শক্তিহীন দেশের লেখকরাই খুব বেশি যাদুবাস্তবতার আশ্রয় খোঁজেন: গাজী তানজিয়ার সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 30, 2012 7:29:54 AM

প্রকাশিত বই: পৃথিবীলোক, জাতিস্মর

পুরস্কার: সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার

দুপুর মিত্র: গল্প লিখেন কেন?

গাজী তানজিয়া : বলতে গেলে হঠাৎ করেই গল্প লিখতে শুরু করা। গল্প লিখব এমন কখনো ভাবিনি। এক সময়ে, খুব ছোটবেলায় সবার মতো আমিও কবিতা লিখতে চাইতাম। দু’চারটা লিখেও ফেলেছিলাম। কিন্তু যখন সত্যিকার অর্থে কবিতা লিখতে চাইলাম তখন দেখলাম কবিতা আমার ক্ষেত্র নয়। তাই বলে যে গল্প লিখতে আসা এমন নয়। এরপর অনেকটা সময় কিছুই লিখিনি। আমি ছিলাম পাঠক, যাকে বলে একেবারে আম-পাঠক। তার মাঝে লেখালেখি যা চলেছে তা ছিল নিবন্ধ রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এক সময়ে অনুভব করলাম নিবন্ধের মধ্যে দিয়ে তো আমি আমার চেনা জগতের সব সঙ্গতি-অসঙ্গতি, বেঁচে থাকা, বিপ্লব এর কোনোটাই তুলে ধরতে পারছি না। কোনো একটা ঘটনা সম্পর্কে আমার একটা ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি আছে, আর সেটা কেমন হতে পারে, আর এটা আমি কিভাবে ব্যক্ত করতে পারি! মত, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের এক ধরনের যন্ত্রণা থাকে মানুষের ভেতরে। আর সেই যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজতে গিয়েই এক সময়ে দেখলাম গল্পের জগতে ঢুকে পড়েছি।

দু: গল্প লিখতে আপনি কাদের বেশি অনুসরণ করেন এবং কেন?

তানজিয়া : গল্প পুরোটাই একজন লেখকের ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। এক্ষেত্রে কাউকে অনুসরণ করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

দু: সমসাময়িক কাদের গল্প আপনার ভালোলাগে এবং কেন?

তানজিয়া : একজন গল্পকার যে সব সময় সব গল্পই ভালো লেখেন এমন কিন্তু নয়। তবে কারো কারো গল্প লেখার আঙ্গিকটা ভালো। যাঁদের অনেক সাধারণ গল্পও কখনো কখনো বর্ণনার ধরনে অসাধারণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ঐ বিষয়ের ওপর লেখকের দখল অভিজ্ঞতা, অন্তদৃষ্টি ও নিজস্ব দর্শন বিশেষ অবদান রাখে বলেই মনে হয়। ভালোলাগা গল্পকারের মধ্যে আছেন- সালমান রুশদি, জন আপডাইক, রিচার্ড রাইভ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হূমায়ূন আহমেদ, ওয়াসি আহমেদ।

দু: সমসাময়িক কাদের গল্প আপনার বাজে লাগে এবং কেন?

তানজিয়া : আগেই বলেছি, একজন গল্পকারের সব গল্পই যে ভালো হবে এমন নয়। আবার একজন সত্যিকারের গল্পকার কখনো বাজে গল্পকার নন। তবে বিষয় স¤পর্কে অন্তদৃষ্টি এবং পূর্ণ জ্ঞানের অভাব থাকলে কখনো ভালো গল্প হয়ে ওঠে না। কারো কারো গল্প আমার কাছে হয়ত ভালো লাগে না, তবে তাদের গল্প বাজে এটা বলা সমীচীন নয় বলেই আমি মনে করি।

দু: আমি গল্প লিখতে চাইলে কী পরামর্শ দিবেন এবং কেন?

তানজিয়া : কেউ গল্প লিখতে চাইলে আমি বলব জীবনকে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখতে। সেখান থেকেই বের হয়ে আসে গল্পের বীজ। আর সেই বীজকে মহীরুহ করে তুলতে চাইলে চাই প্রচুর জ্ঞান এবং সৎ দৃষ্টিভঙ্গি।

দু: আমরা প্রচুর পরিমাণে রাশিয়ান ফিকশন পড়ার পরও কেন গল্পটাকে যাদুবাস্তবতার পর্যায়ে নিয়ে গেছি?

তানজিয়া : আমাদের সব গল্পই যে যাদুবাস্তবতার পথ ধরে হাঁটে এই অভিযোগ কিন্তু সত্য নয়। বাস্তবকে ভয় পেলেই কি মানুষ পরাবাস্তবতা বা যাদুবাস্তবতার পথ ধরে হাঁটে! অনেক সময় বাস্তব খুব বেশি নখ-দাঁত দিয়ে ভয় দেখায়। তাই হয়ত লেখককে যাদুবাস্তবতার পথ ধরে হাঁটতে হয়। অথবা ’পাওয়ার’ একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে এখানে। দেখা গেছে শক্তিহীন দেশের লেখকরাই খুব বেশি যাদুবাস্তবতার আশ্রয় খোঁজেন। এর দুটো কারণ হতে পারে; এক বাস্তবকে সহনীয় করে তোলা বা দুই, বাস্তবকে নগ্নভাবে উপস্থাপন না করা। তবে আমি এই দুই ধারাকেই লেখকের এক ধরনের কল্পনাবিলাস বা কঠিন বাস্তব এড়িয়ে চলার প্রবণতা বলতে পারি। তবে যারা ‘আর্ট ফর আর্ট সেকে’র জন্য জান লড়িয়ে দেন, তাদের জন্য একটা কথা আছে, আর্টের জš§ যে সামাজিক প্রয়োজন ও সামাজিক প্রেরণা থেকে এটা বহুভাবে দেখানো যেতে পারে। এবং যে সাহিত্য যে শিল্পকলা সামাজিক প্রয়োজন মেটাতে পারে না তা কখনোই শিল্প-সাহিত্য হিসেবে টিকে থাকতে পারে না। তা বলে যে সবকিছু খুব বেশি সরাসরি বলতে হবে এমন নয়। কারণ সাহিত্য আর সংবাদ তো এক জিনিস নয়। সংবাদ যদি বৃষ্টির পানি হয় তবে সাহিত্য মাটির তলার জল। বহুকাল ধরে বৃষ্টির পানি জমে জমে যার সৃষ্টি।

দু: কলকাতা ও ঢাকার কথা সাহিত্যের ফারাকটা কোথায়?

তানজিয়া : কলকাতা ও ঢাকার কথা সাহিত্যের ফারাকটা সেই গোড়া থেকেই বিদ্যমান। প্রধান ব্যবধান আমরা দেখতে পাই ভাষায়। আপাত দৃষ্টিতে দুটো ভাষাই বাংলা হলেও, দুই বাংলার ভাষার ব্যবহারে নিজস্বতা আছে। যেমন পার্থক্য আছে এমেরিকান ও বৃটিশ ইংলিশের ক্ষেত্রে। এছাড়া সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কিছু পার্থক্য তো আছেই। আপাত দৃষ্টিতে সংস্কৃতিগত কিছু মিল খুঁজে পেলেও; গল্প উপন্যাসে যখন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখনই মূল ফারাকটা চোখে পড়ে। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হয় ওরা সহজ ও প্রাঞ্জল ভঙ্গিতে সাহিত্য চর্চা করে থাকেন। যেখানে জ্ঞানের গভীরতা আছে তবে আঁতলামি নেই। খুব বেশি ফ্লাওয়ারি লেখার দিকে ওদের ঝোঁক কম দেখা যায় ইদানিং। যে কারণেই হয়ত তারা পাঠককে বেশি টানতে সক্ষম হন। আর আমাদের সাহিত্য যে ভালো হচ্ছে না সে কথা বলব না। খুব উচু মার্গের সাহিত্য চর্চা এখানে হয়। মধ্যম ধারারও হয় আবার একেবারেই বাণিজ্যিক ধারার এলেবেলে সাহিত্যেরও অভাব নেই, তবে এই দুয়ের মধ্যে থেকেও এক বিচিত্র কারণে আমরা পাঠক তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি।