খোয়াবনামাকে সমাজতন্ত্রীরা বহন করতে পারবে না: কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 19, 2012 6:22:41 AM

গল্পগ্রন্থ: মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম (জাগৃতি) কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প (শুদ্ধস্বর), স্বপ্নবাজি (ইত্যাদি)

উপন্যাস : পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী (মাওলা ব্রাদার্স),

প্রবন্ধগ্রন্থ: উপন্যাসের বিনির্মাণ, উপন্যাসের জাদু (জোনাকি)।

সম্পাদক : কথা (কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ)

দুপুর মিত্র : সাহিত্যের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির যোগাযোগটা কেমন? বাংলা সাহিত্যে এই ধারার রচনা হিসেবে কোনগুলোকে উদাহরণ দেওয়া যায়? সাম্প্রতিক সময়ের কথাসাহিত্যে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির প্রতিফলন পাওয়া যায় কি? পেলে তা কেমন?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : সাহিত্যের সাদামাটা মিনিং হচ্ছে যা জীবনের সাথে জড়িয়ে-তাড়িয়ে-নিবিড়ভাবে থাকে তাই সাহিত্য। তার মানে প্রথম কথা হচ্ছে, এর সাথে সম্পর্কটা কার্যত জীবনের। জীবন মানেই এই দুনিয়ায় দেহধারী শরীরটা শুধু নয়, এর সাথে জীবনের সমস্ত আয়োজন, পরিবেশ-প্রতিবেশও থাকবে। আমার যেটা মনে হয় রাজনীতির বাইরে কিছুই নাই। জীবনযাপনের ধরন তো নয়ই। কাছেই অন্য অনেককিছুর মতোই বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির সাথে এর একটা বোঝাপড়া থাকবেই। এখানে বুদ্ধিবৃত্তির সাথে যোগাযোগের বিষয়টা কিয়ার হলো না। আমি বলতে পারি, বুদ্ধিবৃত্তি নয়, বরং এর সৌগন্ধের সাথে জীবনের একধরনের বোঝাপড়া হতে পারে। বুদ্ধির বিকাশ দরকার। এখন আপনি কি এখানে বামরাজনীতির ধারাকেই বোঝাতে চাইছেন? নাকি উদার মানবিক ধারাকে এর পরে কিছু মনে করছেন! বৃত্তি মানে প্রফেশন তো? এর প্রতি আমার সন্দেহ জারি থাকল।

দুপুর মিত্র : আমি আসলে সাহিত্যে বিশেষ কিছুকে জোর দেবার ব্যাপারে বুদ্ধিবৃত্তির যোগাযোগের কথাটা বলেছি। যেমন ধরেন এক সময় হাংরি আন্দোলন হয়েছিল, এখানে স্যাড জেনারেশন গড়ে উঠেছিল। এরা একটা কিছু চেয়েছিল সাহিত্যে।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : ও তাই, এইগুলিকে শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ নয়, সময়ের দাবিও বলতে পারেন। এইসব তো ৬০-৭০ দশকের দিকের বিষয়। তখন কিন্তু সবকিছু ভেঙে, প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করার এক-একটা জোয়ার এসেছিল। শুধু শিল্প-সংস্কৃতিই নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনেও চরম ভাঙচুর ছিল তখন। আমরা নিজেরা দেখেছি, গ্রাম দিয়ে শহর দখলের সেকি সাংস্কৃতিক রোমান্টিসিজম! সবই সময়ের দাবি। শিল্পসংস্কৃতির যথার্থ এনার্কিজম। জীবনকে উপলব্ধি আর ইন্দ্রিয় দিয়ে, নিজস্ব নৈতিকতা দিয়ে নিজের জীবনকে উপলব্ধি করার এক-একটা প্রসেস। এসবের দরকার আছে।

দুপুর মিত্র : বুদ্ধি, প্রফেশনালিজম এই জায়গাকে সামনে না এনে এখানে আমি আসলেই বলতে চাচ্ছিলাম বিদ্যমান নিপীড়ক কাঠামোকে আঘাত করার জন্য একজন সাহিত্যকর্মীও আসলে লড়েন। এখানে কেউ লেফ্টিস্ট, কেউ লিবারেল ডেমোক্রেটিক, কেউ এনার্কিস্ট। এর সবটাই আমি বুঝতে চাচ্ছি যে সাহিত্যে বিশেষ করে কথাসাহিত্যে এর প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে কিনা।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : অবশ্য আছে- তবে সীমিত পর্যায়ে। মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে হলেও লড়ছে। ভাষায় কাজ হচ্ছে কিন্তু। আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি আমাদের জীবন, নৈতিকতার প্রভাব নিশ্চয়ই পড়ছে। তা আরও বেগবান হওয়া দরকার। তা অত জোরালোভাবে কিন্তু হচ্ছে না। আমরা নব্বইয়েই যে মধ্যবিত্ত দেখেছি, এখন আর তা সেইভাবে তারা নেই। ভোগবাদিতা বাড়ছে, এনজিও মননে তাদের সেই নেশা লাগাচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজি মানুষের চৈতন্য কেড়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন মিডিয়ার জৌলুসতার প্রভাব রাখছে।

দুপুর মিত্র : সম্প্রতি কথাসাহিত্যের বিষয় অনেক বেশি এনজিও তাড়িত হচ্ছে বলে মনে করেন কি? হলে তা কেমন? এনজিও তাড়িত বিষয় হলে সমস্যা কোথায়? কাদের লেখাকে এই শ্রেণীর লেখা বলে সনাক্ত করা যায়?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : না আমি তা মনে করি না। তবে অনেককিছু গ্রাস করার মতোই এই দিকেও তাদের নজর আছে বলে আমার ধারণা হচ্ছে। এনজিও’র সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে বিষয়, তা আপনার মুক্তির স্বাধীন বিকাশকে, চেতনার নিবিড় স্তরকে, মানুষকে জাগানোর যে স্বতঃস্ফূর্ত বা লড়াইসমৃদ্ধ পথ আছে বা রচিত হবে, তাকে পেষণ বা দূষণে রাখবে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই যেমন ধরেন, এনজিও যেভাবে রুরাল মাইক্রো ইকোনমিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, বা এর সাথে যোগাযোগ রাখছে, তাতে মানুষের লড়াই-সংগ্রাম দারুণভাবে ব্যাহত হবে। তা এখন হচ্ছেও। এনজিও মূলত পরাশ্রয়ী পুঁজির এক দানবীয় বিকাশের নাম। কাজেই এ ব্যাপারে অবশ্যই আমাদেরকে কার্যকরভাবে সচেতন থাকতে হবে। আমি একেবারে নাম ধরে-ধরে বলতে পারছি না যে কারা এনজিওতাড়িত লেখক।

দুপুর মিত্র : এনজিও তাড়িত বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি এনজিও সোশ্যাল ইস্যুকে। যেমন ধরেন এসিড সন্ত্রাস, নারী, বার্থ কন্ট্রোল, নিও মুসলিম প্রভৃতি...

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : এইগুলি হচ্ছে অনেকটা ক্লাবভিত্তিক কাজ। উদারনৈতিকতা যাকে বলি আর-কি। এর তাৎক্ষণিক কিছু ভালো দিক তো আছে। কিন্তু এ দিয়ে লোভ লাগিয়ে মূলত মানুষের চৈতন্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটা এনজিও’রা করছে আর-কি।

দুপুর মিত্র : আমাদের দেশের সাহিত্যে প্রথম আলো পাত্তা না দিলে কেউ লেখক হতে পারে না বা যাদেরকে সামনে দেখা যায় তারা সবাই প্রথম আলো তাড়িত বা পালিত। আপনিও কি তাই মনে করেন?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আমি যা বিশ্বাস করি তা হচ্ছে, সাহিত্যচর্চা এত নিয়ন্ত্রিত বিষয় নয় যে কোনো একটা পত্রিকা এর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। এভাবে আমি ভাবতেই চাই না। এখানে পাত্তা দেয়া বা নেয়ার বিষয় নয়। এটা জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নেয়ার ব্যাপার। আপনি দেখেন, কথাসাহিত্যের মৌলতাড়নাটাই আসে অকথিত রূপ থেকে, সেটি শুধু মুদ্রণশিল্পের প্রকাশ বা বিকাশের বিষয় নয়। ইলিয়াস যে বলেন গল্প কি মরে যাচ্ছে, তা আসলে তিনি মধ্যবিত্তীয় ভাবনা থেকেই বলেন। তিনি গল্পের সভ্যতাসম ধারাকে তখন মনে রাখেন না। গল্পকে একটা ছোট্ট গণ্ডিতে আটকে ফেলেন মাত্র।

যাই হোক, আমার এধরনের হতাশা একেবারেই নেই যে কোনো একটা বা দুইটা বা সবগুলি পত্রিকাই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সাহিত্যচর্চায় সবধরনের নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে আমি।

দুপুর মিত্র : কথাসাহিত্যে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের তুলনা কিভাবে করা যায়?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : না, এখানে তুলনার কোনো বিষয় নয়। তবে গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় যে তারা রবীন্দ্রযুগকেই অতিক্রম করতে চাইছে না। আামাদের এই বাংলাদেশে কথাসাহিত্যের অনেক বেশি এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। তবে সাহিত্যচর্চার নানান মাধ্যমে তাদের সিরিয়াসনেস ভালোই দেখা যায়। লিটলম্যাগচর্চায় তারা এখনও বেশ অগ্রগামী।

দুপুর মিত্র : আমাদের কথাসাহিত্যে এক্সপেরিমেন্ট বেশি হচ্ছে! এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু কি বলবেন?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, আমি পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের স্টাইল আর প্রবণতা নিয়ে কথা বলছি। এ জন্য আমাদের গল্পের ধরন, বাক্য, প্রবণতা, ম্যাসেজ দেখলেই তা বোঝা যায়। সুবিমল মিশ্র, বারীণ ঘোষাল বা সন্দীপন দিয়ে তো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। বাংলাদেশের গল্পকারদের নানান ধরন খেয়াল করেন; আপনি গল্পের কাগজগুলি দেখেন, নানান সঙ্কলন দেখলে আপনি নিজেই সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন।

দুপুর মিত্র : সমসাময়িক কাদের গল্প বা উপন্যাসকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এবং কেন?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : মানুষকে যারা নিবিড়ভাবে পাঠ করতে চায়, সমাজকে দেখে, রাষ্ট্র’র বদমাইশি নিয়ে ভাবে, তাদের সবই আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। সেটা একেবারে হাসান থেকে শুরু একেবারে নবীনতম লেখককেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এইভাবে একেবারে আলাদা করে চিহ্নিত করে করে কখনও দেখি না।

দুপুর মিত্র : আপনি বেশ অনেকদিন ধরেই কথা নামক একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করছেন। লিটলম্যাগ কি সাহিত্যে বিশেষ কিছু দেয়? এই ম্যাগাজিন নিয়ে আপনার কি কোনও বিশেষ পরিকল্পনা আছে? বা থাকরে সেটা কেমন?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : ‘কথা’ বার করছি একটা প্রণোদনা থেকেই। আমরা মনে করি এর অবশ্যই দরকার আছে। এ হচ্ছে আমার জীবনের অতি দরকারি একটা খোলা দরজা। পৃথিবীর সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে আসতে থাকলেও এর সবকিছু খোলা রাখার বাসনা রাখি।

‘কথা’ প্রকাশের শুরু থেকেই নানান পরিকল্পনার ভিতর দিয়েই যাচ্ছি। তবে আমার একেবারে নিজস্ব চিন্তাপদ্ধতি দিয়ে তো সব করা যায় না, বা হয়ও না। কারণ কথা কোনো গোষ্ঠীবদ্ধ ছোটকাগজ নয়। এর একটা ধারাবাহিকতা তো আছেই। যারা সাহিত্যকে বাজারি করবে না, কথাসাহিত্যের যথাযথ বিকাশ চাইবে, তা এমন দৃঢ় পর্যায়ে হবে যে যাতে কথাশিল্পে এর একটা প্রভাব থাকবে। একসময় আমি নিজে মনে করতাম যে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের বাইরে কিছু নাই। এখন আমি একেবারে এর সাথে জোকের মতো লেগে থাকতে রাজি নয়। মানুষের নান্দনিক মুক্তির জন্য, স্বশাসিত আলোর জন্য, নিজের ঈশ্বরত্ব নিজের ভিতর লালন করার জন্য, গণতান্ত্রিক সাম্যের জন্য, সবধরনের একনায়কতন্ত্রের বিলোপের চেষ্টা করে যাবো। এটা হয়ত অনেক বড়ো কথা হয়ে গেল, কিন্তু আমার সাংস্কৃতিক লটা অন্তত সেই রকমই থাকবে।

এই যেমন ধরেন, কথার আগামী সংখ্যাটি করব কমলকুমারকে নিয়ে। এ জন্য সর্বধরনের প্রস্তুতি আমি নিচ্ছি। বাংলাদেশ এবং অপরাপর বাংলা ভাষীদের সাথে যোগাযোগ করছি। বিভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠী আর লেখকদের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। কমলকুমার পড়ছি। রামকৃষ্ণ আর রামপ্রসাদের যা পাচ্ছি পড়তে চাইছি। যেমন শ্রীমের রামকৃষ্ণকথামৃত, অচিন্ত্য সেনগুপ্তের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমপুরুষ, কোরকের রামকৃষ্ণ সংখ্যা, এমনকি কমলকুমার রচিত উচ্চকোটির রঙ্গকৌতুকও দেদারসে পড়ছি। এ এক মহাযজ্ঞ বটে। রামকৃষ্ণ আর লোকায়ত ধর্মজীবনকে দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, রামকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সহজ জীবনবোধ, মাতৃরূপের জীবনখোঁজাকে আমি তো ইসলামের প্রতিষ্ঠানবিমুখ মাজার-সংস্কৃতির যে সহজতা আছে, এর সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে পারি। অন্যান্য ধর্মের বা নৃগোষ্ঠীর লোকায়ত ভাবধারা আমায় খুব টানে। এতে ধর্মের প্রাবল্যবাদ থেকে হয়ত খানিক মুক্তও হওয়া যায়।

দুপুর মিত্র : ঢাকার সাহিত্য কি চট্টগ্রামের সাহিত্যকে প্রভাবিত করে? করলে কেমন ও কিভাবে? এতে কি চট্টগ্রামের বিকাশমান সাহিত্য বাধাগ্রস্ত হয় বা আদৌ কি ঢাকার সাহিত্য বলে কিছু আছে?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : না, এভাবে প্রভাবের বিষয়টা কখনও ভাবি না। আর এখন ইন্টারনেটের যুগে লেখার পরিসর অনেক বদলে গেছে। আমি বরং অন্যান্য বাংলাভাষায় নিয়ে কলকাতা, আগরতলা, শিলিগুঁড়ি, এমনকি ডায়াস্পরা সাহিত্য দেখি। তাদের কাজের ধরন দেখি, পাঠ করি, এমনকি মননও করি। তবে প্রভাব বিষয়টাই বাজে- কলকাতা ঢাকার উপর, ঢাকা চট্টগ্রাম/সিলেট/রাজশাহী/যশোরের উপর, এরা আবার তাদের অধীনস্ত এলাকার উপর মাতব্বরি করবে- এটা একেবারেই মানা যায় না। আমি মানুষের হৃদয়ের মনয়ের এমনকি দেহের প্রতিক্ষণের সৌন্দর্য আবিষ্কারে বিশ্বাসী।

দুপুর মিত্র : আপনার অনেকদিন আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানবিরোধি সাহিত্য আন্দোলন বা এর এক্টিভিস্টদের সাথে যোগাযোগ ছিল বা আপনার ঘনিষ্ঠ ছিল তারা। সেই জায়গা থেকে কি বলবেন বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যে প্রকৃত অর্থেই কোনও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার চর্চা হয়েছে কিনা। সেটা একেবারে এক্টিভিজম ও সাহিত্য দুই অর্থে বা আলাদা আলাদা ভাবে? হলে সেটা কেমন না হলে কেন?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক বলতে কি আপনি সেলিম মোরশেদ, নীল, তানভীরদের সাথে সম্পর্কের বিষয়টা বোঝাচ্ছেন? আমি এইভাবে ব্যাপারটা দেখি না। আমি মনে করি, সাহিত্যের কাজ সবখানেই হতে পারে। আমার কাজটি যদি সাময়িকীর মাধ্যমে হুবহু করতে পারি তবে সমস্যা নাই।

শোনেন প্রকৃত সৃজনশীল যারা তাদের সাথে প্রতিষ্ঠানের খায়-খাতির থাকবে না। কারণ প্রতিষ্ঠান, আইন, অফিস-আদালত, এমনকি রাষ্ট্র সৃজনশীলতার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে বাধ্য। প্রতিষ্ঠানের সাথে সৃজনশীলতার একধরনের বৈরি ভাব অটোমেটিক হয়ে যায়। আমি সাময়িকীতে আমার যথাযথ কাজটির প্রচার চাইতে পারি। তবে সাময়িকীর বিকাশে আমার ধ্যান-জ্ঞান নেই। আমি মুক্ত-স্বাধীন থাকতেই বেশি পছন্দ করি। আর আমাদের এই দেশে লিটলম্যাগের প্রতিষ্ঠানবিরোধীধারা আমার সাথে মিল খায় না। তাদের কাজে দেখবেন অদ্ভুত ফাঁকি আছে। তারা সাময়িকীর পাতাকেই সাধারণত শ্রেণীশত্রু মনে করে। তাদের রাজনৈতিক শত্রু চিহ্নিত করতে চায় না। দৈনিকপত্রের সামগ্রিক আচরণের সাথে, ধর্মের সাথে, রাষ্ট্রের সাথে বৈরিতার নির্দিষ্ট রূপ আমি অন্তত দেখি না। কে কি করছে, তার বিচারের ভার আমার উপর দিয়ে লাভ নেই। আমি আমার মতো কাজটা করতে চাই।

দুপুর মিত্র : তাদের কাজের এই ফাঁকিগুলো নিয়েই আপনার একটা বিশ্লেষণ আশা করছি।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : এই যে বললাম, প্রতিষ্ঠান মানেই সাময়িকীর পাতা নয়; সংবাদপত্রের বাণিজ্য নিয়েই তো তাদের তেমন মাথাব্যথা নাই। রাজনীতি, সমাজনীতি বা বুর্জোয়া দলীয় প্রবণতা নিয়ে কথা নাই। রাষ্ট্র নিয়ে তাদের সামগ্রিক কাজ কি তা তেমন পাওয়া যায় না। ফেসবুক প্রতিষ্ঠান কিনা এখন পর্যন্ত তাই জানাচ্ছে না! তারা কি সম্মিলিতভাবে একটা কার্যক্রম দিতে পেরেছে? প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা টোটাল ব্যাপার বলছে বটে, কিন্তু সেই টোটালিটি নিয়ে কোনো কাজ তো দেখি না!

দুপুর মিত্র : কথাসাহিত্যে আপনি কি বিশেষ কিছু করার চেষ্টা করেন? করলে সেটা কেমন না করলে কেন?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : কথাসাহিত্য নিয়ে বিশেষ কিছু করা মানে কি? তা তো চাকরি বাকরি করে না, বৈষয়িক সুবিধা কী জিনিস তা জানে না। তবে ব্যক্তি-পারিবারিক-সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় একটা আচরণের জায়গা আমার লেখায় থাকবে। আমার জীবন, আমার স্বাধীনতা, আমার নৈতিকতা তাতে প্রকাশ করতে চাই। একসময় সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের প্রতি দারুণ পক্ষপাত ছিল। এখন মনে করি, সৃজনশীলতার মুক্ত-স্বাধীন উন্মেষ সেখানে কেমন থাকবে, তা আমায় দেখতে হবে। শ্রেণীহীন সমাজ আমিও চাই, তবে মানুষের ব্যক্তিক আনন্দ, স্বাধীনতার কথা আসবে; সেই আনন্দ আর স্বাধীনতার সাথে অন্যের সার্বিক আনন্দের যৌক্তিক বিকাশ দরকার। সামাজিক বিপ্লব আর কথাশিল্পের বিপ্লবকে এক কাতারে দেখতে চাই না আমি।

দুপুর মিত্র : তাহলে এখানে বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলোর ভূমিকাকে কিভাবে দেখেন? আমার তো মনে হয় তারাও সামাজিক বিপ্লব আর কথাশিল্পের বিপ্লবকে এক কাতারে দেখতে চায়। তারা চায় উপন্যাসটা তাদের রাজনীতির কৌশল বা লিফলেট হয়ে দাঁড়াক। আবার এই ক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে বামপন্থিদের নড়াচড়া বা অনেকের মতে ইলিয়াস শেষ পর্যন্ত প্রোপাগান্ডিস্ট লেখক; এসব ব্যাপাগুলো আপনি কিভাবে দেখছেন?

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আমি বোধ করি অলরেডি এর জবাব দিয়েছি। আমি কোনো স্টেটমেন্ট বা লিফলেটে বিশ্বাস করি না। আমার বা আমাদের কাজই সব বলে দিবে। এ জন্যই তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সর্বত্র খাপ খাওয়াতে পারছি না। সম্পূর্ণ প্রসঙ্গতই একটা কথা বলি, আমার তো মনে হয়, ইলিয়াসের সবকিছু ধারণ করতে পারলেও তার শেষের দিকের সাহিত্যসাধনাকে সমাজতন্ত্রের সারথীরা তা পারবে না; একসময় তাদের কাঠামোর ভিতর তা রাখতে পারবে না! বিশেষ করে তার ’খোয়াবনামা’ একসময় তাদের কাজের ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে বসবে। কারণ এর ভিতর যে জীবন আছে, মানুষের বহুমুখী কলতান আছে, অজস্র কণ্ঠ আছে, আছে ভাষার প্রাবল্য, রূপকথার মাধুর্য, জাদুর নিরুপম বিস্তার- এসব তাদের একনায়কতান্ত্রিক ধারণাকেই অগ্রাহ্য করবে। তাদের কাজকে অস্বীকার করবে, ইলিয়াসের এ-ধরনের সৃষ্টির সৌগন্ধ তাদেরকে অসহায় করবে। আমার কিন্তু তাই মনে হয়। তাতে এর সৃজনশীলতার নিয়ন্ত্রণ কিভাবে হবে, কে করবে, তা আমায় ভাবায়। তবে রাজনীতির মূল কাজ তো আমিও চাই, শ্রেণীর বিলোপ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি দরকার। তবে তার সাথে সৃজনশীলতার মুক্তি দরকার। পার্টি-ক্যাডাররা আমার সাহিত্য-বিচার করবে তা আমি মানি না। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র নয় সর্বহারার মানবিক-গণতন্ত্র দরকার। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় এমন প্রায়ই দেখা গেছে যে পার্টি-ক্যাডাররাই সবজান্তা। এখনকার ডিসি-এসপি’র মতো তারা সবখানে নাক গলায়। তা হতে পারে না। এটাই আমি আমার কথাশিল্পে, গদ্যে আনার চেষ্টা করি। তাকে গণতান্ত্রিক সাম্য বা মানবিক নৈরাজ্যবাদ যাই বলেন, এর প্রতিই আমার মমতা জমছে।