অনেকের কবিতায় অন্ধের ছুঁয়ে দেখার যে স্বাদ সেটা পাই না বলেই ভালো লাগে না: কবি মিঠুন রাকসামের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jul 21, 2012 5:51:24 AM

প্রকাশিত বই: মুখ না ধুয়ে লেখা কবিতা, শিকড়ে খরা, শিঙ্গালাগানী মেয়ে, মন্ত্রধ্বনি

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

মিঠুন রাকসাম: কেন যে কবিতা লিখি তা তো সঠিক বলতে পারব না। যখন মনে ভাললাগা-মন্দলাগা ব্যাপারগুলো বুদবুদ করতে থাকে তখন তা প্রকাশ করার জন্য ভিতর থেকেই তাগিদ দিতে থাকে। তখন লিখে ফেলার চেষ্টা করি। আবার এমনও হয় আমি যা দেখছি যা ভাবছি যা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে-নাড়া দিচ্ছে, তাড়া দিচ্ছে তা কাউকে বলতে পারছি না, আবার বললেও ঠিক মত বলতে পারছি না বলেই কবিতায় প্রকাশ করছি! কবিতা এমন একটি মাধ্যম যেখানে নিজেকে ভেঙেচুড়ে নতুন করে আবিস্কার করা যায়, নিজের রাগ-ক্ষোভ, কাম-প্রেম নিরবে উপমা কিংবা চিত্রকল্প ব্যবহার করে প্রকাশ করা যায়। একটি কবিতা লেখার পর মনে কত যে প্রশান্তি আসে তা কি করে বোঝাবো আপনাকে! আরকি করেইবা বোঝানো যায় যে আমি কেন কবিতা লিখি বা লিখছি!

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

মি: কবিতা লেখার জন্যে কতটা প্রস্তুতি নেওয়া দরকার তা বলা কঠিন তবে একজন প্রকৃত কবি নানাদিক থেকে নানাভাবে তৈরি হতে থাকে, হয়ে যায়। কবির বেড়ে ওঠা, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনেকটা কবিকে আলোড়িত করে, ভাবায় বলা যায় সেখান থেকেই একজন কবি তৈরি হতে থাকে। আবার ছন্দ তো জানা দরকার আর সেটার জন্যে কিছুটা হলেও সময় দিতে হয়। তবে আমার মনে হয় বর্তমান সময়ে বিশেষ করে আমাদের জন্যে কবিতা লেখাটা কোমরবেধে নামতে হচ্ছে। কারণ অগ্রজ কবিদের কবিতা পাঠ করে তারপর-না লিখতে যাওয়া। কত দশকের কবিতা যে পড়তে হয় আর দেশের বাইরের কবিতা তো আছে! আর নিজ সময়ের লেখাও পড়তে হয়। তাহলে এই যে কবিদের কবিতা পাঠ করা কি প্রস্তুতি নয়? আমার মনে হয় হুট করে যেমন গল্প উন্যাস লেখা যায় না তেমনি কবিতাও হুট হাট করে লেখা যায় না। অনেকে হয়তো বলতে পারে কবিদের আবার প্রস্তুতি কি? আমার মনে হয় বর্তমান সময়ে কবিদের আরো বেশি প্রস্তুতি দরকার। সেটা পাঠের মধ্য দিয়ে হতে পারে, ভ্রমণের মধ্য দিয়ে হতে পারে কিংবা অন্য কোনোভাবেও হতে পারে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

মি: সমসাময়িক অনেকের কবিতাই ভালো লাগে। নাম বললে শেষ হবে না। ঠিকমত বলতেও পারব না। কারটা রেখে কারটা বলি। কেন ভালোলাগে...? একেকজনের কবিতা একেক কারণে ভালোলাগে। সব মিলে কবিতায় আমি আমার চেনা জগৎকে, আমার ভাবনাকে দেখতে পাই বলে ভাললাগে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

মি: নাম বলে কি মার খাবো! হা হা হা...এমনিতেই মিঠুন রাকসাম অনেকেরই চক্ষুশূল আর নাম বলা! আপনি কি আমার শত্রু বাড়াতে চান? আপনার সাথে তো আমার কোনো শত্রুতা নাই! কেন খারাপ লাগে তা কবি অরুণ মিত্রের একটি কবিতার লাইন দিয়েই বলি-‘প্রাজ্ঞের মত নয় অন্ধের ছুঁয়ে দেখার মত করে বলো’। বলা দরকার এই লাইনটি আমার অসম্ভব রকমের প্রিয়! অনেকের কবিতায় অন্ধের ছুঁয়ে দেখার যে স্বাদ সেটা পাই না বলেই ভালো লাগে না।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দখেছেনে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

মি: মূল্যায়ন কি খুব সহজ? দুই দশকের কাজ দুই ধরনের। নব্বই আর শূন্যের কবিদের চিন্তা চেতনা-ভাবনায় ফারাক কি নেই? মিল একটিই তা হলো আমরা সবাই কবিতা লিখতে চেয়েছি, চেষ্টা করেছি এমন কি লিখে যাচ্ছি... চেষ্টা করে যাচ্ছি।

দু: পশ্চিমবঙ্গরে কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

মি: নামেইতো ফারাক-পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ। আর কবিতা-কবিতে তো ফারাক থাকবেই। বাংলাদেশের কবিরা যে যুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছে সেটা কি পশ্চিমবঙ্গের কবিরা তা করেছে? কিংবা পশ্চিমবঙ্গের কবিরা যে নকশালবাড়ি আন্দোলকে দেখেছে তা কি বাংলাদেশের কবিরা দেখেছে? তাহলে কবি ও কবিতায় চিন্তা ও ভাবনায় লেখায় ও রেখায় কেন ফারাক থাকবে না?

আবার পাঠের বিষয় যদি ধরি তাহলে বিনয়, শঙ্খ, উৎপল, ভাস্কর, অরুণ মিত্র, মণিন্দ্র গুপ্ত, শামশের আনোয়ার, কালীকৃষ্ণ গুহ, রনজিৎ দাশ যেভাবে পাঠ করি সেভাবে কি শামসুর রহমান, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নুরুল হুদা কিংবা মহাদেব সাহা পাঠ করি? কিংবা যেভাবে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র কিংবা সতীনাথ ভাদুরী পাঠ করি সেভাবে কতটা হাসান আজিজুল হক, শওকত ওসমান, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন পাঠ করি? তাহলে ফারাক কি নেই? লেখায়, ভাবনায় বিষয়ে স্টাইলে?

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

মি: দিচ্ছে, তার যা দেওয়ার ক্ষমতা। কিন্তু বিশেষ কিছু দিচ্ছে কিনা তা অনেক গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা, অবলোকনের ব্যপার সেটা তো আমার নাই দুপুর দা!

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

মি: মোটেও না। বলা যায় একেকজন একেক ব্লগ তৈরি করে বসে আছে দোকানদারির মত কিন্তু তাতে সাহিত্যের কতটুকু কাজে আসছে কিংবা যারা সাহিত্য চর্চা করতে আসছে, আসার জন্যে তৈরি হচ্ছে তারা কতটা প্রেরণা পাচ্ছে বা তাদের উপকার হচ্ছে, যেভাবে একটা লিটলম্যাগ তরুণ কবিদের জন্যে সাহিত্য চর্চার একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে সেভাবে কি ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বা পারছে? (তা দেখার বিষয়। শুধু ব্লগের প্রশংসা করে তো লাভ নাই। আবার কুৎসা গেয়েও কি লাভ বলেন?) যদি না পারে তাহলে আমি ব্লগকে কেন লিটলম্যাগের সাথে তুলনা করবো? আর ব্লগ সেই ব্যবহার করতে পারে যার ব্লগ ব্যবহার করার মত এবিলিটি আছে কিন্তু আমাদের কতজনের এবিলিটি আছে লিটলম্যাগের মত ব্লগ ব্যবহার করার? আর এটাও তো মাথায় রাখতে হবে লিটলম্যাগে লেখা ছাপা হবার যে আনন্দ সেটা কি ব্লগে ছাপা হলে পাওয়া যায় বা যাবে? নিজের লেখা ছাপা হওয়া লিটলম্যাগ ব্যাগে ভরে বা টেবিলে, সেলফে সাজিয়ে রাখা যায় ব্লগে কি সেটা সম্ভব? সত্যি বলতে কি আমি মনিটরে বেশিক্ষণ পড়তে পারি না। তাই ব্লগের প্রতি অতটা আগ্রহও নাই।

আমার মনে হয় যারা তরুণ লিখিয়ে তাদের জন্যে লিটলম্যাগের বদলে ব্লগ মোটেও ভাল নয়।

দু: দৈনিকের সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

মি: দৈনিক পত্রিকা তার কাজ করে যাচ্ছে দৈনিকের মতই। দৈনিক পত্রিকা দিয়ে তো একটি দেশের, একটি রাষ্ট্রের সাহিত্যকে আপনি বিচার করতে পারেন না। আর দৈনিকের উদ্দেশ্য কি সাহিত্য সেবা করা? আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্য পাতা না থাকলেই খুশি হতেন মালিক পক্ষ। তবে এটা ঠিক দৈনিকে লেখা ছাপা মানে হাজার হাজার কপি ছাপা আর তা হাজার হাজার পাঠকের হাতে যাওয়া কিন্তু প্রকৃত পাঠক নিয়েও তো প্রশ্ন আছে! গোটাদশেক বাদে সব চ্যামের পাঠক! হা হা হা...

তবে একেক পত্রিকার সম্পাদকের রুচি আর মর্জি একেক রকম সুতরাং তাদের সাহিত্য সেবার মনোভাবও ঐরকম! আমার দৈনিকের পর্যবেক্ষণ এটাই।