অভিজিৎ বেরার স্মৃতিকথা একটি কবিতা ও সুনীলদা’র মৃত্যু

Post date: Dec 19, 2014 5:24:29 PM

রবিবারের সকাল। ম্যানডেভিলা গার্ডেনের বিখ্যাত সেই দশ তলার ফ্ল্যাট।কিছুদিন আগেই বইমেলায় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর হাতেই। সেই সুত্রেই এই রবিবাসরীয় বৈঠকে প্রবেশাধিকার ও কবিতার অন্দরমহলে আনাগোনা শুরু।বাংলা কবিতার মোটামুটি সব প্রজন্মের কবিরা কমবেশি হাজির থাকেন এই বৈঠকে,বিশেষত যারা তাঁর একনিষ্ঠ ফ্যান ...আমাদের কথায় ‘সুনীল গাঙ্গুলির চেলা’।

আড্ডা জমে উঠেছে...সঙ্গে চলছে কাঁচা লঙ্কা সহযোগে ভদকা পান, যারা পানের দোষে দুষ্ট নন, তাঁদের জন্য ঠাণ্ডা পানীয় ...হাল্কা স্ন্যাক্স...একঘর মুগ্ধ কথাবার্তা... আশ্চর্য এক আলো...। দুটো লেখা নিয়ে এসেছি তাঁকে পড়াব বলে, তার মধ্যে একটা কবির মৃত্যু সংক্রান্ত বিষয়ে, সুযোগ না পেয়ে উশখুশ করছি, কে জানে তরুণ কবির প্রলাপ,কী বলবেন... চাপা ভয়ও হচ্ছে।

একটা ফোন এল,তখন তিনি ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমির সভাপতি। হিন্দিতে কথোপকথন চলছিল। ফোন শেষ হতে কিছুটা নীরবতা। সাহস করে লেখাদুটি সুনীল দা’র হাতে গুঁজে দিলাম। পড়লেন না... বললেন- পরে পড়বেন। আমি যেন দু একদিন পরে একটা ফোন করি। ধনঞ্জয়’দা লেখাদুটি তুলে রাখলেন কৃত্তিবাস এর ফাইলে।

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। সাহস করে আর ফোন করা হয়নি। জানা হয়নি তাঁর মতামত। সামনে পূজো। ভাবলাম পূজোর কটা দিন কেটে যাক,পরে তো একদিন যাবই বিজয়ার প্রনাম করতে,তখন না হয় জেনে নেব তাঁর ভাবনা...পরামর্শ।

ইতিমধ্যে কৃত্তিবাস এর সহ সম্পাদক কবি পিনাকী ঠাকুর মানে আমাদের প্রিয় পিনাকীদা’র সঙ্গে দেখা হয়েছে, বললেন –দাদা বম্বে থেকে ফিরেছেন, চেক আপের পরে ভালোই আছেন। এবার পুজোয় শান্তিনিকেতন যাবেন না, কলকাতাতেই থাকবেন। সপ্তমীর দিন sms এ শারদীয়া প্রনাম জানালাম, কামনা করলাম শারীরিক সুস্থতার।

নবমীর দিন সকাল । কৃত্তিবাসের এক কবিবন্ধুর ফোন এল। আমি তখন মেদিনীপুর এ। এমন এসময়ে ফোন! মনকেমন করে উঠল। জানালেন কবি জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি- সুনীল’ দা আর নেই !

সাত পা দূরে পড়ে আছে কবির দেহ.../নির্জন মৃত্যুর আগে / কয়েকটি আঁচড় কেটেছিলেন মাটিতে.../সেই দেখে বোঝা গেলো /তিনি বাংলায় লিখতেন”।

তাড়াহুড়ো করে কলকাতায় ফিরলাম। ততক্ষণে সবাই ফিরে গেছে। সুনীল’ দা পিস হ্যাভেনে শুয়ে। গেটে দারোয়ান কিছুতেই ঢুকতে দিল না। কতক্ষণ গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম জানিনা... চারিদিকে ধোঁয়াশা...ব্যস্ত উত্তর কলকাতার ফুটপাথ... রাস্তার বাচ্চারা খেলছে... ছোট ছোট চায়ের দোকান... জটলা... পুজোর বাজনা...এ কোন দিকশূন্যপুর ... তরুন কবিরা তবে কার কাছে যাবে যথেচ্ছ পাগলামোর জন্যে,সামান্য প্রশ্রয়ের জন্যে ? মন বিদ্রোহ করছিল... এ সত্যি নয়... সুনীল’দা কোত্থাও যাননি... সেই দশ তলার ঘরে বসে আছেন... আর ঢুকলেই বলছেন... এই যে... ভালো আছো তো?

ক্লান্ত গাছগুলি তাঁকে ঘিরে রেখেছে/আর কেউ নেই/কারন বাংলার কবিরা তো অলক্ষেই চলে যান”।

এরপর কেটে গেছে আরও কিছু দিন। সুনীল’ দার শেষকৃত্য,স্বাতী বৌদির কৃত্তিবাসের সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ ইত্যাদির পরে নতুন সংখ্যার আয়োজন চলছে। একদিন কৃত্তিবাসের অফিসে গেছি। ধনঞ্জয় দা বললেন- আপনার দুটো কবিতাই দাদা বেছে রেখে গেছেন পরের সংখ্যার জন্য। মৃত্যু সংক্রান্ত কবিতা টি নাকি বেশ ভালো লেগেছিল তাঁর।

ভুলেই গেছিলাম কবিতা দুটির কথা। ছ্যাঁত করে উঠলো ধনঞ্জয় দার কথায়। কবির মৃত্যু সংক্রান্ত কবিতাটির সঙ্গে সুনীল দার মৃত্যুর নিশ্চয়ই কোনও সম্পর্ক নেই। যদি থাকে তো সে নেহাত ই কাকতালীয়। সুনীলদা তো অসুস্থ ছিলেন... তবে এমন ভাবনা কেন আমার মাথায় আসছে? মনকে বোঝাই নানাভাবে, সান্ত্বনা দিই। তবু এখনও আজ দুবছর পরেও মনের গোপন কোনে কখনো কখনো একটা অপরাধ বোধ কাজ করে। কেন ঐ কবিতাটি দিতে গেলাম ? তাহলে হয়তো আজ তরুণ কবিদের এমন অসহায় অভিভাবকহীন হয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হত না । আমাদের রবিবার গুলো আবারও সব আশ্চর্য রোববারে পরিণত হত।