ভিন্ন পথ ভিন্ন মতকে সব সময় শ্রদ্ধা করা উচিত: রবিউল করিমের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Nov 4, 2012 9:52:32 AM

প্রকাশিত বই: পৃথিবী কিংবা নরকের গল্প, ডোরাকাটাদের দেশে ও অন্যান্য গল্প

সম্পাদক: ব্যাস

দুপুর মিত্র: গল্প লিখেন কেন?

রবিউল করিম: মাঝে মাঝে এই প্রশ্নটা আমাকেও ভাবায়। সত্যি বলতে কি, এর উত্তরটা আমার কাছেও স্পষ্ট নয়;- রহস্যময়। কখনো কখনো এমন কিছু মাথার ভেতরে চাপ তৈরি করতে থাকে যে, তথন সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য লিখি। আবার কখনো স্রেফ লিখতে পারি বলেই যা কিছু নিয়ে একটা খেলায় মেতে উঠি। আপনি যখন জেনে যাবেন যে, আপনার ভেতরে এক ধরনের ক্ষমতা আছে যা অন্য দশজনের ভেতরে নেই, তখন কিন্তু আপনি তা প্রকাশ করতে চাইবেন, অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইবেন। গল্প বলে সেরকম অন্যকে, ঠিক আমি যেরকম চাই সেরকম মানসিক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারাটার ক্ষমতাটাও কখনো কখনো প্রলুব্ধ করে লিখতে। বড় হাস্যকর হতে পারে এসব কথা কিন্তু সত্যিই আমি জানি না কেন লিখি।

দুপুর মিত্র: আমরা প্রচুর পরিমাণ রাশিয়ার ফিকশন পড়ার পরও যাদু বাস্তবতার পৃথিবীতে গল্পকে নিয়ে গিয়েছি। এটা কেন?

রবিউল করিম: প্রশ্নটা ঠিক বুঝলাম না। রাশিয়ান ফিকশন পড়ার সাথে যাদু বাস্তব পৃথিবীর বিরোধ কোথায়? আর আমরা প্রচুর রাশিয়ান ফিকশনই-বা পড়েছি বা পড়ছি কোথায়? গোর্কি, দয়স্তভস্কি, চেখভ… এদের সাথে সাথে তো আমরা পৃথিবীর অন্য দেশের সাহিত্যও পাঠ করছি প্রতিনিয়ত। আপনার কি মনে হয় রাশিয়ান সাহিত্যিকরাই শুধু প্রভাব বিস্তারকারি? অন্যরা নয়? একটা সময় ছিল যখন এসব আমাদের বলা হতো, এটা মহৎ, এটাই ঠিক। কিন্তু প্রকৃত লেখকরা কখনোই এসব বিশ্বাস করেন নি। আর এখন তো যুগ পালটে গেছে। হাত বাড়ালেই সারা পৃথিবী আপনার নাগালে। কেউ কাউকে শাসন করতে পারে না, যদি না শাসিত হতে না চায়। আর লেখকরা তো নয়ই। আপনি হয়ত জানতে চাইছেন যে, রাশিয়ান ফিকশনে যে শ্রমজীবী মানুষ এবং বাস্তবতা নিয়ে আখ্যান রচিত হয় তা যাদু বাস্তবতায় অনুপস্থিত থাকে কেন? যদি তাই হয়, তবে তা সম্পূর্ণ ভুল। আমরা ল্যাটিন আমেরিকার যে যাদু বাস্তবতাকে নিয়ে মাতামাতি করছি, তার বহু আগেই আমাদের দেশে এর চর্চা ছিল। যেমন ঠাকুরমার ঝুলি। এটা আসলে সাহিত্যের এক ধরনের কৌশলের ব্যাপার। যখনই লেখক সরাসরি কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখিন হয়েছেন তখনই যাদুবাস্তবতা বা অন্যকিছুর আড়াল নিয়েছেন। সেটা এদেশেও ঘটেছে ওদেশেও ঘটেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থার নিরিখে লেখকরা কৌশল বদলিয়েছেন। ঠাকুরমার ঝুলিতে রাজা ও ব্রাহ্মন্যবাদের ভয়ে। শহিদুল জহিরের ক্ষেত্রে সরকারি চাকুরিজীবী, স্বৈরশাসন এসব বাধার কারণে। শুধু বাধা থাকলেই যে যাদুবাস্তবতা চর্চিত হবে এমন নয়, অন্যসময়ও যাদুবাস্তবতা চর্চিত হতে তো দোষ নেই। লেখকই নির্ধারণ করবেন তিনি পাঠককে কিভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করতে চান। আর বর্তমান সময়ে এই দেশে ক’জনই-বা যাদুবাস্তবতা নিয়ে কাজ করছে? বেশিরভাগই মুক্ত বাস্তবতা নিয়ে গল্প, উপন্যাস রচিত হচ্ছে। গল্প এখন আর কোনো ভৌগলিক সীমারেখা মানছে না এই বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে।

দুপুর মিত্র: আমি গল্প লিখতে চাইলে আপনি কি করার পরামর্শ দিবেন এবং কেন?

রবিউল করিম: মনটাকে সংবেদনশীল করুন। যতক্ষণ জেগে আছেন, চারপাশটা ভালো করে দেখুন এবং বুঝতে চেষ্টা করুন। প্রচুর পড়ুন তা যা কিছু হোক না কেন। এসবই আপনাকে সাহায্য করবে লিখতে। একজন রিক্সাচালক কিভাবে রিক্সা চালায়, তার প্রতিটি পেশীর নড়াচড়া, মুখের অভিব্যক্তি, তার ভাষা কিংবা একজন মানুষের ভাত খাওয়ার ধরন, সে কি ভাত ছোট ছোট না বড় বড় দলা পাকিয়ে খাচ্ছে? খাওয়ার সময় তার চোখমুখ কেমন দেখাচ্ছে, ঘামছে কি না? শব্দ হচ্ছে কি না? সব কিছু একবারে মেখে খাচ্ছে নাকি আলাদা আলাদা? মোটকথা গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ছাড়া গল্প লিখতে পারবেন না; সেটা ব্যক্তি মানুষ, রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র যা কিছু হোক না কেন। আর সবকিছু স্পষ্ট হলো অথচ আপনার মধ্যে কোনো ক্রিয়া তৈরি হলো না- মনে হলো হচ্ছে হোক, আমার তো গায়ে লাগছে না, তা হলে লিখতে পারবেন না। গায়ে লাগাতে হবে। রামুতে, ইরানে, আমেরিকায়, সিরিয়ায়, আফগানিস্থানে… পৃথিবীর যেখানেই যা কিছু ঘটুক না কেন গায়ে লাগাতে হবে। মনের ভেতরে বিক্রিয়া না ঘটলে কিছুই লিখতে পারবেন না। আর পারবেন না, যদি কিছু বলতে না চান। আমারও কিছু বলার ছিল-এটাই হচ্ছে গল্প। আমি অনেককে মজা করে বলি, কোনো কুজো গল্পকার হতে পারে না। গল্প লিখতে হলে কোমরটা শক্ত হতে হয়, মাথাটা সোজা করে চলতে হয়।

দুপুর মিত্র: আপনি দীর্ঘদিন ধরে কথাসাহিত্যের কাগজ ব্যাস সম্পাদনা করছেন। বাংলাদেশে কথাসাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিকল্প ভাষা নির্মাণ এসব বিষয়ে কিছু বলুন।

রবিউল করিম: দেখুন, ব্যাস যখন বের হয় তখন পূর্ববর্তী কথাসাহিত্যের কাগজগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছিল মিশ্র কাগজ। কবিতা, গল্প, আলোচনা ছাপতো। তো ব্যাস বেরুল এবং পাঠকের কাছে তার একটা আবেদন তৈরি হতে লাগল। আমি কতটুকু সার্থক কতটুকু ব্যর্থ তা ব্যাস-এর পাঠকরা বলতে পারবেন। তবে সব সময় চেয়েছি, লেখকদের সেরা লেখাটা প্রকাশ করতে। আমি লেখকদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমি শুধু তাদের প্রলুব্ধ করতাম। এমনটা লিখলে কেমন হয়, এটা নিয়ে ভাবা যায় কিনা? এসব প্রশ্ন তাদের দিকে ছুড়ে দিতাম। আমি জানতাম সময়মতো তারা ঠিকই এসব নিয়ে লিখবে বা ভাববে। খোকন কায়সার যখন প্রচলিত ভাষা কাঠামো আর জনরুচিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লিখতে শুরু করল আমি উৎসাহ দিলাম, প্রকাশ করতে লাগলাম। রাখাল রাহা যখন আঞ্চলিক ভাষায় একটা উপন্যাস নিয়ে হাজির হলো, আমি আগ্রহভরে প্রকাশ করলাম। এমনিভাবে, প্রশান্ত মৃধা, আহমাদ মোস্তফা কামাল, রায়হান রাইন কিংবা অপেক্ষাকৃত তরুণেরা যখনই প্রচলিত সাহিত্য ভাবনার বাইরে কিছু ভেবেছে, তখনই ব্যাস তাদের সঙ্গ দিয়েছে। কিংবা বলা যায় তারা ব্যাস-এর জন্য ভিন্ন মেজাজের লেখা লিখেছেন যা অন্যরা প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। এসব কথা এই কারণে বলছি যে, আপনি চাইলেই রাতারাতি সবকিছু পালটে দিতে পারবেন না। নতুনকে গ্রহণ করার মানসিক অবস্থা আগে আস্তে আস্তে আপনাকে তৈরি করতে হবে পাঠকদের মাঝে। তারপর পরিবেশন করতে হবে। আমি সেই কৌশলই নিয়েছিলাম। আপনি খেয়াল করবেন, ব্যাস-এ অনেক কবিদের গদ্য প্রকাশিত হয়েছে। তাদের সবসময় উৎসাহ দিয়েছি গদ্য লেখার জন্য। কেননা কবিদের গদ্য কথাকারদের চাইতে আলাদা হয়। তাদের ভাষা ব্যবহার ভিন্ন হয়, পরীক্ষা- নিরিক্ষাও বেশি থাকে।

সব লেখকরাই প্রচলিত ভাষা কাঠামোকে আঘাত করতে চায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চায়। নিজেকে আলাদা করতে না পারলে পাঠক গ্রহণ করবে কেন? আর ছোটকাগজগুলোই তো এইসব পরীক্ষা নিরিক্ষার ক্ষেত্র। সম্পাদকরা এসবকে প্রশ্রয়ও দিয়ে থাকে, আমিও দিয়েছি।

দুপুর মিত্র: আমি যদ্দূর জানি শিরদাঁড়া করার প্রথম চিন্তা এসেছিল আপনার মাথায়। প্রথম সংখ্যা পরে আপনি আর শিরদাঁড়াতে থাকলেন না কেন, এসব ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন।

রবিউল করিম: হ্যাঁ। শিরদাঁড়া করার কথা আসলে ভেবেছিলাম ব্যাস-এর বিকল্প হিসাবে। কারণ ব্যাস ততদিনে একটা অবয়ব পেয়ে গিয়েছিল, তার পাঠকরাও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তখন আমি ভাবছিলাম, ভিন্ন কিছু করার কথা যা ব্যাস-এর সাথে ঠিক যায় না। যেখানে সমকালীন সাহিত্য নিয়ে কঠোর সমালোচনা থাকবে বা তা সাহিত্যের পরিধির বাইরেও হতে পারে। সেই ভাবনা থেকে বন্ধুবর মুজিব মেহদী, মজনু শাহ্, সুহৃদ শহীদুল্লাহ্‌র সাথে আলাপ-আলোচনা। আমার বন্ধুভাগ্য ঈর্ষণীয় বলতে পারেন। এখন পর্যন্ত তারা সাহিত্য কেন কোনো বিষয়েই আমার সিদ্ধান্তকে অসম্মান করেন নি। আমিও করিনি। সেদিনও তাঁরা আমার ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন, একমত হয়েছিলেন। তার পরেরটা তো আপনারা জানেন। শিরদাঁড়া প্রথম সংখ্যা বের হতে না হতেই একটা সোরগোল পড়ে গেল। দেশের নানান জায়গা থেকে সাধুবাদ আসতে লাগল। ব্যক্তিগতভাবে অন্য সকলের মতো আমি আক্রান্তও হয়েছিলাম প্রথম সংখ্যার লেখার জন্য। আমি সব সময় চেয়েছিলাম যে, শিরদাঁড়া যেন কারো ব্যক্তিগত পত্রিকা হয়ে না যায়। এটা আমি বা আমার, এই আমিত্ব থেকে অনেক পত্রিকার সর্বনাশ ঘটেছে দেখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তো সেই ভাবনা থেকে ঠিক করেছিলাম যে, সম্পাদক হিসাবে কারো নাম যাবে না। যারা লিখবে তাদের সকলের নাম যাবে। অর্থাৎ একটা সম্মিলিত প্রয়াস যেন থাকে। প্রথম সংখ্যায় দেখবেন আমাদের সকলের নাম আছে, লেখাগুলোও শুধু সাহিত্য নিয়ে নয়। কিন্তু পরবর্তী সংখ্যার ভাবনা ঠিক করতে গিয়ে দেখলাম কেমন যেন দ্বিধা কাজ করছে বন্ধুদের মধ্যে। ক্রমে স্পষ্ট হলো যে, তারা চায় না আমি ব্যাস এবং শিরদাঁড়া দুটো পত্রিকাতেই থাকি। একটা হার্ড লাইনে তারা যেতে চায়। ব্যাস যেহেতু এমন একটি সাহিত্য পত্রিকা যা প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখক না এমন কারো সাহিত্যগুণ সম্পন্ন লেখা হলেই প্রকাশ করে। তাই তারা একদিন বললেন, হয় এটা, নয় ওটায় থাকুন। ব্যক্তিগতভাবে কারো মনে অন্য কিছু ছিল কি না, তা আমার জানা নেই। আমি ব্যাসকেই বেছে নিলাম, কোনোরকম বিবাদ ছাড়া। আসলে আমি জীবনে বন্ধুত্বকে অসম্ভব রকম প্রাপ্তি মনে করি। সামান্য একটা পত্রিকার মতান্তরের জন্য বন্ধু হারাতে চাই নি। এক জীবনে অনেক পত্রিকা হয়ত করা সম্ভব কিন্তু বন্ধু করা অসম্ভব। আমি পত্রিকাকে বিসর্জন দিয়ে বন্ধুত্বকে আপন করে নিয়েছিলাম সেদিন। তবে শুধু একটিই কথা বলেছিলাম, সাহিত্য কোনো মতাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে পারে না। অসংখ্য গ্রহণ বর্জন মধ্য দিয়েই এর পথ চলা। পরবর্তীতে মুজিব মেহদী ও মজনু শাহ্ও তাদের পূর্ববর্তী ভাবাদর্শ থেকে সরে গিয়ে শিরদাঁড়া থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু সুহৃদ শহীদুল্লাহ শিরদাঁড়াকে বুকে আগলে রেখেছেন। যে উদ্দেশ্য নিয়ে শিরদাঁড়া প্রকাশিত হয়েছিল তা হয়ত আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না কিন্তু বর্তমান শিরদাঁড়া এখনকার ডামাডোলের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা এটা স্বীকার করতে হবে সবাইকে। শিরদাঁড়া দীর্ঘজীবী হোক, এটা শিরদাঁড়া ছেড়ে আসার সময়ও চেয়েছিলাম এখনো চাই। কারণ শিরদাঁড়া আমার পত্রিকা, আমাদের পত্রিকা।

দুপুর মিত্র: কথাসাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জায়গাগুলো নিয়ে কিছু বলুন। এ ব্যাপারে আপনারা কতটুকু কাজ করতে পেরেছেন বলে মনে করেন?

রবিউল করিম: প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা শুধু কথাসাহিত্যের বিষয় নয়। এটা একটা মতাদর্শ। আমি কোনোকালেই বর্তমান প্রচলিত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার শর্তাবলী মানি নি এবং ব্যাস করার সময় আমি বলেছিলাম, এটা হবে কথাসাহিত্যের কাগজ। কোনো মত বা পথের নয়। অসংখ্য ভ্রান্তি আছে এই মতাদর্শের। তবে কোনোসময়ই আমার সাথে প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের বিরোধ তৈরি হয় নি। এটা হয় নি কারণ, আমি যা ব্যাসে প্রকাশ করতাম তা তাদের কাগজেও প্রকাশ হবার যোগ্য ছিল, শুধু লেখকের নাম বাদ দিয়ে। একজন লেখক দৈনিকে লিখলেই কেন সে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করছে বলে মনে হবে? আমরা যারা লেখালেখি করছি, তাদের যে পঠন পাঠন এবং সেসবের রচয়িতারা কে এইসব তর্কের মধ্যে গেছেন? আর সবচেয়ে বড় কথা আমরা সবাই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই বেঁচে বর্তে আছি। পরিবারও তো একটা প্রতিষ্ঠান, তারা কি এর বাইরে, রাষ্ট্র একটা প্রতিষ্ঠান, তারা কি এর বাইরে? অসংখ্য প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলবে না। সবচেয়ে বড় কথা যেসব কাগজ প্রতিষ্ঠান বিরোধী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে গেছে, তারাই একসময় প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। আমার কথা হচ্ছে, যদি বিরোধিতা করতে হয় তবে সবকিছু থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে। মনগড়াভাবে বললে চলবে না, শুধু সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে। আপনি দুধ কিনছেন, চাল কিনছেন, চিনি কিনছেন… মানে কোনো না কোনোভাবে প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্ত হচ্ছেন। আর লেখকদের মনোজগতকে যদি আপনি রুদ্ধ করেন এইসব মত পথ দিয়ে, তবে তা থেকে খুব বেশি পরিমান সৃষ্টিশীল কিছু বেরিয়ে আসা মুস্কিল। আপনি দরজা জানালা বন্ধ করে বসে রইলে ক্ষতি আপনারই, ক্ষতি সাহিত্যেরই। মুক্ত আকাশে, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে হবে সবাইকে। তবে আমি প্রতিষ্ঠানবিরোধীদের শ্রদ্ধা করি। কেননা যেসময়ে এই মতাদর্শ গড়ে উঠেছিল তা ছিল সময়েরই দাবী। একজন তপন বড়ুয়া না থাকলে হয়ত সেভাবে সেলিম মোরশেদ বা কাজল শাহনেওয়াজদের পেতাম না আমরা কথাসাহিত্যে। ভিন্ন পথ ভিন্ন মতকে সব সময় শ্রদ্ধা করা উচিত।

দুপুর মিত্র: বাংলাদেশের সাহিত্যে অপরাজনীতি বলে কোনও বিষয় আছে কিনা। থাকলে সেটা কেমন এবং কি জন্য?

রবিউল করিম: দেখুন রাজনীতি তো সবখানেই। সেখানে প্র, পরা, অপ এইসব থাকবেই। কেউ ভালো কিছু লিখেও পুরস্কার পাচ্ছে না, কেউ পাচ্ছে! কেউ ছোটকাগজকে সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করছে দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক হওয়ার জন্য। এসব তো থাকবেই। সবকালেই কমবেশি ছিল। একজন লেখক এইসব নিয়ে ভাববেন কিনা, এটা প্রশ্ন উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথ, ইউনূস এদের নোবেল প্রাপ্তি নিয়েও কম কথা হয়নি। আমি বলি কি এইসব না ভেবে লিখে যেতে আপনাকে কে বারণ করছে? লিখে যান না। আর যদি পুরস্কার-তিরস্কার এইসবের লোভ-লালসা থাকে জীবদ্দশায়, তবে ক্ষমতাবানদের পা চাটা হোন। কত কে অলঙ্কার পরে ঘুরে বেড়ালো তারপর বিলীন হয়ে গেল সময়ের আবর্তে। এইসব রাজনীতি দিয়ে কিচ্ছু হয় না। ক্ষণিকের জন্য হয়ত একটা আবহ তৈরি করা যায়, এর বেশি কিছু নয়। প্রকৃত লেখকরা এইসব থেকে সবসময়ই দূরে থেকেছেন। যারা মধ্যমানের তারাই এসব নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। লিখে যান। ভাল লিখলে একসময় আপনিই শাসন করবেন। সমকাল নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই।

দুপুর মিত্র: পৃথিবী কিংবা নরকের গল্প, ডোরাকাটাদের দেশে ও অন্যান্য গল্প- এই বইগুলোতে আপনি নিজেকে কতটুকু সার্থক হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন বলে মনে করেন।

রবিউল করিম: যদি কোনো সংশয় থাকতো তা হলে গ্রন্থ দুটি প্রকাশ করতাম না। কিন্তু কোনো লেখা প্রকাশিত হয়ে গেলে তা আর লেখকের থাকে না পাঠকের হয়ে যায়। সেবিবেচনায়, সত্যিই জানি না তারা কোনভাবে গ্রহণ করেছে গ্রন্থ দুটিকে।

দেখুন, লেখকের অহংকার থাকতে হয়। অন্যরা যত পঁচা লেখাই বলুক না কেন, আপনি যদি মনে করেন যে ঠিক আছেন, তবে কিচ্ছু যায় আসে না। আরে ভাই, কেউ তো আপনাকে মারতে আসছে না। যা ভাবেন, যেভাবে পারেন লিখুন না কেন। কেউ প্রকাশ করতে চাইলে আলোর মুখ দেখবে, না হলে দেখবে না। প্রকৃত অর্থেই যদি লেখাটি ভাল হয় তবে আজ না হোক কাল এর সমঝদার আপনি পাবেনই। সব গল্পই তো টিকে থাকবে না কালের আবর্তে, দু/চারটা টিকলেই হলো। রবীন্দ্রনাথের কটা গল্পের বা কবিতার কথা আমাদের স্মরনে আছে। ৮/১০ টার বেশি তো নয়। তাহলে? এত ভেবে লাভ কি? আপনার কাজ লিখে যাওয়া। পাঠকরা হয় গ্রহণ করবে, নয় ছুড়ে মারবে। আমি এসব নিয়ে ভাবি না। লেখালেখিকেও বড় বা মহৎ কাজ মনে করি না। পৃথিবীতে এরচেয়েও দরকারি কাজের সংখ্যা অনেক।

দুপুর মিত্র: কথাসাহিত্যে দীর্ঘদিনের বিচরণে আপনার এর চর্চা নিয়ে অভিজ্ঞতাগুলো যদি বলতেন। আপনি কিভাবে একে দেখতে চান, কিভাবে এর চর্চাটা চান। কিন্তু চর্চাগুলো কোনদিকে এগুচ্ছে এসব বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।

রবিউল করিম: চর্চাটা একেকজনের কাছে একেকরকম। কেউ দেখবেন, ঘড়ি ধরে লিখতে বসে। কেউ খেয়ালে লেখে। যে যেভাবে আরাম পায়, সেভাবেই লিখুক। লেখাটাই আসল কথা- শুয়ে, বসে, কাত, চিত যেভাবেই হোক লেখাটা চালু রাখা দরকার। দীর্ঘদিন ধরে কেউ না লিখলে, পরে লিখতে সমস্যা হয়। কোনোকিছুর পেছনে না ছুটে, কোনো প্রলভনে পা না দিয়ে প্রাণ যা চায় তাই লিখুন। বর্তমান সময় বড় অস্থিরতার। খুব সন্দেহ জাগে লেখার জন্য যেরকম সময় দেয়া উচিত, সেরকম সময় কি আর আমরা দিতে পারব? কথাকারদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ৮০, ৯০, শূন্য দশকের দিকে যদি তাকান তবে দেখতে পাবেন কথাকাররা সংখ্যায় কমছে। গদ্য লিখতে সময় প্রযোজন। এখনকার তরুণেরা সেই সময় দিতে কুণ্ঠিত। অল্পতেই তারা বিভিন্ন মাধ্যমের দিকে ঝুকে পড়ছে। আমি এমন অনেক তরুণকে জানি যাদের হাত শক্তিশালী ছিল। কিন্তু তারা এখন নাটকের স্ক্রিপ্ট নয়ত ফিচার লেখায় ব্যস্ত। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, সবাই দ্রুত আয়ের ব্যবস্থার জন্য ছুটছে। লেখাটা হারিয়ে যাচ্ছে। সব পেশাতেই গদ্য লেখা কষ্টকর। লক্ষ করলে দেখবেন, এদেশে শিক্ষকরাই ভালো কথাকার হয়েছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, শওকত ওসমান, হুমায়ন আযাদ, হুমায়ূন আহমেদ…, অন্যরা যে হন নি তা নয়। তবে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। কথাকারদের তাদের পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত।

আমি সবসময় বলি যে, লেখকরাই পৃথিবীর সবচেয়ে পাপী মানুষ। একটা পিঁপড়া মরলেও তারা ব্যথিত হয়। চারপাশে এত অনাচার, অন্যায়, অবিচার ঘটছে, অনেকেরই কিছু যায় আসে না। কিন্তু একজন লেখক এতটাই সংবেদনশীল হয়ে ওঠে সেসব ঘটনায় যে, নিজেকেই শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করতে পারে না। যেন সবকিছুর জন্য দায়ী সেই-ই। তার হাত কামড়ায়, শরীর মোচড়ায়, হৃদয় রক্তাক্ত হয়। একসময় সে কলম তুলে নেয়। লেখাটাকে করে নেয় তার শরীরের সাথে একীভূত।