আমার কখনও কখনও মনে হয় বাংলা কবিতা একই বৃত্তে ঘোরাফেরা করছে: ঈশিতা ভাদুড়ীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jan 24, 2014 6:20:11 AM

প্রকাশিত বই: অথবা ব্রহ্মকমল, দুই হাতে জলরং, শব্দে রক্তে আঙুলে, কাঠগোলাপেও মৌমাছি. প্রেম ও বিরহের কবিতা, একটা আকাশ একটা চাঁদ, পাখির পালক।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের সাথে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সম্পর্ক থাকতেই হয় বলে মনে করেন কি? হলে কেন?

ঈশিতা ভাদুড়ী: হ্যাঁ মনে করি। কেন না প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘কমার্শিয়াল’ শব্দটি যুক্ত থাকে এবং কোনো সৎ লিট্‌ল‌ ম্যাগাজিন ‘কমার্শিয়াল’ শব্দটিকে আপন করে না। সেখানে সাহিত্যই মূল শব্দ।

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

ঈশিতা ভাদুড়ী: যে মানুষ নিজেকে কবিতার কাছে যথার্থ এবং সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করতে পারেন এবং অন্তর্মুখী ভাবনাকে সঠিক শব্দ-প্রয়োগে ব্যক্ত করতে পারেন,যাঁর অনুভূতি গভীর এবং যাঁর ভাষা অভিধানকে অতিক্রম করে যেতে পারে, চেতনার বিভিন্ন স্তরে যাঁর অবাধ বিচরণ,তিনিই কবি হয়ে উঠতে পারেন। নিপুণ চিত্রশিল্পীর দক্ষতায় যিনি একের পর এক চিত্রকল্প বা রূপকল্প তৈরী করতে পারেন তিনিই তো কবি হয়ে ওঠেন। সচেতন অন্তর্মুখীতাই কবিকে দিতে পারে উত্তরণ। একই সঙ্গে নিপুণ বাক্যবিন্যাসও।

দুপুর মিত্র: কবিতা কি?

ঈশিতা ভাদুড়ী: কবিতা হল একটি উচ্চারণ-মাধ্যম,সঠিক শব্দ-প্রয়োগে এবং ভাষার সুব্যবহারে একটি চিত্রকল্পের নির্মাণ,একটি ক্যানভাস,যেখানে কল্পনার রঙ লেগে থাকবে,অন্তরের বোধ বা বিশুদ্ধ আবেগে এবং পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার কাহিনী সুস্পষ্ট থাকবে সেখানে,কিন্তু কোনো আতিশয্য বা চিৎকার থাকবে না। একটি রহস্যের আঁচলও কখনও কখনও থাকা দরকার। মূলত সূক্ষ্ম অনুভূতি এবং তীব্র অনুভব নিয়েই তো কবিতা। মনন-ধর্মের অসীম ব্যাপ্তিতেই তো কবিতার সৃষ্টি ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

ঈশিতা ভাদুড়ী: পূর্ণেন্দু পত্রী একবার আমায় লিখেছিলেন ‘সাহিত্য-চর্চার নামে ছোট-বড়-মাঝারি সব কাগজেই যে ধরণের মস্তিষ্কহীন আবেগের অপব্যবহার চলছে আমি তার বিরুদ্ধে। কিন্তু যেহেতে কাউকে কিছু শেখানো আমার কাজ নয়,তাই ছটফটিয়ে বেড়োচ্ছি।’

আমার কখনও কখনও মনে হয় বাংলা কবিতা একই বৃত্তে ঘোরাফরো করছে। চতুরতা দিয়ে পাঠককে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।কষ্টকল্পিত শব্দপ্রয়োগে ক্লেশকর প্রয়াস যেন দেখতে পাই। তবে ব্যতিক্রমও আছে, অনেক কবিতা খুবই শিল্পসম্মত হচ্ছে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হচ্ছে, মননশীলতার প্রকাশও দেখা যাচ্ছে এবং নির্মাণ-কুশলতা।

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

ঈশিতা ভাদুড়ী: কবিতার গতিপথ অবশ্যই পরিবর্তন হতে পারে কোনো ইতিবাচক সাহিত্য আন্দোলনের মাধ্যমে। স্থবিরতার চেয়ে পরিবর্তনশীলতা সর্বদাই কাম্য।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?

ঈশিতা ভাদুড়ী: কবিতা যে কবে কখন এলো সাল-তারাখ মনে নেই। কিভাবে এলো সেকথাও স্পষ্ট করে বলতে পারি না। আমি কিন্তু কবিতা লিখবো ভেবে কবিতা লেখা শুরু করিনি। কবিতা-চর্চা আমার পেশাও নয়।

... বাবা রেকর্ড কিনতেন প্রচুর। সেই রেকর্ডে যখন কাজী সব্যসাচী বা শম্ভু মিত্র বা দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বা উৎপল দত্তের কণ্ঠে একে একে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ,শামসুর রাহমান,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবৃত্তি হতো,হয়তো তখনই মনের মধ্যে কবিতার বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল।

... আমাদের সময় শৈশব-কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পড়া হতো বেশি। তবে যে বইটি পড়ে আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়েছিল সেটি হলো পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘তুমি এলে সূর্যোদয় হয়’। পাঠ্যবইয়ের বাইরে রবীন্দ্রনাথকে সরিয়ে রেখে বলি যদি, তবে এই কবিতার বইটিই আমি প্রথম পড়েছিলাম। এই বইটিই সম্ভবত জাগিয়েছিল কিশোরীর কবিসত্তা।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

ঈশিতা ভাদুড়ী: এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। যদি আপনি প্রশ্ন করেন কেন আমি খাই কেন আমি ঘুমাই আবার কেন আমি ঘুম থেকে উঠি সে প্রশ্নের যেমন জবাব হয় না।

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন? কবিতা লিখতে আপনার কতটুকু সময় লাগে?

ঈশিতা ভাদুড়ী: আমাকে একসময় প্রতিদিন ভিড় ট্রেনে বাসে অফিস করতে হয়েছে। এসব কারণে এবং আমার স্বভাবগত কারণেও আমার কবিতা লেখার কোনো নির্দিষ্ট সময় অথবা নির্দিষ্ট কোনো আসন নেই। কত কবিতা ট্রেনে লেখা হয়েছে, কত কবিতা এলোমেলো উড়ে গেছে। কবিতা লিখবো ভেবে কবিতা সচরাচর লিখি না। তীব্র মন-খারাপের মধ্য দিয়ে যখন পথ চলি, তারই মধ্যে কখনও হয়তো এসে যায় কবিতা। কখনও দিনের পর দিন মাসের পর মাস কোনো কবিতাই আসে না। এমন হয়েছে রাস্তায় হাঁটছি অথবা ট্রেনে পাশের মহিলাদের ঝগড়া শুনছি তার মধ্যেই হঠাৎ কোনো একটা লাইন ভাসতে ভাসতে এসে গেল এবং সে থেকেই গেল মাসের পর মাস একা। তারপর হয়তো কোনও একদিন বাকি লাইনগুলি একসঙ্গে। কখনও হয়তো একসঙ্গেই পুরো কবিতা লেখা হয়ে গেল। তবে আমি কবিতা লেখার পরে দু-চারবার এদিক-ওদিক বদল করি।

দুপুর মিত্র: আপনি সাধারণত কোথা থেকে কবিতা লেখার বিষয় খুঁজে নেন?

ঈশিতা ভাদুড়ী: আমার কবিতার কেন্দ্রাবিন্দু মানুষ এবং সমসাময়িক জীবন যাপন।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার বলে মনে করেন?

ঈশিতা ভাদুড়ী: আমার মনে হয় প্রাথমিকভাবে সাহিত্যবোধ এবং চেতনা থাকা দরকার,ব্যুৎপত্তি এবং চিত্তের নির্যাসও। ছন্দ এবং ভাষা-জ্ঞান থাকাও খুব জরুরি। শব্দ-চয়নে অসাধারণ দক্ষতা ও বিশেষণ-ব্যবহারে শিল্প-কুশলতা থাকা দরকার। সবচেয়ে জরুরি হল যে, কোন কবিতা কোথায় শেষ করতে হবে সেই বোধটিও থাকা দরকার। মোট কথা কবিতার ভাব ও ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে প্রকরণের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। কোনো উচ্ছ্বাস-প্রাবল্যে কবিতার সীমারেখা কখনোই অতিক্রম করা যাবে না।