প্রিয় কবি কেবল ছোট বেলার রচনা লেখার বিষয়: কবি ইন্দ্রনীল ঘোষের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 12, 2012 7:03:17 AM

প্রকাশিত বই: লোকটা পাখি ওড়া নিয়ে বলছে

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

ইন্দ্রনীল ঘোষ: কবিতা লেখার শুরু ক্লাস থ্রি-তে। সেই বয়েসে এই প্রশ্নটা মনে আসার কথা নয়। পরে সময়ের সঙ্গে, আমি আর আমার কবিতা একসাথেই বেড়ে উঠি। একে অন্যের বেড়ে ওঠায় প্রভাব ফেলি। সেই বয়েসে কারও সাথে মারপিটে হেরে গেলে (সাধারণত হারতামই) বা কোথাও অসম্মান বোধ করলে, মনে মনে ভাবতাম, আমার তো কবিতা লেখা আছে ওদের তো সেটা নেই। এভাবেই নিজের কবিতার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে একা ও অনন্য দেখতাম। এইসবই। পার্টনারশিপ-বন্ডে ঠিক কবে ও কেন যে কবিতা আর আমি স্বাক্ষর করলাম, তা বলা মুশকিল। যাঁরা পরিণত বয়েসে লেখালিখি শুরু করেন তাঁদের কাছে কারণটা স্পষ্ট থাকে। আমারটা তো নাবালক কেস, বাল্যবিবাহ।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

ই: নিজের কবিকে সাবধানে বাঁচিয়ে রাখা। এটা এক এবং একমাত্র ব'লে মনে হয়। কিন্তু এই কথাটা লিখে ফেলার পরই দেখলাম, কীর'ম একটা বনসাইয়ের দৃশ্য ভেসে উঠলো নিজের সামনে। টবে লাগানো একটা মস্ত-টস্ত মানুষকে রোজ ছাঁটছি, জল দিচ্ছি... গরু ছাগল দেখলেই হ্যাট হ্যাট ক'রে তেড়ে যাচ্ছি।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

ই: এই প্রশ্ন ঠিক আজকের দিনে আর করা যায় কি? জানি না। একটা সময় ছিলো, যখন 'প্রিয় কবি' রচনা আসতো মাধ্যমিকে। লিখেওছি অনেকবার। কিন্তু এখন আর ওরকমটা ক'রে ভাবতে অসুবিধা হয়। সারাদিনে কতো কবিতা পড়ি রোজ! ফেসবুকে, ব্লগে, ওয়েব-পত্রিকায়, ছাপা পত্রিকায়, বইয়ে। কতো লেখা পড়তে গিয়ে মুগ্ধ হই, অবাক লাগে। তাদের অনেকের লেখাই হয়তো আগে কখনও পড়িনি। হয়তো আর কোথাও পড়াও হয়ে ওঠে না পরবর্তী অনেক দিন। তবু ওই কবিতাটার ওপর ভালোবাসা থেকে যায়।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

ই: যে কবিতা খারাপই লাগলো, তার কবিকে খুঁজে কী করবো।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ই: নব্বই একটি মাইলস্টোন দশক, পেরিয়ে আসা রাস্তা আর অজানা রাস্তার মেলবন্ধনে দাঁড়িয়ে থাকা। একদিকে যেমন পেরিয়ে আসা রাস্তার নস্টালজিয়া, প্রেম কিছুতেই তাকে ছাড়তে দেয় না, অন্যদিকে তেমন সামনে প'ড়ে থাকা নতুন রাস্তার জন্য যুগপৎ টান ও সংশয়। নব্বই-এর অনেক কবিই তাই যেমন ওই পুরোনো পথের ধারে ছাউনি টাঙিয়ে আজও জিরোচ্ছেন, তেমনই অনেকে আবার নতুন পথে চরৈবেতি। শূন্যের প্রায় পুরোটাই ওই নতুন পথে হাঁটার আনন্দ, আরও নতুন নতুন পথ খোঁজার অভিযান। মাইলস্টোন খোঁজার অবসর এখনও আসেনি।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

ই: এভাবে দুটি দেশের মধ্যে কবিতা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা এক ধরণের অ্যাভারেজিং ডিমান্ড করে। আর অবশ্যই তাতে ব্যতিক্রমী কবির কথা ভাবা হয় না। যাই হোক, সেই গড় ক'রে নিয়েই এর উত্তরটা দিই। নতুন যাঁরা লিখছেন, তাঁদের লেখায় সেভাবে দেশ-জনিত পার্থক্য আর লক্ষ্য করি না। তবে একটা সময় অবধি নিশ্চয়ই ছিলো বা এখনও পুরোনো অনেকের লেখায় রয়েছে। পার্থক্যটা মূলত কবিতায় বিষয় বক্তব্য কেন্দ্র না-রাখা ও রাখা নিয়ে, বা বিষয় থাকলেও কী সেই বিষয়। এ বাদেও প্রকাশের প্রচ্ছন্নতা থেকে স্পষ্টতা অবধি স্কেল বানালে সেখানেও তারতম্য দেখা যেত দীর্ঘদিন। হয়তো দুই দেশের রাজনৈতিক আর সামাজিক প্রেক্ষাপটের পার্থক্য এর কারণ। আজ দুটো দেশের কবিতা পড়তে গিয়েই মনে হয়, সেই সব কারণকে আত্মস্থ ক'রে কবিতার অনেক গভীরে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন এ' সময়ের কবিরা, তা আর উপরিতলে নেই।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

ই: একদমই। বিভিন্ন জায়গায় ব'সে বিভিন্ন মানুষ পড়তে পারেন। দেশের ব্যবধান থাকে না। তাছাড়া এরকম, লেখা প্রকাশের সাথে সাথেই এত বেশি পরিমাণে মন্তব্য আলোচনা পত্রিকার ক্ষেত্রে হয় না।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

ই: দুটোর জায়গা অনেকটাই আলাদা। লিটিলম্যাগ যে যে অসুবিধাগুলো সবচেয়ে বেশি ক'রে অনুভব করে, ব্লগের সেগুলো নেই, যেমন ছাপার খরচ, সে কারণে পৃষ্ঠা সীমা, প্রকাশের পর ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে চিন্তা ভাবনা ও সেই সংক্রান্ত খরচ-খরচা। একটি ব্লগের পাঠক সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজেই একটা লিটিলম্যাগের থেকে বেশি হওয়া সম্ভব। তাছাড়া ওপরে যেটা বললাম, মন্তব্য আলোচনা সাথে সাথেই পাওয়া যায়। অধিকাংশ মানুষই আজকাল চিঠি লেখাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছেন, ফলে একসময়ে পত্রিকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ 'চিঠিপত্র' ন্যাড়া হয়ে এসেছে প্রায় সব পত্রিকার ক্ষেত্রেই। এগুলো সেই সব কারণ যার জন্য মনে হয় অদূর ভবিষ্যতে -- যখন বাংলার আরও বেশি সংখ্যক মানুষ কম্প্যুটারের সাথে সহজ হয়ে উঠবেন -- ব্লগটাই থাকবে, লিটিলম্যাগের পরিবর্তে। এই নতুন মাধ্যমের কিছু সমস্যা তো নিশ্চয়ই আছে। যেমন কমেন্ট করা সহজ ব'লে, মতামত দেওয়ার আগে সেটা কয়েকবার প'ড়ে কী লিখবো আর কী লিখবো না, এটা ভাবার সময় আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দিই না। যা সহজে উপেক্ষা করা যায়, তা নিয়েও কোমর বাঁধি। আবার অন্যদিকে অধিকাংশ প্রশংসাই নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য। "কেমন লাগলো দাদা, লেখাটা?" কে এর উত্তরে "খুব খারাপ" ব'লে গালাগাল ডাকবে? আসলে Virtual world-এর একটা বড়ো সমস্যাই হলো, একমাত্র 'আমি'-টাই সেখানে actual, বাকি সব virtual, যা কিছু করা তার অধিকাংশটাই বোধহয় নিজের অবস্থান মাপামাপি। এই অবস্থাটা সাহিত্যের ব্লগেও ঢুকে যায়। কিন্তু কী উপায়? একটা নতুন সময় তো তার সাথে প্রাথমিক দোলাচল আনবেই। বিশ্বাস করি, সেটা কাটিয়েও উঠবেন সবাই ধীরে ধীরে, নয়তো অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। এই একটু আগে যে বলছিলাম শূন্যের কোনও মাইলস্টোন খোঁজার অবসর নেই, এখন দেখছি এই প্রশ্নে একটা মাইলস্টোনের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। পিছনে আমার ভালোবাসার লিটলম্যাগ, তার নস্টালজিয়া... সামনে আর একটা রাস্তা-- নতুন, কিন্তু প্রাথমিক সংশয় জড়ানো-- ব্লগ।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ই: ঝাড়খন্ডে থাকার জন্য বাংলা দৈনিক খুব বেশি পড়া হয় না। মাঝেমধ্যে বছরে তিন-চারবার পড়ি। এত কম পড়া নিয়ে কিছু বলা ঠিক নয়।