আমরা প্রথমেই ব্লগ বিষয়টাকে অন্যদিকে নিয়ে গেছি: আরিফ জেবতিকের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Aug 13, 2012 5:37:22 AM

প্রকাশিত বই: প্রকাশিত ও অর্ধপ্রকাশিত বক্রবয়ান, পলিটিক্যাল জোকস, ১/১১’র রাতে, একুশ নম্বর আঙুল, তাকে ডেকেছিল ধুলিমাখা চাঁদ।

দুপুর মিত্র: আপনাকে যদি বলা হয় ব্লগের মাধ্যমেই আপনার উত্থান আপনি কি তা মেনে নেবেন?

আরিফ জেবতিক: আগে আমাকে বুঝতে হবে এখানে উত্থান বলতে কী অর্থ করা হচ্ছে? আমি তো নিজের মাঝে এমন কোনো উত্থান দেখি না যেটি ব্লগ লেখার আগে আমার ছিল না। এখন বলতে পারেন যে উত্থান বলতে এখানে খানিকটা পরিচিতির দিকে নির্দেশ করছেন। সেক্ষেত্রে আমাকে বলতে হয় ব্লগ লেখার পর ব্লগার হিসেবে কিছু মানুষের কাছে আমার পরিচিতি হয়েছে। এভাবে সিলেটের কিছু লোক আমাকে ছাত্র রাজনীতির জন্য চিনে, কিছু লোক আমার মঞ্চনাটকের জন্য চেনে, পত্রিকা অঙ্গনের অনেকে এবং অনেক পত্রিকা পাঠক আমাকে সাংবাদিক হিসেবে চেনেন। সুতরাং সামগ্রিক পরিচয় কোনো একটা বিশেষ কারণে হয়েছে বলতে আমি রাজি নই। আজকের আমির মাঝে গতকালের সবগুলো পরিচয় লুকিয়ে আছে, সেটিতে ব্লগ যেমন আছে, পত্রিকা আছে, লিটিল ম্যাগ সম্পাদনার ইতিহাস আছে, মঞ্চ নাটক লেখার স্মৃতি জমে আছে, সব মিলিয়েই বর্তমানের আমি।

দু: আমাদের দেশে ব্লগের চর্চা যথাযথ ভাবে হচ্ছে বলে মনে করেন কি?

আ:  'যথাযথ' বলে কোনো চর্চায় আমি বিশ্বাস করি না। ব্লগ চর্চার কোনো গ্রামার নেই, কেউ এরকম গ্রামার তৈরি করলে সেটি মানারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

তবে ব্লগের যে বিশাল সম্ভাবনার কথা বিশ্বজুড়ে বলা হচ্ছে, আমরা বাংলাভাষী ব্লগাররা সেই সম্ভাবনার ধারে কাছে নেই। আমাদের দেশের ব্লগ চর্চা অনেকটাই ফোরাম ঘরানার, বিশেষ করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্লগগুলো এখানে এখনও তেমন জনপ্রিয় হয়নি।

দু: বাইরের দেশগুলোতে দেখা যায় এন্টি ওবামা ব্লগ বা এন্টি বুশ ব্লগ বা এনভাইরনমেন্টাল ব্লগ- এরকম সাবজেক্ট ওয়াইস ব্লগের চর্চা হয়। আমাদের দেশে ঠিক এই ধরণের চর্চা হয় নি। এটা কেন?

আ:  বিচ্ছিন্ন দুয়েকটা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু বিষয়ভিত্তিক ব্লগের চর্চাটা বাংলাদেশে এখনও তেমন গড়ে উঠেনি। এর কারণ হচ্ছে আমরা প্রথমেই ব্লগ বিষয়টাকে অন্যদিকে নিয়ে গেছি। বাংলা ব্লগের ধারা তৈরি হয়েছে কমিউনিটি ব্লগ হিসেবে। সুতরাং মাস কমিউনিটির চোখে পড়ার জন্য সহজ বিষয়ে চলে যাচ্ছে সবাই। এর মাঝে কিছু বিষয় ভিত্তিক ব্লগ লেখা হলেও সেগুলো চোখে পড়ে না বা ওভাবে ব্র্যান্ডিং হয়নি।

যেমন ভুলু আপা একজন গৃহিনী এবং তিনি তার নিজের রেসিপিগুলো ব্লগে দিতেন। এভাবে নিজের পেশার কাছাকাছি লেখা ব্লগ খুব কম। কিন্তু অন্যভাষাগুলোতে এরকম ব্লগ লেখা হচ্ছে। আমি যখন ডয়চেভেলের ববস এওয়ার্ডের ভোটাভুটি দেখি গতবছর, তখন ইংরেজি বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল নাইরোবি নাইটস নামের একটি ব্লগ। একজন যৌণকর্মীর ব্লগ এটি, সেখানে তিনি তাঁর নিজের জীবনাচার, তাঁর পেশার দৈনন্দিন আনন্দ-বেদনার কথা লিখে রাখছেন। এই জিনিসটির কোনো চর্চা আমাদের দেশে তেমন করে হয়নি। একজন ব্লগার একটি মাত্র বিষয়ে লিখছেন এমন নয়। আমাদের এখানে একজন সাংবাদিক মিডিয়া নিয়েও লিখেন, কুচো চিংড়ির চচ্চড়ি নিয়েও ব্লগ লিখেন। এর মূল কারণ হচ্ছে এখানে কমিউনিটি ব্লগিংয়ের ধারণা তৈরি হওয়ায় পাঠককে খুশি করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সিরিয়াস ব্লগ পাঠক বা ভিন্ন স্বাদের লেখার পাঠক এখনও তেমন নেই। পাঠক না থাকলে লেখকও আগ্রহী হবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

দু: মাইক্রো ব্লগিং,পারসোনাল ব্লগিং, স্পেসেফিক বা সাবজেক্ট ওয়াইস ব্লগিং এ বিষয়গুলো কি ? বাংলাদেশে এসবের চর্চা কেমন হয়?

আ: এগুলো আসলে যেই লাউ সেই কদুর কাছাকাছি একটা ব্যাপার। শুধু মাইক্রো ব্লগিংটা ভিন্ন জিনিস। খুব ছোট আকারে দুয়েক লাইন ব্লগ লিখে প্রকাশ করাটাই মাইক্রো ব্লগিং। আপনার ফেসবুকের স্ট্যাটাসটা মাইক্রো ব্লগিংয়ের একটা উদাহরণ হতে পারে। টুইটারের টুইটগুলোও মাইক্রো ব্লগিং। বাংলাদেশে যদিও টুইটার তেমন জনপ্রিয় নয়, কিন্তু হাজার হাজার ফেসবুক স্ট্যাটাস তো লেখা হচ্ছে।

পার্সোনাল ব্লগিং আর ব্লগিংয়ে আমি কোনো তফাৎ দেখি না। ব্লগ মানেই পার্সোনাল একটা বিষয়। সাবজেক্টওয়াইজ ব্লগিংয়ের বিষয়টা হচ্ছে একটা বিশেষ বিষয়ে ব্লগ লেখা। দুভাবে এটা হতে পারে। একজন ব্লগার একটি বিষয়েই ব্লগিং করেন এটাও বিষয়ভিত্তিক ব্লগিং, আবার একদল ব্লগার বা একটি ব্লগ সাইটে একই বিষয়ের ব্লগিং করেন সেটাও সাবজেক্টওয়াইজ ব্লগিং।

দু: ব্লগীয় লিটারেচার আর লিটারেচারের মধ্যে ফারাক আছে কি? অনেকে লিটলম্যাগের রিপ্লেস বা প্যারালাল ভাবছেন ব্লগকে। আপনি এটা কিভাবে দেখেন?

আ: জ্বি, বিভিন্ন ধরনের ফারাক আছে। যেহেতু ব্লগ একটি নতুন ধরনের মিডিয়া, তাই এই মিডিয়ার সুবিধানুযায়ী প্রকাশভঙ্গি ও প্রকাশভাষায় কিছু পরিবর্তন স্বাভাবিকও বটে।

সাধারণত প্রিন্ট মিডিয়ার লেখায় একজন লেখক লেখার বাইরেও এর উপস্থাপন নিয়ে অনেক যত্মশীল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখা সম্পাদনার পর প্রকাশিত হচ্ছে। অন্যদিকে ব্লগের লেখা সরাসরি প্রকাশিত হচ্ছে, এই প্রকাশ অনেক বেশি প্রতিক্রিয়ামূলক। যা মানুষকে তাড়িত করছে, যেভাবে করছে তিনি সাথে সাথে সেভাবেই প্রকাশ করছেন। বানান কিংবা ভাষারীতি নিয়ে আলাদা ভাবে মাথা ঘামাচ্ছেন না। এমনকি ব্লগ কেন্দ্রিক অনেক পরিভাষাও তৈরি হয়ে গেছে। এমন প্রায় শতাধিক শব্দ ও পরিশব্দ এখানে এসেছে, যেগুলো আমাদের মূল ভাষায় নেই। লেখার আকৃতিও একটা বড় বিষয়। আমার কিছু গবেষণা আছে, সেই হিসেবে ১ হাজার শব্দের বেশি লেখা হলে সেই লেখা অনলাইন পাঠকের মনোযোগ পায় না। কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়ায় এমন কোনো সমস্যা নেই।

আমি এই মুহুর্তে অনলাইনকে লিটিলম্যাগের রিপ্লেস হিসেবে ভাবি না বরং অনলাইনে নতুন ধারার একটি প্রকাশ মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করতে আগ্রহী। তবে লিটিলম্যাগের যেসব প্রায়োগিক অসুবিধা আছে, সে তুলনায় ব্লগ বেশি সুবিধাজনক। এখানে প্রকাশ করতে টাকা লাগে না, গোষ্ঠিবদ্ধ হওয়া লাগে না, বিপণন সহজ ও বেশি। সুতরাং আগামীতে অনেক সম্ভাব্য লিটিলম্যাগ যদি অনলাইন হিসেবেই প্রকাশিত হয়, আমি আশ্চর্য হব না। এটি ছাপা হওয়া লিটিলম্যাগের প্যারালাল হবে হয়তো।

দু: আপনি নিজে ব্লগে ঠিক কোন কাজটি করতে চান?

আ: আমি নিজে ওভাবে কখনো চিন্তা করিনি। আমার যদি লিখতে ইচ্ছা হয় আমি লিখি। ব্লগে লেখার কারণে আমার লেখার মান ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে একটু মনের মাঝে শংকা আছে, তবে সেটা মেনে নিয়েই আমি এখানে লিখি। লেখালেখি নিয়ে আমার কোনোদিনই সিরিয়াস কোনো পরিকল্পনা ছিল না, এখনও নেই।

দু: আপনার অনেক কলাম প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পত্রিকায় সে অর্থে আপনার লেখা না দেখে অনলাইন মিডিয়াতেই দেখছি। এর কারণটা কি? বিষয়টা কি এমন যে পত্রিকাগুলো কলাম ছাপার বিষয়ে বিষয় বা লেখনিকে না দেখে ব্যক্তি বা ক্ষমতা বা যারা লেখা নেন তাদের নিজেদের সুবিধা এসবই বেশি দেখেন ?

আ: আমার লেখালেখির শুরুটা পত্রিকা দিয়েই। আমার প্রথম কলাম 'মাইক্রোস্কোপ' দৈনিক ভোরের কাগজে প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হতো আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওভাবে আর পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়নি, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এখনও শুধু প্রয়োজন পড়লেই কালের কণ্ঠে লিখি, অন্যথায় ব্যক্তিগত লেখালেখিকে অনলাইন কেন্দ্রিক রাখতেই আমার পছন্দ।

    পত্রিকায় লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখার চাইতে লেখক পরিচয় অনেক বড় একটি বিষয়। এর সঙ্গে বাণিজ্য জড়িত, সুতরাং এটা থাকতেই পারে। মিডিয়া তাঁর নিজস্ব পছন্দ ও চাহিদানুযায়ী ব্র্যান্ড তৈরি করে। আর যারা লেখা নেন, তাঁরা তো তাঁদের ভাই-বেরাদর বা খাতিরের লোককেই খাতির করবেন, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই।

দু: ব্লগের মাধ্যমে অনেক লেখক ও পাঠক তৈরি হয়েছে সত্য। কিন্তু অনেকেই বলেন এই শ্রেনীটা একেবারেই হাল্কা রুচির। দেশ, সমাজ এসব বিষয় সিরিয়াস না। আপনিও কি এরকম মনে করেন? করলে কেন না করলে কেন নয়?

আ:  হালকা রুচি, মাঝারি রুচি এবং ভারি রুচি এভাবে পরিমাপের বাটখারাটা কার হাতে, সেটা নিয়েই আমার প্রশ্ন আছে। দুনিয়ার সব পাঠকের মাঝেই বিভিন্ন রুচির পাঠক আছে। শুধুমাত্র আধাকেজি পৌণে এককেজি ওজনের পাঠক ব্লগ পড়েন এবং আধামনি ওজনের পাঠক পড়েন না, এমন না বিষয়টা। যেহেতু ব্লগ অনেক বড় একটি বিষয় এবং হাজার হাজার মানুষ কোনো ধরণের সম্পাদনা ছাড়াই এখানে সরাসরি লেখা প্রকাশ করতে পারছেন, সুতরাং দেখে মনে হয় অপ্রয়োজনীয় লেখার ভিড় এখানে বেশি। তবে অধিকাংশ ব্লগ লেখকই কিন্তু দেশ সমাজ রাষ্ট্র নিয়েই এখানে লিখছেন, সুতরাং তাঁরা দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবেন না, এমন কথা অবান্তর।

    সবাই উচ্চ দার্শনিক স্তরে উঠে লিখবেন না। সমাজে এমন দার্শনিকের সংখ্যা কম, সুতরাং লেখাতেও তাঁদের সংখ্যা কমই হবে।