দৈনিকে যারা লেখেন তারা নিজেদের মহাজন মহাজন ভাবেন: মমিন মানবের সাথে অনলাইন আলাপ
Post date: Jun 30, 2012 8:20:05 AM
দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?
মমিন মানব: কবিতা কেন লেখি? এর মতন একই উত্তরের আরও একটা প্রশ্ন আছে। ভাত কেন খাই?
অনেক দিন, প্রায় দুই মাস ভাত না খেয়ে দেখেছি; প্রতিদিনই ঘুমুতে যাবার সময় মনে হয়, কী যেনো করা হয়নি! কী যেনো করা হয়নি! কবিতার ক্ষেত্রেও তাই। যে মাসগুলোতে আমি লেখতে পারি না; সেই সব মাসগুলোতে মনে হতো আমি কী যেন করতে পারছি না। মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো, আমি কী বেঁচে আছি!
এমন লাগে যেনো আমি বেঁচে থাকার জন্যেই লেখি।
দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?
ম: অবশ্যই নিজের দর্শন পরিষ্কার থাকতে হবে। তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
রাষ্ট্রকে সে কীভাবে দেখে আর রাষ্ট্রের সাথে তার কী সম্পর্ক; দেশকে সে কীভাবে দেখে আর দেশের সাথে তার কী সম্পর্ক; সমাজকে সে কীভাবে দেখে আর সমাজের সাথে তার কী সম্পর্ক; মানুষকে সে কীভাবে দেখে আর মানুষের সাথে তার কী সম্পর্ক; প্রেমিকাকে সে কীভাবে দেখে আর প্রেমিকার সাথে তার কী সম্পর্ক; সবকিছু…
দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?
ম: অনেকের কবিতাই ভালো লাগে। কারো কোনো কোনো কবিতা খুবই ভালো লাগে।
কবিতায় কোনো একটা গল্প বলতে বলতে হঠাত করে আসল কথাটা প্রকাশ করে পুরু গল্পের মোচড়ই চেঞ্জ করে যে কবিতাগুলো লেখা হয় সেগুলো আমার খুব ভালো লাগে। আমার কাছে মনে হয় এগুলো গেরিলা কবিতা। অনেকেই লেখছেন। ধরুন আপনার ৪৪ কবিতায় একটা কবিতা আছে-
শহরে হেলিকপ্টার উড়ে আসলে
কতলোক উপরে তাকায়
যেন কত দিন ধরে তাদের ইচ্ছে উড়ে বেড়াবার
কতদিন ধরে ইচ্ছে তাদের মুক্ত হবার
আমাদের গ্রামেও একদিন হেলিকপ্টার উড়েছিল
তখন অবশ্য কেউ উড়ে বেড়াবার কথা ভাবেনি
ভেবেছিল কিছু খাবার পড়ুক
হেলিকপ্টারের জানালা থেকে।
কিংবা ধরুন চন্দন চৌধুরীর অনেকগুলো কবিতা আছে এই রকম গেরিলা টাইপের। লাল কাঁকড়ার নদী-তে একটা কবিতা হলো:
পুড়েছি খেরের আগুনে, তোমরা আমাকে বেশ নেড়েচেড়ে দিচ্ছ ভালোভাবে পুড়ে যেন আমার ভেতরটাও সিদ্ধ হয়।
এরকম বলতে বলতে শেষে গিয়ে একেবারে গেরিলা উম্মেচন।
আমি আমার গলার রগ ছিঁড়েও তাদের বোঝাতে পারিনি, আমি খাদ্য নই, আমি মানুষ।
এমনিই আমার ভালো লাগে মজনু শাহ, পিয়াস মজিদ, অলকা নন্দিতা থেকে শুরু করে রিসি দলাই, জিয়াবুল ইবন, শামস শামীমসহ আরো অনেকেরই কবিতা।
দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?
ম: বলতে গেলে কী, সবারই কিছু কবিতা আছে এই রকম যে শব্দের অলংকারে শব্দগুলো এতো ভারি হয়ে উঠে যে এগুলোর মূল জায়গাটা নিয়েই দ্বিধান্বিত হয়ে উঠতে হয়।
এরা কবিতাগুলো এমন করে তোলে যে, যারা কবিতা চর্চা করে তাদের মধ্যে অনেকেও কবিতার জায়গাটা ধরতে পারে না। শুধু কিছু শব্দের ঝনঝনানি শোনা যায়। অনেকে এই কাজটা থেকে অনেক দূরে থাকতে পছন্দ করেন, আর অনেকে এটাই অবলম্বন করে আছেন।
দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
ম: আমার মনে হয় নব্বই দশকে কবিরা নিজেদের উপর যেটা জোর করে চাপিয়ে ছিলেন শূন্য দশকে এসে সেটা মুক্ত করছেন।
দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?
ম: ওখানকার কবিতায় মাটি আছে, হয়তো মাটির মূর্তি আছে; কিন্তু মাটির গন্ধ নেই। মাটির কোমলতা নেই। এখানকার কবিতায় মাটির গন্ধ যেমোন আছে, মাটির নানান রঙও আছে। আর এই গন্ধ জানা নেই বলে, এই রূপ চেনা নেই বলে অনেকে ওই বাংলার কবিতাগুলোকে টেন্টম্যান্টের মতোন অতি গুরুত্বপূ্র্ণ বলে বিশ্বাস করেন।
সমস্যা তৈরি হয়েছে এই বাংলা থেকে। আমরা যেমোন নিজেদের ভাষাটা (যেটা এখন আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করি) ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনিয় কিংবা বর্ধমানিয় ভাষাটাকে প্রমিত ভাষা বা তথাকথিত শুদ্ধ ভাষা হিসেবে নিয়েছি, তেমনি ওখানকার লেখাগুলোকেও অনেকে পরম (absolute) মূল্য দিয়ে আসছে। সেখান থেকে দেখলে আমার নদীকে আমরা কবিতায় যেভাবে প্রকাশ করি, ওখানকার কবিদের নদীকে প্রকাশের ভাষাটা ভিন্ন হয়ে পড়ে। তাই অনেকের কাছেই এই ভাষাটা পড়া কঠিন হয়ে যায় আর কবিতা পড়ে নদীর ঢেউ পায় না, স্রোত পায় না, কোমলতা পায় না, ভাঙা গড়া পায় না।
আরেকটা মজার ব্যপার হলো ওবাংলার অনেক কবি তো জানেনই না, এই বাংলা কবিতার কেমন চর্চা হচ্ছে!
দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?
ম: হ্যাঁ, দিচ্ছে। অনেক দিচ্ছে। আগে আমরা অই শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকতাম, কোথায় কোথায় সাহিত্যসভা আছে। আমার কবিতা পড়ে শুনাবো। দেখি কে কী মন্তব্য করে। এই তো।
কিন্তু আজ এই সিঙ্গাপুরের থেকেও অন্যদের লেখা যেমন পড়তে পারছি, তেমনি নিজের লেখাও প্রকাশ করতে পারছি। মনে হয় প্রতিদিন এবং সারাদিনই আমি সাহিত্যসভায় আছি।
দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?
ম: লিটলম্যাগ আর ব্লগের কাজটা তো একই, সাহিত্যের চর্চা করা। ব্লগে কাজ করাটা আমি মনে করি সহজ এবং দ্রুততর। কিন্তু লিটলম্যাগের কাজটা তুলনামূলক কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ। তাই ব্লগে চর্চার ব্যাপারটা বেশি হয় এবং গোটা কয়েক জনের মধ্যে সীমবদ্ধ থাকে না।
একটা লিটলম্যাগ বের হবার পড়ে যে আনন্দটা আসে, চোখের সামনে নিয়ে বারবার দেখে বুকের ভেতর যে কাঁপনটা আসে, পৃষ্ঠাগুলো নাড়াচাড়া করে যে মুগ্ধতা আসে, নাকের কাছে নিয়ে যে গন্ধটা আসে তা শুধু লিটলম্যাগই দিতে পারে; ব্লগ যেটা পারে না।
আবার যেখানে আমরা কাগজে কলমে লেখা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছি, পকেটে থাকা মুঠো ফোন কিংবা অফিসের কম্পিউটারের বাটনগুলো আমাদের কবিতার নিকটতম বন্ধু বানিয়ে ফেলেছি, সেখানে ব্লগের গুরুত্ব তো দিন দিন বেড়েই যাবে এবং যাচ্ছেও।
দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
ম: দৈনিকে যারা লেখেন তারা যেমন নিজেদের মহাজন মহাজন ভাবেন। আর অই মহাজন ভাবনার কবিদের নিয়েই আবার দৈনিকের সাহিত্য পাতাগুলো চলে (দুই চারটা ব্যতিক্রম ছাড়া)। তারপরও দৈনিককে অচ্ছুত মনে করেন এরকম বেশির ভাগই আবার দৈনিক ছাড়া এক সময় লেখতে পারেন না।