সাঈফ ইবনে রফিকের স্মৃতিকথা লিবিয়া জীবন (একসাথে ১৫টি পর্ব)

Post date: Oct 14, 2014 4:23:06 AM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

লিবিয়া জীবন: ১

যখন বেড়ে উঠছি, তখনই বুঝতে শিখেছি-- দেশটি আমার না, কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির। টিভি যতক্ষণ খোলা থাকতো, তাকেই দেখা যেতো। বাঙালি কমিউনিটিতে তাকে বলা হতো বড় ভাই অথবা গেদু মিয়া। প্রকাশ্যে তার নাম নিয়ে পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চাইতো না কেউ। সাদা পোশাকের পুলিশতো আর বাংলা বোঝে না!

যে টিভি স্টেশনটি আজ বন্ধ হয়ে গেছে, সেটাই তখন আমাদের টেলিভিশনের একমাত্র চ্যানেল। ছাদে উঠে ঠিকমতো অ্যান্টেনা ঘুরাতে পারলে, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালিয়ান টিভিও আনা যেতো। টিভি সারাদিন দেখতাম, একটা জাতি কিভাবে সামরিক হয়ে উঠছে। ছানি পড়া চোখে রাইফেলের লেন্সে চোখ রেখে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বুড়িরাও। আরও দেখতাম, মরুভূমি থেকে দলে দলে বেদুইন ধরে কলোনিতে উঠিয়ে দিচ্ছে সেনাবাহিনী। স্কুলের মেয়েরা বেদুইনদের বাথরুমের ফ্লাশ টানা শেখাচ্ছে। ওই কলোনিগুলোতে বেড়ে ওঠা প্রজন্মই আজ গাদ্দাফিকে হঠালো।

ত্রিপোলি-বেনগাজিতে গাদ্দাফি বিরোধী মিছিলের তরুণরা জানে না, অর্থাভাবে চিকিৎসা জোটে না আমার দেশে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা বা শিক্ষার মতো মৌলমানবিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র বাধ্য, সে কথা যেমন বাংলাদেশীরা ভাবতে পারে না; ঠিক তেমনি ওরাও সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকেই ভাবতে পারছে না লোডশেডিং কি?

গাদ্দাফি পরিবারের দুর্নীতি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, জনগণকে তিনি দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পেরেছিলেন।

লিবিয়া জীবন: ২

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সাম্রাজ্যবাদের একটা আদর্শ উদাহরণ, বিশ্বজুড়ে নানা সমস্যার মূল উৎস-- শৈশবে টেলিভিশনে গাদ্দাফির ভাষণ দেখেই তা জেনেছিলাম আমি। লোকটা ভীষণ স্ট্যান্টবাজ। একবার কাবা শরিফের গিলাফ ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে আল্লাহ! হজরত মুহাম্মদের স্মৃতিধন্য এই প্রিয় ভূমিকে আমেরিকার দালালদের হাত থেকে রক্ষা করো। এরপর লিবীয়দের হজ যাওয়ার ব্যাপারে নানাবিধিনিষেধ আরোপ করছিল সৌদি সরকার।

৮৬ সালে যখন লিবিয়ায় বিমান হামলা চালালো যুক্তরাষ্ট্র, তখন টিভি দেখতাম, প্রেসিডেন্ট রিগ্যান পিস্তল হাতে পৃথিবীর ওপর বসে আছেন। মজার মজার সব স্টিল কার্টুন অনএয়ার হতো টেলিভিশনে।

আমেরিকানরা কাফের। ওরা মুসলিমদের ভালো কখনোই মেনে নেবে না-- এমন জ্বালাময়ী ভাষণের পর গাদ্দাফিকে দেখতাম, আরেক কাফের রাশিয়ার সঙ্গে সেকি দহরম মহরম। হোক ইসলামী সোশ্যালিজম! এই বিপ্লবী নেতার কারণে শৈশবেই আমার সোশ্যালিজমের সঙ্গে পরিচয়।

লিবিয়া জীবন: ৩

রবীন্দ্রনাথ কালারব্লাইন্ড ছিলেন। চোখে ঠিকমতো সবুজ রং দেখতে পারতেন না। সবুজ-শ্যামল দেশটি শারিরীক অবস্থানের কারণে তারপরও তার কবিতায় ছিল সবুজের সমারোহ। মরুময় লিবিয়ায়ও আমি অনেক সবুজ দেখেছি। গাদ্দাফি রবীন্দ্রনাথকে চেনেন কিনা, জানি না-- তবে দেশটাকে সবুজে ভরে দেয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। রাষ্ট্রীয় কাঠামো কেমন হবে তা লিখেছিলেন দ্য গ্রিন বুকে। আরবিতে কিতাবুল আখদার। সেটাই লিবিয়ার বাইবেল।

বাবা-মার কাছে শুনেছি সবুজ বিপ্লবের মধ্যদিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন গাদ্দাফি। গাদ্দাফির সবুজপ্রীতি ছিল অসাধারণ। সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশকে ভালো করেই চিনতেন তিনি। টেলিভিশনে সেনা কর্মকর্তাদের জন্য একটা সাপ্তাহিক ক্লাস নিতেন গাদ্দাফি। একবার এই ক্লাসে তিনি বললেন, বাংলাদেশের আয়তন ৫৫ হাজার বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ১০/১২ কোটি। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবরটি হচ্ছে-- এবার বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অর্ধ শতাধিক প্রার্থী অংশ নিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে হাসির রোল। এ সবই অনএয়ার হলো টেলিভিশনে।

সপ্তাহখানেক পর সপরিবারে দেশে বেড়াতে আসার জন্য ছুটি চাইলেন আমার বাবা। চিফ ইঞ্জিনিয়ার তাকে প্রশ্ন করলেন-- কেন ছুটি চান, দেশে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ইলেকশন করবেন?

মুসরাতায় (বিবিসি যে শহরটার নাম মিসরাতা লেখছে) আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, তার পাশেই একটা পার্ক ছিল। সবুজে ভরা পার্ক। সুন্দর টাইলসে বাধানো রাস্তা। সি-স, ল্যাডার আরো কতো শিশুতোষ খেলনার সরঞ্জাম! বাড়িতে থাকলেও মন পড়ে থাকতো ওই সবুজ পার্কেই।

স্কুলে ঢোকার মুখেই গাদ্দাফি আর তার ভাবগুরু জামাল আবদেল নাসেরের বড় দুটি ছবি। টেলিভিশনের বদৌলতে গাদ্দাফিকে প্রথম দেখায় চিনলেও, জামাল নাসেরকে চিনতে আমার বেশ কিছুদিন লেগেছিল। পাগড়ি পড়া এক ইন্ডিয়ান শিখ ইংলিশ টিচার আমাকে শিখিয়েছিলেন, এটা জামাল আবদেল নাসের। আধুনিক মিশরের নেতা। তার ইয়ং অফিসার্স রেভ্যুলেশনে অনুপ্রাণিত হয়েই অকর্মন্য উপনিবেশের তাবেদার রাজা ইদ্রিসকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন গাদ্দাফি।

লিবিয়া জীবন: ৪

গাদ্দাফির গাড়িতে বোমা পুঁতে রেখেছে সিআইএ। কিন্তু প্রেসিডেন্টের বাসভবন বাব আল আজিজিয়া থেকে তিনি অন্য একটি গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন। টাইমবোমায় তার প্রাসাদসম গাড়িটি উড়ে গেলেও, তিনি বেঁচে গেলেন। এ ধরনের গল্প আরো অনেক আছে। সত্য-মিথ্যা জানি না, মিথের মতোই গিলতাম গল্পগুলো। শুনেছিলাম, সির্তের কাছাকাছি সেবা মরুদ্যানে থাকতো গাদ্দাফা কওম। ওই গোষ্ঠীরই এক প্রভাবশালী নেতা ছিলেন গাদ্দাফির বাবা। ভীষণ অসুস্থ্ হওয়ার পর, তাকে নেয়া হলো সির্ত সেন্টাল হাসপাতালে। প্রেসিডেন্টর বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঘাম ঝরছিল এক বাংলাদেশী ডাক্তারের। পাছে ভুল চিকিৎসার দায়ে তার আবার প্রাণ দিতে না হয়। উপায় না দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফোন করল গাদ্দাফিকে। বলল, উন্নত চিকিৎসার জন্য আপনার বাবাকে ত্রিপলি নিয়ে যান। গাদ্দাফি তখন জিজ্ঞাসা করলেন, গত ৫ বছরে এই রোগের জন্য কয়জনকে ত্রিপলি আনা হয়েছে? হাসপাতালের পরিচালক বললেন, কাউকে নয়। গাদ্দাফি তখন বললেন, অন্য সবার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, আমার বাবার ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। সির্তেই মারা গেলেন গাদ্দাফির বাবা। এ ধরনের আরো অনেক চমক, চটকদারি গল্প আছে গাদ্দাফিকে নিয়ে। সিকিউরিটিকে না জানিয়ে গোপনে দেশের পরিস্থিতি দেখতে বের হতেন গাদ্দাফি। আরব্য রজনীর সেই খলিফা হারুনার রশিদের ইমেজ। একবার গভীর রাতে ত্রিপোলির এক হাসপাতালে আচমকা পরিদর্শনে যান গাদ্দাফি। দেখলেন, ডিউটি ডাক্তারের রূমে টেবিলে মাথা রেখে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন এক ভারতীয় ডাক্তার। তাকে বিরক্ত না করে প্রশাসনকে নির্দেশ দিলেন, কাল সকালেই তাকে ইন্ডিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা কর, যাতে বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে।

১৯৭৮ সালে ইসরাইলের সঙ্গে মিশরের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির কড়া বিরোধিতা করেছিলেন গাদ্দাফি। তার মদতেই আরব লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল মিশরকে। যে জামাল আবদেল নাসেরকে গুরু মানতেন গাদ্দাফি, তার সঙ্গে সব সম্পর্কও ছিন্ন করলেন তিনি। আশির দশকে আরো একবার মিশরের সঙ্গে ঝামেলা হয় লিবিয়ার। মুসরাতায় সন্ধ্যার পরই নেমে গেল সেনাবাহিনী। সিনেমা হল, শপিং মল, হাসপাতাল থেকে শুরু করে অফিস আদালত-- যেখানেই মিশরীয়দের পেয়েছে, দলে দলে ট্রাকে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছে দেশে।

আমাদের বাসার নিচতলায় এক মিশরীয় মহিলা থাকতেন। দৈত্যের মতো লম্বা, ইউরোপীয়ানদের মতো ফর্সা-- নাম ছিল জামালাত। গোটা দশেক ছেলে-মেয়ে ছিল তার। স্বামী ছিলেন ফিলিস্তিনি। আর একারণেই সেই দফা বহিষ্কারের মুখে পড়েননি তিনি।

একদিন বাবার সাথে বাজার থেকে ফিরছি। আমার হাতে বকসাদা ফার্মের মুরগী, লোকাল আরবিতে বলতো দেজাজ। পথে এক লোক বাবাকে খুব গোপনে কি যেন বললেন। আমি আরবি অতোটা ভাল বুঝি না। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, বাবা তাকে এক দিনার দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা তুমি ওকে টাকা দিলে কেন? বাবা বলেন, ও ফিলিস্তিনি। বাড়ি হারিয়ে এখানে এসেছে। তাই ওকে সাহায্য করলাম। এরপর বাবার কাছে ফিলিস্তিনের গল্প শুনতে শুনতে বাড়ি ফিরলাম। জীবনে ওই প্রথম দেখলাম, আদি পেশা ভিক্ষাবৃত্তি! তবে এই পেশাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল লিবিয়ায়।

লিবিয়া জীবন: ৫

শৈশবে পুলিশ আর কুকুর খুবই ভয় পেতাম। একটি আদর্শ পুলিশ স্টেটে বড় হচ্ছি, পুলিশ ভয় না পেয়ে কি কোনও উপায় আছে? প্রায়ই দেখতাম, কোনো বাড়িতে কান্নার রোল। বুঝতাম, পুলিশ এসেছে। ধরে নিয়ে যাচ্ছে কাউকে। অপরাধগুলো খুবই হালকা ধাঁচের। হয়তো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এক বন্ধু অপর বন্ধুকে বলল, গাদ্দাফি আইতাসে তোরে ধরতে। আর অমনি, সিভিল ড্রেসে কেউ এসে বলল, আপনাকে এ্যারেস্ট করা হলো।

আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে একটা লিবীয় পরিবার থাকতো। ভদ্রলোককে আমি কখনোই দেখিনি। শুনেছি, তাকে গুম করেছে সরকারি বাহিনী। ভদ্রলোকের স্ত্রী ইতালিয়ান বংশোদ্ভুত হলেও তুখোড় আরবি বলতে পারতেন। তিনিই আমার মাকে আরবি শিখিয়েছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় ৫ বছর ধরে কারাগারে তার এক ছেলে। অপর এক ছেলে মোহাম্মদ ছিলেন পুলিশের বড় কর্তা। চাকরি আর জীবন বাঁচাতেপরিবারের বাইরে আলাদা থাকতেন তিনি। মেয়ে মরিয়ম থাকতেন মায়ের সঙ্গে। সারাদিন গাদ্দাফিকে অভিশাপ দিতেন মা-মেয়ে। গভীর রাতে লুকিয়ে মাকে একবার দেখতে আসার অপরাধে তাকে দক্ষিণের প্রত্যন্ত এক মরুভূমিতে বদলি করা হয়েছিল। আমি নিশ্চিত, মোহাম্মদ যদি এখনও বেঁচে থাকেন-- তাহলে সে এখন মুসরাতায় বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

পুলিশ বলেই মোহাম্মদকে খুব ভয় পেতাম আমি। একবার বাবা বললেন, সেকি, ওতো তোমার আংকেল। আমি বললাম, পুলিশ আবার আংকেল হয় ক্যামনে। পুলিশ আর সেনাবাহিনীর পার্থক্য আসলে তখনো বুঝিনি। সেনাবাহিনীর চেয়ে পুলিশকেই বেশি হিরো মনে হতো। ওই হিরোইজমে বুদ হয়ে আমিও বলতাম, বড় হয়ে পুলিশ হবো। শুধু আমি না, আমার স্কুলের সব শিক্ষার্থীদেরই স্বপ্ন ছিল পুলিশ হওয়ার। সুপারমলগুলোতে পুতুল পাওয়া যেতো না। মেয়েরাও বন্দুক-পিস্তল নিয়েই খেলতো। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। যা আজও চলছে লিবিয়ায়।

পুলিশের পরই সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল কুকুরে। লিবিয়ার কুকুরগুলো না বোঝে আরবি, না বোঝে বাংলা-ইংরেজি। কোনও ভাবেই থামানো যেতো না ওদের। তবে পুলিশ আরো বেশি হিংস্র। প্রকাশ্যেই গুলি করে মারতো কুকুরগুলোকে। রক্ত ছড়িয়ে পড়তো রাস্তায়। জান খতম হওয়ার পর আসতো সিটি করপোরেশনের ক্লিনাররা। আমাদের দেশে যেমন ক্রসফায়ারের পর মিডিয়া আসে।

১৯৮৬ সালে মার্কিন হামলার পর আরো মজার একটা দৃশ্য দেখতাম। আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যেতো, ইনিফর্ম পড়ে সশস্ত্র অবস্থায় গাদ্দাফির পক্ষে মিছিল করছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীও যে স্লোগান দিতে পারে, এটা দেখেছি তখন। সন্ধ্যার পর শুরু হতো ব্ল্যাকআউট পর্ব। ঘরের সব বাতি নিভিয়ে রাখার কঠোর নির্দেশ। রাজপথে সেনাবাহিনী। ট্যাংক পাহাড়া দিচ্ছে পাড়া-মহল্লা। মাথার ওপর দিয়ে সাই সাই করে উড়ে যেতো জঙ্গিবিমান!

লিবিয়া জীবন: ৬

মিথ হয়ে যাওয়া রোমান সাম্রাজ্য বা হালআমলের ইতালি; ইউরোপীয়দের রক্তে যে উপনিবেশবাদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তা মুসরাতা দেখলেই বোঝা যায়। আজ পশ্চিমা মিডিয়া যাকে মিসরাতা বলছে, স্থানীয়রা তাকে মুসরাতাই বলে। ছিমছাম শহরটিই লিবিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী। এমন একটা অদ্ভুত সময়ে আমার ওই শহরে বেড়ে ওঠা, যখন মোড়ে মোড়ে ইতালিয়ানদের গির্জার চূড়া বদলে মিনার করা হচ্ছে-- ধর্মান্তরিত হচ্ছে উপসনালয়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কেবল লাগছে শহরটিতে। কৃত্রিম ঝর্নায় যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠছে পার্ক। সবুজায়নের আগ্রাসনে মরুভূমি, অদ্ভুত সব দৃশ্য। মাইলের পর মাইল ভূমধ্যসাগরীয় ফলের আবাদ। এখানে যেমন গরুর দাপট, ওখানে তেমন উট আর ঘোড়ার দৌরাত্ম। ভূমধ্যসাগর দেখেই সমুদ্রের বিশালতায় মুগ্ধ আমি তখনো জানতাম না, হতভাগা সাগরটার চারদিকই ঘিরে আছে স্থল।

ইতালিয়ানদের তাড়িয়ে স্বাধীনতা এনেছিল লিবিয়া, আমরা যেমন তাড়িয়েছি ব্রিটিশদের। তবে এখনো যেভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় অস্থিমজ্জায় ব্রিটিশ শাসন, সেখানে পুরো বিপরীত!

মরুভূমির সিংহ ওমর মুক্তারের দেশ বলে কথা, সবুজ বিপ্লবের ছোঁয়ায় তা আমুল বদলে গেলো সেখানে। আর শৈশবে আমার সবচেয়ে প্রিয় সেই টেলিভিশনে প্রায়ই দেখতাম ওমর মুক্তারের সিনেমাটি। শিখেছি স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে হয়, উপনিবেশের শোষণমুখী চরিত্র; দেখেছি প্রকাশ্য ফাঁসির দৃশ্যও। অন্তত বাংলা সিনেমা দেখার আগপর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, ফাঁসিটা দিনে-দুপুরেই হয়। অনেক মানুষ দাঁড়িয়েদাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে, নিঃশ্বাস ফেলে। আর একটা টুলের ওপর দন্ডিতকে দাঁড় করা হয়। টুলটা ফেলে দিলে দড়িতে ঝুলানো রুই-কাতলার মতো কাতরাতে থাকে দেশপ্রেমিক আসামী, করুণ মৃত‌্যু হয় তার। যেমন হয়েছিল ওমর মুক্তারের। সিনেমা দেখার ফাঁকে ফাঁকে বাবা শেখাতেন-- এটা হচ্ছে ওমর মুক্তার বাহিনীর কাউন্টার অ্যাটাক, আর ওইটা ছিল এ্যাম্বুশ।

বাসার পাশে পার্কে আমরা দুই ভাই

লিবিয়া জীবন: ৭

কোরিয়ান হোক, আর চীনা-- নাকবোঁচা মঙ্গলীয় সবার চেহারাই এক রকম লাগতো আমার কাছে। লিবিয়ায় আসা এই নাকবোচাদের অধিকাংশই ছিল শ্রমিক। কোরিয়ান কন্ট্রাকশন ফার্মগুলোতে তখনো বাংলাদেশী শ্রমিকরা ঢোকেনি। ১৯৭৫-৮০ পর্যন্ত লিবিয়ায় বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ইংলিশ টিচারে মতো পেশাজীবীদেরই দাপট ছিল বেশি। ক্যুয়ের পর দেশছাড়া কর্নেল ফারুক-রশিদ থেকে শুরু করে ডেপুটেশনে যাওয়া উইং কমান্ডার রহিম-- সবুজ লিবিয়া গঠনে বাংলাদেশী সামরিকদেরও একটা অবদান আছে।

বাবা বলতেন, যখন বাংলাদেশ গড়ার সময়, তখন তিনি লিবিয়া নির্মাণে ব্যস্ত। এ নিয়ে খুব আক্ষেপও ছিল তার। শপিংমলগুলো কাজ করতো ফিলিপনো আর মিশরীয় মেয়েরা। অধিকাংশ নার্সই যুগোশ্লাভিয়ার-- দেশটা এখন ভেঙে গেছে।

মানচিত্র নিয়ে যে আমাদেরও ঝামেলা আছে, তা বুঝতাম ইলিয়াস আংকেলকে দেখে। ভদ্রলোক আমার বাবার সঙ্গেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন। একই সঙ্গে একই কায়দায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ডেপুটেশনে মুসরাতা গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাওয়ার পর তার মনে হলো-- তার আসল দেশ ইন্ডিয়া। বর্ধমানে পৈত্রিক ভিটায় দালান করলেন, দোকান-পাট করলেন। আরবাংলাদেশের পাট চুকিয়ে ফেললেন।

যা হোক, আবারও সবুজ লিবিয়া ফিরে আসি। আমার বাবা যে পাওয়ার স্টেশনে কাজ করতেন, সেখানের শীর্ষ দুয়েকটি আর ছোট কয়েকটি পদ ছাড়া বাকি সবই বিদেশি। বেদুইন লিবিয়ানরা তখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বিদেশীরা তাদের দেশটি গড়ে দিচ্ছে। অদ্ভুত এক দৃশ্য

লিবিয়া জীবন: ৮

বছরে হাতে গোনা কয়েকদিন বৃষ্টি হতো মুসরাতায়। দিনের বেলা বৃষ্টি নামলেই ক্লাসরূম থেকে বেরিয়ে যেতো ছেলেমেয়েরা, বেরিয়ে আসতেন শিক্ষকরাও। সবাই মিলে ভিজতেন। অফিসের কাজকর্ম রেখে ভিজতেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। সে কি উল্লাস। তখন কখনোই মনে হতো না, এই বৃষ্টিকেই আমি একদিন বিরক্তিকর বলবো। ঢাকায় বৃষ্টি নামলেই সেই বিরক্তি আর দুর্ভোগ।

বৃষ্টি না নামলেও, শহরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অসংখ্য কৃত্রিম ঝর্না। বাবা বলতেন, তেলের বিনিময়ে ওরা পানি কিনছে। ওরা কল্পনাও করতে পারবে না-- আমাদের দেশে কত পানি। লিবীয়রা যখন বাবাকে বলতেন তোমরা গরীব দেশ থেকে এসেছো. মিসকিন! তখন বাবা জবাব বেশ কৌশলে জবাব দিতেন। বলতেন, তোমাদের দেশের সবাইকে বাংলাদেশে এক মাসের জন্য দাওয়াত দিলাম। ৩০ লাখ মানুষকে মেহমান করে রাখতে ঢাকা আর চট্টগ্রামের পরিবারগুলোই যথেষ্ট, সারা দেশ লাগবে না। এবার আমরা আসি তোমাদের দেশে। ১২ কোটি মানুষকে রাখতে হলে মাথাপিছু তোমাদের প্রত্যেকের ঘাড়ে পড়বে ৪০ জন করে। প্রতি পরিবারে এক মাস খাবে গড়ে দেড় শ জন। যতোই তেল উঠাও, ১২ কোটি মানুষের এক বেলা গোসল করানোর মতো পানির যোগানও তোমরা দিতে পারবে না।

লিবিয়া জীবন: ৯

রাত ৩টায় পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের বিমানটি জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়ে ছুঁলো। এরশাদ সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছেন। সামরিক শাসন চলছে। আর ৬ বছর বয়সে আমার প্রথম বাংলাদেশে আসা। গভীর রাত বলে বাবা-মা বের হতে রাজি হলেন না। হিন্দি সিনেমার বদৌলতে ডাকাত সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা ছিল। এবার ডাকাতির ভয় পেলাম। রাতে এয়ারপোর্টের এমাথা-ওমাথা দৌড়ে বেড়াচ্ছি আমরা দুই ভাই। হঠাৎ কাচের দরজার বাইরে চোখ দিয়েই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো আমার ছোট ভাইয়ের। দৃশ্যটা দেখে আমিও নির্বাক, রাস্তায় একটা মানুষ ঘুমিয়ে আছে। মাথার নিচে ইট। সেকি! মানুষ রাস্তায় ঘুমায় কেন? ঘরবাড়ি নাই! নানা প্রশ্ন উকি দিচ্ছে মনে। ছোট ভাই দৌড়ে গেলেন বাবা-মাকে ডাকতে। মনে পড়ছে, লিবিয়ায় বেদুইনদের ধরে ধরে, তাবু থেকে টেনে হিচড়ে বহুতল ফ্ল্যাটে উঠিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। আর এখানে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকে মানুষ।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যতোই বাংলাদেশ দেখছি, ততোই অবাক হচ্ছি আমরা। বাসায় বাবা লুঙ্গি পড়তেন। আর দেশে ঘরে-বাইরে সব জায়গায়ই মানুষ লুঙ্গি পড়ে। লিবিয়ার ফিলিস্তিনিদের মতো দেশজুড়ে ভিক্ষা করছে লাখ লাখ মানুষ। ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার পথে বাবাকে দেখলাম স্টিমারের টিকেটের জন্য বাড়তি কিছু টাকা দিচ্ছেন। জানলাম, ওটা ঘুষ। আরও মজার ব্যাপার ঘটলো নদী দেখে। ছোট ভাই বলতে লাগলো, পিচ্চি সমুদ্র। বাবা বললেন, পানি খেয়ে দেখ। একটুও নোনতা না। আমিতো পানি খেয়ে অবাক। নীল নদের চেয়ে অনেক মিষ্টি কীর্তনখোলার জল।

লিবিয়া জীবন: ১০

দুই মাসের ছুটি কাটিয়ে আবারও আমরা লিবিয়া ফিরছি। সোশ্যালিস্ট লিবিয়ান এয়ারলাইন্সে কোনও ক্লাস বিভাজন নাই। সবচেয়ে পেছনের সিট থেকেও ককপিটের দরজা দেখা যায়। এয়ার হোস্ট্রেসররা বেশিরভাগই মিশরীয় আর লেবানিজ। ইউরোপীয়ানও ছিলেন কেউ কেউ। মিশরীয়দের সুবিধা ছিল তারা আরবি আর ইংরেজি, দুই ভাষাই বলতে পারতো। যে কারণে লিবীয় বা বিদেশী সবার সঙ্গেই তাদের যোগাযোগ ছিল। আমার মা-ও আরবি শিখেছিলেন এক মিশরীয় মহিলার কাছে।

সম্ভবত বর্ধমানে সেটেলড ইলিয়াস বা লন্ডনে সেটেলড রহিম আংকেলকে দেখেই বাবার দেশপ্রেম চাঙ্গা হয়েছিল। একটা কানাডীয় কোম্পানির অফারও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সব সময়ই চাইতেন, আমরা, তার সন্তানরা দেশেই সেটেলড হই। মুক্তিযোদ্ধা আর আওয়ামী লীগের অন্ধ ভক্ত এই মানুষটি যে কারণে আমাদের দেশের বাইরে যাওয়ার সব পথই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। লিবিয়ায় অবস্থানের কোনও কাগজপত্র নেই আমাদের দুই ভাইয়ের। দুজনকেই ক্যাডেট কলেজে পড়িয়েছেন। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করার সব চেষ্টাই করেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি কি না বা পারবো কি না-- তা জানা নেই।তবে দেশেই রয়ে গেলাম।

কাগজপত্র না থাকলেও স্মৃতিটা রয়ে গেছে খণ্ড খণ্ড। বাবা লিবিয়ার মাটিতে বসেই আমাদের বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর চেষ্টা করতেন তিনি। মা নিজের হাতে আদর্শলিপি লিখেছিলেন আমাদের বাংলা শেখানোর জন‌্য। মাতৃভাষার আগাগোড়া আমার তার কাছেই শেখা। বাংলাদেশ থেকে ফেরার পথে আমাদের জন্য প্রথম থেকে ৫ম শ্রেণীর বই কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিধিবাম। ত্রিপোলি বিমানবন্দরে রাজনৈতিক বই সন্দেহে সেগুলো আটকে দিলো লিবিয়ার কাস্টমস বিভাগ। মা আরবিতে বোঝালেন, তোমরাও নিশ্চয়ই চাও না আমার ছেলেরা তোমাদের দেশে থাকুক এবং বিয়ে করুক। এতে তোমাদেরই ক্ষতি। কালচার নষ্ট হয়ে যাবে। হুমকির মুখে পড়বে আরব জাতীয়তাবাদ। এরপর কোমড়ে পিস্তল গোজা ওই কাস্টমস কর্মকর্তা ডেকে আনলেন তাদের বসকে। ভাগ্যিস, বস মিশরীয় ছিলেন। তিনি কাহিনীর কিছুটা বুঝলেন। তবে তিনি মাকে প্রশ্ন করলেন, বইগুলো শিশুদের হলেতো আরও কালারফুল হওয়ার কথা, নিউজপ্রিন্টে ছাপা হওয়ার কথা না। মা জবাব দিলেন, গরীব দেশতো। তাছাড়া শিক্ষার খরচটা বাংলাদেশে সরকার দেয় না। অভিভাবকদেরই বইগুলো কিনতে হয়। এক ইন্ডিয়ান পুলিশ কর্মকর্তা, শ্রীলংকান ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আর ওই মিশরীয় কাস্টমস কর্মকর্তা প্রায় ৩ ঘণ্টা নানা গবেষণা করেবইগুলো ছাড়লেন। বাঙালি কমিউনিটিতে ওই বইগুলো যে কতোবার ফটোকপি হয়েছে, তার হিসেব নেই।

বারান্দায় আলো-ছায়ার খেলায় বাবা ছবিটা তুলেছিলেন!

লিবিয়া জীবন: ১১

সৌদি আরবের 'কাইফা হালুকা' লিবিয়ায় এসে হয়ে গেল ‌'কিফা আলাক‌‌‌‌‌'। বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় 'ক্যামন আছেন'। নোয়াখাইল্যাদের সঙ্গে যেমন বরিশাল্যাদের ভাষার অমিল, ঠিক তেমনি সব আরব দেশগুলোর আরবিও এক নয়। ডায়ালেক্টের ভিন্নতা আছে। আরবিতেও বাংলার মতো বিদেশী ভাষার অনুপ্রবেশ আছে। কিয়া আলাকের উত্তর হলো, কোয়েস্ত। তবে ত-এর উচ্চারণটা উহ্য থাকবে। কোয়েস-এর মতো শোনায়। এটা ইতালিয়ান শব্দ। অর্থ: দারুন। সৌদিরা এর উত্তরে বলবেন, আলহামদুল্লাহ। ইরাক থেকে মরোক্কো-- বিশাল আরব জাহানে আঞ্চলিক ভাষার তারতম্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার সব আরব দেশগুলোর ইতিহাসও এক ধাঁচের নয়। উপনিবেশের ধরণও ছিল আলাদা।

নিরোদ সি. চৌধুরীকে আমি মোটেই পছন্দ করি না। তার ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এরপরও বলবো-- ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্য ব্রিটিশরাই অপেক্ষাকৃত ভালো। নিজেদের প্রয়োজনে হলেও এরা আমাদের দেশে শিক্ষা আর যোগাযোগের অবকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। ফরাসিরা আফ্রিকায় গিয়ে সেটাও করেনি। শুধুই শোষণ করেছে। এখনও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে ফ্রেঞ্চ ভাষার দাপট। নামেমাত্র কলোনি গুটিয়েছে তারা। ব্যাংক থেকে শুরু করে অনেক প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর এখনো প্যারিসে। আইভোরিকোস্ট, সেনেগাল বা কঙ্গো-- কালো আফ্রিকানদের দেশগুলোর সমস্যা এখনও জিইয়ে রেখেছে ফ্রান্স। শাসক হিসেবে ইতালিয়ানরা আরও খারাপ। লুট-পাট-ছিনতাই-ই ছিল তাদের শাসনের একমাত্র মাধ্যম। মুসরাতাসহ লিবিয়ার শহরগুলোতে গির্জা বানিয়ে রেখেছিল, তবে ধর্মপ্রচার চালায়নি। খ্রিষ্টপূর্ব ১১শ' সালে খোমস-এ ভূমধ্যসাগরের তীরে প্রকাণ্ড এক গোলাকার মঞ্চ বানিয়েছিল রোমানরা। কালক্রমে গোটা দেশটাকেই নাটকীয় মঞ্চ বানিয়ে ছেড়েছে তারা। হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় পরিত্যাক্ত হয়ে যায় রোমান সাম্রাজ্যের অভিজাত নগরী লেপটিস মাগনা। সেই লেপটিস মাগনাই আজকের খোমস। শহরটির নন-মুসলিম, সাম্রাজ্যবাদী পুরাকীর্তিগুলো অবশ্য বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই সংরক্ষণ করেছে গাদ্দাফি প্রশাসন।

লিবিয়া জীবন: ১২

৩ হাজার বছর পুরোনো শহর লেপটিস মাগনার ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা আমাকে বললেন, এটা ছিল এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাজার। কায়রো থেকে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল ধরে ব্যবসায়ীরা আসতেন এখানে। আমাকে বোঝানোর জন্য বাবা বললেন, মুসরাতার সুক-তালাতার চেয়েও বড় বাজার ছিল এটি। সুক-তালাতা, আমাদের বাড়ির কাছের একটি বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। তবে ওখানে আগোরা বা মীনা বাজারের মতো অতো ভিড় নেই। কর্মী সংখ্যাও কম। তিউনিশিয়ার পিচ্চি পিচ্চি মেয়েরা কাজ করতো। কাউন্টারে মিশরীয়রা। এদিক-ওদিক ফাঁকা দেখে একবার এক প্যাকেট সিগারেট চুরি করেছিল এক বাংলাদেশী শ্রমিক। সিসিটিভিতে ধরা খেয়ে ১ বছরের জেল হয়েছিল তার। যে প্রযুক্তি এখন ঢাকাকে আধুনিক করছে, ৩০ বছর আগেই তা আমি দেখে এসেছি মুসরাতায়।

লেপটিস ম্যাগনা এখন পতিত শহর। পাশেই গড়ে উঠেছে খোমস। একটি ছিমছাম আধুনিক শহর। এই শহরেই আমি জীবনে প্রথম খাল দেখি। সাগরের পানি লবনমুক্ত করে চলতো একটি সেচপ্রকল্প। সেই প্রকল্পেই খালের মতো নালা। ভূম্ধ্যসাগরীয় ফল আর শাকশবজির আবাদ হতো মাইলের পর মাইল ক্ষেতজুড়ে। ভারতীয় আর বাংলাদেশীরাই মূলত এই ক্ষেতগুলোতে কাজ করতো।

জাহিদ আংকেল একটি শিপিং ফার্মে কাজ করতেন। তার কাজ ছিল, সাগরের মাঝে জাল ফেলা আর ওঠানো। তবে যন্ত্রের বদৌলতে কায়িক শ্রম অতোটা ছিল না। মাসের পর মাস তাকে ভূমধ্যসাগরেইথাকতে হতো। যা হোক, নিজিকে একটি শিপিং কোম্পানির ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে বিক্রমপুরের এক বনেদি পরিবারে বিয়ে করলেন। নিজে ইন্টারমিডিয়েট পাস হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ পাস করা মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের পরই ফাঁপড়ে পড়লেন তিনি। বউ লিবিয়ায় আসতে চায়। তারও বউ আনার সুযোগ আছে। তবে সমস্যা অন্যখানে। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা বউটি জেনে যাবেন, তার স্বামী নিতান্তই এক জেলে।

লিবিয়া জীবন: ১৩

একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেক লোক ভীড় করেছে আমাদের বাসায়। মা কাঁদছেন। শোকে পাথর হয়ে গেছেন বাবা। আমাদের বোনটাকে নিয়ে আসেননি মা। জন্মের মাসখানেকের মধ্যেই মৃত্যু হয় রীমার। চেহারাটা অল্প একটু মনে আছে। এক ঝলক। ধবধবে লালচে ফর্সা। নিজের চুল টানতো আর কাঁদতো। পরে এ একটা সমস্যায় যেন তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। ওই শেষ দেখা। আর কোনও দিন দেখা হবে না রীমার সাথে। বাবা-মাকে কোনওদিন জিজ্ঞাসা করিনি, রীমার কি হয়েছিল। রীমাকে মুসরাতা সেন্ট্রাল হাসপাতালের কাছেই কোনো এক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল। আমরা দুই ভাই এতোই ভেঙে পড়েছিলাম যে, দাফনের সময়ও আমাদের সঙ্গে নেয়া হয়নি।

এবারের গৃহযুদ্ধে সেই সেন্ট্রাল হাসপাতালেও গোলা বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শুনেছি, মুসরাতা এখন গণকবরের নগরী। তবে আমার বোনের কবরটা সম্ভবত এখনো আছে। তিরিশ বছর আগের এক বাংলাদেশী শিশুর কবর। আমার বোনের কবর। খুব যেতে ইচ্ছা করে!

লিবিয়া জীবন: ১৪

মাখরুনাই ছিল শৈশবে আমার প্রিয় খাবার। অনেকদিন পরে ২০০৩/০৪-এর দিকে দেখলাম সেটাই ইতালিয়ান প্যাটেন্ট পেয়েছে ম্যাকারনি নামে। তাহলে দুর্গম মরুদ্যানগুলোতে কিভাবে কয়েক শ বছর ধরে মাখরুনার চল, আমার মাথায় আসে না। লিবিয়ায় ইতালিয়ান উপনিবেশ কিন্তু উত্তরের উপকূলীয় এলাকাগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশাল সাহারা মরু পেরিয়ে রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা ইতালিয়ানরা করেনি। মিশর, আলজেরিয়ায় যা করেছিল ফ্রান্স। যা হোক, উপনিবেশবাদ যে আক্ষরিক অর্থেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর খাবার ছিনতাই করতে পারে, তা শিখলাম মাখরুনা দেখে।

কুসকুসি-ও দারুণ টেস্টি। সুজি তেলে ভেজে এক ধরনের হলুদ খাবার। আরও ছিল এক ধরনের রুটি, খুবজা। বেকারিগুলোতে আশরা গুরুশ-এ (১০ পয়সায়) ৪টা খুবজা পাওয়া যেত। নিচতলায় মিশরীয় মহিলা জামালাতের গোটা দশেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমি কুসকুসি খেতাম। আমাদের দেশে গরুরে খড় খাওয়ার সেই প্রকান্ড পাত্র চারি'র মতো সাইজের একটা বউলে অনেক কুসকুসি দিতেন জামালাত। ওটার চারপাশে বসতাম আমরা। সবার হাতে চামচ। সবাই একসঙ্গে খাচ্ছে একপাত্রে। ডাল-মাছ-মাংস-ভাত মিশিয়ে তবলিগি খাওয়ার মতো ঘেন্না লাগার সুযোগ নেই শুকনো শুকনো কুসকুসিতে। অদ্ভুত এক দৃশ্য। একটায় আরেকটারে খাওয়ায় দিচ্ছে। একটা আবার আরেকটার চামচে বাড়ি দিচ্ছে। তবে চামচের যুদ্ধ ছিল এই খাওয়ায় সবচেয়ে বড় পাপ। জামালাত নামের দৌত্যের মতো বিশাল মহিলাটি ভীষণ রাগতেন তখন।

গরুর মাংসের ঝোলে ডুবিয়ে খুবজা খেতাম বাসায়। আর বাঙালি বাবা-মা অবশ্য ভাতেই ঢুবে থাকতেন। শ্রীলংকা থেকে প্যাকেটজাত চিংড়ি আসতো। চিংড়িগুলো কালো কালো বিশ্রি ‌দেখতে হলেও বেশসুস্বাদু। একবার ঘানা থেকে ২ জাহাজ কলা এসেছিল। খবর পেয়ে সুক-তালাতায় লম্বা লাইন। মাথাপিছু এক ডজন করে কলা বিক্রি হয়েছিল। শুনেছি কলার লাইনে মারামারির ঘটনাও ঘটেছিল। এরপর অনেক দিনের জন্য কলা আমদানি বন্ধ ছিল লিবিয়ায়।

নাকবোচা কোরিয়ানরা নাকি মানুষ খায়-- গুজবটা খুবই বিশ্বাস করতাম শৈশবে। কোরিয়ান শ্রমিকরা নাকি এক পাগড়িওয়ালা ইন্ডিয়ান শিখকে জবাই করে খেয়েছে। কোরিয়ানদের ফ্রিজে নাকি ওই শিখ ব্যাটার রানও পাওয়া গেছে। এমন উদ্ভট সব তথ্য। পার্কে, মাঠে-ময়দানে কোরিয়ান দেখলেই ভো দৌড়!

লিবিয়া জীবন: ১৫

ওয়েস্ট ইন্ডিজে ভারতবর্ষ থেকে যে হারে আখচাষী নিয়েছে ব্রিটিশরা, সে তুলনায় মরুভূমিতে চাষে চাষে সবুজ লিবিয়া গড়তে ভারতীয়রা কমই গেছে। এর অন্য একটি কারণও অবশ্য আছে, সাহারা মরুভূমিতে আরও সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়। এবার যুদ্ধেও সেই কালো আফ্রিকানদেরই ভাড়া করেছিলেন গাদ্দাফি। বড় ভাই দেশটার জন্য সবই করেছেন, তবে জাতিকে রাজনীতি সচেতন করতে পারেননি। ইরাক-আফগানিস্তানের মতো জ্বলন্ত উদাহরণের পরও পশ্চিমাদের ফাঁদেই পা দিল লিবীয়রা। নৃতাত্ত্বিকভাবে খণ্ড খণ্ড সত্ত্বা নিয়ে বেড়ে ওঠা একটা বেদুইন জাতিরাষ্ট্র লিবিয়া। এর ওপরই সেকুল্যার আরব ন্যাশনালিজম চাপিয়ে দিলেন গাদ্দাফি। সঙ্গে আধখানা কমিউনিজম। সব মিলিয়ে গ্রিনবুক। আক্ষরিক অথবা আন্তরিক, দুদিক দিয়েই ত্রিপোলি ও বেনগাজির হাজার মাইলের দূরত্ব। ৪ দশকের লৌহ শাসনে গ্রিনবুক নিঃসন্দেহে কাজে দিয়েছে।

গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়া কি তবে ভাঙতে বসেছ? যুদ্ধ চলাকালে তেরঙ্গা পতাকা দেখে আমারও এমন সন্দেহ হয়েছিল। গাদ্দাফিকে হঠাতে না পারলে অবশ্য হয়তো সেপথেই হাটতো ন্যাটো। যাক, গাদ্দাফির বিদায় লিবিয়ার মানচিত্র আরো কিছুদিনের জন্য অখণ্ড রাখছে তাহলে।

ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল কি তবে নেমকহারামের দল? মোটেই না। গাদ্দাফির পুলিশি শাসন তাদের স্বাধীনতার স্পৃহা উসকে দিয়েছে। মুসরাতার মুহাম্মাদের মতো যারা রাষ্ট্রযন্ত্রে স্বজন হারিয়েছেন, তারাই তেরঙ্গা পতাকা মাথায় বেধে অস্ত্র তুলেছেন। তবে যাই হোক, উপনিবেশের মধ্যেই যেভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে আফ্রিকার রাজনীতি। লিবিয়া আপাতত স্বাধীন হচ্ছে না।