একদা যারা লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে গ্রুপিং করতেন তারা এখন দৈনিকের পোদ্দারি করছেন: কবি কাফি কামালের সঙ্গে অনলাইন আলাপ

Post date: Sep 12, 2013 6:39:36 PM

জন্ম: ৮ জানুয়ারি ১৯৮০।

প্রকাশিত বই:

ডলুতীরে টংঘর (কাব্যগ্রন্থ ২০০৫)

তীরবর্তী হাওয়াঘর (কাব্যগ্রন্থ ২০০৭)

প্রসবকালীন ভাববিদ্যুৎ (কাব্যগ্রন্থ ২০০৮)

ঋতুরঙ্গ (কাব্যগ্রন্থ ২০১১)

লবঙ্গকন্যা (গল্পগ্রন্থ ২০০০)

মেইট্টাল (চট্টগ্রামী ভাষায় প্রথম গল্পগ্রন্থ ২০১১)

কন্যাযাত্রী (গল্পগ্রন্থ ২০১৩)

কুতুব মিনার থেকে কন্যাকুমারী (ভ্রমণ ২০১৩)

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

কাফি কামাল: কবিতা কেন লিখি এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর এখনও আবিষ্কার করতে পারিনি। একটি বৃকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তুমি কেন ফুল-ফল দাও? বৃরে যা জবাব হবে সেটিই সম্ভবত আমার উত্তর। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ নিজের মতো করে তার উপলব্ধি-অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে। ব্যক্তি হিসেবে আমি খুবই সংবেদনশীল এবং সাহিত্যের সংবেদনশীল শাখাটি হচ্ছে কবিতা। তাই হয়তো আমি কবিতার মাধ্যমে নিজের সে সংবেদন মনের অনুভূতিগুলো কবিতায় অনুবাদ ও প্রকাশ করতে চাই। আর আমি যে সমাজে জন্ম নিয়েছি তার ঘুরপাক থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসার একটি জেদ শৈশব থেকে আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কবিতার ভেতর দিয়ে আমি এক পরমের অনুসন্ধানে ছুটছি। ফলে আমার অন্তর্গত জগতে যে সত্তাটি নিত্যকর্মে অব্যক্ত গুমরে মরে তা কখনও কখনও পঙ্ক্তিতে অঙ্কুরোদগম হয়। আমি তার পরিচর্যা করি। পঙ্ক্তিঘোরে আমি ডুব দিই ভাবনা সমুদ্রের গভীরে, ঢুকে পড়ি বোধের খনিরাজ্যে, বিরাজ করি গহীন সন্ন্যাসে। কবিতা, এ এক অদ্ভুত মনোক্রীড়া। আবার উৎকৃষ্ট, ভাল ও জনপ্রিয় কবিতা লিখতে পারার মধ্যে একটি দৃশ্যমান গৌরববোধ আছে। এ গৌরববোধ উপভোগে অবহেলা, অমরত্ব, খ্যাতির মোহহীন সন্ন্যাসি আমি নই। আমি নিশ্চিতভাবেই তা উপভোগ করতে চাই। কবিতাকে আমি নির্মাণের বিষয় হিসেবে দেখি না। অন্তর্গত তাড়নায় পঙক্তি বিশেষ আমার স্নায়ুর এন্টেনায় ধরা না দিলে আমি বাটি চালানও দিই না, কাদামাটি নিয়েও বসি না। আর নির্মাণ করতে পারি না বলে বহু ছোটকাগজে দাওয়াত পেয়েও অনুপস্থিত থাকতে হয়। অপেমাণ সে সময়ে গল্পে কথার জাল বুনি। কবিতা এখন আমার জীবনের অনুষঙ্গ। যতদিন আমার আত্মা বেঁচে থাকবে ততদিন আমি কবিতার ঘোর নিয়েই বাঁচব।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

কাফি কামাল: –কবিতা লেখার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। সে প্রস্তুতি নিরন্তরের। কবিত্বশক্তি সহজাত হলেও তার প্রকাশ জলবৎ তরল নয়। কেবল কবিত্বশক্তি থাকলেই কবিতা লেখা যায় এটা অবিশ্বাস্য। প্রশিক্ষণ নিয়ে মোনালিসা বা গোয়ানির্কা আঁকা যায় না কিন্তু চিত্রশিল্পী হলে রঙের ব্যবহার বুঝতে আপনাকে প্রশিণ নিতে হবে। চিত্রকরের রং, কণ্ঠশিল্পী সুরের মতো কবিকে শব্দ চিনতে হবে। কবিতা কি, কোন প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয়, কিভাবে চেহেরা পাল্টায় তা জানতে হবে। কবির কল্পনা শক্তি হতে হবে আকাশের মতো মুক্ত ও সুবিশাল। ধরুন কবি ভাবনার দ ডুবুরি হয়ে উঠছেন, বোধ এসে তার দরোজায় ভিড় করছে কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত কবি তা ভাষায় অলঙ্করণ করতে পারছে না ততণ তো পাঠক তা দেখতে পাবেন না। পাঠকের সামনে দৃশ্যমান করতে অলঙ্কৃতভাষায় একটি অবয়বের প্রয়োজন। তাই কবিতা লেখার জন্য কবিকে তো গভীর ভাবনায় ডুব দেয়ার মতা, ভাবনার রাজ্য থেকে সংগৃহীত বোধকে বিশ্লেষণ করার মতা, আবেগকে নির্মোহ করে তোলার মতা এবং সে বোধকে ভাষিক অবয়ব দেয়ার জন্য নির্মাণ কৌশল অর্জন করতে হবে। শব্দ, ছন্দ, অলঙ্কার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক, চিত্রকল্প কি এবং তার ব্যবহার আত্মস্থ করতে হবে। শব্দভাণ্ডার আত্মিকরণ, কবিতার বিবর্তন, ভাষা, ছন্দ-মাত্রা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মিথ-পুরাণ, মানবসভ্যতার বিবর্তন, জীবনের ধর্ম-দর্শন উপাদান সম্পর্কে জানতে হবে। অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ, ভাষাজ্ঞান, প্রকাশভঙ্গি, অবয়ব তৈরির কৌশল জানতে হবে। বিস্তর পড়াশোনার পাশাপাশি বিচিত্র অভিজ্ঞতার অনুপম অনুবাদে পারঙ্গম হতে হবে। এটা আত্মস্থ করতে একটি নিরন্তর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে কবিকে অন্তহীন ভ্রমণে মেতে থাকতে হয়। এখানে প্রস্তুতির অর্থ দাঁড়াতে পারে সমৃদ্ধি অর্জনের মতো। একজন দরিদ্রের মন যতই বড় হোক না কেন সে মেজবান খাওয়াতে পারবে না। তাই অন্তর্গত তাড়না আসার পর কবিতা নামক মূর্তি বানানোর জন্য আপনার শিল্পী মন থাকলেই হবে না, দার্শনিকের বোধও যথেষ্ট নয়; নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের পরিমাপও জানতে হবে। নির্মাণের জন্য অবশ্যই অনুশাসন মেনে চলতে হয়। একজন কবি ছন্দ না জানলে ছন্দ ভাঙবেন কি করে? ধরলাম কবিতা প্রসব বেদনার মতো। কিন্তু আপনি প্রসবকালে আপনি যদি দাঁড়িয়ে থাকেন তবে কবিতাতো আছড়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে। যখন আপনি দ শিল্পী হয়ে উঠবেন তখন এসব আপনার হাতে খেলতে থাকবে। সাঁতার নিশ্চয় কেউ মায়ের পেট থেকে শিখে আসেনি। হয়তো স্বতঃস্ফূর্তভাবে জলে পায়ের পাতা সঞ্চালনের কৌশলটি কোন একজনের মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে গেছে। এখন পায়ের পাতা সঞ্চালনের মাধ্যমে হয়তো পুকুরে সাঁতরানো সম্ভব। কিন্তু হস্ত সঞ্চালন, ভেসে থাকার টেকনিক, উল্টে-পাল্টে, কাত-চিৎ হয়ে এগিয়ে যাবার কৌশল আত্মস্থ করতে না পারলেও কারও পে সাগর দূরে থাক নদীতে সাঁতার কাটাও বিপজ্জনক। সমকালীন প্রবণতা জানতে-বুঝতে হবে। নইলে বাটারফাই প্রতিযোগিতায় ফ্রি স্ট্রোক সাঁতার কেটে ডিসকোয়ালিফাই হবেন। কবিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপন মেজাজে প্রকাশিত হয় বলে একটি মহৎ কবিতার জন্য কবিকে অনির্দিষ্টকাল অপো করতে হয়, পার করতে হয় মননের জটিল স্তর। কালের এ অমোঘ পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রয়োজন বিস্তর সময়। কিন্তু কবিতা এমন একটি মাধ্যম যার চর্চা করলে প্রাপ্তির চেয়ে হারানোর কার্যকরণ সবচেয়ে বেশি। এখন কেউ যখন তার জীবন কবিতার পেছনে উৎসর্গ করবেন তার তো সে জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে আপনি দুনিয়ার এত কাজ ফেলে কবিতা লিখবেন কেন? এটা কি প্রস্তুতি নয়? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের মতো কবিরাও হাত মশকো নামক প্রস্তুতি পর্ব পার করেছেন। যা প্রথমদিককার কাব্যগ্রন্থের দিকে তাকালে পরিষ্কার হয়। তবে প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেই কেউ কবিতা লিখতে পারে না। এ প্রস্তুতি তলোয়ার চালানো বা পরীক্ষা টেবিলে বসার নয়। আপনি প্রস্তুত কিন্তু ভেতরের তাড়না নেই, অনুভূতির গভীরতা নেই, ভাবনার পরিণতি নেই তাতেও কবিতা হবে না। আসলে লিখতে লিখতেই মনের ভেতরে অলৌকিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। পরিপার্শ্ব, পাঠ, ধ্যান, আত্ম-অনুসন্ধান, প্রজ্ঞা, কবিতার ব্যাকরণ একজন প্রকৃত কবিকে নিরন্তর প্রস্তুত করে তোলে। আমি কবি ও কৃষক, মানে পঙ্ক্তি ও শস্য সাধনার মধ্যে একটি দূরবর্তী মিল খুঁজে পাই।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

কাফি কামাল: পৃথিবীর সকল কবিই আমার প্রিয়। যখন যার যে কবিতাটি ভালো লাগে তখন সে আমার প্রিয় কবি হয়ে ওঠে। পৃথিবীর কোন কবিরই সকল কবিতা নিখুঁত নয়। প্রকৃত পাঠকের তাই সুনির্দিষ্ট প্রিয় কবি থাকতে পারে না। পাঠক হিসেবে আমি সর্বগ্রাসী। কোন কোন গদ্যকারের ভেতরও কবিত্ব আবিষ্কারের আনন্দে যেমন উচ্ছ্বসিত হই, আবার কোন কবির অকবিতা পড়েও বিরক্ত হই। সমকালীন কয়েকটি নাম উল্লেখ করে আমি আমার ভালো লাগার অনুভূতিগুলোকে তুচ্ছ করতে চাই না। বাংলা কবিতাকে আমি বিবেচনা করি সুন্দরবনের হরিণ। সমকালীন কবিতা ভালো লাগে কারণ তা নিয়মরীতি ভেঙে নির্দিষ্ট সীমারেখা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পাপ-পুণ্য, শ্লীল-অশ্লীলের ধার ধারছে না। যাপিত জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ও গভীর অনুভূতি সহযোগে তুলে আনছে। আমার সমসাময়িক অনেকেই ভালো লিখছেন। একেক জনের কবিতা একেক কারণে ভালো লাগে। কারো দুর্দান্ত ছন্দের হাত, কারো অভূতপূর্ব উপমা, অনাস্বাদিত চিত্রকল্প, উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্ব, প্রচলিত ধারাকে ভাঙার কোশেশ, নিরীক্ষা প্রবণতা, আশ্চর্য প্রকাশ ভঙ্গিমা, বহুরৈখিক ব্যঞ্জনা, ভাষার বৈচিত্র্য, কারো স্যাটায়ার, কারও প্রকাশভঙ্গির নতুনত্বের ঝিলিক আমাকে মুগ্ধ করে। একেকটি কবিতা একেক কারণে ভালো লাগে। কোন কবিতায় আমার চেনা জগৎ, অনুভবের সমর্থন, ভাবনা-বোধ দেখতে বা নতুন চিন্তার সন্ধান পেলে ভালো লাগে। কবিতায় আমি সংগীতময় এক আশ্চর্য দ্যোতনার সন্ধান করি। একই সঙ্গে আমার সামনে একটি নতুন চিত্রকল্প তৈরি করবে, কানে অনুরণন তুলবে, ভাব আবিষ্ট করবে, বোধ ঘোরগ্রস্ত করবে। তবে বেশিরভাগ কবিতায় পূর্ণাঙ্গভাবে কাছে টানে না, পঙ্ক্তি বিশেষ মুগ্ধ করে। কিন্তু কবিরা তো বেঁচে থাকেনÑ ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ দু-একটি পঙক্তির মাধ্যমে। আমার সমসাময়িকদের মধ্যে দু’একটি স্বর স্বাতন্ত্র্য হয়ে উঠতে চাইছে।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

কাফি কামাল: সমকালীন অনেকের কবিতা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু তাদের নাম উল্লেখ হবে বিপজ্জনক। সমকালীন অনেক কবিই কবি নন। তারা লেখার স্বপ্রণোদিত ভাব ও ভারবাহী মাত্র। প্রযুক্তিগত সুবিধা, গোষ্ঠীর পিঠ চুলকানি এবং সাহিত্য ও লিটলম্যাগ সম্পাদকদের অযোগ্যতার সুযোগে তারা প্রচারে-প্রকাশে একটি কবি চেহেরা তৈরি করে নিয়েছেন। ভারতীয় বঙ্গের কতিপয় কবির অন্ধ অনুকরণ, বাংলাদেশের কতিপয় গুরুর অন্ধ অনুসরণকারী এরা পঙ্ক্তি সাধনার চেয়ে প্রচার-কৌশল, রাজনীতি ও ধূর্তামিতেই বেশি মনোযোগী। সমসাময়িক কবিদের বড় অংশটিই গোষ্ঠীবদ্ধ। তারা গোষ্ঠীর বাইরে কাউকে কবি মনে করেন না, তাদের কবিতাও পড়েন না। কোন ভাল কবিতা নিয়ে তারা টুঁ শব্দটি না করলেও চক্রভুক্ত তেলাপোকাদেরও বিহঙ্গ বিবেচনায় তারা সদা তৎপর। গোষ্ঠীকৃত্যের স্বার্থে বাজে কবিতাকে ভালো কবিতা বানানোর সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং ভাল কবিতার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন খুবই হতাশাব্যঞ্জক। অনেকেই গোষ্ঠীবাদিতার আশীর্বাদে প্রচার সুবিধার সুযোগ নিয়ে প্রতিদিন কবিতার নামে মলমূত্র প্রদর্শন করছেন। সমকালে স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যঞ্জনাপূর্ণ কবিতার আকাল চলছে। প্রায় কবিতায় মনে হয় একই ছাঁচে ফেলে তৈরি। সমকালের বেশিরভাগের কবিতা পড়লে মনে হয়, তারা কবিতার ইতিহাস, ছন্দ-মাত্রা, শব্দ বাছাই, উপমা-উৎপ্রো ও চিত্রকল্পের ভাল ব্যবহার জানে না। সমকালীন অনেকেই গদ্য কবিতার নামে গদ্য লেখে। কবিতার প্রবণতার খবর রাখেন না, ছন্দ-মাত্রাসহ অন্যান্য আঙিক বিষয়কে নির্লিপ্ত ভাব দেখান, দূর্বলতাকে ফ্যাশন আখ্যায়িত করে। ছন্দের বিরুদ্ধে অকারণ যুদ্ধ ঘোষণা করে। অগ্রজদের খারিজ করে মুই কি হনু ভাবধারণ করে। তাদের কোন কোন কবিতার হয়তো একটি পঙ্ক্তিটি কৌতূহলী করে তুলল কিন্তু কয়েক পঙক্তির পড়তে পড়তেই অস্পষ্টভাব, অর্থহীন চিত্রকল্প, শব্দ ব্যবহারের অজ্ঞতা, অসচেতনতা, খাপছাড়া ভাব, দুর্বোধ্যতা, বালখিল্যতা, নিজস্ব প্রকাশ ভঙ্গির অভাব, অযথা জটিলতা তৈরির প্রবণতা, অপ্রয়োজনীয় শব্দের ব্যবহার, জানাশোনার ঘাটতি, উপস্থাপনের গতানুগতিকতা, সারমর্মহীনতা প্রকাশ করে দেয়। তাঁদের চিন্তা স্পষ্ট নয়। ব্যক্তিগত তুচ্ছ আবেগকে প্লাস্টিকের ফুলে সাজায়। একজন কবিকে দেখি তার কবিতায় সাপের মুখে হুঙ্কার শুনিয়ে দেন। কিন্তু গোষ্ঠীপ্রবণতার সুযোগে কবিতার নামে অকবিতা দখল করে নিচ্ছে দৈনিকের জমিন, লিটলম্যাগের আকাশ, আলোচনার হাওয়া। অকবিদের প্রলাপসর্বস্ব কবিতা খুব কষ্টদায়ক। ছন্দ নিয়ে অনেকের অনাগ্রহ আছে। আমি বলতে চাই, ছন্দ থাকলে কবিতা না হোক নিদেনপে পদ্য হয়। কিন্তু গদ্যকবিতা যদি কবিতা হয়ে না উঠে তবে সে কি বস্তু হয়! সমসাময়িক দশজন কবির কবিতা তাদের নাম উল্লেখ না করে কোন পাঠককে পড়তে দিলে কোনটি কার কবিতা তা পাঠকের ধরতে ব্যর্থ হবেন নিশ্চিত। এমনকি দু-একদিন পর কবিতাগুলো কবিদের ফেরত দেয়ার সময়ও একে অন্যেরটা নিজের বলে দাবি করে বসতে পারে। সোজা কথায়, সমকালীন কবিতার পাঠ-উদ্ধার কঠিনতর হয়ে উঠেছে। তবে যে কবিতা আমাকে আক্রান্ত করে না সেটাকে আমি কবিতা স্বীকৃতি দিই না।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

কাফি কামাল: কবিতায় দশক আসলে নানা রঙের মুখোশ। সকল মুখোশের অন্তর্গত ব্যক্তি, চরিত্র, যাত্রাপথ ও গন্তব্য একই। পাঠক দশকের হিসাবে কবিকে বিচার করেন না। এটা গোষ্ঠী রাজনীতির একটি কৌশলমাত্র। দেখা গেছে, কোন সম্পাদকের শূন্য দশকের কবি বিবেচনা করেছেন ১৯৬০-৯০ সালে জন্ম নেয়া কবিদের। আরেকজন দেখা গেল, এমন কবিরা আছেন যাদের কারও কবিতা চর্চার শুরু ৯০ সালে কারও ২০১০ সালে। কিন্তু গোষ্ঠীদণ্ডধারী সম্পাদক এককাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। ২০-২৫ বছর বয়সের ব্যবধান সম্পাদকের ইচ্ছায় গুছে গেছে। সমান হয়ে গেছে তাদের অভিজ্ঞতা, পঠনপাঠন সবকিছু। শূন্য দশকের ত হচ্ছে এ দশকে কবিতা বিচারের ভার পেয়েছেন বা নিয়েছেন অকবিরা। যারা পরস্পর পরস্পরকে ছেপেছেন, পিঠ চুলকে দিয়েছেন। কারও মধ্যে কবিত্ব শক্তির উত্তাপ দেখলেই জল ঢেলেছেন স্বউদ্যোগে। অপপ্রচারের রাজনীতিকে করেছেন প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। এটা তারা অর্জন করেননি, পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে নব্বই দশক থেকে। নতুনরাও পরিস্থিতি বুঝে তাদের দুয়ারে ভিড় জমিয়েছেন, তাদের হাতে দীক্ষা নিয়ে ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছেন। পাঠকদের মন্তব্য করতে শোনা যায়, শূন্য দশকে ঢাকা শহরে গলায় বেল্ট লাগানো বিশেষ প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। যারা পেছনেরগুলো গেলে, সামনেরটা চুষে। তবে দুই দশকেই কিছু ভাল কবিতা লেখা হয়েছে। নব্বইয়ের কবিতা অগ্রজ-অনুজদের কাছে যতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে সে গুরুত্ব পায়নি শূন্যের কবিতা। নব্বইয়ের কবিদের নিয়ে গণমাধ্যমে যে মাতামাতি ছিল শূন্য ছিল ঠিক উল্টো। ফলে বৃহত্তর পাঠকের মনোযোগ ও কৌতূহল নিবিষ্ট হয়নি শূন্যের কবিতায়। এখন তো পরের দশকের হাওয়া বইছে। নব্বইয়ে ইজম চর্চা ছিল জোরালো। শূন্যে ইজম গুরুত্বহীন। আশির দশকে লিটলম্যাগ সাধনা। নব্বইয়ের দশকে তা হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের সিঁড়ি। শূন্য সে সিঁড়িকে ব্যবহার করেছেন যথেচ্ছ। নব্বই ও শূন্যের কবিতার চরিত্রগত পরম্পরায় খুব বেশি পার্থক্য লণীয় না হলেও শূন্যের কবিতা অনেক বেশি খোলামেলা, রীতিবিরুদ্ধ, ভঙ্গিমায় সাহসী ও স্পর্ধায় উদ্ধত্য, কবিতার ভাব, ভাষা ও আঙ্গিকের দিক থেকে বহুরৈখিক হয়ে উঠেছে। নব্বই যেমন শূন্যে উজ্জ্বল তেমন শূন্য হয়তো চলতি দশকে ছড়াবে উজ্জ্বলতা। আমি বিশ্বাস করতে চাই, শূন্য আপন আলোতে আলোকিত করবে পূর্ণ শতক।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

কাফি কামাল: বাংলাদেশের কবিতার পরতে-পরতে জড়িয়ে আছে ভাষাআন্দোলন, স্বাধিকার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা-উত্তরকালে গণমানুষের স্বপ্নভঙ্গ, প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব, স্বৈরাচারের উত্থান ও গণতন্ত্রের বিপর্যস্ত যাত্রা। এমন ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মুখোমুখি হয়নি ভারতীয় বঙ্গের কবিতা। বাংলাদেশের কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের জীবন-সংগ্রাম, ভারতীয় বঙ্গের কবিতায় প্রাধান্য জুড়েছে অসঙ্গতি। বাংলা কবিতায় রোমান্টিসিজম ও রিয়েলিজমের দ্বন্দ্বকে নতুন করে আবিষ্কার করছেন কেউ- কেউ। এ দুইয়ের সম্পর্কে বলছেন, আপাত বিরোধমুখর কিন্তু আখেরে সমান্তরাল। পাশাপাশি চলে, চলছে এবং সম্ভবত চলবে। বর্তমানের কবিতায় ধর্ম, মিথ, প্রকৃতি ও ইন্দ্রিয়সহযোগে আবহমান বাংলার লোকজ ও ধ্রুপদ রোমান্টিসিজম জেঁকে বসেছে। পাশাপাশি স্বগতোক্তি, বিবৃতি, প্রাত্যহিক ধারাবর্ণনা ইত্যাদি ফর্মে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে রিয়েলিজম। বলা হচ্ছে, রোমান্টিকতা কৃত্রিমতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে, রিয়েলিটি পরছে মুখোশ। রোমান্টিসিজমে ভারতীয় বঙ্গ ও রিয়ালিজমে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের কবিতা। আসলে দুই দেশের কবিতায় পার্থক্য তৈরি করেছে জীবনবাস্তবতা, উপলব্ধি, উপস্থাপন ভঙ্গি ও কাব্যভাষা। বাংলাদেশের কবিতা অবিকশিত নগরযন্ত্রণা, জীবনযাতনা, সরব দেশকালের উপস্থিতি, প্রকৃতি-বর্ণনা, শেকড়কেন্দ্রিকতার মিশেলে স্বকীয়। ভারতীয় বঙ্গের কবিতায় বির্নিমাণ, রহস্য, অনুভূতি ও নিরীক্ষার জটিল মনস্তত্ত্ব নির্ভর বিষয়কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের কবিতা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, দ্বন্দ্ব-সঙ্কটে টলটলায়মান, হৃদয়াবেগে ফেনা তোলা, অফুরন্ত-সম্ভাবনায় সামনের দিকে ধাবমান। বিপরীতে ভারতীয় বঙ্গের কবিতা নিরাবেগ, অবসাদে মনমরা, স্বপ্ন ও প্রাণ-প্রাচুর্যহীন, মেধার বিচ্ছুরণ। ভারতীয় বঙ্গের কবিতায় যেখানে শব্দ বুননের কৌশল পরিণত, জীবনঘনিষ্ঠ ও দ্বিধাহীন সেখানে বাংলাদেশের কবিতায় শব্দপ্রয়োগ, রূপকল্প, উপমা, প্রকাশের ভঙ্গিমায় উচ্ছ্বসিত, চটুলতাপূর্ণ, অপরিণত, জটিল, অনুকরণপ্রিয়তায় দ্বিধাগ্রস্ত। এপারের কবিতা ছন্দ থেকে বেরিয়ে আসছে, কিন্তু ওপারের কবিতা এখনও দারুণ ছন্দময়। তথাপি পাঠকের অভিমত, বিষয়াবলী, ভাষাগত নিরীক্ষা, বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষা ও বাকভঙ্গির ব্যবহারে বাংলাদেশের কবিরা এগিয়ে থাকলেও প্রকরণগত নিরীক্ষায় সমরূপীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রবণতায় দুই দেশের বাংলা কবিতা সমগোত্রীয়। ভারতীয় বঙ্গের নবীনদের পড়ে প্রবীণরা গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি প্রেরণা দেন। বাংলাদেশে যে রীতি গড়ে ওঠেনি এখনও।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

কাফি কামাল: ব্লগ সাহিত্যকে নিশ্চয় কিছু শস্য দেবে। আপাতত পাঠক তো দিচ্ছে। আলোচনা-সমালোচনার একটা মুক্ত প্লাটফর্ম তো দিচ্ছে। ব্লগ লেখক ও পাঠকের যোগসূত্র তো ঘটিয়ে দিচ্ছে। মুদ্রিত সাহিত্য যেখানে পৌঁছাতে পারছে না দ্রুততম সময়ে সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। নানারকম পাঠকের সংপ্তি মতামত জানতে পারছেন লেখক। আমার মতামতগুলোতো ব্লগের মাধ্যমেই আপনি প্রকাশ করতে পারছেন। প্রকাশের দরজা খুলে দিয়েছে ব্লগ। ভবিষ্যতে ব্লগ হবে মুক্তবাজার সাহিত্যের প্রধান তীর্থ স্থান। অল্প সময়ে অভাবিত উন্নতি হয়েছে ব্লগের। ব্লগের চাহিদা বেড়েছে, ব্লগারের সংখ্যা বেড়েছে। ব্লগ লেখক তৈরি করেছে। ব্লগে দশকের রাজনীতি নেই, গোষ্ঠীর কানাগলি নেই, প্রতিষ্ঠানের ব্রাহ্মণ্য, দৈনিক ও লিটলম্যাগ সম্পাদকদের প্রভাব খাটে না, ফাঁকা বেলুন প্রকাশ্যে ফুটো হয়। ব্লগে লেখার বাধাধরা নিয়ম নেই, সম্পাদনার কাঁচি নেই। লেখক চাইলে তার দুর্বল লেখাটি সংশোধন করতে পারছেন, বারবার সম্পাদনা করতে পারছেন। এমন কি তুলেও নিতে পারছেন। অবশ্যই এখানে স্বেচ্ছাচারিতার প্রদর্শনও মারাত্মক। দৈনিকের সাময়িকী চারপৃষ্ঠা হলে লিটলম্যাগের জমিন চারফর্মার কিন্তু ব্লগসাহিত্য শরীর আকাশের মতো বিশাল। তবে লেখকের পরিচিতির জগৎ বাড়ানোর পাশাপাশি লেখার মান কমিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও সমান ভূমিকা রাখছে। অতিসুলভ এ ব্লগ কবি-সাহিত্যিকদের অপরিণত সৃষ্টিকে আর অপ্রকাশ্য থাকতে দিচ্ছে না। এখন লেখক যদি পাঠকের মতামতকে গুরুত্ব দিতে পারে, তাৎণিক প্রকাশের লোভ সামলাতে পারে তবে ব্লগ নিশ্চয়ই ভাল কিছু দিতে পারবে। অন্য মাধ্যমের চেয়ে বরং ভাল পারবে। ব্লগে পাঠক ও লেখকের সম্পর্ক বেশ অনেকটাই আন্তরিক, স্বচ্ছ ও স্বাধীন। ব্লগের আলোচনা-সমালোচনায় ঋদ্ধ করে লেখক তার সাহিত্যকে মুদ্রণ করতে পারেন।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

কাফি কামাল: আমার কাছে এখন পর্যন্ত দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ব্লগ আর কাগুজে বইয়ের উপযোগিতা, আবেদন ভিন্ন। লিটল ম্যাগাজিনের পরিধি ছোট কিন্তু ব্যয়বহুল। আন্দোলন-আদর্শ যাই স্লোগান হোক, লিটলম্যাগ হচ্ছে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। যা প্রকাশের পেছনে গৌরববোধের সঙ্গে থাকে অপমান, লজ্জা, হতাশা এবং মুমূর্ষু আবেগ। হয় মানুষের কাছে বিজ্ঞাপনের জন্য হাতপাতো নয় বাবা কিংবা নিজের পকেট কাটো। কিন্তু লিটলম্যাগের মাধ্যমেই লেখক এবং ক্রেতা পাঠকের বস্তুগত সম্পর্ক তৈরি হয়। ছাপার অরে নিজের লেখাটি দেখলে লেখকের যে উত্তেজনা তৈরি হয়, বারবার পৃষ্ঠা উল্টে পড়া তার আবেদন থাকে তা ব্লগে থাকে না। মুদ্রিত সাহিত্য ছাড়া এখন পর্যন্ত কেউ পাঠকের কাছে সাহিত্যিক স্বীকৃতি পায়নি। অন্যদিক ব্লগের পরিধি অসীম ও ব্যয় স্বল্প। ব্লগের কোন পরিসীমা নেই। সময়, অর্থ ও শ্রমের সাশ্রয় হয়। ঢাকায় বসে আপনি কি লিখলেন মুহূর্তের মধ্যেই উত্তর থেকে দনি, পূর্ব থেকে পশ্চিম গোলার্ধের পাঠক আস্বাদনের সুযোগ পাচ্ছেন। ব্লগে সরাসরি আলোচনা-সমালোচনা করা যায়। তবে হাততালিতে (লাইক) মজে গেলে লেখকও ডুববেন। লেখককে বুঝতে হবে কোন মন্তব্যটি সঠিক পরামর্শ আর কোনটি স্রেফ স্তাবকতা। তথাপি ব্লগ পুরোপুরি যন্ত্র নির্ভর, গ্রন্থগত বিদ্যার মতো। ব্লগের কোন মানদণ্ড নেই, কিন্তু কমবেশি একটি নির্দিষ্ট মানকে দণ্ড ধরেই লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয়। ব্লগিংয়ে লেখকের সাহিত্যরুচি প্রাধান্য পায়, লিটলম্যাগে লেখকের সঙ্গে সম্পাদকের রুচিও প্রতিফলিত হয়। লিটলম্যাগ আবেগ সর্বস্ব ও ব্লগে আত্মপ্রশংসার ত্রে হয়ে পড়েছে। অন্যভাবে বিবেচনা করতে গেলে ব্লগে আত্মপ্রকাশ অনেকটা অর্থ দিয়ে পুরস্কার কেনার মতোও বটে। আমি মনে করি, যে দ্রোহ থেকে লিটল ম্যাগাজিনের কনসেপ্ট এসেছে, সেটা ভালো মতোই খাটতে পারে ব্লগে। স্বাধীন প্রকাশমাধ্যম হিসেবে ব্লগকে অগ্রাধিকার দিলেও একটি অবস্থান নিয়ে লিটল ম্যাগাজিনও থাকবে।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

কাফি কামাল: দৈনিকের সাহিত্য পড়ে বড় হয়েছি। চোখ কান খোলার সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছি এ জগৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। দৈনিক একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে তার মুনাফার স্বার্থ বিবেচনা করা। বাংলাদেশে এখন সাহিত্যের চেয়ে মতাচর্চা গুরুত্বপূর্ণ তাই লেখার চেয়ে রাজনীতি শক্তিশালী। দৈনিক সাহিত্যে রাজনীতি ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। দৈনিক বিচারপতি থেকে আমলা, রাজনীতিবিদ থেকে জমির দালাল সবাইকে সাহিত্যিক বানিয়ে দেয়। দৈনিকের মতাদর্শ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট আচরণে ত-বিত হয়েছে সাহিত্য। বাংলাদেশে প্রতিটি দৈনিকের পোষমানা নিজস্ব লেখক গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের হাসি-কাশি সবই ছাপা হয় বড় যতœ করে। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পোষমানা লেখক ও লেখার মান দুটোর সমন্বয় ঘটে না। দৈনিকে লেখা বাছাইয়ে প্রতিনিয়ত অযোগ্যতা, গোষ্ঠীবাদী মনোভাব, নিরীক দৃষ্টির অন্ধত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হচ্ছে লেখার চেয়ে লেখককে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা। আমি বলি দৈনিকে সাহিত্য নয়, সম্পর্কই ছাপে। দু’একটি ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের মতামতই সাহিত্য সম্পাদকের মতামত হলেও মোটাদাগে দৈনিকের এ অধঃপতনের প্রধান কারণ এগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কেরানি। বর্তমানে বেশির ভাগ দৈনিকের সাহিত্যপাতা দেখার সময় নেই মালিকপক্ষের। তারা যাকে বসিয়ে দেন তিনিই সে সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়ে উঠেন। একদা যারা লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে গ্র“পিং করতেন তারা এখন দৈনিকের সাময়িকী নিয়ে পোদ্দারি করছেন। ইঁদুরের হৃদয় আর গাধার বিবেচনাবোধ নিয়ে সাহিত্য সম্পাদকরা জেঁকে বসেছেন দৈনিকে। তাদের রঙিন জলে সাঁতার কাটাতে পারলে কিংবা কথায় কথায় তোষামোদ করলে আশীর্বাদ পাওয়া যায়। আবার লিটল ম্যাগাজিনের ছোট পরিসরে যারা দৈনিককে গালি দেয় তারাই উঁকিঝুঁকি মারেন তার দৈনিকের বড় পরিসরে। কবিতা ও গল্প মিলে আমার ৮টি বই বেরিয়েছে। কিন্তু আমার আটটি লেখাও দৈনিকে ছাপা হয়নি। সাহিত্য সম্পাদকের পেছনে ঘুরে, গোষ্ঠীর কুয়োয় ডুব মেরে, পারস্পরিক পিঠ চুলকে লেখা ছাপানোর মানসিকতা দৈন্যতা আমার কোনকালেই ছিল না। দৈনিকে লেখকের পরিচিত বাড়ায় এ কথা সত্য। এক্ষেত্রে দৈনিকের দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশিত থাকলেও ঘটে উল্টো। অলেখক-কুলেখকদের পকেটেই যায় সে সুযোগ। দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ পাঠক মনে করে ওরাই বুঝি বড় লেখক। দৈনিক বা লিটলম্যাগ যেখানেই হোক প্রকৃত সাহিত্য প্রকৃতই। দৈনিকে যে প্রকৃত সাহিত্য ছাপা হয় না এমন ঢালাও মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। পাঠক হিসেবে প্রত্যেকের নিজস্ব গ্রহণ-বর্জন ক্ষমতা রয়েছে। পাঠককেই সে বাছাই করে নিতে হবে।