আরও অনেকে জীবনানন্দের উপন্যাসের জগতে নতুন করে প্রবেশ করুন: ঔপন্যাসিক স্বাতী গুহের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 11, 2012 9:08:27 AM

স্বাতী গুহের জন্ম ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতায়। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস সমুদ্র (২০১০), মৃত্তিকা (২০১১) ও বাবুলাল, পাখি এবং আমাদের কথা (২০১২), সাঝতারা স্বপ্ন কথা ।

দুপুর মিত্র: সাহিত্যের শুরুটা আপনার কি দিয়ে, গল্প না কবিতা?

স্বাতী গুহ: কবিতা

দু: আজ থেকে কত বছর আগে?

স্বা: অনেক বছর হল। তখন আমি ক্লাস সিক্স কিম্বা সেভেনে পড়ি।

দু: পরে আর কবিতা লিখেন নি, গল্পে চলে এসেছেন?

স্বা: ৩৪/৩৫ বছর হবে। কবিতা আমার আজও খুব কাছের বিষয়। কিন্তু ছাপতে দিতে ইচ্ছে করে না।

দু: তারমানে কবিতায় আপনি যা চান, তা পুরোটা করতে পারেন না, কিন্তু গল্পে পেরেছেন?

স্বা: না, তা নয়। আমার অনেক বন্ধুরাই কবিতা লিখেন। আমার চারপাশে অনেক কবিতা। তাই আমার মনে হয় আমি নাই আর পাঠক খুঁজে বেড়ালাম। আমার গল্প-উপন্যাস ও যে আমি ছাপতে দিব তা বহুদিন ভাবিনি। লিখে জমিয়ে রাখাই ছিল আমার স্বভাব। আমার খুব কাছের বন্ধুরাও জানত না আমি লিখি।

দু: খুবই লুকানো স্বভাবের ছিলেন মনে হচ্ছে। আপনার বন্ধুদের মধ্যে আপনি কাদের কবিতা বেশি পছন্দ করেন এবং কেন?

স্বা: অনেকের কবিতাই বেশ ভাল লাগে। তবে বন্ধুদের নাম কারোরই আলাদা করে বলাটা ঠিক হবে না। বাকিরা কষ্ট পেতে পারেন। এই সময়ের অনেকের লেখাই ভাল লাগে। আবার লাগে না তেমন অনেক লেখা। সেটা আমার স্বভাব দোষ বলাই ভাল।

দু: আপনি তাহলে গল্পের তুলনায় বেশি কমফোর্ট ফিল করেন। এর কারণটা কি?

স্বা: এক স্পষ্ট করে জানি না। এক একটা ভাবনা এক এক ভাবে আসে। ফর্মটা কি হবে তা জেনে আমি নিজেও টের পাইনা সব সময়। গল্পের মধ্যেও তাই কবিতার উদ্ভাস থাকে মাঝে মাঝে। কখনও কখনও গোটা একটা গল্পও নাকি আসলে একটা বড় কবিতা হয়ে ওঠে আমার লেখায়। এসব পাঠক আর বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা কথা। আমার যখন যা ভাল লাগে আর আসে তাই লিখি।

দু: আপনার লেখাগুলোতে আপনি সংলাপকে প্রধান করে লিখেন। এর বিশেষ কারণগুলো কি?

স্বা: গল্প, অনেকগুলিই আছে ন্যারেশনে। সংলাপ বরং কম। উপন্যাস লিখেছি চারটে। মূলত সংলাপে। কারণ আবারও বলতে হবে- আমার নিজস্ব সুবিধার ব্যাপার। আমার কাছে খুব সহজে আসে সংলাপ। চরিত্রটা খুক সহজে নিজের বলতে চায় যেন। কোনও বিশেষ একটা স্টাইল তৈরি করার কোনও ঝোঁক থেকে নয়। আমার মনের গঠন বা লেখার সহজতাই এর কারণ বোধহয়। তবে আর একটা ভিতরের কারণ হয়ত থাকতেও পারে। আমি সারাক্ষণ নিজে নিজে কথা বলি। মনে মনে বিড়বিড় করি। আমার ভাল লাগার কথা বলার মানুষ খুক কম হয়ত। তাই নিজে কথা বলি। আর যা শুনতে চাই- সেগুলো ভেবে নিই মনে মনে। হয়ত সংলাপ সেখান থেকে ওঠে আসে।

দু: আপনাকে যদি বলা হয় আপনার গল্প আর উপন্যাসের ভেতর থেকে কোন বইটিকে পাঠককে সবচেয়ে বেশি পড়তে বলবেন, তাহলে কি বলবেন?

স্বা: এমন কিছু আমি বলতেই পারব না। যেদিন যার যেটা ভাল লাগে পড়বেন। আমি কিছুই বলতে পারব না।

দু: আপনার সব মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত?

স্বা: আপাতত পাঁচ।

দু: সমুদ্র (২০১০), মৃত্তিকা (২০১১) ও বাবুলাল, পাখি এবং আমাদের কথা (২০১২) এই তিনটি উপন্যাসই তো সংলাপ নির্ভর?

স্বা: হ্যাঁ সাঝতারা স্বপ্ন কথাও সংলাপ নির্ভর। তবে এখানে একটি চরিত্রই কথা বলে। অন্য চরিত্রের কথা সেইভাবে নয়। কাজেই সংলাপ দীর্ঘ হয়। ন্যারেশনের মত হয়ে ওঠে। কিন্তু উত্তম পুরুষেই কথা চলে।

দু: কবিরা জীবনানন্দের ঘোরে পড়ে কবিতা লিখেন, কিন্তু আপনি তাঁর উপন্যাসের ঘোরে পড়ে উপন্যাস লিখেছেন। জীবনানন্দের উপন্যাস বিষয়টি নিয়ে আপনি কিছু বলতে চান?

স্বা: উপন্যাস, কবিতা, এমন আলাদা করে বলতে পারব না বোধহয়। আমার সমস্ত ঘোর জীবনানন্দকে ঘিরেই। তাঁর উপন্যাস তো ব্যক্তি মানুষের ভিতরের ছবিটিকে ধরতে চেয়েছে বারবার। তাই বোধহয় আমাকে খুব বেশি টানে। টানে তাঁর অজস্র পরত। ছবির মত যা উঠে আসে গদ্যে। কবিতার সঙ্গে তার ভেদরেখা আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে ওঠে।

দু: সেখানে জীবনানন্দকে আলাদা করে চেনার বাকি রয়ে গেছে, মানে উপন্যাসের জায়গাটা অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে বলে মনে করেন কি?

স্বা: অনাবিষ্কৃত বলব না। হয়ত একটু কম চর্চা করা হয়েছে একটা সময়। তবে এখন তো অনেকেই আগ্রহ দেখান।

দু: জীবনানন্দের উপন্যাস নিয়ে আপনি আলাদা করে কিছু বলতে চান?

স্বা: আলাদা করে কি বলতে চাইব, আরও অনেকে উনার উপন্যাসের জগতে নতুন প্রবেশ করুন। খুঁজে পান তার নিজস্ব চলনটিকে, পাঠক ক্রমশ আবিষ্ট হোন মনের গভীর অতলে থিতু থাকা ছবিটিকে ধরে। মানুষের একটা কথা কিভাবে অনেকের হয়ে ওঠে, বড় একটা সময়ের হয়ে ওঠে, তা আবিষ্কৃত হোক বারবার, এইই চাইতে পারি।

দু: বাংলাদেশের উপন্যাস চর্চার ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কি?

স্বা: বাংলা ভাষায়, একটা গোটা দেশ জুড়ে যে কাজ চলেছে, বহু বছরের ঐতিহ্য সঙ্গে নিয়ে, তার কোনও মূল্যায়ন করারই আমি উপযুক্ত হয়ে উঠি নি। আর কোনোদিনও হয়ে উঠব না। যা পাই হাতের কাছে পড়ে ফেলি। ভাল লাগে কখনও , আপ্লুত হই। কখনও হয়ত ততটা ঢুকতে পারি না. তার নানা কারণ। আমার নিজস্ব অপরাগতাই বেশি।

দু: কারও নাম উল্লেখ করবেন যাদের লেখা ভাল লেগেছে?

স্বা: কারও নাম উল্লেখ করা কি জরুরি? আমার তো তোমার চা বাগান পড়ে বেশ লেগেছিল। মাহবুব মোর্শেদের উপন্যাস ফেস বাই ফেস ভাল লেগেছে। আরও ভাল লেগেছিলে ওর গল্প সংগ্রহ।

দু: বাংলাদেশের উপন্যাস চর্চার কোন জায়গাকে আপনার বড় বেশি দুর্বলতা বলে মনে হয়?

স্বা: কঠিন প্রশ্ন করবে না কথা ছিল। আমার জন্য এটা কঠিনই তো হয়ে গেল।

দু: হা হা হা দিদি এটা কঠিন প্রশ্ন? আচ্ছা পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের উপন্যাস চর্চার মূল ফারাকটা কোন জায়গায় বা আদৌ ফারাকটা আছে কিনা?

স্বা: সত্যি বলছি, এইসব ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। সব দেশে সব সময়ে সাহিত্য মানুষের কথা বলে এসেছে। আর বলে চলবে, যতদিন মানুষের অস্তিত্ব থাকবে।

দু: ধন্যবাদ দিদি, আমাকে অনেক সময় দেবার জন্য।

স্বা: তুমি এত যত্ন করে এত সময় ধরে কথা বললে। ধন্যবাদ তো তোমারই পাওনা। ভাল থেকো। মনের মত করে লিখ। ঠিক পড়বে, কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও। এই স্বপ্নটা বেঁচে থাকুক। আর না পড়লেও লেখাই যাদের নিয়তি, তাদের লিখে যেতেই হবে।