কবিতার রাজ্যে আমি এক স্বঘোষিত ভিলেন: কবি বারীন ঘোষালের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 7, 2012 9:12:44 AM

দুপুর মিত্র: কালগাড়ি পত্রিকার গ্রীষ্ম ২০১০ সংখ্যায় অলোক বিশ্বাসের নেওয়া আপনার একটি সাক্ষাতকারে আপনি বলেছিলেন যে, কবিতার ব্যাখ্যায় আমি বিশ্বাস করি না । কেন বিশ্বাস করেন না এ নিয়ে কিছু বলবেন?

বারীন ঘোষাল: প্রথমেই আমি একটা বোমা ফাটিয়ে দিই-- ঠিক আছে? দীর্ঘকালব্যাপী প্রকাশিত আমার লেখা গদ্যগুলো পড়া না থাকলে শুরুতেই বলে রাখি-- কবিতার রাজ্যে আমি এক স্বঘোষিত ভিলেন--হা: হা: ! তুলনীয় উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে ইওরোপ-ফ্রান্সে কবিতার 'রাজা-রাজপুত্র' অভিধা-- বিংশ শতাব্দীর মিডিয়া উত্থানে বাংলা ভাষা দুনিয়ায় বাজার সম্মানিত ক্ষমতাবান কবিদের আবির্ভাব ও আকর্ষণ। তারই বিকর্ষণে আমার কবিতা-ভিলেইনি। পরের কথাগুলো ভাবতে বলি।

সংস্কৃত ভাষায় শব্দের গঠনের মধ্যেই ছিল শব্দের অর্থসূত্র। ইংরাজি শিক্ষায় কালে কালে বাংলা অক্ষর ও শব্দ পুনর্গঠনের সময় আভ্যন্তরীন অর্থব্যবস্থার বদলে লোগোসেন্ট্রিক বা প্রতীকসর্বস্ব হয়ে উঠল শব্দব্যবস্থা। তাই বাংলা বা ইংরাজি শব্দের কোন মানে হয় না। অভিধান অনুযায়ী শব্দগুলি প্রতীক ও রূপক মাত্র। যে কোন শব্দের ধ্বনি থেকে সম্পর্কিত নানা বস্তু বা ভাব, বা বস্তুভাবের রূপ ফুটে ওঠে তা আমরা ছেলেবেলায় বর্ণপরিচয় থেকেই শিখেছি। কোন শব্দেরই কোন অমোঘ অর্থ বা মানে হয় না বলেই সেই সব শব্দ দিয়ে রচিত কবিতারও কোন মানে হয় না। প্রতীক শব্দে রচিত কবিতা প্রতীকশ্রেণী বা রূপকথা হতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যাসম্ভব কবিতা হতে পারে না কখনোই।

'কবিতার শত্রু' নামের একটা গদ্যে কবিতার শত্রু হিসেবে যাদের চিহ্ণিত করেছিলাম তাদের মধ্যে অন্যতম হল বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ। কারণ, তারা রাষ্ট্র, ধর্ম ও সমাজের রক্ষণশীল পরিমন্ডলের মধ্যে ছাত্রদের সিলেবাস অনুযায়ী কবিতার সারাংশ ও ব্যাখ্যা রচনা শিখিয়ে হয় কবিতার প্রতি তাদের বিরূপ করে অথবা ভুল বুঝতে শেখায়। বোঝ! যার মানে নেই তার আবার ব্যাখ্যা!

তাহলে শব্দে রচিত কবিতা আমাদের কি দেয়? দেখা যাক একটু ভেবে। যে কোন দেশে যে কোন সময়ে কবি প্রথমে একটি নিরাকার কবিতার অনুভব বোধ করে, লালন করে, তারপর সেটি চাক্ষুষ সংরক্ষণের জন্য ভাষায় প্রকাশ করতে চায়। এই প্রকাশিত শব্দসজ্জাটি কবিতা নয়, কারণ, মূল কবিতাটি কবির মনেই রয়ে যায় এবং বারে বারে সেটি তাকে প্রেরিত করে আবার নতুনতর শব্দসজ্জায় মূল কবিতার আরো কাছাকাছি যেতে। প্রকাশিত শব্দসজ্জাটিকে আমি বলি কবিতালিপি, যেমন গানের সুরের হয স্বরলিপি। আমার কবিতালিপি থেকে আমি কবিতার অনুভবটিকে পুনর্জাগ্রত করতে পারি। সব কবিই তা পারে। আমি অন্য কবির কবিতালিপি থেকে তার কবিতায় পৌঁছবার চেষ্টাও করি। তা সম্পূর্ণ হবার আগেই হয়তো মাঝপথে কবিতালিপিটি আমার ব্যক্তিগত কবিতাবোধে টংকার দিয়ে অন্যতর কবিতার জারণ-প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। তখন আমি বলি শব্দরূপে লিখিত কবিতালিপিটি বেশ ভালো, অসাধারণ। সাধারণত মানুষ যাকে কবিতা বলে আমি তা বলি না। স্বরলিপির নোটেশনের মতো কবিতালিপিতে কোডস থাকে। অভিজ্ঞ শিক্ষিত পাঠক সহজেই তা ডিকোড/আনকোড করে নিতে পারে। আমি পারি। এনজয় করি।

আমাকে এতদূর জানার পরেও অলোক বিশ্বাস কেন ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করলো? ব্যাখ্যা যারা করে তারা পোস্টমর্টেমের মতো মৃত নিষ্প্রাণ কবিতার ব্যবচ্ছেদ, বিনির্মাণ করে থাকে। কবির শিল্পবোধ, নান্দনিক দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গী, দর্শন, বুদ্ধিমত্তা, উইট, হিউমার, বিষাদ, আনন্দ, প্রেম, নিবেদন আবিষ্কার করে থাকে ব্যাখাতারা। কবিতার প্রাণপাখি ততক্ষণে উড়ে গেছে। শব্দসজ্জার নিপুণতার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সেসবের মধ্যে কবিতা থাকে না কোথাও। তাহলে কবিতার ব্যাখ্যা করি কি করে? আমি বিশ্বাস করি না। এটা কবিতার ভিলেনি নয়? তোমরাই বল!

দু: আপনি লিটলম্যাগের লেখক হিসেবেই পরিচিত হতে কি বেশি পছ্ন্দ করেন? করলে কেন, না করলে কেন নয়?

বা: ব্যাপারটা পছন্দ অপছন্দের নয়। এটাই ছিল আমার ভবিতব্য। ১৯৭১ থেকে শুরু করে ছোট পত্রিকা 'কৌরব' এর সঙ্গে আমি আজও ওতপ্রতভাবে জড়িত। লিটল ম্যাগের সংসারেই বেড়ে উঠেছি। ১৯৮১ সালে কৌরব বাংলার শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিনের শিরোপা পেয়েছিল এবং আজও সেই উজ্জ্বলতা বজায় আছে। আমাদের দেখলেই লোকে বলত--ঐ, কৌরবরা এসে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানের লেখকরা কৌরবে লেখার সুযোগ না পেলে দু:খিত হতো। সেই গর্বই আমাকে কোনদিন প্রতিষ্ঠানমুখী হতে দিল না। মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রিক কারণে কলকাতা ক্ষমতাবানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হওয়া সত্বেও পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগাজিন কি করতে পেরেছিল-- ভাবা যায়!

দু: হাংরি আন্দোলনের কবিতা বিকাশে কি কোনও ভূমিকা রয়েছে? থাকলে সেটা কেমন? না থাকলে কেন?

বা: হাংরি আন্দোলনের ফলে বাংলা কবিতা ভুবনে দুটি বিশেস উপকার হয়েছিল।

  • আবহমান বাংলা কবিতার ধ্বজাধারী প্রতিষ্ঠানের রক্ষণশীল শুদ্ধতাবাদীদের মুখোশ খসে পড়েছিল। বাবুদের বৈঠকখানা ছেড়ে পথে নেমেছিল কবিতা। আন্দোলন বন্ধ করার জন্য তাদের চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গিয়েছিল।
  • সাব-অল্টার্ন ভাষায় কবিতা লেখার সাহস এগিয়ে এলো। ভাষামুক্তি হল প্রায়। তবে এসবই ছিল কবিতার বহিরঙ্গ। মূল কবিতাবোধে কোন রূপান্তর হয় নি।

দু: ষাটের দশকে বাংলাদেশেও অনেকটা হাংরি আন্দোলনের আদলে স্যাড জেনারেশন মুভমেন্ট হয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

বা: বাংলাদেশের কবিতাচর্চার বিষয়ে আমার জ্ঞান সামান্য। স্যাড জেনারেশন সম্পর্কে আমার ধারণা এরকম-- ষাট দশকে হাংরি আন্দোলন নয়, রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের জন্য পশ্চিমবঙ্গে সংগঠিত নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে তুলনীয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ-বিদ্রোহের অগ্রিম আন্দোলনগুলোর মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্বের সাহিত্য প্রকাশে সঠিক সময়ে সঠিক ভূমিকা নিয়েছিল স্যাড জেনারেশন আন্দোলন। আমি ভুল বললে শুধরে দিও।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতাকে মোটা দাগে কিভাবে আপনি পরিচয় করিয়ে দিতে চান?

বা: পশ্চিমবঙ্গে ৯০ এ দশকব্যাপী সংগঠিত ওয়ার্কশপের মাধ্যমে কবিতাধারার মুক্তি ঘটে গেছে। অর্থে, প্রতিষ্ঠানে ও মিডিয়া পালিত মেইনস্ট্রিম কবিতাধারা বিপক্ষে একেবারে নতুন পরিবেশে 'নতুন কবিতা'র উদ্ভব হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনকে বেস করে। তরুণ কবিদের আর প্রতিষ্ঠানের পিছনে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। দৈনিক পত্রিকার দাদাদের দাদাগিরি ঘুচে গেছে। শূন্য দশকে এবং পরবর্তীতে কবিরা আজ জীবনানন্দের সুররিয়াল প্রভাব মুক্ত হয়ে কবিতা লিখে থাকে। তাই বলে কি ইঁদুরের আকাল হয় নাকি? হা: হা: ! আর ইঁদুর থাকলে দৌঁড়ও চোখে পড়বে স্বাভাবিক।

দু: বাংলাদেশের কবিতা আর পশ্চিমবঙ্গের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

বা: বাংলাদেশের কবিতা আর পশ্চিমবঙ্গের কবিতার মধ্যে কোন ফারাক নেই। তবে, হ্যাঁ, কবিতালিপির ফারাক আছে। তার মূল কারণটা হল জিওপোয়েটিক। আর খানিকটা মৌলবাদী নজরদারি।

দু: দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য কিভাবে সাহিত্যকে বা সাহিত্যের বিকাশকে ধ্বংস করে দেয়?

বা: মানুষের মনের চাহিদার কারণে চিরকাল সাহিত্যের বিকাশ হয়েছে। দৈনিক পত্রিকা তাকে ধ্বংস করতে পারে না। দৈনিক পত্রিকা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকে। নিউজের মধ্যে গল্পের ভেজাল দিয়ে উত্তেজনা ছড়ায়। সাহিত্যকেও ভেজালযোগ্য বিবেচনায় সাহিত্যিককে বাজারমুখী করে দেয় বিক্রির টোপে। সাহিত্যিক তার রচনাতে ভেজাল দিয়ে বাজার দর বাড়াতে থাকে। আনসাস্পেকটিং সাধারণ পাঠক সেদিকেই চালিত হয়। কবি হিসেবে আমি এসব সমস্যাকে পাত্তা দেই না।

দু: পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য আগ্রাসনের ধরণগুলো কেমন?

বা: ওপরেই বললাম। জীবনে আমি ওমুখো হইনি। ভেতরের খবর জানি না। আমি নিজে গত ২৫ বছর দৈনিক বা সাময়িক সাহিত্য পত্রিকা পড়িনি। তাই জানি না সব।

দু: সাহিত্য কি কলোনিয়াল মাইন্ড নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে? বাংলা কবিতায় এই কলোনিয়াল মাইন্ডকে কিভাবে দেখা যায়?

বা: ওপরে ৩ নং এ হাংরি আন্দোলন বিষয়ে বক্তব্যে কিছুটা বলেছি। কলোনিয়াল মাইন্ড ব্যাপারটা কি একটু ভাবা যাক। গাজোয়ারি কলোনি প্রতিষ্ঠাতা ও শাসকের মাইন্ড তো জাতির মাইন্ড হয় না। সাহিত্যিকের মাইন্ডও হয় না তেমন। অধিকৃত ও শাসিত জাতির চরিত্র ও মাইন্ড সাধারণভাবে পদলেহনের জন্য উন্মুখ হলেও সাহিত্যিকের তেমন হয় না। শাসক ও শাসিত উভয়পক্ষের সতসাহিত্যিকদের মাইন্ড স্বাধীন ও ফ্রি থাকে। সেখানে সাহিত্য বেড়ে ওঠার কোন বাধা নেই। এশিয়ায়, ল্যাটিন আমেরিকায়, আফ্রিকায় আমরা সেটাই দেখেছি। ফলে এ নিয়ে রাজনীতির কোন অবকাশ নেই।