ঈদ বিশেষ সংখ্যা
ঢাকার পুরনো দিনের ঈদ
দীপংকর গৌতম
ঢাকার ঈদ ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। ইতিহাসের তথ্য সুলতানি আমল থেকেই ঢাকায় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঢাকারঈদের রয়েছে নিজস্ব ধরন ও ঐতিহ্য। তবে মোগল আমলথেকে এ উৎসব জাঁকজমকপহৃর্ণ রূপ নেয়। ঢাকার ঈদের জৌলুসের কথা ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকেই দেখা যায়।একসময় ঢাকা মোগল রাজধানীর গৌরব হারায়। তারপরও নায়েবে-নাজিমদের আমলে ঢাকায় ঈদের চাঁদ দেখা, ঈদ জামাত, ঈদ মিছিল ও ঈদমেলার জৌলুস বজায়ছিল। ইংরেজ শাসনামলেও নবাব পরিবারগুলোর কল্যাণে ঢাকার ঈদ জৌলুসের পুরনো ধারাটা মোটামুটি অত ছিল। তবে পাকিস্তান আমল থেকে সামাজিক আচারেরবদলে ঈদউদযাপন ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে থাকে। ফলে উৎসবের ব্যাপ্তি কমতে থাকে।
ঢাকা গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ঢাকার ঈদ উদযাপন রীতি বদলে গেছে। আগের সেই আন্তরিকতা আর সামাজিক আয়োজনে এখন আনুষ্ঠানিকতাইপ্রধান হয়ে উঠছে। নবাবিকালের সেই খানদানি ঈদ এখন নেই; সময় বদলের সঙ্গে সংস্কৃতি বদলেছে। উৎসব সময়োপযোগী আবেশে বদলিয়েছে তার চরিত্র।
পুরান ঢাকার বংশালের স্থায়ী বাসিন্দা হাজী আবুবকর বলেন, আগে যা দেখেছি, সেসবের কিছুই নেই। মানুষও বদলে গেছে, উৎসবও বদলে গেছে।
আজ থেকে তিন-চারশ’ বছর আগের ঈদ পালনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তখন বর্তমান বাংলাদেশের একমাত্র ঢাকা নগরীতে জাঁকজমকের সঙ্গে ঈদ পালন করাহতো। অন্যান্য অঞ্চলে ঈদ উৎসব ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। ঈদছিল তখন ধনাঢ্য বিত্তবান ও নবাব শ্রেণীর ব্যক্তিদেরই আনন্দ-উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তখন ঢাকাছিল ধনাঢ্য, বিত্তবান ও নবাবদেরই নগরী। ১৮৪৭ সালের আগে ঢাকা ছিল পূর্ববঙ্গের প্রধান ও মূল শহর। তাই এখানেথাকতেন নবাব ও অন্যান্য মুসলমান ধনাঢ্যব্যক্তিরা। ফলে ঈদের আনন্দ-উৎসব এখানেই পেত যথার্থ উৎসবের মেজাজ। ঈদের নামাজ পড়ার জন্য শহরের বাইরে এক বিরাট উন্মুক্ত জায়গা নির্ধারণ করা হতো, যাকে বলা হতোঈদগাহ। এ রকম একটি ঈদগাহ এখনও আছে ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকায়, যা বর্তমানে রণাবেণ করছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। উনিশ শতকের শেষদিকে শহরেরমুসলমানরা ঈদের নামাজ পড়ত ঈদগাহে এবং ঈদগাহের চতুর্দিকেআয়োজন করা হতো বিশাল মেলার। ত্রিশ-চল্লিশের দশকে ঈদের দিনে ‘খাটকা’ নাচ অনুষ্ঠিত হতো।বড় বড় ময়দানেই এসব নাচের আসর বসত। কাবুলিওয়ালা, মহাজন বা ফেরিওয়ালারা এই নাচের আয়োজন করত।বর্ষাকালে ঈদ হলে অনুষ্ঠিত হতো নৌকাবাইচপ্রতিযোগিতা! এছাড়া সেকালে ঈদের দিন শিশু-কিশোরদের ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতারও আয়োজন হতো।
চাঁদ দেখা নিয়ে সেই প্রাচীনকাল থেকেই ঐতিহ্যবাহী রীতির প্রচলন ছিল। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, চাঁদ দেখা থেকে শুরু হতো ঈদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ঈদের চাঁদদেখার পর তা পরিণত হতো উৎসবে। মোগল সংস্কৃতির এধারা ঢাকা নগরে দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। মোগলদের পর ঢাকার নায়েবে-নাজিমদের আমলে নিমতলীপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে চাঁদ দেখা উৎসব এবং ঈদ মিছিলের আয়োজন করা হতো। মোগল আমলে ঢাকায় ঈদের চাঁদ দেখানিয়ে সুবেদার ইসলাম খানের সেনাপতি মির্জানাথান তার ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় যখন নতুন চাঁদ দেখা গেল, তখন শিবিরে বেজে উঠল শাহী তূর্য। একের পর একগোলন্দাজ বাহিনীছুড়তে থাকে গুলি, যেন তা আতশবাজি। সল্পব্দ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চলে এ আতশবাজি। শেষ রাতের দিকে বড় কামান দাগানো হয়। তাতে সৃষ্টিহয় ভূমিকম্পের অবস্থা।’ মোগল আমল ছাড়া ইংরেজ আমলেও ঢাকায় চাঁদদেখার এমন আয়োজন অব্যাহত থাকে। তখন ঢাকার প্রতিটি ভবনের ছাদে ছোট-বড় সবাইচাঁদ দেখার জন্য অপো করত। চাঁদ দেখামাত্র চারদিকে হৈচৈ ও আনন্দ-উৎসব শুরু হয়ে যেত।
জানা যায়, নবাব স্যার খাজা আবদুল গনির (১৮১৩-১৮৯৬ খ্রি.) সময় থেকে চাঁদ দেখা, ঈদ উৎসব পালন ও ঈদ মিছিল জাঁকজমকভাবে শুরু হয়। এরপর নবাবআহসান উল্লাহ (১৮৪৬-১৯০১ খ্রি.), নবাব সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫ খ্রি.) প্রমুখ ঢাকার চাঁদ দেখা ও ঈদ মিছিল করেছেন।
সবচেয়ে বিচিত্র ছিল ঈদের দিনের খাবারের আয়োজন। খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শিরমলি, বাখরখানি, চাপাতি, নানরুটি, কাকচা-বুলিচা, নানখাতাই, শিক-কাবাব, হাড্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোপ্তা, শাহী কাবাব, টিকিয়া, পরোটা, বোগদাদি রুটি, শরবতি রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবত ও নানা রকমফল। তবে ঈদের খাবারের মধ্যে বিখ্যাত ছিল ‘তোরাবন্দি’ খাবার। ধনী ও আমির শ্রেণীর ব্যক্তিরাই এই দামি ‘তোরাবন্দি’ খাবারের আয়োজন করত। এই খাবারেরমধ্যে থাকত চার রকমের রুটি, চার রকমের পোলাও, চার রকমের নানরুটি, চার রকমের কাবাব, পনির, বোরহানি, চাটনিসহ সর্বমোট ২৪ রকমের খাবার।আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীকেউ বাদ পড়ত না সেই খাবার থেকে।
ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকার প্রাচীন ঈদমেলা হচ্ছে চকবাজারের ঈদমেলা। এই মেলার প্রাচীন ছবিগুলো দেখে বোঝা যায়, এতে অভিজাত থেকে শুরু করেসব শ্রেণীর মানুষই আসতেন। পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দাও মরহুম মাজেদ সর্দারের ছেলে নাজির হোসেন জানান, ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি পুরানা পল্টন মাঠে ঈদেরদিন মেলা বসত। পুরান ঢাকা থেকে ওই মেলায় তারা যেতেন। স্টেডিয়ামের পরিধি বাড়ার পর মেলা বল্পব্দ হয়ে যায়বলে তিনি জানান। ঢাকায় এখন ঈদের দিনচকবাজারে ছোট আকারে ঈদমেলার আয়োজন করা হয়। এখন আর মেলাটিতে জৌলুস নেই। আরমানিটোলার মাঠে একটি ঈদমেলা বসে। তবে এসব মেলা ঈদমেলারআগের ঐতিহ্যধরে রাখতে পারছে না।
হাকিম হাবিবুর রহমান, নাট্যকার সাঈদ আহমেদ এবং আশরাফ-উজ-জামানের স্মৃতিকথা থেকে গত শতাব্দীর বিশ-ত্রিশ দশকের যেসব ঈদের মিছিল বের হয়েছে, তারবিবরণ জানা যায়। নগর থেকে ঈদ মিছিল একেবারেইহারিয়ে যায়নি। এখন শিশু একাডেমী থেকে হাইকোর্ট, প্রেসকাব হয়ে হাজারীবাগ পর্যন্ত একটি ঈদ শোভাযাত্রারআয়োজন করে ঢাকাবাসী সংগঠন।
আঠারো ও উনিশ শতকের শেষার্ধ্বের ঢাকার ঈদ মিছিলের বেশ কিছু ছবি সংরক্ষিত আছে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে। এর মধ্যে রয়েছে চকবাজারের ঈদমেলার চারটিছবি।
ঢাকা শহরে স্বাধীনতা পরবর্তী কালের ঈদের নামাজের সবচেয়ে বড় জামাত হয় হাইকোর্ট এলাকার জাতীয় ঈদগাহে। তবে প্রাচীন বিবেচনায় এগিয়ে আছে ১৪৫৭ সালেপ্রতিষ্ঠিত নারিন্দার বিনত বিবির মসজিদ। এটি ঢাকারপ্রথম মসজিদ। এখানে ঈদের জামাত হতো বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন। বাংলার সুলতান ইউসুফ শাহেররাজত্বকালে ১৪৮০ সালে মিরপুরে নির্মিত হয়েছিল একটি মসজিদ, যেখানে গড়ে উঠেছে হজরত শাহ আলী বাগদাদীর (রহ.) মাজার। তবে ঢাকা নগরের প্রথমপরিকল্কিপ্পত ঈদগাহ হিসেবে চিহিক্রত করা হয়েছে ১৬৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত সাতমসজিদ রোডের ধানমন্ডি ঈদগাহকে।
এখনকার ঈদে কোটি টাকা খরচ হলেও আগের মতো সেই আন্তরিকতা দেখা যায় কম। সবকিছুই যেন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। জাতীয় ঈদগাহ ছাড়াও নগরের৩৬২টি ঈদগাহে ঈদের নামাজের আয়োজন করে থাকেঢাকা সিটি করপোরেশন।
ওয়াসিম জাভেদ এর একগুচ্ছ নতুন কবিতা
শুধু পেছানো গল্প না বলে
আমি সময় আবার পাব
শীত পার করে গ্রীষ্ম, তার পরে
শরতের পরিচিত ঘ্রাণে
সময় ঠিকই পাব।
ফাঁক ফোকরে চলে যাবে দায়ভার,
সেদিন অত শত ভাবার প্রয়োজন থাকবে না
বিশেষ করে অনিকেত, নাসির, আর সুনন্দনকে
নিয়ে সময় কেটে যাওয়া ছোট বেলা,
আর থাকবে না।
সময় মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে ভুল করে।
শুধু পেছানো গেল না বলে
এক বুক শ্যাওলা জমে গেছে
কাজল জেঠীমার বিজয়ার নাড়ু, ফিকে পরে গেল
তবু না বলে চলে আসা দিওয়ালিতে
কিংবা দেশের বাড়ির ঈদের সালামি,
একে একে সব ভুলে খেয়েছে শুন্যতা।
বাবা বলেছে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে,
মা বলেছে ‘তুমি সুখি হলেই আমি খুশি।
আমি সুখি হতে চেয়েছি...
যদিও কোনো দিন সৌখিন ছিলাম না।
শুধু পেছনো গেল না বলে
অকারণে এগোচ্ছি কেমন স্বার্থপরের মত...
বারোর ‘এ’
আমাদের বাড়ির পাশে
আরো যেন কারা থাকে এক ঘর
তারপর আরো কারো সংসার পাতা,
তার পাশে সড়ক,
দু'ধার দিয়ে দোকান পাট,
মোড়ের মাথায় চায়ের দোকান
একটা ছোট বেঞ্চ থাকে সারা বেলা।
চোখে দেখিনি..তবে শুনেছি মোড়ে
একটা ফুলের বড় গাছ ছিল, কৃষ্ণচূড়া
সেই থেকে ফুলতলা নাম তার।
কেউ জানে না এ বাড়ি কার,
তবু চিঠি আসে এই ঠিকানায়
বারোর ‘এ’ , ফুলতলা......
গাছ কেটে নিয়ে গেছে কারা,
নাম থেকে গেছে এ যাবৎ,
মরে গিয়েও নাম আজও আছে একই রকম
ফুলের কি দাম ছিল চূড়ায় চুড়ায়।
আমি যদি মরে যাই এই বেলা-
আমার নাম কদিন মনে থাকবে?
কারা আমার নামের ফলক গাঁথবে?
চিঠি লিখবে এই ঠিকানায়
ফুলতলা, বারোর ‘এ’ ......
অষ্টম পর্ব
১. প্রাপ্ত, সে তো রপ্ত হল না আজও
দীপ্ত, সেতো ক্ষীপ্ত সারা বেলা।
২. তফাৎটুকু বেড়ার ওপারে রেখে গেছে
নিমগ্ন স্রোতে ধীরে ধীরে বয়ে যায়
পদতলে আজও আছে দু-এক ফালি মাটি,
পরিচয়টুকু স্মৃতির ওপারে থেকে গেছে।
৩. মনুষ্যত্বের বিষে মিশে সরল দোল গতি,
এক প্রান্তের ছাপোষা জীবন মধ্যিখানে
পোশাকি সাফল্য ছুঁয়ে,
অন্য প্রান্তে দু'ঢোক মৃত্যু গিলে
নিশপিশ করে,
সাবিত্রী ও সতী......
৪. লিপিবদ্ধ সীমান্তের গন্ডি
ব্যাথা নিরাময় ঔষধী
কাজের বেলায় নেই শুধু
বিষাক্ত দুরভিসন্ধি।
গ্রহনের কিছু আগে ও পরে
দাহণের জ্বালা শিরায় শিরায়
প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি আগা গোড়া
নির্লোভ আলো ধীরে ধীরে দানা ধরে,
গ্রহনের কিছু আগে আর কিছু পরে।
দিবসের শুরু,
উত্তাপে স্নান করা মহানগর
কিছুটা ঘর্মস্নাত কিছুটা অবিকৃত
তবুও দেখেছি আবছায়া ভিড় করে
গ্রহনের কিছু আগে আর কিছু পরে।
কেউ ছিল না সেদিন,
চৌরাস্তাও তেমনি শুনশান থ থ
কুকুর বেড়াল ঘুরে বেড়ালো অবাধে
একে একে এবার সবাই যাবে সরে,
গ্রহনের কিছু আগে আর কিছু পরে।
সহসা ব-দ্বীপ
ব-দ্বীপ যেন নুড়ি পাথর ঘেরা
রাস্তার গোষ্পদে,
বৃষ্টির সাথে নৌকা ডুবি খেলা।
খেলা ভেঙ্গে দ্বীপ জলেই গিয়েছে ভরে,
গ্রহনের কিছু আগে আর কিছু পরে।
গ্রহননের কিছু আগে আর কিছু পরে
ভ্রমনের সাথে অতঃপ্রত জুড়ে
আরও আছে পথে জীবন কিছু বাকি,
গ্রহনের কিছু আগে আর কিছু পরে।.........
মোজাফ্ফর হোসেন
একটি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ গল্প
বিয়ের আগে
আজ শীলার জন্মদিন। বাবা কিছুতেই যেতে দিল না। অনেক করে বললাম,নিলু, নাজমা, নাইছু, ডাক্তার আঙ্কেলের মেয়ে সকলেই যাচ্ছে; আরো বললাম,সন্ধ্যে হবারআগেই বাড়ি ফিরে আসবো, তবুও না। বাবা না বললে সেটাকেহ্যাঁ করাই কার সাধ্য! হেলাল সাহেব আমার বাবা। একমাত্র অফিসের বস ছাড়া কারও কথাই শোনেন নাতিনি। বস যা বলেন সবকিছুই মেনে নেন আর বসের ওপরের রাগটা এসে আমার আর মার ওপরে দেখান। মা নিরবেমেনে নেন, আমিও। মা প্রায়ই বলেন, ‘তোর বাপপুরুষ মানুষ, বাইরের কত ঝামেলা-ঝক্কি সহ্য করতে হয়, রাগ তো একটু করবেনই।’ আমি কোন কথা বলিনি না মাকে, না বাবাকে। ওরা এখন নিশ্চয় খুব মজাকরছে!
বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এই বাড়িটার আবার সামনে এবং পিছনে দুই দিকেই বারান্দা আছে। পিছন বারান্দা থেকে সড়ক দেখা যায়, গাড়ি আর জ্বলন্ত মানুষ দেখতেআমার ভালোই লাগে। মনে হয়, এই রোবটের জগতে আমিইএকমাত্র মানুষ। এখন আমি সামনের বারান্দায়। এখান থেকে খাঁখাঁ শুন্যতা দেখা যায়। দূরে একটি স্কুল মাঠ, ওখানে সকালে স্কুলের ছেলেরা এবং বিকালে মহল্লার ছেলেরা খেলা করে। নাম না জানলেও ওদের সবাইকে আমিচিনি। প্রতিদিন আমি বারান্দায় বসে খুঁজে বের করিনতুন কে কে যোগ দিল,এভাবে আমি ওদেরকে নিয়ে খেলি।
আজ আবহাওয়াটা বেশ গুমটে, বাতাস বোধহয় বিল্ডিংগুলোর ওপাশে আটকে গেছে। বারান্দার চেয়ারটিতে অনেক্ষণ বসে রইলাম। মা বলেছেন, আজ ছুটির দিন, ভাইয়াএবং বাবার কিছু কাপড় কেচে দিতে। ভাইয়া অনার্সফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। ওরা কলেজ থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে গেছে; বলেছে, আমার জন্য কক্সবাজারের অপরূপদৃশ্যের অনেক অনেক ছবি তুলে আনবে, আর কত কত শামুকের কসমেটিক্স নিয়ে আসবে আমি বলেছি আনতে। ‘মা চন্দ্রা, তপনের কাপড়গুলো ভিজিয়ে রাখলাম; গোসলের আগে কেচে রোদে দিস।’ ভাইয়ার নাম তপন,মামারা আদর করে রেখেছিল। আমার নাম চন্দ্রায় থাক,দাদা বলেছিলেন। দাদা আমাকে খুব ভালোবাসতেন।সবসময়দাদাভাই দাদাভাই করে ডাকতেন, আমাকে গভীর রাত পর্যন্ত নানার অতীত জীবনের বিরত্বের গল্প শোনাতেন, যার বেশিরভাগই বানানো,আমি খুব মনোযোগদিয়ে শুনতাম।
মা আবারো ডাকলেন। আমার আজ পানি নাড়তে ইচ্ছে করছে না। তবুও কাপড়গুলো কেচে ছাদে শুকাতে দিয়ে রুমে এলাম। আজ শীলার জন্মদিনে যাব বলে বেগুনিরঙের সালোয়ার-কামিজটা বের করে রেখেছিলাম। একবারভেবেছিলাম শাড়ি পরবো। নাজমা বলল, ওরা কেউই শাড়ি পরবে না। এখন আমি ইচ্ছে করলেই শাড়ি পরতেপারি। ওরা নিশ্চয় অনেক মজা করছে! শাড়িটা খুব পরতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমি আবার একা একা শাড়ি পরতেপারি না। এখন এই অসময় শাড়ি পরার কথা বললেনা নিশ্চয় ক্ষেপে যাবেন। অগত্যা সালোয়ার-কামিজটা পরলাম। গত ঈদে ভাইয়া কিনে দিয়েছিল। মাচিং করে টিপ, কানের দুল, লিপস্টিক সবই পরলাম। ওরা আজকেমনসেজেছে কে জানে! আবারো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আজ স্কুল বন্ধ-সাপ্তাহিক ছুটি। মাঠে কয়েকটি ছাগল জিরিয়ে নিচ্ছে এই অলস দুপুরে।
রুমে এসে টেলিভিশনটা ছেড়ে দিলাম। চ্যানেলগুলো শেষ অব্দি ঘুরে এলাম। বিশেষ কিছু হচ্ছে না। দ্যা টারমিনাল মুভিটার শেষ দৃশ্যটা আবারো দেখলাম। মা কাজে ব্যস্ত।আমাকে এই ভাবে সেজে-গুজে টিভি দেখতে দেখলেনিশ্চয় খুব রাগ করবেন। টিভি বন্ধ করে হুমায়ন আহমেদের আজ হিমুর বিয়ে বইটা হাতে নিলাম। গতকালই বইটাশেষ করেছি। কিছু কিছু জায়গা আবারও পড়লাম। হুমায়ন আহমেদ যদি প্রতি সপ্তায় সপ্তায় বই বের করতেনতাহলে বেশ হত! আমার না মাঝে মাঝে হিমু হতে ইচ্ছেকরে! মেয়েরা কি হিমু হতে পারে? আমাদের এই সমাজে রাতে হিমুর বয়স্ক একটা মেয়ে হিমু হয়ে যদি রাতদুপুরে রাস্তায় হেঁটে বেড়ায় তাহয়ে তার কি কি ক্ষতি হবেভাবতেইগা শিউরে ওঠে। মেয়েরা শিশুদের মত ঘরেই নিরাপদ। এসব ভাবনা মাথায় এলেই আমার আর হিমু হওয়া হয় না।
আবারও বারান্দায় গেলাম। এখন নতুন পোশাকগুলো ছেড়ে সাদা-কাল মিক্সড সুতি কাপড়ের একটি ছালোয়ার পরে আছি। কিছু দূরে একটি একটি ল্যাংড়া ফকিরকেচাকা ওয়ালা গাড়িতে করে ওর বৌ টেনে নিয়ে যাচ্ছে।ফকিরটা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর বোধহয় আমার বয়সী মেয়ে আছে; আমাকে দেখে তারকথা ভাবছে, কিন্তু দৃষ্টি বলছে অন্য কথা। আমার গা ঘিন ঘিন করে উঠল।
বিয়ের পরে
আজ আর ঘুম আসল না কিছুতেই। জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। একছিটে আলোকচ্ছটা সামনের উঁচু দালানটির ফাক গলিয়ে আমার কপালে এসে পড়ল। আলোআমার ভালোলাগে না কিন্তু রোদ আমার বেশ লাগে। দাঁড়িয়েরইলাম ঠাঁই। আমার রুমটা পশ্চিমে হওয়ায় দুপুরের রোদে বেশ তেতে ওঠে। আমার আবার গরম সহ্য হয়না। এ কারণে দুপুরে ঘুমাতে বেশ কষ্ট হত। মি. শাফিন আহমেদ, আমার হ্যাসবেন্ড, বেশ মোটা বেতনের চাকুরী করে।প্রতিবেশীরা এ জন্য আমাকে বেশ সমীহ করে।গত একবছর থেকে ওর পিছনে লেগে থেকে রুমে এসি লাগিয়ে নিয়েছি। প্রথম প্রথম এসির ঠান্ডা সহ্য হত না। এখন সয়ে গেছে, এই নতুন জীবনটার মতন। পর্দা সরিয়েদিলাম, কপাল তেতে গেছে। এসি থাকলে এই এক অসুবিধে-রুমের বাতাসকে আবদ্ধ রাখতে হয়। আচ্ছা বাতাস, তোর মন খারাপ হয়? নাকি তোরো সয়ে গেছে? ও, মানে আমার হ্যাসব্যান্ড এখন অফিসে। কাজ পাগল মানুষ। ছুটিরদিনেও গাদা গাদা কাজ নিয়ে বসে যায়। আমরা শেষ কবে একসাথে ঘুরতে বেরিয়ে ছিলাম, ঠিক মনেপড়ছে না,তবে এটুকু মনে আছে, ঐ সময় শীতকাল ছিল। বাইরে প্রচন্ড হিম বাতাস বইতেছিল। আমি মেরুন শাড়ির ওপরকাল রঙের চাদরটা পেচিয়ে রেখেছিলাম, ওপরেছিল সাদা সার্টের হালকা এ্যাস কালারের ওপর কাশ্মিরি সোয়েটার। দিনটি ছিল শুক্রবার। আমরা বোধহয় ওর কলিগের বাচ্চার জন্মদিনে গিয়েছিলাম;এর বেশি কিছুমনে নেই।গত ঈদে আমার তপনভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল, বাবা যেদিন মারা গেলেন, ঐ শেষ যাওয়া। মা কেমন আছেন কে জানে ! গেল সপ্তায় তপন ভাইয়েরমেয়ে হয়েছে, আমার মতন নাকি দেখতে!
রিমোর্টটা হাতে নিলাম। এখন পরিচিত কোন সিরিয়াল নেই। যেগুলো হয় পুনঃপ্রচারিত, রাতেই দেখা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তাও দেখি। ওদের কি হবে আগে থেকেই বলেদিই,ভবিষ্যৎকে যদি এমন করে দেখতে পেতাম, মাঝেমাঝে খুব লোভ হয়! আজ শনিবার। এই দিনে তেমন কিছু হয় না। আমির খানের অনেক পুরানো একটা সিনেমাখুলে বসে থাকি। সিনেমাটি যে কতবার দেখেছি তার ইয়াত্তা নেই। আমার যদি ভুলে যাওয়ার কঠিন কোন রোগথাকতো, তাহলে টিভি দেখেই দিব্যি কাটিয়ে দিতেপারতাম কয়েকটি জীবন। ঘন্টাখানেক টিভির সামনে ঠাঁই বসে রইলাম। ৭৭টি চ্যানেল আছে, সবগুলো কয়েকবার পাক মেরে এসেছি। রিমোটের ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছেতাইঝুঝি এক চাপে কাজ হচ্ছে না। বিদ্যুৎ চলে গেল। দুপুর দু’টা, এই সময় একবার যাবেই। এ মাসের সানন্দাটা নিয়ে বাইরের রুমের সোফাই গিয়ে বসলাম। এইসংখ্যাই রুপ চর্চার ওপর ভালো একটা আর্টিকেল আছে, গতকাল ট্রাইকরেছিলাম। এই সংখ্যাই মেয়েদের ব্যয়াম নিয়ে দীর্ঘ এক ফিচার আছে। আমার ঠিক কাজে লাগবেনা তবুও পড়লাম। বাংলাদেশের মেয়েরা নাকি বসে থেকে থেকে মুটিয়ে যাচ্ছে। আমার স্বামীর আবার স্বাস্থ্যবান মেয়ে পছন্দসুতরাং আমার শরীরে আরেকটু মাংস লাগলেমন্দ হবে না, সে বরং খুশিই হবে। বাচ্চা হওয়ার পর মেয়েদের স্বাস্থ্য নাকি ঢিলে হয়ে যায়, আমার ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। সানন্দায় কারিনার স্বল্প কাপড়ে বেশ বড়সড় একটাছবি প্রিন্টকরা হয়েছে, বাঙালি মেয়েদের ব্যামের সুফল বোঝানোর জন্য এই আয়োজন। এতে করে অবশ্য পুরুষ মহলেও সানন্দার কদর বাড়বে। পুরুষদের কিত্তির কথাভাবলে মাঝে মাঝে আমার খুব হাসি পাই, আবার করুনাও হয়।সানন্দাটা বেশ কয়েকবার উল্টে-পাল্টে দেখলাম, পড়তে আর কিছুই বাকি নেই। প্রতি মাসে তিনটে করেবেরুলে বেশ হত। ওটা টেবিলের ওপর রেখে বারান্দায় চলে আসলাম। যখন তখন বারান্দায় আসাতে স্বামীর বারণ আছে, এ কারণে কেন জানি বারান্দায় আসাটা বেশিহয়ে যায় ইদানিং। এ বাসাতে একটিই বারান্দা। যতদূর চোখ যায় বিল্ডিং আর বিল্ডিং,উঁচু-নিচু, চ্যাপ্টা-সরু, নতুন-পুরানো, ঝকঝকে-ধূসর বিল্ডিং। আমাদেরবিল্ডিং এর এই পার্শেছোট্ট একটা জায়গা ফাকা পড়ে আছে। এই জায়গাটি বেশ নোংরা। আশে পাশের বিল্ডিংগুলোর যতসব আবর্জনা এখানে এসে আবাস গড়ে,খুব বাজেএকটা গন্ধ বেরুই ওদের শরীর থেকে। আমি এই পাঁচতলা থেকেও দিব্যি টেরপাই ওদের অবস্থান। জায়গাটির এক কোনায় খুব স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ, গাছটির নাম জানা হয়নি আজও। আমার স্বামীকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। ও আবার উদ্ভিদবিদ্যায় খুব কাঁচা। বাড়ীর কাজেরমেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওবলেছে পাতা না দেখে বলতে পারবে না। সমস্যা হল, গাছটিতে পাতা গজাতে দেখেনি কখনও। আচ্ছা, ও বেঁচে আছে তো? অনেক আগে একবার রাস্তায় একটি কুকুরদেখেছিলাম : শরীরে কে বাকারা যেন গরম পানি ঢেলে দিয়েছিল, ফলত শরীরে কোথাও কোন লোম ছিল না। আমি দেখেই বমি করে ফেলেছিলাম। গাছটিকে দেখলেআমার ঐ কুকুরের কথা মনে হয়। এখন আর বমি পাই না আমার, খুব করুনা হয়গাছটির জন্য। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেন গাছটির সাথে মিশে যাচ্ছি ক্রমশঃ।বারান্দায় বসে থেকে আমি গাছটিকে দেখিঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়। বজ্জাত কাকের দল সব ময়লা আবর্জনা ঘেটে ঘেটে গাছটিতে চেপেবসে। আমি অনেক বারণকরেছি, ধমকও দিয়েছি, কাজ হয়নি। শূন্য গাছটির শরীর জুড়ে যখন ক্ষুধার্ত কাকের দল হা করে ঠিকরে তাকায় আমার দিকে। ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় আমি।তড়িঘড়ি করে কপাট লাগায় দরজার : পন করি, বারান্দায় আর নয়। গাছটির মায়ায় এ পন বেশিক্ষণ টেকে না। আজ কাকগুলো কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। আমিঅনেকক্ষণ গাছটির সাথে কথা বললাম। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে চমকে উঠি। কে যেন গেটে, কেআর হবে এই ভরদুপুরে,আকলির মা থাকাতে আমার ভালোইহয়েছে। গেট খুলতে না খুলতে শুরু হয়ে গেল ওর বকর বকর।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে আরও একবার বসলাম। চুলগুলো আচড়ানো শেষ করে নতুন টিপগুলোর কয়েকটি ট্রায়াল দিলাম। গত সপ্তাহে ও আমার জন্য দুটো ড্রেস কিনেএনেছে। ওখান থেকে কালো রঙেরটা বের করলাম। ড্রেসকেনার পর আর বাইরে যাওয়া হয়নি। রুমেই যে কয়েকবার পরেছি। এখন কাল রঙেরটা পরে দেখি, হুম, নাথাক, একবারে গোসল করে পরব। টিভিটা আবার ছাড়লাম। গতরাতে দেখা সিরিয়ালটা আবার দেখলাম। তিনটাবাজতে আর বেশি বাকী নেই। আজ ও লাঞ্চ নিয়েঅফিসে গেছে। এখন গোসল করার দরকার। টিভি অফ করে গোসলে গেলাম।
গোসল সেরে আবারও ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলাম। অনেক্ষণ। আমার আয়নার সামনে বসতে মোটেও ভাল লাগে না, তবুও বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। আয়নারভেতর আমি আমার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখতেপাই। টেবিল থেকে রবিনসন ক্রসো বইটা নিয়ে বারান্দায় গেলাম।
যখন আগ-পিছ বলে কিছূ নেই
খুব পাশের বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে। ঐ বাসায় গেলে আরজু আবার খুব রাগ করে। আরজু আমার একমাত্র ছেলে। আরজুর এক ছেলে। আরজুর বাবা মারা যাওয়ার পরথেকে ওর ছেলেটা নিয়েই যেটুকু ব্যস্ত থাকি। বৌমাব্যাংকে চাকুরি করে। ওরা দু’জনে বেশ ভোরে বের হয়ে যায়, বাড়ি ফেরে পড়ন্ত বিকেলে, মাঝে মাঝে সন্ধ্যাও হয়েযায়। রামিম মানে আরজুর ছেলেও বেশ ব্যস্ত। সেই সকালে স্কুলে যায়, বাসায় ফেরে দুপুরে, তারপর শুরু হয়হোম টিউটিরদের আসা,কেউ অংক শেখায়, কেউ ইংরেজি, কেউ ছবি আঁকা, কেউ গান, কেউবা আবৃত্তি কোনো কোনো দিন রাত অব্দি চলে যায়। আমাকে কোনকিছুই করতে হয় না।
এ বাড়িতে আবার কোন বারান্দা নেই। পাশের বাড়ি যাব সেটাও বারন। আরজুকে কত করে বললাম, বাড়িটা চেঞ্চ করে বারান্দা আছে এমন বাড়ি নিতে। আরজুকিছুই বলে নি। আরজু অনেক ব্যস্ত, ঠিক যেমনটি আমার বাবাছিল, যেমনটি ছিল ওর বাবা। আমার বারান্দা নিয়ে ভাববার সময় ওর নেই।
আমি কি চাই, আমার ভেতরটা কি বলে ওরা কোনদিনই জানতে চায়নি,না আমার বাবা, না আরজুর বাবা, না আরজু। একদিন আমি নদী হতে চেয়েছিলাম, কাশফুলের বনে দেহ এলিয়ে ভেসে থাকতে চেয়েছিলাম, চেয়েছিলামনগ্নপায়ে শিশিরস্নাত ক্ষেতের আইল ধরে এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতা ঘুরে বেড়াতে। আমি ব্যস্তথাকতে চেয়েছিলাম। আমিও ওদের মত সমাজের কেউ হতে চেয়েছিলাম। একসময় ছিলাম হেলাল সাহেবের মেয়ে, পরে হলামতপনের বোন, শাফিনের বউ, আরজুর মা; আর এখন, রামিমের দাদি। শুধু পরিচয় বদলেছে থেকে থেকে, এছাড়া আর খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি আমার;ভালো ছিলাম, ভালোই আছি!
বেদনার নীল
এখানকার তথাকথিত নিচু শ্রেণীর লোকদের সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ জমে উঠেছে; কেননা আমি ওদের মত নই, যারা গরীবদের কাছে গিয়ে তাদের দুরবস্থা নিয়েঠাট্টা করে তাদের বেদনা আরও বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য আমিজানি পৃথিবীর ধনী-গরীব এক হবার নয় এবং ওদের দুঃখ-কষ্টও ঘুচবার নয়; কেননা আমাদের সাথে সাথেপ্রকৃতিও এই দুই শ্রেণীর মাঝে একটা হিম শীতল ব্যবধান বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে আমি মনে করি যারা আত্মসম্মানেরখাতিরে গরীব অন্ত্যজদের কাছ থেকে দূরে থাকেতারা সেই সব কাপুরুষদের মতই হীন, যারা পরাজয়ের ভয়ে শত্রু থেকে দূরে লুকিয়ে থাকে।
সম্প্রতি একদিন আমি মাঠে গিয়েছিলাম। দেখি একজন বয়স্ক লোক বোঝা ওঠাতে পারছেনা। আমি কাছে যেতেই লোকটা কেমন সংকোচ বোধ করল; আমি জোর করেবোঝা উঠিয়ে দিলাম। বাবুদের মত ঠক করে ধন্যবাদ নাদিলেও তার চোখে মুখে যে বিনয়ের ছাপ ফুটে উঠলো তাতে মনে হল আমি তার দেবতা।
সব মিলিয়ে আমি কিন্তু বর্তমানে বেশ সুখি; তারপরও মনটা কেমন জানি পালাই-পালাই করছে । ইচ্ছে করছে কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। সত্যি বলতেমানুষের এই মেপেজুখে চলা আমার আয়ত্বের বাইরে; একঘেয়েমি সুখকেও ঠিক মেনে নিতে পারিনা। তাই হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলাম, সিলেট যাব। নতুন পরিবেশে নিজেকেনতুন করে জানা হবে। সবকিছু প্রায় ঠিকঠাক, শুধু খারাপ লাগছে ঐ ঝুনু পাগলিটার জন্য। এখানকারসকলের চেয়ে ও আবার আমাকে একটু বেশিই ভালবাসে। বর্তমানেপাগলিটাও আমার কাছে বিশেষ কেউ হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে যত কোটি মানুষ ঠিক তত কোটি ভাষা আছে, আর তা হল চোখের ভাষা। মুখের ভাষায় আমরাসহজেপটি আর চেখের ভাষায় হয়ে পড়ি অসহায়। আমাকে ও বেঁধেছে চোখের ভাষায়। যে আমি ফুটন্ত জ্যোস্নার মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেছি অনুভূতিহীন, রঙধনু মাখানো সন্ধ্যায়ঘুমিয়েছি আয়েশ করে, বহুবার হাতে নিয়েও পড়তেপারিনি শেষের কবিতা, উত্তম-সুচিত্রার সাগরিকা দেখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি অসময়ে, সেই আমি রাস্তার নোংরা একপাগলীর ভালবাসাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি নিজের অজান্তেই; পৃথিবীর অনেক কিছু জানলাম, নিজের মনকেজানা হল না আজো !
বলতে দ্বিধা নেই, পাগলিটাকে বেশ আমি আপন করে ফেলেছি যদিও তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানিনা। লোক মুখে শুনেছি বছর বিশেক আগে ও এ অঞ্চলে এসেছেতারপর আর কোথাও যায়নি। হাঁটার সময় পুঁটলির ভিতর ঝুন্-ঝু্ন্ করে কি যেন একটা বাজে এজন্য সকলে ওকে ঝুনু পাগলি নামেই ডাকে। এতদিনেও একটা জিনিসআমি বুঝলাম না, ছোট বাচ্চাদের দেখলেই ও কেমন জানি ছটফট করে। এইতো সেদিন রাস্তা থেকে একটা বাচ্চা তুলে নিয়েপালাচ্ছিল, লোকজন তো মেরেই ফেলতো, শেষমেষ আমি হয়ে রক্ষা। এর আগেও ওকে আমি এমন ঘটনার হাত থেকে বেশ কয়েকবার বাঁচিয়েছি। হয়ত তারই জন্যে ও আমাকে এত ভালবাসে। আমার চলেযাওয়াটা কোন ভাবেইমেনে নিতে পারছেনা। জামা কাপড় গোছগাছ দেখে ভেবেছে আমি ওকে চিরদিনের জন্যে ছেড়ে যাচ্ছি। পাগলি তো তাই কোন কথাই বোঝানোগেলোনা, অভিমান করে ইনিয়ে-বিনিয়ে কি যেন সব বলে গেল!
ভোর ছ’টায় ট্রেন; তৈরী হচ্ছি এমন সময় একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলল, ‘‘ঝুনু পাগলিটা Road accident করেছে’’। আমি আর নিজেকে দমিয়ে রাখতেপারলাম না। সংগাহীন এক ভালবাসার টানে ছুটে গেলাম তার লাশেরপাশে। মনের অজান্তেই কয়েক ফোটা অশ্রু মিশে গেল রক্তে।
একি দুর্ঘটনা নাকি স্বেচ্ছায় হনন? আচ্ছা ওতো আমাকে প্রচন্ড ভালবাসতো, এমনতো হতে পারে আমি চলে যাচ্ছি বলেই..., নাকি এটা আমার দুর্বলতা! মাঝবয়সী একলোক ওর এতদিনের সযত্নে লালন করা পুঁটলিটা ঝেড়ে ফেলল; বের হয়ে আসলো বাচ্চা ছেলের কয়েকটা পোষাক, একটা ঝুমঝুমি ও একটা ফটো, কিন্তু একি দেখছি! এতো আমার-ই বাল্যকালের ছবি তাহলে কি এই পাগলিটাই আমার...! কিন্তু তাই বা হয় কি করে আমার মা তো মারা গেছেনঅনেক আগে। আর দেরি না করে চলেআসলাম বাবার কাছে; ছবিটা দেখা মাত্রই কেমন যেনো মুষড়ে গেলেন তিনি। অতঃপর চলে গেলেন অন্য এক জগতে : ‘‘কলেজে আমাদের প্রথম পরিচয়; ঘটনাচক্রেআমাদের ঘনিষ্টতাআড়ালে আবডালে আলোচনা-সমালোচনার বেশ জনপ্রিয় বিষয়ে পরিনত হয়। দুটি ভিন্ন সপ্রদায়ের এই সখ্যতা যেন সমাজের মাথা ব্যঁথার প্রধান কারণহয়ে দাঁড়ায়। আমরাও যেনো সমাজকে ভুল প্রমানিত করার জন্য উঠে পড়েলেগেছিলাম। এক পর্যায়ে আমরা পরস্পরকে ধর্ম, সামাজিক রীতি-নীতি, অর্থনৈতিকবাস্তবতা সবকিছু ছাড়িয়ে ভাবতে থাকি; যদিও জানতাম, দুটো মানুষ একটা পরিবার তৈরি করতে পারে, একটা সংসার তৈরি করতে পারেকিন্তু কখনো একটাসমাজ তৈরি করতে পারে না। সমাজ মানেই অনেকের সমষ্টি, দুইজন মিলে একাধিক হওয়া যায় অনেকে হওয়া যায় না। কিন্তু সেই সময়টাই ছিল এমন যেন আমরাকোনকিছুতেই দমবার পাত্র নই; বলা যেতেপারে ‘লাভ ইন লাভ’। সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ে করার; সমাধানটা হল এমনএকদিকে মসজিদ অন্যদিকে মন্দির মাঝখানটাএকান্তই দুজনার, তৃতীয় কোন ইস্যু থাকবেনা সেখানে। বেশ ভালই কাটছিল; তারপর জন্ম হল তোমার।তোমার আগমনে বেশ কিছু নিয়মেরও পরিবর্তন জরুরী হয়েউঠল। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি হলাম না। আমি চাই তুমি বড় হয়ে আমার অনুসারী হবে, শিপ্রা চায় তার। শুরু হল কলহ, বিশৃংখলা।একপর্যায়ে আমি আশ্রয় নিলাম পুরুষত্বের, সবকিছু একবাক্যে নস্যাৎ করবার সর্ব শক্তি যেখানে নিহিত। যে ক্ষমতা পরিবর্তনে ধর্ম পরিবর্তিত হয় সেখানে শিপ্রা তো একজননারী! তাই জোর খাটিয়ে বললাম, হয় তুমি আমার সবকথা মেনে চলবে নতুবা সংসার ছাড়বে। শিপ্রা আমার কাছে আশ্রয় চেয়েছিল একজন মানুষ হিসাবে, একজনহিন্দু হিসাবে নয়, কিন্তু আমি ততদিনে সর্বাংশে একজন সমাজের কেউ; সমাজস্থ কিছু লোকের প্ররোচনায় শিপ্রাকেমারধর করে বাড়ী থেকে বের করে দিলাম। বছরখানেকের মাথায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে শিপ্রাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করি। এক সময় দেখা পেলেও কোন লাভ হয়নি কেননা ততোদিনে সে এক বদ্ধ উম্মাদ...! তাইঅনেকটা ভেবেচিন্তে এবং তোমার অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে এতদিন তোমাকে আমি মিথ্যে বলে এসেছি। ইনিই তোমার গর্ভধারিনী...!’’
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। পায়ের তলার মাটি যেন সরে সরে যাচ্ছে। বিশাল এক ভূমিকম্প বয়ে যাচ্ছে সমস্ত দেহে। টলতে টলতে নেমে আসলাম রাজপথে।দুই আঙ্গুলের মাঝখানে জমে থাকা নীল বর্ণের রক্ত দেখেমাথার ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল। দৃষ্টি মেলে দিলাম শূণ্যে : চারিদিকে শুধু নীল আর নীল;আমার বেদনারনীল।
শিমুল সালাহ্উদ্দিনের কবিতা
প্রতিভাভষ্ম
বালিতে ভাজ্ছি কবিতার বই
বালিতে ভাজ্ছি শিরস্ত্রাণগুলি
রক্তে কাগজে বানানো ভষ্ম
কোথায় যে ফেলে আসি!
ঠনাৎ কাসার থালা,
কেঁপে ওঠে জ্যান্ত কবিতা
অন্ধকবির থালায়, পল্টনে।
দিক নির্দেশনা
ভালোবাসার মুখ ফেরাও নিজের দিকে; আবার সব ভালোলাগবে। মাঝে মাঝে দ্বিধার করাত ঘুরে ঘুরে বুকের ভেতরে ফাঁকা ভেতরটা দুইভাগ ক’রে দেয়- সন্দেহে সমুদ্রশীর্ণ জলমরা নদী।
যেহেতু তোমার আনখকম্পন ধরে আছি বুকের ভেতর।
অথচ দেখো, যে বুকেই পড়্তে চাও, লুকোনো অবিশ্বাসের ভয় ছিটকে আনে, ভয় হয়। পাইলটে কালি ভরতে গেলেই দুম্ করে উলটে যাবে পৃথিবীর দোয়াত।
ভালোবাসার মুখ ফেরাও, আবার সব হবে। হয়। তোমার পাশে সবার হাত। মুখের পাশে মুখ।
অশ্বডিম্ব
শূন্যতা খুঁজে চলে শূন্যতা আরেক। উভয়ের কারো কোন পাঠশালা-ইশকুল নাই। ছবি নাই, গান নাই, আরশিতে একটু দাঁড়ানো মুখ দেখা নাই। তৈরি বা লয় নিয়া শলানাই, পরামর্শ নাই। দাবিদাওয়া দেওয়া নেওয়া নাই।
খালি এ ওরে আঁকড়ায়া ধরে রোদে শীতে হিহি করে, হিহি হিহি করে, সন্ধ্যাতক মেঘে ভিজা পাপে, কিছুটা বৃষ্টি দূরে হিহি হিহি কাঁপে
একা মেঘ খোঁজে দূরে আরো একা মেঘ। দেখা হয়। দুজনে একসঙ্গে থাকে। থাকে। তারপর বজ্রপাত হয়।
এভাবে কোথাও কিছু, পূর্ণ হয়, পূর্ণ হয়ে ওঠে।
অভ্যাস
ভুল দেখো না নারীকে তুমি
জেনো উচ্ছিষ্ট
হয় না কখনো নারী।
ইরাবতী ঋতুমতী হলে
বিশ দিন বেড়ে যায় পৃথিবীর আয়ু।
নারীরা দুঃখ পেলে ঘাসের বিস্বাদ লাগে
মোমের শরীর ভোরের শিশির।
এভাবেই, তুমি ব্যথা পেলে টের পাই আমি।
আকস্মিক
সুবিশাল প্রতিভার পাশে ইঁদুর বিড়াল হয়ে প্রলাপ বলে চলে,
পাশ-বালিশ পা’য় জড়িয়ে মাতৃভাষা বলে:
দুধভাতমাছ খাই, মানুষ খাই না, চলে?
ঈশ্বর
একলা ডোবা একলা ভাসা
একলা বলেই ফিরে আসা একা
একেক্কে এক বলেই দেখো
কেউ শেখেনি থাকা
একলা একা গাছের তলে
একলা বসা জীবন ডালে
নির্জনতা একলা ঠোঁটে বাঁকা
ঠোঁকরানো আর চাখা
হাতের কাছে চঞ্চলতা
ত্রিলোক আছে অনিন্দিতা; পঙ্কিলতা
বুকের ভেতর ঠিক কিন্তু ফাঁকা
রক্তরেখাগুলি
চুপচাপ। ঘর অন্ধকার। বসে আছি। থির। এসো না। এসো না তুমি আর। ভিক্ষুকের মতো। তুমি যে রাজার দুলালী ওগো। বন্ধ দরোজায়। করাঘাত করো। বারবার।বারংবার। দশবার, বিশবার। হয়তো প্রথমে সাড়া দেব না।হয়তো অভিমান। দেহমন উচাটন। তবু কণ্ঠরোধ। তুমিতো জানো না। বন্ধুরা পালিয়েছে ফেলে। সঙ্গহীনআমি। লোকেদের ভীড়ে। বসে আছি। ভাবছি-
এখনও আমার ঠোঁটে। যৌবন রয়েছে লেগে। ভালোবাসা। দস্যুর মতো। হঠাৎ দস্যুর মতো এসো। ভালোবাসা। তোমাকেও একদিন। দ্বারস্থ হতে হবে। রক্তরেখাগুলির।
কালস্নান
অস্থিরতা অস্থিকথা কুড়িয়েছি চিতাভষ্ম থেকে সারারাত্রি ঘুরে
নাভি ও অঙ্গারগুলি হাই তোলে ধোঁয়াটে ঢেঁকুড়ে
ঢুকে গেছে আমার ফুসফুসে
যার ডাক শুনে কাঁদি আমাকে সে
শূন্যের মোচড়ে ব্যোম-ভাঁজে-ভাঁজে দিলো ছুড়ে
পুতলো লুব্ধক চাঁদিতে আমার গোল ছিদ্র করে
ঘামরজঃরক্ত শুষে
নীল কালো রাত্রি চুষে।
সাকিনগোত্রহীন রাত্রির চাল রাষ্ট্রময় মধ্যস্রোতে দাঁড়িয়েছি
মরা মানুষের নক্ষত্রের দেশে রক্ত মাখা ভাত খেয়ে বেঁচে আছি
এই মরা শহরেও গজায় নতুন পাতা, ফুল ফোটে, প্রজাপতি ওড়ে,
খুব খুব আকাশ উঁচুতে দু-একটা মিষ্টি ফল সোনালিরোদে ওঠে ভরে।
সঙ্গত
মুহূর্তগুলোকে অখণ্ড সময়ে বিলীন করে দিয়ে
বাস্তবতার নগ্নস্রোতে ভেসে-ডুবে
প্রতি মুহূর্তে যার সাথে বসবাস তার নাম প্রেম নয়
উৎকণ্ঠা
ট্যারা চোখ। প্রেম।
অচেনা অতিথির মতো। ঢুকে পড়ে তাচ্ছিল্য হেসে।
সারাবাড়িতে। চিহ্ন আর স্মৃতি ফেলে। হঠাৎ অদৃশ্য হয়।
তারপর সারাটা সময় জুড়ে।
আমরা কেউ আর উৎকণ্ঠা।
আমরা একজন আর উৎকণ্ঠা।
পাশাপাশি রেলপাত। চলতে থাকে।
রাত থেকে দিন। দিন থেকে রাত।
সকলের কাছে প্রেম তাই
বউ কথা কও, ওই তো বাজে শাখ্
শাদাকালো ছবি।
সূর্যাস্ত
শাড়ির পাড় ততণে ঝুলে পড়েছে দূরগামী পাদুটোর আরো নিচে
দুম্ করে যেন রঙ পাল্টাল আকাশ
ছাইচাপা শরতের মেঘের আড়ালে
ভেতরের, আড়ালের কথা
জানা যায়নি সারাদিন।
মুহূর্তে আকাশের রঙ বদলে গেল।
এখন সূর্যাস্ত।
স্থবির
কবি মানেই সহমর্মী বলেছেন এক কবি
কবি এক বলেছেন সহমর্মী মানেই কবি
পাশের বাড়ির দোতলায়। কোনার ফ্ল্যাটটাতে। আলো নিভে গেলে বুঝি। গভীর হলো রাত। আমি আমাদের ছাদে। আমগাছটার আড়ালে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।সিগারেট খাই, আর প্রতিদিন। ভিন্ন ভিন্ন রমণীর সাথে। লোকটারসঙ্গম দেখি। ইদানিং একঘেয়ে লাগে। চারিদিকে শুধুই ভালোবাসার কথা। গল্পে, উপন্যাসে। একজনআরেকজনকে ভালোবাসে। আর তাদের। বিয়ে হয়ে যায়। অফিসে, কারখানায়। কত রকমের অফিসার আর আর্দালি।কলেজে, গানের স্কুলে। কত রকমের অধ্যাপকআর ওস্তাদ। ভালোবাসায় ঝকঝক করছে তাদের মুখ। ঝকঝক করছে তাদের চশমা। আংটি আর জামার বোতাম। আর বিশাল এক আকাশের নীচে শুয়ে থাকতেথাকতে আমরাস্বপ্ন দেখছি, আমরা সুখী হয়েছি। আমাদের ছেলেপুলেরা সুখী হয়েছে। তাদের ছেলেপুলেরা। মেয়েদের কাছে এটা চাইছে ওটা চাইছে। মেয়েদের জন্যজান-জীবন দিচ্ছে। আমার দুঃখ এই। স্বপ্নগুলো স্পর্শ করতে পারি না। হাত দিয়ে।
সারাদিন আজ। শুধুই তোমার কথা। মনে পড়ছে।
এখানে। আশেপাশে আছে। কিছু ধাতব-মানুষ। ধাতব বউ নিয়ে তারা। অনবরত ঢুকে পড়ছে। স্টারসিনেপ্লেক্সে।
সমুদ্রের পাশের। ওইযে ওই ছোট্ট শহরটাতে। হালকা পায়ে। কোন্ শিশুদের সঙ্গে তুমি খেলে বেড়িয়েছো আজ? বিছানায়। কার জামা ধরে। কার জামা ধরে তুমি। টানদিচ্ছো এখন? নোংরা আর ঘেমে ওঠা চেহারাটা নিয়ে।দারুণ কাটালাম। এবারের গ্রীষ্ম। আর এখন শরতের রাতে। দূরে। শান্ত নূরজাহান লেন। আমি কিছুই করছি না।আমি ঘুমুচ্ছি না। লিখছি না। শুধুই মনে পড়ছে। আমাদের পুরনো সকালবেলার কথা। আর দুপুরবেলার কথা।আর বিকেলবেলার কথা। মনে পড়ছে। আকাশের দূরকোনায়। সেই কবে! একটা মাত্র তারা জ্বলেছিল। জ্বলে যাচ্ছিল। লিখে রাখিনি কিছুই। রাত্রিদিন। আমি কেবল। অলৌকিক একটা আকাঙ্খা। বুকের ভেতর নিয়ে বেঁচেচলেছিতোমার জন্য...
যদি ভালো থাকি। ফোন করব আবার। কাল বিকেলবেলা। আর তুমি ধরবে না। তুমি ধরবে না কিন্তু তোমার মনে পড়বে। মনে পড়বে এ ফোনটা। ধরা যাবে না।যাক, বাদ দাও। তুমি এখন ঘুরে বেড়াও। স্বপ্নের ভেতর। আরআনন্দ কর। যার ইচ্ছা তার। যেথায় সেথায়। যার তার বিছানায়। তুমুল আনন্দ করো।
শোনো। একটি মেয়ে। সিএনজির ভেতর। গতকাল সন্ধ্যায়। চারুকলায়। একা-একা কাঁদছিল। দেখলাম। কবিরা ঈশ্বর। তাই আমি শুনে ফেললাম। এটুকু পড়েই তুমিদাঁতে দাঁত চেপে বলছো- “আমি কি আর কম কেঁদেছি!”
ঢেউ
তুলসী পাকুড় বট- হারিয়ে যেও না
বেতস বৈঁচি বিষকাটালিরা থাকো, পাশে থাকো
সবচে’ কষ্টে থাকে যেই ফুল কুয়াশা জড়ানো
শিশিরসিক্ত মানবিক লণ্ঠন
এ-তো মণ্ডপ, ও-ই মসজিদ, ষষ্ঠীর বোধন
থাকো, পাশে থাকো।
প্রথম কপোল বেয়ে ঝরে পড়া জল, থাকো।
ফেরানো ময়ূর মুখ, প্রহারের দাগ, সারাদেহ-পিঠ-
থাকো ‘ও অনুগ্রহ’ থাকো
পাখি, ও পাখি আমার-
মন, ও মন আমার- স্মৃতিকাতরতা
হারিয়ে যেও না।
যাও, যাও, যাও-
যেমতি চলিয়া ঢেউ যায় একা
ঢেউয়ের মতন রেখে যাও ওগো
আমার চিহ্ন শুধু বালুতটে ছিন্নভিন্ন ফুল
রেখে যাও তুমি যাবার আর্তনাদ
বুকের ওপর তীব্র নখরাঘাত
সিক্ত তিক্ত তিতি-বিরক্ত এ উদভ্রান্ত ঝড়-দুড়ন্ত জলপ্রপাত
এসো, এসো, এসো-
ঘোচাতে দূরতা যেভাবে তীব্র তীরে আসে ঢেউ
বহুদূর থেকে ছুটে এসো তুমি অমল-ধবল সাধ
শাদা দাঁতে তুমি বিদ্ধ করো এ সোনালি চিবুক-
পদাঘাত করো শিথিল বালির
অতল পাতাল কলিজা-জঠর চরে; এ-সলীল নায়
যেও না! যেও না!
কিছু না বলেই ঢেউ যেমতি চলিয়া যায় ॥
অদৃশ্য সংসার
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে নলের বেড়া
ওরে হাত বাড়ায়া দিতে পান কপাল দেখি পোড়া ॥
(আব্বাসউদ্দিনের গান, সুর:সংগ্রহ, কথা: কানাইলাল শীল)
এখনো রয়েছো নাকি সোনা!
ও সোনামন, শিমুল শিমুল ডেকে
শিমুল তুলোর মতো উড়িয়েই দিলি
সমস্ত অনুভব উদ্ভাসন থেকে!
এখনো আছিস নাকি!
দৈব দুপুরে যেই ধ্বক করে ওঠে বুক
অমনি সাঁই সাঁই উড়ে উড়ে যায় কালোমেঘ
সূর্য খসে পড়ে ঘাসে।
সব শব-অন্ধকার।
চিমনিহীন অদৃশ্য লণ্ঠন ফেটে
ঢুকে যাচ্ছে শরীরে যকৃৎ-এ ভাঙা কাঁচ
আমার হাত পা ফাঁপা
মাথার ওজন নেই
অনু, বেঁচে থাকে কতদিন লোকে?
দু’চোখের ফোয়ারার নীচে বসে
একটি চাতক পাখি
শুষে নিচ্ছে আমাকে করাল
ঝুর ঝুর ঝুরঝুর বালি ঝরে পড়ে
অথচ শোণিত আর্দ্র
শুকনো প্রাণে
এখনো রয়েছো নাকি!
তবু মনে পড়ে, তবু ভাবি-
ষষ্ঠীর বোধহন হলো শুরু।
সপ্তমী অষ্টমী। নবমী।
তারপরইতো দশমী।
বিসর্জন।
নদীর থমকে থাকা স্রোতে
প্রতি ষষ্ঠীতেই
কেন যে অন্তত একটি চোখ
ধড়হীন উল্টানো মুণ্ডু ভেসে ওঠে!
সতীনের মোচড়
মেঘমেদুর। রোদ্দুর রোদ্দুর। অপো। অপেক্ষাশেষে। এক গণ্ডূষ জল। কিংবা খরা। রুখু মাঠে হাঁটতে হাঁটতে। মাঠপারে। মেঘের ডম্বরু। লাল রঙে আঁকা দরোজা তোমার।তোমার দরোজা থেকে। বলবো বলবো করে ফিরে। ফিরেফিরে আজ। বলে ফেললাম সেই কথা। কথা। চুপ। কথা। কথাচুপকথা। অমনি নামলো বৃষ্টি, বৃষ্টির বিহ্বল ঠাণ্ডাশীৎকার। স্নান। আর সৎবিৎ ফিরে পেয়ে। মনে হলো। সত্যি বলেছি কি! বলতে কি পেরেছি সেই কথা। কথা। চুপ।কথা? সেই কথা। যা আমার। একান্ত। আমারই?
সুভিক্ষ কথার দুর্ভিক্ষে এসেছে হাহাকার। এসে অনিবার্য প্রগল্ভ সৃষ্টিকে বুকের ফাটল থেকে আচমকাই দিয়েছে ছলকে! বলতে না পারার রহস্যরাস্তায় রাখি এই আনাগোনা।এই আনাগোনা। চকিত দ্বিতীয় স্বত্বা। সঙ্গে দ্বিধা। পেরেছিতো! বলতে পেরেছি তো!
দীপ্ত মোম যেভাবে শিউরে ওঠে আনমনে, সেভাবে শাড়ির খসখসে তুললে হাওয়া- সেই হাওয়া মুচড়ে মুচড়ে ঢুকে পড়ছে। ঢুকে পড়ছে। অলিন্দে। অলিন্দেআমার।
আলোস্মৃতি আলোবিস্মৃতি
আবার আমার ঘরে ফিরে আসি রাতে। মনে পড়ে শুধুই তোমাকে মন। এখন অনেক রাত। আমার ভ্রমণ শুধু। তোর দুই চোখে। থেমে যায়। জানিনা এখন তুই কার শূন্যঘর আলো করে ভালো করে কুকুরাসনে মুগ্ধতা ছড়িয়েদিচ্ছিস, অথচ আমার ছোট্ট একলা ঘরে আলো আজ-
তোর সোনামুখ।
হাজার বছর আগেকার মুখ। যেন অচেনা অর। বেজে ওঠে গান শুধু গান। ছোটো এই ঘরে শুয়ে আজ মনে পড়ে প্রেমিক ছিলাম, অনু।
তারপর পড়ে থাকে বৃষ্টিভাষা আর কাঁটাতার। যতিহীন মুদিত মুদ্রিত পৃথিবী। পৃথিবী, আমার পৃথা।
আবহমান
ও রাত! তোমার সাথেই তো কথা হলো! এতো সহজে ভুলে গেলে! ওই যে, ধ্যানধারণা, আরাধনা ওসব বিষয়! শোনো ও রাত! এ মালভূমিতে দাঁড়িয়ে সবই তো দেখিআজ পথে-বসেছে। কয়লা কাঠের মতো অঙ্গার একটা চুতিয়াজীবন নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে বেড়াচ্ছি আর লোক হাসাচ্ছি। আর নিজের লাশের ঘাড়ের ওপরদাড়িয়ে উদোম এক সিগারেটখোর বদ্ধ পাগল বাংলা কবিতাকে মুক্তি দিতে চাইছি কবিতা থেকে।
ভগবান পাঠক, মুক্তি দেবার বিষয়টা আরেকদিন বুঝিয়ে বলবো বলে আশা করি! তবে তার আগে আপনি আমার কবিতাগুলো পড়ে ফেলতে পারেন! একটা ধারণাপেয়েও যেতে পারেন হয়তো! প্রণাম।
প্যারিসের চিঠি
লতিফুল ইসলাম শিবলী
প্রিয় আকাশি,
গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পেয়েছি,
খামের ওপর নাম-ঠিকানা পড়েই চিনতে পেরেছি
তোমার হাতের লেখা
ঠিকানা পেলে কীভাবে, লেখনি
কত দিন পর ঢাকার চিঠি, তাও তোমার লেখা
ভাবতে পারো আমার অবস্থা!
গতকাল প্যারিসে ঝরেছিল এ বছরের রেকর্ডভাঙা তুষারপাত
তামাক ফুরিয়ে গেছে আনতে পারিনি, এই প্রথম আমি
অনেকটা সময় নিয়ে ভুলেছিলাম তামাকের গন্ধ।
তোমার চিঠিতে পরিবর্তন আর
বদলে যাওয়ার সংবাদ-
তুমি কষ্ট পেয়ে লিখেছ, রাত্রির ঢাকা এখন
নিয়নের স্নিগ্ধতা ছেড়ে নিয়েছে
উৎকট সোডিয়ামের সজ্জা,
আমাদের প্রিয় রমনা রেস্তোরাঁ এখন
কালের সাক্ষী,
মিষ্টি কয়েন বক্সের জায়গা দখল করে নিয়েছে
ডিজিটাল কার্ডফোন
শীতের বইমেলা পরিণত হয়েছে
মিনাবাজারে,
টিএসসির চত্বর যেন উত্তপ্ত বৈরুত।
বদলে যাওয়ার কষ্টের অপর নাম স্মৃতি
এখন তাই নিয়ে বুঝি মেতে আছ
এই পরবাসে আমার চোখের সামনেও বদলে যেতে দেখলাম
কত সুদৃঢ় ইতিহাস-
বালির বাঁধের মতো ভেসে গেল পূর্ব ইউরোপ
নদীর পাড় ভাঙার মতো ভেঙে গেল বার্লিন প্রাচীর
ইংলিশ চ্যানেলের তল দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলছে ট্রেন;
ইউরোপের মানচিত্র এখন রুটি হয়ে গেছে,
ক্ষিদে পেলেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাও, স্বাধীনতা মানেই যেন উদরপূর্তি
তুমি লিখেছ, ‘তোমাকে ভুলে গেছি কি না’
প্রিয় আকাশি, আমি জেনে গেছি, পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ ভুলে থাকা;
স্মৃতি থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য এই সুদীর্ঘ প্রবাসের
অর্ধেকটা কাটিয়েছি বোহেমিয়ানদের মতো ঘুরে ঘুরে
মাদ্রিদ থেকে হামবুর্গ, নিউক্যাসল নেপলি থেকে প্রাগ
বুখারেস্ট মেসিডোনিয়া, নর্থ সি থেকে মেডিটেরিয়ান
কিংবা ব্ল্যাক সি।
তবু বাঁচতে পারিনি স্মৃতি থেকে-
ফ্রাংকফুর্টের বইমেলায়
নতুন বইয়ের গন্ধে মনে পড়েছে তোমাকে
ফ্লোরেন্সে-মিকেলাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’,
রোমে ‘পিয়েতা’ আর সিস্টাইন চ্যাপেলের
‘লাস্ট জাজমেন্টের’ মতো
মহান সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে
প্রথমেই মনে পড়েছে তোমাকে।
সিসিলির কার্নিভেলে, এথেন্সের কফিশপের জমজমাট
কবিতাপাঠের আসরে মনে পড়েছে তোমাকে;
পালারমোর সৈকতে কিম্বা ভিয়েনার তারাজ্বলা রাত্রির
আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়েছে
তোমার প্রিয় কবির কবিতা-
Under the wide and starry sky
Dig my grave and let me lie
Glad did I live and gladly die
And I laid me down with a will.
সুইজারল্যান্ডের লেকের স্বচ্ছ জলে নিজের ছায়ার পাশে
যাকে খুঁজেছি, সে তুমি
ভার্টিক্যানের প্রার্থনা সভা শেষে এক গ্রিক তরুণীকে
বাংলায় কী বলেছিলাম, জানো?
বলেছিলাম, ‘তুমি আমার আকাশি হবে?’
ভুলতে পারিনি তোমাকে, শত চেষ্টা করেও পারিনি
আর কেউ না জানুক অসংখ্য জিপসি রাত জানে
সেই না ভুলতে পারার ইতিহাস।
তুমি জানতে চেয়েছ প্যারিসের কথা-
সত্যি বলতে কি,
প্যারিস খুলে দিয়েছে আমার আত্মার চোখ
সংগীত আর শিল্পের অভিন্ন সুর আমি শুধু
প্যারিসেই শুনেছি।
কনসার্টে যতবার মোৎসার্ট কিম্বা বিটোভেন শুনেছি
ততবারই কেন যেন চিরদুখী পাগল
ভিনসেন্ট ভ্যান্গগের কথা মনে পড়েছে।
সমস্ত প্যারিসের রাস্তায় গ্যালারিতে ফেস্টিভেলে খুঁজে ফিরেছি ভিনসেন্টের কষ্ট।
তোমার প্রিয় গায়ক জিম মরিসনের শেষ দিনগুলো
কেটেছে এই প্যারিসে। প্যারিসেই জিমের কবর।
অগণিত শিল্পীর কষ্ট থেকে প্যারিস পেয়েছে সৌন্দর্য;
কষ্টই প্যারিসের ঐশ্বর্য।
আমাদের সুবর্ণ সময়ের স্বপ্নের প্যারিসে আজ
নিজেকে ভীষণ একা মনে হয়
এলোমেলো পড়ে আছি শিল্প-সাহিত্যের এই জাগযজ্ঞে
তীব্র শীতের জন্য শ্বাসকষ্ট ভোগায় মাঝে মাঝে
এই তো সেদিন আবারও বদলালাম চশমার কাচ
প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছি সময়ের কাছে;
তুমি মনে রেখো, পরিবর্তনের দমকা হাওয়ায়
আমি বদলাইনি এতটুকু।
বাইজেনটাইন সম্রাজ্ঞীর মতো তোমাকে ঘিরে থাক
পৃথিবীর সমস্ত সুখ
তুমি অনিন্দ সুন্দরী হয়ে ওঠো
তোমার সৃষ্টিতে
তুমি ভালো থেকো।