কবিতাকে কবিতা দিয়াই উত্তীর্ণ করতে হবে: কবি আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’র সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 20, 2012 7:53:10 AM

প্রকাশিত বই: শীতমৃত্যু ও জলতরঙ্গ(১৯৯৫), বাল্মীকির মৌনকথন(১৯৯৬), পলাশী ও পানিপথ(২০০৯), গানের বাহিরে কবিতাগুচ্ছ(২০১০), শাদা সন্ত মেঘদল(২০১১), নো ম্যানস জোন পেরিয়ে(২০১২) ও জল্লাদ ও মুখোশ বিষয়ক প্ররোচনাগুলি(২০১২)।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ: কেন কবিতা লিখি এটি আসলে একটা শূন্যবাদী প্রশ্ন। মানে এর কোনো উত্তর নাই। যদি একটি গাছকে প্রশ্ন করা হয়- কেন পাতা দাও ফুল ও ফল দাও বা একটা পাখিকে প্রশ্ন করা হয় - তুমি উড়ো কেন? তাহলে ওরা কি বলবে! এগুলির কোনো জবাব নাই। কারণ এগুলি খুবই স্বয়ংক্রিয়, সহজাত। কবিতা লেখার বিষয়টা মনে হয় তাই। কারণ কবিতা-পাওয়া বিষয়টি প্রথমে এমনিতেই হচ্ছে, কবির কোন রকম ইনভল্বমেন্ট ছাড়াই বা প্রক্রিয়া-জ্ঞান ছাড়াই। আমি ছোট বেলায় কারো কবিতার নতুন এক্সপ্রেশন বা ইম্প্রেশন দেখে মুগ্ধ হতাম। অভিজ্ঞতা বা বোধকে নতুন ভাষা-কৌশলে যারা বলছে তাদের সৃষ্টি ভাবনা দেখে বিস্মিত হতাম। যেমন আল মাহমুদ যখন বলল- কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়শা আক্তার বা জীবনানন্দ’র- তোমার প্রেম ঘাস হয়ে আসে। এগুলি আমাকে ঝাঁকুনি দিল। এই নতুন করে বলার ইচ্ছার আনন্দে কবিতা লিখি।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

আ: কবিতা লেখার জন্য কোনো ধরণের প্রস্তুতি জরুরি বলে মনে হয় না।কারণ কবিতা প্রস্তুতি করে লেখা যায় না। তাহলে তো গল্প গদ্য উপন্যাস প্রবন্ধের মতো সবাই কবিতা লিখতে পারত। কবিতা একটা হওয়ার ব্যাপার করার ব্যাপার না। এই জন্যই কবিতা সবাই লিখতে পারে না। একাডেমিতে দুই তিন মাসের ট্রেনিং নিয়ে কেউ কবি হতে পারে না। যাদের এই ভিশন-পাওয়া শক্তিটুকু আছে, তাদেরকে একটি উন্মুক্ত মন আর চারদিকের বাস্তবতার বাইরে আর একটা বাস্তবতা দেখার চোখ তৈরি করে নিতে হয়। নতুন নতুন আবিষ্কার চিন্তা আর অভিজ্ঞতার কাঠামোকে যে বদলে দিচ্ছে তাকে ধরার জন্য একটা নতুন ভাষার সন্ধানে নামতে হয়।দৈনন্দিনের ভাষা বা বহু ব্যবহৃত ভাষায় আনতে হয় নতুন রঙ নতুন কারেক্টার। আর এটি ঘটতে পারে যখন একজন কবি নতুন জন্ম গ্রহণের স্মৃতি নিয়ে কবিতাকে লিখতে পারে। তার সাথে সাথে দরকার, শুধু বাংলা ভাষার না বিভিন্ন ভাষায় লিখিত কবিতা পড়া বোঝা ও রিফ্লেক্ট করা।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

আ: সমসাময়িকতার গন্ধ শুঁকে আমি কবিতা পড়ি না। কারণ সমসাময়িকতা একটা আপেক্ষিক বিষয়। বরং আমার খেয়াল থকে লিখিত কবিতাটির ভাষার প্রতি, স্টাইলের প্রতি। কবিতাটির টোটাল মেকিং এর উপর। যারা আজকাল কবিতার ভাষাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে- যারা নতুন করে ভাবছে তাদের কবিতা পাঠে বেশি আনন্দ পাই। সেই অর্থে পুরানো কবি ও নতুন কবি আমার কাছে সব এক। সমসাময়িক অনেককে দেখেছি- এক ধরণের পাঠককে সামনে রেখে মুখের ভাষায় কবিতা লেখেন। কবিতার কবিতামি প্রাণবীজ বাদ রেখে কৃত্রিম ছন্দবাজি করেন। তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চান। কবিতা এভাবে হয় না। এর একটু প্রচ্ছন্নতা লাগে ঘুমিয়ে থাকা চৈতন্যকে জাগিয়ে তোলা লাগে। তা না হলে তো এইগুলি কবিতা না।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

আ: উপরে উত্তর দেয়া আছে।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

আ: আশি দশকে কবিতায় ঘরে ফিরে আসার যে প্রণোদনা দেখা দিয়েছিল, তার হাত ধরেই নব্বই দশকে এক ঝাঁক নতুন কবির আগমন। তবে আশির দশক যেমন একটি বিশিষ্ট টোনালিটির বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল- যা মূলত এক কেন্দ্রিক কিছুটা ব্যক্তিগত আচার আচরণের নিবিষ্ট পরিধি (জীবানানন্দ দাশের বিপন্নতাবোধ বা জয় গোস্বামীর মনোটোনাস রিদমিক্যাল শব্দসর্বস্বতা)- তার থেকে সরে গিয়ে নব্বই দশেকর কবিতায় এসেছে বিবিধ বিষয়, চেতনা আর বোধের শত সহস্র উৎসারণ, জিনের সাথে মিশে থাকা গুপ্ত বা জায়মান লোকাচার ঐতিহ্যস্নাত ভাষাবিন্যাস। বাংলা কবিতার ইতিহাসে এত কবি আর কোনো দশকে এসেছে কিনা আমার সন্দেহ। যদিও সংখ্যা কোয়ালিটির মাপকাঠি নয় তবু বলা যায় নব্বই দশকই ধরে রেখেছে কবিতার সেই মানচিত্রটি যার শরীরেই রয়েছে নতুন কবিতার ভিন্ন দেশ মহাদেশ বিষয় আর ভাষা। আর একই কারণে শূন্য দশকের কবিতাও আমার কাছ থেকে পায় সমান পাঠ-আগ্রহ।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

আ: ভাষা এক হওয়া সত্তেও শুধু ভৌগলিক অবস্থানের কারণে দুই অঞ্চলের কবিতার মেজাজ মর্জি আলাদা। এটি ভাল না মন্দ- তা বিচার নির্বাচনের বাইরে। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি স্টেট হওয়ার কারণে এর আছে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক রিজিডিটি, আছে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ।আর ভাষা তো মানুষের সেই চিন্তা-চেতনা বোধ থেকেই আসে। মানে এখানে জীবনকে দেখার ক্ষেত্রটি সংকুচিত। তাই মনে হয় পশ্চিম বঙ্গের কবিতার ভাষা অধিক ইন্টেলেক্ট নির্ভর কখনো আবেগশূন্য রক্তশূন্য। বিষয় ও ভাষা যেন লিমিটেড। কিন্ত তাদের একটি পজিটিভ দিক হল তারা আসলে একটি দীর্ঘদিনের লালিত ও চর্চিত তৈরি ভাষার ধারাবাহাকিতায় বসবাস করছে। তার মানে ভাষাগত ও শৈলীগতভাবে তার অলরেডি প্রিভিলেজড। বিষয়টি বাঙলাদেশের ভাষিক সাহিত্যিক প্যারাডাইমে ধীরে ধীরে ঘটছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ- এসব তাৎপর্যময় ঘটনা থেকে শুরুর কবি সাহিত্যিকেরা কোনরকমের ভিশন না পেয়ে, তাৎক্ষণিকতার ক্রোধ বিক্ষোভ স্বপ্ন আশা বা আশা ভঙ্গের আবেগে ভেসে গেছে। তাই বাঙলাদেশের কবিতা শুরুতেই ধারণ করেছে মানুষের মুখের ভাষা-- যেখানে রক্ত মাংসের আয়োজনটা বেশি। তবে আশার কথা হল আশি দশকে এসে কবিতা তার নিজস্ব ঘরে ফিরতে শুরু করে এবং নব্বই দশক থেকে জীবন ও জীবনকে যা কিছু নিত্য ঘিরে আছে তার বিবিধ আয়নায় বিভিন্ন অ্যাংগেল থেকে দেখা আর বোঝার পালা শুরু হয়। কবিতা তার আরাধ্য মৌন অথচ গভীর সরল কিন্তু মাল্টিভার্স, মাল্টিলেয়ার্ড চরিত্রটি অজর্ন করতে পেরেছে।

আঙ্গুল দিয়া দেখানো এটি পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতা- এই বিষয়টির মধ্যে একটি ভয় কাজ করে। ভয়টা আসতে পারে কবিতার অস্তিত্ব জনিত সংকট থেকে। মানে কেউ যদি তার মধ্যে বিবিধ বোধের উন্মেষ বা কবিতাকে ‘কবিতা’ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তাহলে এটি তখন তার মনে ভয়ের বাসা তৈরি করে।তার মনে হীনম্মন্যতার জন্ম দেয় ।একজন কবিকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেখানে বাংলাদেশের আমজনতা মোবাইল ফোন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, প্লাষ্টিক কার্ড দিয়ে এটিএম থেকে টাকা তুলছে সেখানে শুধু পেছনে যাওয়ার পদ্যগিরির কোনো মানে হয় না। কবিতা তো খালি হাট বাজার দোকানপাট গরু বলদের বিবরণ না। এটি একটি যথার্থ শিল্প। তাকে আগে কবিতা হতে হবে। কবিতাকে কবিতা দিয়াই উত্তীর্ণ করতে হবে।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

আ: ব্লগ যেটি করছে সেটি হল মানুষের পঠনের বন্দীদশা তথা রিজিটিডি বা স্থান কাল পাত্র সম্মিলনের অসুবিধাটাকে দূর করে দিচ্ছে। একটু আগে ঢাকায় বা কলকাতায় বা পৃথিবীর অন্য কোন জায়গায় একটি কবিতা প্রকাশ হলে আমি সেকেন্ডই তা পড়তে পারছি। এটি ইন্টার অ্যাক্টিভ হওয়াতে আমি আমার মতামতও জানাতে পারছি। এখন লেখকেরা আরো স্বাধীন আরো সহজলভ্য। এটি একটি পাঠবিপ্লব।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

আ: লেখক নির্বাচন আর লেখার মানের জন্য লিটলম্যাগ অবশ্যই বেশি গুরত্বপূর্ণ। ভালো লেখকেরা হয়ত এখনও ব্লগ কালচারের সাথে পরিচিত না। তবে আমার মনে হয় অর্থনৈতিকভাবে লিটলম্যাগ ব্যায়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বলে ব্লগ ধীরে ধীরে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

আ: লেখা যে কোন জায়গায়ই প্রকাশিত হতে পারে। সবকিছু নির্ভর করে লেখার মানের উপর। সাথে সাথে সম্পাদকের পড়াশোনা রুচি লেখা নিবার্চনের ক্ষমতা ইত্যাদি পুরো আয়োজনকে প্রভাবিত করে। সম্পাদক যদি ‘অহং’তাড়িত না হোন, লেখার জন্য শুধু বন্ধু বান্ধব স্বজনআশ্রিত বা গ্রুপিং এর শিকার না হোন তাহলে দৈনিকও লেখালেখির একটা ভালো জায়গা হতে পারে।