গল্পের আইডিয়াটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ: শেরিফ আল সায়ারের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Aug 15, 2012 6:50:16 AM

প্রকাশিত বই: কয়েকটি অপেক্ষার গল্প

দুপুর মিত্র: আপনি নিজেকে কেন লেখক বলে পরিচিত করাতে চান?

শেরিফ আল সায়ার: যখন ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি তখন হুমায়ূন আহমেদের ‘নীল হাতি’ পড়েছিলাম। একজন মানুষ কী করে লিখতে পারেন সে বিষয়ে আগ্রহ জন্মে ‘নীল হাতি’ পড়েই। কিন্তু হুট করেই তৈরি হওয়া আগ্রহটা খুব একটা টেকেনি। কলেজ জীবনে বেশ কিছু গল্প/উপন্যাস আমাকে কাছে টানতে শুরু করে। প্রথমত হলো, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সপ্তপদী’। অদ্ভুতধরনের অনুভূতি সেসময় আমাকে নাড়া দিত। বিশেষ করে রিনা চরিত্রটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আবার মানিকের পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা। এসব সাহিত্য আমাকে অবাক করে তুলতো। জানতে ইচ্ছে করতো কী করে মানুষ লিখতে পারে?

ছোটবেলা থেকে আমার ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিল। একবার এক বান্ধবীকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিসের চিঠি তা বলা যাবে না। তবে বান্ধবী চিঠি পড়ে দুদিন পর আমাকে বলল, ‘গল্প লেখা শুরু কর। ভালো করবি। তোর হাতে জোর আছে।’ সেদিনই মনে হয় নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস তৈরি হওয়া শুরু করেছিল। এরপর তো পথ চলছি। কিন্তু আদৌ লেখক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলার আগ্রহ জন্মায়নি। অথবা বলতে পারেন, লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়ার পদ্ধতিটাও আমি জানি না। আমি শুধু জানি, আমি লিখতে চাই। যতদিন বেঁচে থাকি লিখে যেতে চাই। আর সেজন্য যদি দু-চারজন মানুষ চেনে তবে বলতে পারেন সেটা হবে বাড়তি পাওনা। কেউ যদি আমার ভাষা বুঝতে পারে তবে সেটা হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা।

দু: কবিতার চেয়ে কথাসাহিত্যকে আপনি কেন বেছে নিলেন?

শে: অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন, কবিতা পড়ো? তখন আমি না সূচক মাথা নাড়ি। এটি দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়। কেন কবিতা পড়ি না? আমি আসলে কবিতা পড়ি। যে কবিতা বুঝি সেটি বার বার পড়ি। কিংবা অনেক কবিতা না বুঝলেও মনের ভেতর তীব্র হাহাকার তৈরি করে। সেসব কবিতাও পড়তে ভালো লাগে। যেমন, আমি স্কুলে থাকতেই জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি পড়েছিলাম। কিন্তু তখন এর আগা মাথা কিছুই বুঝিনি। কিন্তু ভালো লাগতো। মনের ভেতর নিজে নিজেই বলতাম, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা/ সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’/পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

একটু বড় হয়ে এর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করতাম। এখনও করি। কোনোভাবেই পাই না। তাই কবিতা বিষয়টি আমার কাছে অন্যরবম। কবিতার জন্য প্রয়োজন তীব্র অনুভূতি। তীব্র বেদনার। যা হয়ত আমার ভেতর নেই। একটি শব্দে হাজারো কথা বোঝানোর ক্ষমতা নেই। তাই হয়ত কবিতা টানেনি। গল্প টেনেছে। আবার বলতে পারেন, প্রতিটি মানুষ একটি ফর্মের সঙ্গে খাপ খায়। আমি খাপ খেয়েছি গল্পের সঙ্গে।

দু: বাংলাদেশের সমসাময়িক গল্পচর্চা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

শে: সমসাময়িক গল্পচর্চা হচ্ছে। কিন্তু ষাটের দশক থেকে নব্বয় দশক পর্যন্ত গল্পগুলোতে রাজনীতি কিংবা রাষ্ট্র উঠে আসতো। যা এখনকার সময়ে গল্পে অনেকটাই অনুপস্থিত। রাষ্ট্র যেন গল্পে হারিয়ে গেছে। এছাড়াও আশির দশক এবং নব্বয়ের দশকের গল্পে মধ্যবিত্ত সমাজ উঠে আসা শুরু করেছিল। যা এখন নিভু নিভু করছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, বর্তমান সময়ে গল্পে তাহলে থাকে কি? বর্তমান সময়ে গল্পে ব্যক্তিগত হতাশা, মানুষের নিঃসঙ্গতা উঠে আসে। কখনও কখনও তার ফাঁক ফোকর দিয়ে রাষ্ট্রকে উঁকি দিতে দেখা যায় বটে। তারপরও সেটার ব্যাপকতা খুবই কম। তারপরও এটাকে আমি সমালোচনা বলবো না। গল্পচর্চা সবসময় একই পথে এগুবে এও তো হতে পারে না। গল্পের বাঁক বদলে বদলে মানুষ এখন নিজের নিঃসঙ্গতাকেই গল্পে তুলে আনছে। এটা খারাপ না।

দু: কথাসাহিত্যের কোন ধারাকে আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এবং কেন?

শে: কথাসাহিত্যের প্রতিটি ধারাই গুরুত্বপূর্ণ। গল্প, উপন্যাস যাই হোক। সেটা যদি ‘লেখা’ হয়। তবেই তার গুরুত্ব আছে।

দু: লেখার বিষয়ের ক্ষেত্রে আপনি কোন জায়গাকে বেশি গুরুত্ব দেন এবং কেন?

শে: গল্পের আইডিয়াটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শুরুতেই যে আইডিয়াটা ভেতরে জন্ম নেয় সেটাই ঘষামাজা প্রয়োজন। আইডিয়ার পর চরিত্র নির্মাণ, গাঁথুনী, প্লট এসব উঠে আসবে। তাই আইডিয়াটা যদি ভিন্ন হয় তবে চরিত্রগুলোকে নিজের মতো করে সাজানো যায়।

দু: লেখা নিয়ে আপনি কেমন আশা করেন? তার কতটুকু আপনি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন এবং কেন?

শে: আমার লেখালেখির চর্চাটা শুরু ব্লগ থেকে। ব্লগে লিখে লিখে নিজেকে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে নেওয়ার সাহস পেয়েছি। তবে যখন ব্লগে লিখেছি তখন লেখা নিয়ে তেমন কোনো আশা ছিল না। লিখতে ভালো লাগে তাই লিখেছি। এখনও তাই। লিখতে ভালো লাগে। লেখা মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করার এক অদ্ভুত মাধ্যম। অজানা অপরিচিত মানুষ আমার লেখা পড়ে আমাকে জানবে চিনবে। যেমন ধরেন, ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখেই মনের ভেতরের অবস্থা আপনার বন্ধুরা বলে দিতে পারবে। কিন্তু গল্প পড়ে নিজের সৃষ্টি চরিত্রগুলো পাঠককে ভাবাবে। বিষয়টি খুবই অন্যরকম অনুভূতি। আমি এমন অনুভূতি পাঠকদের ভেতর দিতে চাই। আমি জানি না আপনার প্রশ্নের উত্তর এটি হবে কিনা।

তবে এই বিষয়ে নিজের একটা গল্প বলতে পারি। আমার মা আমার লেখা নিয়ে বর্তমান সময়ে অতিমাত্রায় বিরক্ত। শুরুতে তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু ইদানিং তিনি বিরক্ত হয়ে উঠছেন। একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেন লিখে কি হবে? উত্তরে বলেছিলাম, ‘আমি বাঁচতে চাই। আমার একটি লেখা হয়ত আমাকে ১০০ বছর বাঁচিয়ে রাখবে।’ কিন্তু আমার মা বললেন, ‘কিন্তু আফসস এটি দেখার জন্য তুমি বেঁচে থাকবে না।’

দু: পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্য আর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ফারক কোথায়?

শে: দুই বঙ্গের সাহিত্যের ফারাক নিয়ে আলোচনা করার আগে সাহিত্যিকদের নিয়ে আলোচনা করা উচিত। আসল ফারাকটাই হলো, আমরা পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য পড়ি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা নিজেদের এতোই এলিট মনে করেন যে, বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে তারা খুব একটা ভাবেন না। তাই আমার মতে আগে সেই ফারাক বন্ধ করার চেষ্টা করা উচিত। তারপর দুই বাংলার সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার সময় হবে।