সাজ্জাদ শরিফ স্বেচ্ছায় অবসরে যান কবি হিসেবে: কবি খালেদ হামিদীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 28, 2012 8:00:28 AM

কবিতার বই: আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো, হে সোনার এশীয়, মুখপরম্পরা, ধান থেকে শিশু হয়।

প্রবন্ধের বই: কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে

গল্পের বই: আকব্জিআঙুল নদীকূল

দুপুর মিত্র: আশির দশকের অন্যান্য কবিদের থেকে নিজেকে কিভাবে আলাদা করবেন?

খালেদ হামিদী: আমার স্বাতন্ত্র্য তো পাঠকই শনাক্ত করবেন। আমি নিজে কিভাবে বলবো? বিষয়ে ও বাকপ্রতিমায় প্রত্যেক কবি-লেখকই তো স্বতন্ত্র। তবে আমি আমার এ যাবৎ প্রকাশিত চারটি কাব্যগ্রন্থের শেষ দুটিতে আত্মরতির সীমানা পেরুতে চেয়েছি সচেতনভাবে। স্বমেহনের কাব্যই অব্যাহত রাখলে, আমি আস্থাশীল যে, এতোদিনে পরিচিতি, খ্যাতি ও প্রচারের শীর্ষে অবস্থান করতাম।

দু: মার্কসীয় সমাজচৈতন্য থেকেই আপনি কবিতা-গল্প লিখেন। এই কথাটি আপনি স্বীকার করেন? করলে কেন, না করলে কেন?

খা: অস্বীকারের তো কিছু নেই। সাহিত্য সমাজ বদলায় না, ঠিক। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সৃষ্ট সংবেদনগুলোই মাত্র অনূদিত হয় কবিতায়, ছোট গল্পে। উপন্যাসে তো খোদ ইতিহাসই কথা বলে কখনো কখনো। কিন্তু সাহিত্য আবার গণজাগরণকে উৎসাহিত, প্রভাবিত এবং এমনকি ত্বরান্বিতও করে। সেই রুশ বিপ্লবকেন্দ্রিক সাহিত্য তো আমরা বিস্মৃত হইনি। গোর্কির মা কি আর দ্বিতীয়টি লেখা হয়েছে? রুশ বিপ্লবের অর্জনকে তছনছ করে দেয়া হলেও এর সাহিত্যের আবেদন তো ফুরিয়ে যায়নি। সাহিত্যে নান্দনিকতার প্রতিষ্ঠিত ধারণাটি পুঁজিবাদী। লেখকের অঙ্গীকারের প্রশ্নে ধনতান্ত্রিক সাহিত্যকে, বিশেষত কাব্যকে, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির আত্মপ্রেম, আত্মরতি আর আত্মমুগ্ধতা ছাড়া আর কি বলা যায়? এঁদের মতো নয়া বামপন্থীরাও অতীত ভেবে হতাশ এবং অতীতের জন্যে উচাটন। মার্ক্সীয় নন্দন তাত্ত্বিক লুকাচেরও বিরোধিতা করেন বেনিয়ামিন এবং ব্রেশট। এনৎসেন্সবারগার তো বলেন, সত্যিকার দায়িত্ববোধ, অঙ্গীকার বা পরিবর্তন অতীতের জন্যে উচাটন থেকে আসবে না, আসবে বিদ্যমান দশাকে জেরা করার মাধ্যমে। আমি তাই করতে চাই। আপনাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই এজন্যে যে, আপনিই প্রথম আমার এই প্রবণতা শনাক্ত করেছেন হলফ করে।

দু: স্লোগান সর্বস্ব কবিতা কেন খারাপ কবিতা?

খা: খারাপ কবিতা আবার কি? হয় কবিতা নয় অকবিতা। তবে শ্লোগান যদি রাজনীতিক পদ্য বা ছড়া হয় তাহলে রাজনীতিসচেতন কবিতাকে রাজনীতিক দর্শনের কাব্যরূপ বলা যায়। কিন্তু শ্লোগান, বলা বাহুল্য, মোটেও কবিতা নয়। কেননা এর সৃষ্টি তাৎক্ষণিক উত্তেজনা বা প্রয়োজন থেকে। কবিতার ব্যঞ্জনা তো সুদূরপ্রসারী। সত্যিকার কবিতা পাঠককে অতীত বা বর্তমানমুখী করে রাখে না, উন্মুখ করে তোলে সমষ্টিগত স্বপ্ন ও ভবিতব্যের দিকে।

দু: কবিতায় গণমানুষের অনুভূতি আর ব্যক্তির অনুভূতির ফারাকটা কোথায়?

খা: ব্যক্তিকবির অনুভবেও, পরোক্ষে হলেও, সমষ্টিগত বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটে। ঘটাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যক্তিক অনুভবের প্রকাশ আত্মরতির অনুবাদ হয়ে উঠলে কাব্য-শিল্পের নামে তা গণবিচ্ছিন্নতাই প্রতিষ্ঠিত করে। বিচ্ছিন্নতার সাহিত্য তাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের প্রিয় পণ্য। নানা পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে এসব রচনার বাজার মূল্যও তাই আরও বাড়িয়ে তোলা হয়। গণমানুষের অনুভূতি নিয়েও এই বাণিজ্য করেন কোন কোন লেখক-কবি। হরিজন বা ব্রাত্যজনের লেখক হিশেবে পরিচিতি পাওয়া পুরস্কারপ্রাপ্ত বর্তমান কোন কথাসাহিত্যিকের ধরনে অদ্বৈত মল্ল বর্মণ কি নিজের শ্রেণীপরিচয় বিক্রি করেছিলেন? তবে কবিতায় গণমানুষের অনুভূতির বিষয়টি এসব থেকে আলাদা। নির্মলেন্দু গুণের মুজিব লেনিন ইন্দিরা নামের কাব্য আর সুকান্ত, বীরেন্দ্র কিংবা ব্রেশট-এর কবিতাসমগ্রের পার্থক্য তো আর ব্যাখ্যা দাবি করে না। লেনিনের ধনতন্ত্রীকরণ ঘটে গুণের কাব্যটিতে। গুণ যে পার্থক্যটা বোঝেননি, আপনার এই প্রশ্নের উত্তর তার মধ্যেই নিহিত।

দু: আপনাদের সময়কার মানে আশির কাব্য আন্দোলন নিয়ে কিছু বলুন।

খা: এ নিয়ে তো আমি একটা বই-ই লিখেছি, কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে নামে, ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এটি কয়েকটি দৈনিক ও একটি সাহিত্য পত্রিকায় আলোচিত-সমালোচিত হয়। বইটিতে আমি আশির দশ কবির কবিতার পর্যালোচনা লিপিবদ্ধ করি। আশি ও নব্বইয়ের দুই কবি আমার কবি-নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। বইয়ের সূচনাপ্রবন্ধে আমি কিন্তু বলেছি যে, আশির কবিদের মধ্যে যারা এখনো সক্রিয় আছেন এবং প্রতিক্রিয়াশীলতায় পর্যাবসান মানেননি তাঁদের মধ্য থেকেই দশজনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। এই মাপকাঠিতে অসীম কুমার দাস, বিষ্ণু বিশ্বাস এবং শোয়েব শাদাব বাদ পড়েন। কিন্তু তাঁদের ঐতিহাসিক অবস্থান আমি অস্বীকার করি না। আশির কাব্য আন্দোলন এর আগের চল্লিশ বছরের বিবরণধর্মী এলানো কবিতার আধিপত্য প্রায় নস্যাৎ করে দেয়। এতে এসে মেশে রাজনীতিক ও অরাজনীতিক নানান প্রবণতা।

দু: সে সময়ের তপন বড়ুয়া বা হালে আলোচিত সাজ্জাদ শরিফ,সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান উনাদের নিয়ে কিছু বলবেন?

খা: যদি বলি মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন, তাহলে আপনি কি বলবেন? যে তিনজনকে হালে আলোচিত বললেন তাঁদের অন্তত দুজনের কবিতা, খুব সম্ভব, প্রথমবারের মতো সিরিয়াসলি আলোচিত হয় আমার অই বইয়ে। প্রথমজন ছাড়া বাকি তিনজন তো আমার বইয়ে আলোচিত হনই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, সাজ্জাদ শরিফ আমার কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে বইটির রিভিউ করানো দূরে থাক, খবর পর্যন্ত ছাপেননি তাঁদের কাগজে। অথচ টেলিফোনে বলেছিলেন-আশির কবিতা নিয়ে এমন কাজ আর হয়নি। বইটি প্রকাশের পর থেকে সাজ্জাদ আমাকে সার্বিকভাবেই পরিত্যাগ করেন। এই আচরণ আসলে হাস্যকর। ওদিকে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজও সিলেট থেকে প্রকাশিত একটি ছোট কাগজে, ৫/৬ বছর আগে, বাংলা ভাষার আদি রূপ ও ব্যবহার নিয়ে আমার কাছে ইমেইলে পাঠানো তাঁর বক্তব্য আমার নিজের বলে একটি বুক রিভিউতে আমি চালিয়ে দিয়েছি মর্মে বিশ্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হা হা হা। এরও বেশ কিছুদিন পরে আমার একটি গল্প পড়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁর অই কৃতকর্মের জন্য তিনি দুঃখও প্রকাশ করেন ইমেইলে। কিন্তু এসবের পর থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এঁদের অকৃতজ্ঞতায়, আত্মম্ভরিতায় এখন আমার খুব হাসি পায়। তবে সুব্রত আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো-র ওপর ভালো আলোচনা লিখেছিলেন একবিংশে, আমার প্রবন্ধের বইটিও বেরুবার আগে। সাজ্জাদ শরিফ স্বেচ্ছায় অবসরে যান কবি হিসেবে। সুব্রত থেকে যান আত্মবৃত। মাসুদ খান হয়ে পড়েন গগনবিহারী, মৃত্তিকাবিচ্ছিন্ন। প্রবাসী এই দুই কবিই নিজ নিজ দেশ ও মানুষের অভিজ্ঞতাশূন্য অবস্থায় আত্মঅনুবর্তনময়।

দু: আপনার আকব্জিআঙুল নদীকূল গল্পগ্রন্থ নিয়ে হরিপদ দত্ত বলেছেন, কবিতার দুঃসাহস হচ্ছে, যখন তাঁরা চিরচেনা কাব্যের রেলস্লিপার পাশে ফেলে গদ্যের অন্য স্লিপারে পা ফেলে অন্য দিগন্তে পা রাখেন, কবিতার আত্মগূঢ়তার জটিল বৃত্তটা তখন ভেঙে যায়। আপনি কি উনার সাথে একমত? একমত হলে কেন, না হলে কেন নয়?

খা: দ্বিমত পোষণের কি কোন সুযোগ আছে? কবিতা সবসময় আত্মগূঢ়তার জটিল বৃত্ত না হলেও এতে কথা বলার সুযোগ অনেক কম। কবিতায় যা বলা যায় না তা নিশ্চয়ই বলা যায় গল্পে। একজন কবির লেখা গল্পে যদি কবিতার প্রভাব না থাকে তাহলে শ্রদ্ধেয় হরিপদ দত্তর মন্তব্যটি পুরোপরোই সঠিক প্রমাণিত হয়।

দু: কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগকে কেন আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?

খা: ঠিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করার ব্যাপার নয়। আমি নিজে কি এ যাবৎ আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখেছি? আরেকটা কথা, ঢাকা শহরে প্রচলিত কথ্য ভাষা আর আঞ্চলিক জবান এক নয় মোটেও। প্রত্যেক অঞ্চলের ভাষা সেই অঞ্চলের মানুষদের মাতৃভাষা। প্রমিত ভাষা ঠিক শাসকদের ভাষা ছিল না। কোন কোন আঞ্চলিক ভাষার সর্বজনীন যোগাযোগ–অক্ষমতার কারণে মানুষ নিজেই সর্বজনবোধ্য একটি প্রমিত ভাষা সৃষ্টি করে নিয়েছে। জোসেফ স্তালিনও বলেছেন, কোন ভাষাই কোন বিশেষ শ্রেণীর প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়নি। তা কোন জনগোষ্ঠীর দীর্ঘকালের ইতিহাস, ভূগোল এবং জীবন-সংগ্রামের সামগ্রিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল। তবে একটি ভাষা অপর ভাষাকে অস্বীকার করলে, খারিজ করতে চাইলে তখন আধিপত্যবাদী ভাষার শাসক-চরিত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন অনিবার্য হয়ে ওঠে, হওয়া উচিত, যেভাবে ১৯৫২ সালে আমরা অতুলনীয় ইতিহাস গড়েছি। তবে পরোক্ষ অর্থনৈতিক এবং প্রত্যক্ষ প্রযুক্তিগত সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের কবলে, আমাদের গ্রামবাংলা ভাষাসমেত ধ্বংস হতে চলেছে। তাই গ্রামাঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে কোন কবি এই আগ্রাসনের বিরোধিতা করলে আমি অভিনন্দন জানিয়ে থাকি।