কবির অভ্যুত্থান নীরব, শীতল, বর্ষ বর্ষ ব্যাপী: মৃদুল দাশগুপ্তের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Sep 8, 2013 6:31:25 AM

মৃদুল দাশগুপ্ত - জন্মগ্রহণ করেন হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে।

সম্পাদিত পত্রিকা বাইসন।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “জলপাই কাঠের এসরাজ” (১৯৮০), “এভাবে কাঁদেনা” (১৯৮৬), “গোপনে হিংসার কথা বলি” (১৯৮৮), সোনার বুদ্বুদ।

পুরস্কার: রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, ২০১২

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

মৃদুল দাশগুপ্ত: এই বয়সে ভেবে দেখেছি, লিখি বেঁচে থাকার জন্য, আত্মরক্ষার জন্য।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

মৃদুল দাশগুপ্ত: সামরিক প্রস্তুতি+ জন্মগত প্রতিভা।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

মৃদুল দাশগুপ্ত: এক্ষেত্রে আমার বিবেচনা বিবিধ সময়ে হেরফের হতে পারে। এই মুহূর্তে দেবদাস আচার্য্য, নিত্য মালাকার, শম্ভু রক্ষিত, জয় গোস্বামী, রণজিৎ দাশ। মাসুদ খান, চঞ্চল আশরাফ ঠিক আমার সমসাময়িক নন, তবু এ তালিকায় রাখছি।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

মৃদুল দাশগুপ্ত: খারাপ কবিতা বলে কিছু হয় না। হয় কবিতা নয় অকবিতা। বেশিরভাগই অকবিতা লেখেন। তাঁরা উল্লেখের নন।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য দশককে আপনি বেশ কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

মৃদুল দাশগুপ্ত: আমি প্রত্যাশী। দীর্ঘকাল অপেক্ষায় রয়েছি।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

মৃদুল দাশগুপ্ত: খুলনার কবিতার সঙ্গে বগুড়ার কবিতার যে ফারাক, হুগলির কবিতার সঙ্গে মুর্শিদাবাদের যে তফাত।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

মৃদুল দাশগুপ্ত: আমি মুদ্রিত পাঠবস্তুতে বিশ্বাস করি। গ্রন্থে আমার আস্থা। আমি খেয়াল করে দেখেছি যে নেটে পাঠানো কবিতা পড়তে আমার মানসিক অবরোধ জেগে ওঠে। ভাল-মন্দ বুঝতে পারি না। আমি হয়ত সেকেলে, সেই জন্যেই।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন, না হলে কেন নয়?

মৃদুল দাশগুপ্ত: মনে করি না। এক ফর্মার একটি লিটলম্যাগও সার্বভৌম। উড়ন্ত।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয় আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

মৃদুল দাশগুপ্ত: সাহিত্য বিষয়ে বলতে পারব না। কবিতা, আমাদের এখানেও অনেক দৈনিকে প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু কবিতা ওই যে লিটলম্যাগেই উড়ন্ত। কবিতা পাঠকেরা লিটলম্যাগেরই।

দুপুর মিত্র: নিজেকে অন্যের লেখা থেকে কীভাবে পৃথক করেন?

মৃদুল দাশগুপ্ত: আপন মনে লিখি। অন্য কারও সংশ্লিষ্ট হওয়ার ভীতি আমার নেই। এখন বয়স যা, তাতে বন্ধুদের মাঝে থেকেও কখনো কখনও একাকী লাগে।

দুপুর মিত্র: আপনার বিখ্যাত কবিতার বই 'জলপাই কাঠের এসরাজ' এর 'বিবাহ প্রস্তাব' নামে একটা কবিতা এক সময়কার তরুণ মহলে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এটা এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে গ্রিটিংস কার্ডেও এই কবিতা ছাপা হত। এই কবিতা ও এর জনপ্রিয়তা, জনপ্রিয়তার কারণ , সে সময় এসব নিয়ে কিছু বলুন।

মৃদুল দাশগুপ্ত: এক বর্ষার দুপুরে শ্রীরামপুরে আমাদের বাড়িতে খাটে বসে কবিতাটি লিখি। ১৯৭৪ সালে, তখন বয়স ১৯। যার উদ্দেশে, সে সপ্তদশী। সাড়া মেলেনি। অনেক বছর পর দুর্গাপুরের অচেনা এক তরুণ তার বিবাহের আমন্ত্রণপত্র পাঠালেন। তাতে ওই কবিতা কার্ডে অলঙ্কৃতভাবে ছাপা। আরও বহু বছর পর ফোনে এক তরুণী জানালেন, তাদের বিয়েয় কবিতাটি মন্ত্র হিসেবে পঠিত হবে। আমি জীবনে এই ধরনের কয়েকটি নোবেল পেয়েছি। কিন্তু কেন জনপ্রিয় হল, তা কী করে বলব।

দুপুর মিত্র: আপনার সম্পাদিত পত্রিকার নাম বাইসন। এ সম্পর্কে কিছু বলুন। কিভাবে এটি বের হত। আপনারা এই পত্রিকার মাধ্যমে কি করতে চেয়েছিলেন? কতটুকু করতে পেরেছিলেন ইত্যাদি?

মৃদুল দাশগুপ্ত: ১৯৭২ সালে হাল্কা আর্ট পেপারে ১/৮ সাইজে একটি সিটে বাইসন নামে কবিতাপত্র বের করি। এক পিঠে আমার ৮টি কবিতা, অন্যপিঠে দেব গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা। ওই একটি সংখ্যা আর ১৯৭৪ সালে এক ফর্মার আরেকটি সংখ্যা। তখন ইন্দিরা গান্ধী পোখরানে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। জরুরি অবস্থার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সে সংখ্যায় প্রচ্ছদে জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ ছাপা হয়েছিল। দুটি সংখ্যাই বেরিয়েছিল। আমার হকার বন্ধুরা ট্রেনে ট্রেনে দক্ষিনবঙ্গে যথাক্রমে দশ পয়সায় ও পঁচিশ পয়সায় পত্রিকা দুটি বিক্রি করেছিলেন। নিজেদের কবিতা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম।

দুপুর মিত্র: আমি যতদূর জানি সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনে আপনার অংশগ্রহন ছিল। এর পর মমতার বিজয়। এখন তো অনেক দিন হয়ে গেছে। সেই আন্দোলন, আপনাদের অর্জন এসব নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

মৃদুল দাশগুপ্ত: সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমি আমাদের শ্রীরামপুরের বাড়ির কাছে। ওই উর্বর কৃষি জমির অধিগ্রহণ মাতৃহত্যার মত অপরাধ মনে হয়েছিল। দমনপীড়ন দেখে ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম। আপন বিবেকে যেভাবে যতটা প্রতিবাদ করা যায় করেছিলাম। রাজনৈতিকদলগুলোর কাছে, ওই সিপিআই(এম), তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস কারও প্রতি আমার আশা আকাঙ্খা ছিল না। নেইও। প্রতিবাদ করাটা আমার কর্তব্য। করেছিলাম।

দুপুর মিত্র: আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলা কবিতায় কি বিশেষ আপনি সংযোজন করেছেন যা আগে কখনও কেউ করেনি; তাহলে কি বলবেন?

মৃদুল দাশগুপ্ত: এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া আমার উচিত নয়।

দুপুর মিত্র: বাংলা কবিতায় আপনার বিশেষ কাজ কি যা আপনি বলতে গৌরাবান্বিত বোধ করেন?

মৃদুল দাশগুপ্ত: আমিতো সর্বদা কুণ্ঠিত থাকি। কবিতা এমনই এক কুহকিনী, যার ছায়া স্পর্শ করতে পারিনি। সর্বদা ব্যর্থতার বোধে ভুগি।

দুপুর মিত্র: কবিতায় কি রাজনীতি হয়? যেমন ধরেন কারও কবিতা ছাপানো না ছাপানো? এতে কি বিশেষ কিছু লাভ হয়? লাভগুলা কি রকম? রাজনীতিটা কি রকম?

মৃদুল দাশগুপ্ত: অবশ্যই কবিতার জগতে মাফিয়ারা আছেন। তারা প্রকাশন, বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাকাদেমি, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে কবির অভ্যুত্থান নীরব, শীতল, বর্ষ বর্ষ ব্যাপী।

দুপুর মিত্র: সাম্প্রতিক কবিতায় কি কোনও পরিবর্তন এসেছে? আসলে সেটা কি রকম?

মৃদুল দাশগুপ্ত: ভাষা সর্বদাই বদল হচ্ছে। সেটাই বিজ্ঞান।

দুপুর মিত্র: আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলা কবিতায় আপনার বিশেষ কাজ কি যা এর আগে কেউ করেনি; তাহলে আপনি কি বলবেন?

মৃদুল দাশগুপ্ত: বললাম তো, আমি ব্যর্থ, কুণ্ঠিত। তবে সচেষ্ট।

দুপুর মিত্র: কবি জায়গাটিকে কি দখল করা যায়?

মৃদুল দাশগুপ্ত: প্রশ্নটা ঠিক বুঝলাম না। কবিরা উড়ন্ত, মুক্ত। কে কাকে দখল করবে!

দুপুর মিত্র: আপনি কি লিটলম্যাগে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন ? কেন?

মৃদুল দাশগুপ্ত: হ্যাঁ আমি তো লিটলম্যাগাজিনেই আপনার কাছে পৌঁছেছি, তাই না দুপুর?