বামপন্থিরাও সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রগতিশীলতার সনদপত্র বিতরণ করেছে: আনন্দ মজুমদারের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 9, 2012 10:27:38 AM

আনন্দ মজুমদার,কবি।

দুপুর মিত্র: সাহিত্য কি মার্কসবাদী এরকম করে শুরু করা উচিত?

আনন্দ মজুমদার: সাহিত্য আর দর্শনের সম্পর্ক ও পার্থক্য সম্পর্কে সাবধান থাকা দরকার। দর্শন বা কোন ভাবাদর্শের পায়রুবি করার গোঁড়ামির একটা কাল গেছে। “ মার্কসবাদী” সাহিত্য নামে যা কিছুকে অভিহিত করা হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে রচিত সাহিত্য বা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে সকল সাহিত্যিক উঠে এসেছেন তাঁদের সাহিত্যকে বোঝানো হয়েছে। একটা সময় ছিল এইসব সাহিত্যের আড়তদারি করতেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েতের লেজুড় পূর্ব ইউরোপীয় কতগুলো দেশের সাহিত্য। মার্ক্সবাদী সাহিত্য জিনিসটা কী তা সাহিত্য ও রাজনীতির দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে। যে সব সাহিত্যের প্রকল্পের মধ্যে চেতনা জাগানোর বা কোন ঐতিহাসিক কালপর্বের ন্যায্যতা দানের প্রকল্প সৃজনশীলতার মুল নিয়ামক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়, সেগুলো সাহিত্য আকারে পড়া আমার জন্য কঠিন। আবার কোন ঐতিহাসিক পরিবর্তন, বাঁক, বিপ্লবের লক্ষণ, ইংগিত, ঠার, সাহিত্যে আগে ধরা পড়ে। কালের বয়ান, সমকালকে চিরকাল করে তোলার কাজ, সমসাময়িকতার ঐতিহাসিকতা, বা ঐতিহাসিকতাকে সজীব ও জীবন্ত রূপে বর্তমান করে তোলার কাজ সাহিত্য করে। মার্কসবাদী সাহিত্য নামক ধারণার সাথে আমি একমত নই। সাহিত্যের কাজ দর্শন চর্চা নয়, যদিও সাহিত্য দর্শন ও চিন্তাশূন্য হতে পারে না। দর্শনের দায় ব্যাখ্যা করা। মার্ক্সবাদী সাহিত্যের সেই কালে এই ধারার সাহিত্য কর্মের মধ্যে এক ধরণের প্রোপাগান্ডা থাকে, সাহিত্যে বা সাহিত্য নিয়ে।

দু: অনেকে সাহিত্যকে মার্কসবাদী মেনিফেস্টো আরোপ করে চর্চা করতে চায় আবার অনেকে বলেন মেনিফেস্টো দ্বারা সাহিত্য রচনা করা উচিত নয়। আপনার কি মনে হয়?

আ: সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে আঁটোসাঁটো হয়ে মার্কসবাদী নামক সাহিত্য রচনা করা ছাড়া আর তো কোন উপায় নাই। মার্ক্স, মাও জেদুং বা বিপ্লবীদের প্রেম, দ্রোহ, বৈপ্লবিক রোমান্টিসিজম নিয়ে তাঁদের রচিত, কমরেডদের হাতে রচিত সাহিত্য পড়ে আনন্দ পেয়েছি। গোর্কি বা আন্তন মাকারেঙ্কো পড়ে সাহিত্যের দুই ধারা বুঝতে পেরেছি। সৌমেন চন্দ বা সুকান্তকে মার্ক্সবাদী সাহিত্যর উদাহরণ হিসাবে টেনে আনা ঠিক হবে না।

কোন দর্শনের প্রচারক সাহিত্য হতে পারেনা। এই তর্ক সাহিত্য নিয়ে উঠছে এই কারণেই যে দুনিয়াজোড়া শিল্প ও সাহিত্য আন্দোলন নিয়ে আমাদের দেশে গভীরভাবে জানা বোঝার কাজটি হয়নি। সাহিত্যের নিজের লড়াই থাকে। মডার্নিজম, উদাহরণ হিসাবে বলছি, আধুনিকতার পর্যালোচনা, রোমান্টিসিজম গোঁড়ায় একটি পুঁজিবাদবিরোধী লড়াই। নন্দনতত্ত্ব ও মানুষ, সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্বের যে ঐতিহাসিক লড়াই, সেই লড়াই নিয়ে অসচেতনতা থেকেই কোন দর্শনের প্রকল্প থেকে সাহিত্য রচনা শুরু। যিনি রচনা করেন তাঁর দর্শন থাকতেই পারে। আসলে মার্ক্সবাদী সাহিত্য বলে যে কিছু আখ্যায়িত করার মধ্য দিয়ে সাহিত্য ও ভাবাদর্শের সম্পর্কের দিকগুলো খোলা মনে পর্যালোচনার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। মানিক এই ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ। কোন দর্শনের দাসত্ব না করেই কী করে “ নিপীড়িত” মানুষের সাহিত্য হয়ে উঠে, তা তিনি দেখিয়েছেন। সোভিয়েত রাশিয়ায় তলস্তয় নিয়ে বিতর্ক তো আমরা জানি।

সাহিত্যে মার্ক্সবাদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। এটা মেনে নিচ্ছি। এর আরও গোঁড়ায় যাওয়া দরকার, শুধু নিপীড়িত মানুষের লড়াই, শ্রেণী দ্বন্দ্ব নয়, সাহিত্যের প্রাক পুঁজিতান্ত্রিক এলিটিসিজম বা কান্টিয় নন্দনতত্ত্বের নন্দনতাত্ত্বিক Hiearchy or cultural eliticism ভাঙার ব্যাপারটাও পুঁজিতন্ত্রের দগদগে ঘা উন্মোচনকারী “ সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের মধ্যে সংস্কৃতি ও রুচি উৎপাদনের যে কালপর্ব ( যা এখনো চলছে) তার বিরুদ্ধে লড়াই আকারে হাজির হাজির হয়েছিলো। এটা "NewHistoricism" ও "Cultural Materialism" তৈরি করেছিল। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বাইরেও এই কালের অনেক সেরা সাহিত্য এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তৈরি। ইতিহাসই বিরচিত হয়েছে। এলিয়ট আধুনিকতার আগাপাছতলা ধোলাই করেছেন। হোমার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলো। কিন্তু “ মার্ক্সবাদী” নন। সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা অর্থ উৎপাদনের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।

দু: এমন অনেকেই বলেন রাশিয়াতে একসময় এমন অবস্থা ছিল যে বল হথ কারও বই রাশিয়াতে ১ ফর্মা প্রকাশ হলে সেই বইই দেশের বাইরে ৩ ফর্মা প্রকাশিত হত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের খবরদারি ছিল অনেক বেশি। যা সে সময়ের লেখকরা মানতে চাইতেন না। আবার এমনও হয়েছে অনেক লেখককে দ্বীপান্তরিত করা হয়েছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রশ্নে এই মার্কসবাদী সরকার ব্যবস্থা কি আদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত হতে পেরেছে?

আ: মার্ক্সের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো একটি সাহিত্য। মার্ক্স কবিও ছিলেন। মার্কসবাদী প্রভাবের ব্যাপারটা ত্রিশ, ষাট দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত নানাভাবে আলোচনায় এসেছে। সমাজতান্ত্রিক রিয়্যালিজম, নিউ রিয়েলিজম বা ইম্প্রেশনিজম বা অন্যান্য বিমূর্তবাদের পাশাপাশি ও একসাথে বেড়ে উঠতে থাকে। ভারতের সুন্দরাম ও উমাশঙ্কর যোশীর কথা মনে পড়ে। হিন্দি, উর্দু ও বাঙলা সাহিত্যে এর প্রভাব অপরিসীম। মোহন রাকেশের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যশপাল সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম থেকে হিউম্যানিস্ট হয়ে উঠছেন। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠির কথা আর নাই বা বললাম। ফৈয়াজ আহম্মেদ বা মুলুক রাজ আনন্দের লেখালেখিতে এই ছাপ স্পষ্ট। আমাদের নজরুল ও ফররুখ এই সাহিত্যের আদর ও ঘাড় ধাক্কা দুটোই খেয়েছেন। নজরুল ও ফররুখ দুইজনই কমিউনিস্ট সংস্পর্শে বিকশিত। ইসলামী গান বা সাহিত্য ( মুসলিম সাহিত্য নামে যা আলাদা করা হয়, সেই আলাদাকরণটাও এক ধরণের সাম্প্রদায়িকতা) করে টিকে গেছেন। বাংলাদেশের বামদের রোষানলে পড়ে ফররুখ শেষ। সাদত’ হোসেন মান্টো বা তাঁর কালে আরও বেশ কয়েকজন গল্পকার ও উপন্যাসিক রাষ্ট্রের উপনেবেশিকতা ফালা ফালা করে চামড়া তুলে আমাদেরকে দেখাচ্ছেন। মুশকিল হচ্ছে, কমিউনিস্ট পার্টি বা রাষ্ট্রের খপ্পরে পড়ে অনেক ভালো সাহিত্য সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের মর্যাদা পায়নি। নজরুলের সাহিত্য তো সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য নয়। তার মানে রাষ্ট্রের সাহিত্য হয়ে উঠতে হয়েছিল।

ফরাসী দার্শনিক Paul Ricouer মার্ক্সবাদী সাহিত্যকে "hermeneutics of suspicion” বলেছেন। এটা তার বেশী বেশী কড়া সমালোচনা। আদর্শের বেসাতি করা আর কোন সাহিত্যে আদর্শ থাকা এক ব্যাপার নয়। সাহিত্যের মধ্যে আদর্শ থাকবে নীরব; পুকুরে মাছের মতো। সাহিত্যে মতাদর্শ দৃশ্যমান হলেই বিপত্তিটা ঘটে। মূল্যবোধ বা ভাবাদর্শ সাহিত্য উৎকটভাবে প্রকাশ করলে বোঝাই যায় এই সাহিত্য প্রচারণা যন্ত্র। আধিপত্যশীল শ্রেণীর "false consciousness” এর দিকে মার্ক্স ইংগিত করেছেন। এই অবস্থাকে উন্মোচন করাই তো সাহিত্যের কাজ। জগত সাহিত্যের মধ্যে নিজেকে উন্মোচন করে। স্ট্যালিনের আমল থেকে শুরু করে ব্রেজনেভ পর্যন্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভেতরে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন লেখকেরা।

আদর্শ যখন কালের হাওয়া হয়ে যায়, তখন সেই হাওয়ার দিক ও দিকচক্রবালে পর্যালোচনার হিন্মত নিয়ে হাজির হওয়াও বৈপ্লবিক কাজ। সাহিত্য একটা নতুন চিহ্নব্যবস্থাও; Hegemony ও Power discourse এর দিক থেকেও সাহিত্যকে দেখা যেতে পারে। বৃহত্তর মানুষের কথা, চিন্তা, সাংস্কৃতিক চর্চা, কাব্য এবং এদের বাস্তবতার উন্মোচন, বয়ান সাহিত্যের অংশ হয়ে উঠতে হবে। গ্রামসি সাহেব এই নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। ট্রটস্কি সাহেব মার্ক্সীয় নৈতিকতা ও নন্দনতত্ব্ব নিয়ে অনেক জারিজুরি বকেছেন। যে লেখক সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার বিরুদ্ধে তাকে ধারণ করতে অক্ষম সমাজে যে সৃজনশীলতাকে কফিনবন্দী করেছে, তাতে কোন সন্দেহ নাই। মায়াকোভস্কি আর আল্লামা ইকবালের তুলনা করা যেতে পারে। দু’জনই লেলিন নিয়ে কবিতা লিখেছেন। ইকবাল মরুভূমিতে টিউলিপ ফোটানোর মতো কবি। সাংস্কৃতিক উৎপাদনশীলতা ও দুনিয়ার ভোক্তাদের কাছে হাজির করার কাজ “ সমাজতান্ত্রিক” ও পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়ার লড়াই আকারে দেখাই ভাল। আপনার প্রশ্নটি অনেক দিকে ইংগিত দিচ্ছে।

নেরুদা বা হিকমতের কবিতা ভীষণ রোমান্টিক। বিপ্লবীও। মজার ব্যাপার হল, বাংলাদেশে মার্ক্সবাদী সাহিত্যের খুব বেশি উদাহরণ নেই। এখানে একটা জগাখিচুড়ি ব্যাপার হয়েছে। জাতীয়তাবাদী সাহিত্যগুলো মার্ক্সবাদীদের পাঠের বিষয়। এই ক্ষেত্রে ইলিয়াসের গুরুত্ব মার্ক্সবাদীরা ধরতেই পারেন নি।

হাসান আজিজুল হক বা লেখক শিবিরের লেখকদের মূল্যায়নটাও করা হয়ে উঠেনি। হাসান আজিজুল হক ছাড়া অন্যদের নিয়ে মাতামাতিও তেমন নাই। নগরের বাইরে, উপনিবেশ বিরোধী সাহিত্যগুলোর দিকেও খুব বেশী নজর দেয়নি বাঙালি মধ্যবিত্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই এখানকার বামপন্থীরাও সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রগতিশীলতার সনদপত্র বিতরণ করেছে।

রোবার্ট কনকোয়েস্টের ১৯৬৮ সালে রচিত গ্রেট টেরর বইটির পাতা আবার উলটে দেখা যেতে পারে। তাঁর বইটির মাধ্যমেই ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড শব্দটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় মস্কো ট্রায়ালের শিকার অনেক বরেণ্য কবি, শিল্পী। ১৯২০-১৯৩০ এর মধ্যে প্রায় ২০০০ কবি সাহিত্যিক লেখকদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে ১৫০০ জন ক্যাম্পে মারা যান। এই ক্ষেত্রে স্মরণীয় বিখ্যাত কবি অসিফ ম্যান্ডেলস্টান। তাঁকেও গ্রেফতার করার আদেশ দেয়া হয়েছিলো। বরিস পাস্তারনায়েকের হস্তক্ষেপে তিনি জানে বেঁচে যান।

দু: বাংলাদেশে মার্ক্সবাদী সাহিত্যের খুব বেশী উদাহরণ নেই। এখানে একটা জগাখিচুড়ি ব্যাপার হয়েছে। জাতীয়তাবাদী সাহিত্যগুলো মার্ক্সবাদীদের পাঠের বিষয়। এই ক্ষেত্রে ইলিয়াসের গুরুত্ব মার্ক্সবাদীরা ধরতেই পারেন নি। আপনার এই কথাগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে আগ্রহী ।

আ: বাংলাদেশের মার্কসবাদী সাহিত্য বলতে যা গড়ে উঠেছে তার মধ্যে শ্রমিক –কৃষক আন্দোলন নিয়ে, তেভাগা নিয়ে, গোপন দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে অল্প কিছু উপন্যাস, গল্প ছাড়া বিশেষ কিছু নজরে পড়ে না। সাহিত্য সম্পর্কে আমার যতোটুকু জানা-বোঝা আছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রাম চোখে পড়ার মতো করে গল্প উপন্যাসের বিষয়বস্তু হয়ে উঠে নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই তো তেমন বড়ো কোন কাজ হয়নি। গরীবকে নিয়ে লিখলেই গণমুখী জীবন ঘনিষ্ঠ সাহিত্য হয় না; বাংলা চলচ্চিত্রের সেলুলয়েডের মতো শ্রেণী সংগ্রাম প্রদর্শন করলেই ভালো সাহিত্যের নজির হতে পারে না। আমাদের সাহিত্য আমাদের ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করে না। সাহিত্য “ জাতীয়তাবাদী” , “মার্ক্সবাদী” এইভাবে ভাগ করার মধ্য দিয়ে শিল্পের অন্তর্নিহিত কাঠামো, শৈলী ও সৃজনি প্রাণশক্তির বিনাশ ঘটে। সাহিত্যের জমিন কাল, কালে কালে আবির্ভূত ইতিহাস, কালের স্পন্দন, ইতিহাসের গর্ভবতী লক্ষণ টের পাওয়া। গরীবের জন্য আহাজারি মানেই ভাল সাহিত্য নয়। ষাট দশকে ইতিহাসের অভিমুখ গণতন্ত্রের দিকে। সেই সময় জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন কম্যুনিস্টদের কাছে এক পর্যায়ে অমীমাংসিত ডিসকোর্সে পরিণত হলো যদিও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বাম প্রগতিশীলদের অনন্য সাধারণ নিয়ামক ভূমিকা রয়েছে। সেই সময় কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রবল ছিল। কিন্তু সেই সংগ্রামের বয়ান সাহিত্যে নাই। থাকলেও সেটা ছিটেফোঁটা। জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ের পটভূমি সাহিত্যে বেশ ভালোভাবেই প্রকাশিত হল। ফলে, মার্ক্সবাদীরা “ দেশপ্রেমের” ধারায় রচিত সাহিত্যগুলোকেই নিজেদের পাঠের বিষয় করে তুলল।

ইলিয়াস ইতিহাসের ধুকপুকানি তার চিলেকোঠার সেপাইতে টের পেয়েছেন। লড়াইয়ের অভিমুখ তার চরিত্রের মধ্য দিয়ে বয়ান করছেন। তাঁর চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭) ও খোয়াবনামা (১৯৯৬) যেই কালকে ধরছে সেই কালের ক্যানভাসটা ইতিহাসকে বর্তমান করে তুলছে। সেই কালের বয়ানে সমসাময়িকতা ধরছেন । এটা বিশাল ব্যাপার। পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে তাঁর খোয়াবনামা। উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে লিখা। এই অঞ্চল কৃষক আন্দোলনের জোয়ারে ফুঁসেছে, কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ঘাঁটি। আবার একই অঞ্চলে ইসলামের জয় জয়কার।বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক মেরুকরণের, পক্ষাবলম্বনের এক জটিল মনস্তত্বের প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাস। ইলিয়াসের এই উপন্যাসের মর্মার্থ বুঝতে বামপন্থিরা বুঝতে পারবে না। সমাজের বাইরের কোন ভাবাদর্শ “ শ্রেণী সংগ্রামের” লড়াইয়ে তখনই প্রাসঙ্গিক হয়, গ্রহণযোগ্য হয়, যখন লড়াই এই ভাবাদর্শের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কুটুম্বিতা পাতায়। কাগমারি সম্মেলনের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক এজেন্ডাগুলোর সাথে বামদের যে সম্পর্ক, তার রূপায়ণ বামেরা করতে পারেন নাই, করেছেন ইলিয়াস।

আগামীর অগ্রসরমান আঁধারে যদি আলোর দেখা পেতে হয় তবে প্রতিটি আন্দোলনের জাতীয় চরিত্রের মধ্যে শ্রেণীসত্তা ও কোন এক শ্রেণীর শোণিতে অন্য কোন শ্রেণীর সগৌরব জাগরণ পরিলক্ষিত হয়। জাতীয় চেতনা যে সব সময়ই “ শ্রেণী নির্বিশেষ” নহে, অভিজ্ঞতা কয়, এটা বোঝা জলবৎ তরলং। জাতীয়তার দাপটে শ্রমিক, কৃষক, জমিহারা ভূমিহীন, খুদে ঋণের ফলে খোদ্গারির ফজিলতে খোরাকির চালে টান, পোষ্যদের ক্ষুধাকাতরতার কাছে অশ্রুকাতর আত্মসমর্পণ, চোখের পানি গোপন করে মান সম্মান বিকিয়ে দেয় যে মানুষ, সেই মানুষরা, যারা এক অনড় বৈষয়িকতার মধ্যে বন্দী যে মানুষ, সেই মানুষদের কথাই বলছেন ইলিয়াস। সেই ইতিহাস বাম প্রগতিশীলরা এড়িয়ে চলেছেন, চলছেন।

জাতীয় স্বার্থ ও শ্রেণীগত স্বার্থের মধ্যে অন্তর্গত বিরোধ যে-ই মাত্রায় হ্রাস পায়, সে-ই মাত্রায় কোন শ্রেণীর শাসন জনগণের জন্য অধিকতর শ্রেয় হয়ে ওঠে। এটি সাধারণত ঐতিহাসিকভাবে চিরায়ত বুর্জোয়ারা বুঝত।

খেয়াল করুন, পরিচয়ের রাজনীতির “ বাঙালি মুসলমান” পর্বের মধ্যে দ্বন্দ্বগুলো আমাদের ইতিহাসের অংশ হিসাবে রাজনৈতিক দিক থেকে সাহস করে যথেষ্ট পর্যালোচনা হয়নি। ১৯৪৭ সালে যে বাঙালী কবিরা কায়েদে আজমের গুণগান গাইছেন কবিতায়, তারাই তাঁকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইলিয়াস ইতিহাসের সাক্ষ্যদাতা নন, তিনি ইতিহাসের অন্তর্গত সংকট তাঁরই লিখায় “ স্থূল বস্তুবাদীতার” গণ্ডির বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরছেন। তাঁর চিলেকোঠার সেপাইতে স্বাধীনতা আসছে, রূপান্তর অনিবার্য। এই রূপান্তরের রূপায়ন খুব বেশী উপন্যাসে নাই, ঘটে যাওয়া ঘটনার বয়ান আছে।

বাংলাদেশকে জননীরুপে না ভাবলে ১৯০৫ সালের বিপ্লবীদের চেতনা জাগত না। দেশপ্রেমের সব বয়ান এই জননীমূলক বিমূর্ততা থেকে উৎসারিত। মানুষ ও প্রকৃতির, নাগরিক ও পরিবেশের দিক থেকে রাষ্ট্রের সাথে এই পলিপ্রধান মায়ের শরীরের সম্পর্কের দিকে তাকালে বোঝা যায় দখল ও ধ্বংসের সম্পর্ক ছাড়া এই রাষ্ট্র ও রাজনীতির আর কোন সম্পর্ক নাই। মায়ের গায়ের সকল গয়না- হাওড়, নদী, বন- খুলে নিচ্ছে এই দখলতোষণ ও গুন্ডাপোষণকারী রাষ্ট্র ও রাজনীতি। অবাধে যে বিচরণশীল প্রাণী ও মাছ, সটান দণ্ডায়মান বৃক্ষ সব শেষ করে ফেলেছে। তা’হলে দেশপ্রেমিকের দাস হয়ে গেছে মা। মা কী করে দাসেরে মনে রাখবে! দেশের সংগে জননীমূলক দাস্যভাব কিংবা প্রণয়ণীমূলক লাস্যভাব তৈরি করার যে রাজনীতি সে-ই রাজনীতির ধারে কাছেও নাই বামেরা। ইলিয়াস চরিত্রগুলোকে দেখাচ্ছেন। বাঙালিদের চিনিয়ে দিচ্ছেন। তিনি শ্রেণী দ্বন্ধ ও বৈষম্য প্রকট করে তুলছেন না, পাঠক কিন্তু টের পেয়ে যাচ্ছেন। তাঁর গল্পগুলো পড়লেই বোঝা যায়। ইতিহাসের দায় ও শাপমোচন কী করে হচ্ছে! ইলিয়াস তরতাজা মানুষের গল্প বলছেন। ইলিয়াসের গল্প পড়লেই বোঝা যায় , বাম আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা কোথায়?

সাহিত্য ও রাজনীতির সম্পর্কের দিক থেকে ষাট দশকের একটা পর্যালোচনা দরকার। সাহিত্য দর্শন বা ইতিহাসগ্রন্থ নয়। ১৯৪৭ পূর্ব বা পরে সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য নামে বা মার্ক্সবাদী সাহিত্য কেরালায়, পশ্চিম বাঙলায় কিছু কিছু দেখেছি। অন্ধ্র ও কেরালার কিছু কিছু সাহিত্য, মালায়লাম ভাষার কিছু কিছু সাহিত্য অসাধারণ। একটা ভয়াবহ ব্যাপার হল এই অঞ্চলের সাহিত্যের সাথেই আমাদের চিন পরিচয় গড়ে উঠেনি। এই বাংলাদেশেই এক সময় আরবি-ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যের চর্চা ছিল। এখন নাই। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশের প্রতি অতি অনুরক্ততা, যা ফ্যাসিবাদেরই আরেক রূপ, আমাদেরকে এই সব সাহিত্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। উপমহাদেশীয় বিভিন্ন ভাষায় রচিত সাহিত্যের প্রতি আমরা চরম অবিচার করছি। বিহারে, অন্ধ্রে , কেরালায় ল্যাটিন আমেরিকার সমকক্ষ সাহিত্যের দেখা পাই। দুই বাংলায় দুই আজিজুল হক সাহিত্য কী করে ইতিহাস আত্মস্থ করে সেই পথ দেখিয়েছেন। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তানের সাহিত্য আমাদের এই বৃহত্তর অঞ্চলের ভাব, ভাষা ও সাহিত্য। মুসলমান বা হিন্দুরা নিজেদের ঐতিহ্যকেই “ হিন্দু” বা “মুসলিম”বলে ত্যাগ করে নিজেদেরকেই দরিদ্র করে রেখেছে। সর্ব ভারতীয় সাহিত্য ও শিল্পকলা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা দরকার। সব ভাষার সাহিত্য, গান, ভাব, সুর, চিন্তা, দর্শন, জীবনচর্চা নিয়ে গবেষণা হবে। এটাই চাই। এছাড়া গড়ে উঠবে দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়; কম্বোডিয়ান ও ভিয়েতনামের, বার্মার ও থাইল্যান্ডের সাহিত্যের পাঠ ও পর্যালোচনা দরকার। নিজের প্রতিবেশীর সাহিত্য না পড়লে নিজেদের সাহিত্য বিকশিত হতে পারে না। শরত বাবু সহ আরও অনেকের লিখায় বার্মার কথা এসেছে। বার্মার সাথে আমাদের নানা দিক থেকে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। অথচ, আমরা সাহিত্যের ঐতিহাসিকতা উপেক্ষা করেছি। ঐতিহাসিকতার মধ্যে সাহিত্য কী কী ধারণ করেছে, সেটা বিস্মৃতপ্রায়। বাংলা কবিতার ক্ষমতাকেই খর্ব করা হচ্ছে এখন। কবিতার ইতিহাসের সাথে, পদ্যভাষা ও চিন্তার সাথে কোন সম্পর্ক ছাড়াই কাব্য হচ্ছে!!

বাংলার ঘরে ঘরে বিষাদসিন্ধু,কোরান শরীফ যেমন থাকে রেহালে। থাকে ঠোঁটেঠোঁটে তোতাপাখি। দুল দুল থাকে। থাকে রহস্য থাকে দেয়ালে দেয়ালে। ফুল তোলা ফ্রেমে ফ্রেমে। বাংলার ভাব, চিহ্ন – যা কিছু আছে সেগুলো রাজনৈতিকভাবে আত্মস্থকরণের সময় খুবই সাবধান থাকতে হবে। পশ্চিমা ঔপনেবিশিকতা এতো প্রকটভাবে আমাদের চিন্তার উপর আছর করেছে যে এ থেকে মুক্তির জন্য তীব্র লড়াই দরকার। আমাদের অপার সম্ভাবনা আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এই অপার সম্ভাবনা পয়ারাশ্রিত করাই আমার কাজ। আমি সে-ই বাংলার কবি, যিনি নিজেকে বাঙালি বলে গর্ববোধ করে না আর। এই শব্দটি এখন রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছে। এই শব্দের মাহাত্ম্য শেষ। আমি নিজেকে সর্বজনীন মানুষের প্রতিনিধি ভাবতে চাই নিজেকে বাঁচানোর জন্য। আমি এমন কাব্য রচনা করতে চাই যা মানুষ রেহালে রাখবে। গিলাফে ঢেকে রাখবে। কাব্যের অপরিসীম শক্তি তাঁতির বুননে, কৃষকের লাঙ্গলের ফলায়, ঘামে জবজবে শরীরে প্রাণ সঞ্চার করে। কাব্যের অন্য কোন কাজ নাই। অন্তত আমার কাছে নাই। অন্য কবিদের কাছে থাকতে পারে। আমার কাছে কবিতা হচ্ছে সকল ধরনের অন্যায় –অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কবিতা মিছিলে মানুষের সংখ্যা বাড়ায়। কবিতা মানুষকে শহীদ হবার অনুপ্রেরণা দেয়। কবিতা ইতিহাসের প্রতি আমাদের দায়-দেনা কর্তব্য মেটায়। কবিতা পদ্যে ইতিহাসের চর্চা।

নজরুল যদি সুস্থ থাকতেন তা’হলে তিনি নিশ্চয়ই আমার কমান্ডার হতেন। কাব্যের শেষ দশা সার্বভৌম সত্তার পরিপূর্ণ আত্মস্থকরণেই সম্ভব। বাগ ও পঙক্তির চাতুর্যময় কবিতার খুব একটা দরকার আর নাই। নজরুল তা আমাদের শিখিয়েছেন। শুধু কবিতা লিখা কোন কাজের কাজ হতে পারে না। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তা আমাদেরকে শিখিয়েছেন। যে কবির সাথে ফসলের সম্পর্ক নাই, উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতি মুহূর্তে যে কাব্য তৈরি হচ্ছে, তার খোঁজ রাখেন না, তিনি কবি নন। কবি প্রকৃতির অভিধানে শব্দ খুঁজেন, ইতিহাসের মধ্যে ভাষা অনুসন্ধান করেন। আসুন রূপকের চাতুর্য থেকে কবিতাকে মুক্ত করি।

বস্ত ও ভাবের দ্বিখণ্ডকরণের ফাঁদে আমরা পা দিতে পারি না। বিরাজগুণের দশার মধ্যে আটকে পড়লেও দিশাহারা হয়ে পড়তে হবে। তবে কবি হিসাবে বিরাজগুণ অস্বীকার করি না। কোন কিছুকে প্রমাণ করা কবির কাজ নয়। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কূটতর্কে না গিয়ে কবির কাজ সত্যাগ্রহী হয়ে উঠা, জগতের সাথে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত অভিব্যক্ত সত্য চিনে ফলে। কোন কিছু সঠিক হলেই সত্য হয় না। ঠিক মনে হলেই করণের ন্যায্যতা তৈরি হয় না। কোন কিছু করার ন্যায্যতা তার সঠিকতার উপর সবসময় নির্ভর করে না। কবিতা কালের বয়ান। কবিতা নৈসর্গিক ওহী।