নিজের জীবনের রেখার পাশে কলমের রেখা দেওয়ার জন্যই হয়ত লিখি: অঞ্জন আচার্যের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Apr 24, 2014 1:15:30 AM

আবছায়া আলো-অন্ধকারময় নীল, জলের উপর জলছাপ, রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া ধর্ম, নিধর্ম সংশয় , জীবনানন্দ দাশ-এর নির্বাচিত গল্প , পাবলো নেরুদার কবিতা সংগ্রহ

দুপুর মিত্র : আপনি কেন কবিতা লিখেন?

অঞ্জন আচার্য : কবিতা লিখি কেন? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়শই আমাকে হতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকি। উত্তর যে নেই তা কিন্তু নয়। আছে। উত্তরটি বরং রবীন্দ্রনাথের ওপর চাপিয়ে দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথের তাঁর পঞ্চভূত গ্রন্থের পরিচয় প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছিলেন- “জীবন এক দিকে পথ আঁকিয়া চলিতেছে, তুমি যদি ঠিক তার পাশে কলম হস্তে তাহার অনুরূপ আর একটা রেখা কাটিয়া যাও, তবে ক্রমে এমন অবস্থা আসিবার সম্ভাবনা, যখন বোঝা শক্ত হইয়া দাঁড়ায়- তোমার কলম তোমার জীবনের সমপাতে লাইন কাটিয়া যায়, না তোমার জীবন তোমার কলমের লাইন ধরিয়া চলে। দুটি রেখার মধ্যে কে আসল কে নকল ক্রমে স্থির করা কঠিন হয়। জীবনের গতি স্বভাবতই রহস্যময়, তাহার মধ্যে অনেক আত্মখ-ন, অনেক স্বতোবিরোধ, অনেক পূর্বাপরের অসামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু লেখনী স্বভাবতই একটা সুনির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিতে চাহে। সে সমস্ত বিরোধের মীমাংসা করিয়া, সমস্ত অসামঞ্জস্য সমান করিয়া, কেবল একটা মোটামুটি রেখা টানিতে পারে। সে একটা ঘটনা দেখিলে তাহার যুক্তিসংগত সিদ্ধান্তে উপস্থিত না হইয়া থাকিতে পারে না। কাজেই তাহার রেখাটা সহজেই তাহার নিজের গড়া সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে, এবং জীবনকেও তাহার সহিত মিলাইয়া আপনার অনুবর্তী করিতে চাহে।”

অর্থাৎ নিজের জীবনের রেখার পাশে কলমের রেখা দেওয়ার জন্যই হয়ত লিখি, বিশেষ করে কবিতা। সত্যিকার অর্থে আমার কিছু বলার আছে, যা সবার সাথে ভাগাভাগি করার। ভাবনাগুলো তাই লিপিবদ্ধ করি। বলা যায় ভাবনার বুদ্বুদগুলো মস্তিষ্ক থেকে প্রসব করি মাত্র। তার চেয়েও বড় কথা, কবিতা আমি লিখি না, কে যে আমাকে দিয়ে কবিতা লেখায়।

দুপুর মিত্র : কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

অঞ্জন আচার্য : পৃথিবীর কোনো কিছুই সাধনা ছাড়া হয় বলে আমার মনে হয় না। কবিতাও তার বাইরের কিছু নয়। প্রতিনিয়ত সাধনার ফলেই নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে গড়ছি আজো। প্রতিভা-ফতিভা বলে কিছু থাকলে, তা থাকতে পারে। আমার প্রতিভা নেই, আমি তার ওপর নির্ভর করেও বসে নেই। আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে লেখা আর আজকের লেখার মধ্যে এই যে আমি বিস্তর ফারাক দেখতে পাই- তা তো সাধনারই ফল। যদি সেসময়ের লেখাকে এখনও কালজয়ী ভেবে বসে থাকতাম, তাহলে কুয়োর ব্যঙ হয়ে বেঁচে থাকতে হতো। তবে সত্যি কথা বলতে কি, একেকজনের প্রস্তুতিপর্ব একেক রকম। প্রচুর পড়তে হয়, দেখতে হয়, শুনতে হয়- আর তাই শব্দ আকারে বলতে হয়। পড়ার বিকল্প আসলে পড়াই, অন্য কিছু নয়।

দুপুর মিত্র : সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার ভালো লাগে এবং কেন?

অঞ্জন আচার্য : ভালো লাগা না-লাগা তো আপেক্ষিক ব্যাপার। আমি যেহেতু সমকালে বাস করি, অতীত কিংবা ভবিষ্যতে নয়; সেহেতু সমসাময়িকদের লেখা আমার পড়তেই হয়। অনেকেই ভালো লাগে। তবে সবার সব কবিতাই আমার ভালো লাগে, এমনটা নয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দেরও না। এ মুহূর্তে কয়েকজনের কথা মনে আসছে। সমকালের মধ্যে আপন মাহমুদের কবিতা আমার বিশেষ ভালো লেগেছে। তাঁর “সকালের দাঁড়িকমা” বইটি পড়তে অনেকেই উৎসাহিত করি আমি। এছাড়া কুমার চক্রবর্তী, ওবায়েদ আকাশ, মজনু শাহ, বদরে মুনীর, অতনু তিয়াস, মাসুদ পথিক, ফিরোজ এহতেশাম, মুজিব ইরম, জুয়েল মুস্তাফিজ, রহমান মাসুদ, নির্লিপ্ত নয়ন এমন অনেকের অনেক কবিতা আমার ভালো লেগেছে। তাছাড়া শূন্য দশকের পরের দশকের অনেকে ভালো লিখছে। হাবিবুল্লাহ রাসেল, সানাউল্লাহ সাগর, চাণক্য বাড়ৈ, অরবিন্দ চক্রবর্তী, অচিন্ত্য চয়ন ওরা ভালো লিখছে।

সত্যিকার অর্থে ভালো লাগার কোনো পূর্বশর্ত নেই। আমি যে সমাজে বাস করি তাদের কবিতার ভেতর সেই সমাজ বাস্তবতার রূপ পাই। কবিতার কল্পরূপই আসল। অকাল প্রয়াত আপন মাহমুদের ভেতর তা আমি বিশেষভাবে পেয়েছি। কবিতার চিত্রকল্পই, কবিতার প্রাণ, দেহ তো বাক্য দিয়ে গড়া।

দুপুর মিত্র : সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

অঞ্জন আচার্য : এই যে বললাম, ভালো লাগা না-লাগাটা একান্তই আপেক্ষিক বিষয়। সবার সব কবিতা আমার ভালো লাগে না। এমনকি একটি ভালো-লাগা কবিতার সব পঙ্ক্তি আমার কাছে সমানভাবে ভালা লাগে না। সবটুকুই নিয়ে ভালো লাগা-মন্দ লাগায় আমাদের পৌঁছাতে হয়। তবে কেউ কেউ কবিতা না বুঝেই উপর থেকে নিচে লাইন ধরে লিখে যায়। এগুলোকে আবর্জনা ছাড়া কিছু মনে হয় না। এমনকি কেউ কেউ আছেন যারা ইতোমধ্যেই কবি খ্যাতি পেয়ে বসে আছেন, অথচ কবিতার কিছুই তার মধ্যে আমি অন্তত পাই না। এটা আমার মেধাগত ব্যর্থতাও হতে পারে। তাছাড়া অনেকে আবার দুর্বোধ্যতার আশ্রয় নেয় আপন প্রাণ বাঁচার আশায়। ভাবে, যত বেশি দুর্বোধ্য হবে ততই কবি আসরে ঠাঁই মিলবে। এটা এক ধরনের কবিতার নামে হঠকারিতা।

দুপুর মিত্র : নব্বই ও শূন্য- এই দুই দশককে আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এ দুই দশক সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

অঞ্জন আচার্য : আমার জন্মটা আশির প্রান্তে। শৈশব কেটেছে আশিতে। কৈশোর থেকে তারুণ্যে বেড়ে ওঠা নব্বইয়ে। আর লেখালেখির শুরু শূন্য থেকে। রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে পুরো নব্বই দশকটাই গেছে বড়ো ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে। স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে রাজপথ থেকে মফস্বল শহর তখন উত্তাল অবস্থা। ময়মনসিংহে আমরা মিছিল করেছি- স্বৈরাচার নিপাত যাক। পুলিশ আমাদের তাক করে গুলি ছোড়ে। একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে যাই আমি। আমার ঠিক পাশের একটি বন্ধ ভিডিও ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে গুলিটি লাগে। এর›পর ঢাকাসহ সারাদেশে শুরু হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন। এসময় অধিকাংশ কবিতাই লেখা হয়েছে স্লোগানধর্মী- “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”। হেলাল হাফিজই কেবল এমনটা লিখেছেন তা কিন্তু নয়; রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, দাউদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, আবু হাসান শাহরিয়ার, মোহন রায়হান তারাও এমন স্লোগান নির্ভর কবিতা লিখেছেন। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহাও বাদ যাননি।

শূন্য দশকের ক্ষেত্রে এমন উত্তাল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। তারা বরং অন্য পরিস্থির মুখোমুখি হয়েছে। তারা ক্ষয়িঞ্চু রাজনীতি দেখেছে, রাজনীতির নামে স্বেচ্ছাচারিতা দেখেছে, রাষ্ট্রের রক্ষক হয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভক্ষক হতেও দেখেছে। দখলদারিত্ব, দুর্নীতি ও সর্বোপরি মানবিক স্খলন দেখেছে। তাই শূন্যের কবিদের মধ্যে এক ধরনের বেদনাহত নীরব চিৎকার শোনা গেছে প্রতিনিয়ত।

দুপুর মিত্র : পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

অঞ্জন আচার্য : ভাষাগত পার্থক্য তো দু’দেশের মধ্যে আছেই, তবে ভাবগত পার্থক্যটাও কম নয়। তা নিতান্ত স্বাভাবিক। পশ্চিমবঙ্গের একজন কবি হয়ত লিখতে চাইলে লিখতেই পারেন- “ট্রামের জানালার পাশে চলন্ত রাস্তা”। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো কবি তা লিখবে কী করে? এদেশে তো ট্রাম লাইন নেই, যার পথ ধরে গড়িয়ে যাবে ট্রামগাড়ি (জীবনানন্দ দাশ বাংলাদেশে থাকলে, আর যাই হোক, অন্তত ট্রামের ধাক্কায় মরতে হতো না)। মেট্রো রেলও তো নেই। তাছাড়া স্থান-কাল-পাত্রের পরিবর্তনের সাথে সাথে কবিতার অবয়ব পরিবর্তন হবেই- এটাই স্বাভাবিক। তবে পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় কাঠিন্য ভাবটা কম, যা আমাদের এখানে প্রায়শই দেখা যায়। তাছাড়া ওদের কারো কারো কবিতায় কোনো না কোনোভাবে গল্প থাকে, আমাদের এখানে থাকে গল্প-সংলাপ, অথবা বিমূর্ত গল্প।

দুপুর মিত্র : ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

অঞ্জন আচার্য : ব্লগের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে, তা অস্বীকার করার নয়। এটা বিশ্বব্যাপী প্রসারিত। কাগুজে পত্রিকার মতো সীমাবদ্ধ নয়। লেখাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারে ব্লগ। তবে ব্লগ লেখা কিন্তু সাহিত্য চর্চা নয়। সাহিত্যের ভেতর যে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও পরিস্থিতি দরকার তা অন্তর্জালিক জগতে আমি কম খুঁজে পাই।

দুপুর মিত্র : লিটলম্যাগের চেয়ে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন, না হলে কেন নয়?

অঞ্জন আচার্য : না, আমার তা মোটেই মনে হয় না। লিটলম্যাগের চেয়ে ব্লগ আমার কাছে অধিক গুরুত্ব বহন করে না। লিটলম্যাগের আগে ‘লিটল’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে, তবে সত্যিকার লিটলম্যাগ ‘লিটলবয়’ রূপও পেতে পারে কখনো-সখনো। তখন তার প্রলয়ঙ্করী শক্তি দেখে বিস্মিত হতে হয় বৈকি। কিন্তু ব্লগে তেমনটা বিস্মিত কেউ সহজে হতে চায় না। অন্তত এদেশে না। এদেশের এমন অনেক বড় লেখক আছেন যারা এখনও কাগজ-কলম দিয়ে হাতে লিখেন, কম্পিউটারে নয়। এমনকি তাঁরা কম্পিউটার ব্যবহারও করতে জানেন না। এটা দোষের কিছু নয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বা খাপ খাওয়াতে একটু সময় লাগে। এক্ষেত্রে ভালো লাগারও একটা বিষয় আছে।

দুপুর মিত্র : দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

অঞ্জন আচার্য : আমাদের দেশে যেসব দৈনিক সাহিত্যপাতা বের করছে, সেইসব পত্রিকার মালিকেরা সাহিত্য পড়েন না বা পড়ার আগ্রহ বোধ করেন না। সম্পাদকদের মধ্যে দুই তিনজন ছাড়া বাকিরা সাহিত্য পাতাটিকে অবহেলার চোখে দেখেন। তারা পাতা বের করার অর্থে বের করেন মাত্র। তাছাড়া অনেক সাহিত্য সম্পাদকের ভালো পঠন-পাঠনেরও অভাব আছে। আর পত্রিকার পাতায় শব্দের সীমাবদ্ধতা তো আছেই। হাত-পা বেঁধে সাঁতার যেমন কাটা যায় না, তেমনি শব্দের সীমারেখা টেনে, আর যাই হোক সাহিত্য হয় না। শব্দগুনে গুনে যিনি সাহিত্য রচনা করেন, তিনি লেখক হতে পারেন- সাহিত্যিক নয়। তিনি যদি বৃথা সাহিত্যচর্চা রেখে অঙ্কের মাস্টার হন, তাহলে অন্তত নিজের তো বটেই, সাহিত্যের মান বাঁচে।