রাজীব দত্তের স্মৃতিকথা: মুজিব পরদেশীরে মনে পড়ার পর

Post date: Oct 23, 2014 4:40:03 PM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

আপনি যদি বাড্ডা থাকেন এবং বাড্ডা থেকে যদি মালিবাগ যেতে চান রামপুরা ব্রিজ হয়ে যাইতে হবে। আর একারণেই আপনারে দীর্ঘ একটা জ্যাম পাড়ি দিতে হবে। আমার বেলায়ও তা-ই। তাইতাড়াতাড়ি পৌঁছাইতে এবং মালসামানার কারণে সিএনজি যোগেই রওনা দিলাম। যা হওয়ার তা-ই ঘটলো। গাড়ি আগায় হাতির মতোন। হেলে দুলে। আর আমরা ভিতরে গরমে সিদ্ধ হইতে থাকি।গাড়ি কোনরকম যখন রামপুরা ব্রিজ পৌছাইল, ভাবলাম একটু স্বস্তি পাবো। পাইলাম না। জ্যাম বরংচ ডাবল। গরুর হাটের কারণে। রাত এগারোটা-সোয়া এগারোটার মতোন বাজে। এসময় হরেদরে মানুষ ঢুকতেছে গরু কিনতে । খোশ মেজাজে। ভিড় ঠেলে ঠেলে। আর আমরা তার ভিতর আলু সেদ্ধ। এর জন্য দুই দুইটা গরুবাহী ট্রাককেও দায়ী করা যায়। গায়ে ভেঁপু বাজাবেন না লিখেএমন রাজার মতোন ভেঁপু বাজায় যাচ্ছে, যেন এলাকার মাস্তান। কিছু বললেই থাপ্পর। ট্রাকের পাশে অতি গোবেচারা সিএনজির ভিতর বসে আমরা ট্রাকের গরুজাতি নিয়ে কিছুক্ষণ সমবেদনাজানাইলাম। আহা বেচারা এইভাবেই হয়তো চিটাগং যাবে। যেহেতু আমরা চিটাগংগামী, ধরে নিলাম গরুরাও। কিন্তু এইসবে সমবেদনা প্রকাশেও যখন গরম কমে না, তখন আমরা ট্রাকের গায়েআঁকা পল্লী অঞ্চল নিয়ে মশগুল হইলাম। এরকম ছবি যেমন হয়, নদী পাড়ে বাড়ি। বাড়ির পিছে গাছ। গাছের পাশে খড়ের গাদা। এবং আশ্চর্য, নিয়ম মতোন এইখানেও গরু। আহা বেচারা গরু।সেও দাঁড়ায় আছে বাছুরসমেত। বাছুরটা কি ডাকতেছিল? আমরা জানি না। কারণ, শিল্পী এইখানে নীরব। আমরাও। আমাদের এই নীরবতারে খান খান করে দিল মাইকের এনাউন্স। এনাউন্সমানে এনাউন্স। যা ঘোষিত হয় এবং তাহা আপনার কর্ণকুহরকে কোনোরকম পরোয়া না করেই। মাইকঅলা ঘোষণা দিল, সাবধান সাবধান। আপনার মানিব্যাগ সাবধান। মাইকঅলার টোনেআঞ্চলিক টান প্রচুর। যেহেতু আমরা চিটাগংগামী, ধরে নিলাম অই মাইকঅলাও চিটাগংয়ের। চিটাগংয়ে সে কই থাকে? মালঘর বাজার? তার আগেই গাড়ি স্টার্ট দিয়া দিল আর মালিবাগ চৌধুরিপাড়া আসতে না আসতেই গাড়ি দাঁড়ায় পড়ল। আমরাও। আর সাথে গরুবাহী ট্রাক এবং পল্লীঅঞ্চল, নদী-গরু-বাড়ি সহই। আমাদের স্বপনে তখন সোহাগের বাস। আহা সোহাগ। আহা বাস।আমরা কি পাবো তোমায়? আমাদের এই উৎকণ্ঠার ভিতরই গেয়ে উঠলেন মুজিব পরদেশী; নিকটের প্রাইভেট কারের ভেতর; আমি বন্দি কারাগারে , আছি গো মা বিপদে-

হু ইজ মুজিব পরদেশী?

তার সাথে আমার পরিচয় আমার ছোটবেলায়। যাকে ন্যাদাকাল বলে। একদম হামাগুঁড়ি পর্যায় না কিন্তু। টু কি থ্রিতে পড়ি। ভালো মনে নাই। তো, এটুকু মনে আছে। তখন গভীর যুদ্ধের কাল।যুদ্ধের কাল মানে গভীর অশান্তি। বাইরে ভিতরে। আমরা তখন হোয়াইক্যঙ থাকতাম। টেকনাফের আগে করে। পাহাড়ি এলাকা। আমরা, মানে আমরা দুইভাই, আরো ছেলেপিলেও; পাহাড়েহরিতকি কুড়াতে যাইতাম। ভোরে উঠতাম। কার আগে কে কতো কুড়াইতে পারে এ প্রতিযোগিতার জন্য। আমাদের ভয়ে পাহাড়ে হরিতকি খাইতে আসা হরিণদল ( আসলে ২/৩টা) পালাই যাইতো।আর আমরা পালাই যাইতাম, যখন দেখতাম পাহাড়ের মতোন কালো, বিশাল বিশাল আর্মি লরি ঢুকতো আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে। রাস্তা কাঁপিয়ে। মা-বাপ বলতো এরশাদের কথা্।এরশাদি শাষণের কথা। আমরা রুপকথার মতোন শুনতাম। আর শুনতাম। সাদ্দাম-বুশের গল্প। আমাদের স্কুলের যে কপি খাতা, যা আমরা দোকান থেকে কিনতাম, যার ভেতর আমরা আমি হবসকাল বেলার পাখি লিখতাম অথবা যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ। তার উপর সাদ্দাম-বুশের ছবি। আর বিমান। যুদ্ধ বিমান। আমরা বুশে মুখে গোঁফ বা সাদ্দামের মুখে দাঁড়ি এঁকে দিতে দিতে যুদ্ধ যুদ্ধখেলতাম। কখনো সাদ্দামরে শক্তিশালী ভাবতাম, কখনো বুশ। কে ভালো কে মন্দ সে হিসাব তখনো বালকমনে কুলায় উঠতে পারে পারে নাই। তাই নিয়ত দ্বিধার ভেতরই আমরা পক্ষবদলাইতাম। আর কানাঘুষা শুনতাম, সাদ্দাম একদিন এইদেশে এসে সকল ড্যাঁঢাদের (হিন্দুদের) মুসলমানি করাই দিবে। যে স্কুলে পড়তাম, অইখানে আমিই একমাত্র হিন্দু হওয়াতে ভয় পাইতামখুব। তবে কি সাদ্দাম খারাপ? আর মুসলমানি কি জিনিস? রাতে মারে জিগ্যেস করতাম। মা উত্তর না দিয়ে পুরাণের লব-কুশ কীভাবে রামের কাছে পৌছাঁইল তার গল্প বলতো। আমি লব-কুশেরসাথে সাথে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে ঘুমাই পড়তাম। এইভাবে দিনে সাদ্দাম-বুশের মিথের ভেতর এবং রাতে লব-কুশের পুরাণের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে, একদিন জানলাম, আমাদের স্কুলে আর্মিথাকবে এখন। সো, স্কুল বন্ধ। স্কুল বন্ধ হওয়াতে মুসলমানির ভয় থেকে যেমন পালাইতে পারলাম, তেমনি ভয়ও পাইলাম। অদ্ভূত-অজানা এক আশংকায়। অবশ্যই অবশ্যই সে আশংকার উৎসছিল, মুরব্বিদের কথা-বার্তা। সে কথার আগা-মাথা বুঝতাম না। কিন্তু তার ভেতর বড় বড় শিঙের-দশ মাথার রাবণের আভাস পাইতাম। সেই আভাসের দিনগুলিতেই আমার বাপ ঘরে নিয়েআসলো একখানা টেপ। হ্যাঁ, আমরা অডিও রেকর্ডাররে আমরা তথন টেপই বলতাম। সেকেন্ড হ্যান্ড। তার সাথে অডিও ক্যাসেট। শেফালি ঘোষ-রুপবান- বেদের মেয়ে জোসনা’র অডিও’সহ ( হ্যাঁতখন সিনেমারও অডিও ছিল। শুধু সংলাপ-গানের সাথে চরিত্র মুখ কল্পনামতোন বসায় নেয়া একটা সুযোগ তাতে ছিল) আরো নানান রকম গানের। সেই গানের ভিতর একখানা মুজিবপরদেশীও ছিল, তা এখনও মনে আছে। মনে আছে সেই এলবামের নাম ছিল- মা, আমি বন্দী কারাগারে- । স্কুল কতোদিন বন্ধ ছিল, আজ আর মনে নাই, তবে সেই প্রায় গৃহবন্দী দিনগুলিতেরুপবান -বেদের মেয়ে জোসনার সাথে সাথে মুজিব পরদেশীও সাদ্দাম-বুশ সকলের জায়গা নিয়া নিলো। উল্লেখ্য, টিভি বাকশোটার সাথে তখনো আমাদের শৈশব পরিচিত হইতে পারে নাই।

মুজিব পরদেশী ছিলেন গ্রামের লোক। সহজ-সরল লোক। কিন্তু গ্রামের যে চেয়ারম্যান, মেম্বারও হতে পারে; তার ছেলে খুন করে ফেলে এক লোকরে। সেই খুনের দায় গিয়া পড়ে মুজিব পরদেশীরউপর। যেহেতু সে গরীব, সহজ সরল, তাকেই জেলে যেতে হয়। জেলে গিয়ে সে দিনের পর দিন আটকে থাকে। তারে কেউ ছাড়ায় অানতে পারে না।গরীব বলে। জেলে বসে বসে মুজিবের মা,রেমনে পড়ে। সে মায়ের মুখ মনে করে গান লিখতে থাকে। সে গান গাইতে থাকে থাকে। দারুণ সুর করে। তার গান শুনে কারাগারের বাইরের পক্ষী পর্যন্ত কাঁদতে থাকে। সে পক্ষী কাঁদানো গানএকদিন উকিল-ম্যাজিস্ট্রেট-ব্যারিস্টারের কানে গিয়ে ঢোকে। তারা শুনেই তাকে বের করে আনে। বের হয়ে মুজিব পরদেশী মার কাছে ফিরে আসে এবং গানই গাইতে থাকে। নিজে লিখে, নিজে সুরকরে। অামরা শুনতাম, আর আহা আহা করে উঠতাম। কংসের কারগারে কৃষ্ণের বাপের বন্দী হওয়া দেখে যে মমতা জাগতো, মুজিবের জন্যও আমাদের সেই মমতাই জাগতো। টেপে ফুল ভলউমদিয়ে, পরদেশীর সাথে ঠোঁট মিলাইতে মিলাইতে আমরা কল্পনা করতাম, গভীর রাত। অন্ধকার জেলখানা। তার ভেতর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মুখে মুখে একজন পরদেশী গান বানাচ্ছে আরেগাচ্ছে। গাইতে গাইতে তার চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ছে পানি। চোখের পানি। তার মা,র জন্য। আমাদের চক্ষুও ছলছল করে উঠতো পরদেশীর বেদনায়। এই পরদেশী গাঁথায়। আমরা আমাদের গৈয়ামগাছের গুলতি রেখে তারে নিয়া তর্ক করতাম: সে কয়মাস- নাকি কয় বছর জেলে ছিল তা নিয়া কথা উঠলে আমরা জিতার জন্য মুরুব্বিদের রেফারেন্সই দিতাম। যেন একজন মুজিব পরদেশীঅদূরের উখিয়াতেই থাকেন অথবা শিলখালি। আমরা শুধু অইখানে এখনো যাই নাই বলেই যেন দেখি নাই। গেলেই দেখতে পাইতাম, তিনি গান গাইতে গাইতে ফাইভ স্টার খাচ্ছেন এবং সাদ্দাম-বুশযে আদতে নাই, সব ভুয়া, এ নিয়া আমাদের আশ্বস্থ করছেন। আমরা মনে মনে ভাবতাম, ইশ, কপিখাতায় যদি এই মুজিব পরদেশীর ছবিটা থাকতো, মোচঅলা, চেহারা কালো:আমাদের মতোন।যেটা রিগুলার রোদে শুকাইতে দেয়া সেই ক্যাসেটের কাভারে থাকতো।আমরা নিশ্চয় তখন তার মুখে ইকোনো ঘষে ঘষে দাড়ি এঁকে দিতাম না !

বালক বয়স বড়ো আশ্চর্য টাইম, বালিকা বয়সও। কারণ বালক ছিলাম বলেই বোধহয় মুজিব পরদেশীদের দ্রুত ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম, অই সময়ে ঘনিষ্ট বন্ধুটারেও। যে আমারে হয়তো পাখিআঁকা শিখাইছিলো অথবা গুলতি বানানো। এতে সুবিধা হইলো যেটা, পরদেশীর জায়গায় হয়তো জসিম বা ইলিয়াস কাঞ্চন ঢুকে গেলো অথবা শাবনাজ-নাঈম বা তাদের চাঁদনী অথবা কেয়ামতথেকে কেয়ামত: সালমান শাহ-মৌসুমি। এইরকম আরো কেউ। খোদ টেলিভিশনও তখন একজন। একসময় এরাও পর হয়ে গেল। টেলিভিশনও। এরকম আরো কতকিছু। এটা খারাপ না ভালোই।অনেকটা একই ট্রেনে নতুন নতুন পাবলিকের সাথে ভ্রমনের মতোন। মজা আছে বটে। তবে অনেক পরে এসে যখন পুরানা কারো কারো সাথে স্টেশনে বা প্লাটফর্মে দেখা -সাক্ষাত ঘটে। তখন তারেনিয়া পুরান স্মৃতির নাড়াচাড়ার মধ্যেও আরো মজা আছে। কোরবানির গরু-জ্যাম এইসবের কারনে মুজিব পরদেশীরেও তেমন মনে পড়লো। তাই জাবর কাটলাম। আর আপনিও পড়লেন। তাইভালো থাকুন।

গুড নাইট।