ফ্ল্যাশ ফিকশন নিঃসন্দেহে ওয়েবের ফলে একটা জায়গা করে নিয়েছে: শমীক ঘোষের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Nov 26, 2013 5:48:06 PM

দুপুর মিত্র: অনলাইনে লেখালেখি কেন শুরু করলেন?

শমীক ঘোষ: আমি সেই অর্থে অনলাইনে খুব বেশি লেখালেখি করিনি। তবে আমি একটা অনলাইন পত্রিকা www.bookpocket.net এর সাথে যুক্ত। বলা চলে যে বুকপকেট অনেকদিনই আমার ভাবনা। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অনলাইনকে বাদ দিয়ে কিছুই করা সম্ভবনয়। আমি যে চাকরী করতাম, কিছুদিন যাবত ছেড়ে দিয়েছি, সেই সুবাদে আমি নতুন মার্কেটিং টুলগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমি আসলে একটা রিপোর্ট হাতে পেয়েছিলাম। ভারতবর্ষে মোবাইল এর কম্পাউণ্ড গ্রোথ রেট প্রায় ৩৮%। এটা ২০১০-১১ সালের পরিসংখ্যান।আমি বুঝতে পারছিলাম যে প্রকৌশলের উন্নয়নের সাথে সাথে ওয়েব বা ইন্টারনেট ফোনের মাধ্যমে একটা বিশাল সংখ্যক মানুষের হাতে পৌঁছে যাবে। ভারতবর্ষে একটা প্রজন্ম নেট করবে ফোনের মাধ্যমে। এবং ক্রমশ ট্র্যডিশানাল মিডিয়ার পতন ঘটবে। আমি এই একইসময় এটাও দেখতে পাই যে বিদেশের কিছু প্রথম সারির পত্রিকা যেমন প্যারিস রিভিউ ক্রমশ শুধু নেটকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যানটা আমি জানি না। কিন্তু এটা ঠিক যে ছাপা বইয়ের দিন শেষ হয়ে গেছে।

তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক, টুইটার – একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ, কেউ বাংলাদেশে, কেউ ভারতের নানা প্রান্তে, কেউ বা বিদেশে সবাই সবার সাথে ইণ্টারঅ্যাক্ট করছে বাংলায়। একজন লেখক নিজের লেখাটা লিখে দিচ্ছেন নিজের ওয়ালে আর ভালো হলে লোকেলাইক করছে শেয়ার করছে। অনেকে বলেন বিষয়টা খুব তাৎক্ষনিক, কিন্তু একটা জিনিস খুব প্রকট যে স্রষ্টা এবং ভোক্তা/ পাঠক নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেট করছে। এই জিনিসের সুযোগ সাহিত্যে বা শিল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে, সেই রাজা রাজড়ার আমলের পর আর তেমনঘটেনি। এটা একটা বিশাল ফেনোমেনন। প্রথাগত মিডিয়ায় এই সুযোগ নেই বললেই চলে। তাছাড়া প্রথাগত মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার মধ্যে ক্ষমতার নানান সূত্র কাজ করে। পাওয়ার ইকুয়েশন। সোশ্যাল মিডিয়া পাওয়ার ইকুয়েশনের এযাবৎ চলে আসা সূত্রগুলোভেঙে দিচ্ছে। ধরা যাক আপনার লেখার একটা জনপ্রিয়তা প্রাপ্তির ক্ষমতা আছে, কিন্তু পাওয়ার ইকুয়েশন চায় না আপনাকে উঠতে দিতে। আপনি এই ব্যারিয়রটা সহজেই ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবেন।

এছাড়াও রয়েছে বাঙালীর অর্থনীতির জায়গাটা। বাঙালীর সামাজিক ইতিহাসের জায়গাটা। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সামাজিক রাজনৈতিক কারণে বহুধাখণ্ডিত। বাঙালীর কেন্দ্র এই মুহূর্তে মূলত চারটে – বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা, আসামের কাছাড় উপত্যকা ও ত্রিপুরা।বাংলাভাষার সাহিত্যের গত ১৫০ বছরের ইতিহাস কলকাতা কেন্দ্রিকতার ইতিহাস। কিন্তু সেই কলকাতা ছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী। বা তারপরেও ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক কেন্দ্র। সেইসময় বাংলাভাষা যে জায়গা করে নিয়েছে, তা মূলত সেই অর্থনৈতিকরাজনৈতিক কারণেই। কিন্তু আজকের কলকাতার সেই মাসল পাওয়ার নেই। সে আজ এক মৃতপ্রায় শহর। একসময় আসাম, ত্রিপুরার ভালো ছেলেরা কলকাতায় পড়তে আসত। আজকে দিল্লি যায়। বাংলাদেশ থেকে পড়তে এলেও দিল্লি যায়। অথচ কলকাতাকেন্দ্রিকবাংলাভাষার পাওয়ার হাউজগুলো আজও সেই কেন্দ্র-প্রান্ত সমস্যায় ভোগে। বাংলাভাষার জন্য যদি কেউ রক্ত দিয়ে থাকে তাহলে সেটা বাংলাদেশে বা কাছাড়ে। অথচ কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলাভাষা চর্চায় এই তথাকথিত প্রান্তকে ছোঁয়ার কোন চেষ্টা নেই। বাংলাভাষাকেবাঁচিয়ে রাখতে হলে এই পুরো সামগ্রিক বাংলাভাষা চর্চার জায়গাটাকে নিয়েই কাজ করতে হবে। এর বাইরেও, এই আগে বলে দেওয়া মূল বাংলা কেন্দ্রগুলো ছাড়াও একটা বিশাল জায়গা হচ্ছে বাঙালি ডায়াস্পোরার। যাঁরা বাংলাভাষার ক্ষেত্রের বাইরে বাস করেন, এবংবাংলাভাষী মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সব থেকে স্বচ্ছল; এদের বাদ দিয়ে আজ আর বাংলাভাষার চর্চা হয় না। কিন্তু এই বিরাট জায়গাটাকে ধরতে গেলে একমাত্র অনলাইন ছাড়া গতি নেই। বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ অনলাইন।

দুপুর মিত্র: আপনি দীর্ঘ দিন ধরেই অনলাইনে গল্প লিখছেন। আপনার কি মনে হয় অনলাইন গল্পের একটা বিশেষ ফর্ম দিতে যাচ্ছে যেমন পাল্প ফিকশন বা ফ্ল্যাশ ফিকশন? এটা কিভাবে বিকল্প সাহিত্য তৈরি করছে।

শমীক ঘোষ: দেখুন পাল্প ফিকশন বাংলাভাষায় আগে থেকেই ছিল। আমরা যাকে বটতলা সাহিত্য বলি। পাল্প অর্থাৎ অল্পদামী কাগজে ছাপা, মূলত সস্তা। এবং যার বিষয়ও ঠিক স্তরীয় নয়। বাংলাভাষার পঞ্জিকাগুলোতেও এই ধরণে লেখা দেখা যায়। ওয়েব-এ পাল্প বা গ্লসি বাস্লিক-এর পার্থক্য করা যায় না।

ফ্ল্যাশ ফিকশন হল মূলত খুব ছোট লেখা। কারুর মতে ১০০০ শব্দের কম। কারুর মতে ৩০০ শব্দের কম। এই লেখাও বাংলাভাষায় বহুযুগ আগে থেকেই ছিল। তবে আজকালকার ফেসবুক স্ট্যাটাস মেসেজ, বা ফসবুক নোটসকে ফ্লাশের আওতায় আনা যায়। লোকে ফেসবুকেচটজলদি লেখে। পড়েও চটজলদি। বিশেষ করে যারা মোবাইল থেকে বা ট্যাবলেট থেকে নেটে আসেন। এর ফলে এই ধরণে ছোট লেখা একধরণে আনুকূল্য পায়। আজকাল অনুগল্পের জন্য অনেক ব্লগজিন তৈরী হয়েছে, অনেক ফেসবুক গ্রুপস আছে। তা নিয়ে মাতামাতিওচোখে পড়ে। ফ্ল্যাশ ফিকশন নিঃসন্দেহে ওয়েবের ফলে একটা জায়গা করে নিয়েছে।

তবে এর বাইরেও ওয়েব সাহিত্যের একটা নতুন দিক খুলে দিতে পারে। আমরা মূলত ওয়েবের ভিস্যুয়াল দিকটা নিয়েই কথা বলছি। কিন্তু ওয়েব অডিওকেও সমান গুরুত্ব দিতে পারে। ঠিক সিনেমার মত। এছাড়াও ওয়েবের এমন অনেক টেকনিক্যাল দিক আছে যেটাসাধারণ কাগজে লেখা বইতে হয় না। আমার ধারণা এইগুলোর ব্যবহার আমরা ক্রমশ সাহিত্যে দেখব। ধরা যাক কেউ মনে করলেন যে তাঁর উপন্যাসের সাথে আবহসঙ্গীত ব্যবহার করবেন। এটা ওয়েবে বা ডিজিটালে ছাড়া সম্ভবই নয়। বা ধরুন আপনি একটা প্রবন্ধলিখছেন, সেইখানে আপনি কিছু সামঞ্জস্য আছে এমন ভিডিও ব্যবহার করলেন বা অডিও। করতেই পারেন। যেমন ছাপা বইতে ছবির ব্যবহার করা হয়। তারপরে ধরুন আপনি লেখায় পাঠককে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে দিলেন। চরিত্র কি করবে যদি এইটা করে তো গল্পের চলনএকরকম। যদি অন্যরকম করে তো আরেকরকম। এটা লিংক করে করে ওয়েবে বা ডিজিটাল মিডিয়ামে খুব সহজেই করা যায়। এইগুলো আমরা এখনও বাংলাভাষায় তেমন দেখিনি। কিন্তু আমার ধারণা ক্রমশ দেখব। এইগুলোই বাংলা সাহিত্যের নতুন নতুন ফর্ম খুলেদিতে পারে।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে? লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

শমীক ঘোষ: ব্লগ নিঃসন্দেহে গোটা পৃথিবীতেই একটা নতুন ফেনোমেনন। ক্ষমতার নিজস্ব মিডিয়ার বাইরে অল্টার্নেট মিডিয়ার সব থেকে বড় জায়গা হচ্ছে ব্লগ। আপনার লেখা, মতামত আপনি ব্লগের মাধ্যমে খুব সহজেই ছড়িয়ে দিতে পারেন। আজকাল দেখি মূলধারারসংবাদপত্রেও ব্লগের মতামত ছাপা হয়। কখনো কখনো এমনও দেখেছি যে মাইক্রোব্লগিং সাইটে আপলোড করা কোন একটা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা ছবি মূল ধারার কর্পোরেট মিডিয়া কিনে ব্যবহার করছে। লিট্‌ল ম্যাগ কোনদিন এমন জায়গা পায়নি। সে এতটাছড়াবার সুযোগও পায়নি। কিন্তু অবস্থানগত দিক দিয়ে দেখতে গেলে ব্লগ হল লিট্‌ল ম্যাগের পরের ধাপ। উত্তরসূরি।

কিছুকাল আগে দেখছিলাম আপনাকে মলয় রায়চৌধুরী বলেছেন যে ক্ষমতা যেদিন দেখবে ইন্টারনেট তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে সেইদিনই সে তার বিরুদ্ধস্বরকে মুছে ফেলবে। এটা কিছুটা সত্যি। যেমন আমি দেখেছি আমেরিকার লেফটিস্ট ব্লগগুলোকে অনেকসময়েই গুগল্‌ ব্লককরে দেয়, বা কম্পিউটারের জন্য হার্মফুল বা হ্যাকড সাইট হিসেবে দেখায়। আমি উত্তর কোরিয়ার অনেকগুলো কমিউনিস্ট সাইটে একসময় এইটা দেখেছি। এইগুলো সত্যিও হতে পারে আবার এটা পরিকল্পিতও হতে পারে। বা কোন একসময় এই ধরনের পরিকল্পনা করা হতেপারে। আসলে ইন্টারনেট এখন একটা প্রাথমিক পর্যায়ে যখন তার শক্তির মাপটা ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে। আপনি যদি সমাজের সাথে অ্যানালজি টানেন তাহলে দেখবেন সভ্যতার ঊষাকালেও এইধরনে গণতান্ত্রিক বা কোথাও কোথাও অ্যানার্কিস্ট বিষয়গুলো ছিল। পরে রাষ্ট্রক্রমশ তার রাশ টানে।

ইন্টারনেট এত নতুন যে রাষ্ট্র বা ক্ষমতা এখনও বুঝে পায়নি কিভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ক্রমে ক্রমে বুঝবে। আবার বিরোধীতাও তার নিজস্ব কৌশল খুঁজে নেবে।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি? অনলাইনে এই সব লেখালেখির ভবিষ্যত কি। ভবিষ্যতের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

শমীক ঘোষ: আমি মুম্বাইতে থাকি। অতএব আমার দৈনিকের যেটুকু পড়া সেটাও নেট থেকেই পড়া। আমি সাহিত্যিক বিচার এইভাবে করতে চাই না। তবে কলকাতার দৈনিকে আমি দেখি মূলত মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্ত কেন্দ্রিক লেখালেখি। অর্থাৎ ভোক্তাকে ডাইরেক্ট ক্যাটারকরার একটা চেষ্টা। আবার যখন হিন্দি সিনেমা দেখি, তখন দেখি বলিউডের মেইনস্ট্রিমও ক্রমশ প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে আসছে। ছোট শহর। ছোট গ্রামের কথা বলছে। দুটোই মার্কেটিং স্ট্রাটেজি। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বলতে পারব না।

অনলাইনে লেখালেখি করেও হাতের জোর থাকলে যে কল্কে পাওয়া যায় তার বড় প্রমাণ কুলদা রায়। পশ্চিমবাংলার মূল ধারার কাগজেও আজকাল তাঁর লেখা দেখা যায়। আমি তো বললাম অনলাইনই ভবিষ্যৎ। কাগজ ক্রমশ হারিয়ে যাবে। সময় কই গাবদা বই নিয়ে বসেপড়বার। আমরা তো আজকাল পড়িই মোবাইলে, ট্যাবলেটে যাতায়াতের সময়। আর বাড়ি এসে নেট করাটাও একটা প্রাত্যহিকতা।