এক একটি দশকের ছাতার ডান্ডা ধরে রাখেন এক একজন গডফাদার: গোলাম রাব্বানীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Sep 22, 2012 8:32:37 AM

প্রকাশিত বই: হুদাই

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

গোলাম রাব্বানী: আমি কি জানি? সব তো সাঁই জানেন। আর আমি যা জানি, তা হগলেই জানে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কি জানে? মানুষের সকল সৃষ্টিই তার বেঁচে থাকার জন্য। দম বন্ধ হওয়া ওয়েদারে কিছুটা দম নেবার খোরাক জোগায় কবিতা। যদিও এমন শোনা না যায় কবিতা সমাজ বদল করে, কবিতা মানুষের বোধ জাগ্রত করে এ ধারণাগুলোকে আমি একটি প্রোডাক্টের মোড়ক মনে করি। মোড়কের ভেতর যে সাব-টেক্সট থাকে, তা হল নিজেকে জাহির করা। সময়ের হাজিরা খাতায় নিজের স্বাক্ষর করা। এখানেও লাল কালির বিষয় আছে। লেট অ্যাবসেন্টের ব্যাপারগুলোও থাকে। ইহা একটি চিরন্তন সত্য। আমার মনে হয় ওমর খৈয়ামকে যদি এই প্রশ্ন করা হয় তিনি হয়তো বলবেন, পানপাত্রের আনন্দ নেবার জন্য। আর আমি কবিতা লিখি আমার ভেতরকার হগল আর্বজনা উগরে দেবার জন্য। অতিরিক্ত মদ্যপান করে বমি করার পর যে প্রশান্তি লাগে, কবিতা লিখে সে প্রশান্তি পাই। এখন কথা হচ্ছে আমার উগড়ে দেওয়া আর্বজনা থেকে কেউ কেউ বায়ু গ্যাস তৈরি করতে পারে, একদল হয়তো উন্নত জৈব সার তৈরির কাজে লেগে পড়বে। আর ল্যান্ড ব্যাবসায়ীরা নদী ভরাটের কাজে লাগাতে পারে। এ দায় আমার না, এটা তাদের। কবিতা লেখার চেয়ে এবং প্রচুর বই পড়ার চেয়েও জরুরি প্রচুর মানুষ পড়া। মানুষকে অনুবাদ করার জন্যই কবিতা লিখি।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

গোলাম রাব্বানী: সর্ব প্রথম তার সতিচ্ছেদ করা ফরজ। এই সতিচ্ছেদ হচ্ছে তার মনের ভেতরের স্বচ্ছ পর্দাটা ছিড়ে ফেলা দরকার। এই পর্দা ছিঁড়ে তাকে মানুষ হতে হবে। না পুরুষ না নারী না হিজড়া। আজন্ম প্রেমিক। এ কর্ম করে সে যদি কবির স্বীকৃতি নাও পায়, তার কবিতা জনপদের কোনও পাঠক না পড়লেও আফসোসের কিছু নেই। মনে নিজের প্রশান্তি থাকবে। জীবনের সকল স্বাদগ্রহণ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কাচাসুপারি দিয়ে মিষ্টি পান খেয়ে আরামছে বাড়ি ফেরা যাবে। জীবনটাকে দেখতে হবে, তাকালে হবে না বন্ধু। ঘরে বসে কল্পিত মিথ্যা কবিতা রচনা করা যায়। আন্দাজ করি সে কবিতায় জীবন বরাবরই উধাও। আর ভাইরে সকল শিল্পকলাই শুরু করতে হয় কবিতা থেকে। সুতরাং কবিতা সহজ বিষয় না। এটা সাধনার বিষয়। কাম ঘাম আর প্রেমের বিষয়। সাধনার তরিকা জনে জনে আলাদা হতেই পারে।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

গোলাম রাব্বানী: যে কবিতা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে আক্রান্ত নয় এবং যাহার শরীরে মেদ কম ও র‌্যাম্প মডেলের কোমড়ের লাগান ধারালো, সে কবিতাই আমার ভালো লাগে। যারা কঠিন কথা ও ভাব সহজ ভাবে প্রকাশ করেন সে কবিরাই আমার প্রিয়। দেখুন আমাদের এখানে দু' ধরনের চর্চা চলে। একদল আছে সহজ কথা কঠিন করে বলতে পছন্দ করে আর একদল আছে কঠিন কথা সহজ ভাষায় প্রকাশ করে। দ্বিতীয় দলই আমার পছন্দ। আপন মাহমুদের কবিতা পড়ে আরামপাই। সাপের শরীরের মত ঠান্ডা তার কবিতা। কেমন আরাম আরাম ভাব আছে। আর রুদ্র আরিফের কবিতা। পারফিউম সিনেমার নায়কের মত রুদ্র অদ্ভুত এক কবিতার পারফিউম আবিষ্কার করে চলছে গোপনে। দেবদূতের মত একদিন সে পারফিউম ছুঁড়ে দিবে আমাদের মুখের ওপর। যদিও আমি জানি তার দশকের অনেকেই তাকে কবি মনে করে না। আর এটা অকবিরাই মনে করে। কারণ আমি বিশ্বাস করি অকবিরা রাজনীতি করে আর প্রকৃত কবিরা অকালে মরে। সোমেশ্বর অলির খরগোশের শরীরের মত আরামদায়ক কবিতাগুলো না পড়লে কেমনে হবে সাধনা?

আমার আল মাহমুদ, ওমর আলির কবিতা ভালো লাগে। টোকন ঠাকুর, কামরুজ্জামান কামু, মারজুক রাসেলের কবিতা অনেক জোস লাগে। জীবনের ফূর্তি আছে। তাদেরকে মনে হয় এক একটা ফূর্তিবাজ ট্রাক। হিজল জোবায়ের এক ধরনের নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন কবিতায়। তার কবিতা পড়লেই নতুন কিছু ঘ্রাণ পাই। ভালে লাগে সে ঘ্রাণ। আর একটি কথা বলা জরুরি প্রায় কবির কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আবার এমনও অনেকে আছেন যারা হয়তো আরও ভালো কবিতা লিখেন। কিন্তু সে কবিতা পড়ার সুযোগ হয়নি। মাফ চেয়ে নিচ্ছি তাদের কাছে।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

গোলাম রাব্বানী: যারা জীবনটাকে যাপন না করে ছন্দ শিখে ব্যাকরণ মেনে কোন একটি ছকে হাজার বছরের নিয়মে কবিতা লিখছেন এবং নিরীক্ষার নাম করে সহজ কথা কঠিন করে বলেন কবিতায় এবং যা পড়িলে আমার কলিজায় দাগ কাটে না বা লাল পিঁপড়ার লাগান কামড় দেয় না, তাহাদের কবিতা খারাপ লাগে। আর এই সংখ্যার কবিতার হুড়াহুড়ি দেখি চারদিকে-আফসোস! তারা খারাপ লিখেন এটা আমি বলতে চাই না। তাদের কবিতা আমার ভালো লাগে না এটা আমার জ্ঞানের অভাব হয়তো।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

গোলাম রাব্বানী: দশক একটি ফাচুকি শব্দ ও কনসেপ্ট। সাম্প্রদায়িক শব্দও বলতে পারেন। প্রতিটা দশক এক একটি পর্দামাত্র। পর্দা খুলে ফেলার টাইম হইছে ভাইজানরা। পর্দা খুলুন একটু আলো বাতাস আসুক। নইলে তো এলার্জিজনিত রোগবালাই বাড়বে। সাধারণ পাঠক দশক হিসাব করে কবিতা পড়ে না কবিতার বই কিনে না। দশক মানে নোংরা রাজনীতির একটি বড় কালো ছাতার ডান্ডা। এই ছাতার ডান্ডা ধরে রাখেন এক একজন গডফাদার। ওই ছাতার তলে না গেলে সিদ্ধিলাভ হয় না। কি হাস্যকর! আর এর জন্য দায়ী আমাগো মুরুব্বি কবিরা- দশক প্রথা কোন কবিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে না। মহান সময় দশক মনে রাখেন না। মহান সময় আমার গুরুজি। জয়গুরু। এ বিষয়ে আর কিছু বলার নাই ভাই।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

গোলাম রাব্বানী: শুধু কাঁটা তার। পৃথিবীর কোন কবিই মৌলিক কোনও কিছু লিখতে পারেন না। শুধু প্রকাশ ভঙ্গি আলাদা হয় মাত্র। পশ্চিম দিকে আমরা টাক্কর দিতে পছন্দ করি বলে ওপারের কবিতা আমাদের কারো কারো কবিতায় প্রভাব ফেলেছে।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

গোলাম রাব্বানী: আগামী দিনের উন্মুক্ত সাহিত্যের একটি তীর্থ স্থান হবে ব্লগ। এখানে কোন দশকীয় রাজনীতি থাকবে না। নতুন নতুন টেলেন্ট কবি ডাউনলোড হবেন এখানে। ব্লগ আমাদের ভাষাও চেঞ্জ করছে। নতুন ভাষা তৈরি হচ্ছে। এগুলোকে আমি পজেটিভ সাইন হিসাবে দেখি। ব্লগ যেহেতু একটি বাজার এখান থেকে সব ধরনের সওদা করার সুযোগ থাকবে রসিকজনদের।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

গোলাম রাব্বানী: আমার মনে হয় লিটলম্যাগের দিন শেষ। এটা বাস্তবতা। কিন্তু লিটলম্যাগের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। আমি নিজেও দু'টি লিটল ম্যাগ প্রকাশ করতাম ২০০০-২০০২ এর দিকে। লিটল ম্যাগের প্রতি আমার প্রেম আছে। দেখুন ব্লগে আপনি দুনিয়ার যে কোন প্রান্ত থেকে লিখতে পারছেন। অন্যদের লেখাও পড়তে পারছেন। দিন দিন একটি বিশাল ভার্চুয়াল কমিউনিটি তৈরি হচ্ছে। বর্তমান সময়ে ব্লগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া। এটাকে যারা অস্বীকার করতে চান তারা এখনো বটতলার ছাপাখানার যুগেই আছেন। আমি দেখেছি অনেক কবিরাই ব্লগটাকে সচেতন ভাবেই ইগনোর করেন। এরকম কয়েকজনের সঙ্গে আমার বাতচিত হয়েছে। তাদর বক্তব্য হল, ব্লগে লেখা দিলে সেটা সস্তা হয়ে যায়- ব্লগে বা ফেইসবুকে কেন কবিতা দিবো? আমি শুধু হাসি। কারণ সাঁই বলেছেন কুতর্কে যেও না। কবি মজনু শাহ্, টোকন ঠাকুর, সুব্রত আগেস্টেন গোমেজ, কামরুজ্জান কামু, জুয়েল মাজহার, ব্রাত্য রাইসু, ফরহাদ মযহার, মাহবুব মোর্শেদ সহ বহু মুরুব্বি কবি ও লেখকরা ব্লগে লিখেন ফেইসবুকে লেখা দেন। তাতে কি তারা সস্তা হয়ে গেলেন?

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

গোলাম রাব্বানী: দেখুন আমি নিজে একজন সংবাদকর্মী। সংবাদপত্র সমাজসেবা করে, সমাজের দর্পন এগুলো হুদাই কথাবার্তা। সংবাদপত্র হচ্ছে একটি প্রোডাক্ট। এই প্রোডাক্টের সেল বাড়িয়ে মালিকপরে মুনাফা অর্জনে সহায়তা করাই হচ্ছে সংবাদপত্রকর্মীর মহান দায়িত্ব। দৈনিকে সাহিত্য সাময়িকীতে বহুবিদ লেখা থাকে। যা আমি কাছ থেকে দেখি বা আন্দাজ করি। এ সকল লেখার বাইরের যে রুপ আমরা দেখতে পাই তাও আবার সেই দশক প্রথা, দলবাজির বাইরে নতুন কোন চেহারা দেখতে পাই না। অথচ একমাত্র দৈনিকের সাহিত্য পাতা গুলোই পাড়তো দলবাজির গন্ডি থেকে বেরিয়ে নতুন রাইটার তৈরি করতে। যে কাজটি খুব কম পত্রিকাই করে থাকে। হাতে গোনা কয়েকটি নাম ঘুরে ফিরে সকল স্থানে ঠাঁই পায়। নেইম ফেইমটা বিক্রি করতে চায় সংবাদপত্র।