ফকির ইলিয়াসের স্মৃতিকথা: অতৃপ্ত আত্মস্মৃতিখণ্ড

Post date: Oct 9, 2014 12:02:39 PM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

অনেক কথা মনে এলে কিছুই প্রকাশ করা যায় না। শুধুই ভাবনা বাড়ে। বেদনা বাড়ে। হাহাকার উড়ে যায় হাওয়ার সমান্তরাল। হাডসন নদীর তীর দিয়ে হেঁটে যাই। এর আগে হেঁটেছি টেমস নদীর পাড় দিয়েও। সুনসান নীরবতা-মনের ভেতর। কোথাও কেউ নেই ! অথচ শত শত মানুষ হাঁটছে নদীর তীর ঘেঁষে। হাঁটি। হাঁটতে থাকি। আমি পেছনে একটি নদী ফেলে এসেছি। সেই নদীর নাম সুরমা। ভারত থেকে 'বরাক' নাম নিয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। সেই সুরমা নদীর তীরে আমি বেড়ে উঠেছি। কেটেছে আমার শৈশব। কৈশোর। যৌবনের একটি অংশ। সেই নদীটির ছায়া দেখি আমি হাডসন নদীর বুকে। মনে পড়ে, নদীর কোনো দেশ নেই। এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে প্রবেশ করেও নিজ নাম নিয়েই থাকতে পারে। অথবা মানুষ বদলে দেয় নদীটির নাম। কিন্তু স্রোত একই থাকে। ঢেউ একই থাকে।একই থাকে উজান-ভাটির খেলা।

আর মানুষ দেশান্তরি হলে পাল্টে নেয় নিজেকে।তাকে পাল্টে নিতেই হয়। না নিয়ে উপায় থাকে না। নাগরিক সভ্যতা আর ব্যস্ততার চাহনী মানুষের চাওয়া পাওয়াকে বেশ ছোট করে দেয়। যে মানুষের বনের মতো উদার হবার কথা ছিল- সে ক্রমশ হয়ে যায় বনসাই।

আমেরিকান কবি ডাব্লিউ এস মারউইন এর তিন মিনিটের একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। বলেছিলাম- আপনি কবি না হলে কি হতেন ? চটপট জবাব- কৃষক হতাম। কেন?- জানতে চাই। কবি বলেন- কবিও চাষাবাদ করেন, কৃষকও চাষাবাদ করেন।

একজন প্রকৃত মানুষ তার জন্মমাটির কাছেই হার মানে সবচেয়ে বেশি। মনে পড়ে,আমেরিকান কবি ডাব্লিউ এস মারউইন এর তিন মিনিটের একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। বলেছিলাম- আপনি কবি না হলে কি হতেন ? চটপট জবাব- কৃষক হতাম। কেন?- জানতে চাই। কবি বলেন- কবিও চাষাবাদ করেন, কৃষকও চাষাবাদ করেন।

বিমোহিত হই। আমি কি কৃষক হতে পারতাম ? মা'র কথা মনে পড়ে। মা- আমার ভবিষ্যত নিয়ে খুবই চিন্তিত থাকতেন। কীভাবে খাবো-বাঁচবো আমি এই দুনিয়ায় ! বিষয়টি নিয়ে আমি কখনও যে ভাবি নি- তা নয়। ভেবেছি। তবে মায়ের মতো নয়। মা বরাবরই চেয়েছেন আমি যে বেঁচে-বর্তে মানুষের মতো দাঁড়াতে পারি। আমি কি তা পেরেছি ?

এই অভিবাসে, একা হয়ে গেলেই খুব বেশি মা কে মনে পড়ে। জানি তিনি জায়নামাজে বসে তসবিহ'র দানায় হাত বুলাচ্ছেন। আর তাকাচ্ছেন আকাশের দিকে।

আচ্ছা, মানুষ আকাশের দিকে তাকায় কেন ? আকাশ থেকে মানুষ কী আহরণ করে ? বিষয়টি নিয়ে আমি বেশ ভাবি।

যে পরবাসে থাকি, এখানে আমার ঠিকানা,বিত্ত,বৈভব,প্রতিপত্তি সবই গড়ে উঠেছে সাধ্যানুসারে।তারপরও কি যেন নেই। কিছু- যেন নেই। কেন নেই ? তবে কি নাড়ি বিযুক্ত মানুষ চিরদিনই করে তার জন্মশিকড়ের সন্ধান !

মাঝে মাঝে আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নও আমাকে দেখে। আমরা একে অপরের স্বজন হয়ে যাই। তারপর জিজ্ঞাস করি- একে অন্যের কুশল।কুশল জানতে চাওয়া মানুষের স্বভাব। ফোন এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। স্কাইপে, স্মার্টফোন কতকিছু।চাইলেই কাউকে দেখা যায় দূর-দূরান্তে।

মা আমার সাথে বেশি কথা বলতে পারেন না। শুধু জানতে চান- ভালো আছিস তো ! নাতনীরা কেমন আছে ! বউ !

এর বেশি আর বলা হয় না তাঁর। বেশি বলা তার স্বভাবও নয়। 'তুই কবে দেশে আসবি'- সে প্রশ্নও করা হয় না তাঁর। কারণ তিনি জানেন- আমার দায়িত্ব অনেক। দায় অনেক। 'যখন সময় পাবি আসিস বাপু'- এটা তো তিনি বলেই রেখেছেন।

মনে পড়ে যখন দূরালাপ এতো সহজলভ্য ছিল না- তখন তিনি চিঠি লিখতেন আমাকে। অপেক্ষা করতেন চিঠির। সে এমন এক দিন ছিল- যখন মাতৃচিঠির অপেক্ষায় আমারও কাটতো না প্রহর।

প্রথম যখন বিদেশে এলাম তখনকার সময়ের মা'র লেখা একটি চিঠি আমি বার বার পড়ি। ভাবি, আমি এখনও তাঁর কাছে খুব 'ছোট্ট'-ই রয়ে গেছি। কারণ আমি চিরদিনই তো তাঁর বাপু !

তাঁর লেখা সেই চিঠি পড়তে পড়তে এখনও আমার পাঁজর ভেঙে আসে। কন্ঠে জমা হয়ে পড়ে পৃথিবীর সকল শব্দাবলি।

'' বাপু,

তোর শৈশব কালে তোকে খাইয়ে যে আমের বীজটি আমি পুঁতেছিলাম, সেই বৃক্ষটি এখন অনেক বড় হয়েছে। এবারই প্রথম এলো আমের বোল। আমও ধরেছে বেশ। না- আমি সে আমগুলো খাবো না। খেতে পারবো না- বাপু।ভেবেছি, আমের আচার করে রেখে দেবো তোর জন্য। সুযোগ পেলে পাঠিয়ে দেবো কারও সাথে। তুই তো দেখিস নি, তোর রোপণ করা জবা গাছগুলোতে লাল টুকটুকে ফুল ফুটেছে অনেকগুলো। আমি প্রতিদিন ভোরে ফুলগুলোকে স্পর্শ করি। অনুভব করি তোর হাত। তুই যে হাত দিয়ে গাছগুলো লাগিয়েছিলি- তার ছায়া এখনও পড়ে আছে উত্তর বারান্দায়। তুই ভালো আছিস তো ? রান্না করে খেতে পারছিস তো ?

খুব ভালো থাকিস বাপু আমার।

--- মা ''

না, মা আমার পরবাসী জীবন চাননি। তিনিও আসতে চাননি পরবাসে। তারপরও নিয়তি হায় ! অভিবাসী মাল্যদান করেছে আমার গলায়।

গেল বছর যখন তাঁকে দেখতে স্বদেশে গেলাম, তখনও তাঁর সেই শংকা ! 'বউ বাচ্চা নিয়ে দেশে চলতে পারবি তো !' ' তোর কাছে টাকা-কড়ি আছে তো!' একদিন আমাকে আর বউকে কাছে ডেকে আমাদের দু'হাত ভরে তুলে দিলেন বেশ কিছু টাকা। আমার তো চোখ ছানাবড়া ! এতো টাকা - তুমি পেলে কোথায় ?

তিনি হাসেন। বলেন- জমিয়েছি। পাল্টা প্রশ্ন- কেন আমার বুঝি জমানো থাকবে না! আমি হেসে উঠি। হাসে বউও।

টাকাগুলো তোমরা নিয়ে নাও। আমি বলি, আমার কাছে তো চলার মতো টাকাকড়ি আছে। তাঁর জোরাজোরির সাথে কি আমি পেরেছি কখনও ? কিছু টাকা নিয়ে নিই। কিছু টাকা নেয় তাঁর বউও। মহাখুশি তিনি। তোরা হোটেলে গিয়ে খিছু খেয়ে নিস। এখনও তাঁর ভাষায় 'ভাতের হোটেল' যেখানে বিরিয়ানি পাওয়া যায়।

আমি হাডসনের তীর ঘেঁষে হেঁটে যাই।আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে ছোট ছোট ডিঙ্গিগুলো আমার খুব কাছ দিয়ে চলে যায়। নিয়ন বাতির আলো জানান দেয় সন্ধ্যা নামছে। এখন এখানে সন্ধ্যা। পৃথিবীর অন্যমেরুতে এখন ভোর হচ্ছে।

মা ঘুম থেকে জাগছেন। তারপর প্রাত্যহিক রুটিন মাফিক বসছেন প্রার্থনায়। দু'হাত তুলে বলছেন- হে প্রভু,আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।