গণসংহতি আর সিপিবির বাহাস থেকে বোঝা যায় বামপন্থিরাও আলাদা কিছু নয়: বাধন অধিকারীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Apr 30, 2012 4:31:39 AM

বাধন অধিকারী: কলামিস্ট, সমালোচক, রাজনৈতিক ডট কমের সাবেক অনলাইন এডিটর।

দুপুর মিত্র: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে ইন্টারনেট মিডিয়ার সম্পর্কটা কেমন ?

বাধন অধিকারী: আমি এই প্রশ্নটা বুঝিনি দাদা! আমাকে সহজ করে বলতে হবে। কী ধরনের সম্পর্কের কথা বলছেন। রাষ্ট্র বলতে কী বোঝাচ্ছেন? রাষ্ট্রের সাথে মানে কী রাষ্ট্রের সীমানায় বসবাসকারী মানুষের সাথে, নাকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে? সম্পর্ক বলতেই বা কী বোঝাচ্ছেন? অর্থনৈতিক সম্পর্ক, নাকি রাজনৈতিক সম্পর্ক, নাকি প্রাযুক্তিক সম্পর্ক? আমাকে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করলে আমার জন্য উত্তর দেওয়াটা সহজ হবে।

দু: সবকিছু মিলিয়েই। ক্ষমতা সম্পর্কের জায়গা থেকেই এগুতে চাই ।

বা: আমি যেমনটা বুঝলাম, আপনি রাষ্ট্র আর ইন্টারনেট মিডিয়ার রাজনৈতিক সম্পর্ককেই নির্দেশ করছেন। তাহলে বলব সম্পর্কটা বহুমাত্রিক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাশক্তি দরকার মতো ইন্টারনেটকে নিজেদের মতাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, করতে পারেও। আবার জনগণের দিক থেকে প্রতিরোধের জমিন যেখানে যেখানে তৈরি হয়, সেখানে সেখানে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে।

তবে বলে রাখি, আদতে ইন্টারনেট মিডিয়া তার প্রাযুক্তিক বৈশিষ্ট্যগত গণতান্ত্রিকতার কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাশক্তির বিরুদ্ধে সব থেকে সোচ্চার মিডিয়া। এখানেই কেবল বহু মতের দেখা মেলে, বহু বিকল্প স্বর শোনা যায়। স্বল্প পুঁজিতে এই মিডিয়ার অংশীদারিত্ব পাওয়া যায় বলে আর প্রযুক্তিগত গণতান্ত্রিকতার কারণে...

দু: www বলে আমার যাকে চিনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এখানে রাষ্ট্র বা স্থানিক কাঠামোর হস্তক্ষেপ কি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে?

বা: আমি এর প্রাযুক্তিক দিকটা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ বলতে পারেন। তাই গেটওয়ে বন্ধ করে দেওয়া, সার্ভার বন্ধ করে দেওয়া, কিংবা নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রাযুক্তিক সম্ভাবনা/সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমি বলতে পারব না। তবে এটাতো দেখতেই পাচ্ছি, হস্তক্ষেপ জোরালো করবার চেষ্টা আছে। নজরদারি আছে, সঙ্গত কারণেই হুমকি-ধামকি আছে, ব্যান কালচার আছে। ফেইসবুক বন্ধ করা, মঙ্গলধ্বনি নামের একটা ওয়েব মিডিয়া বন্ধ করার প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী হয়েছি আমি নিজেও। কিন্তু আমার বিবেচনায় প্রতিরোধের শক্তি ক্ষমতার চে' বেশি। আর ইন্টারনেটের প্রাযুক্তিক স্বভাব গণতান্ত্রিক স্বভাব, আমি আগেও বলেছি। নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টার পাশাপাশি তাই প্রাযুক্তিক গণতান্ত্রিকতাকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প পথ-পদ্ধতিও প্রতিরোধী মানুষ খুঁজে নেবে-- আমার এমনটাই ধারণা।

রাষ্ট্রতো সবসময়ই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এক্ষেত্রেও চাইবে। কিন্তু বিনা প্রতিরোধে কোন ক্ষমতাই পার পেয়ে যায় না। আমি আশাবাদী মানুষ!

দু: ইন্টারনেটের কারণে রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে বামদলগুলোর মধ্যে। দলীয় রাজনীতির প্রকাশ্য একটা রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। আপনার কি এরকম মনে হয়?

বা: আমি একমত না আপনার প্রথম কথাটুকুর সাথে যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এনেছে ইন্টারনেট মিডিয়া। কোথায় পরিবর্তন দেখতে পান? এখানে কি খালেদা-হাসিনার উচ্ছ্বিষ্টভোগীদের মারামারি-লাগালাগি নেই? এখানে কি তাদের পক্ষের মতাদর্শিক প্রচারণা নেই? এখানে কী একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীন ব্যক্তিকে বলির পাঠা বানানোর চর্চা নেই? বরং আপনি দেখতে পাবেন, এখানে সেন্সরশীপ প্রবল নয় বলে (সেটা কিন্তু আমাদের জন্য আশীর্বাদ, আগেই বলে নিলাম) রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরও নগ্ন চেহারা এখানেই দেখতে পাই আমরা। এখানে হাসিনা-খালেদার ছবি ভয়ঙ্করভাবে বিকৃত করে প্রচার করা যায়।

এখানে রাজনৈতিক বিতর্ক হলে সেটা টিভি-সংবাদপত্র-সংসদ সবকিছুকে ছাপিয়ে আরও নগ্ন রূপ ধারণ করে। তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির কী পরিবর্তন আপনি দেখলেন?

আসলে 'রাজনৈতিক সংস্কৃতি' নামের জিনিসটাই আমার কাছে এক গোলমেলে ধারণা। রাজনীতি থাকে সংস্কৃতির বিপরীতে। সংস্কৃতি স্বত:স্ফূর্ত, যাপনের সাথে সম্পর্কযুক্ত; আর রাজনীতি আরোপিত, ক্ষমতাশক্তির দ্বারা প্রযুক্ত। তাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানে আমি বুঝি, রাজনীতি যা আরোপ করে।

এখন আমাদের দেশের মতো তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোর বাস্তবতায় এই 'রাজনৈতিক সংস্কৃতি' নামের ধারণাটি বেশি বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে সুশীলরা। বামপন্থি বলে পরিচয়দানকারী রাজনৈতিক দলগুলো, সুশীল সমাজ, সুশীল বুদ্ধিজীবী, সুশীল মিডিয়া এদের কাছেই বেশি বেশি শুনি এই 'রাজনৈতিক সংস্কৃতি' কথাটা। তারা আসলে আওয়ামী লীগ বিএনপি'র মারামারি মানতে পারেন না। ওয়েস্টের মতো করে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে একটা সমঝোতা চান। পার্লামেন্ট সচল চান, গণ্ডগোল-মারামারির অবসান চান, ক্ষমতায় ৫বছর থাকবার পর ভালোভাবে সেখান থেকে সরে যাওয়া চান, কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ চান। এজন্যই আমাদের 'রাজনৈতিক সংস্কৃতি' উন্নত করতে হবে জাতীয় কথা বলেন। আমার কাছে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি নামের জিনিসটার গুরুত্ব নাই। রাজনীতি এখানে যেভাবে আছে, তাতে তার সংস্কৃতি এমনই হবে। এটা পাশ্চাত্য না। আমাদের ভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় থাকতে হয়। পাশ্চাত্যে যা আছে সেটা কি ভালো কিছু? ওটাতো আরেক ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি। সেদিকে না যাই।

    এবার আসি আপনার আলাপের পরের অংশে। বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্দেশ করে আপনি বলেছেন "দলীয় রাজনীতির প্রকাশ্য একটা রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে"। এটা বুঝিনি। আমাকে আরেকটু ভেঙ্গে বলেন, প্লীজ...

দু: সরি কাল হঠাত করেই অনলাইনে থাকতে পারিনি । আপনি ফ্রি এখন?

বা: নিশ্চয়ই। আমরা শুরু করতে পারি আবার। আমি একটু অভ্র করে নেই। জাস্ট এ মিনিট। আপনি বলুন, দাদা।

দু: দলীয় রাজনীতি বলতে আমি সিপিবি, গণসংহতি এসব বুঝাচ্ছি। এদের চর্চাটাকে বুঝাচ্ছি।

বা: আচ্ছা, আপনি কি বলতে চাইছেন, দলীয় রাজনীতির প্রকাশ্য রূপ ইন্টারনেট মিডিয়াতে মূর্ত হচ্ছে? মানে ইন্টারনেট মিডিয়া বাম-রাজনৈতিক প্লাটফর্মগুলোর প্রকাশ্য প্রচারণার জায়গা হয়ে উঠেছে? এটাকে কীভাবে দেখছি?

দু:   হুম প্রকাশ্য প্রচারণার জায়গা তো বটেই, সাথে সিপিবির পার্টিগত চরিত্রটা কেমন, বা গণসংহতির পার্টিগত চরিত্রটা কেমন সেটাও বেশ প্রকাশ পাচ্ছে।

বা: আচ্ছা! আমি এবার সম্ভবত আপনার কাছে পৌঁছাতে পেরেছি! বুঝতে পেরেছি বোধহয়। আমি বলি এবার। প্রথম কথা হলো, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক প্রচারণার বিভিন্ন সুযোগ থাকলেও ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর সেই সুযোগ কম। ইন্টারনেট এক্ষেত্রে পজিটিভ একটা মিডিয়া, বহু স্বর, মানে ভিন্ন স্বর শুনবার সুযোগ করে দিয়েছে। বলে রাখাটা ভালো, আমি রাজনীতির পক্ষের লোক না। রাষ্ট্র-রাজনীতির উচ্ছেদ চাই। মুক্ত সমাজতন্ত্র চাই। সেটা অন্য বিবেচনা। কিন্তু রাজনীতি যখন আছে, দলপার্টি যখন আছে, তখন আমি চাইব-ই যে ২টা মাত্র দল না-থাক, বৈচিত্র্য থাক, ক্ষমতাকেন্দ্র কম নিরঙ্কুশ হোক। দুই দলের বাইরে অনেক অনেক দল থাকলে মানুষের একদিক থেকে লাভ, সেটা হলো ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম কেন্দ্রিভূত থাকবে। সেদিক থেকে বাম রাজনৈতিক দলগুলো থাকা ইতিবাচক, এবং ইন্টারনেট মিডিয়ার মধ্যে এই গরীব দলগুলোর প্রচারণার সুযোগ তৈরি হওয়াটা ইতিবাচক। যদিও বলে রাখাটা দরকারি, বাম রাজনৈতিক দলগুলোও আমার কাছে আলাদা কিছু না। সবাই রাষ্ট্র ক্ষমতা চায়। কেউ জাতীয়তাবাদের নামে, কেউ ইসলামের নামে, কেউ হিন্দুত্বের নামে, কেউ জিওনিজমের নামে, কেউবা আবার সমাজতন্ত্রের নামে। কিন্তু আমরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বারবার দেখেছি, 'যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবন'। রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ না করে তাই সমাজতন্ত্র হয়না। হতে পারে না। আর কথা না বাড়াই এক জায়গায়।

    অন্য প্রসঙ্গটাতে আসি। গণসংহতি আর সিপিবির ইন্টারনেট প্রচারণা আর বাহাস আমি খেয়াল করেছি মাঝে মাঝে। খুবই মজার ব্যাপার হলো, ডান-বাম নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলগুলো যে ক্ষমতার জন্য মরিয়া, বামপন্থিরাও যে খুব একটা আলাদা কিছু না, সেটা বোঝার জায়গা তৈরি করে দেয় তাদের বাহাস! যেভাবে তারা পারস্পারিক আলাপ করে, একদল আরেকদলকে গালাগালি করে, মতাদর্শিক তর্কের নামে ব্যক্তিগত ঝগড়াঝাটি করে সেটা কিন্তু আমাদের, মানে আমজনতার জন্য পজিটিভ। আমরা এদের চিনে নিতে পারি... আমরা রাজনীতি জিনিসটাকেই চিনে নেবার সুযোগ পাই এর মধ্যে দিয়ে!

দু: রাষ্ট্র উচ্ছেদ কি রাজনৈতিকদল ছাড়া সম্ভব?

বা: দাদা, আমার ইন্টারনেটের ব্যালান্স শেষ হয়ে গিয়েছিল.... রিচার্জ করে আবার বসলাম... সরি

দু: ঠিক আছে। রাষ্ট্র উচ্ছেদ কি রাজনৈতিকদল ছাড়া সম্ভব?

বা: রাজনৈতিক দলগুলোই তো রাষ্ট্র। তারা রাষ্ট্র উচ্ছেদ করবে কী করে? কী কারণে? রাষ্ট্র উচ্ছেদ করার প্রশ্ন অনেক পরের প্রশ্ন। আমি আপাতত আলাপ করতে আগ্রহী না, আপনার যদি খুব বেশি আগ্রহ না থাকে। আমি বরং আগ্রহী রাষ্ট্রের বিভিন্ন এ্যাপারেটাসগুলোকে গণতান্ত্রিক করার প্রশ্নে। নোম চমস্কির কথা বলি।

আর্জেন্টিনার লড়াকু শ্রমিকদের কাছে শিখে এসে চমস্কি আমাদের বলেছিলেন, খাচার মেঝেকে প্রসারিত করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ থাকতে দেয়া যাবে না। প্রশ্ন করতে হবে। চ্যালেঞ্জ করতে হবে। যেভাবে যতোখানি পারা যায়, প্রতিরোধ তৈরী করে গণতন্ত্রের পরিসর বাড়াতে হবে।

    আজকে বাংলাদেশ নামের রাস্ট্রে বসবাসকারী একজন মানুষ হিসেবে আমিও তাই চাই। নিপীড়ন আর বল প্রয়োগের এলাকাগুলোকে নির্দিষ্ট করতে চাই। প্রশ্ন করতে চাই। চ্যালেঞ্জ করতে চাই। নিরন্তর এর বিরুদ্ধে বলতে চাই, লিখতে চাই, অনেক মানুষের সাথে একসাথে হয়ে অহিংস প্রতিবাদ করতে চাই...

দু: ঠিক আছে গণতন্ত্রকরণের প্রশ্নেই যদি আসে তাহলে কোন ধরণের গণতন্ত্র এই প্রসঙ্গটা চলে আসে।

    বা: নিশ্চয়। সেটাই বলি...

দু: হ্যাঁ

বা: যখন বিভিন্ন দেশের সাথে ঋণচুক্তি করা হয়, তখন সেটা কি আমার সাথে আলাপ করে করা হয়? সরি, এটুকু ভুল করে পেস্ট হয়ে গেছে। আমি আবার লিখছি: আপনার মতো একজনের সাথে যখন আলাপ করছি, তখন আমি আলাদা করে বলবার দরকার মনে করিনি যে পার্লামেন্টারি কিংবা রিপ্রেজেনটেটিভ গণতন্ত্রের কথা বলিনি আমি। আমার কাছে গণতন্ত্রের একটাই মানে। সেটা হলো, সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের ডিরেক্ট সিদ্ধান্তের প্রশ্ন। জনগণের ডিরেক্ট অংশগ্রহণই গণতন্ত্র। একাডেমিতে 'ডিরেক্ট ডেমোক্র্যাসি' 'পার্টিসিপেটরি ডেমোক্র্যাসি' নামে এই ধারণাগুলো জারি আছে কিন্তু! পার্লামেন্টে যে গণতন্ত্র থাকে না, সেটা আমরা এমনিতেই বুঝি। খুব বেশি জ্ঞানের দরকার পড়ে না এজন্য।

যখন বিচারবহির্ভূতভাবে মানুষ মারা হয়, তখন জনগণের সিদ্ধান্তে কি সেটা করা হয়? যখন কোনো মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন সেটা কি জনগণের সাথে আলাপ করে করা হয়? যখন বিভিন্ন দেশের সাথে ঋণচুক্তি করা হয়, তখন সেটা কি আমার সাথে আলাপ করে করা হয়? হয় না। দেখেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋণগ্রস্ত হচ্ছি, অথচ আমি জানিই না। আজ যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হলো, সে কয়েকশ' (আমি পরিসংখ্যানটা জানি না এই মুহূর্তে) মার্কিন ডলার ঋণগ্রস্ত হয়ে গেল। এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র? পার্লামেন্ট তাই একটা ফ্যালাসি! ভুয়া জিনিস। গণতন্ত্রের সাথে এর সম্পর্ক নাই, কোনোরকম সম্পর্ক নাই।

কিন্তু এই বাস্তবতায় আমি একেবারে একলাফে সমুদ্র পার হবার কথা ভাবি না। আমি প্রথমে পার্লামেন্ট নিয়েই ভাতে আগ্রহী। প্রথমেই আমি বলতে চাই, দলের বিরুদ্ধে ভোট দেবার অধিকার থাকতে হবে

    সাংসদের, শুধু সেই অধিকার থাকলে চলবে না, সেটা প্রতিষ্ঠিতও করতে হবে। বলতে চাই, সাংসদের বিরুদ্ধে যেকোনো মুহূর্তে অনাস্থা আনবার সুযোগ চাই। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো ৫বছরের জন্য নিশ্চিত ক্ষমতাভোগী হতে দিতে চাই না। আর কি? আমি বলপ্রয়োগ আর নিপীড়নমুক্ত সমাজ চাই। চাইলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না, তাই ৫৪ ধারার বিলোপ চাই। রিম্যান্ডে নিয়ে অত্যাচার করা যাবে না, খোদ রিম্যান্ড জিনিসটাই তুলে দিতে হবে, কেননা রিম্যান্ড থাকলে অত্যাচারের সুযোগও থাকে। আলাদতকে নিরঙ্কুশ হতে দেয়া যাবে না। আদালত অবমাননার উছিলা তুলে কোনভাবেই আদালতের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া যাবে না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর জবাবদিহিতা চাই, একেবারে জনগণের কাছে। রাষ্ট্রের কাছে না। জনগণ যদি না চায়, তো এইসব সন্ত্রাসী বাহিনীকে বিলুপ্ত করে দেয়া হোক, এটা চাই। মোটকথা, বলপ্রয়োগ আর নিপীড়নের আইন-বিচার-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে প্রতিরোধ তৈরী করতে চাই। এবং সেটা গণতন্ত্রের প্রশ্নে। সরাসরি গণতন্ত্র।

দু: আপনি বলছেন, বলপ্রয়োগ আর নিপীড়নের আইন-বিচার-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে প্রতিরোধ তৈরি করতে চাই। এই প্রতিরোধ রাজনৈতিক দল ছাড়া তৈরি করা সম্ভব কিনা?

 বা: দাদা, আমি ৫মিনিট সময় নিচ্ছি... একটু সিগারেট কিনতে যাব নিচে... প্লিজ... এসে আলাপ শুরু করছি...

হুম, এটা আমার মনে করা না করার প্রশ্ন না দুপুর দা'। বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক দলের সব প্রতিরোধই ক্ষমতায় যাবার উছিলা। সত্যিকারের প্রতিরোধ সবসময় রাজনৈতিক দলের বাইরেই দাঁড়ায়। আমাদের দৈশিক বাস্তবতায় একুশে ফেব্রুয়ারি, একাত্তরের সুমহান জনযুদ্ধ, ৯০এর ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক নের্তৃত্বকে অস্বীকার করে প্রতিরোধ তৈরির অনন্য নজির। এগুলোর ভিন্ন আতিহাস রচনা করা সম্ভব। কানসাট বিদ্রোহ আবার একেবারে রাজনৈতিক নের্তৃত্বহীন। ২০০৭ এ সেনা-কর্পোরেট কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত এক ছাত্র আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম আমরা। রাজনৈতিক দলকে পুরোপুরি অস্বীকার করেই।

আমাদের বাস্তবতার বাইরে "অকুপাই" আন্দোলনের কথা বলি। কোথায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব। গোটা নিও লিবারাল পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কেঁপে উঠলো, রাজনৈতিক নের্তৃত্ব ছাড়া, জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে...

দু: তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন নেতৃত্ব ছাড়াও আন্দোলন সম্ভব। এটা কি স্পন্টেনাস রেভ্যুলেশন বা এরকম কিছুর মত?

বা: আমি বলতে চাইছি কই? ইতিহাস বলছে! বাস্তবতা বলছে! ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট বলছে! আর এটাকে আমি কোন নাম দিতে চাই না। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ সৃজনশীল, আর স্বাধীনতা পেলেই প্রতিটি মানুষ নিজ বোধ দিয়ে সুজনশীল কাজে সক্ষম। আর মানবিয়তার সহজাত উপাদান হলো ন্যায়-সংহতি। মানুষের তাই পরিচালিত হবার দরকার নাই। তাই নের্তৃত্ব দিয়ে মানুষকে পরিচালিত করাটা অন্যায্য, অন্যায়।

       এখন কথা হলো তাহলে কীভাবে সংগঠিত হবে মানুষ? আসুন ওয়ালস্ট্রিটের ঘটনা দেখি। কীভাবে ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট হল? অ্যাডবাস্টার নামে একটা পত্রিকা আহ্বান করল। ছোট ছোট গ্রুপ একজায়গায় হল।

অ্যাডবাস্টার্সে’র সাথে আলাপ করে ‘পিপল’স জেনারেল এসেম্বলির ডাক দিলেন “যে কোন ধরণের কাট-ছাঁট ও কৃচ্ছ্বতা সাধনের” বিরদ্ধে, এবং পরিকল্পনা আঁটতে লাগলেন সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখের ‘ওয়ালস্ট্রীট দখল’ কর্মসূচি নিয়ে। এ নিয়ে তারা একটি ‘পিপল’স জেনারেল এসেম্বলি’ ডাকলেন।

আমি উদ্ধৃত করছি ড্রেক বেনেত্তে-এর "ডেভিড গ্রেয়বারঃ ওয়াল স্ট্রিট দখল আন্দোলনের অ্যান্টি-লিডার" শিরোনামের একটা লেখা থেকে (ভাষান্তর করেছেন বখতিয়ার আহমেদ)। উনি বললেন:

"...‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ বা ‘পিপল’স জেনারেল এসেম্বলি’ কথাটি একজন নৈরাজপন্থির কাছে বিশেষ অর্থ ও তাৎপর্য বহন করে। একভাবে ধরতে গেলে এটা সমসাময়িক নৈরাজপন্থার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় যেটি দাঁড়িয়ে আছে এই ধারণার উপর যে বল-প্রয়োগ নির্ভর যে কোন বিপ্লবী আন্দোলনই নিপীড়নমূলক সমাজেরই জন্ম দেয়। ‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ হচ্ছে খুবই সুচিন্তিত সতর্কতায় পরিচালিত একটি যৌথ আলোচনা পদ্ধতি যার মাধ্যমে সব সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় কোন গুটি কতক নেতার মাধ্যমে নয়, সংখ্যাগুরুত্বের জোরে নয়, যৌথ-মীমাংসা বা কনসেন্সাসের মাধ্যমে। অমিমাংশিত বিষয়গুলো তুলে দেয়া হয় জমায়েতের মধ্যেই ছোট ছোট ওয়ার্ক গ্রুপের হাতে, কিন্তু শেষতক সিদ্ধান্ত হতে হবে সর্বসম্মতিক্রমে, এমনকি

জমায়েতের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেলেও। আপাত দৃষ্টিতে এটা খুব কঠিন সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া মনে হতে পারে, কিন্তু ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন যে অভিনব ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সাধারণ্যের সমাবেশকে বিশালকায় জনস্রোতের মধ্যেও কার্যকর একটি পদ্ধতি হিসেবে প্রমাণ করা, এবং বিদ্রোহের স্বতন্ত্র সব চিহ্ন-ভাষা উদ্ভাবন করা যা ব্যবহার করে যে কোন অংশগ্রহণকারীই সরাসরি প্রশ্ন তুলতে, সমর্থন দিতে বা অসম্মতি জানাতে, এমনকি নির্জলা বিরোধিতা করতে পারেন।"

কিন্তু আগস্টে সেই সমাবেশে হাজির হলেন নৃবিজ্ঞানী গ্রেয়বার ও তার বন্ধুরা। তারা আবিস্কার করলেন যে আয়োজনটা যত না ‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ তার চেয়ে বেশি একটা প্রথাগত মিছিল যা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে কিছু পূর্ব-নির্ধারিত দাবি-দাওয়া নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট অভিমুখে যাত্রা করবে।

লেখক জানাচ্ছেন:

"নৈরাজপন্থার পরিভাষায়, আয়োজনটা পরিচালিত হচ্ছিল ‘উলম্বিক’ ভাবে, ‘আনুপূর্বিক’ সংগঠনের মত, গ্রেয়বার ও তার বন্ধুরা যেমন আশা করেছিলেন সে রকম ‘আনুভূমিক’ ভাবে নয়, এবং এটা দেখে গ্রেয়বার আর সাগ্রি ভীষণ ক্ষেপে গেলেন।

এরপর যা ঘটল তা যেন নৈরাজপন্থার একটি শিক্ষনীয় গল্প। কোহসোকে সাথে নিয়ে এই দুইজন আর‌ও কিছু লোকজন জুটিয়ে ভিন্নমত আর অসন্তুষ্টি জানিয়ে চলে এলেন পার্কের আরেক কোনে এবং নিজেদের মত করে ‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ শুরু করলেন, ১৭ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচীর পরিকল্পনা শুরু করলেন। শুরুতে ডজন খানেক লোক থাকলেও আস্তে আস্তে এপাশে লোক বাড়তে থাকল, তাদের র‍্যালিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আয়োজকদের অনেক চেষ্টা স্বত্ত্বেও। এই দড়ি টানাটানি চলল সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত, কিন্তু শেষতক বোউলিং মাঠের অবশিষ্ট ৫০ জনের মত জমায়েতের সবাই যোগ দিলেন বিদ্রোহের ভিতরের বিদ্রোহীদের ‘সাধারণ্যের সমাবেশে’।

“ঐ মিছিলের আয়োজকরাও শেষ পর্যন্ত যোগ দিয়েছিলেন আমাদের সাথে”, স্মৃতি-চারণ করছিলেন কোহসো। “তারপর সবাই মিলে অনেক অনেক রাত পর্যন্ত আমরা পরিকল্পনা করেছি আমাদের কি কি কমিটি দরকার সে নিয়ে”।

যদিও পরের কয়েক সপ্তাহের প্রস্তুতি বাকি ছিল, কিন্তু সেদিন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জিত হয়েছিল। ঘটনাটা আনুভূমিকভাবে পরিচালনা, এবং সে অনুযায়ী যা যা করা প্রয়োজন তা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া। তার মধ্যে অন্যতম একটা সিদ্ধান্ত ছিল কোন নেতা, এমনকি পুলিশের সাথে দেন-দরবারকারী পর্যন্ত না রাখা, প্রাত্যহিক ‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ ও তৎসংশ্লিষ্ট অগুনতি ওয়ার্ক গ্রুপের সভা করা যা এখনও জুকত্তি পার্কের প্রতিরোধ আন্দোলনের হৃৎপিন্ড হিসেবে কাজ করছে, এর থেকে দুনিয়া জুড়ে স্রোতস্বিনী হওয়া অন্য সব আন্দোলনেরও।"

    আমি এই লেখাটি পড়ে ভীষণ আলোড়িত হোই। এই সুবাধে এর অনুবাদক বখতিয়ার আহমদ-কে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখলাম। তো যাই হোক, নের্তৃত্ব তারমানে সমস্যা না। নের্তৃত্ব থাকতেই পারে। কিন্তু সেই নের্তৃত্বকে অবশ্যই কর্তৃত্বহীন হতে হবে। অর্থাৎ সংগঠন চাই। কিন্তু সেটা একেবারে পুরোপুরি সরাসরি গণতন্ত্রের সংগঠন। নের্তৃত্বও সরাসরি গণতন্ত্রের অধীন হবে। এটাই আমার চাওয়া।

দু: রাজনৈতিক ডট কম নিয়ে আপনি কি ভাবছেন?

বা: রাজনৈতিক ডট কম-তো আর নেই। সাইটটি বন্ধ হয়ে গেছে। এবং সেটা আমি সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার পর! তাই আমার ভাবনার তো আর কিছু নেই! এখন পাঠক হিসেবে আমি ব্যথিত। এরকম ছোট ছোট প্রতিরোধগুলো হারিয়ে গেলে সামগ্রিকভাবে আমাদের ক্ষতি হয়। সেদিক থেকে এই বন্ধ হয়ে যাওয়াটা আমার জন্য কষ্টের।

দু: এটা কি কোনও কারণ ছাড়াই বন্ধ করে দেওয়া হয় না বলা হয়েছিল এই সমস্ত কারণে রাজনৈতিক ডট কম বন্ধ করে দেওয়া হল। যদি বলা হয়ে থাকে সে সমস্ত কারণগুলো কি জানাবেন?

বা: রাজনৈতিক সমাজের কেন্দ্রাভূমুখী প্রধান স্বরের বাইরে ভিন্ন স্বর জানান দিত। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ডট কম-এ আমার প্রাক্তন সহযোদ্ধারা যারা ছিলেন, তাদের বলতে চাই, সাইটটি তারা আবার শুরু করুক। আমরা পাঠকরা আনন্দিত হব!

 দু: আপনারা নিজেরাই এটা বন্ধ করে দেন ?

বা: দেখেন, আমি আগেই বললাম, রাজনৈতিক ডট কম বন্ধ হয়েছে আমি সেখান থেকে বের হয়ে আসবার পর। তাই আমি জানি না, ঠিক কী কারণে এটা বন্ধ হলো। আন্দাজ করতে পারি, কারণটা অর্থনৈতিক। টাকা-পয়সায় কুলোচ্ছিলো না অনেকদিন থেকেই। আর রাজনৈতিক ডট কম বন্ধ হবার পেছনে কোনো কারণ জানান দিয়েছে বলে আমি দেখিনি! সম্ভবত তারা কিছুই বলেনি। মানে আমার চোখে পড়েনি।

দু: এসব ছাড়া পারসোনাল ব্লগিং বা এসবের মাধ্যমেও কাজ করা যায়। আপনি সেভাবে কিছু ভাবছেন?

বা: ফেইসবুকটা আমি ব্লগের মতো করেই ব্যবহার করি! আপাতত আলাদা করে কোন একটা ব্লগ খুলে পার্সোনাল ব্লগিং নিয়ে ভাবছি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। একটা জীবিকার অনুসন্ধান করছি আপাতত, জীবিকার বড্ড বেশি দরকার পড়ে গেছে অর্থনৈতিক কারণে; এমন একটা জীবিকা খুঁজচি যেখানে নিজেকে খুব বেশি বিসর্জন না দিলেও চলে!

দু: ধন্যবাদ বাধনদা। আমাকে অনেক সময় দেবার জন্য।

বা: আমারও ভীষণ ভালো লাগলো আপনার সাথে আলাপ করে। আপনাকেও ধন্যবাদ। এটা তো এভাবেই যাবে, হুবহু, তাই না?

দু: হুম । আপনি চাইলে এডিট করে দিতে পারেন।

বা: না, সেটা চাই না। বরং হুবহু গেলে (ওঠাউঠি, অফলাইন হওয়া-সহ) সব কিছু থাকুক... অনানুষ্ঠানিকতার গন্ধটাই ভালো

দু: ঠিক আছে। আমারও তাতে পছন্দ।

বা: ভালো থাকবেন। আলাপটা আপলোড করলে আমাকে লিঙ্ক দেবেন...শুভকামনা

দু: ঠিক আছে। কালই আপলোড করব ভাবছি। অনেক কিছু জানা গেল।