অনেক গল্পকারের ভিতরই গল্পকে অযথা টেনে লম্বা করার একটা প্রবণতা আছে: রাতুল পালের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 22, 2012 5:53:29 AM

প্রকাশিত বই: দ্বিধা ( মোজাফ্ফর হোসেন, রাতুল পাল)

দুপুর মিত্র: আপনি নিজেকে কেন লেখক বলে পরিচিত করাতে চান?

রাতুল পাল: লেখক আমাকে হতেই হবে, বা লেখক হিসাবে আমার পরিচিতি দাঁড় করাতেই হবে, এমন কোন তাড়না আমি অনুভব করি না। সাহিত্যচর্চার প্রতি আমার তীব্র অনুরাগ রয়েছে, এবং শুধুমাত্র এ-জন্যই আমি তা করি। এর পিছনে অন্য কোন কারণ নেই। আর তাছাড়া আমি যদি বলি আমি লেখক, তাহলেই তো আমি লেখক হয়ে গেলাম না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পাঠকের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা। তবে আমি বলছি ভালো পাঠকের কথা- যাঁরা অভিজ্ঞ ও যাঁদের সাহিত্যবোধ প্রখর। আমি যদি সারা জীবন ধরে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখি, এবং তারপরও যদি পাঠকের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা না থাকে, তাহলে আমি লেখক নই, কেউই নয়। আমি চেষ্টা করছি মাত্র, এবং এই চেষ্টার মধ্যে আনন্দ পাচ্ছি। আর কিছু নয়। সাহিত্যের প্রতি আমার ভালবাসার ফলস্বরূপ আমি যে শুধু মৌলিক লেখাই লিখছি তা নয়, কিছু অনুবাদও করেছি ইংরেজী থেকে, ভবিষ্যতে আরও করবো। তাছাড়া আমি একটি সাহিত্য পত্রিকা “শাশ্বতিক“-র সহ-সম্পাদক, যার প্রধান সম্পাদক হল আমার বন্ধু মোজাফ্ফর হোসেন। তবে এ-সব কিছুই হল প্রচেষ্টা। কতটুকু সফল হয়েছি, পাঠকই তা বলে দেবে।

দু: কবিতার চেয়ে কথাসাহিত্যকে আপনি কেন বেছে নিলেন?

রা: সত্যি বলতে, পাঠক হিসাবে কথাসাহিত্যের চেয়ে কবিতাই আমার কাছে বেশি প্রিয়। এখনও আমি গল্প বা উপন্যাসের চেয়ে কবিতাই বেশি পড়ি। কিন্তু কবিতাচর্চা করি না, কারণ কবিতা লিখতে গেলে কিছু গুণের দরকার হয়, যেগুলি, আমার মনে হয়, সেই ভাবে আমার নেই। প্রথমত, কবিতা লিখতে গেলে নিজস্ব একটি কাব্যিক ভাষা থাকা দরকার, একটি স্বতন্ত্র প্রকাশভঙ্গি থাকা দরকার। প্রত্যেক মহান কবির নিজস্ব এক প্রকার প্রকাশভঙ্গি থাকে, এমনকি অনেক মাঝারী কবিরও তা আছে। কিন্তু আমি বুঝছি, আমার সেই স্বতস্ত্র ক্ষমতা নেই। কথাসাহিত্যে যে লেখকের নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি থাকে না, আমি তা বলছি না, অনেক লেখকেরই আছে। তবে গদ্যভাষার উপর মোটামুটি দখল থাকলেই কথাসাহিত্য চর্চা করা সম্ভব, কারণ কথাসাহিত্য মূলত বর্ণনানির্ভর, ভাষার সূক্ষ্ম কারুকাজ এখানে সেই অর্থে মুখ্য নয়। ভাষার চূড়ান্ত শৈল্পিক প্রয়োগের জায়গা হল কবিতা, যা, আমার মনে হয়, সহজাত এক প্রকার প্রকাশভঙ্গি না থাকলে সফলভাবে লেখা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, আমার ছন্দজ্ঞান নেই। কবির ছন্দজ্ঞান থাকা আবশ্যক। কবিতায় সে ছন্দ ব্যবহার করতেও পারে, নাও পারে; কিন্তু ছন্দজ্ঞান জরুরী। একজন বিখ্যাত কবি, সম্ভবত এলিয়ট, বলেছিলেন যে, ঠিকভাবে মুক্তছন্দে কবিতা লিখতে গেলেও ছন্দ জানতে হয়। আমি ছন্দের উপর কিছু বই পড়েছি- কিছুটা বুঝেছি, কিছুটা বুঝিনি। তবে অবশ্যই তা প্রয়োগ করার ক্ষমতা আমার হয়নি। তৃতীয়ত, গল্প দিয়েই আমার লেখালেখি শুরু। যারা জানে আমি লিখি, তারা মূলত আমাকে গল্পকার হিসাবেই চেনে। এই পরিচয়টা আমার ভালোই লাগে, ভবিষ্যতেও এটি ধরে রাখতে চাই। তবে কবিতা যে একেবারেই লিখিনা তা নয়। বেশ কিছু বাংলা ও ইংরেজী কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। তবে লিখেছি একেবারেই মনের খোরাকের জন্য, অন্য কোন কারণ নয়।

দু: বাংলাদেশের সমসাময়িক গল্পচর্চা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

রা: বর্তমানে বাংলাদেশে যে গল্পচর্চা হচ্ছে, তা নিয়ে আমি কিছুটা হতাশ। আমাদের দেশে বাস্তবধর্মী গল্প বেশি লেখা হয়, যেখানে প্রাধান্য পায় গ্রাম ও নগরের প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন ঘটনা। প্রায় সব লেখকই এ-ধরনের গল্প লেখেন। কিন্তু পুরমাত্রায় কল্পনানির্ভর লেখা আমাদের এখানে লেখা হয়না বললেই চলে। আমি যে রিয়্যালিস্টিক লেখার বিপক্ষে, তা নয়। কিন্তু কল্পনানির্ভর লেখারও প্রয়োজন আছে। অসকার ওয়াইল্ড, গ্রিম বাদার্স বা হান্স এ্যান্ডারসন- এঁদের লেখায় যেমন একটা মিথিক টাচ আছে, বা রূপকথার গন্ধ আছে, তেমন বাংলা গল্পে খুব একটা পাওয়া যায় না। তাছাড়া, ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতার প্রয়োগও আমাদের দেশের গল্পে খুব একটা ঘটে না। ফিলোসোফিক্যাল বা সাইকোএ্যানালিটিক্যাল গল্পও আমাদের দেশে খুব বেশি লেখক লেখেন না। এই বিষয়গুলি গল্পে আসা দরকার, না হলে বৈচিত্র্য আসবে না। গল্পের ফর্ম নিয়েও খুব বেশি নিরীক্ষা চোখে পড়ে না। তাছাড়া, আরেকটি নেতিবাচক দিক আমি ইদানীং তরুণ লেখকদের গল্পে লক্ষ্য করছি, তা হলো অতিকথন। অনেকের ভিতরই গল্পকে অযথা টেনে লম্বা করার একটা প্রবণতা আছে। তাদের গল্প পড়লেই বোঝা যায় যে, তাদের বর্ণনা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী নয়, বরং গল্প দীর্ঘায়নের একটি প্রক্রিয়া।

দু: কথাসাহিত্যের কোন ধারাকে আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এবং কেন?

রা: প্রত্যেকটি ধারাই আসলে স্বতন্ত্র। প্রত্যেকটি ধারারই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, একটির সাথে আরেকটির তুলনা করা বেশ কঠিন। তারপরও আপনার প্রশ্নের খাতিরে বলবো, উপন্যাস কিছুটা এগিয়ে। পাঠকের মনে চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলার জন্য সাহিত্যকর্মের দীর্ঘ পরিসর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, যেটি উপন্যাসের আছে, ছোটগল্পের নেই। আবার নাটকের দৈর্ঘ্য যথেষ্ট হতে পারে, কিন্তু তা শুধুই সংলাপ-নির্ভর, লেখকের নিজস্ব বর্ণনা বা চরিত্র বিশ্লেষণ নাটকে সেই অর্থে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু উপন্যাসে বিশ্লেষণ, বর্ণনা ও সংলাপ সব-ই থাকতে পারে। এসব বিষয়গুলি বিবেচনা করলে উপন্যাসকে কথা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রাখা যায়।

দু: লেখার বিষয়ের ক্ষেত্রে আপনি কোন জায়গাকে বেশি গুরুত্ব দেন এবং কেন?

রা: আমি লেখায় একটু কল্পনাপ্রবণ হতে পছন্দ করি। আমি ইমাজিনেটিভ ও রিয়্যালিস্টিক- উভয় ধারার গল্পই কিছু লিখেছি, তবে ইমাজিনেটিভ গল্পের প্রতিই আমার আকর্ষণটা বেশি। আমি সাধারণ মানুষের কথা, বা তাদের সুখ-দুঃখ অথবা অস্তিত্ব সংকটের কথাই বলতে চাই, কিন্তু রূপকের আড়ালে। প্রশ্ন হতে পারে যে, অনেক বাস্তবধর্মী গল্পও তো কল্পনা করেই লেখা হয়। এর উত্তর হলো, কল্পনা করে লেখা হলেও সেগুলি আমাদের চিরচেনা জগতেরই গল্প। চারিপাশের বাস্তবতাই সেই গল্পগুলির সেটিং, লেখক সেখানে শুধুমাত্র ঘটনা বা চরিত্রই কল্পনা করে লিখছেন। কিন্তু আমি যে ধরণের গল্পের কথা বলছি, সেখানে কল্পনা দিয়ে ভিন্ন একটি জগৎ তৈরি করা হবে, আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের সাথে যা মিলবে না। এই কাজটি করার জন্য আমি কিছু গল্প একদমই রূপকথার আদলে লিখেছি, আবার কিছু গল্পের সেটিং হিসাবে নির্ধারণ করেছি মধ্যযুগ বা প্রাচীন যুগ। মধ্যযুগ বা প্রাচীন যুগের বিস্তারিত বর্ণনা হয়তো আমার গল্পে পাওয়া যাবে না, কিন্তু পাঠক পড়লে বুঝতে পারবে সে নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতার কোন গল্প পড়ছে না। তাছাড়া আমি কিছু গল্প লিখেছি যেখানে লেখক বা কবি নিজেই লেখার বিষয়বস্তু। অর্থাৎ আমি শিল্পীর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে চেয়েছি শিল্পের মাধ্যমে।

দু: লেখা নিয়ে আপনি কেমন আশা করেন? তার কতটুকু আপনি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন এবং কেন?

রা: শ্রী অরবিন্দের একটি কথা আছে, তা হলো- একজন লেখক যতো ভালুই লিখুক, তাঁকে সবসময় ভাবা উচিৎ যে, জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটি তিনি এখনো লেখেননি। আমি এই উক্তিটিকে অনুসরণ করি। এমন কিছু বিশ্বাস না করলে ভেতরে লেখার স্পৃহা কমে যাবে। আমি চেষ্টা করছি, ভবিষ্যতেও করে যাবো। আগের প্রশ্নের উত্তরে আমি যে যে বিষয়গুলি উল্লেখ করেছি, সেগুলির উপর ভিত্তি করেই আমি গল্প লিখতে চাই। গল্পের ফর্ম নিয়েও ছোটখাটো কিছু নিরীক্ষা করেছি, সামনে আরও করবো। আমার আশা কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা বলতে গেলে বলতে হবে, কিছুটা হলেও হয়েছে। কারণ কিছু ভালো পাঠকের কাছ থেকে আমি যথেষ্ট ইতিবাচক মন্তব্য পেয়েছি। আমার অনেক বন্ধু আছে যারা নিজেরাই লেখক। তাঁরা আমার লেখা নিয়মিত পড়ে, এবং মন্তব্য করে। এছাড়া সাধারণ কিছু পাঠকও আছে। এরাই আমার অনুপ্রেরণা।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্য আর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ফারক কোথায়?

রা: সত্যি বলতে, ওপার বাংলার সমসাময়িক সাহিত্যের সাথে আমি খুব একটা পরিচিত নই। তবে তাঁদের যারা শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক অর্থাৎ মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, বনফুল, পরশুরাম- তাঁদের পড়েছি। আবার সুনীল, শীর্ষেন্দু বা নীহাররঞ্জন- এঁদেরও কিছু কিছু পড়েছি আগে। তবে একেবারেই যাঁরা সমসাময়িক, তাঁদের সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। তাই এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা ঠিক হবে না। আমি যেহেতু ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র, তাই ইংরেজীই বেশি পড়তে হয়। তাছাড়া অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের ইংরেজী অনুবাদও পড়ি। আমার বয়স এখন মাত্র চব্বিশ, সামনে আরও অনেক সময় পড়ে আছে। ভবিষ্যতে কোন সময়ে অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য মনোযোগ দিয়ে পাঠ করবো।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।