লিটলম্যাগ একদিন ‘বেঁচে’ নাও থাকতে পারে: কবি সঞ্জীব নিয়োগীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 26, 2012 8:48:09 AM

প্রকাশিত বই:

একটি সুইসাইড নোট বা পোস্টমটের্ম রিপোর্ট (নভেলেট ১৯৯৩)

মোষ একটি বর্ণান্ধ চতুষ্পদ প্রাণী (গল্প ১৯৯৭)

সুদূর প্রসারী লিপিস্টিক (কবিতা ২০১১)

গড়দূরত্বের স্বরলিপি (কবিতা ২০১২)

এছাড়া ২০০৪ থেকে পার্থসারথি উপাধ্যায়ের সাথে ‘বিনির্মাণ’ নামে অনিয়মিত একখানা কাগজ সম্পাদনা করেছেন।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

সঞ্জীব নিয়োগী: বোধের জে-জাতীয় spark কবিতা নামক মাধ্যমে কিছুটা হলেও প্রকাশ করা সম্ভব, সেটা সাহিত্যের অন্য মাধ্যমে পারা যায় না। আর আমি গান গাইতে বা ছবি আঁকতেও জানিনা। জীবন আমাকে যেসব ‘ইনপুট’ চেতনে বা অবচেতনে, আমার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দিচ্ছে, সে-সবের বহিঃপ্রকাশ আমার কবিতায়।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

স: সারাটা জীবন ধরে নিজেকে আপডেট করতে হয়। বই-পত্তর পড়া নিশ্চয়ই দরকার। বেশি কাজ দেয় ‘পৃথিবীর পাঠশালা’। নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হয় নতুনের জন্য, লাগাতার বদলাতে থাকা দুনিয়াকে বোঝবার জন্য।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

স: যারা যেকোনো ভাবে নতুন-কে বুঝতে চাচ্ছেন, তাদের সকলেই আমার প্রিয়।আলাদা ভাবে নাম নেওয়ার কোনো মানে নেই।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

স: কাউকে পুরোপুরি খারাপ লাগে না কখনো। আবার যাকে ভালো লাগে তাকে যে কখনো খারাপ লাগেনা, তাও নয়। যারা বহুপ্রচারিত কাগজে ছাপার লোভে কবিতার গলা টিপে মারে, ৫০/১০০ বছর আগের ছলা-কলার মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেনা, তাদের কবিতা কীভাবে ভালো লাগবে?’কবিতার মতো’ কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয় না। কবিতা নিছক ঘটনার পরিদর্শন নয়, মগজে প্রক্রিয়া ও পরিপাক হওয়া চাই।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

স: মেধার জগতে একটা উল্লেখ্য বাঁকবদল ছিল অবশ্যম্ভাবী। কেননা সমাজ-জীবনের মোটা-মিহি পরিবর্তনগুলো গত কয়েকটি দশকে বিশেষভাবে সুস্থিরতা লাভ করে ও সমাজ সেগুলির সাথে সুপরিচিত হয়ে খাপ খাইয়ে নিতে থাকে। নিতে নিতে স-ছন্দ গতি পায়। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার চরম বিকাশ, বহুজাতিক লগ্নী, গ্লোবালাইজেশন, লিভটুগেদার, সমকাম ... ধীরে ধীরে সমাজ-friendlty ওঠে। ব্যাপারগুলো বাইরে থেকে সামান্য বা নিরীহ মনে হলেও জীবনের, আল্টিমেটলি শিল্পের গভীরে ছাপ ফেলে।

সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার রূপটি আটের দশক থেকেই দ্রুত বদলে যেতে থাকে কবিতায়। নব্বইয়ের দশকে তা চোখে পড়ার মতো হয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত দিক দিয়ে পরীক্ষা আর নতুনের সমাগমে নয় পার করে শূন্য-এর গোলা সোনার ফসলে ভরে ওঠে।

এখন কবির যেন দু-জোড়া ডানা। এক জোড়া বাইরে অন্যটি অন্দরে। কবি কি এমন স্বাধীন আগে ছিল কোনো দিন? বিষয়ে? টেকনিকে?

নতুন কবিতা, উত্তর আধুনিক কবিতা, অপর কবিতা, পরিবিষয়ী কবিতা, মাধবীমূলক কবিতা – যাবতীয় ভাবনা ও মেধার জারণে পরিপুষ্ট অতি-সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা। গতানুগতিকতায় ভালোছেলের মতো ঘুরপাক খেলে বাংলা কবিতার পক্ষে নতুনের স্বাদ সৃষ্টি সম্ভব ছিলনা।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

স: এই দুই জায়গার ভূ-প্রকৃতিতে কিছু ভিন্নতা আছেই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বেসিক্যালি আলাদা। মানুষের চাওয়া-পাওয়ায় মিহি পার্থক্য আছে। পশ্চিমবঙ্গ ভারত নামক একটি দেশের রাজ্য মাত্র। এই দেশের বৈচিত্র্য সকলের জানা! এমনকি সামাজিক ব্যবস্থা, বন্ধন, আইন-কানুন! জবাবদিহি! আন্তর্জাতিক রিলেশনও একটু অন্যরকম। একজনের পরমাণু আছে।

এই সব ব্যাপার কবিদের মাথায় কাজ করে। তাই কবিতাও কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো ভাবে একটু আলাদা হতে বাধ্য।

বাংলাদেশের কবিতায় যে-ধরণের আবেগ, সত্য, সমাজ আর সাহস খুঁজে পাই তাতে আমার সামনে অসামান্য এক পৃথিবীর জানালা খুলে যায়।

আমার বাপ-ঠাকুরদার মূল বসত ছিল ঢাকা জেলায়।এমনিতেই দেশটার নাম মুখে আনলে শিহরণ,চোখ ভিজে যায়। সেখানকার কবিতার প্রতি আলাদা টান থাকবেই।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

স: নিশ্চয়-ই দিচ্ছে। নিজেদের মধ্যে সরাসরি ভাবনা-বিনিময় সহজ হয়েছে। সাহিত্য-পৃথিবী কাছাকাছি এসেছে। লেখক,পাঠক সকলেই একাধারে সমৃদ্ধ হচ্ছেন।

কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, লেখক ও পাঠকের একটা বড় অংশ, বিকশিত টেকনোলজির এই সুবিধা থেকে অনেক দূরে থেকে যাচ্ছেন। যে সংখ্যাটা উপেক্ষণীয় নয়।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

স: নিজের নিজের জাগায় দুটো মাধ্যমই গুরুত্বপূর্ণ। লিটলম্যাগের জমি ব্লগ এখনো দখল করতে পারেনি। কয়জন পাঠকের আওতায় নেট সার্ফ করার সুযোগ,বলুন? খুব বেশি নয় কিন্তু!

নেট এর সুবিধাভোগী শ্রেণি ক্রমশ বাড়ছে। আগামীতে ব্লগের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। লিটলম্যাগ একদিন ‘বেঁচে’ নাও থাকতে পারে। কিন্তু তবুও লিটলম্যাগ কোনোদিন ‘মরে’ যাবে না। কারণ লিটলম্যাগ একটা আদর্শ। আদর্শ মরে না।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

স: দৈনিক কাগজ তার পাঠক-রুচির দিকে নজর রাখে। সুতরাং সেখানে সাহিত্যকে একটা সীমা বা অলিখিত গাইডলাইন মেনে চলতে হয়। আবার কোনো কোনো দৈনিক নিজের মতো করে পাঠক-রুচি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। উঁচু মানের কাজ করে। বাংলায় এমন এক-আধটা কাগজ যে নেই তা নয়।