বিশ্বজিৎ লায়েকের স্মৃতিকথা বিয়োগফলের বত্রিশআনা জীবন

Post date: Sep 4, 2017 3:24:27 AM

ভাবছি নিজের কথা লিখব। হয় না। লেখার সঙ্গে ঢুকে পড়ে চাল, গম, চিনি। পি এল এর মানুষ । মিড ডে মিলের ভাত। কৌতুহল ও আর্দ্রতা।

আকশে চাঁদ উঠলে নাচতে ইচ্ছে করে। কানে গুজে নিতে ইচ্ছে করে পাখির পালক। সম্ভব হয় না। ঘর বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। পারি না।

মেস বাড়ির জানালা বন্ধ করলে পাশের খাট থেকে চিৎকার শুরু করে বিশু- দেখছিষ না, বিড়ি ধরিয়েছি। স্যাভোকেশন হবে।

আমি বিড়ির ধোয়ার দিকে ঈষৎ প্রেম প্রেম চোখে তাকাই। ঈষৎ জল জল চোখে তাকাই। প্রবল ইচ্ছে হয়।

তাকের উপরে রাখা ডিওলিন চোখ গোল গোল করে তাকায়। আমি ফাটা বেলুনের মত চুপসে যাই।

অতনু ফোন করে। বলে- আমার খুব খারাপ লাগছে। খবরটা শুনে সেই থেকে। কেন এমন হলো বলো তো? কি হল ভাততে থাকি।

১৯ মিনিট ১৩ সেকেন্ড কথা বলার পর বললাম- সে কি? অমন তো কিছু হয় নি। হ্যাঁ হতে পারত। কিছু হয় নি।

বাংলা বাজারের জলবায়ু অঙ্কোরোদগমে সহায়ক। দ্রুত মাটি ফুড়ে চারাগাছ। ডালপালা গজায়। গোঁফ দাড়ি গজায়। কিশোর যুবক হয়। যুবক প্রৌড় হয়। প্র্যড় কি হেঁটে যায় ফেলে আসা শৈশবে। হাঁটি হাঁটি পা পা।

মিহির এসেছিল। আজ এসে আস্তাকুড়। থাকিস কি করে। বিছানা জুড়ে বই পত্র, খাতা চ্যবন প্রাস, আয়না, বিস্কুট, মুড়ির প্যাকেট, ব্যাগ, সোয়েটার, ল্যাপটপ, টর্চ। বসবো কোথায়? আমি সন্তর্পণে বসিয়ে গুছিয়ে জায়তা করে দি। নে বস।

আমি শুয়ে পড়ি টান টান।

মিহির বোঝাতে থাকে বি কম্প্লেক্সের গুণাগুণ।

আমি অনেকটা পিছনে হেঁটে ক্লাস ফাইভে ঢুকে পড়ি। গরুর গাড়ি চেপে মামার বাড়ি। একমাসের অফুরন্ত মজার ছুটি। সন্ধ্যে বেলায় পড়তে বসা।

আমাকে অঙ্ক কসতে দিয়েছে মিহির। আমি মিহিরকে দিয়েছি পাটিগণিত। কে উত্তর মেলাতে পাড়ে আগে ঠাণ্ডা লড়াই।

জানা অঙ্ক ভুল করি। হড়বড় করতে গিয়ে লাল কালিতে গোল্লা। আমি দশে শুন্য। ও দশে দশ। আমার সারা ক্লাস মুখ নিচু। লজ্জা। আর মিহির বীর পুরুষ। মুখে, চোখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। মেজাজের রঙ দশে দশ।

ইলেকট্রিক বাতি তখনও আসেনি গ্রামে । বিকেল বিকেল হারিকেনের কাঁচ মুছে দিত মা। কেরোসিন ভরে দিত মা। টিউশন শেষে হৈ হৈ বেরিয়ে পড়া। নিজের সামেন টুকু আলো। পিছনে ধূ ধূ অন্ধকার। হ্যারিকেন থেকে দৌড়ালেই ঝুপঝাপ অন্ধকার। সামনে –ফিছনে- মাথার উপরে অগণিত নক্ষত্র। কে যেন চিৎকার করছে- ভূত আসছে-দে দৌড়-

আজ দুনিয়া জুড়ে এত আলো। টিউব লাইট। নিয়নের ধাধা। আমাদের সন্তানরা কি টের পাবে ভূতের ভয়অ। পাবে না। আরে ভূতের রাজা তো বর দিয়ে গেছে জব্বর জব্বর তিন বর- আলো- আলো – আলো....

এত কষ্ট করে থাকিস। ভালো ঘর দেখে উঠে যা। আমি চায়ে চুমুক দি। আর্দ্রতা বেশি পেলে কাটাকাটি। ঘরের কোণে এনে রাখি পরিত্যক্ত পাখির বাসা। ছেলের ভাঙা খেলনা। ডায়েরির পাতায় লিখি হিসেব। তের বছর তিন মাস সতের দিন সময় বিক্রি করে শ্রম বিক্রি করে নিম্ন মেধার সঙ্গে ঘামবেঁচে সাকুল্যে এক লাখ উনিশ হাজার সাতশো সতের টাকা পঞ্চাশ পয়সা।

আয়নায় ঢিল চুঁড়েছিল যে প্রবীন, ইন্ধন দিয়েছিল হঠাৎ নবীন যুবক ও মধ্যবর্তী তরুণ। আজ ওরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। কথা বলে না।

গোপনে- আড়ালে- লোক মারফত খবর নেয়। ভাবে কোন যাদুবলে একটা খেটে খাওয়া মধ্য তিরিশের যুবক এত আনন্দে গম গম করে হেঁটে যায়।

দুঃখ কি লুকোয় তাকে। নাকি সেই দুঃখ লুকিয়ে রাখে। বাড়ি আসে। ছাদে উঠে পায়চারি দেয়। ফুলগাছে জলও দেয়। গান গায়- আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ। বাড়ি এলে – দু’ পাঁচজন লোক দেখা করতে আসে। চা আর পাঁপড় ভাজা ভাজা খায়। আড্ডা দেয়। কবিতা ও অঙ্ক কষে।

ভোলা নাথ। সাত বছর পর আমার আবার চোখে জল আসছে। আমি কুন্তু কাঁদছি না। আমার অপ্রতিম সত্ত্বার ভেতরে দেখছি আমার বীজ, আগামী স্বপ্ন....

হাসছি। হো হো করে হেসে উঠছে অপ্রতিম। আমিও আপ্রাণ চেষ্টা করছি বত্রিশ বছর পিছনে নিয়ে সেই হাসিটুকু ছুঁয়ে থাকবে।