সমাজতান্ত্রিক চেতনা বাংলা সাহিত্যকে যতটা সমৃদ্ধ করেছে ঐতিহাসিক কারণেই ওপারের সাহিত্যে তা হয়নি: ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায়ের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 31, 2012 7:01:50 AM

সম্পাদক ‘অন্যনিষাদ’ ও ‘গল্পগুচ্ছ’

দুপুর মিত্র: আপনি অন্যনিষাদ ও গল্পগুচ্ছ নামে দুইটি ই-পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। লিটলম্যাগ না করে ই-পত্রিকা কেন করছেন?

ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায়: হ্যাঁ, বাংলা কবিতার ই-পত্রিকা ‘অন্যনিষাদ’ ৯ই অক্টোবর ২০১১ এবং বাংলা ছোটগল্পের ই-পত্রিকা ‘গল্পগুচ্ছ’১৪ই নভেম্বর ২০১১ থেকে প্রকাশ করছি নিয়মিত – সাপ্তাহিক প্রকাশনা রূপে । পাঠক মহলে ‘অন্যনিষাদ’ বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে এর পাঠক রয়েছেন। না, মুদ্রিত লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প হিসাবে ‘অন্যনিষাদে’র আত্মপ্রকাশ হয়নি, হয়েছে কিছুটা পরিপূরক হিসাবে। কবি বন্ধু তরুণ বসুর সম্পাদনায় ‘অন্যনিষাদ’ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে আসছে বাংলার জেলা শহর হুগলীর ডানকুনি থেকে, বিগত ১৭ বছর ধরে। এটা সকলেরই জানা যে টিকে থাকতে গেলে একটা লিটল ম্যাগাজিনকে কি কঠিন লড়াই করতে হয়। নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে পত্রিকা ছাপাতে হয়, পাঠক পাওয়া যায় না । একশ টাকা ব্যয় করে মোবাইলে কলার টিঊন লাগাবেন কিন্তু ত্রিশ টাকা খরচ করে একটা সাহিত্য পত্রিকা ? না । ‘অন্যনিষাদ’এর মুদ্রিত সংস্করণ পুরোপুরি সাহিত্য পত্রিকা – ‘অন্যনিষাদ’ ই পত্রিকা শুধুই কবিতার পত্রিকা । আমার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা কবিতাকে আরো বেশি পাঠকের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া। নতুন করে কবিতার মুদ্রিত ছোট পত্রিকা করলে সেই লক্ষ্য কিছুতেই সাধিত হতনা। তবে আমি একথাও বিশ্বাস করি যে আন্তর্জাল পত্রিকা কখনোই মুদ্রিত পত্রিকার বিকল্প হতে পারেনা, কখনো হবে বলেও আমি মনে করিনা। কারণ ই-পত্রিকার পাঠক তারাই যারা প্রযুক্তির ব্যবহার জানেন, ই–পত্রিকায় তাদের একটা গল্প বা কবিতা পড়ার তৃপ্তি বা ভালো লাগা অনেকটাই তাৎক্ষণিক, তারা একটা ভাল গল্প বা কবিতা কদাচই বারবার পড়েন। পাঠকের ইচ্ছা হল – আলমারি থেকে পত্রিকা বের করে তার ভালো লাগা কবিতা আবৃত্তি করলেন – কিন্তু ই-পত্রিকার ক্ষেত্রে এমনটি হবার নয়। ‘অন্যনিষাদ’ ই-পত্রিকার কথাই ধরুন, প্রকাশ হবার পর প্রথম সপ্তাহে হয়তো ১২৫/১৩০ জন পড়লেন কিন্তু তারপর কবিতাগুলি অপঠিত থেকে গেলো। গল্পগুচ্ছের ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। পাঠক পুরানো সংখ্যাগুলি পড়েন মাঝে মধ্যে। ই- পত্রিকা করা সহজ, কোন খরচ নেই, সংগঠন দরকার হয়না, একক প্রয়াসে করা যায়। সুতরাং দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর আয়োজন করতেই ই-পত্রিকার প্রকাশ করছি। কাজটা একান্ত নিজের, সুতরাং মানসিক তথা সৃষ্টিশীলতার যে তৃপ্তি তাও একান্ত নিজের ।

দু: সাম্প্রতিক ধারার গল্প ও কবিতার সাথে আপনার বেশ ভাল যোগাযোগ আছে । এর মূল্যায়নটা কিভাবে করবেন বলবেন কি?

ফা: বয়স একাত্তর ছুঁয়েছে, সুতরাং বাংলা গল্প ও কবিতার দীর্ঘ পরিক্রমার সাথে কিছু পরিচয় আছে এবং সেই সূত্রে এর বিবর্তন ও দেখেছি, বুঝতে চেয়েছি নিজের মত করে । কবিতা, গল্পও বা সাহিত্যের সৃষ্টিশীল সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় সমকালীন সময় ও সামাজিক প্রেক্ষিতে । সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক ও লেখক উভয়ের ভাবনা বৃত্তের পরিবর্তন হয় – সৃষ্টিতে তার ছায়াপাত ঘটে । গত শতাব্দীর আশির দশকের আগের গল্প কবিতার সঙ্গে পরবর্তী সময়কালের গল্প কবিতার মধ্যে অনেক গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। আশি পরবর্তী সময়কালে বিশ্বায়ন নামক দানবের আগ্রাসনে আমাদের সমাজ দারুণ ভাবে প্রভাবিত হয়েছে পণ্যায়ন ও ভোগবাদে, তারই অনিবার্য ছায়াপাত গল্প কবিতায়। লক্ষ্য করা যায় এই সময়ের গল্প-কবিতায় শ্রমনির্ভর মানুষ প্রায় অনুপস্থিত । এই সময়ের গল্প উপন্যাসের ভাববীজ তাই মধ্যবিত্ত মানুষের আত্ম অন্বেষণ, আত্মযুদ্ধ, ব্যক্তিক প্রেম । আসলে এ এমন এক  সময় – যখন নবীন প্রজন্মের কাছে কোন আদর্শবাদের আকর্ষণ নেই, সমাজকে বদলে ফেলার ইতিবাচক প্রয়াসে প্রবল অনীহা । সুতরাং যা হবার তাই হয়ে চলেছে , আজকের গল্প কবিতায় ব্যাপক মানুষের অনুপস্থিতি তাদের জীবন যন্ত্রণা, তাদের হর্ষ-বিষাদ, আনন্দ- বেদনা, তাদের জিজ্ঞাসার ছায়াপাত তেমন ভাবে ঘটছেনা আজকের গল্প- কবিতায়, এটাই আমার উপলব্ধি বা মূল্যায়ন যাই বলুন ।

দু: পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সাহিত্যের পার্থক্যটা কিভাবে করবেন ? 

ফা: এভাবে সাহিত্যের ভেদরেখা টানা যায় বলে আমি মনে করিনা । দুদেশের মানুষইতো একই জাতিসত্তার অংশ । একটা গল্প বা কবিতা পড়ার সময় আমার কখনোই মনে হয়না এটা বাংলাদেশের কোন লেখকের লেখা কিংবা এপারের। গুণগত পার্থক্য করা যায়না, বিষয় গত পার্থক্য থাকতে পারে । সাহিত্যে সমাজ ও সময়ের প্রতিফলন ঘটে। এপারের সমকালীন বিষয় ভিত্তিক একটা গল্প-ধরা যাক নোনাডাঙ্গা বস্তির মানুষের নতুন করে বাস্তুহারা হওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে লেখা একটা গল্প আর চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড়ে সব হারানো মানুষের বেদনা নিয়ে একটা গল্প নিশ্চয়ই পৃথক, গল্পের প্রেক্ষাপট বিচারে । কিন্তু গল্পের সাহিত্যগুন বা পাঠকের ‘ইনভলভমেন্ট’ এর ক্ষেত্রে তো কোন পার্থক্য থাকেনা । একই সাহিত্য সম্পদের অংশীদারতো দুই বাংলাই । তবে একথা প্রসঙ্গত বলতে হয় যে, দুই বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য আছে । বাংলা ভাষা একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে – এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা । বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে বাংলাদেশের আবেগ এপারের চেয়ে অনেক বেশি বলেই আমার ধারণা । কিন্তু গুণগত মান এপারের সঙ্গে সমান ভাবে তুলনীয় নাও হতে পারে , কারণ মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স মাত্র চল্লিশ বছর । ১৯৪৭ পরবর্তী সময়কালে এপারের বাংলা সাহিত্য যেভাবে সমৃদ্ধ হবার সুযোগ পেয়েছে, ওপারের সাহিত্য তা পায়নি কারণ দেশ বিভাগের প্রথম দিন থেকেই তাকে লড়াই করতে হয়েছে ভাষাগত সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে – নিজ মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে। অর্থাৎ সাহিত্যের পুনর্গঠনের যে কাজ এপার করতে পেরেছে ওপারের পক্ষে তা সম্ভব ছিলনা । সৃষ্টির ক্ষেত্রে দুটি দশক তো বড় কম নয় ! আর একটা বিষয় উল্লেখ করবো । সমাজতান্ত্রিক চেতনা বাংলা সাহিত্যকে যতটা সমৃদ্ধ করেছে ঐতিহাসিক কারণেই ওপারের সাহিত্যে তা হয়নি । ১৯৫০ পরবর্তী সময়কালে এপার বাংলায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তরঙ্গ তীব্রতর হয়েছিল যার অনিবার্য প্রভাব পড়েছিল সাহিত্যে । ৪৭ থেকে একাত্তর পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ বা ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়নি। সুতরাং পার্থক্য যদি কিছু থাকে তা এই ঐতিহাসিক পৃষ্ঠভূমির কারণে ।

দু: ই-পত্রিকা সাহিত্যের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে ?

ফা: আমি বিশ্বাস করি, সাহিত্যের মুদ্রিত রূপের প্রভাব আন্তর্জাল সাহিত্যের চেয়ে অনেক বেশি । ইন্টারনেট কখনোই মুদ্রিত পুস্তকের স্থান নিতে পারবেনা । সাহিত্যের ওপর ই-পত্রিকার প্রভাব অবশ্যই ইতিবাচক, কারণ সৃষ্টির একটা প্রাচুর্যতো আছে । ই পত্রিকা প্রায় নিখরচায় চালানো যায়, তেমন কোন সংগঠন প্রয়োজন হয়না ফলে প্রচুর সৃষ্টি হয় । এটা সামগ্রিক ভাবে সাহিত্যের পক্ষে সুখবর নিশ্চয়ই । কিন্তু সৃষ্টির এই প্রাচুর্য  যদি মুদ্রিত রূপ না পায় তাহলে তা অর্থহীন হতে পার । অর্থাৎ ই-পত্রিকাগুলিতে রচিত গল্প-কবিতাগুলি যদি মুদ্রিত পুস্তকে রূপান্তরিত হয় তখনই এই সৃষ্টিগুলি অর্থবহ হবে, স্থায়িত্ব পাবে । আমার জানা অনেক কাব্য ও গল্প সংকলন প্রকাশিত ও পাঠক সমাদৃত হয়েছে যেগুলির প্রথম প্রকাশ ইন্টারনেট পত্রিকাতেই হয়েছিল । সুতরাং সাহিত্যের ওপর ই-পত্রিকাগুলির প্রভাব ইতিবাচকই বলবো । কিন্তু পত্রিকা সম্পাদকের সাহিত্যবোধ বা সাহিত্য সম্পর্কিত দৃষ্টিকোণও ইতিবাচক হওয়া দরকার । পত্রিকার বিষয় নির্বাচন যদি সাহিত্যগুনান্বিত না হয় সে পত্রিকা পাঠককে আকর্ষণ  করবে না । সুতরাং বলবো ই-পত্রিকার সংখ্যা নয়, সেগুলির মানই বিচার্য । সাহিত্যগুণান্বিত রচনায় সমৃদ্ধ ই-পত্রিকাগুলি বাংলাসাহিত্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলেই আমি মনে করি ।

দু: অনেকের মতে অনলাইনে প্রকাশের বেশি স্বাধীনতা সাহিত্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আপনি কি তাই মনে করেন?

ফা: একথা ঠিক যে অনলাইন প্রকাশে প্রকাশকের ও লেখকের অনেক স্বাধীনতা আছে । কিন্তু একমাত্র এটাই সাহিত্যের ক্ষতি করতে পারে এমনটা আমি মনে করিনা । মুদ্রিত ছোট পত্রিকার একটা ব্রত থাকে পত্রিকাটিকে রুচিসম্মত ও সাহিত্যগুনান্বিত করার। সেখানে পাঠকের সঙ্গে লেখকের ও পত্রিকা প্রকাশকের সরাসরি যোগাযোগ ঘটে, অনলাইন প্রকাশনার ক্ষেত্রে তা হয়না । একজন ব্যর্থ কবি বা গল্পকার অতি সহজেই একটা ই-পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেন বা ফেসবুকে একটা গ্রুপ তৈরি করতে পারেন এবং অপাঠ্য এমনকি কুরুচিপূর্ণ লেখাও প্রকাশ করতে পারেন তা করার স্বাধীনতা আছে । নিশ্চিত ভাবেই এমন স্বাধীনতা সাহিত্যের ক্ষতি করে । কিন্তু সেসব পত্রিকা টেকেনা, পাঠক সমাদর পায়না । এটাও মনে রাখতে হবে যে ই-পত্রিকাগুলি থেকে নবীন প্রজন্মের অনেক কবি, গল্পকার উঠে আসছেন । সুতরাং আমি মনে করিনা অনলাইন পত্রিকা সাহিত্যের কোন স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে, – সে ক্ষমতা নেই ।

দু: গল্পের পালাবদল কি আপনার চোখে পড়েছে ? সেটা কেমন? একই প্রশ্ন কবিতার ক্ষেত্রেও?

ফা: হ্যাঁ, গল্প ও কবিতা দুটি ক্ষেত্রেই লক্ষণীয় পালা বদল ঘটেছে – বিষয়বস্তু ও রচনা শৈলী দুটি ক্ষেত্রেই । আমাদের সমাজটাও তো আর আগের মত নেই । এই পালাবদল নতুন কোন ব্যাপার নয় । সমাজ ও সময় যে রকম তার সাহিত্যও তেমন । গল্পের ক্ষেত্রে দেখা যাবে বিষয়বস্তু বা গল্পের ‘ভাববীজ’ এখন মধ্যবিত্ত শহুরে জীবন কেন্দ্রিক, কৃষক, শ্রমিক বা গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ এখন আর গল্পের চরিত্র হয়ে উঠছেনা । তাদের জীবনের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, তাদের কান্না, তাদের জিজ্ঞাসা এখন আর গল্পের বিষয় বস্তু হচ্ছেনা, হচ্ছে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষের লালসা, আত্মগ্লানি, হতাশা, তাদের আত্ম-যন্ত্রণা । এই পালা বদল সাহিত্যকে মহৎ করেছে একথা আমি বলব না । মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষের জীবন-বৃত্তান্ত নিয়ে লেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে পাঠক , কারণ সে যদি নিজেকে সে গল্পের মধ্যে আইডেন্টিফাই না করতে পারে তাহলে সে গল্প সে পড়বে কেন ? মানবতা বিরোধী কোন সাম্প্রতিক ঘটনা কি এখনকার গল্প কবিতায় ছায়াপাত ঘটায় ? ঘটায় না। পণ্যসংস্কৃতি এখনকার বাংলা সাহিত্যকে গ্রাস করেছে, গল্পের পালাবদল এটাই । কবিতার ক্ষেত্রেও ছবিটা একই ।