স্টাইলে যারা নতুন তাদের অনেক পাত্তা দিই আমি: জহির হাসানের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Dec 13, 2013 6:54:12 AM

পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে (২০০৩), গোস্তের দোকানে (২০০৭), ওশে ভেজা পেঁচা (২০১০), পাতাবাহারের বৃষ্টিদিন (২০১৩), অনুবাদ: এমে সেজেরের সাক্ষাৎকার ও আধিপত্যবাদ বিরোধী রচনাসংগ্রহ,কথাবার্তা (উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার, ২০০৬)।

দুপুর মিত্র: আপনি কি মনে করেন কবিতা সমাজে একটি ভূমিকা রাখে?

জহির হাসান: পাখির গান আপনার রাজনৈতিক চিন্তাকে কতটুকুন প্রভাবিত করে? পাখির গান আমার মনরে ঘুরায়ে দেয় পাখির গানের দিকে। সুরের একটা অচিন আনন্দলোক আছে তারদিকে। কবিতা সমাজে ভূমিকা রাখে না, বরং সমাজ থাইকা কবিতা হয় কখনো কখনো।সৃষ্টিশীল কবিতাকে সমাজকে নিতে হবে।কবিতা নিজে সমাজের কাছে যাবে না, সমাজকে আসতে হবেকবিতার কাছে।কবিরা সমাজে জন্মায় বটে, বাস করে সে ভাবের জগতে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সমাজে কী ভূমিকা রাখছে? সমাজের রুচির সাথে যে কবিতা যায় সেইটা ভূমিকা রাখছেবলে ধরে নেয়া হয়।

দুপুর মিত্র: যদি রাখে সেটা কিভাবে যদি না রাখে সেটা কেন?

জহির হাসান: কবিতা তো আর পাখির গান না, এখন এইটার একটা লিখিত রূপ আছে। তো লিখিত রূপে হিসেবে কবিতা শ্রুতিরূপের অধীন মানুষদের কাছে যায় না। লিখিত সংস্কৃতির অধীনলোকেরা লিখিত কবিতারে নিচ্ছে। তাদের কারও কারএ মনের অপ্রয়োজনের খিদারে থামায় কখনো । কবিরা তো সমাজের অতিথি না, কয়দিন বেড়াতে আসছে, দেখাসাক্ষাৎ শেষ এখন যাই, আবার দেখা হবে, বাই, বাই! কবিরা চায় সমাজে নৈরাজ্য থাকুক কিছু মাত্রায়, মানে বিধিবদ্ধ সমাজের নিয়মরীতির বাইরেও অনেক কিছুর সম্ভাবনা আছে। ধরেন, কবিদের কল্পনা-রাজ্যএইটারে সমাজকে নিতে হবে।পাখির গানের মতো কবিতারও একটা অপ্রয়োজনের খাতির আছে, থাকা উচিত। পরিবেশ বিপর্যয়ে মরে যাচ্ছে পাখিসমেত তার গান। কবিরাও এরকম বিপর্যজয়েরমুখোমুখি! সমাজে কবিরা ভূমিকা রাখতে যাবে কেন? বরং রাষ্ট্র-সমাজ কবিদের কাছে যেচে যাবে। সমাজ সবসময় পশ্চাতে থাকে, তার উচিত এগিয়ে থাকা কবিদের কবিতার কাছে শিক্ষণীয়যদি কিছু থাকে তা নেওন।

দুপুর মিত্র: আপনি কোন কোন কবি দ্বারা বেশি প্রভাবিত?

জহির হাসান: ভালো কবিতা আমারে শাসায়, নাচায়, কান্দায়, হাসায়, কিছুদিন ঘোরের ভেতর রাখে, আরও অনেক কিছু করে। প্রভাবিত করে প্রেরণা দেয় ভাল কবিতা লিখতে। হয়তো সেটাকরতে আমি বার বার ব্যর্থ হই।রসের কিছু পাইলেই আমি কাতর হয়ে পড়ি। সংবেদনশীলতার বাইরে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। চর্যার কবি, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দ দাস, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, উৎপল, আল মাহমুদ… এই রকম কবিদের রচনারীতি আমারে ধান্দায় ফালায়ে দেয়। হালের কবিরাও আমারে প্রভাবিত করে, কইলাম তো ভাল শক্তিশালীকবিদের কবিতা আমারে বিপন্ন অসহায় করে ফ্যালে। প্রভাবিত হওন ভাল জিনিস হিসেবে দেখি আমি।

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

জহির হাসান: সংবেনশীলতাকে বহুমুখী করে নিজের ভাবরস কন্ঠস্বরকে এক বা একাধিক আলাদা আলাদা নতুন ভাষায়,স্টাইলের মধ্যে পুরে দিয়ে ফল-লাভের আশা পরিত্যাগ করি কানখাড়াকরি লিখে যাওয়া।

দুপুর মিত্র: কবিতা কি? সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

জহির হাসান: কবিতা লিখি বটে, এইটা যে একটা পদার্থ তা বুঝি না পরিষ্কার। জগতে এত বিচিত্র কবিতা- মন্তব্য করে বোকা হইতে চাই না। ত্রিশ বছর ধরে কোনো নারীর সাথে সংসার করেযেমন কাছের নারীটিই রয়ে যায় সবচেয়ে অচেনা তেমনি যেন কবিতা সেই অচেনা নারী। কবিতা বোধ হয় ডিফাইন করার মতো কোনো জিনিস না। এইটা হয়ে ওঠারই জিনিস। হইলে বোঝাযায় হইছে। ‘বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা-/বলিলাম ম্লান হেসে ; ছায়াপিন্ড দিলো না উত্তর;/ বুঝিলাম সে তো কবি নয়- সে যে আরূঢ় ভণিতা:’ দাঁড়াইলো সমালোচকের/অধ্যাপকের ডিফাইন করা কবিতা- কবিতা না। কবিতা হতে হলে তা লিখে দেখাতে হয়। হয়ত জীবনবাবু সেজন্য কইছেন- ‘বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা’। তবে নিকানোরপাররার কবিতা নিয়া কইছিলেন, কবিতা হইলো তাই যেইখানে সবকিছু চলে। সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কী বলা মুশকিল। এর জন্য গবেষণা করা দরকার। এক কথায় বল্লেগলদ থেকে যাবে।এইটা কবিতা গবেষকদের ব্যাপার। কবিতারে আমি প্রবণতা আকারে দেখি না।

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

জহির হাসান: সাহিত্য আন্দোলন পরিবর্তন করে বটে। গতানুগতিক সাহিত্য আন্দোলনের বাইরেও সাহিত্য হইতে পারে, কবিতা হইতে পারে।

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

জহির হাসান: আমি বহুদিন নোট নিই, সেই গুলা লিখে রাখি।তারপর বহুদিন পর যখন ভাব আসে দয়া করে তখন লিখি সেই নোট থেকে কিছু কিছু নিই, বাদ দিই, জোড়াতালি দিই, নতুন ভাবেরলগে মিশ খাওয়াই। এইভাবে বোধ হয় লিখি।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

জহির হাসান: বাইরের দেশের কবিতা পাইলে পড়ি। যা মনে হয় অল্প-স্বল্প পইড়া মন্তব্য করা ঠিক না। নিশ্চয়, সবদেশেই ভাল কবিগো কবিতার স্টাইলের মধ্যে ভাবান্দোলন হচ্ছে, একটা ঝড় বহিযাচ্ছে আমাদের মতো।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?

জহির হাসান: আমি তখন ক্লাস সিক্সে। বিজয় দিবসে স্কুলে কবিতা পড়ব বলে আব্বাকে বলি একটা কবিতা লিখে দেন। আব্বা ‘বেড়াল ছানা’ নিয়া একটা পদ্য ফাঁদলেন, কিন্তু মাঝপথে তা আরশেষ করতে পারতেছিলেন না্। আমারে ডাইকে কলেন, তুই এবার মিলা। সেকি আমি কী পারুম জন্ম দিতে? আমি কতটুকু মেয়ে? কতটুকু নারিত্ব থাকলি একজন জন্ম দিতে পারেন? জন্মদেওনের পুব-কায়দাকানুন তো মোর জানা নাই! ওমা লেখা শুরু করলাম আব্বার পর থাইকে। দেখি শেষ মিলাইতে পারলাম। হায়রে যেৌথ রচনা, মোর আর আব্বার পদ্য লেখন মোর সেইছোটবেলায়!

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

জহির হাসান: আমি কবিতা না লিখলে সৃষ্টির কোনো শর্ত অপূরণীয় থেকে যাবে। তা না হলে এ ঘোড়ার ডিম লিখতে যাব কেন?

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

জহির হাসান: নতুন কবি আগের কবিদের স্টাইলরে নিতে পারেন, নাও নিতে পারেন। ভাবটা তার নিজের। এতএব আগের কবিদের লেখা পড়লে সুবিধা হয়, নতুন ভাবেরে কী কী জামা-কাপড়পরাইবেন!

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

জহির হাসান: স্টাইলে যারা নতুন তাদের অনেক পাত্তা দিই আমি। নাম ধরে ধরে বলতে পারব না।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

জহির হাসান: পশ্চিমবঙ্গের কবিতার ভাষা আর বাংলাদেশের কবিতার ভাষা এক না। ‘কবিতা মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আকতার’ লেখার সাহস ও বাস্তবতা থাকলেও তাদের সেই ভাষানাই। তবু উৎপলকুমার বসু তার মতো করে নিচতলার মানুষদের ভাষাটারে ওনার কবিতায় ভাসায়ে তুলতে চাইছেন।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে? লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি?

জহির হাসান: ব্লগে সেন্সর কম। তবু ব্লগেও গ্রপিং আছে তলে তলে। লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ কিনা বলা কঠিন। ব্লগ তো সেদিনের। আরও কিছুদিন যাক। তখন বলা যাবে কেগুরুত্বপূর্ণ।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

জহির হাসান: দৈনিকের সাহিত্যপাতা ময়দানি সাহিত্যের কবি, লেখক, নোবেল পুরস্কার, বুকার…এইসব জানার জন্য ভাল।