কৃষকের কথা বললেও কার্যত দল ও নেতাদের কল্যাণ ছাড়া কিছু ভাবে না বাম-রাজনীতির লোকেরা: কবি সমরজিৎ সিংহের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 16, 2012 10:49:17 AM

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

সমরজিৎ সিংহ: এই রে! বিপদে ফেলার চেষ্টা প্রথম থেকেই! কি উত্তর দেব? কেন লিখি? কোন কম্ম আমার দ্বারা হবে না, তা ছেলেবেলায় বুঝে গিয়েছিলাম। মা চেয়েছিলেন, হাকিম হই, আমি চেয়েছিলাম ডাক্তার হতে, বাবা চেয়েছিলেন, মানুষ হয়ে উঠতে... পরে টের পাই এর কোনটাই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পড়াশোনায়, স্কুল-লাইফে খারাপ ছিলাম, এ কথা আমার কোন শত্রুএ বলতে পারবে না। তারপরও কি যে হয়ে গেল। ক্যারিয়ার আর হল না। পাড়ার মাস্তান হলেও একটা দাম ছিল। রমণীমোহনও হতে পারলাম না, বেঁটে-খাটো ও মর্কট চেহারা জন্য। বাম-রাজনীতি করতে গিয়ে জলে খাটলাম, ঐ টুকুই সার। অনুধাবন করলাম, এই জগতেও খাঁটি দুধের চেয়ে দশ আনা জল মেশানো দুধের মূল্য অনেক বেশি। মুখে জনগণের কথা, শ্রমিক-মেহনতি মানুষের, কৃষকের কথা বললেও কার্যত দল ও নেতাদের কল্যাণ ছাড়া কিছু ভাবে না বাম-রাজনীতির লোকেরা, তা ১৯৭৪ ষালেই টের পেয়েছিলাম। ফলে ওসব ছেড়ে, কবিতার কাছে আশ্রয় নিই।

দু: কবিতা লেখার জন্য কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

স: প্রস্তুতি? কে কি বলবে, জানি না, সকল বিদ্যেটে যেমন দরকার, এখানেও তাই। চুরি করতে গেলে, আগেকার দিনে তালিম নিতে হত ওস্তাদের কাছে। কবিতার ক্ষেত্রে, ওস্তাদ কোথায়? কেউ ওস্তাদ নয়, আবার আমরা সকলেই ওস্তাদ। কবির প্রস্তুতি, তা বলে অন্যদের মত নয়। তাকে পড়তে হবে, কবিতার ইতিহাস ধারাবাহিক জানা থাকতে হবে। ঐ ধারাবাহিকতাই আসলে ওস্তাদ। বড় কবিদের কবিতা পড়লে নিজে কিভাবে লিখব, সেই পথ খুঁজে নিতে সুবিধা হয়। আর , হ্যাঁ , বাংলা ভাষাটা জানা থাকা চাই। তার মানে, নিশ্চয়, ব্যাখ্যা করতে হবে না। অনেকেই, আজকাল, লিখতে আসেন ভাষা না জেনেই, এটা খারপ লাগে। সমাস-সন্ধি-কারক-প্রত্যয়, অলংকার, ছন্দজ্ঞান বিনা কি লভিবে হায়। প্রস্তুতি বলতে এসবই জানি আমি। তাছাড়া, ভূগোল-ইতিহাস-রাষ্ট্রবিজ্ঞান-দর্শন-ন্যূনতম ধারণা ঐতিহ্য সম্পর্কে থাকা দরকার। কবিকে সর্বভূক বলা হয়ে থাকে, এই কারণেই, যে তিনি জ্যাোতির্বিজ্ঞানটাও জানেও। না হলে, শূন্যতা নিয়ে লিখতে গিয়ে, লিখে ফেলবেন প্রেমের কবিতা। তাও তো হয় না ঠিক মত।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

স: আপনার উদ্দেশ্য বকি বলবেন? আমি খুব ভীতু লোক। এই উত্তর দিতে গেলে অনেকেই রেগে যাবেন যে। আর সমসাময়িক মানে কি? আমার সমসাময়কি , না , এই মুহূর্তের কবিদের কবিতা? প্রশ্নটা স্পষ্ট নয় আমার কাছে। এটুকু জানাই, আমার ভাল লাগে (জীবিতদের মধ্যে, শঙ্খ ঘোষ, অলোক রঞ্জন, রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী, মণীন্দ্র গুপ্ত, নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, উৎপল কুমার বসু, নবনীতা দেবসেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কালী কুষ্ণগুহ, শঙ্খপল্লব আদিত্য, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, অমিতাভ গুপ্ত, অমিতাভ মৈত্র, রণজিৎ দা, কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, শ্রাম কান্তি দাশ, পূণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত, মৃদুল দাশগুপ্ত, গৌতম চৌধুরী, অনির্বান ধরিত্রীপুত্র, গৌর বন্দোপাধ্যায়, শংকর চক্রবর্তী, সোমক দাশ, অনুরাধা মহাপাত্র, গৌতম বসু, সৈয়দ কওসর জামাল, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্রায়, নতুল রায়, রাহুল পুরকায়স্থ, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, সংযুক্তা বন্দোপাধ্যায়, সুতপা সেনগুপ্ত, মন্দাক্রান্তা সেন, দীপশিখা পোদ্দার, মৌ সেন, মিতুল দত্ত, প্রবুদ্ধ সুন্দর কর, স্বাতী ইন্দু, পল্লাব ভট্টাচার্য, বিজয় সিংহ, গৌতম গুহরায়, অমিতাভ দেবচৌধুরী, স্বর্ণালী বিশ্বাস, সঞ্জয় চক্রবর্তী, অশোক দেব, মিলনকান্তি দত্ত, চিত্রভানু সরকার, রিমি দে, সেবন্তী ঘোষ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ব্রাত্য রাইসু, মজনু শাহ, মুজিব ইরম, সরদার ফারুক, কচি রেজা, পাবলো শাহী, টোকন ঠাকুর, এহসান হাবীব, শামীম রেজা, ওবায়েদ আকাশ, শুভাশিস সিংহ, মেঘ অদিতি, অপরাজিতা ফেরদৌস, খলিল মজিদ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, শাহনাজ মুন্নী, হিন্দোল ভট্টাচার্য, রূণা বন্দ্রোপাধ্যায়, জাহিদ সোহাগ, প্রীতি আচার্য... নাম বলতে গেলে ফেসবুকে মাল কুলেবে না... আরও অনেকে আছেন... কেন ভাল লাগে? বাহ্! এটা কোন প্রশ্ন হল? ভাল কবিতা যারা লেখে সবার কবিতাই আমার ভাল লাগে। লক্ষ্য করবেন, এঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা আছে, যা উজ্জ্বল ও সুন্দর তা তাদের চিহ্ণিত করে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

স: আর যাই হোক, এই প্রশ্নের উত্তর দেব না । আসলে কোনও উত্তর নেই এর। এটুকু বলতে পারি, কবিতা যা নয়, তা আমার ভাল লাগে না। ছদ্ম-কবিতার এত ছড়াছাড়ি... আর ভাই, কে আর হায় ভেজাল ভালবাসে।

দু: নব্বই বা শূন্য দশককে আপনি খুব কাছ থেক দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

স: নব্বই বা শূন্য দশক কেন বলছেন? আমি তো খুব কাছ থেকে সুনীল-শক্তিকেও দেখেছি। সত্তরের দশক তো আমাদেরই দশক। তাহলে ? ওহ্ বুড়ো, বলে, বাতিলের খাতায় ফেলে দিচ্ছেন? পুরনো চালে ভাত বাড়ে, জানেন তো? নব্বই বলুন, শূন্য বলুন, সবই পরম্পরা। আবহমান বাংলা কবিতার সুন্দর এক ধারা। বাংলাদেশে তো কবিতায় নতুন যুগ আনলেন তো আশির দশক থেকে সুব্রত-ব্রাত্যরা... তারপর, নব্বইয়ে এসে আমূল পাল্টে গেল কবিতার ভুবন। আমি জানি অনেকেই রে রে করে উঠবেন, এখন, সত্য যদি বলি, কবিতা লেখা হচ্ছে বাংলাদেশেই, তারপর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বায়তুল্লাহ কাদেরী, মুজিব ইরম, শামীম রেজা, মজনু শাহ বা ওবায়েদ আকাশের কবিতা পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি আমি। কচি রেজার অবিশ্বাস্য বেড়ালের নূপূর পড়ার পর, জাহিদ সোহাগকে জিগ্যেস করেছিলাম, কচি রেজা কি করেন? যা শুনেছিলাম, মাথা খারাপ হযে যাবার উপক্রম। এরকম আরও অনেকের কবিতাই আমাদের বাংলা ভাষার সম্পদ। মৌ-মিতুল-সেবন্তীরা, প্রবুদ্ধসুন্দর, অশোক-স্বাতী বা অমিতাভ দেবচৌধুরী-স্বর্ণালীদের কবিতা ছাড়া বাংলা কবিতার আলোচনা করা বাতুলতা মাত্র। শুন্য তো মাতাতে এসেছে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম গেলে শূন্য সম্পর্কে বলা উচিত।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

স: জল, মাটি ও আবহাওয়ায়।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

স: এই তো। আপনার সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ হল। মেঘ-অদিতি- অপরাজিতা, সরদার ফারুক-রাজন্য রুহানি, মৌ, নীল পরী- অন্তরীপ-জয়সি আরও কতজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। এটা কি কম প্রাপ্তি?

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

স: পাতা ভরানো আর বিনোদনকে আপনি গুরুত্ব দেন? আপনি আঙুল দিয়ে দেখাতে পারেন, তা হলে কবি বা লেখকরা এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কেন? ভাই টাকা। কবিও তো বাজার করে, মাছের দর নিয়ে গলদঘর্ম হয়, কনডোম আর বউয়ের জন্য ন্যাপকিন কিনতে হয় তার। সুতরাং টাকা দরকার। আর, ঐ পাতাগুলি টাকা দেয়, তারাও লেখে, দু হাজার শব্দের মধ্যে, আমাদের রাজ্যে অবশ্য আরও মজার ঘটনা ঘটে। এই পাতায় সাধারণত কেউ লিখে না। টাকা দেয় না যে। ফলে পুরানো লেখা পুন:মুদ্রণ, আর যশোপ্রার্থীদের লেখা নিয়ে চাইপাশ একটা পাতা বের হয়, যে গায়, তাকে দেওয়া হয়, যে রেগার কাজ করে তাকেও দেওয়া হয়, তা হলে, লেখক-কবিরা পাবে না কেন? একবার একটা দৈনিকে দারাবিহক রহস্য উপন্যাস লিখেছিলাম অনুরুদ্ধ হয়ে। রেসপন্স পাচ্ছিলাম খুব, দিল, মাত্র দু হাজার টাকা। সে থাক। এটুকু বলতে পারি অর্থ কামাইয়ের জন্য দৈনিকের পাতায় লেখা আর সাহিত্য আমার কাছ এক নয়।