কবিতার সাম্প্রদায়িকতা ভয়াবহ: সিদ্ধার্থ শংকর ধরের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Dec 14, 2012 9:35:30 AM

প্রকাশিত বই: মনের কুমারীর নাম স্নেহতাপ্তি নদী, বসন্তে মুদ্রিত বিরহ

দুপুর মিত্র: কবিতা কেন লিখেন?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: আত্মহত্যা করব বলে যতবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গিয়েছি, ততবারই কোনও গ্রহণযোগ্য তথ্যের সপক্ষে যুক্তির অভাবে ওইরকম পবিত্র সততার জায়গা থেকে ফিরে আসতে চাই বলেই হয়ত কবিতায় কাজ করা। কবিতা আমার প্রকৃত সত্যের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক, বিনির্মিত মিথ্যার ঘোরতর অন্তর ব্যবধান। আন্তদেশীয় বাস্তব, প্রেক্ষাপটে প্রবল অস্তিত্ব সংকটের; যেখান থেকে যখন ফিরে আসি, তখন নিজেকেই যেন ডেকে বলি আমি আছি, আমি আছি, আমি আছি। এই আমাকে ডেকে আমার বলাটাই তখন হয়তো কবিতা।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য দশক নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: কেবল নব্বই এবং শূন্য অনানুষ্ঠানিক অগভীর ও অনির্ধারিত আড্ডা বৈঠকের বিভিন্ন প্রকরনে অধিকাংশকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যে নিবিড় অবলোকনের সুযোগ বহুবার করে যে ঘটেনি যে সত্য অস্বীকার করার ইচ্ছে নেই। প্রায় ১২ বছরে আমার ঢাকা জীবনের কবি আড্ডাই কেটেছে বেশি। কারণ পেশাগত জীবনের আয়ুরেখা অজ্ঞাত অভিশাপে বহুখন্ডিত। কবিতা তার একটি অদৃশ্য কারনও বটে। তথাকথিত শূন্য দশক গঠিত আমাদের ও সমসাময়িকদেরকে দিয়েই- আর নব্বই দশক পিঠেপিঠি বড়। আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে চারিত্রের পরম্পরা থেকে বিশেষ কোনও পার্থক্য দেখি না। কারণ উভয়েই রাজনীতির উচ্ছ্বিষ্টের প্রতি বড়ই লোভাতুর। করুণ ও কাতর চিত্তে স্মরণ করে কানাগলির সুবিধার অন্ধকার উতস। ক্ষমতার অযোগ্য কাঙাল বলেও মনে করি। শুধু সুবিধাভোগী-নীতিগত আদর্শহীনরাই সব নয়, তবে তারা দলে বড় এবং তারা তথাকথিত এই দশক চর্চা ও দশক ব্যবসা করাটাকেই এই কাব্যজীবী পেশার মৌলিক স্তর বলে মনে করে। কবিতা এদের উপাস্য নয়। কবিতাকে ভর করে দশক দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু দশককে ছেড়ে গেছে কবিতা। কবিতায় দশক পরিচিত হলেও নব্বই ও শূন্য দশক কবিতার কোনও আলাদা চরিত্র নয়। দশক দু'টি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক গাণিতিক পার্থক্য শাখা বটে। এই দশকগুলোকে পিঠে ঝুলিয়ে চলছে একটি বিশেষ মুখ ও মুখোশের দল। তারা সকলে কবি নয়। তাদের অধিকাংশই কাব্যজীবী। নতুনদের সাবধান থাকা দরকার তাদের থেকে।

দুপুর মিত্র: বাংলা সাহিত্যের শত্রু বললে আপনি কি সামনে নিয়ে আসবেন?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: বাংলা সাহিত্যের তারাই শত্রু তথা আধুনিক রাজাকার যারা মিসকিন সেজে বিদেশী ভিক্ষার অর্থ গ্রহণ করে ভাষা পরিবর্তনের প্রজেক্ট পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেছে কিংবা করতে কারও স্বপ্ন দেখায় তারা। বিশেষত এই দলটি নিজেদেরকে মডারেট নামেও বাজারে বিক্রি করে, আরবের কাবুলিওলাদের ঝোলা কাঁধে করে। পাকিস্তান যা করতে পারেনি- তারা ৫২ এর পরাজিতের গ্লানি মোচন করে দেবে বলে প্রতীক্ষা করেছে। মাঝে মাঝে যেসব অনুষ্ঠানের দাওয়াত আমরা অহরহ পেয়ে থাকি, তবে তাদের দক্ষতার প্রশংসাও করা দরকারি যে কলকাতায় কতিপয় নষ্ট পরমায়ু লোভী দাদারা তাদের প্রতি প্রতিশ্রুতি পূরণের শর্তে এদেরকে নেক নজরে দেখে থাকেন।

দুপুর মিত্র: সাহিত্যে মাফিয়া বললে কাদেরকে সামনে আনবেন?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: কাবুলিওয়ালা ও মিসকিন এবং খয়রাত এই শব্দগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা চালিয়ে নিতে তার বাইরে উপায় কী। মাঝে মাঝে এইসব মাফিয়াদের প্রতি আমার বড় মায়া হয়। আক্ষরিক অর্থেই বলছি।

দুপুর মিত্র: কবিতা চর্চায় সাম্প্রদায়িকতা কাজ করছে বলে মনে করেন কি?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: কবিতার সাম্প্রদায়িকতা ভয়াবহ। কারণ দূর নিয়ন্ত্রিত দর্শনতাড়িত হয়ে অধিকাংশরাই ভাষা-সংস্কৃতির নিজস্বতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যার ফলে সাহিত্যে এসব পুরনো হয়ে যায় খুব দ্রুত। তা ফেলে দিতে হয় সময়কে। তরুণ কবিদের একত্রিত আড্ডাগুলোতে কান পাতুন- লক্ষ্য করবেন কেবল রাজনীতির নষ্টামি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কেউ কবিতা লেখা ও পড়া নিয়ে কথা বলছে না।

এই ঘটনাটি যেহেতু প্রায় সফল সম্ভাবনাময় কিংবা প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত কবিদের বেলাতেই ঘটে তাই এ নিয়ে কেউ আর গাঁ করে না। তবে বিষয়টিকে আক্রমণ হিসেবে দেখলে সত্যিই ভয়ঙ্কর। এটিকে সাম্প্রদায়িক প্রতিপক্ষের সবচেয়ে কঠিন আক্রমণই হয়তো হবে হত্যার আগে। যুগে যুগে এই ধরণের আক্রমণের ফলাফলও ছিল তাদের জন্য লাভজনক তবে সময়ের সাথে কৌশলের আধুনিক নবায়ন ঘটেছে তো। কী আর করা। তবে আমার ও একই সাথে তাদের জন্য আশঙ্কার কথা হল যে ইদানিং কেবল হিন্দু নয় যে কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তরুণেরা নিজেকে খুব বেশি দুর্বল মনে করে না - কারণ তাতে কোনও লাভ নেই।

দুপুর মিত্র: দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী পড়ে যারা কবিতা বুঝতে চায় তাদেরকে আমার আপনার করুণা করা ছাড়া কী করার আছে। আর দৈনিকে তো কোনও সাহিত্য সম্পাদক থাকতে পারে না, সাহিত্য সাংবাদিক থাকতে পারে যিনি কর্তৃপক্ষ নির্দেশিত কর্মটিই সম্পাদনা করবেন। আর যেহেতু সম্পাদক-প্রকাশক যেহেতু বাণিজ্য করেন, তাই-ই যদি মাফিয়াদের কাছে আত্ম-বিক্রি করতে কখনো কখনও সম্মত হবেন। এছাড়া উপায় কী।

দুপুর মিত্র: কাদেরকে আপনি বাজে লেখক মনে করেন?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: বাজে লেখক বলে কিছু নেই। আছে কিছু পাগল- যারা অহেতুক হট্টগোল তলৈরি করতে পছন্দ করে। নীতি- আদর্শ উদ্দেশ্যের ধার এরা ধারেন না । একটা নিরাপদ ছদ্মবেশে আত্মঅবস্থানে এরা বিশ্বাসী। এরা সুবিধাবাদী শ্রেনীর ছিটকে পড়া ছায়া সদস্য মাত্র।

দুপুর মিত্র: দশক দখল বলে একটি বিষয় কি আছে? এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: দেখুন দখল-সংস্কৃতি এ রক্তে আজ থেকে নয়। ৪৭ এর দখল, ৭১ এর দখলের চেয়ে ভয়াবহ দখল তো হবে। তখন দখল হতো ভূমি, আর এখন দখল হচ্ছে মেধাস্বত্ত্ব। সমস্যাটা কোথায়? কোথায় দেখলেন নতুন করে। আমি তো আগের উত্তরে বললাম- এটা একটা মডারেট প্রজেক্ট। এটা ঠিক যেভাবে নয় অন্যভাবে। এরা ভূমিদস্যু নয়, মেধাস্বত্ত্ব দস্যু। তবে সম্পদহারা শ্রেনীও সেই একটি বিশেষ শ্রেনী এবং দখলদারীরাও ওই একই শ্রেনীর। পার্থক্য কেবল শিক্ষিতের আর অশিক্ষিতের যতটুকু। দশক তো দখল করতেই হবে, তা না হলে আর করবে কোথায় দাঁড়িয়ে। দশক তো মুক্তিযুদ্ধের সনদের মতো। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, সার্টিফিকেট নেই, সুবিধাও নেই। আমার বন্ধুর বাবা রাজাকারী করেছেন, তার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট আছে। তাই তাদের সরকারি চাকরি আছে। এখানে দশক সনদ জীবীকার বাস্তবায়ন পরিচিতির ভিত্তিমূল। দশক দখল হবে না কেন?

যারা এখনও সত আছেন দশক দখলের অভিপ্রায়ে নয়, যারা কবিতা লিখতে বসেন কোনও বিশেষ অসত উদ্দেশ্যকে সামনে না রেখে, কোনও মডারেট প্রজেক্টকে মাথায় না রেখে তাদেরকে আমি গুরুত্বপূর্ণ বোধ করি। দায়িত্ববোধ থেকে যারা এখনও কাজ করে যান তাদেরকে। যারা কলম বেঁচেন না, তাদের। তাদেরকে আপনিও চিনে থাকবেন- যে কোনও কাগজে যে কোনও মানের প্রকাশনায়। আমি তাদের চিনি খুব সহজেই।

দুপুর মিত্র: বাংলাদেশে লেখকদের লেখা পেশা হয়ে ওঠতে পারছে না কেন?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: আমাদের দেশে লেখকদের কাছে লেখা পেশা হয়ে উঠতে পারে না, একারণেই যে, তাদেরকে নিয়ে গণমাধ্যম ও সমাজ দালালি ও করতে পছন্দ করেন। মূলকথা সাহিত্য নিয়ে সরকার, রাজনীতি ও গণমাধ্যমের কোনও সদিচ্ছা নেই। বরং বাধাদান করলেই লাভজনক মনে করে।

দুপুর মিত্র: কবি-লেখকদের কোন বিষয়টিকে আপনি সহ্য করতে পারেন না?

সিদ্ধার্থ শংকর ধর: প্রথমত চরিত্রহীনতা। দ্বিতীয়ত নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে ছিটকে পড়া।