আমি আন্দোলনে যুক্ত হবো না কোনোদিন: অনুপম মুখোপাধ্যায়ের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Sep 19, 2013 5:41:42 PM

প্রকাশিত বই: প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ১। রোদ ওঠার আগে ২। যার নাম অপরাজিতা , সেও কিন্তু নামকরণে হেরে যায় ৩। রুবারু ৪। হাইওইয়ে ৫। মেরিগোল্ড_কানেক্টেড ৬। অনুপম % মানুষরা ৭।ইউডলেইং

সম্পাদক: বাক্

দুপুর মিত্র: আপনি কি মনে করেন কবিতা সমাজে একটি ভূমিকা রাখে?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: অবশ্যই ।

দুপুর মিত্র: যদি রাখে সেটা কিভাবে যদি না রাখে সেটা কেন?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: দেখুন, কবিতা তো একটা সামাজিক ব্যাপার,তাই না ? কবি তাঁর নিজের খাতায় যদি কবিতাকে আটকে রাখেন, তাহলে আলাদা ব্যাপার । কিন্তু তিনি সেটা ছাপতে দিচ্ছেন , সেটা সম্পাদকের হাতে যাচ্ছে , প্রেসের একাধিক কর্মী সেটা নিয়ে কাজ করছেন , হয়তো সেটার বিপনন হচ্ছে , অগনিত পাঠক সেটা পড়ছেন , তাঁদের মধ্যে সেটা ক্রিয়া করছে , প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে । কাজেই সমাজের বাইরে সেটা আর থাকছে কী করে ? যদি সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বস্ত কিনা সেই প্রশ্ন ওঠে , তাহলে তো বলতে হয় সে সমাজের ভিতরে থেকেই কবির কথাটা বলে , কিংবা বলতে চেষ্টা করেও বলে উঠতে পারে না । এটা হয়ত ভাবা যায় না যে কবিতা পড়ে মানুষ খুন বন্ধ করে দেবে , ধর্ষন বন্ধ করে দেবে । সেটা নয় । আবার উল্টোটাও নয় । কবিতা পড়ে কেউ একটি রূপসী মেয়ের উপর হামলা করেছে এমন নজির নেই । আমাদের বিপ্লবীরা নজরুলের দ্বারা প্রাণিত ছিলেন । আবার ব্রিটিশরা হয়ত কিপলিং বা ইয়েটসের রাজভক্তিকে রেলিশ করতেন । কবিতা বিপ্লবের জন্ম দিতে পারে , এটাও প্রমাণিত । কিন্তু সমাজকে শোধন সে করতে পারে এটা প্রমাণিত নয় । কবিতাকে ফিনাইল হিসেবে আপনি ব্যবহার করতে পারেন না , বিধিসম্মত সতর্কীকরণ হিসেবেও না । অবশ্যই কবিতাকে সমাজের বাইরের কোনো ঘটনা ভাবা সুস্থ মস্তিস্কের কাজ নয় । কবিতা কোনোভাবেই অসামাজিক নয় । তবে মিশুকে না-ও হতে পারে । কতিপয়ের কাছেই সে রয়ে গিয়ে খুশি থাকতে পারে ।

দুপুর মিত্র: আপনি কোন কোন কবি দ্বারা বেশি প্রভাবিত?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: আমি অনেকের দ্বারা প্রভাবিত। আলাদা করে কারো কারো নাম বলার মানে হয় না। বলা যায়, আমি সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতার আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত, এবং এলার্জি-আক্রান্ত ।

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: নিজের হাতে একটা টেক্সটের কবিতা হয়ে উঠতে চাওয়ার অবাক প্রক্রিয়াটাকে যিনি উপভোগ করেন, তিনি কবি । আবেগ , কিংবা অনুভূতি থাকলেই কবি হয় না । দর্শন থাকলেও হয় না । সামাজিক ক্রোধ থাকলেও হয় না । ওই ব্যাপারটা থাকা চাই ।

দুপুর মিত্র: কবিতা কি?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: কবিতা যা নয়, তা-ই হল কবিতা, মানে আজ অবধি আমার চোখের সামনে কবিতা যা হয়নি ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: এটার জন্য একটা ইন্টারভিউ পর্যাপ্ত নয়, এমনকি একটা প্রবন্ধ লেখার সুযোগও যথেষ্ট নয়। একটা গ্রন্থ রচনা করতে হবে এর উত্তর দিতে হলে । তবে কবিতার বাইরে যাওয়াটা সবচেয়ে বড়ো প্রবণতা মনে হয় । কবিতা তো আর কবিতাকে ট্রিগার করতে পারছে বলে মনে হয় না । কবিও আজ নিছক কবিতালেখক নন ।

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: আমি আন্দোলনে যুক্ত হবো না কোনোদিন । তবে অবশ্যই পরিবর্তিত করে । সমসাময়িক কবিতায় সেই ষাটের দশকের হাংরি , শ্রুতি এই আন্দোলনগুলোর প্রভাব আপনারা দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই । আমি তো নিজের কবিতায় পাই ।

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: এর উত্তর দেবো না । দিলে অনেক মজা নষ্ট হয়ে যাবে । সেই শার্লক হোমস বলতেন না ওয়াটসনকে , কী করে তিনি ওগুলো বুঝে ফেলতেন বললে তার দাম থাকবে না । খুবই সহজে কবিতা লিখি আমি। একেবারেই কোনো ইন্দ্রজাল নেই । এমনকি ঘামও ঝরাতে হয় না । শ্রমটা খুব ধীরে এবং ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: যেটুকু পড়ছি , আমার মনে হয় , আমাদের ভাষায় সবচেয়ে ভালো কাজটা হচ্ছে । এত কবিতাপাগল আর কোনো ভাষায় নেই । আর ... একসঙ্গে এতজন অসামান্য কবি ।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: আমি লিখছি ১৯৯২-৯৩ সাল থেকে । তখন ক্লাস সেভেন-টেভেনে পড়ি । তখন থেকেই বয়স্কদের কবিতা লিখতাম । তবে ছাপাতে শুরু করি শূন্য দশকের সূচনা থেকে । ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকায় আমার তথাকথিত আত্মপ্রকাশ ঘটে । তার আগেকার লেখা সব পড়ে আছে ।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: ওই যে বললাম , একটা টেক্সট আমার হাতে কবিতা হয়ে উঠতে চাইছে , এটা আমাকে বেদম পুলক দেয় । সেটাকে অন্যরাও কবিতা ভাবছেন ! এ এক অপরূপ উল্লাস । এর কোনো তুলনা নেই ।

দুপুর মিত্র: কবিতা লিখতে আপনার কতটুকু সময় লাগে?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: কিছু কবিতা ৫ মিনিটে লেখা হয় । কিছু লিখতে ৫ দিন লাগে । কিছু কবিতা ৫ মাস সময়ও নেয় ।

দুপুর মিত্র: আপনি সাধারণত কোথা থেকে কবিতা লেখার বিষয় খুঁজে নেন?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: আমার কবিতায় বিষয় তো নেই । তবে একটা কবিতা শুরু হয় , একটা শিহরণ থেকে , একটা বোধ কাজ করে যে একটা প্রথম লাইন আমার কাছে এসে গেছে , সে আমার কাছে একটা গতি চাইছে ।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: সামগ্রিকভাবে এই মুহূর্তে বাংলা কবিতায় কী হচ্ছে , তাঁর জানা দরকার , তবে তিনি কী হচ্ছে না সেটা বুঝবেন । সেটাই তো তাঁর অপেক্ষায় আছে । অন্তত বিগত তিনটি দশকের কাজকর্ম তাঁকে জানতে হবে । কোন কোন পত্রিকা বিশুদ্ধ কাজ করছে , তাঁকে খোঁজ রাখতে হবে । সর্বোপরি বলি , তাঁকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে একেবারেই এই পরিসরের একজন মানুষ হতে হবে । কবিতার কারিগরিতে দক্ষতাটা শিখে না ফেলাই মঙ্গল , ওটা অনেক ধাক্কা খেয়ে খেয়ে অর্জন করলে সিগনেচারের দিকে চিরকালের মতো এগোতে পারবেন তিনি ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: একটি নামও বলা পাপ হবে । কারণ অনেক নাম বলার পরেও দেখবো কয়েকটি নাম করা হয়নি । তার প্রায়শ্চিত্ত কী করে করবো ?

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: কবিতা খারাপ লাগে না । কবিতা না হলে খারাপ লাগে । এমন নাম প্রচুর আছে । সেই নামগুলো আমি যদি বলি , বাংলা কবিতার কোনো কাজে লাগবে না , মঙ্গলও হবে না । কোনো লাভ নেই ।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: দুটো দশক পুরোপুরি আলাদা মেজাজের । কিছু ওভারল্যাপিং আছে । সে তো থাকবেই । নব্বইয়ের কবিরা বাংলা কবিতা নিয়ে বহু ঘাম রক্ত ঝরিয়েছেন । আজও লড়ছেন । শূন্য দশক খুব শক্তিশালী দশক হয়েও সেটা ততদূর করেনি । শূন্য দশক ব্যক্তিগত উৎকর্ষকে গুরুত্ব দিয়েছে বেশি । আমি নিজেও তার উদাহরণ । শূন্য দশক অনেক বেশি ভার্চ্যুয়াল । শূন্য দশকের গুরুত্ব ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে ।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: কবিতার প্রাণের দিক থেকে বাংলাদেশের থেকে পশ্চিমবঙ্গের অনেক কিছু নেওয়ার আছে । বাংলাদেশের কবিদের আমার খুব জ্যান্ত মনে হয় । সরাসরি বুক থেকে লেখাগুলো আসে । আবার , কবিতার দেহকে কীভাবে গড়ে তুলতে হয় , সেটা বাংলাদেশ হয়ত পশ্চিমবঙ্গের কাছে কিছু নিতে পারে । কবিতার নির্মাণকে পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেশি মূল্য দেওয়া হয় আমার অনুমান । তবে এই দুই ভুবন পরস্পরের সম্পূরক হয়ে আছে ।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: এই মুহূর্তে ব্লগ এক অনিবার্য ব্যাপার একজন তরুণ কবির কাছে । যদি তিনি কাউকে খুশি না করে নিজের একটি জগত গড়ে তুলতে চান , ব্লগ তাঁর একমাত্র অপশন মনে হয় । নিজের ব্লগে তিনি নিজের সৃষ্টিসুখের উন্মাদনাকে যেমন খুশি উপস্থিত করতে পারেন । সেই ব্লগে তারপর তিনি আমন্ত্রণ জানাতে পারেন পাঠকদের । তাঁকে নিজের কবিতা নিয়ে প্রকাশক বা সম্পাদকদের দরজায় দরজায় আর ঘুরে বেড়াতে হবে না । নিজের কবিতার দায়িত্ব এখন তিনি তিনি নিজে নিতে সক্ষম । দুই বাংলার বেশ কিছু তরুণ কবি আজ এই পথে হাঁটছেন । আজ তাঁরা খাদক নন , উৎপাদকের ভূমিকা আজ তাঁর । অবশ্য জবাগাছের পাশাপাশি বিছুটিও এক উৎপাদক , কারণ সেও ক্লোরোফিলের অধিকারী ।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: না । আমি এদের একীকরণে আস্থাশীল ।

দুপুর মিত্র: হলে কেন না হলে কেন নয়?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: একটি ব্লগজিন তো এক লিটল ম্যাগ হিসেবেই কাজ করছে , তাই না ? বানিজ্যপত্রের গুণ এবং দোষগুলো কেউ কেউ তাতে আরোপ করতে চাইছেন , শোচণীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন ।একটা কথা স্পষ্ট করেই বলি ? আন্তর্জাল যে বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ , এ নিয়ে খুব সন্দেহের সুযোগ আজ আর বোধহয় নেই । তালপাতার যুগ থেকে যেমন ছাপাখানা , লেটার প্রেস থেকে যেমন ডিটিপি , তেমন ভাবেই এসেছে আন্তর্জাল । এ অনিবার্য বিবর্তন বলেই আমি মনে করি । কিন্তু এই বিবর্তনে আমাদের ভূমিকাটা যেন অসংযত না হয় । তাহলে কবিতার ভবিষ্যৎ মাদের ক্ষমা করবে না ।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

অনুপম মুখোপাধ্যায়: খবরের কাগজের সাহিত্য আমি পড়ি না । কোনো ধারণাই নেই । এটা অহমিকা ভাববেন না । এটা আমার সীমাবদ্ধতা ।