কবিতা মূলত কানেক্শনের ব্যাপার: আজাদুর রহমানের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jan 17, 2014 3:49:09 PM

প্রকাশিত বই: লালনের গান, ২০০৭ অন্বেষা; সাধুর বাজার, ২০০৯ অন্বেষা; লালন মত লালন পথ, ২০১০ অন্বেষা; বাংলাদেশ বাংলার মেঠো পথে, ২০১১ জয়তী; বাংলাদেশ অন্য কোনওখানে, ২০১৪ সৃষ্টিসুখ।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

আজাদুর রহমান: কবিতা লিখি মনের তাগিদে। বাউল যেমন করে গান করে ওঠেন একজন কবিও তেমন। জোয়ার এলে যেমন নদী ফুলে ফেপে ওঠে, তেমনি মনে ভাব জমলে কবিও শব্দের বান ডাকেন। কবিতার মিছিল তোলেন।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

আজাদুর রহমান: কবিতা মূলত কানেক্শনের ব্যাপার। কানেক্শন পেয়ে গেলে আর দেখতে হয় না। অটোমেটিক ঝাঁক ঝাঁক শব্দ নাজেল (নাজিল) হতে থাকে মনের মধ্যে। অঝোর শব্দধারায় তখন ভিজতে ভিজতে কবি সহজানন্দে বুনে চলেন কবিতা। এর জন্য আসলে আলাদা করে প্রস্তুতি নিয়ে লাভ হয় না। কানেক্শন পেয়ে গেলে অটো সাজেশন চলতে থাকে।কানেক্শন না পেলে খোদ কবিও একজন সাধারণ, নিয়মিত গৃহী। জোর করে লিখতে গেলে বড় জোর প্রবন্ধ বা গদ্য পাওয়া যায়। সে কবিতা লেখার ব্যাপারে আমার নিজস্ব কোন কৃতি নাই। খামোখা প্রস্তুতি নেবার মানেই হয় না বরং কখন কানেক্শন পাব-সেই আশায় বসে থাকি।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

আজাদুর রহমান: অরণ্য আমাকে দারুণভাবে মৈথুন করে। আমি মুলত প্রকৃতিপ্রিয়, তলে তলে গভীরভাবে নস্টালজিক আর বাউলা। জীবনানন্দে আর লালনে বুদ হযে থাকি। অনবরত নিপতিত হই। ভাবি, লালনের মত আমিও তো অপার হয়ে বসে আছি। দয়াময়কে বলি,পার করো, বুড়ি চাঁদ ভেসে যায় বেনো জলে। এছাড়াও সমসাময়িক কবিদের মধ্যে জয় শক্তি সুনিল, নির্মলেন্দু গুণ, আল মাহমুদসহ অনেকের কবিতাই ভাল লাগে।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

আজাদুর রহমান: পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের ভাষা তো মোদ্দাভাবে এক। সেই বিচারে কবিতাও কাছাকাছি। তবে বাংলাদেশের কবিতায় আবেগটা যেন বেশি আসে। বাংলাদেশের কবিতায় নদী পাহাড় আর প্রকৃতির সন্ধানটা বেশি পাই।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে? লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

আজাদুর রহমান: দেখুন বছর পনের আগেও আমাদের কারও হাতেই মোবাইল ফোন ছিল না। তখন কী আমরা অসুখি ছিলাম।এখন মোবাইল পেয়ে আগের চেয়ে কী সুখি হয়েছি। এই রকম প্রশ্নে অনেকেই বলেছেন-যাই বলেন আগেই ভাল ছিলাম। আমি পাল্টা বলি তাহলে মোবাইল ছেড়ে দিন। মোবাইল ছাড়তে কেউ রাজি নয়। আসলে সুখ ব্যাপারটা আপেক্ষিক। পরিবর্তনটা মানতে হবে। সময়ের সাথে সবকিছু একটু একটু পাল্টায়, পরিবর্তনটা তাই একদাগে বোঝা যায় না। সাহিত্যও এর বাইরে নয়। লিটল ম্যাগ বা ব্লগ বা দৈনিক-সবকিছুরপ্রয়োজন আছে। আমি কোন কিছু কিছু নিয়ে বিরক্ত হতে চাই না। কবি বা লেখক কোথায় আরাম পাবে সেটা আপনিতেই বাছাবাছি হয়ে যাবে। যে যার জায়গামত গিয়ে আলটিমেটলি থিতু হবে।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

আজাদুর রহমান: দৈনিকে প্রকাশিত সাহিত্য একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ ব্যাপার বটে। তবে সর্বস্ব নয়। কারণ এখানে সাহিত্যের সাথে আরও কিছু ভেজার যুক্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। বাজারি চাহিদা, তদবির, জনপ্রিয়তা, ইগো-ইত্যাদিও বিষয়ও এখানে মূল সাহিত্যের সাথে অংশগ্রহণ করে। ফলে দৈনিক সাহিত্য থেকে সত্যিকার মূল্যায়নের সকল মাপকাঠি পাওয়া যায় না।

দুপুর মিত্র: আপনি কবে থেকে লেখালেখি শুরু করেছেন?

আজাদুর রহমান: মনে মনে সব সময়ই লিখতাম। তবে ঠিক কবে থেকে খাতাকলমে লেখালিখি শুরু করেছিলাম-হুবহু মনে নেই। স্কুল লাইফে চেষ্টা করেছিলাম। লেখকদের মহানায়ক মনে হত। এখনও হয়। নিজের লেখা নিয়মিত পত্রিকায় বের হবে ভাবিনি। সে যাই হোক নড়েচড়ে লিখতে শুরু করেছি ২০০৭ সাল থেকে। তখন কুষ্টিয়ায় থাকতাম। বলতে পারেনলালন কে দিয়েই আখড়াবাড়ি থেকে লেখা্র শুরু।

দুপুর মিত্র: আপনার সবচেয়ে সফল কাজ কোনটা?

আজাদুর রহমান: এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখা পাঁচ লালনের গান, ২০০৭ অন্বেষা সাধুর বাজার, ২০০৯ অন্বেষা লালন মত লালন পথ, ২০১০ অন্বেষা প্রকাশনী,বাংলাদেশ বাংলার মেঠো পথে, ২০১১ জয়তী প্রকাশনী,বাংলাদেশ অন্য কোনওখানে, ২০১৪ সৃষ্টিসুখ, কোলকাতা সবগুলোই আমার বন্ধুর মত। কোনটাকে সফল বলব, বলুন।

দুপুর মিত্র: উপন্যাস লেখায় আপনি সুনির্দিষ্টভাবে কোন সমস্যায় বেশি পড়েন? লেখার সময় আপনি কি শিডিউল করেন?

আজাদুর রহমান: একটা দৈনিক থেকে উপন্যাস লেখার তাগাদা আছে। কিন্তু আমি এখনও শুরু করিনি। সময় আর ধৈর্য্য খুব লাগবে। আপাতত কোনটারই নাগাল পাচ্ছি না।

দুপুর মিত্র: আপনি কি কম্পিউটারে লিখেন?

আজাদুর রহমান: আগে হাবিজাবি কাগজে লিখতাম। বছর কয়েক হলে কম্পিউটার ধরেছি।

দুপুর মিত্র: আপনার গদ্যশৈলী কি আলাদা? কিভাবে এটা আলাদা? নিজের কোন কাজটির জন্য খুব তৃপ্ত বোধ করেন? আপনি কি বিশেষ কোনও পাঠককে সামনে রেখে লিখেন না বিশেষ অডিয়েন্সকে? সাহিত্যের কি সামাজিক বাধ্যবাধকতা আছে?

আজাদুর রহমান: আমার গদ্যশৈলী একান্তই আমার মত। আমার যেমন আলাদা হাত পা মাথা মুখ তেমন ভাবনাকথাও। মেলানো যাবে না। আমি কোন প্লান করে কিছু করিনা। সিডিউল তো নাই। গল্প খোঁজার জন্য আমি হণ্যেও হই না। মানুষের কাছে নিগুঢ়ভাবে গিয়ে আমি যা দেখেছি তাহল—প্রতিটি জীবনই কিংবদন্তী। জীবন আছে অথচ গল্প নেই-এমন হয় না। সাদামাটা মানুষেরও আছে অসাধারণ এক রোমঞ্চকর গল্প। অনেক সময় তো আতকে উঠতে হয়। প্রথ্যেকের ভিতরেই বয়ে চলেছে-রুপবান এক দুঃখনদী।কারও চেয়ে কম গভীর নয় সে নদী। আছে অজস্র সুখের ঝরনাধারা। কারও চেয়ে কম নয় তার বেগ।মন সে তো ‍আকাশের মত, ক্ষণে ক্ষনে বদলায়। এই মেঘ তো,ওই রোদ্দুর, এই বৃষ্টি তো ওই নীল আকাশ। কখনওবা ঝকঝকে উল্লাসময় খাণেক বাদেই আবার থমথমে গাল ফোলানো। এইসব দেখে বুঝেই গল্প নিজ মর্জিমত হয়ে ওঠে।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখার কক্ষ নিয়ে কিছু বলুন? আপনি কি বেশি পড়া পছন্দ করেন?

আজাদুর রহমান: আমার আলাদা লেখার ঘর নেই। তাছাড়া লেখালেখিতে ভাতের চেয়ে হাভাতের টানটাই বেশি। সেকারেণ আলাদা করে সংসারের কেউই তেমন গরজ দেখায় না। মাথার মধ্যে কারখানা খুরে বসে আছি। দেখা যাক কী হয়। মাথায় মাল মেটিরিয়াল থাকলে দু চারটা কিছু তো বের হবেই।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখালেখির কায়দাটা কেমন?

আমি একটানে লিখি। তবে পরে খাণিক ফিনিসিং দিতে হয়। অনেকটা ইট গাঁথার পর প্লাষ্টার করার মত। যাহোক কবিতা লিখতে গেলে যেমন একটা কানেক্শন দরকার হয়। গল্পে ঠিক ততটা লাগে না।একটা ঘোর তৈরি হয়ে গেলেই হয়। তবে কবিতার মত ম্যাজিকের ব্যাপার নয়, একান্ত ইচ্ছে সময় ধৈর্য্যশক্তিটাই এখানে মেইন। আমি কোন টার্গেট করে কিছু করি না। আপনা আপনি গল্প গল্পের মত চলে যায়। আর যদি নাই হয় তো, বাতিল। কাউকে মনে করে লিখি না। আর আপাতত কোন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লিখছিনা। নিজের আরাম পাই তাই লিখি। আরাম বন্ধ হলে হয় তো আর লেখা হবে না। মোটকথা আমি সিরিয়াস নই। পাঠক যদি আমার লেখা পড়ে তৃপ্তি পায়, সে তো আমার বোনাস।