আমাদের কবিরা এক দশকেই প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েন: কবি শ্যামল দাষের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 29, 2012 8:21:37 AM

সম্পাদিত কাগজ : শতদ্রু । প্রথম প্রকাশ -১৯৯৭ ।

দুটি কবিতার বই । ১. ধর্মে ধরমে সত্যাগ্রহী ২. ধর্মে নেই জিরাফেও না ।

প্রকাশিতব্য গ্রন্থ : হ্যাঁ ঘূর্ণন না ঘূর্ণন, গণশার কবিতা

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

শ.দাষ : ধন্যবাদ মিত্র আপনাকে । শৈশব থেকে মানুষকে কোন না কোন একটা নেশায় পেয়ে বসে । যে নেশা তাকে তাড়িয় বেড়ায় । সে ক্ষান্ত দিতে চাইলেও নেশা তাকে মুক্তি দেয় না। আমার হচ্ছে সেই দশা। অন্যের ভালো না লাগলেও গোপনে গোপনে আমি তার সর্বনাশ করি কিংবা সে আমার। ভালো কবিতা লিখতে পারা একটা গৌরবের বিষয় । মনে মনে হলেও আমি তাকে নির্জনে উপভোগ করি। তা ছাড়া সব মানুষের চিন্তা ভাবনার সাথে নিজের ভাবনা চিন্তাকে মিলিয়ে দেখার অভিপ্রায় নিয়েই মূলত: আমি লিখি। লিখে লিখে এক সময় কিছু একটা আর্থিক সচ্ছলতা আসবে এমন একটা বোধও মাঝে মাঝে কাজ করে মনের ভেতর ।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

শ.দাষ : ওত পেতে বসে থাকা । আরও বিস্তৃত ভাবে বললে কবি যে সময় ও সমাজের লোক সেই সময় ও বাস্তবতাকে আবিষ্কারক আলভা এডিসনের দৃষ্টিতে দেখা ।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

শ.দাষ : সত্যি কথা বলতে কি সম সাময়িক সময়ে অনেকেই ভালো কবিতা লিখছেন । ভালো কবিতা লিখতে পারা একটা দক্ষতার কাজ। কিন্তু ঐটুকুই কবিতা সম্পর্কে শেষ কথা নয় । আপনি বর্তমান ও আগামী সময়ের মানুষকে কি এমন বিশেষ বোধ ও চিন্তার সাথে যুক্ত করতে চাচ্ছেন সেটিও কবি হিসাবে আপনাকেই ভেবে দেখতে হবে। সমসাময়িক সময়ে আমি কাউকেও ছোট করে দেখতে পারি না এবং তা উচিতও নয় কিন্তু এ কথা সত্যি যে প্রয়োজনীয় ভালো কবিতা তেমন হচ্ছে না। এই শেষ কথার সামান্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আপনি খেয়াল করে দেখবেন স্বাধীনতার শুরুর দশক থেকে বর্তমান সময় কাল পর্যন্ত যে অস্থির ও আতংকিত কাল আমরা যাপন করলাম জাতি হিসাবে কিংবা আরও বাড়িয়ে বললে বিশ্ব মানুষ হিসাবে তার তেমন কোন ছাপই পড়েনি। এই সময় খণ্ডে প্রবহমান কবিদের কাব্য চৈতন্যে । ভাবা যায় ! এই সময়ের একজন সচেতন মানুষ হিসাবে এই অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের যে প্রয়োজনীয় রসদ থাকা দরকার ছিলো তা দিতে প্রায় সকল কবি সমান ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন । ফলে কাউকেই তেমন আলাদা করে ভাবতে পারছি না। সকলেই প্রায় সমান ভাবে ভালো লিখছেন এমনটা বলা যায় মাত্র । যেমনটা নিত্যই লেখেন পেশাদার লেখক ।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন ?

শ.দাষ : নিজের কবিতাকেই বেশি খারাপ বলে মনে হয় । কেননা অন্যরা পড়ার পর আর কোন মন্তব্য করেন না । কবিতা লিখি শুনলে কেমন যেন তাচ্ছিল্যর দৃষ্টিতে দেখেন । সম্ভবত তারা কবিতার প্রভাব সম্পর্কে সন্দিহান ।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

শ.দাষ : প্রথম কথায় নব্বই থেকে শূন্যের অবস্থান খুব ভালো । এই দুই দশকেই কবির সংখ্যা ছিলো প্রচুর । নব্বইয়ের অবস্থান এখন প্রায় তলানির দিকে। এই দশকের কবিরা সবচে বেশি লিটল ম্যাগাজিন উন্মাদনায় ভুগেছেন মিডিয়ার বিরুদ্ধে গালি দিত দিতে এখন মিডিয়ায় স্থিত হয়েছেন এবং সব রকম দ্রোহের পরিচয় দিতে গিয়ে অব্যাহত ভাবে কবিতার টেকনিক ও ফর্মকে ঘন ঘন পাল্টে নিজের কবি জীবনের পরি সমাপ্তি ঘটিয়েছেন । সেই তুলনায় শূন্যের কবিরা নিজেদের অধিক বেশি সুস্থির রেখেছেন বলে মন হয় ।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

শ.দাষ : মোটা দাগে তেমন কোন ফারাক দেখি না । তবে কবিতার গতি প্রকৃতির দিক থেকে কছুটা এগিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের কবিতা । একজন জয় গোস্বামী যে ঝড়ো গতি এনে দিলেন বাংলা কবিতায় তেমনটা গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের কবিতায় বিরল । আমাদের কবিরা যেখানে এক দশকেই প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েন ; সেখানে পশ্চিমবঙ্গের কবিরা পাল্লা দেন সদ্য আসা তরুণ কবিদের সাথেও । এতে করে আমাদের দেশের কবিতা সামান্য পিছিয়ে পরেছে বৈকি । যা আমাদের দেশের কবি সমাজে কদাচিৎ কিঞ্চিত পরিমাণে ভাবা যায় ।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

শ.দাষ : আমার তেমন মনে না । যদিও সাহিত্য কোন বিশেষ মাধ্যমের বিষয় হতে পারে না । সাহিত্যিক তাঁর নিজের প্রকাশ বিকাশের প্রয়োজনেই এক বা একাধিক মাধ্যম বেছে নিতে পারেন । ব্লগ সে রকম একটি মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয় ।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

শ.দাষ : লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ মোটেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না । লিটলম্যাগের সাথে ক্রেতা পাঠকের এক রকম বস্তুগত সম্পর্ক তৈরি হয় । যাকে কেন্দ্র করে তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে বেড়ে ওঠে এবং ছড়িয়ে পড়ে । তাছাড়া ব্লগ বিষয়টা একান্তই যন্ত্র নির্ভর । অজপাড়া গায়ের পাঠকের সাথে তার তেমন সম্পর্ক নেই বললেই চলে । সেই তুলনায় লিটল ম্যাগ অধিক কার্যকর, দীর্ঘস্থায়ী ও জীবনীযুক্ত বলে মনে করি ।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

শ.দাষ : দৈনিকে আমি লিখি না । আহসান হাবিব এর মতো যোগ্য ও প্রাজ্ঞ সম্পাদক এখন আর কোন দৈনিকেই নেই । তবু দুই দশটা ভালো লেখা যে সাম্প্রতিক দৈনিকের সাহিত্য পাতায় পাওয়া যায় না এমন নয় । তবে বেশির ভাগ সাহিত্য সম্পাদক এটিকে চাকরির অংশ হিসাবে ভাবেন বলে এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোন সাহিত্যের প্রকাশ ঘটে না । বর্তমান দৈনিক পত্রিকার

সাহিত্য সম্পাদকেরা বয়সে কিংবা যোগ্যতার বিচারে খুব বেশি তরুণ বিধায় অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকের বাজে লেখাটিও ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ছাপতে বাধ্য হন । তাতে কান চুলকাবার পালক জুটলেও সুগন্ধি যুক্ত মাংসের আস্বাদ পাওয়া একান্তই দৈব ঘটনা । শুভেচ্ছা জানবেন । ভালো থাকবেন ।