বিকশিত হবার আগেই প্রকাশিত কবিদের কবিতা পড়ে মূষড়ে পড়ি: কবি অবনি অনার্যের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 5, 2012 1:54:12 PM

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (প্রা.) লি.,সরস সতী,লঘুচালে চোরাবালি খেলা

কবিসংঘ অনুসংগ, আমাদের আর তাহাদের আমেরিকা(অনুবাদ), আমার ক্ষোভ আমার অহংকার(অনুবাদ), জেগে ওঠেছে ইরান(অনুবাদ), উন্মাদ(অনুবাদ)

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

অবনি অনার্য: নিঃসীম নৈঃশব্দে বাঙ্ময় হবার তূরীয় আনন্দে, শিল্পের চূড়ান্ত সংবেদনশীল মাধ্যমে প্রকাশের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা অ-পরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই বলে।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

অ: প্রস্তুতি নিয়ে কবিতা রচনা করা যায় বলে আমার জানা নেই। তবে, কবিমাত্রই স্বকীয়-উপায়ে 'প্রস্তুত' বলে ধরে নিই। বিস্তর পড়াশোনার পাশাপাশি বিচিত্র অভিজ্ঞতার অনুপম অনুবাদে পারঙ্গম হওয়া বাঞ্ছনীয়; কবিতার মৌলিক কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা উপকারী বলে মানি, অত্যাবশ্যক কিনা জানি না।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

অ: সমসাময়িক শব্দবন্ধটা নিয়ে বিতর্ক মীমাংসিত নয় বলে জানি। তবু ধরে নিচ্ছি তথাকথিত দশক-বিবেচনায় আশির দশকের পর থেকে বর্তমান সময় অব্দি বোঝানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে, আমার পছন্দের তালিকায় আছেন (এটাই চূড়ান্ত তালিকা নয়) মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ব্রাত্য রাইসু, কামরুজ্জামান কামু, চঞ্চল আশরাফ, টোকন ঠাকুর, সাখাওয়াত টিপু, ফিরোজ এহ্তেশাম, সোহেল হাসান গালিব, আফরোজা সোমা প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকের কবিতাই অন্তত কোনো একসময় আমাকে কাব্যিক সুষমায় বিস্ময়াভিভূত করেছিল। এঁদের প্রত্যেকের কবিতারই নিশ্চয়ই স্বতন্ত্র্য ধারা-প্রকরণ ইত্যাদি রয়েছে, কিন্তু যেখানে এঁরা সবাই এবং প্রত্যেকেই আমার প্রিয় কবি সেটি হচ্ছে কাব্যরচনার মুন্সিয়ানায়-- কবিতার আখ্যান বলুন আর আকর বলুন, গঠন বলুন আর প্রকাশভঙ্গী বলুন (এগুলোর প্রত্যেকটি বা সবক'টি কবিতা বিবেচনায় অত্যাবশ্যক নয়), এঁদের কবিতায় (সব কবিতায় অবশ্যই নয়, তবে অনেক কবিতায়) অন্ততঃ একটি বিশেষ বিভায় আমি সম্যক আক্রান্ত হয়েছি, ঘোরলাগা বিস্ময়ের সন্ধান পেয়েছি।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

অ: মন্দলাগা প্রকাশে আমরা জন্মগতভাবে পটু। অতএব, অসামান্য গুণটির সামান্যতম প্রকাশেও আমি কুণ্ঠিত। তবে, সমসাময়িক অধিকাংশ কবিযশোপ্রার্থী ব্যক্তির রচনাবলীর কাব্যরূপ-প্রকাশে আমি মূষড়ে পড়ি-- তাঁদের অপরিসীম মূর্খতা, অপ্রয়োজনীয় শব্দরাশি প্রকাশে সীমাহীন নির্লজ্জতা, এবং 'বিকশিত হবার আগেই প্রকাশিত' হবার সুতীব্র বাসনা দেখে।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

অ: দুই দশকেই বাংলা সাহিত্য কিছুসংখ্যক অসামান্য কবি এবং শিল্পোত্তীর্ণ কবিতায় ঋদ্ধ হয়েছে। তবে, কবিতার চূড়ান্ত সর্বনাশেও এই দুটি দশকের ভুমিকা কালোত্তীর্ণ বলে আমি ধারণা করি। এ-দুই দশকে মিডিয়ার অকল্পনীয় উত্থান হয়েছে; আর কবিতাও ওই মিডিয়ার মাধ্যমেই বিকশিত হতে চেয়েছে (বিকল্প ছিলো কিনা, বা বিকল্প ব্যবহৃত হয়েছ কিনা, হলে কতটা সফল সেটা বিবেচনা করা হচ্ছে না এখানে), বা বিকশিত হতে হয়েছে। অন্য দশকগুলোর চেয়ে এ-দুই দশকের বিশিষ্টতা এখানেই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চূড়ান্তমাত্রায় ব্যর্থ কবিরাই কবিতা বিচার-প্রকাশের ভার পেয়েছেন। কর্পোরেট দুনিয়া উত্তম ম্যানেজার চায় (এটা কিন্তু খু্বই প্রশংসনীয়), উত্তম কবি নিতান্তই গৌণ। সফল কিছু কবি যে এ-দায়িত্ব নেননি সেরকম নয়, তবে তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই কবিতা রচনা থেকে অবসর নিয়েছেন, কিংবা চাকুরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত (!) হয়েছেন। ব্যর্থ কবিরা পরস্পর পরস্পরের কবিতা ছেপেছেন-- দৈনিকে কিংবা লিটলম্যাগে। এঁরা নিজ-উদ্যোগে তাঁদের চাইতে শক্তিমান কবিদের কবিতা উপেক্ষা করেছেন, কিংবা অনাগ্রহ নিয়ে সর্বনিম্নহারে প্রকাশ করেছেন। ভালো কবির প্রচারের মধ্য দিয়ে তাঁদের নিজেদের মূর্খতা রাষ্ট্র করতে তাঁরা স্বভাবতই অনীহা প্রকাশ করেছেন। সত্যিকারের প্রতিভাবান নবীন কবিরা অচিরেই এসব গৌণ কবিদের দ্বারস্থ হয়েছেন প্রকাশের বাসনা নিয়ে, এবং দীক্ষিত হয়েছেন কবিতার রাজনীতিতে। কবিতা রচনার প্রয়াস ছেড়ে তাঁরা আগ্রহী হলেন সাহিত্য সম্পাদকের অফিস কিংবা বাসায় সান্নিধ্য পেতে। যেহেতু গৌণ কবিদের কবিতাই ছাপা হয় বেশি হারে, এবং যেহেতু এসব সম্ভাবনাময় শক্তিমান কবিদের অপেক্ষাকৃত দুর্বল কবিতা প্রকাশিত হয়, ফলে উত্তম কবি এবং উৎকৃষ্ট কবিতার ধারণাই পাল্টে যায় এসকল তরুণ কবির। এককালে, এই বদলে-যাওয়া ধারণা নিয়ে আরো নিকৃষ্ট কবিতা রচনায় নিযুক্ত হন এঁরা (প্রকাশের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় বলে), অথবা সবার অগোচরে বিদায় নেন-- এপারে, ওপারে কিংবা পরপারে।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

অ: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা পর্যাপ্ত পরিমাণে পড়া হয়নি বলে মন্তব্যটা নিছক ছেলেমানুষী। যতটুকু পড়েছি, পশ্চিমবঙ্গের কবিতা প্রাণহীন, খটখটে মনে হয় আমার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ বাক্য কিংবা কবিতা বলেই মনে হয় না আমার; অনেকটা গুগলে অনুবাদের মতো।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

অ: ব্লগ অনস্বীকার্য। কবিতার পাঠক সংখ্যায় বাড়ছে বলে ধারণা করি, প্রকৃত পাঠকের হাতে ঠিকঠাক কতোটা যাচ্ছে সেটা নিশ্চয় করে বলতে পারি না। তবে, এর মাধ্যমে পাঠক তৈরি হবে বলেও আমি বিশ্বাস করি।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

অ: দুটোকে তুলনা করা যায় বলে আমি মনে করি না; দুটোর মেজাজ আলাদা, উদ্দেশ ভিন্ন, দর্শন স্বতন্ত্র্য। আমি চাই দুটোই হোক, প্রকৃত পরিচালকের হাতে। অন্যথা, দুটোই বিপজ্জনক।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

অ: এ-বিষয়ে অনেকটা বলা হয়ে গেছে। দৈনিকে সাহিত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কাজ করে বাজারের চাহিদা ( সেটাই স্বাভাবিক, এবং উচিত); সাহিত্য যে ছাপা হয় এই ঢের! দৈনিকে সাহিত্য ছাপা হয় অনেকটা সাহিত্য সংবাদ প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা থেকে, এবং (সম্ভাব্য) সাহিত্যিক সমাজকে ভোক্তা বিবেচনা করে, সাহিত্যসেবার নামে কখনোই নয়। এখানে একজন নামকরা (বা একেবারেই অপরিচিত) কবির ইসরাইল-বিরোধী (বা আমাদের অপছন্দের যেকোনো দেশ-বা-সংস্কৃতি-বিরোধী অথবা আমাদের পছন্দের দেশ-কিংবা-দর্শন-সমর্থনকারী) কবির কবিতার মূল্য একটি আনকোরা অসামান্য শিল্পগুণসমৃদ্ধ কবিতার চাইতে অনেক বেশি। এখানে ক্ষমতাবান ব্যক্তির বর্জতুল্য পুস্তক-পরিচিতি (সাহিত্য সমালোচনার নামে) একটি সুপাঠ্য গল্পের চেয়ে গুরুত্ববহ। এমনকি, বিজ্ঞাপনের স্থান সংকুলানের উদ্দেশে গোটা সাহিত্যপাতাটাই গায়েব হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়! শুধু তাই নয়, এই পত্রিকায় চাকুরি করেন বলে আপনার কবিতা হয়তো এবার ছাপা হলো ঈদ সংখ্যায় (এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ!), চাকুরি ছেড়েছেন তো আপনার কবিতা ছাপানোর উপযুক্ততাই হারালো। সাহিত্য সম্পাদক কিংবা তাঁর পছন্দের ব্যক্তির অখাদ্য-কবিতার বইয়ের আলোচনা লিখবেন, নাকি সাহিত্য সংবাদ লিখবেন, অথবা কবিতাই রচনা করবেন--এ-জাতীয় বিতর্কেই গোত্তা খেতে থাকেন দরিদ্র কবিকূল!