যেখানে বঞ্চনা আছে, দারিদ্র্য আছে আবার মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকাও আছে-কবিতা জন্মায় সেখানে : বিভাস রায়চৌধুরীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Nov 16, 2014 5:15:15 PM

 

প্রকাশিত বই:  সমস্ত দুঃখীকে আজ, ভালোবাসার মাটি, অশ্রুডানা, প্রিয় ইচ্ছামতী, বাইশে শ্রাবণ, জীবনানন্দের মেয়ে, পরজন্মের জন্য স্বীকারোক্তি, শিমুল ভাষা, পলাশ ভাষা

 

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের সাথে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সম্পর্ক থাকতেই হয় বলে মনে করেন কি?

বিভাস রায়চৌধুরী: লিটল ম্যাগাজিন নিজেও একটা প্রতিষ্ঠান। সে তার মত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, বড় পুঁজি বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানও আছে, এটার সোজা সাপটা কোনও উত্তর হয় না।

 

দুপুর মিত্র: প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জায়গা থেকে লোককে কিভাবে দেখবেন?

বিভাস রায়চৌধুরী: দেখো সেইভাবে ভাবলে বিদ্যালয় সংসার বিবাহ সবই তো প্রতিষ্ঠান। একটা, দু’টো বড় পুঁজির সংবাদ পত্রকে আক্রমণ করে বা তাকে এড়িয়ে একজন কবি কিংবা সাহিত্যিক স্বাধীন ভাবে থাকতে পারবে-তা কিন্তু বলা যায় না, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা একটা সাধনার মতো, আখড়ার বাউল আছে, তারা যেমন স্বাধীন বাউল সাধক, আবার যারা রেডিও টিভি মঞ্চে বাউল গান করে, তারা এক ধরনের প্রতিষ্ঠানের অধীনে বাউল গান করা শিল্পী, সে রকমই কবিতার ক্ষেত্রে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, কিন্তু একটা ঝগড়া বাধিয়ে দেওয়ার কোনও ব্যাপার না, এটা একটা ... মানে ... পছন্দের ব্যাপার একজন শিল্পীর, সে কোনটা পছন্দ করছে।

 

দুপুর মিত্র: ওয়েব ম্যাগ, ব্লগ ইত্যাদির মাধ্যমে একটা পাল্টা মিডিয়ার গঠন প্রক্রিয়া চলছে বলে আপনি মনে করেন কি?

বিভাস রায়চৌধুরী:  হ্যাঁ সেইটা আমি মনে করি, এখন ... অনেক সময় দেখা যেত দু চারটে পত্র-পত্রিকা যারা সব চাইতে বেশি প্রচার দিতে পারে তাদের চোখে পড়তে না পারলে ... যারা শিল্পী ... অনেকেই তো স্বভাব লাজুক শিল্পী, তারা অনেকটা পিছিয়ে থাকতো, এখন অনেক ওয়েবম্যাগ ইত্যাদি হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে- যদি কারও কোয়ালিটি থাকে, তবে সে প্রচারের অভাবে হারিয়ে যাবে না, এ‌ই দিক থেকে একে সত্যিউ একটা বিকল্প বলে মনে করি।

 

দুপুর মিত্র: এখানে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বিষয়গুলোকে কিভাবে দেখবেন?

বিভাস রায়চৌধুরী:  দেখো আমি গ্রাম বাংলার মানুষ, কর্মসূত্রে প্রতিদিন নাগরিক অভিজাত সমাজে যাই, রোজ ফিরে আসি, ফলে আমার যাওয়া-আসার মাধ্যমে অমূল্য অভিজ্ঞতা গয়, তা সহজে কারোর হয় না।

কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন আছে, যারা অভিজাত প্রতিষ্ঠান ছাড়া কিছুই না, আবার এখন অনেক পুঁজিবাদী কাগজও রয়েছে, যারা নিজেদের সংগঠনের স্বার্থে তাদের জানালাগুলো গ্রাম বাংলার তরুণ লেখকদের জন্যে খুলে দিয়েছে। পৃথিবীতে এমন একটা জটিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলছে, যাতে এক কথায় কাউকে লিটল ম্যাগাজিন বা কমার্সিয়াল ম্যাগাজিন বলা যায় না, সবটাই নতুন ভাবে আসছে, আমি বলতে চাইছি, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা শব্দটা যদি একটা দার্শনিক শব্দ হয়, তবে এটা শিল্পীর অন্তরে জন্মায়, বিকশিত হয়, অন্তর থেকে গ্রাহ্য হয় অথবা অন্তর থেকে পরিত্যক্ত হয়।  

 

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

বিভাস রায়চৌধুরী:  এইটা সেই কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলার মতো ব্যাপার, আমি দীর্ঘদিন কবিতা রচনা করছি বা কবিতা রচনাকে জীবনের মুখ্য বিষয় হিসেবে দেখেছি। কবিতা আমাকে চারপাশের অশুভ শক্তির হাত থেকে যে ভাবে রক্ষা করে গেছে, তার কনও তুলনা নেই, কবিতার কাছে আমার অনেক ঋণ রয়েছে, কবিতা আমার জন্যে অনেক কিছু করেছে। কিন্তু আমি কবিতার জন্যে তেমন কিছুই করতে পারিনি, আমি অপরাধী, কবিতা আমার পাশে চলা এক অপূর্ব জীবন।

 

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

বিভাস রায়চৌধুরী: পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশ- দুটো দেশের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে এই লক্ষ্যটা একটা পাল্টে পাল্টেই গেছে, পশ্চিমবঙ্গে আমি দেখছি যে, লেকালেখির প্রধান বা জনপ্রিয় ধারাটি পঞ্চাশ-ষাট দশকের অনুসলণেই হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা হচ্ছে, কিছু কিছু সদর্থক লিটল ম্যাগাজিনে অন্যরকম লেখা ছাপা হচ্ছে- এটা তো সত্যি। কিন্তু খুবই কম, আবার বাংলাদেশে এ্‌ই অন্যরকম লেখালেখির ধারাটিই প্রধান হয়ে উঠেছে যেমন আমি একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, দুর্গা পুজো উপলক্ষ্যে যে সব শারদ সংখ্যাগুলো প্রকাশিত হচ্ছে... তাতে ( কবিতার কথা বাদ দিচ্ছি... কবিতার বাণিজ্যায়ন হয় না) গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে কোনও পরীক্ষামূলক লেখালেখির সুযোগই পায় না লেখকরা, কিন্তু বাংলাদেশের ঈদ সংখ্যাগুলোতে প্রকাশিত নব্বই শতাংশ রচনাই পরীক্ষামূলক, যা আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সঙ্গে অনেকটা যুক্ত, সেইজন্যে আমি বলব, আমার মধ্যে একটা বিশ্বাস প্রবল হয়েছে, বাংলাদেশের লেখালেখির ধারা বাংলার ভাষার প্রধান লেখালেখির ধারা বাংলা ভাষার প্রধান লেখালেখির ধার হয়ে উঠছে এবং অদূর ভবিষ্যতে সেটাকেই মাথায় রেখে  আমাদের বলতে হবে।   

 

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

বিভাস রায়চৌধুরী:  আন্দোলন এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্পোরেট সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ম্যানিফেস্টো, এখন মিডিয়া ঠিক করে দেয়প্রতিবাদ বা প্রেমের ধরন, কিন্তু এটা শহুরে পৃথিবী আর্থাৎ পৃথিবীর একটা ছোট অংশেই প্রভাব বিস্তার করে তার বাইরে বিরাট উপেক্ষিত গ্রামীন পৃথিবীতে ই আছে, যেখানে মানুষ নিজের আনন্দে বাঁচে, নিজের মতো বাঁচে ফলে আমি মনে করি না দু’ একজন মানুষ ঠিক করে দেবে যে এরকম ভাবে লিখলেই আন্দোলন  আর সেটা আন্দোলন হয়ে যাবে তবে যে স্বতঃস্ফূর্ত লেখালেখি হচ্ছে, সেগুলিকে ভালোভাবে আলোচনা করলে যদি দেখা যায় তা বিগত দশ-বারো বছরের থেকে আলাদা, তবে তাকে একটা নতুন ধারা বলা যেতে পারে।

 

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

বিভাস রায়চৌধুরী: এটা তো নিজের নগ্নতা নিয়ে কথা বলা... আমি মন খারাপ হলে কবিতা লিখি, মন খারাপ হলে আমি কবিতা লিখি না।

 

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?

বিভাস রায়চৌধুরী: ধনতান্ত্রিক পরিকাঠামো যে দেশগুলোতে চলছে সেখানে কবিতার আর কোনও জায়গা নেই, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, কবিতা দুঃখী মানুষের শিল্প, সেটা আমি বিশ্বাস করি, যেখানে বঞ্চনা আছে, দারিদ্র্য আছে আবার মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকাও আছে-কবিতা জন্মায় সেখানে, কবিতা আসলে দুঃখী মানুষের কথা-বার্তা বলার মাধ্যম।

 

দুপুর মিত্র: আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?

বিভাস রায়চৌধুরী: আমার জন্ম শহর বনগাঁর সাহিত্যের উজ্জ্বল অতীত আছে। সীমান্ত শহর, উদ্বাস্তু অধ্যুষিত বলে আইডেনটিটির খোঁজে অনেকেই লেখার দিকে ঢলে পড়েন। তাছাদা দীনবন্ধু মিত্র, বিভূতিভূষণের ইতিহাসও প্রভাবিত করে, এই প্রবাহেই ১৯৮৪-৮৫ সাল নাগাদ আমি কবিতা লেখা শুরু করলেও সিরিয়াসনেসটা আসে ৯১-৯২ সাল নাগাদ।

 

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

বিভাস রায়চৌধুরী:  আমি বুঝতে পারি না... প্রতিটা শিল্পের উৎসমুখই তো কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে, আমার বরাবরের ঝোঁক গান আর নাটকের দিকে, রহস্যজনকভাবে কবিতার দিকেই ঢলে পড়লাম।

 

দুপুর মিত্র: আপনি সাধারণত কোথা থেকে কবিতা লেখার বিষয় খুঁজে নেন?

বিভাস রায়চৌধুরী:  এটা আমি বলব আমার জীবন, আমার জীবনের চারপাশ থেকে সংগ্রহ করি।