অগ্রজ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য একরাশ ঘৃণা জানাতেই পারি: শুভ্রনীল সাগরের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 24, 2012 6:33:25 AM

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

শুভ্রনীল সাগর: ‘অস্তিত্বের চেতনা আর সময়ের প্রবাহকে আমি আঁকতে চাচ্ছি মাত্র। যেমন লোকে নিজের নাড়ী টিপে দেখে’। (অঁরি মিশো)

দু: কবিতা লিখতে গিয়ে আপনি কোন বিষয়ে জোর দেন বেশি?

শু: উপরের কথা দিয়েই এ-প্রশ্নের দেয়া যায়। তবু ভেঙে বললে, আমার অস্তিত্বের চেতনা আর সময় প্রবাহের তাপ, আমি সর্বান্তকরণে অনুধাবন করার উপরেই বেশী জোর দিই।

দু: আপনি কাদের কবিতাকে বেশি অনুসরণ করেন?

শু: স্বনামধন্য সংগীত শিল্পী Pete Seeger এর একটা কথা আছে, “All song writer are connected in a long chain.” এটা একটু পালটে নিয়ে আমি বলবো, All poet are connected in a long chain. আমি বাংলা কবিতার একজন উত্তরপুরুষ। আমার শরীরে বইছে আমার পূর্বপুরুষদের রক্ত। কাজেই রক্তের একটা পরোক্ষ অনুসরণ তো আছেই। তাছাড়া একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রত্যক্ষ অনুসরণ আমাদের দরকার হয়। যেমন বাবার হাত ধরে আমরা হাঁটতে শিখি। তারপর গোটা জীবন নিজের পায়েই হাঁটতে হয়। খোঁড়া ও বৃদ্ধ কবিদের ক্ষেত্রে আলাদা কথা –- তাদের তো লাঠি বা হুইলচেয়ার লাগবেই!

দু: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কবিতার ফারাকটা কোথায় ?

শু: কলকাতা ছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী। বাস্তবিক কারণেই এ-অঞ্চলের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন, অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি ছিল এবং এখনো তার একটা ক্রমহ্রাসমান পরম্পরা বিদ্যমান। এদিকে, ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে আজকের বাংলাদেশ। ফলত, বাংলাদেশিরা না হতে পেরেছে পুরোপুরি বাঙ্গালী, না পুরোপুরি মুসলমান বা হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান যাইহোক। একটা জাতিগত মতাদর্শ সংকটের ভূত এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের। আছে আরও নানামুখী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। একজন কবি তার কাব্যভাষা ও কাব্য উপকরণ তৈরি করে, তাকে ঘিরে থাকা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কবিতার প্রধান যে পার্থক্য, সেটা হল – কাব্যভাষা। আমার বিবেচনায় পশ্চিমবঙ্গের কবিতা –- পরিণত, সাবলীল, নিজস্ব, জীবনঘনিষ্ট ও দ্বিধাহীন। অপরদিকে, বাংলাদেশের কবিতা -- অপরিণত, জটিল, অনুকরণপ্রিয়, জীবনবিচ্ছিন্ন ও দ্বিধাগ্রস্ত(অধিকাংশ)।

দু: গোষ্ঠীবাদিতাই বাংলা কবিতার জন্য শনি। আপনার কি এরকম মনে হয়? মনে হলে কেন না হলে কেন?

শু: উদ্দেশ্য দিয়ে উপায়ের বিচার করা উচিত। গোষ্ঠীবদ্ধতা হল সামাজিক ধারণা। বড় বড় কাব্য আন্দোলনগুলো (ইংরেজি, ফরাসী, স্প্যানিশ সাহিত্যে) গোষ্ঠীবাদিতারই ফসল। এটা(কাব্য আন্দোলন) বাংলা কবিতায় খুব একটা ঘটেনি অবশ্য। মোদ্দাকথা হল, উদ্দেশ্য যদি অমানবিক ও অসৃষ্টিশীল হয়, তবে গোষ্ঠীবাদিতা বাংলা কবিতার শুধু শনিই না –- রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ... হয়ে যাবে!

দু: ঢাকার সাহিত্য বলে তেমন কিছু কি গড়ে উঠেছে? হলে কিভাবে না হলে কেন?

শু: আমি মোটেও মনে ক’রি না যে, ‘ঢাকার সাহিত্য’ ব’লে তেমন কিছু গড়ে উঠেছে। কারো যদি মনে হয় গড়ে উঠেছে, তবে তিনি ব্যক্তিগত দায়িত্ব নিয়ে বলবেন আশাকরি।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনি বেশি পছন্দ করেন এবং কেন? সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার বাজে মনে হয় এবং কেন?

শু: সমসাময়িক ব’লতে, আমার সম বা কাছাকাছি বয়সী অর্থাৎ শূন্য দশক পরবর্তী কবিতা লিখিয়েদের ধরে নিচ্ছি। সবে তো আমরা লিখতে শুরু করেছি। অধিকাংশ লিখিয়ের নিজস্ব কাব্যভাষাই তৈরি হয় নি। তাই ভালো কবিতা, বাজে কবিতা, কেন পছন্দ করি, কেন করি না – এ-জাতীয় সিদ্ধান্তে আসার সময়ই আসলে হয় নি। এখনো বহুদূর যাওয়া বাকি।

দু: মফস্বলে অনেক ভাল কবি থাকার পরও উঠে আসছেন না লিটলম্যাগের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা এবং দৈনিকের বাজে সাহিত্যের জন্য। আপনার কি এরকম মনে হয়? হলে কেন ? না হলে কেন?

শু: ‘উঠে আসা’ ব’লতে আমরা প্রথম সারির দৈনিক ও মাসিক-ত্রৈমাসিক কাগজগুলোতে লেখা ছাপা হওয়া কে বুঝি। কাঁচাভাষায় বললে, জাতে ওঠা আর কি! যতদূর জানি নব্বই দশক বা তারও আগে থেকে, এই ‘বাজে সাহিত্য’র সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে। আজ ২০১২। বাংলা কাব্যজগতে আমি একজন নবীন লিখিয়ে। আমাকে কেন এ-জাতীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হ’তে হবে!! এ প্রশ্ন তো আমার অগ্রজ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে করার কথা। তাহলে মাঝখানের এতগুলো বছর কি ছেঁড়া হ’ল?? সুকান্ত ব’লে গেছেন, নতুন শিশুকে স্থান ছেড়ে দিতে এবং ছেড়ে দেবার আগে পৃথিবীকে তার জন্য বাসযোগ্য করে যেতে। এই একটা প্রশ্নের মাধ্যমেই বোঝা যায় যে, কাব্যজগতটা মোটেও বাসযোগ্য নয় আর তারা সামান্য স্থানও আমাদের জন্য ছাড়েন নি বা ছাড়ছেন না। তো আমি বাংলা কবিতার একজন নবীন লিখিয়ে, আমার অগ্রজ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য একরাশ ঘৃণা জানাতেই পারি...!!!