অকবিদের প্রলাপসর্বস্ব রচনা দেখলে মর্মাহত হই: মোহাম্মদ নূরুল হকের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 13, 2012 7:05:01 AM

প্রকাশিত বই: মাতাল নদীর প্রত্নবিহার, স্বরচিত চাঁদ, সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য, সমালোচকের দায়।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

মোহাম্মদ নূরুল হক : শিল্পের সবচেয়ে সংবেদনশীল শাখা কবিতা, মানুষ হিসেবে নিজেকে সংবেদনশীল মনে করি। সংবেদনশীলতা প্রকাশের জন্য সংবেদনশীল প্রকাশমাধ্যম প্রয়োজন। ওই অর্থে কবিতা-ই উপযুক্ত মাধ্যম নিজের মনোভাব প্রকাশের। আবেগের চূড়ান্ত মুহূর্ত ধারণ করার মাধ্যমও কবিতা। সেখানে প্রজ্ঞা ও যুক্তিবোধও উপস্থিত রাখার চেষ্টা চলে। এসব কারণে কবিতা লিখি।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

নূ: প্রত্যেক ভাষাভাষী অঞ্চলের অনুজ কবিকে তার পূর্ববর্তী কবিদের কবিতা শৈলী, পাঠ এবং ইতিহাস জানতে হয়। প্রচুর পাঠের ফলেই কেবল নিজের জন্য কাব্যভাষা নির্মাণের পথ সহজ হয়। এছাড়া কবিতার আঙ্গিক, প্রকরণ, ভাষা ও স্বর চেনার জন্য প্রস্তুতির দরকার। না হলে সাঁতার না জেনে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার মতো বিপদ ডেকে আনা হয়।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভালো লাগে এবং কেন?

নূ: সমসায়িক বলতে যদি আমার সমবয়সী এবং আমার সঙ্গে একই সময়ে লিখতে আসা কবিদের কথা বলেন, তাহলে বলব—কাজী নাসির মামুন, চন্দন চৌধুরী, মাদল হাসান, ইমতিয়াজ মাহমুদ, ফেরদৌস মাহমুদ, অতনু তিয়াস, জাকির জাফরান, এমরান কবির, মামুন রশীদ, মিজানুর রহমান বেলালসহ আরও দু-একজন আছেন, যাদের নাম এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। একবিদের কবিতায় ঐতিহ্য, আধুনিকতা, মিথ এবং দেশীয় অনুষঙ্গের মিথস্ক্রিয়া রয়েছে, রয়েছে কবিতার আঙ্গিক, প্রকরণ বিষয়ে সচেতনতাও।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

নূ: কোনো কবিতা-ই আমার খারাপ লাগে না, খারাপ লাগে অকবিতাকে কবিতা নাম দিয়ে চালিয়ে দিলে। অকবিদের প্রলাপসর্বস্ব রচনা দেখলে মর্মাহত হই।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

নূ: আমি সাহিত্যের দশক বিভাজন পছন্দ করি না। তাই দশকবিভাজন সম্পর্কে কিছু বলার নেই। তবে, গত বিশ-বাইশ বছর ধরে যারা লিখে আসছেন, কোনো রকম প্রগলভতায় গা না ভাসিয়ে তাদের কবিতা আমাকে মুগ্ধ করে। তবে এ সময়ে তেমন নতুন কোনো কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। এরপরও যাদের কবিতা পড়লে শৈলী বোঝা সহজ হয়, তাদের মধ্যে রহমান হেনরী, হেনরী স্বপন, মজনু শাহ, জাফর আহমেদ রাশেদ, আলফ্রেড খোকন, আহমেদ স্বপন মাহমুদ উল্লেখযোগ্য। এর বাইরেও কয়েকজন রয়েছেন, এ মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি না।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

নূ: পশ্চিমবঙ্গের কবিরা যখন লিখতে আসেন, তখন মোটামুটি পড়াশোন করেই শুরু করেন। আর আমাদের এখানে ‘যখনই জন্মাইলা, তখনই কবিতাইলা’। আমাদের এখানে জন্মসূত্রে কবি। ফলে পঠনপাঠন দরকার হয় না। একারণে পশ্চিম বঙ্গের কবিতার একটি গড়মান সহজে সনাক্ত করা যায়। কিন্তু আমাদের এখানের গড়মান সনাক্ত করা যায় না। তবে এরই মধ্যে যে দু-একজন ভালো কবিতা লিখেছেন, তারা এককভাবেই পশ্চিম বঙ্গের সম্মিলিত কবিদের চেয়ে উত্কর্ষ সাধন করেছেন বেশি।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

নূ: সাহিত্য সৃষ্টিই আসল কথা, মাধ্যম নয়। এরপরও বলতে গেলে ব্লগে স্বেচ্ছাচারিতা বেশি, ফলে শিল্পমান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয়? হলে কেন, না হলে কেন নয়?

নূ: লিটলম্যাগে আবেগ সর্বস্ব রচনা ভরে থাকে আর ব্লগে চলে আত্মপ্রশংসা। বিপরীত দৃশ্যও আছে, কোনো কোনো লিটলম্যাগ যথার্থ সাহিত্যের পরিচর্যা করে। এদিক থেকে লিটলম্যাগের গুরুত্ব বেশি।

দু: দৈনিকে সামপ্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

নূ: আমি নিজেও দৈনিকে লিখি। দৈনিকে সাহিত্যপাতায় মানসম্পন্ন সাহিত্যের আশা করা ভুল। কারণ, সেখানে নানা রকমের উদ্দেশ্য থাকে, থাকে নানা পরিকল্পনা। এছাড়া দৈনিকে একই সঙ্গে অনেককে ঠাঁই দিতে হয়, দিতে নানা মতের লেখকের মতেরও গুরুত্ব। দৈনিক মুখ্য উদ্দেশ্য বাণিজ্য, সাহিত্যের পরিচর্যা নয়। অসংখ্য মানুষের রুচির যোগান দিতে গিয়ে সাহিত্যের বিশুদ্ধতা ধরে দৈনিকের পক্ষে সম্ভব হয় না। এছাড়া সাহিত্য-সম্পাদকের সাহিত্যরুচি, মালিক পক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে পাঠক সাধারণের চাহিদার একটা মেলবন্ধন ঘটাতে হয় দৈনিকে। ফলে দৈনিকের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করা উচিত নয়।