চিন্তার সংকীর্ণতায় কবিতা কি কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে? ধ্রুপদী সার্বজনীন রূপ হারাচ্ছে?

Post date: Feb 2, 2013 12:39:28 PM

চিন্তার সংকীর্ণতায় কবিতা কি কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে? ধ্রুপদী সার্বজনীন রূপ হারাচ্ছে?

শুক্রবারের ক্ষেপচুরিয়াস-অলস দুপুর অনলাইন আলোচনা প্রকল্পের বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচক ছিলেন-

ইয়াসিন ফিদা হুসেন, দুপুর মিত্র, মনিরুজ্জামান খান, মিলন চ্যাটার্জি, দীপু হাসান, আফরোজা শীলা, অত্রি ভট্টাচার্য্য, আবু এম ইউসূফ, রেজওয়ান তানিম, কচি রেজা, সুশান্ত কর।

এখানে তা তুলে ধরা হলো।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে কবিতা আসতে পারে কিনা এটা প্রথম প্রশ্ন হইতে পারে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, কবিতার কোন ধ্রুপদী সার্বজনীন রূপ থাকার দরকার আছে কিনা? শুরু করা যাক।

দুপুর মিত্র: আমি অবশ্যই মনে করি চিন্তা যদি সংকীর্ণ হয় তাহলে কবিতা কুক্ষিগত হবেই। একজন কবির সবচেয়ে প্রথম প্রয়োজন চিন্তার উদারতা, দেখবার বিশালত্ব, অনেক বড় ক্যাম্পাস।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: চিন্তার উদারতাটা কি কবি হয়ে ওঠার আগের প্রক্রিয়া না পরের। চিন্তা উদার না হলে কি আদৌ কবি হয়ে ওঠা যায়? আমি অপকবির কথা বলছিনা এখানে।

দুপুর মিত্র: আপনার মতামতটাও জানাতে পারেন। প্রাথমিকভাবে।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে কবিতা আসতে পারেনা, এটা আমার প্রাথমিক বক্তব্য। সুতরাং আমার কাছে চিন্তার সংকীর্ণতায় কবিতা কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে কিনা? - এই প্রশ্নটিই অবান্তর। বাকি থাকছে চিন্তার সংকীর্ণতা ও চিন্তার উদারতার মধ্যে যে ব্যবধান এটা নির্দিষ্ট করা এবং তাকে অ্যাপ্রোচ করা। সংকীর্ণতার ব্যাপ্তি থেকে বেরিয়ে এসেই শুধু মানুষ কবি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে, আর উদারতা তো অসীম। কবির চলার পথে যদি বিচ্যুতি হয়, তবে কবি আবার নেমে যেতে পারেন অ-কবি বা অপকবির পর্যায়ে, তখন তার সচেতন প্রচেষ্টা বা সাধনা থাকতে হবে বিচ্যুতি ও সংকীর্ণতা কাটিয়ে আবার কবি হয়ে ওঠার।

ধ্রুপদী সার্বজনীন রূপ - এই শব্দ সমষ্টি ইদানীং শোনা যাচ্ছে। কবিতায় এটা আসলে কি তা বিশ্লেষণের দায় এই আলোচনা প্রস্তাব উত্থাপকের। সেটা জানতে পারলে বিস্তারিত মন্তব্য করবো। তবে প্রাথমিকভাবে এইটুকু মনে হয় কবিতাকে কোন রূপের ছকে ফেলার প্রচেষ্টাটা কবির জন্য শিকলের মতো মনে হতে পারে। সৌন্দর্য আর শিল্পবোধ থাকলেই তা কবিতা হতে পারে। এটা ছাড়া আর যে কোন রূপের ছক থেকে মুক্ত থাকুক কবিতা।

মনিরুজ্জামান খান: ইয়াসিনের সাথে একমত। কবি হয়ে যাওয়াই আসল কথা। কে কি ধারণ করে কবি হবে তার রূপ নির্ধারণ কিভাবে সম্ভব? বরং এমন নির্ধারণ কবি জগৎকে সংকীর্ণ করে তুলবে। লালন তো রবীন্দ্রনাথের মত হয় না। ধ্রুপদী সার্বজনীনতা বিষয়টি কিভাবে নির্ধারিত হয়? এধরণের নির্ধারণ অনাগত সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে তোলে।

মিলন চ্যাটার্জি: চিন্তার সঙ্কীর্ণতা থাকলে কবিতা হয় বলে আমি মনে করিনা । চিন্তার পথ যদি বদ্ধ জলের মত হয়, যদি স্রোত না থাকে তবে সেই চিন্তায় ভাঁটা আসতে বাধ্য । কবিকে হতে হবে দমকা বাতাসের মত, নদীর স্রোতের মত । তবেই লেখায় তার ছাপ পড়বে । যদিও কবিতা তাতে কুক্ষিগত হচ্ছে কিনা সেই প্রসঙ্গে যাবো না । তবে চিন্তার সঙ্কীর্ণতা কবিতাকে নষ্ট করে দেয় এটাই আমার মত । এইপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো- সঙ্কীর্ণতা আর একমুখীনতা এক নয় । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় - অনেক কবিকেই আমরা অনেক নামে অভিহিত করি, যেমন - বিষণ্ণতার কবি, দুঃখের কবি, ননসেন্স কবি ইত্যাদি ইত্যাদি । অর্থাৎ সঙ্কীর্ণ নয় বলেই সেটা ভার্‌সেটাইল হবে এমন কোন কথা নেই ।ব্যক্তিগত ভাবে সঙ্কীর্ণ মানসিকতার কিন্তু কবি হিসেবে বড় জায়গায় আছেন এটা আজকাল দেখা যাচ্ছে । আসলে এখন ' মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে ', যদিও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে - কবির কবিতা এতে কুক্ষিগত হয়েছে বহুল পরিমানেই । যে কবিতা সেই কবিদের পরিচিতি দিয়েছে তা কবির উদার মানসিকতার সময়ই লেখা হয়েছিল এটা বলাই যায় । কবিকে হতে হবে মুক্ত মনা, তাকে মিশে যেতে হবে জনারণ্যে তবেই কবিতা সার্থক হবে, তাতে আসবে সৌন্দর্য , আর কে না জানি সৌন্দর্য না থাকলে শিল্প হয় না ।

দীপু হাসান: চিন্তার সংকীর্নতা/বিস্তার ও ভাবনার বিষয়বস্তু অবশ্যই আমাদের পারিপাশ্বির্ক জানালার সাথে সর্ম্পকিত যেই জানালায় রাস্ট্র, সমাজ, শিল্প, শ্রদ্বা, আচার ও রীতি ইত্যাদি একেক ছায়াছবি । এগুলো পেরিয়েই তবে চিন্তার বিস্তার ও কখনো কখনো বৈশ্বিক ও সার্বজনীন রুপটি অর্জন করতে সক্ষম কিনতু এবিষয়ে তার জানালার সীমাবদ্বতা ও আকাশের মেঘ/রোদ ভুমিকা রাখে, ভুমিকা রাখে দিগন্তের সীমান্ত, সীমান্তের অসীমতাও ।

আফরোজা শীলা: অনেকের আলোচনা পড়ার অপেক্ষায় ছিলাম। সাধ মিটল না। এইখানে সবাই চিন্তায় সংকীর্ণ থাকলে কি কি হয় হতে পারে তা বলেছেন বাট কেউ কি একটু ডিসকাস করতে পারত না চিন্তার সংকীর্ণতা আসলে কি জিনিস তা নিয়ে। আমি আসলে জানতে চাচ্ছি কোন সময় আমরা বলব কবি আপনার চিন্তায় তো সংকীর্ণতা দেখা যাচ্ছে। কার কোন চিন্তা তাকে সংকীর্ণ বলতে পারি? যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি নিজ নিজ অবস্থানে নিজের চিন্তাকে সর্বোচ্চ জ্ঞান করে। ব্যক্তি যদি বুঝত সে যা ভাবছে তা সংকীর্ণ পর্যায়ের তবে সে অবশ্যই তা থেকে নিজ দায়িত্বে বেরিয়ে আসত। তাই নয় কি? এছাড়া সময় আর পরিস্থিতির কারণে এক ব্যাপার এক এক জনের কাছে এক এক রকম। সো আমার কাছে যেটা যেরকম সেটা অন্যের কাছে সেরকম নাও হতে পারে। সো এইটা আলোচনা করুন যে চিন্তার বা ভাবনার বা বোধের কোন পর্যায়কে আমরা সংকীর্ণ বলব?

দুপুর মিত্র: হুম আপনি বেসিক জায়গাটা ধরেছেন আমরা সবসময়ই একে অপরকে সরিয়ে দেই সংকীর্ণ চিন্তার লোক এই বলে। কেন সে সংকীর্ণ চিন্তার সেটা সে ধরতে পারে না। বুঝতে পারে না আসলেই সংকীর্ণ চিন্তাটা কি? সংকীর্ণ বিষয়টাকে ইংরেজিতে বলে ন্যারো। মানে স্মল। মানে আয়তনে ছোট চিন্তা। মানে চিন্তার একটা জগত থাকে। সেই জগতটা যে যত বেশি পড়াশোনা করে, চিন্তা করে, ভাবে সে তত বেশি বাড়াতে পারে। আর যে পড়ে না, ভাবে না তার ছোটই থেকে যায়। এটাই সংকীর্ণ চিন্তা। আমাদের দেশে আমরা ধর্মীয় চিন্তাকেই কেবল সংকীর্ণ চিন্তা বলে জাহির করি। ধর্মীয় চিন্তা মানে একটা বলয়ের ভেতর চিন্তা মানে একটা জায়গার ভেতরে চিন্তা অবশ্যই সংকীর্ণ চিন্তা। তবে মার্কবাদীরা যদি শুধু মেনিফেস্টো পড়ে, আর কিছু না পড়ে না চিন্তা করে তর্ক করে বা চাপিয়ে দেয় বা কিছু বলতে চায় সেটাও কিন্তু সংকীর্ণ চিন্তা। শিলা।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: ধ্রুপদী আবার সার্বজনীন হয় নাকি?

দুপুর মিত্র: আপনার পয়েন্টটাও কিন্তু বেশ জোরাল। আসলেই তো যা ধ্রপদী তাই কি সার্বজনীন। অথবা যা সার্বজনীন তাই কি ধ্রুপদী। না একেবারে মার্কসীয় সমালোচনা তত্ত্ব ধরে বললে ধ্রুপদী শিল্পরূপ কখনোই সার্বজনীন রূপ পাই নি। বরং এটা বড়লোকের জমিদারের সংগীত হয়েছে। শিল্প হয়েছে। কবিতা হয়েছে। আবার উল্টোভাবে বা একটু অন্যরকম করে যদি ভাবেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা কি ধ্রুপদী কবিতা না? সেটা কি সার্বজনীন না ? আবার সেটা কি আসলেই সকলের কাছে পৌঁছেছে না এলিট ক্লাশ হয়ে এখন কেবল মিডল ক্লাশে লয়ার মিডল ক্লাশে এসে পৌছেছে। অত্রি।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: আমি একটু যোগ করি। বিশ্বাস, নিয়তি, অবধারিত, প্রকৃতি, সম্পর্ক, নিয়ম - এই সব কিছুর একটা আইডিয়া থাকে মানুষের ভিতর, যা সে তার পারিপার্শিকতা ও সীমিত জ্ঞান থেকে পায়। এসব আইডিয়ার ভেতরে আটকে যাওয়াটাকেও এক ধরনের সংকীর্ণতা বলা যায়। কবিকে এই সব আইডিয়া এবং আইডিয়ার বাইরের আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে হয়, তাও আবার মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে। এজন্য আমি কবিকে ধর্মযাজক বলি, যেখানে ধর্ম কবি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করেন।

মনিরুজ্জামান খান: চিন্তার সংকীর্ণতায় কবিতা কুক্ষিগত তো হবেই, কিন্তু কুক্ষিগত হওয়া লাইনগুলোকে কি আপনি কবিতা বলবেন? কবিতা তো একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াতে চায়। কে কতটুকু পারল তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এমন একটা জায়গা যেখানে সবাই সমান দেখে কবিতার তো এমনই আকাঙ্খা থাকে। এ অর্থে সার্বজনীন বলা যায়।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: যেমন জসীমউদদীনকে আমি সংকীর্ণ কবি বলি, কারণ উনি গ্রামজীবনের একটা ইউটোপিয়া থেকে বাইর হইতে পারেন নাই।

দুপুর মিত্র: হুম ভাল একটা ডিবেটে আসা গেছে। জসীমকে যদি আমরা সংকীর্ণ বলি, গ্রামের ইউটোপিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি বলে; ঠিক এই জায়গাতে আবার এই ভাবে যদি ভাবেন সে গ্রাম্য জীবনকেই আদর্শ জীবন ধরে একটা সংগ্রাম চালাতে চেয়েছে কবিতায় ; তাহলে কিন্তু আপনি যে সংকীর্ণতার কথা বলছেন তা থাকছে না। মানে কবিতায় সংকীর্ণতার ধরণটা প্রকাশ পায় আরও ভিন্ন ভাবে ঠিক ।এভাবে নয়। যেটা মনির ভাই বলছেন।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: "মার্কসীয় সমালোচনা তত্ত্ব"-টা কি জিনিস দুপুরবাবু?

অত্রি ভট্টাচার্য্য: ইয়াসিনভাই - কবিতা গ্রাম-শহর সমানভাবে এলে তা সংকীর্ণতার উর্ধ্বে - এইভাবে ভাবা বোধ হয় ঠিক নয়। সংকীর্ণতা-প্রসারতা কোয়ান্টিটেটিভ অপেক্ষক ! মানুষ টু মানুষ, গোষ্ঠী টু গোষ্ঠী ভ্যারী ক'রে।

দুপুর মিত্র: এটা নিয়ে আলাপ করতে গেলে তো অনেক সময় লাগবে। আমি আসলে মার্কসীয় তাত্ত্বিকরা এই যেমন ধরেন টেরি ঈগলটনরা মার্কসকে ধরে যে সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব খাড়া করতে চেয়েছিলেন সেই জায়গা থেকে বলছি।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: এখানেই তো মুশকিল। টেরি ইগলটনের নামটা উল্লেখ ক'রা উচিত ছিল। শূধু মার্কসীয় বললে ডাজন্ট মেক এনি সেন্স !

মনিরুজ্জামান খান: 'বিশ্বাস, নিয়তি, অবধারিত, প্রকৃতি, সম্পর্ক, নিয়ম' ইত্যাদি নিয়ে যখন আপনি 'কবি' হিসাবে ভাববেন তখন তা পারিপার্শিকতা ও সীমিত জ্ঞান হয়ে থাকার জো পাবে না। অসীম অতীত থেকে বর্তমান হয়ে অসীম ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান হতে পারে। আবার এ নিয়ে যে আপনাকে কোনো সূত্র দিতে হবে তা তো না, ভাবনার একটা জানালা খোলা তো হতে পারে খোলা ভাবে। ফিদা।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: সংগ্রাম চালাতে চাইলে মেনে নিতাম, জসীমউদদীন তো ইউটোপিয়া থেকেই বের হতে পারেননি, অন্যভাবে বললে সচেতনভাবে ইউটোপিয়ার বিস্তার করেছেন। সেই সময়ে কবিপাড়ায় স্থান পেতে উনার একটা নিশ (niche segment) সেগমেন্ট দরকার ছিলো, উনি সেটা নিয়েই পড়ে ছিলেন। তাকে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে সংগ্রাম করেননি।

অত্রি, শুধু গ্রাম-শহর কেন উপ-গ্রাম, উপ-শহর সহ আরো যাই কিছু সমান বা ভেঙে আসুক বা না আসুক তার উপর সংকীর্ণতা নির্ভর করেনা। সংকীর্ণ তখনই হয় যখন কবি একটা নির্দিষ্ট বৃত্ত থেকে নিজেকে ও নিজের কবিতাকে বে করে নিয়ে আসতে না পারেন।

আবু এম ইউসূফ: কবি তার সীমাবদ্ধ পরিবেশের মধ্য থেকেই সর্বজনীনতার আবিষ্কারের অভিযানে নামবে। সেটা যদি না করতে পারে, তবে সংকীর্নতার লেবেল তার গায়ে আটকে যেতেই পারে। পরিবর্তন সবসময়ই ধ্রুপদী'র প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। কিন্তু, সর্বজনীনতা কালের অভিযাত্রী। সামগ্রিকভাবেই বাংলা কবিতা যেন বেশী বেশী করে 'আমি'র গন্ডীতে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা সামাজিক মালিকানার বিরুদ্ধে ব্যক্তি মালিকানার জয়জয়কারের কারনে হতেও পারে।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: মনির, আমি কিন্তু প্রকারান্তরে আপনার কথাই বলেছি।

দুপুর মিত্র: আপনি যেভাবে বললেন ধরেন বিনয় মজুমদার। সব জায়গায় উনি গায়ত্রীকেই খুঁজে পেতেন। এটাকে কি আপনি সংকীর্ণতা বলবেন?

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: আবু এম ইউসূফ, 'আমি' গন্ডিতে আবদ্ধ হবার অন্য ব্যাখ্যা থাকতে পারে। হাহাকার, একাকীত্ব, বিষাদ প্রকাশে মানুষ 'আমি'র ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য পায়, কারণ সে তার নিজের বিপর্যস্ততাই শুধু পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: "সব জায়গায় উনি গায়ত্রীকেই খুঁজে পেতেন।" - এটাই একটা সংকীর্ণতা ! হয় জ্ঞানের অথবা চিন্তার সংকীর্ণতা ।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: দুপুর মিত্র, বিনয় মজুমদার এখনো পড়ছি, সার্বিক মন্তব্যের পর্যায়ে এখনো পৌঁছুতে পারিনি। তবে যতটা পড়েছি, উনার লেখায় মিথ ও ধর্মের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব ধরা পড়েছে, গ্রাম থেকে ধর্ম এবং মিথের ব্যাপ্তি অনেক বিশাল, তাই এখনো সংকীর্ণ মনে হয়নি। আর মিথ ও ধর্ম ছাড়াও উনার সৃষ্টি আছে, তাই বলবো উনি আটকে যাননি বা আটকে যেতে চাননি।

আবু এম ইউসূফ: প্রকৃতপক্ষে, একজন কবি সবকিছু ছাড়িয়ে স্বকীয় স্বত্বাটিকেই প্রকাশ করেন। তাঁর উচ্চারণে বা অভিব্যক্তিতে তিনি তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বের গভীরতম বাস্তবতাটাকেই প্রকাশ করেন এবং প্রত্যাশা করেন যে তাঁর শিল্প ও সাহিত্যকর্মের একজন পাঠক সেই কর্মের ঘনিষ্ট সংস্পর্শে এসে তার নিজের অস্তিত্ব, অভিজ্ঞতা অথবা তার নিজেরই পরিচয়টিই খুঁজে পেয়ে সেই সৃষ্টিকর্মটির সাথে একাত্ম হয়ে পরবেন। এই কারনেই এই 'আমি'র মধ্যে সেই একাত্ম হওয়ার উপাদানগুলো বিদ্যমান যদি না থাকে তবে কবিতা 'সংকীর্নতায়' ভুগবে।

দুপুর মিত্র: না এটা সংকীর্ণতা নয়। এটা হলো একজন গায়ত্রী অনেকজন করে তোলা। অত্রি। আপনি যে অর্থে বিনয় মজুমদারকে দেখছেন, ঠিক একই ভাবে জসীকেও পাবেন। ফিদা।

মনিরুজ্জামান খান: ঠিক আছে ইয়াসিন ভাই

দুপুর মিত্র: ঠিক আমি যখন সিঙ্গুলার থেকে প্লুরালে যায় তখন আর সংকীর্ণতা থাকে না। বিষয়টাই হচ্ছে ব্যাপ্তি কে বাড়ানো। যে যত বেশি ব্যাপ্তিকে বাড়াবে, জায়গাকে বড় করবে সে তত বেশি সংকীর্ণতা মুক্ত হবে।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: দুপুর মিত্র, সেটাই। জসীম ব্যাপ্তিটা বাড়াতে পারেননি, বা চাননি।

দুপুর মিত্র: না এটা আমি মানতে রাজি নই। যাই হোক এটা একেবারে জসীম সংকীর্ণ না অসংকীর্ণ এটা একেবারে তাকে নিয়ে পাঠের বিষয়। আমরা সাবজেক্টের ভেতরে আসি। সমকালীন চিন্তার সংকীর্ণতা আর কবিতায় চিন্তা বা চিন্তার ব্যবহার কি একই রকম? কবিতায় চিন্তা কিভাবে ব্যবহার হয়? সেটা কি সমকালীন থাকে না দর্শনে রূপান্তর হয়? আর সেটা হলে সংকীর্ণতার প্রশ্নটি কবিতায় থাকে কিনা?

আবু এম ইউসূফ: আধুনিককালে সমাজে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের অবস্থানগত একটি নেতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, দেখা যায় যায় যে সাধারনভাবে অতীতের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মতৎপরতায় একজন শিল্পী ও সাহিত্যিক মনে করতেন যে, তিনি সমাজেরই একজন সদস্য। এই কারনে তিনি সমাজের মূল্যবোধ ও মনোভঙ্গীর সাথে নিজেকে একজন সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত ব্যক্তি হিসাবেই বিবেচনা করেছেন। এই কারনে, একজন সংবেদনশীল ও সৃষ্টিশীল শিল্পী ও সাহিত্যিকের কর্ম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু, বর্তমান বিশ্বে, শিল্পায়ণ ও নগরায়নের কারনে আধুনিক সভ্যতার কর্পোরেট কালচার একজন শিল্পী ও সাহিত্যিককে ক্রমে ক্রমে একজন বিশেষভাবে দক্ষ কর্মীতেই পরিণত করছে। শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা তাই অনেকসময় শাসকশ্রেণী ও কর্পোরেট শ্রেনীতে অন্তর্ভুক্ত গোষ্ঠীর মূল্যবোধকেই তাঁর শিল্প ও সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়। এই কারনে, যে উপ-সংস্কৃতির জন্ম নিয়েছে, সেই উপ-সংস্কৃতির বৃত্তে দুইটি ভিন্নধারার মূল্যবোধের মধ্যে সংঘাতের ফলে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মাঝে একপ্রকার সার্বিক সমাজবিচ্ছিনতার জন্ম নিয়েছে। কেননা, এই সংঘাত ও দ্বন্দ্বের ফলে মনে হয় দ্বন্দ্বটি যেন ‘অভিজাত’ অথবা 'অধিপতি' শিল্পী ও সাহিত্যিক সমাজের সাথে শাসকশ্রেনী ও কর্পোরেট মহলের করণিক শিল্পী ও সাহিত্যিক সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এই দ্বন্দ্বটি সমগ্র সমাজের একটি সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, যে দ্বন্দ্বটির সাথে জড়িয়ে আছে সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাস, সামাজিক মুল্যবোধ এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তির সর্বজনীন মানবিক দাবী।

মনিরুজ্জামান খান: তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সনে ... এটা পড়ে শৈশবে কৈশোরে কি হত আমাদের? গ্রামের প্রতি গভীর মমতা অনুভব করতাম। এখন যদি বলি জসিমউদ্দিন শহুরে মধ্যবিত্ত জীবন থেকে আর বের হতে না পেরে এখানে তার দায় শুধেছেন তাহলে তো কচি বয়সের সেই নির্জলা মমত্বকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হবে। জসিমউদ্দিন কি তার কবিতার আবেগে থাকবেন নাকি তার ব্যক্তিগত অভিবাসি জীবনের টানাপোড়েনে বিচার্য হবেন তা এখন সমালোচনা বিদ্যা

ইয়াসিন পিদা হুসেন: সমকালীন চিন্তা আর কবিতায় চিন্তার মধ্যে ভেদ টানার সুযোগ খুব কম বলে আমার মনে হয়। আমাদের মানস কবিতার জন্য এক ধরনের চিন্তা আবার ব্যক্তিজীবন বা সমাজ জীবনে ভিন্ন চিন্তা করবেন, এমন মনে হয়না, আর করলে তাকে হিপোক্রেসি বলতে হয়।

কিছু কিছু সমকালীন চিন্তা দর্শনে রূপান্তর হয়, সবকিছু নয়।

দুপুর মিত্র: না আমি একেবারেই বলছিলাম এইভাবে যে contemporary time e একটা চিন্তা আর সমকালীন চিন্তা এক নয়। contemporary time এ অনেক কিছুই হয়ত চিন্তা হল তার ভেতর অনেক চিন্তাই হয়ত চিরন্তনতা পেল। সেটা একটা বিষয়। কিন্তু কিছু চিন্তা সমকালীন যা কখনোই সমকালীনতা থেকে বের হতে পারে না।

আবু এম ইউসূফ: একজন পদ্যকার'কে কবি বলছি কি না ?

একজন কবি' সমকালীন'এর মধ্যে 'সর্বকালীনতার' আবিষ্কারের অভিযানে না নামতে পারলে তাকে 'কবি' বলা যায় কি না ?

দুপুর মিত্র: এই ক্ষেত্রে কবিতাতেও তাই কিছু কবিতা থাকে সমকালীন চিন্তার। সেটা এক পর্যায়ে সংকীর্ণ হয়ে যায়।

যেমন ধরেন জসীমের কবিতাগুলো সত্তরের দশকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গ্রাম থেকে আসা মানুষ গ্রামের মানুষ যখন নিজেরা শহর বানাচ্ছে তখন সেই শহরই তাদের ভাল লাগত না। তারা গ্রামে ফিরে যাবার কবিতা , গ্রামের উপমা এসব দেখলে শিউরে উঠত। এটা সমকালীনতা। কিন্তু জসীমের সব কবিতাই কি সমকালীন। মানে সংকীর্ণ । কেবল মাত্র সেই সময়ের। তা কিন্তু নয় । সেটা হলে আমরা হয়ত আজ জসীমের প্রসঙ্গই তুলতাম না।

মনিরুজ্জামান খান: আমিও বিনয় খুব কম পড়েছি তবু সাহস করে একটু বলি, আর কিছু না লিখে গায়ত্রী বা নিরাকে নিয়েই যদি তারা সারা জীবন লিখতেন তাহলে কি কবিতা হত না? এটাকে তো একটা ফানা পর্যায় বলা যায় যেখানে সব গায়ত্রী বা নিরা হয়ে যায়। বরং এখানে পৌছানটাই একজন কবির জন্য ভাগ্যের ব্যাপার হতে পারে। যেমন হাল্লাজের আনাল হক।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: দুপুর মিত্র, আরেকটা বিষয়, জসীম যদি আমাদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত না হতো তাহলে তাকে নিয়ে কতটা আলোচনা হতো?

দুপুর মিত্র: হ্যাঁ এটা বলতেই পারেন। আবার পাঠ্যপুস্তকে ছিল বলেই যে আলোচনা হচ্ছে এটাও কিন্তু বলতে পারেন না।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: পাঠ্যপুস্তকে ছিলো বলেই আমরা সহজে তা সরিয়ে রাখছিনা, বা রাখতে পারছিনা। গ্রাম নিয়ে তো আরো অনেক কবি লিখেছেন, কেন আমরা জসীমের রেফারেন্সই দেই শুধু।

দুপুর মিত্র: ওই যে বললাম জসীমের কবিতাগুলো সত্তরের দশকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গ্রাম থেকে আসা মানুষ গ্রামের মানুষ যখন নিজেরা শহর বানাচ্ছে তখন সেই শহরই তাদের ভাল লাগত না। তারা গ্রামে ফিরে যাবার কবিতা , গ্রামের উপমা এসব দেখলে শিউরে উঠত। সেসময়ে কিন্তু জসীমই সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি ছিলেন, আমার যার এখন খুব একটা নাম নিচ্ছি না।

মনিরুজ্জামান খান: একটা প্রশ্ন আসছে, সমকালীনতা মাত্রই সংকীর্ণ অভিধা দেয়া হবে কিনা। তাহলে কি কবিদের সমকালীনতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়াই উচিত হবে না সংকীর্ণতা এড়াতে।

দুপুর মিত্র: না না সমকাল অবশ্যই প্রভাব ফেলবে কিন্তু লেখা সেই সমকালীনতাকে ছাপিয়ে ওঠবে।

মনিরুজ্জামান খান: কবি তো সমকালে থেকেই বিবিধ অভিজ্ঞতার জারকে মেশেন

কচি রেজা: চিন্তার সংকীর্নতা বিষয়টা কী? একজন কবি ধর্মে উদার হতে পারেন, পারেন ধর্মান্ধ হতে। একদম নাও মানতে পারেন অথ্যা্ত নাস্তিক ও হতে পারেন। এ-হলো একদিকের কথা। অন্যদিক, যেটা আমরা মাত্র কিছুদিন দিন আগেই রক্তাক্ত ক্ষতের মতো দেখেছি, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে কতিপয় কবিদের আচরন, দৃষ্টিভংগী। দুপুর, আপনি কি মনে রেখেছেন, সৈয়দ আলী আহসান সহ কতিপয় নামী কবিদের কথা?

এদের হাতেও কিন্তু ভালো কবিতা রচিত হয়েছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে এরা কোন শ্রেণীর?

যারা নিজের দেশের স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দেয় না--আমার চোখে তারা চরম সংকীর্ণ এবং প্রতিক্রিয়াশীল ও বটে।

এইভাবে কেবল সমকালে নয় যুগে যুগে জীবন এবং জগতের প্রশ্নে ধনী এবং প্রলেতারিয়েতের লড়াইয়ে কবিরা এক থাকেন নি। ধ্রূপদী কবিতা কিন্তু রচিত হয় নি তাদের হাতে , তাও মিথ্যে নয়। বিষয়টা আসলে বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারবে না। কারণ মানুষ কখন ই কবির থেকে বড়ো নয়। অর্থ্যাৎ কবি স্বত্তা মানুষ স্বত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে নি। অতিক্রম করতে পারে নি।

দুপুর মিত্র: হুম ভাল একটা জায়গা থরেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা বা পাকিস্তানপন্থিরা সেই জায়গাতে অবশ্যই সংকীর্ণ। এবং আপনি যে জায়গায় বললেন কবিতার বিষয়টি আলাদা। বা ভালো কবিতা রচিত হয়েছে। আমি কিন্তু সেই জায়গাটিও প্রশ্নে আনতে চাই। কবিতার ক্ষেত্রে তাদের অবদান কতটুকু যে তাদের এই ভালো কবিতা রচিত হয়েছে বলে আমরা আমলে আনি । ঠিক এই জায়গাতে হুমায়ুন আজাদ কিন্তু ঠিক ছিলেন। তিনি আল মাহমুদের কবিতা তার সংকলন থেকে বাদ দিয়েছিলেন। যদিও বাংলাদেশের সিভিলসোসাইটি এটা মেনে নেয় নি।

মানব সত্তাই কবি সত্তা তৈরি করে। কবি সত্তা আলাদা কিছু বলে আমি মনে করি না। আর যে কোনও মানুষই বা সব মানুষই আসলে কবিতার থেকে আলাদা নয় বা বিচ্ছিন্ন নয়। যে কোনও মানুষই যে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সেটাই কবিতা। সেক্ষেত্রে ধ্রুপদী এই প্রশ্নগুলো অনেকটা একাডেমিক। মৈয়মনসিংহ গীতিকাকে আজ আমরা ধ্রুপদী বলব না?

আবু এম ইউসূফ: যে কোন জৈবিক প্রাণীর মত, একটি সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ পন্থা অবলম্বন করেই আমরা পৃথিবী ও পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের ধারণা, অনুভুতি ও জ্ঞান অর্জন করি। এই পন্থাটি, অবশ্যই একটি মশা, মাছি, তেলেপোকা অথবা ইঁদুরের থেকে জটিল। কিন্তু, তথাপি একথা বলা যেতেই পারে যে, জীবের বিবর্তন আমাদের এই সক্ষমতার সীমাটিকে নির্ধারন করে। আমাদের চতির্দিকে যা কিছু ঘটছে সেই ঘটনাগুলো ঘটার পেছনে সীমাহীন সংখ্যক কারন বিদ্যমান কিন্তু আমাদের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারনে আমরা শুধুমাত্র কতগুলি সংখ্যক অথবা কিছুমাত্র পরিমানে ধারণা, অনুভুতি অথবা জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হই। তা স্বত্বেও প্রাণীকুলের মাঝে হয়তো আমরাই একমাত্র প্রাণী যারা বেঁচে থাকার সার্থকতার একটি রূপ দিতে আগ্রহী। একথা ভেবে যে, আমরা চিন্তা করতে সক্ষম এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই আমাদের চারদিকের পৃথিবী ও পরিবেশলব্ধ ধারণা, অনুভুতি ও জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে একটি বা একাধিক ব্যখ্যা দিতে পারি এবং সেই ব্যখ্যাটি প্রকাশ করতে পারি। আমাদের ব্যখ্যাটি হয়তো সম্পূর্ণ নয় কিন্তু সম্পূর্ণ করার প্রচেষ্টার দিকেই ধাবিত। সুতরাং, এটা এভাবেও বলা যেতেই পারে যে, আমাদের ব্যখ্যাটি যতটা সহজ ও সরলভাবে আমাদের কাছে বোধ্যগম্য ও গ্রহনযোগ্য, বাস্তবতা হয়তো ততটা সহজ ও সরল নয়। আমরা না চাইলেও আমাদের ধারণাকে সুসংহত করতে পারি না, কেননা আমাদের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন ও নানামুখী উপাদান দিয়ে গঠিত। এই ভিন্ন ভিন্ন ও নানামুখী উপাদানগুলি কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত থাকলেও, এই উপাদানগুলির একটি অভিন্ন সুত্র অনেকসময় খুঁজে পাওয়া যায় না। যার ফলে, লব্ধ ধারণা, অনুভুতি ও জ্ঞান; আমারেকে এই বিশ্ব, মহাবিশ্ব, প্রাণী, পরিবেশ, মন ও চেতনা সম্পর্কে যতনা স্পষ্ট করে তার থেকে অস্পষ্টতার বৃত্তটাকেই বাড়িয়ে চলে। শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা যে কতটুকু প্রযোজ্য, এই ক্ষেত্রটির চলমান বাস্তবতার মাঝেই তার অবিরল উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। কল্পিত বাস্তবতা, বিমূর্ততা অথবা পরাবাস্তবতার ধুসর জমিতে একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিক তার নিজস্ব অনুভুতি ও উপলব্ধি তার নিজের কাছেই কতটুকু স্পষ্ট করতে পেরেছেন, এই প্রশ্নের বিশ্বস্ত উত্তর দেয়া যখন কঠিন হয়ে ওঠে, সেই পরিস্থিতিতে একজন শিল্পী অথবা সাহিত্যিকের অন্তরের দ্বন্দ্ব জটিল রূপ পরিগ্রহ করে। যার ফলাফল, হয়তো উচ্চস্তরের শিল্প ও সাহিত্যবোধ সৃষ্টির দিকে ধাবিত ও উত্তীর্ণ করতে সাহায্য করতে পারে অথবা অপ্রত্যাশিত পতনের দিকেও ধাবিত করতে পারে।

বস্তুতঃ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা, অনুভুত বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, বিমূর্ততা ও আধ্যাত্মিকতা বোধের মাঝের বিভেদরেখায় যে সূক্ষ্ম কাচের দেয়াল, সেই দেয়াল অতিক্রম করার চেষ্টায় মাথা খুড়ে দেয়াল ভেদ করে অগ্রসর হওয়ার অপার সম্ভাবনার পাশাপাশি ভেঙ্গে যাওয়া কাচের দেয়ালের সুক্ষ্ম ভঙ্গুর ও সূঁচালু খন্ডে রক্তাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। কেননা, অন্তরজ্ঞাত অনুভুতি প্রকাশের বাস্তব মাধ্যমের সীমাবদ্ধতার দেয়ালটি অস্বচ্ছতা ও দুর্বোধ্যতার কুঁয়াশায় হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় ঘেরা। যার ফলে, সাধনার উচ্চতর স্তরে, একজন শিল্পী ও সাহিত্যিকের জীবনে একাকীত্ব, নিভৃততা ও আত্মকেন্দ্রিকতার দুঃখের কূপের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা হয়ে ওঠে, প্রবল।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: "যদিও বাংলাদেশের সিভিলসোসাইটি এটা মেনে নেয় নি।" - বাংলাদেশের সিভিলসোসাইটি কারা তাহলে? এরা কাদেরকে রিপ্রেজেন্ট করে? এদের মেনে নেয়া বা না মেনে নেয়ায় তাহলে কতটুকু এসে যায়?

সুশান্ত কর: দ্রুত পাঠ করলাম। দারুণ বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু সাধ থাকলেও আমার বেশি যোগ দেবার সাধ্য নেই। সংকীর্ণ সময় সমস্যা। এক জায়গাতে দুপুর মিত্র লিখেছেন, "সেই জগতটা যে যত বেশি পড়াশোনা করে, চিন্তা করে, ভাবে সে তত বেশি বাড়াতে পারে। আর যে পড়ে না, ভাবে না তার ছোটই থেকে যায়। এটাই সংকীর্ণ চিন্তা।" পড়াশোনা মানুষকে চিন্তার প্রসারতা দেয় না, বরং উল্টোটাও হতে পারে। যা তাকে প্রবল দাম্ভিক করে তুলতে পারে। মধ্যবিত্ত যেহেতু বিত্তে শ্রেণি অতিক্রম করবার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না, অনেক সময় সে জ্ঞানকে ব্যবহার করে প্রতাপ বিস্তার করতে। কী পড়বে কেন পড়বে, সেটি কিন্তু নির্ধারণ করে তাঁর বইএর বাইরের জগত। আর এমনিতেও জ্ঞানের অতি অল্পই বইতে থাকে। এক বন্ধু লিখলেন জসিম উদ্দীন গ্রাম্য ভাবনা থেকে বেরুতে পারেন নি, তাই সংকীর্ণ। আমরা কি তবে যারা কবিতাতে গ্রামে পাই ফেলেন না, সেই সব নাগরিক কবিকে ও সংকীর্ণ বলতে রাজি আছি? তবে তো প্রাক বৃটিশ যুগের সমত কবি সংকীর্ণ। কেননা, সাধারণত যিনি বৈষ্ণব কবিতা লিখতেন তিনি শাক্ত কবিতা লিখতেন না। কিম্বা সুফি কবিতা। চিন্তার সংকীর্ণতার প্রশ্নগুলো স্থানে কালে আপেক্ষিক। আমরা কি ইচ্ছে করলেই আর এখন একজন রবীন্দ্রনাথ সমান পেতে পারি? না। কিন্ত্রু অদূর ভবিষ্যতে তাঁর থেকেও বড় প্রতিভা কিন্তু পেতেই পারি, যিনি রবীন্দ্রনাথকেও ম্লান করে দেবেন। রবীন্দ্রনাথের সময়টা কল্পনা করুন। গোটা সমাজ তখন এক নতুন দেশ তথা দুনিয়ার স্বপ্ন দেখছে। এমন আরেকটা আসতে হবে না? মার্ক্সীয় তত্ব্ব জিনিসটা কিন্তু বড় গোলেমেলে চালু আছে। অত্রি সঠিক প্রশ্ন তুলেছেন। নিশ্চয়ই লেখক এবং লেখার শ্রেণি ভেদ আছে। কিন্তু জাত ধর্ম দেশ অঞ্চল এবং সময় ভেদও আছে। আছে বলেই নাগাদের মধ্যে এখনো নিদেন পক্ষে একজন জীবনানন্দও মিলেছে বলে আমি জানিনা, হয়তো হবেও না কোনদিন, হয়তো অন্য বহু প্রতিভা আছে এবং থাকবে। এগুলো এখনো মার্ক্সসীয় তত্বে আলোচিত হয় না। কিন্তু এমনও নয় যে শাসক শ্রেণির লোক হলেই মার্স্কীয়দের উচিত তাদের সৃষ্টিগুলোকে সংকীর্ণ বলে বর্জন করা। মার্ক্স থেকে লেনিনের সবচে প্রিয় লেখকেরা দেখবেন, অমার্ক্সীয় এবং শাসক শ্রেণির লোক। সেক্সপীয়র থেকে বোদলেয়ার হয়ে টলস্টয়। এই দ্বন্দ্বগুলোর ইতিহাস নিয়ে কথা হয় প্রচুর , কিন্তু রহস্যটি বোঝা হয় কম। ইগলটন ইত্যাদি আমি সরাসরি পড়েছি কম। ভবিষ্যতে পড়ার ইচ্ছে আছে।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: কচি রেজা, আল-মাহমুদকে তার রাজনৈতিক দর্শন থেকে আলাদা করে শুধু যদি কবিতায় রাখা যায়, তাহলে আপনি সংকীর্ণতা যাকে বলছেন, তা পুরোটা মিলবেনা। আর মেলে যদি, তাহলে কি আমরা আহমদ ছফাকেও (যেহেতু তারও একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চিন্তা আছে যা স্বাধীনতার পক্ষে) সংকীর্ণ বলবো? ফরহাদ মজহারকে? স্বাধীনতাবিরোধী বা মৌলবাদী সংকীর্ণ নিশ্চই, তবে দেখার বিষয় হলো তাদের কবিতা সেই সংকীর্ণতায় আক্রান্ত কিনা।

আবু এম ইউসূফ: একজন কবির কবিতা তার ব্যক্তিগত জীবনদর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ কি আদৌ থাকে ?

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান

আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি

পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন

আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া–

আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!

কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী

কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন

পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ

মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর

বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।

--- একে যদি শুধু একটি কবিতা হিসেবে পাঠ করা যায়, কেমন হয়? কি দর্শন থাকতে পারে এর?

দীপু হাসান: জগতের সবচেয়ে মধুর মৌলিক সম্ভবত ভাবনার স্বাধীনতার মৌলিক সমস্ত প্রয়োজনের সংসারী হিসেব ছাড়িয়ে, তাই বিষয় এখানে বিশেষ সময়ে বিষয়ী,প্রয়োজনের গন্ডী পেরিয়ে অদেখা মানসলোকে স্থান করে আরাধ্য অভিযানের শ্বাস নেয় অভিযাএীর মতো,চোখ মেলে জাগতিক রুপকথা দেখে, সেই রুপটিই চিন্তার বিকাশের সময় । সেই রুপটিকে ধারন করলেই পালন হয়না তাকে লালন করলেই চিন্তার সংসার । সেই মৌলিকের স্বার্থকতার আবশ্যিকতা নিজেকেই অনুভব করতে হয় কেননা সংসার এই রুপটিকে মনে করিয়ে দিবে না, সংসারী মৌলিকত্বের তালিকায় এই রুপটি সহজে ধরা পরে না । চিন্তার সংর্কীনতার বৃও মুলত সেই রুপটিকে পালন না করা, লালন করলে চিন্তার প্রসারিত শাখা প্রশাখাসমুহ আমাদের দৈনন্দিন ও ভাবীকালের চিন্তার রুপরেখাটি নির্ধারন করে দেয় । আমরা বহু বহু কাল ধরে তাদেরই উওরাধীকার ।

কচি রেজা: বড়োই জটিল। আদর্শ জিনিসটাই অদ্ভূত।

রেজওয়ান তানিম: আজকের আলোচনার বিষয়টি আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। যদিও যোগ দিতে বেশ দেরি হয়ে গেল। কে কি বলছেন সব মোটামুটি চোখ বুলিয়ে এলাম। কিন্তু আমার কাছে বেশ কিছু জিনিস অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। অবশ্য একা আমার কাছেই যে এগুলো অস্পষ্ট এমনটি নয় বোধহয়।

আগে বিষয়টি কি সেটা দেখি। বিষয়টি ছিল- চিন্তার সংকীর্ণতায় কবিতা কি কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে? ধ্রুপদী সার্বজনীন রূপ হারাচ্ছে? এখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা টার্ম পুরো বিষয়টাকে নিয়ে গেছে এক বিরাট দ্বন্দ্বের দিকে।

প্রথমে আসি, কুক্ষিগত হয়ে যাওয়া বিষয়ে। এই শব্দটার প্রয়োগ কবিতার বেলায় কতটুকু প্রযোজ্য তা নিয়ে আমি সন্দিহান। কুক্ষিগত করে রাখা বা নিজের হাতে কবিতার শাসনভার বজায় রাখা দুই অর্থে আসতে পারে এক একটি শক্তিশালী সাহিত্য সিন্ডিকেট যারা দলবদ্ধভাবে তাদের লেখালেখি দ্বারা ইতিবাচক ভাবে সমাজে প্রবাহমান ও গ্রহনযোগ্য সাহিত্য ধারার জন্ম দিয়ে অথবা হতে পারে সেই সিন্ডিকেট অসাধু উপায় অবলম্বন করে যেন তেন উপায়ে অন্য সাহিত্য ধারাগুলোকে দমিয়ে দিয়ে নিজেদের হাতে সাহিত্যের চাবিকাঠি রাখার মাধ্যমে। তবে এই অসাধু সিন্ডিকেটের কুক্ষিগত করে রাখাটা নিন্দনীয় হলেও প্রথমটি কোন ক্রমেই নিন্দনীয় নয় বরং তাদের লেখনীর তাৎক্ষণিক সাফল্য। যদিও এই সাফল্য প্রমাণ করেনা তারা চিরকালীন বিচারে সফল।

আরেকটি ধারা হতে পারে নির্দিষ্ট কোন কবিমাত্রের সাহিত্যকর্ম দ্বারা কুক্ষিগত করে রাখা কবিতার আকাশটুকুকে। এ বিষয়টিকেও নিন্দনীয় ধরা চলে না। আর একক ব্যক্তির পক্ষে অসাধু উপায় অবলম্বন করে ক্ষমতা বা কবিতা কুক্ষিগত করা সত্যিই মুশকিল। তাহলে কুক্ষিগত শব্দটা দিয়ে কি বোঝানো হচ্ছে একটি সাহিত্য সিন্ডিকেট কর্তৃক অপরাপর সাহিত্যকে দমিয়ে রাখা যে কোন উপায়ে হোক?

আরেকটি টার্ম-চিন্তার সংকীর্ণতা। এটি বলতেও আসলে কি বোঝানো হচ্ছে সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। একজন নির্দিষ্ট কবি মাত্রের চিন্তা করার বা নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন ভাবে উপস্থাপনের অপারগতা বা দুর্বলতা ? যদি তাই হয়ে থাকে তবে চিন্তার সংকীর্ণতা কোন অর্থেই কবিতাকে কুক্ষিগত করতে পারে না। কেননা কোন নির্দিষ্ট দেশ, কাল কিংবা সমাজে কবিতার চর্চা একক কোন ব্যক্তির হাতে সোপর্দ করা থাকে না, বরং সামষ্টিক চর্চাই কবিতা। এক্ষেত্রেও কোন কাব্যরীতি হয়ত আপাত পিছিয়ে পড়ে থাকতে পারে পাঠক, সমালোচক কিংবা অপরাপর গোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্যতার অভাবে কিন্তু তাকে ব্যক্তি চিন্তা কিংবা সমাজের চিন্তার সংকীর্ণতা বলে উল্লেখ করা যায় না। এখানেও সিন্ডিকেশনের প্রসঙ্গ আসে। যদি উদ্দেশ্যমূলক কোন একটি সাহিত্যধারাকে খারিজ করে দেবার প্রবণতা কাজ করে কোন সাহিত্য গোষ্ঠীর মধ্যে তবে সেটিকেই চিন্তার সংকীর্ণতা বলে অভিহিত করতে পারি। এই প্রসঙ্গে জীবনানন্দ ও জসিমউদ্দীন প্রসঙ্গটি টানতে চাই। সমসাময়িক দুজন কবিই গ্রাম বাংলা নিয়ে লিখেছেন। অথচ স্বকালে প্রবল জনপ্রিয় এবং বহু ভাষায় অনূদিত জসিমউদ্দীন এর কবিতা এখন মোটামুটি বিস্মৃত প্রায়। অপরদিকে জীবনানন্দ ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে আর কিছুই নয় আমাদের জাতীয় চেতনার পরিবর্তন, পাশ্চাত্য করণ এবং জীবন ধারণের সামষ্টিক চেতনার বদলে ব্যক্তিক চেতনার উদ্ভবকেই চিহ্নিত করা যায়। এ বিষয়গুলো বিগত পাঁচ শতাব্দীতে যত বাড়ছে জীবনানন্দ ততই উজ্জ্বল হচ্ছেন। এই বিষয়টি প্রমাণ করে সমকালের পাঠক কিংবা সমালোচক শ্রেণীর চিন্তার সংকীর্ণতায় জীবনবাবু পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে জসিমউদ্দীন বা কবির চেতনা চিন্তা গত সংকীর্ণতার শিকার কিন্তু তিনি হননি। আমি সমালোচক এবং কবিকে আলাদাই রাখতে চাই কেননা দিনশেষে বড় সমালোচক কোন দিনই বড় কবি নন।

এই তো গেল দুই টার্মের অস্পষ্টতা, এর পরে এসেছে আরেকটি অর্থহীন টার্ম (আমার চোখে) ধ্রুপদ। কোন কবিতাই কি ধ্রুপদ বলে অভিহিত হতে পারে। একশ বছর আগে রবিঠাকুরের বেশিরভাগ কবিতাই ছিল অসাধারণ কবিতা, পঞ্চাশ বছর আগে বেশ কিছু কবিতা অসাধারণ আর এখন স্বল্প সংখ্যক কবিতাই কবিতা; অধিকাংশই পদ্য পদবাচ্য। দেড়শ বছর অনেক বড় ব্যাপার কিন্তু এক সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুধুই একাডেমিক আলোচনার বিষয়বস্তু হবে যেমন হয়েছে মাইকেলের কবিতা। তাই ধ্রুপদ সৃজন বলে কিছু নেই থাকতে পারে বলেও মনে হয় না। চর্যাপদ নিয়ে পাতার পর পাতা আমরা লিখি কিন্তু মন খারাপ হলে কিংবা ধর্মচর্চার সময় এলে ওর শ্লোক গুলো বলি না।

তাই এই বিষয় আলোচনার প্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই, ধ্রুপদ সৃজন বলে কবিতায় কিছু নেই যা আছে তা হল একটি কবিতার দীর্ঘকালীন আবেদন যা কবিতাকে বহমান করে দশক থেকে দশকে, শতকে। আর চিন্তার সংকীর্ণতা নির্দিষ্ট দু একজন কবিকে গ্রাস করলেও সামগ্রিক কবি সমাজকে গ্রাস করার শক্তি রাখে না তাই সে কখনোই ভয়ের কারণ নয়। (একবারে দেয়া গেল না বলে দুবারে দিলাম)

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: রেজওয়ান, তিনটি প্রশ্ন। ১. চিন্তার সংকীর্ণতার উর্ধ্বে না উঠে কি কবি হয়ে ওঠা সম্ভব? ২. জসীমউদদীনকে তাহলে কি আমরা সংকীর্ণ চিত্ত কবি বলতে পারি? ৩. "... দিনশেষে বড় সমালোচক কোন দিনই বড় কবি নন।" - এটা কি সিদ্ধান্তবাচক না হাইপোথিসিস?

আর একটি সংযোগ প্রশ্ন। আপনার চোখে আল-মাহমুদ এবং ফরহাদ মজহার কি সংকীর্ণ চিত্ত কবি?

রেজওয়ান তানিম: আপনার প্রশ্ন চারটির জন্যে ধন্যবাদ। উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।-

১) যে কোন নির্দিষ্ট একজন কবি যেহেতু একটি সমাজের বা দেশের বা ভাষার সামগ্রিক কাব্য চেতনার প্রকাশ নন, তাই চিন্তার এই তথাকথিত সংকীর্ণতার মধ্যে থেকে কবি হওয়া অবশ্যই সম্ভব। ধরি বোদলেয়ার ছিলেন অশুভ পুষ্পের উপাসক, উনার ভাল লাগে না জগতের যত সব আপাত সুন্দর জিনিস;এই ধারনাকে বাতিল করে দিয়ে রোম্যান্টিক কবিরা কি লেখেন নি ? তাতে কি তারা ব্রাত্য হয়ে গেছে ? অতএব চিন্তার সংকীর্ণতা যখন সামগ্রিক বা সামাজিক আকার ধারণ করে তখনই তা ক্ষতিকর।

২) জসিমউদ্দীন কেন সংকীর্ণ চিত্ত কবি হবে? উনার যা ভাল লেগেছে উনা তাই নিয়ে লিখেছেন। উনি কেন লিখেছেন এ প্রশ্ন করেন সমালোচকরা। আজকে যে সমালোচক রা উনাকে ব্রাত্য বলে ঘোষণা করেন তারাই স্বকালে জীবনবাবুকে ব্রাত্য ঘোষণা করেছিলেন। তাই আপনি চাইলে সমালোচকদের বলতে পারেন সংকীর্ণ চিত্তের। যদিও এ কথাটিও বর্তায় না কেননা সমালোচনার নানা আঙ্গিক আছে যার কোনটা ব্যবহার করেছে সজনী কোনটা বুদ্ধবাবু।

৩) এটা আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ। দু একটি ব্যতিক্রম আছে অবশ্য, তবে তা খুবই নগণ্য; ব্যতিক্রম মাত্রই

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: তার মানে কি আমরা প্রতিষ্ঠিত যে কোন কবিকেই চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে দায়মুক্ত করছি?

রেজওয়ান তানিম: ৪) আমার চোখে কোন কবিই সংকীর্ণ চিত্তের নন, অন্তত তার লেখার ক্ষেত্রে। আল মাহমুদ, ফরহাদ মজহার, ব্যক্তিজীবনে কিংবা তাদের কোন কোন লেখায় প্রবন্ধে এবং বক্তব্যে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন ও তা লালন করেছেন। সেটা তাদের ব্যক্তিচরিত্রের সংকীর্ণতা, কবিতার মধ্যে ওটা টানার কিছু নেই।

ভারতে শিব সেনা প্রধান মারা যাবার পর সারা ভারতের সব গণ্যমান্য লোক (কবি ও অন্তর্ভুক্ত) কট্টর এবং উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতা বাল ঠাকরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে। এটাকে কি তাহলে কাব্যিক চিন্তার সংকীর্ণতা বলে অভিহিত করা হবে ভারত বাসীর কিংবা শ্রদ্ধা জানানো কোন কবির ? নাকি তাদের ব্যক্তি চরিত্রের সংকীর্ণতা ? ব্যক্তি ও সাহিত্যকে আমরা প্রায়শই মিশিয়ে ফেলি, বিশেষত এই ভারতবর্ষে। এ কারণেই কবি রবীন্দ্রনাথ এক সময় মানুষ থেকে হয়ে গেছেন গুরুদেব।

আপনার সর্বশেষ প্রশ্নের উত্তর, সাহিত্য জিনিসটা একটা চিন্তা থেকেই আসে, নতুন কিছু সৃজন করতেই আসে। এমনকি তা প্রতিক্রিয়াশীলতা হলেও। তাই চিন্তার সংকীর্ণতা সাহিত্যকে বাধাগ্রস্ত করছে এই মতটার সাথেই আমার সমর্থন নেই।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: অন্ততঃ এইটুকু তো তাহলে বলা যায়, নতুন কিছু সৃষ্টি করা না হলে তা সাহিত্য নয়, অপ-সাহিত্য।

রেজওয়ান তানিম: সে তো অবশ্যই। ব্যক্তি চিন্তার সংকীর্ণতা প্রসূত কোন লেখা যদি সাহিত্য পদবাচ্যই না হয় তা হলে সাহিত্য সংকীর্ণতার চর্চা আসছে কি করে বুঝি না। আর একজন কবি সংকীর্ণতার গহ্বরে আটকে গেলে সময়ই নতুন কবি তৈরী করে নেয়। এক জন কবির জন্যে কোন দিনই কবিতা আটকে থাকে বলে মনে হয় না।

আজকের মত বিদায়। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ফিদা ভাই

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: এই আলোচনায় এটুকুই জানবার ছিলো। ভালো থাকবেন। ভোর হলো প্রায়, হয়নি যখন এখনো, তাই শুভরাত্রি।