সত্যিকারের কবির জন্য সিন্ডিকেশন-টেশন লাগে না: শিমুল সালাহ্উদ্দিনের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Aug 2, 2012 6:41:01 AM

প্রকাশিত বই: শিরস্ত্রাণগুলি, সতীনের মোচড়

দুপুর মিত্র: আপনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন অনেক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। এই সব আন্দোলন থেকে আপনার শিক্ষা কি?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সরাসরি উত্তরে যাবার আগে আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই সাক্ষাৎকারভিত্তিক ‘অলসদুপুর’র এই উদ্যোগটির জন্য। এই প্রথম আমি এমন সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, এ সুযোগটি তৈরি করে দেবার জন্যও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আক্ষরিক অর্থেই আমার দ্বিতীয় জন্মের আঁতুরঘর। আমার সত্যিকারের লাল ছেলেবেলা। একজন সামাজিক মানুষ হয়ে ওঠা, কবিতাই লিখব,পড়ব, এটাই জীবনের ব্রত কিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে নেবো এবং তাকে বাস্তবায়ন করবো এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়তো হতো না জাহাঙ্গীরনগরে পা না দিলে। আমি মোটামুটি ফেরে চক্রে পড়ে পড়তে গিয়েছিলাম জাহাঙ্গীরনগর। জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট ও আবৃত্তিসংগঠন ধ্বনি’র কর্মী হিসেবে কাজ করেছি দীর্ঘ সাত বছর। তার মধ্যে চারটি আন্দোলন। তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী, গোলাম মুস্তাফা, জানোয়ার হোসেন স্যরি সানোয়ার হোসেন সানী, এই তিনটা নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন। আন্দোলনগুলো আসলে তার ছায়তলে দাঁড়িয়ে থাকা সকল কর্মীকেই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে। কর্মীদের জীবনাচরনকে একধরনের আকার দেয়। ক্যাম্পাসে আমার বেড়ে ওঠার সামগ্রিকতায় কিছু অসাধারণ মানুষ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের বেশিরভাগই এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রেই আমার নিকটবর্তী হয়েছেন বা আমি তাদের নিকবর্তী হয়েছি। রফিক স্যার, সেলিম স্যার (কবি মোহাম্মদ রফিক, নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীন), মানস স্যার এর আগেই যাঁদের কথা আসবে তাঁদের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। কবি রায়হান রাইন, মাদল হাসান, শুভাসিষ সিনহা’র শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেলেও আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি তখনো তাঁদের যাতায়াতটা আছে। আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচের পিয়াস মজিদ, মেহেদী রাসেল, নওশাদ জামিল,রাহেল রাজীব মণ্ডল, ইফতেখার ইনান, তাদের থেকে একটু সিনিয়র রাশেল শাহরিয়ার, ফয়সাল রহমান কিশোর, রাসেল মৈতালী, আপনি দুপুর মিত্র, বাংলার দুই সুমন ভাই (ফারুক সুমন, সুমন সাজ্জাদ) সহ কবিদের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ ছিল তখন। আমার ব্যাচে আমি পেলাম গৌতম কৈরী, দিবাকর মজুমদার, মেহেদী হাসান, সাদিকা রুমন, ইমরান কামাল, রহমান জর্জি, তৌহিদুল ইসলামদের। এবং এঁদের প্রায় সবাই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। আয় তবে বেঁধে বেঁধে থাকিটা অনেক বেশি তাই রাস্তায় রাস্তায়ই হয়েছে। স্লোগানে, প্রতিবাদে, মুক্তমঞ্চের নাটক কিংবা আবৃত্তি প্রযোজনায়। কবিদের কেউ কেউ নিরব থাকলেও সমর্থনটা থাকতো আন্দোলন সংগ্রামে। প্রথম বর্ষেই ভাসানী হলে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়ে আমার বিভাগের বড় ভাইরা পাঠালো কবি সুমন সাজ্জাদের কাছে র‍্যাগ দিতে আমাকে। তিনি তখন প্রায় মাস্টার হয়ে হল ছাড়বেন ছাড়বেন করছেন। তিনি আমাকে র‍্যাগের বদলে পড়তে দিলেন আহমদ ছফার অলাতচক্র। তো, এমনি মোহনীয়, দুর্দান্ত ছিলো সেই হলে হলে দৌঁড়ে কবিতা সংগ্রহ করে দেয়ালিকা কিংবা দ্বিতীয় বর্ষের দিকে ‘অস্তিত্ব’ মাসিক ভাঁজপত্রটি বের করার কাজ। আমার দুই সতীর্থ সাদিকা রুমন আর মেহেদি হাসানসহ আমি এটা শুরু করেছিলাম। পরে যুক্ত হয় আরো ইমরান, তৈমুর রেজা, মনিরুস সাব্বিন। আন্দোলন তো জাহাঙ্গীরনগরের সংস্কৃতিরই অংশ। এটিই একমাত্র ক্যাম্পাস এখনো যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রায় সব রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। তো চারটি বড় আন্দোলন আমাকে মানুষ, মানুষের মোটিভ, আক্রান্তের ক্ষরণ ও বেদনার সাথে যুগপৎ মোহন ও বীভৎস জীবনের দিকগুলোকে চিনিয়েছে। কিছু মানুষের অসাধারণ বক্তৃতা এখনো আমার কানে লেগে আছে। তৈমুর খুব ভালো কথা বলতো। কিন্তু বন্ধুত্ব আমাকে দিয়েছে আন্দোলন। যেমন, তৈমুর রেজা, আতিউর রহমান ফারুক, তামান্না আরা, সাদিকা রুমন। এদের বাইরে,আমার দ্বিতীয় বর্ষে দেখা হলো কবি নির্লিপ্ত নয়নের সাথে। সে পড়তে এসেছে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। সেলিম স্যার তার জন্যই আলাদা এক কোটা খুলে তাঁকে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। তো, জাহাঙ্গীরনগরে সে সময় পর্যন্ত লেখক কবিদের এই চরম অভ্যর্থনার বিষয়টি ছিলো।শিমুল ভাই, শিমুল ভাই বলা কবি নয়ন আমার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠলো। আমি, তৈমুর,নয়ন বেশ একটা ট্রায়ো হয়্যা ছিলাম বটতলাবাসীর কাছে দীর্ঘ সময়। পরে যেইটা সানি বিরোধী মুভমেন্টে আরো বাড়লো। দ্বিতীয় বর্ষের প্রথমদিকেই আমি বেশ ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ হয়ে উঠলাম। ধ্বনি, সাংস্কৃতিক জোট, কবিতা এর সাথে নৃবিজ্ঞান বিভাগ। বটতলায় ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা, সংগঠনের জন্য কর্মী সংগ্রহ, তাদের সাসটেইন করানো…আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, রাত তিনটায় রুমে ফিরে পড়াশুনা লেখালেখি নিয়ে বসা, তো জাহাঙ্গীরনগর না হলে আসলে আজকের আমি হয়তো অন্য রকম হতাম। শিক্ষার আসলে শেষ নাই জাহাঙ্গীরনগরের আন্দোলন থেকে…এটা বললে একটা বিশাল স্মৃতিকথা হয়ে যাবে…রাইসুদা বলে রেখেছে, লিখবো হয় তো কোনদিন। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী, আন্দোলনকারী, কবি হিসেবেই এরপর বিভিন্ন মাধ্যমে (চিঠি, মেইল, ফেসবুক) আমার সাথে কথা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রজ অনেকের সাথে। সুমন রহমান, কফিল আহমেদ,মাহবুব পিয়াল এই তালিকায় থাকবেন যারা আমাকে প্রেরণা দিয়েছেন। মজনু ভাইয়ের (মজনু শাহ)সাহচর্য পাওয়া এক সন্ধ্যার কথাও বলতে হবে। বলতে হবে। আর আলাদা করে বলতে হবে কবি সাদিকা রুমনের কথা,যে বিষণ্ন এক ছেঁড়া ঘুড়ি হয়ে কই থাকে জানিনা আমি এখন।তো আন্দোলন সংগ্রাম তো্ এই সবাইকে জড়িয়েই, সবকিছু জড়িয়েই। এই সব মানুষ, জাহাঙ্গীরনগরের প্রকৃতি, বটতলায় রাজ্জাক ভাইয়ের খারাপ রান্না আর জব্বারের চা সিগারেট...এ সবই গড়ে তুলল আমাকে। আন্দোলন মানেই হাজারো মানুষের মুখ, কত কত মুখ যে মনে পড়ে যাচ্ছে দুপুরদা, স্যরি…বাদ দেই…এসব শিক্ষার তো শেষ নাই…

দুপুর মিত্র: আপনি কবি ও আবৃত্তিশিল্পী দুটিই। কেউ কেউ এই দুইকে বিরোধী জায়গা থেকে দেখেন। আপনি কিভাবে দেখছেন।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কাব্য ও আবৃত্তি দুটি আলাদা শিল্পকলা। দুটির মধ্যে বিরোধ নাই, বরঞ্চ ঐক্য আছে। আবৃত্তিশিল্প মূলত কবিতানির্ভর।আবৃত্তি করতে হলে আপনার ভালো উচ্চারণ জানা দরকার, বাচনভঙ্গি দরকার, কণ্ঠ দরকার, কবিতা তো ভালোলাগা ভালোবাসার ব্যাপারই। জীবনে জীবনাচরনে ধারণ করার ব্যাপার। সেক্ষেত্রে আমার সংগঠন ধ্বনি আমাকে সাহায্য করেছে কবিতায় আমার আশ্রয় খুঁজে পেতে। যারা এই দুটিকে বিরোধী জায়গা থেকে দেখেন তাদের আমি মূর্খ জ্ঞান করি। ‘কবির কবিতা পাঠ’ নামে একটা অনুষ্ঠান আমি করতাম জাহাঙ্গীরনগরের জহির রায়হান মিলনায়তনে নিয়মিত। আমার শিক্ষাজীবনের শেষদিকে। ‘অস্তিত্ব’র আয়োজনে। আপনার মনে থেকে থাকবে। ধ্বনি’র ও এমন একটা আয়োজন ছিলো। বাৎসরিক। যেখানে ক্যাম্পাসের সব কবিদের ডাকা হতো। কেবলমাত্র সে অভিজ্ঞতা না, আমাদের অনেক সিনিয়র কবির কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান আমি সরাসরি এবং টিভিতে দেখেছি। এমনকি নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, এবং শামসুর রাহমান ভুল উচ্চারণে কবিতা পড়েছেন। ২০০৪ এর দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিজয় দিবসের একটা অনুষ্ঠানে আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে আমি কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম। সেখানে তিনজন কবিও ছিলেন, তাদের উচ্চারণ ছিলো মারাত্মক। স্টুডিওর লোকজন ভুল উচ্চারণে কবিতা টেক করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে বলছিলেন “উনারা কবি!”। তো একজন কবি যদি ভালো করে নিজের কবিতাটি না পড়তে পারে তবে তিনি ভালো কবিতা কিভাবে লিখবেন তা আমার মাথায় আসে না। কারণ আমার কাছে কবিতার খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মনে হয় প্রত্যেক শব্দের যে নির্দিষ্ট শ্রাব্যত, টোনাল কোয়ালিটি তাকেও। মানুষ যেভাবে বলে কান তার নিজের কান সেভাবে অভ্যস্ত হয়। বাংলা ভাষার একজন কবির জন্য তাই বাংলা ভাষা ঠিকভাবে তিনি বলবেন, ঠিকভাবে উচ্চারণ করবেন এটাকে আমি ফরয মনে করি। আর কবিতা পত্রিকায় পড়বার জন্য নয় কেবল, তা পাঠ করার, উচ্চকণ্ঠে পাঠ করার বিষয় বলেই আমি মনে করি।

দুপুর মিত্র: বাংলাদেশে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার সহজ রাস্তা কোনটি?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কোন সহজ রাস্তা নাই। একটাই রাস্তা। একমাত্র রাস্তাটা হলো ভালো কবিতা লেখা। জীবনকে কবিতার জন্যই তৈরি করা। জীবনের সমস্ত উপাদান কবিতাবউকে মাথায় রেখে সাজানো। শিল্পের শর্টকাট কোন ওয়ে নাই, আছে মরণের।

দুপুর মিত্র: যে কোনও প্রতিষ্ঠান বা ক্ষমতাশীল ব্যবস্থার মত কবিতা-শিল্প এসব ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট রয়েছে। আপনিও কি তাই মনে করেন? মনে করলে এই সিন্ডিকেটগুলো কেমন?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দেখেন দুপুরদা, সকল কলার মতোই কাব্যকলাও গুরুমুখী বিদ্যা। তো কেউ গুরু’র ছায়াতল থেকে প্রস্তুতিপর্বের পর নিজের পথ আবিষ্কার করে নেয়, আর কেউ পারে না। আমি খুব কাছ থেকে সাহচর্য পেয়েছি কবি মোহাম্মদ রফিকের এবং নাট্যকার সেলিম আল দীনের। প্রথম মানুষের সামনে আমাকে কবিতা পড়তে প্রায় বাধ্য করেছেন কবি রায়হান রাইন। মাদলদা এক সারারাত আমাদের তিন তরুণের কবিতা শুনেছেন। জাহাঙ্গীরনগরের কাব্যিক এই পরিসরের আরো অনেকের কথা আমি প্রথম প্রশ্নেই বলেছি। ক্যাম্পাসে আমি অনেক বেশি আভ্যন্তরীন বিষয়াদি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ঢাকা আসা হতো না। আমার সমসাময়িক পিয়াস ভাই, নওশাদ ভাই ঢাকায় যাতায়াত করতেন। তো এ নিয়ে একদিন রফিক স্যার বললেন, ওরা তো যায়, সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ হয়, তুমি যাও না কেন? আমি বলছিলাম, স্যার, আপনে তো বলেন নাই, আমার কিছু হয়! তো স্যার আমার কথা শুইনা হাসছিলেন, প্রশ্রয়ের হাসি, আমার মনে হইলো আমি যে যাই না, কাউকে ছাপতে দেই না নিজে থেকে স্যার এইটারে পছন্দ করতেছেন। তার কয়েকদিন পর কইলেন, কখনো কেউ না চাইলে কবিতা দিবা না, এইটা আমি এখনো পালন করি, সবসময় করবো। আপনি যেই সিন্ডিকেশনের কথা কইলেন আলটিমেটলি তার লগে আমার পরিচয় নওশাদ ভাই পিয়াস ভাইয়ের আর নয়নের (কবি নির্লিপ্ত নয়ন) গুজুর গুজুর থেকে। তো একসময় ক্যাম্পাসে যেহেতু কবিতা নিয়া কাজ করি, ঢাকা থেকে আমার রুমে কবিরা আসা শুরু করলো। এবং বিভিন্ন রকম এজেন্ডা নিয়ে। অমুক খান ভালো কবি, অমুক ভাই কইছে এইসব আর কি! তো এইসব নিয়া রফিক স্যারের সাথে কথা কইলাম, স্যার কইল দেখছো তো, তুমি ঢাকা যাও নাই বিষয়টা আমার পছন্দ ছিল, এখন দেখো ঢাকাই তোমার কাছে আসে।

কিন্তু এই ঢাকা আমার কাছে আসা বিষয়টা খুব প্যাথেটিক হইয়া দাঁড়াইলো, যখন উক্ত কবিগণ আমার ধারণায়নের সাথে মিলাইতে পারলেন না নিজেদের। কিংবা আমি তাদের। তারা দেখলেন তারা বামে কইলে আমি ডানে হাঁটি, আর ডানে কইলে বামে, ফলে তারা তখন কাব্যস্বাতন্ত্র্যের পথ ধরলেন। পরে দুয়েকদিন বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের সাথে মদ্যপান করছি,পিককে বইছি,ওদের টাকায় খাইছি, কথা কইছি, কিন্তু আসলে যেই আমি সেই আমি। আমার মনে হইছে, সত্যিকারের কবির জন্য সিন্ডিকেশন টেশন লাগে না। আর একসময় দেখলাম এইসব তো প্রকাশিতই, কেউ বলে না, জানে সবাই। তো আমি ইদানিং এইসমস্ত কবিদের থেকে আরো দূরে থাকার চেষ্টা করি। শিল্পীর পথ নির্জন, একলার, আমি এইটা কায়মনোবাক্যে মানি। আর শিল্পী হবার প্রাথমিক শর্ত আমার কাছে “ভালো মানুষ’’ হওয়া। ভালো মানুষ সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে একজনরে ছোট কইরা আরজনকে বড় করতে পারে না। ভালো মানুষের জাজমেন্ট তো ভালো হবে, সৎ হবে, মেকি হবে না।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: নব্বই এ যাঁরা তাদের মধ্যে যাঁদের আমি কাছ থেকে দেখছি তার সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ নব্বই তো গড়ায়া শূন্যে চইলা আসলো। আর শূন্যেও তো ঠিক শূন্যের লোকজন নাই। এখন দেখি আবার প্রথম দশকের অবস্থান নিয়া কাড়াকাড়ি। তো এইসব দশক নিয়া কখনই আমার আগ্রহ ছিলো না, নাইও। শূন্যের দুইটা সংকলনে আমার কবিতা আছে, তো যে সম্পাদক কবিতা চাইছে সে আমারে কয় নাই যে শূন্যের সংকলন করবে। দশক ওয়ারি সংকলন জানলে হয়তো দিতাম না। তবে গত বিশ বছরে অনেক ভালো কবিতা লেখা হইছে, অনেকেই আমার প্রিয় কবি আছেন। আর শূন্য বইলা যারে বলা হইতেছে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি লেখা হইছে জাহাঙ্গীরনগরে। পিয়াস মজিদ, নওশাদ জামিল, শিমুল সালাহ্উদ্দিন, নির্লিপ্ত নয়ন, মেহেদী রাসেল, রাহেল রাজীব মন্ডল, ইফতেখার ইনান..আর কত কমু! যদি ধরেন মাদলদা, মিঠুদা, গালিব ভাইরে বাদও দেই, তাইলেও… আর থাকে কি? কয়জন?

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এইটা একটা ফাচুকি প্রশ্ন দুপুরদা। ফারাক সোসাল কন্টেক্সটে। টোনে। ফারাক টাইম, স্প্যান সবকিছুতেই। এমনকি বানানেও। তবে প্রযুক্তির কারণে অনেক কিছু একই পাটাতনে আইসা যাইতেছে, আমার মনে হয় এই ফারাক কমতেছে। আমাদের আশির অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবির সাথে দেখবেন পশ্চিমবঙ্গের ৬/৭ এর দশকের কবিদের বেসিক জায়গায় মিল আছে, একই রকমের কথা কইতেছেন একইভাবে তারা। যাই হউক, সবচেয়ে বড় মিল তো হইলো পশ্চিমবঙ্গের কবিতাকেও কবিতা হইতে হয়, বাংলাদেশেরটাও। আর ধর্তব্য, একটা সময়ে দুইটা এলাকা মিলাই বাংলাদেশ আছিল। তো, বরিশালের কবিতা, রাজশাহীর কবিতার যে ফারাক, বাংলাদেশের আর পশ্চিমবঙ্গের কবিতার ফারাক…একই প্রকার বিষয় বইলা মনে হয় আমার…অগুরুত্বপূর্ণ…

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: অবশ্যই।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: নাহ, লিটলম্যাগ ব্লগের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্লগের কোন মানদণ্ড নাই, লিটলম্যাগের সম্পাদকেরা একটা নির্দিষ্ট মানকে দণ্ড ধরেই পত্রিকাটা করেন। লিটলম্যাগ তাই আরো অনেক বেশি বাইরানো উচিত।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: ট্র্যাশ। এন্ড ট্র্যাশ সেলস। মাঝে মাঝে এইটারে আমার একটা সিএসআর মনে হয়। এবং আমাদের কোন পত্রিকায় যোগ্য আধুনিক সাহিত্যমনস্ক সম্পাদক নাই। যে দু’একজন ছিলো তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে। তবে এইটা থেকে উত্তরণ সম্ভব, আমি যদি কোন সাহিত্যপাতার সম্পাদক হই, আর আমারে বেতনের বিনিময়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়।

দুপুর মিত্র: সাম্প্রতিক কবিতা থেকে আপনি কিভাবে নিজেকে স্বতন্ত্র হিসেবে মনে করেন?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সেইটা আমার দুইটা বই ‘শিরস্ত্রাণগুলি’(ঐতিহ্য,২০১০) আর ‘সতীনের মোচড়’(শুদ্ধস্বর,২০১২) পড়লেই টের পাওয়া যাবে। আমার কবিতার বয়ানভঙ্গি, বিষয়, ক্রাফটসম্যানশিপ, ছন্দের কাজ, প্যাটার্নিং, টোনালিটি পুরাপুরি আমার, আর সেইটা আসমান থেকে পড়া কোনকিছু না, আমাদেরই ভূগোলের, আমারই চারপাশের, আমার দেখার কথকতা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেইটা, গত তিনদশকে মানুষ এত অকবিতা পড়ছে, তারা প্রায় ভুইলাই গেছে ‘কবিতা’ কারে কয়। তো, আমার সহজ লেখাগুলারে আমি ‘কবিতা’ কই, কই বইলাই প্রকাশ করি। তো, একটা কবিতা পইড়া শেষ করেন আমার সাক্ষাৎকার, কবির সাক্ষাৎকার পড়বেন কবিতা পড়বেন না, এটা তো ঠিক না। এই কবিতার নাম “আধুনিক সাহিত্য বিষয়ে শোকপ্রস্তাব”

“আমার বিধ্বস্ত মুখ

রক্তরঙ মাটিতে রাঙানো

তবু জেনো,

বুকের ভেতরে সব গাঙ্

আমার সমস্ত নদী

মানুষের কংক্রিটেই বাঁধানো”

শুভেচ্ছা, সবার প্রতিটি মুহূর্ত সুন্দর হোক।