স্বকৃত নোমানের স্মৃতিকথা: কথাকারের সান্নিধ্যে

Post date: Oct 5, 2014 10:22:17 AM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

সাংবাদিক-সাহিত্যিকের যেটা আসে সেটা কেবল মোটা দাগের ম্যাটার,তাৎক্ষণিক ইফেক্ট সৃষ্টির অমোঘ অস্ত্র―যা দিয়ে আক্রমণ করে পাঠক-মনকে তাঁর জয় করতে হয়। কেননা বশীকরণ করার সময় তাঁর থাকে না। কারণ তিনি নিত্যপরিবর্তমাণ বস্তুপরম্পরার একজন শশব্যস্ত অনুধাবক। প্রতিপক্ষ সাহিত্যিক রচনাকারের জাদুর কাঠিটি বশীকরণেরই,যেহেতু তাঁকে অনিত্য থেকেও নিত্যকে ছেঁকে তুলতে হয়। যাই হোক,আমার প্রসঙ্গ ছিল ভাষাগত প্রশ্নে সাংবাদিকের সতর্ক হওয়া। আমি মনে করি বাংলা ভাষার দূষণ রোধে সাংবাদিক সমাজকেই অগ্রণি ভুমিকা পালন করতে হবে,তারপর কবি-সাহিত্যিক সমাজকে।

“শোন নোমান,আমার পাঠশালার সহপাঠী ও দীর্ঘজীবনের একান্ত সুহৃদ মাস্টার নোমানের বর্তমান মুমূর্ষু অবস্থার কারণেই বোধ হয় তোমার প্রায় সকল প্রশ্নই আমার কাছে বাল্যবন্ধু নোমানের প্রশ্ন বলেই মনে হয়েছে এবং আমাকে করে তুলেছে একান্তই স্মৃতিবেদনাতুর। বেশি অতীত-আর্ততায় যাপিত জীবনের হাহাকার বেজে উঠতে চায় বেশি―যা সত্যকথনে বিঘ্ন ঘটাতে পারে বেশি। তবে স্মৃতিবেদনা অনেক বিস্মৃতিকেও টেনে আনে। তোমার সঙ্গেকার এই দীর্ঘ গল্পবাজিতে সে উপহারও আমি অনেক পেয়েছি―ফিরে এসেছে আমার চিরতরে হারিয়ে ফেলা অনেক অমূল্য স্মৃতি। ফলে সাক্ষাৎকারটা অনেকাংশেই আমার জীবনের গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে গল্প নেহাত নীরসও নয়। কারণ ক্যারিয়ারটা আমার আগাগোড়াই,যাকে বলে,‘চের্কাড’ (chequered)―সাদা বাংলায় নকশি কাঁথা।

জানি আমার কিছু উত্তর রূপ নিয়েছে ভাষ্যের আর অধিকাংশ জবাবই হয়ে উঠেছে বয়ান। তবে বয়ান আমার যাপিত জীবনেরই। ফলে এতে অপ্রাসঙ্গিক কিছুই নেই। তোমার প্রশ্নগুলো ছিল আমার জীবনের স্মৃত ও বিস্মৃত ফাইল এবং ফোল্ডারগুলো খোলার পাসওয়ার্ড বা চাবি। অলস ক্ষণে অন্যমনে নেহাত অহৈতুকী কৌতূহলবশত কেউ আমার মতো অকৃতীর জীবনের গভীর ভিতরটা একনজর দেখতে চাইলে খোলা খাতার এ বয়ানটুকুর বেশি জানার দরকার হবে না তাঁর। আমার অকিঞ্চিৎকর জীবনের ভেতরমহলটা এভাবে খুলে তুলে ধরার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। শুভ নববর্ষ!

আবদুশ শাকুর

ধানমন্ডি লেকসাইড,ঢাকা,পয়লা জানুয়ারি ২০১২”

গত দশকের শুরুর দিকে প্রয়াত কথাশিল্পী আবদুশ শাকুরের অনবদ্য স্মৃতিকথা ‘কাঁটাতে গোলাপও থাকে’ পাঠের মধ্য দিয়েই মূলত তাঁর লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তাঁর রচনার শিল্পগুণ এত বেশি মুগ্ধ করে যে,তাঁকে আরো বেশি করে জানতে সচেষ্ট হই। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর বিচিত্র রচনাবলী পাঠ করতে করতে,তাঁকে জানতে জানতে দশকের শেষের দিকে এসে তাঁর সান্নিধ্য লাভের গৌরব অর্জন করি। প্রস্তাব করি তাঁর একটি আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যাপারে। বেশ কয়েক মাস সময় নিয়ে অবশেষে প্রস্তাবে রাজি হলেন। কাজ শুরু হলো। দীর্ঘদিন ধরে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ শেষে তিনি আমাকে উপর্যুক্ত পত্রখানা ই-মেইল করে পাঠান।

শক্তিমান কথাশিল্পী আবদুশ শাকুরের আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকারটি যখন নিচ্ছিলাম সেই সময়ের অভিজ্ঞাতার কথা বলি। উর্দু কবি মির্জা গালিবের ‘কাল্লু’ নামে একজন খেদমতগার ছিল। দাস্তান বা গল্প শোনার প্রচ- নেশা ছিল তার। রোজ গল্প না শুনলে রাতে তার ভালো ঘুম হত না। মির্জা গালিবের কাছ থেকে তো শুনতই,শহরে কোনো দাস্তানগো এলে তাকে ধরে নিয়ে আসতো দাস্তান শোনার জন্য। আবদুশ শাকুরের জীবন-দাস্তান বা জীবনের গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে সেই কাল্লুর মতোই মনে হয়েছিল। যে কিনা নির্বাক শ্রোতা,গল্প শুনতে শুনতে যে আমুণ্ডু নিমজ্জিত হয়,যে গল্পের ভেতরে জীবন-সঞ্জীবনী খুঁজে পায়।

আবদুশ শাকুরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অনেকটা গুরু-শিষ্যের,কিংবা বলা যায় মির্জা গালিব এবং কাল্লুর। তাঁর সঙ্গে প্রায় আট বছরের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে প্রায়ই তাঁর ‘মহলে’ যাওয়া হতো। তবে কখনোই স্বেচ্ছায় নয়,তাঁর আহ্বানে। তিনি না ডাকলে তাঁর কাছে যাওয়া বারণ। একদিন তিনি ফোন করে বললেন,‘অফিস শেষ করে বিকেলে একটু আসো,জরুরি কথা আছে।’জরুরি কথাটি শোনার উদগ্রীবতা নিয়ে জরুরিভিত্তিতে বাংলামটর থেকে যানজট ঠেলে তাঁর মহলে যাই। ভেতরে ঢোকা মাত্র তিনি ব্যস্তকণ্ঠে বললেন,‘শোনো,একটা জরুরি লেখা শুরু করতে হবে এখুনি। তুমি এখন যাও,পরে তোমাকে ফোন করব।’

এরকম ডেকে নিয়ে দরজার সামনে থেকে বিদায় করে দেয়ার ঘটনা একবার নয়,অন্তত দশ-বারো বার ঘটেছে। কখনো বিরক্ত হলেও খানিকের মধ্যে তা উবে যেত। কারণ আমাকে ডেকে নিয়ে যে তিনি সময় দিলেন না,এর পেছনের কারণ তাঁর লেখা ছাড়া তো অন্য কিছু নয়! এই আচরণ তাঁর ব্যক্তিসত্তার নয়, লেখকসত্তার। সুতরাং বিরক্তি উবে যাওয়ারই কথা। একজন নিবিষ্ট লেখকের জন্য এই মগ্নতা আবশ্যক। মগ্নতার বাইরে যখন ছিলেন তখন আমাকে ডেকেছেন। এখন তিনি মগ্নতায়,তাই যত জরুরি কথাই হোক,সেটা এখন তিনি বলতে চান না। যতই তাঁর কাছের মানুষ হই,আমার উপিস্থিতি তাঁর জন্য এখন বিব্রতকর।

‘কথাকার’ ও ‘মহল’ শব্দ দুটি আবদুশ শাকুর খুব ব্যবহার করতেন তাঁর লেখায়। নতুন নতুন শব্দ আবিস্কারে সিদ্ধহাত ছিলেন তিনি। কথাশিল্পী,কথাসাহিত্যিক―এসব অভিধা সেকেলে মনে করতেন তিনি,তাই নতুন অভিধার আবিস্কার। আর তিনি যে ফ্ল্যাটে থাকতেন সেটাকে ফ্ল্যাট না বলে মহল বলতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। জিজ্ঞেস করলাম,ফ্ল্যাট সর্ববাঙালির কাছে পরিচিতি একটি শব্দ। বাংলা ভাষায় ফিউশন হওয়া এই ইংরেজি শব্দটি ব্যবহার করলে অসুবিধা কী?

উত্তরে তিনি বললেন,বাংলা ভাষায় শব্দটি ফিউশন করেছে কারা? নিশ্চয়ই লেখকরা! সেই লেখক দলিল লেখক হোক,কেরানি,পুস্তক লেখক বা কবি,সাহিত্যিক,সাংবাদিক হোক। জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে শব্দটি হয়ত মুখে মুখে ব্যবহার করত ইংরেজি ভাষার আগ্রাসনের শিকার সাধারণ মানুষ। কিন্তু লেখক তার লেখনির মাধ্যমে শব্দটিকে স্বীকৃতি দিলেন বলেই তো বাঙালিসাধারণ এটিকে অতিউৎসাহের সঙ্গে ব্যবহার করছে। লেখকরাই ভাষার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেন। আমি একজন লেখক,জেনেশুনে একটি ইংরেজি শব্দকে অকারণে আমার লেখায় কেন ফিউশন করব?এই স্বাধীনতা ভাষা আমাকে দেয় না। দেখ, ফ্যাট শব্দটি লেখা কতটা কঠিন। প্রথমে ‘ফ’, ফ-এর সঙ্গে ‘ল’ সংযুক্ত, তারপর ‘্য’, তারপর ‘া’, তারপর ‘ট’। ঘোরানো-প্যাচানো এই জটিল শব্দটি কেন আমি ব্যবহার করব? বাংলা ভাষায় মাত্র তিন অক্ষরে সহজ-সাবলিল ‘মহল’ শব্দটিকে আমি কেন উপেক্ষা করব? এই উপেক্ষা ঔপনিবেশিক প্রভাবিত হীনম্মন্যতার বহিঃপ্রকাশ বলে আমি মনে করি।

: কিন্তু স্যার,নগর সভ্যতায় বহুল প্রচলিত ফ্ল্যাট-এর পরিবর্তে আমি যদি মহল লিখি তা হলে তো সাধারণরা বিভ্রান্ত হবে। ধরুন,নোয়াখালীর রামেশ্বরপুর থেকে আপনার নামে একটা চিঠি পাঠাল আপনার কোনো এক অনুরাগী বা স্বজন-পরিজন। তিনি যদি ফ্ল্যাটের বদলে চিঠির খামের উপর মহল লেখেন,তাহলে ডাকপিয়ন বিভ্রান্ত হবে না?

: শোনো,ডাকপিয়নকে তুমি এত মূর্খ মনে করো না। সে তো বাঙালি। তার রক্তের ভেতরে ঐতিহ্যবাহী মহল শব্দটি রয়েছে। খামটাতে চোখ বুলিয়ে প্রথমবার বুঝতে না পারলেও দ্বিতীয়বার সে ঠিকই বুঝে ফেলবে মহল মানে যে ফ্ল্যাট কিংবা ফ্ল্যাট মানে যে মহল। একবার যদি সে অভ্যস্ত হয়ে যায়,তাহলে পরবর্তী সময়ে এটি বুঝে নিতে তার আর অসুবিধা হবে না। অসুবিধা যে হবে না এর প্রমাণ আমি পেয়েছি। তুমি জানো যে কলকাতা থেকে আমার বিভিন্ন বই প্রকাশিত হচ্ছে। আমি আমার কলকাতার প্রকাশককে ডাকযোগাযোগের যে ঠিকানাটা দিয়েছি তাতে ‘ফ্ল্যাটে’র বদলে ‘মহল’লিখে দিয়েছি। একবার তিনি আমাকে ডাক মারফত একটা চিঠি পাঠালেন। চিঠির খামে ঠিকই মহল লেখা ছিল। কই, চিঠিটা আমার মহলে আসতে তো কোনো অসুবিধা হয়নি!

এরকম বহু শব্দের আবিস্কারক বা পুনর্জ্জীবনদাতা আবদুশ শাকুর। ভাষা ব্যবহারে তার সচেতনতার ব্যাপারে আরো কয়েকটি উদাহারণ দেয়া যেতে পারে। কথাপ্রসঙ্গে একদিন তিনি বললেন,বর্তমান সময়ে কবি-সাহিত্যিকরা যতটা না সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব ফেলেন,তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন একজন সাংবাদিক। কিন্তু তুমি দেখবে আমাদের সাংবাদিকরা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কতটা অসচেতন। যেমন ধরো, জনৈক সাংবাদিক আমার জন্মদিন উপলক্ষে একটি টেলিভিশনে একটি সংবাদ পরিবেশন করছেন। তিনি আমাকে ফোন করে জানালেন সংবাদটি দেখার জন্য। তিনি বলছেন, ‘আবদুশ শাকুর বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে অবসর নিয়ে পরবর্তীতে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। খেয়াল করে দেখ বাক্যটি কতটা ভুল! ‘পরবর্তীতে’ শব্দটা একটি অসম্পূর্ণ শব্দ, এটি হবে ‘পরবর্তীকালে’। সাংবাদিক অজ্ঞতাবশত একটি ভুল শব্দকে টেলিভিশনের মতো একটি প্রচার মাধ্যমে প্রচার করছেন। আর এতে পুরো জাতি একটি ভুল শব্দ শিখছে।

: তাহলে কি ভাষার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরকেও পরদর্শী হওয়ার কথা বলছেন?

: নিশ্চয়ই। সাংবাদিকতা এখন আর আগের জায়গায় নেই। সমকালীন সাহিত্যে প্রাচুর্য এনেছে লিটারারি জার্নালিজম। এটিকে নিউ জার্নালিজম বা নবসাংবাদিকতাও বলা যায়। মূলে ভিন্ন হলেও জার্নালিজম এবং লিটারেচারের পার্থক্যটা সর্বদা স্পষ্ট নয়। কারণ তাদের সাদৃশ্য অনেক। থাকবে না-ই বা কেন, সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক দুজনেই মানবিক অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন ভাষার মাধ্যমেই। সংবাদ-প্রতিবেদক যে-ঘটনাগুলোকে প্রত্যক্ষে রেকর্ড করে থাকেন,সেগুলো পরোক্ষে মানুষের জগজ্জীবনের গল্পই বলে। অনুরূপভাবে সাহিত্যও কেবল কালপর্ববিশেষের ঘটনাবলির কথাই বলে না,যুগটির মানুষগুলির মন-মানসিকতা ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার কথাও বলে। লিটারারি জার্নালিজমের কাজটা হল ‘ঘটনার মূল্যসংযোজিত বর্ণনা’। বস্তুত সাংবাদিকতার ভিতরে সন্নিবেশিত সাহিত্যই সে মূল্যটুকু যোজন করে। বস্তুত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক পরস্পরের পাড়াতোভাই। দেশে এবং বিদেশে সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত তাঁদের অনেকেই দুজনের কাজই করেন।

: পাড়াতো ভাই,কিন্তু উভয়ের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য তো রয়েছে?

: তা রয়েছে। সাহিত্যিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতার মৌলিক প্রভেদ হল,সাহিত্যিকের দূরবীনে খুব কাছের জিনিসের স্বরূপ ধরা পড়ে না। প্রতিপক্ষে সাংবাদিকের গোচরে কাছের জিনিসের মোটা রূপ ছাড়া দূরের বেশি কিছু আসে না। তার মানে সাংবাদিক-সাহিত্যিকের যেটা আসে সেটা কেবল মোটা দাগের ম্যাটার,তাৎক্ষণিক ইফেক্ট সৃষ্টির অমোঘ অস্ত্র―যা দিয়ে আক্রমণ করে পাঠক-মনকে তাঁর জয় করতে হয়। কেননা বশীকরণ করার সময় তাঁর থাকে না। কারণ তিনি নিত্যপরিবর্তমাণ বস্তুপরম্পরার একজন শশব্যস্ত অনুধাবক। প্রতিপক্ষ সাহিত্যিক রচনাকারের জাদুর কাঠিটি বশীকরণেরই,যেহেতু তাঁকে অনিত্য থেকেও নিত্যকে ছেঁকে তুলতে হয়। যাই হোক,আমার প্রসঙ্গ ছিল ভাষাগত প্রশ্নে সাংবাদিকের সতর্ক হওয়া। আমি মনে করি বাংলা ভাষার দূষণ রোধে সাংবাদিক সমাজকেই অগ্রণি ভুমিকা পালন করতে হবে,তারপর কবি-সাহিত্যিক সমাজকে।

তাঁর আবিস্কৃত নতুন নতুন শব্দ,শব্দের প্রায়োগিক কৌশল ও বাক্য বিন্যাস অনেক সময় পত্রিকার প্রুফ রিডাররা ধরতে পারত না। যেমন ‘বৈদ্যুতিক’শব্দটিকে বৈয়াকরণিক যুক্তি দিয়ে ভুল প্রমাণিত করে তিনি লিখতেন ‘বৈদ্যুতিন’। প্রুফরিডার ‘বৈদ্যুতিন’কে ভুল শব্দ মনে করে ‘বৈদ্যুতিক’ করে দিত। তাঁর লেখা বহু বিশুদ্ধ শব্দ এভাবে বিকৃতির শিকার হতো। এই কারণে তিনি মাঝেমধ্যে ক্ষেপে যেতেন। একদিন প্রথম শ্রেণীর একটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদককে ফোন করে তাঁর ক্ষোভের কথা জানালেন। সেদিন থেকে সম্পাদক সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আদেশ জারি করলেন,আবদুশ শাকুরের লেখার প্রুফ দেখা যাবে না। তাঁর ক্ষেত্রে পত্রিকার নিজস্ব বানানরীতি প্রযোজ্য নয়।

এরকম বহু পত্রিকায় তিনি স্বীয় বানানরীতি বিষয়ক অধিকারটি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভাষা নিয়ে যে নৈরাজ্য চলছে,আবদুশ শাকুর ছিলেন তার ঘোর বিরোধি। এ জন্য তাকে পাল্টা সমালোচনার মুখোমুখিও হতে হয়েছে বহুবার,কিন্তু জয় শেষ পর্যন্ত সমালোচকদের হয়নি,হয়েছে তাঁরই।

‘দেশ টিভি’তে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি নিচ্ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। প্রসঙ্গক্রমে আবদুশ শাকুর বললেন,ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি পৃথিবীতে মহাসমুদ্র পাঁচটি। কিন্তু বড় হয়ে জানলাম,মহাসমুদ্র আসলে ছয়টি। ষষ্ঠ মহাসমুদ্রের নাম রবীন্দ্রনাথ।

তাঁর এই উক্তির মধ্যে কিছুটা আতিশয্য থাকলেও থাকতে পারে,কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তাঁর জানাশোনার পরিধি যে ব্যাপক,এতে কোনো আতিশয্য নেই,সন্দেহ তো নেই-ই। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘মহামহিম রবীন্দ্রনাথ’ছাড়াও তিনি রবীন্দ্রজীবনী প্রণয়ণের কাজে হাত দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ জীবন নিয়ে কোনো গবেষণামূলক গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বাংলা একাডেমীর অনুরোধে কাজটা শুরু করেছিলেন তিনি। দুই খণ্ড লিখেছেনও। এই রবীন্দ্রজীবনী প্রণয়নের কাজে হাত দিয়ে তিনি গভীর মগ্নতায় ডুব দিয়েছিলেন। কাজটি শুরুর আগে দুদিন পরপরই তার সঙ্গে আমার ফোনালাপ হতো। সাধারণত মধ্যরাতেই তিনি ফোন দিতেন বেশিরভাগ। কাজটি শুরুর পর তার সঙ্গে ফোনালাপ অনেকটা কমে যায়। দু-দিনের জায়গায় এক সপ্তাহ পর পর তিনি একবার ফোন দিতেন। আমি কখনো ফোন দিলে খুব ব্যস্ত হয়ে বলতেন,‘নোমান,রবীন্দ্রনাথে ডুবে আছি, তোমাকে আমি পরে ফোন দেব।’

কিন্তু পরে আর ফোন দেয়া হতো না। আমার সাহস হতো না তাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করি। সর্বশেষ তিনি আমাকে ফোন দিলেন মৃত্যুর আগের দিন। নানা বিষয়ে কথা বললেন। তার কণ্ঠস্বর শুনে আমার একবার মালুম হলো না তিনি যে অসুস্থ। অসুস্থতার কথা বলেছেন বটে,কিন্তু আমি তেমন একটা আমলে নিইনি। শেষে বললেন,বিকেলে একবার এসো,কথা আছে।’

ব্যাক্তিগত ব্যস্ততায় আমি স্যারের এই আহ্বানকে উপেক্ষা করেছি। অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় স্যারের বাসায় যাওয়ার কথাটা ভুলেই গেলাম। স্মরণ হলো পরদিন বিকেলে। কবি নওশাদ জামিল ফোন করে জানতে চাইলেন তার মৃত্যুসংবাদটা সত্য কিনা। আমি তখন ছবিরহাটে। এক দৌঁড়ে আজিজ মার্কেটের কোণায় এসে রোদেলা প্রকাশনীর রিয়াজ খানসহ রিকসায় চড়ে বসি। আধা ঘণ্টার মধ্যে স্যারের ধানমন্ডির বাসায় এসে দেখি,সাদা কাপড়ে ঢাকা স্যারের শব।

নিজেকে তখন খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। তাঁর ডাকে কেন সাড়া দিলাম না আমি?এই অপরাধের দায় মাথায় নিয়ে সারা রাত নির্ঘুম কাটাই। হয়ত সারা জীবন এই অপরাধের বোঝা মাথায় বয়ে বেড়াতে হবে। ক্ষমা করবেন মহামহিম কথাকার। আমি আপনার কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থণা করছি।