নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের স্মৃতিকথা: অন্ধকারের স্মৃতি

Post date: Oct 4, 2014 3:51:26 AM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

স্মৃতি আর সন্ধ্যার আরক্ত অন্ধকার। তোমাকে মনে পড়ে। মনে আছে, তোমাকে অনেক দিন কোনো চিঠি লিখি না। আজ এই জ্বরাক্রান্ত শরীরে সহসা তোমাকেই মনে হলো কেনো তা বলা কঠিন। প্রকৃত অর্থে মনে হলো তোমার মৃত্যু এবং হারিয়ে যাওয়ার কথা। যখন গিয়েছিলো ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ- তখন বুঝি তোমার মরার সাধ জেগেছিলো মনে?

সেদিন ভরা বিকেল ছিলো। দিগন্তের সোনালি রং ছিলো শাহরিক ধোঁয়ায় ম্লান। ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন স্ট্রিট, কলকাতার একতলা বাড়িটার সামনে বুড়ো নিমগাছ বাতাসে কাঁপছিলো ধীর ধীর। কতোদিন হলো এইবাড়িতে? তুমি মনে করতে চায় না। স্বরাজ পত্রিকার চাকরি তোমাকে এইখানে তাড়িয়ে এনেছে- নাকি দেশভাগ; নাকি পরিবার, লাবণ্যগুপ্ত? শিরীষের ডালপালা নেই- আছে ধু ধু গড়ের মাঠ। ধানসিড়ি হারিয়ে গেছে কবে কালীগঙ্গায়!

তোমার ডায়েরি মানে তো আর দিনলিপি নয়, কী পড়েছো, না পড়েছে, কার কবিতা পড়ে কী মনে হয়েছে তাইই লিখে রেখেছো। ভূমেন করেছে কী জানো, তুমি যেইসব লেখা পড়ে সেই সম্পর্কে লিখেছো ওইসব লেখাও অনেকাংশ ছাপিয়ে দিয়েছে তোমার দিনলিপির ভিতর। তাই অনেক মোটা হয়ে গেছে। অনেক দাম। চারখণ্ডের দাম চারহাজার তিনশো কুড়ি টাকা। অথচ কী অভাবের মধ্যেই না তুমি ছিলে কলকাতার শেষ ক’বছর।

এইবাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করে না...। অরবিন্দকে বলেছিলে বেশ কয়েকবার। সে নিশ্চয়ই অন্য একটা বাড়ি খুঁজে বের করবে। কিন্তু কখন যে করবে? নিমগাছের পাশ দিয়ে কবি রাস্তায় উঠে এলে। জলার হাওয়ায় তোমার শরীর জুড়োবে? অলোক আসবে। তার সঙ্গে কথা, তার সাথে প্রতিদিন একাকীত্ব। তুমি ফিরছিলে নিমগাছের ঘরে। ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন স্ট্রিট। ল্যান্সডাউন ফিরে গেছে ব্রিটেনের রাস্তায়। কলকাতার ল্যান্সডাউন এখন সারদা বসু।

ধেয়ে আসছিলো একটা লোকজনে ভর্তি ট্রাম। তুমি তারও অনেকদিন আগে লিখেছিলে বোধহয় একখানা মোটর-কার এসে- গাড়লের মতো কেশে এই জাতীয় একটা কবিতা। অথবা লিখেছিলে, একটা মোটরকার খটকা নিয়ে আসে। মোটরকার সব-সময়েই একটা অন্ধকার জিনিস, যদিও দিনের রৌদ্র-আলোর পথে রাতের সুদীপ্ত গ্যাসের ভিতর আলোর সন্তানদের মধ্যে তার নাম সবচেয়ে প্রথম। একটা অন্ধকার জিনিস: পরিষ্কার ভোরের বেলা দেশের মটরশুঁটি-কড়াইয়ের সবুজ ক্ষেতে মাঠে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি লাল সুরকির রাস্তার ভিতর দিয়ে হিজলগাছ দুটোর নিচে দিয়ে ১৯৩৪ এর মডেল একটা মোটরকার ঝকমক করছে, ঝড় উড়িয়ে ছুটেছে। এখন তেমনই একটা মোটরগাড়ি ট্রামের রূপ ধরে আসছে, তুমি টের পাচ্ছো না। ট্রাম যাবে বালিগঞ্জ। বালিগঞ্জে ট্রামের কী কাজ?

তোমার মা আমাকে বলেছিলো, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে? আমি মনে মনে বললাম, জানি না তো! বাতাস এসে বন্ধ করে দিলো আমার বইয়ের জানলা। তারপর অনেকদিন গেছে, আমি অপেক্ষায় থেকেছি। কুসুমকুমারী তার মিলুর কথা আমাকে না বলেই একদিন হারিয়ে গেলো, আমার বইয়ের পাতা থেকে। তারপরও মনে মনে প্রতীক্ষায় থেকেছি।

তখন আমি বছর বারো। তখন আমি শৈশবরহিত একলা শ্রাবণ। তখন আমি ভিড়ের ভিতর ভয়ানক নৈঃসঙ্গ। তখন আমি হট্টগোলে ব্যাপ্ত নৈঃশব্দ্য। তখন আমি বিরান বনভূমিতে একা পাহাড়ের অভিমান। তখন আমি পাহাড়ের দেহে গোপন নির্ঝর। একদিন বইয়ের পাতায় তুমি এসে চলে যাওয়ার সময় বললে, আবার আসিবো ফিরে... সারাদিন কেটে যাবে কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায় দেখিবে ধবল বক...। এইই প্রথম তোমাকে আমার পড়া। তখনো তোমাকে দেখিনি কিছুই। দেখিনি ভীরু ভীরু চোখের অন্ধকারে ডুবে আছে আলোর চরাচর। আমার মাথার ভিতর ঢুকে গেলো শঙ্খচিল, কিশোরীর ঘুঙুর আর লাল পা। আমি তখনো জানতে পারি নি- এর থেকে আমার মুক্তি নেই। তারপর তোমাকে প্রথম জেনেছিলাম অবসরের গান, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেকদিন জেগে থেকে ঘুমোবার সাধ ভালোবেসে। তখন কি আমি সপ্তমশ্রেণিতে পড়ি? মনে পড়ে না তেমন। হতে পারে। গ্রামের বইয়ের দোকান থেকে আমি তোমার শ্রেষ্ঠ কবিতা কিনেছিলাম মনে আছে, দাম নিয়েছিলো ৪৫টাকা মনে হয়। এখনো আছে। ১৯৯৩ সন হবে।

পুরনো ট্রাংকে তোমার সাতান্নটি খাতা পাওয়া গেছে, জানো? কেনো তুমি অইসব লুকিয়ে রেখেছিলে। না, হয়তো যত্ন করেই রেখেছিলে। ময়ূকের ভূমেন ওইসব ছাপিয়ে দিয়েছে, দিনলিপি নাম দিয়ে। অনেক দাম। কিনতে পারি নি এখনো, একেকটা একহাজার আশি টাকা করে। ছুঁয়ে দেখে এসেছি অনেকবার। পৃষ্ঠা উল্টিয়েও দেখেছি। তোমার ডায়েরি মানে তো আর দিনলিপি নয়, কী পড়েছো, না পড়েছে, কার কবিতা পড়ে কী মনে হয়েছে তাইই লিখে রেখেছো। ভূমেন করেছে কী জানো, তুমি যেইসব লেখা পড়ে সেই সম্পর্কে লিখেছো ওইসব লেখাও অনেকাংশ ছাপিয়ে দিয়েছে তোমার দিনলিপির ভিতর। তাই অনেক মোটা হয়ে গেছে। অনেক দাম। চারখণ্ডের দাম চারহাজার তিনশো কুড়ি টাকা। অথচ কী অভাবের মধ্যেই না তুমি ছিলে কলকাতার শেষ কবছর।

অলোকের সাথে কী কথা তোমার আজ? কবিতার কথা? সে তো তুমি নিজেই লিখে রেখেছো। অনেকদিন লেখো না তুমি। অলোকের কাছে কি টাকা ধার করবে? তোমার গায়ের রং গাঢ় শ্যামল। তোমার ভিতর ছিলো রাইমাধব। অলোকের সঙ্গে কি দেখ হলো? সুবোধের সঙ্গে কী কাজ। জয়া র্স্টোস এর সামনে কি জেব্রা ক্রসিং ছিলো? কী ভাবছিলে তুমি? হাতে বাজারের ব্যাগ, বগলে ছাতা। তোমার মাথার ভিতর কি ঘুরছিলো কবিতার কোনো চিত্রকল্প, নাকি অর্থের চিন্তা? হাতে টাকাকড়ি নেই। ট্রামের হুইসেল কানে বাজলো না তোমার। ট্রামের চাকা তোমাকে টেনে নিয়ে গেলো। তারপর শম্ভুনাথের দিন। তারপর তোমার অন্ধকারের কাছে। তোমার বনলতা সেন, প্রিয়তম অন্ধকার, থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার।