতাও ছাপা হয়েছে অপ্রচুর। তাই ভাল কবিতাটি চিনে নিতে পাঠকেরা বিভ্রান্তির শিকার হতে পারে।আপাতত এর বেশি কিছু বলার নেই।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

ত: ফারাক? ফারাক কেন হবে? দুটোই তো বাঙলাভাষার কবিতা। তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ পর্যন্ত আামরা তাদের মুখাপেক্ষী ছিলাম। কিন্তু ষাটের পরে সেটিও নেই। পশ্চিমবঙ্গে ষাটে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত,উত্তম দাশ, কেদার ভাদুড়ী, মৃণাল বসুচৌধুরী,আশিস সান্যাল, রাণা চট্টোপাধ্যায় ছাড়া তেমন ভাল কবি কই?আমাদের ষাটের কবিরা অনেক বড়। সত্তরের, আশির, নব্বইয়ের কবিতাও ওদের চেয়ে এগিয়ে।আমি ভূগোলের চেয়ে ভাষার প্রতিই জোর দিতে চাই। একই কবিতা বহুজনে লিখছি মাত্র। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনার দিন এখন আর নেই।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

ত: ব্লগ হচ্ছে একটি মাধ্যম। প্রচার মাধ্যম। আরো সূক্ষ্মভাবে দেখলে বলা যায়,আত্মপ্রচারমাধ্যম। সে কেন সাহিত্যকে বিশেষ কিছু দিতে যাবে? দেয়ার মালিক সাহিত্যিক। নেয়ার মালিক পাঠক বা ব্যবহারকারী। প্রশ্নটা যদি এমন হতো যে, ব্লগের মাধ্যমে চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সাহিত্যের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা, তাহলে কিছু কথা বলা যেত। যা হোক, ব্লগমাধ্যমে সাহিত্যচর্চার সুযোগ সৃষ্টির ফলে আগাছাও বৃক্ষ নামে পরিচিত হতে চাইছে। এখানে প্রতিযোগিতা নেই, সম্পাদকের কাচিঁ নেই, পাঠকের প্রতিক্রিয়া না হলেও চলে। লিখে পোস্ট করেই 'আমি কী হনু রে' ভাব করা যায়। এক ধরনের আত্মরতি বলা যেতে পারে। ব্লগে অনেক ভাল লেখাও পাওয়া যায়। অনেক দ্রুত পাঠকের কাছে যাওয়া যায়, তাৎক্ষণিত পাঠপ্রতিক্রিয়া জানা যায়, এসব সুবিধা থাকার পরেও মনে হয়, ব্লগের মাধ্যমে সাহিত্যের মূলপ্রবাহ সৃষ্টি করা যাবে না।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

ত: দুটি মাধ্যমেরই কিছু ভাল-মন্দ, সাদৃশ্য-বৈশাদৃশ্য আছে।এককথায় জবাব দেয়া যায় না।

ক. লিটলম্যাগ ছোট কোনো গোষ্ঠীর মুখপত্র হতে পারে।, ব্লগ ব্যক্তির মুখপাত্র হতে পারে।

খ. লিটলম্যাগ প্রকাশের একটা পর্যাবৃত্ত থাকে। ব্লগের থাকে না।

গ. লিটলম্যাগ সম্পাদনা-আড্ডা প্রবৃতি সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। ব্লগ যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়।

ঘ. লিটলম্যাগে সম্পাদক ভিন্ন মানুষ হতে পারে বলে লেখককে সতর্ক থাকতে হয়। ব্লগে নিজেকেই সম্পাদক হতে হয়।

ঙ. লিটলম্যাগে একেবারে যাচ্ছেতাই লেখা যায় না। ব্লগে যাচ্ছেতাই লেখা যায়।

এবার বুঝুন কোনটি গুরুক্বপূর্ণ!!!!

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ত: চালু দৈনিকগুলো সাহিত্যপৃষ্ঠা সম্পর্কে ঢালাও মন্তব্য করার সুযোগ নেই। ধরুণ, 'ভোরের কাগজের' পাঠক একেবারেই নেই। স্টলগুলোতেও কিনতে পাওয়া যায় না। কিন্তু সাহিত্যের পৃষ্ঠা যথেষ্ট ভাল। পাঠযোগ্য। ‌'যুগান্তর' বই নিয়ে পৃথক পৃষ্ঠা প্রকাশ করে। বিষয়টি খুবই শংসাযোগ্য। 'সমকাল' এর কালের খেয়া কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে। ‌'কালের কণ্ঠ'র 'শিলালিপি'র ঝোঁক বেশি বিশ্বসাহিত্যের প্রতি। কিছু বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা তারা ভাল করেছে। 'জনকণ্ঠ' গতানুগতিক হলেও মন্দ নয়। 'ইত্তেফাক' কয়েকমাস ধরে খুবই ভাল করছে। নতুন বিষয়, নতুন লেখক, পৃষ্ঠাসজ্জায় নান্দকিতা-- সবইউপভোগ্য। '‌প্রথমআলো'তে সবাই ভাল লেখাটি দিয়ে থাকেন। তবে সাহিত্যের চেয়ে সাময়িকী পৃষ্ঠার দিকে তাদের নজর বেশি। এই হচ্ছে, আপাত পর্যবেক্ষণ। তবে, কথা হচ্ছে, দৈনিকের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। স্থানের সংকীর্ণতা তারা এড়াতে পারে ন।আকারের কারণে অনেক ভাল লেখাও তারা বাদ রাখতে বাধ্য হয়। খ্যাতিমান লেখকের দুর্বল লেখাও অনেক সময় ছাপতে হয়। এই সব সীমবাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের সাহিত্যের জন্য যেটুকু কাজ হচ্ছে, তা ওই দৈনিকের সাহিত্যপৃষ্ঠা ঘিরেই আবর্তিত।