কবিতা পায়, তাই লিখি: মিলন চ্যাটার্জির সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Oct 13, 2012 6:19:11 AM

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লেখেন ?

মিলন চ্যাটার্জি: বড্ড শক্ত প্রশ্ন । কবিতা কেন লিখি সেটা বোঝানো সত্যিই কষ্টকর। আসলে কবিতা আমার কাছে 'শারীরবৃত্তীয় জৈবনিক প্রক্রিয়া'র মত। কবিতা পায়, তাই লিখি।

যে কথাগুলো সরাসরি বলতে পারিনি কখনও সেই অনুভূতিই আমাকে দিয়ে লেখায় । চরম যন্ত্রণার সময় কলম হৃদয়কে প্রাধান্য দেয়, কি এক ঘোরে সে উঠে আসে হাতে ।

কবিতা লেখার পিছনে আমার অনেক কারণই আছে। হতাশা,যন্ত্রণা,অপ্রাপ্তি,বিষাদ আবার কখনও প্রতারনা নানা কারনেই লেখনী সক্রিয় হয়। সেই অর্থে ভাবিনি কখনও যে কেন লিখি ।

বেশীর ভাগ সময়েই কোনো একটা শব্দ বা বাক্য মাথায় ঘুণপোকার মত ঘুরঘুর করে , মাঝরাতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ কোনো শব্দ পিঁপড়ের মত কামড়ায়! হাতের কাছে খাতা,পেন থাকলে সেটা লিখে রাখি। বেশীর ভাগ সময়েই হারিয়ে যায়। সেই হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলোকে বড্ড মিস করি। আসলে কবিতা আমার কাছে উচ্চারিত চারণ।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

মিলন চ্যাটার্জি: কবিতা জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা নয় যে একে সাময়িক প্রস্তুতিতে ফেলা যায় । কবিতা একটা নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া । "যাবৎ বাঁচি , তাবৎ শিখি "।

তবে কবির কবিতার প্রাথমিক ব্যাকরণ জানা উচিৎ । ছন্দ ,মাত্রা , অলংকার ... এই বিষয়গুলোতে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন । তবে সেটা জানলেই যে কবিতা লেখা যায় তেমনও নয় । কবিকে হতে হয় শিল্পীর মত । দৈনন্দিন যাবতীয় কিছুকে কাছ থেকে দেখার চোখ, অনুভব করার ক্ষমতা থাকা দরকার ।

কিছু কঠিন শব্দ , তাত্ত্বিক শব্দ প্রয়োগ করলেই কবিতা হয়না । কবিতা তখনই সার্থক যখন তা পাঠককে একাত্ম করে । আবার অতিসরল কিছু বাক্য-বন্ধই কবিতা নয় । উদারন হিসেবে বলা যায় .......

"মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,

শুধু এই –

ঘৃনা নেই, নেই তঞ্চকতা,

জীবনজাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,

বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।" -- --এই লাইনগুলোতে ভাষা যথেষ্ট কঠিন তাও আমরা আমৃত্যু মনে রাখবো । কেন ? কারন - এটা আমাদের ভাবায়,আবেশ আনে, অনুভূতির গোড়ায় ধাক্কা দেয় ।

আবার, 'অ্যান্টেনায় কাক / আমি তো অবাক ' এই সোজা বক্তব্যটি কি আদৌ কবিতা ? না , কারন অ্যান্টেনায় কাক বসাই স্বাভাবিক এতে অবাক হবার কিসসু নেই ।

মোদ্দা কথা হল লেখনীকে থামতে দিতে নেই , লিখতে লিখতেই সরে । কবিতা লেখার জন্য ভালোমানুষ হওয়ার প্রয়োজন । অনুভব করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে । ঘরে বসে থেকে কবিতা লেখা প্রায় অসম্ভব , পরিধি বাড়াতে হবে,মিশতে হবে জনারণ্যে । একটা শব্দের জন্য করতে হতে পারে অন্তহীন পদচারণ । আমি নিজে নতুন কিছু শব্দের জন্য নানা মানুষের সাথে মিশেছি দিনের পর দিন । যারা বস্তা সেলাই করেন তাঁদের সাথে মিশে গেছি তবেই পেয়েছি 'আয়নাতালি','ফড়িয়া' এমন সব অনাভিধানিক শব্দরাশি ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

মিলন চ্যাটার্জি: কাদের কবিতাকে ভালো লাগে এটা বলা কষ্টকর । এমন বহু কবি আছেন যাঁদের লেখা প্রথমবার পড়েই মুগ্ধ হয়েছি ।

আমার পূর্বসূরিদের ভেতর -- পিনাকী ঠাকুর,বিনায়কদা, পুণ্যশ্লোকদা, মুরারি সিংহ , প্রভাত চৌধুরী , শ্যামল কান্তি দাশ, গৌতম চট্টোপাধ্যায় এঁদের লেখা ভালো লাগে ।

আর ভালো লাগে -- জুবিন ঘোষ, অয়ন দাসগুপ্ত, রঙ্গীত মিত্র, অনন্যা, রিপনদা, প্রবুদ্ধদা, মেঘদি, শৌণক এঁদের লেখা ।

আমার সমসাময়িকদের ভেতর -- রিকদা, সম্বিত বসু, কৌশিকদা, নির্মাল্য চ্যাটার্জি , নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃথা রায়চৌধুরী, পৃথা বারি, সুচেতা, মৌমিতা,পূজা ,পার্থপ্রতিম রায়, অত্রি, প্রসেনজিৎ, বাণীব্রত, ইন্দ্রনীল, সুমনা, সোমনাথ, প্রলয়দা , বাপী, প্রদীপদা, অলক্তা এরা দুর্দান্ত লিখছে । এদের লেখার ভেতর একটা অদ্ভুত স্মার্টনেস আছে , জানার পরিধিও বড় । যদি লেখা কিছুটাও বুঝে থাকি তবে এরাই পরবর্তী দশকে তুলে নেবে বাংলা সাহিত্যের শাসনভার ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন ?

মিলন চ্যাটার্জি: এইভাবে বলা মুশকিল । আমি লেখা খারাপ হচ্ছে এটা বলার কে ? কবিতা, কবির কাছে সন্তানের মতো । আমি যে নজরে খারাপ বলছি সেটাই সঠিক এটা বলার মতো ক্ষমতা আমার নেই । তবে একটা কথা বলতে পারি-- কবিতা মানেই কিছু কঠিন শব্দ প্রয়োগ নয় । কবিতা আসলে কবিতাই । কালের গর্ভে টিকবে কিনা সেটা পাঠকের ওপর নির্ভরশীল ।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি ?

মিলন চ্যাটার্জি: নব্বই দশকের কবিতা বাংলা কবিতায় এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিলো । এই দশকে একঝাঁক কবি বাংলা কবিতাকে তুলে এনেছিলেন এক উঁচু আসনে ।

শূন্য দশকে অনেকেই এসেছেন , হারিয়েও গেছেন । ব্যাক্তিগতভাবে মনে হয় নব্বই দশকে কবিতার এক আমূল দিক-পরিবর্তন হয়েছিলো ।যদিও শূন্য দশকেও বেশ কিছু শক্তিশালী কবি এসেছেন যাঁদের লেখা আমার অনুভূতিকে জোরালো ভাবে স্পর্শ করে ।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায় ?

মিলন চ্যাটার্জি: সেভাবে এখন ফারাক চোখেই পড়ে না । যদিও বাংলাদেশের কবিতায় সবুজের আভা লেগে আছে । সোজাভাবে বলা যায় জীবনানন্দের প্রভাব এখনও আছে যদিও সেটা সুখপাঠ্য ।

পশ্চিমবঙ্গে এক্সপেরিমেন্টাল লেখা অনেক বেশী হচ্ছে ।

যদিও এভাবে তফাৎ করা যায়না । বাংলাদেশের মোশতাক আল মেহেদী, সরদার ফারুক, জুয়েলদা , কচি রেজা দিদি , ওবায়েদ আকাশ ... এরা অসামান্য লিখছেন । সদ্যপ্রয়াত আপনদা দুর্দান্ত লিখে গেছেন ।

আসলে এখন পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের কবিতা বলে ভাগাভাগির কোনো অর্থ নেই । দুই ভাই দুই বাড়িতে থাকলেও নাড়ীর টান রয়েই যায় ।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে ?

মিলন চ্যাটার্জি: অবশ্যই দিচ্ছে । অনেক তরুণ প্রতিভাকে সামনে আনতে পেরেছে । অনেকেই ভালো লেখেন কিন্তু সঠিক জায়গায় যেতে পারেন না নানা কারনে । সেখানে ব্লগে লিখে ( যদি ভালো লেখা হয় ) চট করে অনেকের নজরে আসা যায় । তাঁদের ভালোবাসায় , সাহচর্যে লিখতে থাকেন । ব্লগের মাধ্যমে পরিচিতিও বাড়ে । সমমনস্ক বন্ধুরা একজোট হওয়ার ক্ষেত্রেও ব্লগের অবদান অনস্বীকার্য। যারা বাইরে থাকেন , সহজে বাংলা পত্র-পত্রিকা হাতে পান না তাঁদের জন্য ব্লগ এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে ।আপনার অলস দুপুর যেমন কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করছে । তেমনই ক্ষেপচুরিয়াস, যার সম্পর্কে আপনারাই বলবেন ।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয় ?

মিলন চ্যাটার্জি: না,আমার মনে হয় লিটলম্যাগের গুরুত্ব অনেক বেশী । কারন, মুদ্রিত আখরে নিজের লেখা দেখতে বা বন্ধুদের লেখা পড়ায় যে রোমাঞ্চ আছে সেটা ব্লগে পাওয়া যায়না । আমার যেমন ছাপার অক্ষরে লেখা দেখতে সাংঘাতিক উত্তেজনা হয় , নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকতে দারুন লাগে, মাথার পাশে বই নিয়ে না শুলে ঘুম আসেনা । পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলাদেশে এখনও বহু মানুষ আছেন যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না , তাঁদের কাছে ব্লগ একটা অলীক শব্দ । ব্লগের অবদান নিঃসন্দেহে আছে কিন্তু সেটা লিটলম্যাগের মতো নয় ।এখনও কোনো পত্রিকায় বা লিটলম্যাগে ছাপা না হলে কবি তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পান না ।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি ?

মিলন চ্যাটার্জি: আসলে আমার কাছে মাধ্যম বিচার্য নয় । আসল হল সাহিত্য । সেটা লিটল ম্যাগ বা দৈনিক পত্রিকা ( বাজারী সাহিত্য !) যেখানে খুশি হতে পারে। আমরা --গোঁসাইবাগান , দেখি নাই ফিরে থেকে শুরু করে সুধীর চক্রবর্তীর কিছু অসামান্য মুক্ত গদ্য এই দৈনিক বা সাম্প্রতিকি গুলোতে পেয়েছি । অধুনা আনন্দবাজারে মাসে একদিন করে সম্পাদকীয় কলামের ওপরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিছু মুক্তগদ্য লিখছেন। এগুলোকেও সাহিত্যবিচারে ওপরের দিকেই রাখতে হবে । তেমনই , লিটলম্যাগ গুলোতে কিছু অসামান্য লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে কিছু অসাধারণ সাহিত্য। কবিতা পাক্ষিক, কবি সম্মেলন, বৃষ্টিদিন, কৃত্তিবাস,ক্ষেপচুরিয়াস, আরশিনগর -- এরা বানিজ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে লেখা ছাপায় না । আবার একদিন বলে একটি সংবাদপত্র রবিবারে একটি সাময়িকী করছে যেখানে মনীন্দ্র গুপ্ত রামকিঙ্করের ওপর অসামান্য লিখছেন, যিনি আদতে লিটল ম্যাগাজিনের পরিধিতেই পরিচিত ।মোদ্দা কথা হল -- পাঠকের রেসপন্স । যে লেখে তার কোনও ছুৎমার্গ থাকা উচিৎ নয়। সাহিত্য আসলে সাহিত্যই ।